কবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ফরহাদ মজহার। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। ইনসাফ কায়েম কমিটি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকার, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, আগামী নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের পতনের কারণ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি প্রকাশ হলো শনিবার (১৭ আগস্ট)। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খবরের কাগজের হেড অব ডিজিটাল গোলাম রাব্বানী
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ বলছেন আগস্ট বিপ্লব। আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ফরহাদ মজহার: মাসের হিশাবে‘জুলাই বিপ্লব’ বা ‘অগাস্ট বিপ্লব’ ইত্যাদি নানা নামে বলা হচ্ছে বটে, তবে এর রজনৈতিক চরিত্রটা বোঝা বিশেষ ভাবে জরুরী। এই বিপ্লব মর্মের দিক থেকে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তা এবং রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। ব্যক্তির অধিকার ও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এই অভ্যুত্থান। এটা কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না। দেখুন, কিভাবে ‘রাজাকার’ বলায় তরুণরা অপমানিত বোধ করেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা অভ্যুত্থানটা করে ফেলতে পেরেছে। এটা দেখে আমি অভিভূত। আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।
খবরের কাগজ: আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। যদিও এই অভিযোগ হোয়াইট হাউস খারিজ করে দিয়েছে। আপনার মত কী?
ফরহাদ মজহার: এগুলো হালকা ষড়যন্ত্রের ব্যাখ্যা। আমাদের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকলে অসুবিধা কী? ভারত যদি শেখ হাসিনাকে না নিত এবং ষড়যন্ত্র না করত তাহলে তো আর তাদের সঙ্গেও আমাদের ঝগড়া কোন ঝগড়া হোত না।
খবরের কাগজ: আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন দিল্লি যদি উসকানি দিয়ে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ লাগানোর মতলব করে তাহলে ভারত টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে কথা বলেছেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও ভারতকে ছাড় দিতে নারাজ। আপনার মূল্যায়ন কী?
ফরহাদ মজহার: রাষ্ট্র হিসেবে ভারত আর সে দেশের জনগণ- ‘ইটস টু ডিফারেন্ট ম্যাটার’। প্রচার ও লেখালিখির মাধ্যমে ভারতের জনগণকে বোঝাতে হবে যে, আমরা দিল্লির এখনকার পররাষ্ট্রনীতির বিরোধী। কিন্তু ভারতবিরোধী নই। এটা আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। আমার হাতে যদি সিদ্ধান্ত থাকত তাহলে আমি অবিলম্বে সাংস্কৃতিক একটা অনুষ্ঠান করতাম তথ্য আদান-প্রদানের ও পরস্পরকে বোঝার জন্য। তাদের আপত্তির জায়গা, কী কী তথ্য সঠিক, কী কী বেঠিক, তারা নিজেরা এসে দেখতেন। আমাদের যে অভিন্ন স্বার্থ, পশ্চিম বাংলার স্বার্থ, ত্রিপুরার স্বার্থ এসব নিয়ে কথা বলতাম। ত্রিপুরা এখন যদি কিছু এক্সপোর্ট করতে চায়, তাহলে তাকে বহু জায়গা ঘুরে যেতে হয়। ত্রিপুরাকে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিতে চাই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভারত সরকার আমাদের বন্দর ব্যবহার করবে আর আমাদের কিছুই দেবে না, বাংলাদেশকে তার কলোনি মনে করবে, ষড়যন্ত্র করবে বসে বসে, এটা তো হতে পারে না।
খবরের কাগজ: এই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আপনার রাজনৈতিক বিশ্লেষণটা জানতে চাই।
ফরহাদ মজহার: প্রথমত, এটা অসাধারণ ঘটনা। অভূতপূর্ব, সব অর্থেই। ভূ-রাজনীতি, বিশ্ব ইতিহাস, স্থানীয় রাজনীতি- সবদিক থেকেই এটা একেবারে নতুন ধরনের ঘটনা। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব হয়েছে। যেখানে ফিউডাল শ্রেণিকে পরাস্ত করে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছে। এখানে কিন্তু আরও বড় ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছিল। নিউ লিবারেল ইকোনমিক অর্ডারের মাধ্যমে একে গড়ে তোলা হয়েছে। সিকিউরিটির অজুহাতে একটা হিংস্র রাষ্ট্র আমরা দেখেছি, র্যাব তৈরি করা হয়েছে, নির্যাতনের বহুরকম পদ্ধতি বের করা হয়েছে। ফলে এই গণঅভ্যুত্থান তো হওয়ারই কথা।
