সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে (সুরেন্দ্র কুমার) সিনহা নির্বাসিত জীবনযাপন করলেও বাংলাদেশের সব খবর তার কাছে পৌঁছায়। তিনি নিজেও উন্মুখ থাকেন দেশের সব খবর পেতে। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ, পুলিশ ও ভূ-রাজনীতি তথা প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে গত সোমবার খবরের কাগজ তার সঙ্গে কথা বলেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিলেট ব্যুরো প্রধান উজ্জ্বল মেহেদী। [শেষ পর্ব]
খবরের কাগজ: রেভ্যুলুশনের পর বিচার বিভাগেও পরিবর্তন এসেছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
এস কে সিনহা: সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়েছি জুডিশিয়াল ক্যুর চেষ্টা হয়েছে। এটা বানোয়াট গল্প। কিছু ইলেট্রনিক মিডিয়াতেও দেখেছি। এগুলো খুব হালকা, ইয়েলো জার্নালিজম বলা যায়। জুডিশিয়াল ক্যু বলে যেসব কথা প্রচার করা হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প। দৃঢ়চিত্তে এ কথা বলছি। এটা (জুডিশিয়াল ক্যু) যে সম্পূর্ণ বানোয়াট বলছি, তার কারণ হলো- এই বিচারকরা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী।
বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ আরও অনেককে ডিঙিয়ে হয়েছে। এরা অনেক জুনিয়র। বর্তমানে যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমদ, খুবই জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে কোনো কিছু নেই। কিন্তু তাকে না নিয়ে তার জুনিয়রদের নেওয়া হয়েছিল।
খবরের কাগজ: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশ। জনগণের কাছাকাছি থাকা এ বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়াতে পোশাক-লোগো পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে। আপনি কী বলেন?
এস কে সিনহা: পুলিশ নিয়ে এসব কথা মিডিয়াতে শুনেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা বলেছেন। এগুলো হটকারী সিদ্ধান্ত। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর নাম, ড্রেস চেঞ্জ করা হলো। তখন বিডিআরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। খুবই ভালো ও সৎ অফিসার, তার মতো সৎ অফিসার খুবই কম দেখেছি আমি। তখন ড্রেসগুলা চেঞ্জ করায় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এসব বিষয়ে প্রচুর টাকা খরচ হয়। আমাদের এখনকার ইকোনমি নিয়ে ভাবতে হবে।
আমাদের অনেক ক্রাইসিস। বিডিআরের নাম চেঞ্জ, ড্রেস চেঞ্জ করে কোনো আমূল পরিবর্তন হয়েছে? এখনো স্মাগলিং হচ্ছে, এখনো বর্ডারে লোক মারা যাচ্ছে। ড্রেস চেঞ্জে কোনো কিছু চেঞ্জ হয়েছে? নো। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক করতে হবে। সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কী পোশাক পরলেন এটা না, পুলিশকে কী আইন দ্বারা পরিচালিত করলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশ যদি ভদ্রলোকের মতো জনগণের সেবক হয়ে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে, তাহলে পুলিশের ড্রেসে কিছু আসে-যায় না। পুলিশ চলে অ্যাক্টে। এটা একটা কলোনিয়াল ল। আমরা কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু কলোনিয়াল সিস্টেম উঠে যায়নি। পুলিশের আইন ও কলোনিয়াল থেকে মুক্তির চিন্তা করতে হবে। পুলিশের ড্রেস নয়, তাদের মানসিকতা চেঞ্জ করতে হবে।
খবরের কাগজ: রেভ্যুলুশনের আগে ও পরে ভারত নিয়ে অনেক কথা উঠছে। আপনি কী বলেন?
