সাফল্যের পথে কেউ কেউ এগিয়ে যান নিঃশব্দে, আত্মপ্রত্যয় আর কঠোর পরিশ্রমকে সঙ্গী করে। তেমনই এক অনুপ্রেরণাদায়ী গল্পের নায়ক আবু সাঈদ, যিনি সম্প্রতি ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী।
আবু সাঈদের এই যাত্রা ও নতুনদের জন্য তার পরামর্শ নিয়েই আজকের আয়োজন। লিখেছেন শাহ বিলিয়া জুলফিকার
শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল স্থির
বিচার বিভাগে কাজ করার স্বপ্ন তার অনেক দিনের। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন। পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের ধরন বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছেন। বিগত বছরের প্রশ্নপত্র অনুশীলন করে তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন কীভাবে প্রস্তুতি নিলে ভালো ফল করা সম্ভব।
সফলতার জন্য তিনি যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছেন, তা বেশ ব্যতিক্রমী। অনেকেই একসঙ্গে অনেক কিছু পড়তে চান, কিন্তু আবু সাঈদ ধীরে ও গভীরভাবে বিষয়গুলো অনুধাবন করতেন। আইনের প্রতিটি সেকশন বুঝে পড়ার চেষ্টা করতেন। একটি সেকশন পড়ে পুরো বিকেলও কাটিয়ে দিতেন তিনি, যাতে বিষয়টি তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। তা ছাড়া তিনি অযথা সময় নষ্ট করতেন না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় কাজে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তিনি পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। আইনের পাঠ্যবই ও রেফারেন্স বই পড়ার পাশাপাশি, বাস্তব আইনগত প্রসঙ্গ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে ভালো আইনজীবী বা বিচারক হওয়া সম্ভব নয়, বরং প্রয়োজন বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও বাস্তবসম্মত জ্ঞান।
প্রস্তুতি যেমন ছিল
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার তিনটি ধাপ প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা— প্রত্যেকটির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। আবু সাঈদ এই তিনটি ধাপে সফল হওয়ার জন্য সুস্পষ্ট কৌশল অনুসরণ করেছেন।
প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি
প্রিলিমিনারিতে ভালো করার জন্য লিগ্যাম প্রশ্নব্যাংক বই থেকে প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে পড়া তাকে উপকৃত করেছিল। এতে সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। প্রিলির জন্য তিনি সংক্ষিপ্ত নোট তৈরি করতেন, যাতে শেষ মুহূর্তে দ্রুত রিভিশন দেওয়া যায়।
লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি
লিখিত পরীক্ষার জন্য আবু সাঈদ প্রতিটি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত নোট তৈরি এবং নিয়মিত অনুশীলন করেছেন। আইনবিষয়ক বিভিন্ন রেফারেন্স বই থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে তিনি তার উত্তরকে সমৃদ্ধ করতেন। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হলে দ্রুত ও সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর লিখতে জানতে হয়। এ জন্য তিনি মডেল টেস্ট দিয়েছেন এবং বিগত বছরের প্রশ্নপত্রের সমাধান করেছেন।
ভাইভা প্রস্তুতি
ভাইভা পরীক্ষার জন্য তিনি সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা রেখেছিলেন। তা ছাড়া আইন বিষয়ে তার গভীর জ্ঞানই ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি। ভাইভার জন্য তিনি বাজারের প্রচলিত মাইন্ড গেম বই কিনেছিলেন এবং ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন রিয়েল ভাইভা পড়েছিলেন, যা ভাইভাতে তার সাহস বৃদ্ধি করেছিল।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
বিচারক হতে চাইলে কেবল বই মুখস্থ করলেই হবে না, প্রয়োজন ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্লেষণী দক্ষতা। প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় সফল হতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকর কৌশল অনুসরণ করা জরুরি। আবু সাঈদ অভিজ্ঞতা থেকে নতুনদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন—
পরিকল্পিত পড়াশোনা: একটি সুনির্দিষ্ট সময়সূচি তৈরি করে প্রতিটি বিষয়ের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে অধ্যয়ন করুন। এলোমেলোভাবে না পড়ে ধারাবাহিক ও কাঠামোবদ্ধ উপায়ে প্রস্তুতি নেওয়া উত্তম।
নিয়মিত অনুশীলন: বিগত বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ ও মডেল টেস্টের মাধ্যমে উত্তর লেখার দক্ষতা বাড়ান। এতে পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গড়ে উঠবে এবং সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়বে।
আত্মবিশ্বাস: নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রাখুন এবং ধারাবাহিক অধ্যবসায় বজায় রাখুন। পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে (প্রিলি, লিখিত, ভাইভা) ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসী মনোভাব আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
সেকশন বুঝে পড়া: আইন মুখস্থ করার বদলে প্রতিটি ধারা বা সেকশন গভীরভাবে অনুধাবন করুন। আইনের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার ওপর গুরুত্ব দিন। কারণ বিচারকের দায়িত্ব কেবল আইনের বই অনুসরণ করা নয়, বরং বাস্তব পরিস্থিতিতে তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
সময় ব্যবস্থাপনা: অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট না করে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্রাম এবং মানসিক প্রশান্তিও জরুরি, যাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি কার্যকর থাকে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর আবু সাঈদ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে চান। বিচার বিভাগে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে ন্যায়বিচারের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন, একজন বিচারকের প্রধান দায়িত্ব হলো সঠিক বিচার নিশ্চিত করা এবং বিচারপ্রার্থীদের প্রতি ন্যায্যতা বজায় রাখা।
তারেক