খবরের কাগজ: ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে আপনি জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি নামে একটি সংগঠন শুরু করেছিলেন। আপনাদের দাবি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন একটি জাতীয় সরকার এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন। ইনসাফ আর বৈষম্যবিরোধী তো একই ধারার আন্দোলন। এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। আপনার মন্তব্য বলুন।
ফরহাদ মজহার: একটা পর্যায়ে আমার মনে হয়েছিল যে বিএনপিকে বোঝানো দরকার, জনগণ মৌলিক পরিবর্তনের জন্য তৈরি। বিএনপি বারবার ভুল করছিল এবং বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। তারা কখনো রাজনীতিকে – অর্থাৎ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও আকাংখাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে। জনগণ যে মৌলিক পরিবর্তন চায়, এটা কেন তারা বুঝেনি, সেটা এখনো আমার কাছে রহস্য। আমি তখন সাতটা কিস্তিতে তাদের একটা পর্যালোচনা করেছি। তাদের সমালোচনা করেছি, কোথায় কোথায় তাদের ভুল, কী করা দরকার। কিন্তু তখন তো তারা আমাদের কথা শোনেনি। অসুবিধা নেই, অতীত মানে অতীত। এখন আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই অভ্যুত্থানের শুরুতে বিএনপি কিছুটা বিভ্রান্ত থাকলেও পরে তারা বিচক্ষণ একটা পজিশন নিয়েছে। এখন তারা বর্তমান সরকারকে সময় দিতে চেয়েছে। তারা যদি ভিন্ন অবস্থান নেয় তাহলে প্রতিবিপ্লবীরা শক্তিশালী হতে পারে। আমার ধারণা এটা তারা বুঝতে পেরেছে। আমি দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার কাছাকাছি থাকায় তার রাজনৈতিক বাসনা বা ইচ্ছা বুঝতে পারতাম। তিনি কী চাইছেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটা আবারও প্রমাণ হলো।
খবরের কাগজ: খালেদা জিয়া ৭২-এর সংবিধান চান না, আপনি বলেছেন তার এই স্বপ্ন পূরণ হোক।
ফরহাদ মজহার: ৭২-এর সংবিধান তো বাংলাদেশের সংবিধান না, এটা পাকিস্তানের সংবিধান। একটা মুক্ত দেশে পাকিস্তানের লোকজন দিয়ে সংবিধান বানানো হলো। অর্থাৎ যারা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল তাদেরকেই স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য হিশাবে ঘোষণা দেওয়া হোল। এটা তো হতে পারে না। তার মানে, ৭২ থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি এজেন্ট ছাড়া আর কিছু ছিল না। এমনকি বাংলাদেশও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যুক্তিতে আরেকটি পাকিস্তানই ছিল। জনগণ যখন একটা দেশ স্বাধীন করেছে তখন আপনি জনগণকে বলবেন, তোমরাই এমন একটা গণপরিষদ নির্বাচিত কর যাতে তোমরা তোমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে পার। যেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিশাবে নতুনভাবে ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করব। ‘গঠনতন্ত্র’ কথাটাই ইংরেজি Constitution কথাটির সঠিক অনুবাদ। ‘সংবিধান’ না। সংবিধান শব্দটা কাদের? কলোনিয়াল পাওয়ার সংবিধান রচনা করে, ইন্ডিয়া অ্যাক্ট যেমন- আপনি কলোনিয়াল শক্তি, পরাধীনদের শাসন করবার জন্য একটা বিধান বানালেন -- একটা ‘অ্যাক্ট’ করলেন সেরকমই। র্থাৎ দাবি করলেন, আমি কলোনিয়াল শাসক, অ্যাক্ট দ্বাবা সংবিধান দ্বারা আমি কলোনাইজ পিপলকে শাসন করব। এই রকম। কোনো গঠনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদ গঠন না করে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার পাকিস্তানের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে বাংলাদেশে ‘সংবিধান’ বানিয়েছে। তো এই সংবিধান আমরা রাখব কেন? অনেক আগেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল।
খবরের কাগজ: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ৭২-এর সংবিধান কি বাদ দিতে পারবে বলে মনে করছেন?
ফরহাদ মজহার: অবশ্যই পারবে। কী সমস্যা? গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে। বাদ দিতে পারবে না কেন? লাথি মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিবে। এখনো কেন করেনি, সেটাই আমি তাদের বরং প্রশ্ন করতে চাই। আমরা কি পাকিস্তানের সংবিধানে ফিরে যেতে চাই? অর্থাৎ পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য যারা নির্বাচিত তাদের বানানো সংবিধানে?