এস কে সিনহা: আমাদের এখানে (বাংলাদেশ) ভারত যথেষ্ট হস্তক্ষেপ করছে। আমাদের ইন্টারনাল ম্যাটারে এবং যত দিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে ভারতের চিন্তা-চেতনার বাইরে এক ইঞ্চিও তিনি সরেননি। বরঞ্চ যতগুলো এগ্রিমেন্ট করেছেন, যতগুলো কাজ করেছেন, সবই ভারতের স্বার্থে। এমনকি আদানি গ্রুপের স্বার্থেও শেখ হাসিনা কাজ করেছেন। এইটা তো আমি জানি, আমি তখন প্রধান বিচারপতি ছিলাম।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমার কাছে তো পরামর্শের জন্য লোক আসত। বলত, আদানির যেগুলো নরেন্দ্র মোদির লোক, যা চায়-তোমরা দিয়ে দিও। জাস্ট এই রকম। এই হলো ভারত। ভারত এবং বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ, এটা কিন্তু কেউ চেঞ্জ করতে পারবে না। একটা বৃহৎ রাষ্ট্র পাশে থাকলে, ছোট দেশগুলোর অনেক অসুবিধা হয়। আমরা ভারতকে অস্বীকার করে থাকতে পারব না। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা সারেন্ডার করব।
আমরা সহাবস্থান চাই। তবে আমরা তাদের (ভারত) লেজুড়বৃত্তি করব না। আমরা যখন অন্যায় হবে, তখন প্রতিবাদ করব। যেটা শেখ হাসিনার সরকার পারেনি। পারেনি এই কারণে, সে জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় এসেছে। এখন যে সরকার, বর্তমান সরকার, তাদের পেছনে আমি বলব ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন আছে। জনসমর্থন যদি থাকে, যত বড় দেশই হোক আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।
খবরের কাগজ: পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো নিয়েও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করেন কি?
এস কে সিনহা: সেভেন সিস্টার বা কোনো সিস্টারই কিছু না। এটা তো ঠিক, পাঞ্জাবে একজন কৃষক যে টাকা রোজগার করেন, এটা ত্রিপুরার একজন লোকের চার ভাগের এক ভাগও না। ব্যাঙ্গালুরু শহরে একজন চাকরিজীবীর যে ইনকাম, তার অর্ধেকও না আগরতলায় একজন চাকরিজীবীর। এটা তাদের (ভারত) বিষয়, তাদের মাথাব্যথা। তারা ঠিকমতো চললে ওখানে কোনো প্রবলেম থাকার কথা না।
খবরের কাগজ: প্রধান বিচারপতি থেকে আপনাকে সরানো এবং এই রেভ্যুলুশন, এ দুটোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এস কে সিনহা: আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত ঘটনার তৃতীয় ঘটনা। তবে প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে এ রকম ঘটনার পর কিন্তু সরকার উৎখাত হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ রকম হয়েছিল, সরকার উৎখাত হয়ে গেল।
পাকিস্তানেও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ রকমটি হয়েছিল, সে দেশের সরকারও উৎখাত হয়ে গেল। আমাকে সরানোর ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বার লাইব্রেরি কিছুটা প্রতিবাদ দেখিয়েছিল, আমি যখন গৃহবন্দি ছিলাম। দ্যাট ওয়াজ দি টার্নিং পয়েন্ট, তখন যদি বিরোধী দল-সুশীল সমাজসহ প্রত্যেকে যদি প্রতিবাদ করত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো শেখ হাসিনা কিন্তু গদিচ্যুত হতো।
দেশে এত অন্যায় ও খুনখারাবি হতো না। ২০১৭ সালেই শেখ হাসিনাকে পদচ্যুত করা যেত, যেটা পাকিস্তানে হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তারা এটা করেনি। এটা দুঃখজনক। এটা ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে তারা হয়তো বলেছে, তিনি তো শেখ হাসিনার লোক, যাউকগা!
খবরের কাগজ: এখন বাংলাদেশে ফেরার ক্ষেত্রে আপনার কোনো অন্তরায় আছে কি?
এস কে সিনহা: আমি প্রকৃতপক্ষে দেশে ফেরার জন্য মুখিয়ে আছি। আমি এখানে রিফুজি হিসেবে আছি। আমার তো রিফুজি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমি সুপ্রিম কোর্টের একজন নামকরা আইনজীবী ছিলাম, বিচারক ছিলাম। প্রধান বিচারপতিও হয়েছি। আমি কোনো দিনই এ জীবনে অভ্যস্ত না। আমি দেশে থাকব, দেশেই আসতে চাই। কিন্তু দেশে আসতে হলে অন্তরায় আছে।
প্রথমত হলো, আমার ও আমার স্ত্রীর পাসপোর্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমি ইমার্জেন্সি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছি। এটা পেতে হবে। দুই নম্বর বিষয় হচ্ছে, যদি সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি দেশে আসব।
> [প্রথম পর্ব] সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা: আমার ফেরাটা হবে আরেক রেভ্যুলুশন