আর দেখুন, আমাদের জনগণ কোথায় বলেছে যে তারা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ চায়? কোথায় বলেছে তারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ চায়? কোথায় বলেছে যে তারা ‘সমাজতন্ত্র’ চায়? শেখ মুজিবের ৬ দফার মধ্যে এই সব ছিল? কি এগুলো? এইসব জঞ্জাল? ৭২-এর সংবিধান ছিল একদিকে প্রণয়ণ প্রক্রিয়ার দিক থেকে পাকিস্তানিদের রচিত সংবিধান, কারন পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্যই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছিল।অন্যদিকে সেটা ছিল ইন্ডিয়ানদের বাংলাদেশে শাসন করবার কলোনিয়াল হাতিয়ার। লিগ্যালি ছিল পাকিস্তানিদের আর পলিটিক্যালি ছিল ইন্ডিয়ানদের সংবিধান। এই সংবিধানকে তো অবশ্যই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।
এত বছর পর যখন সুযোগ এসেছে এখনো কেন তারা এটি ছিঁড়ে ফেলেনি সেটাই সন্দেহের। আমি বারবার বলেছি, ইমিডিয়েটলি ড. ইউনূসকে জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হোক। যেন আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের জন্য দায়িত্ব পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে পারি। তিনি কার দ্বারা ‘নির্বাচিত’? অভ্যুত্থান যারা করেছে সেই জনগণ দ্বারা দ্বারা নির্বাচিত।
প্রশ্ন হছে তাঁকে আমরা ‘নির্বাচিত’ বলছি কেন? তিনি কি কোনো ‘নির্বাচন’ করে এসেছেন? তিনি ‘নির্বাচিত কারণ জনগণই তাকে ‘নির্বাচিত’ করেছে। তাহলে তিনি কোন যুক্তিতে সংবিধানের অধীনে শপথ নিলেন? কারা করেছে, আমি জানতে চাই। যারা করেছে, তারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত।
খবরের কাগজ: সংবিধান ছাড়া দেশ চলবে কীভাবে?
ফরহাদ মজহার: প্রথমত হলো, সভারেন উইল অব দ্য পিপল (Sovereign Will of the People), -- অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় সেটা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্যক্ত, প্রকাশিত এবং বিজয়ী। তারই প্রতিনিধি হিসেবে ড. ইউনূস হচ্ছেন পিপলের সভারেন পাওয়ার বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি। অতএব, তিনি এখন যা কিছু বলেন বা আদেশ দেন, সেটাই কিন্তু আইন- লিগ্যালি এবং পলিটিক্যালি।
এখন উকিলরা প্রতিবিপ্লব করার জন্য যে তর্কটা করে সেটা হোল সংবিধান ছাড়া কি দেশ চলবে? আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, তাহলে ইংল্যান্ড কীভাবে চলে? সেখানে তো কোন লিখিত সংবিধান নাই। বাংলাদেশের যেসব উকিলরা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ইউকে সংবিধান ছাড়া কীভাবে চলে? বুঝিয়ে বলুন। বাংলাদেশও গঠনতন্ত্রকে লিখিত রূপ দেবার আগে অনায়াসেই চলতে পারবে। বিশ্বের বহু দেশ আছে সংবিধানই নেই।
আসলে সংবিধান বা তথাকথিত আইন সব সময়ই সমাজে থাকে। সেটা লিখিত থাকতে হবে তার কোন যুক্তি নাই। আইন, বিধান, সংবিধান সমাজ থেকে কখনো চলে যায় না। পার্থক্যটা হলো- কোথাও এটা থাকে লিখিত, কোথাও এটা থাকে অলিখিত। আমাদের ক্ষেত্রে বিপ্লবের পরে অলিখিত সংবিধান জারি হয়ে গিয়েছে যা জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় ধারণ করে। মানে জনগণের অভিপ্রায়, এই অভিপ্রায়েরই নির্বাচিত প্রতিনিধি হচ্ছেন ড. ইউনূস। তাকে ঘিরে জনগণের ইচ্ছাটা অলিখিত রূপে আছে। এটাকে এখন লিখিত রূপ দিতে হবে। এটাই মূল ব্যাপার।
খবরের কাগজ: আপনি কি আশা করছেন এই সরকার এটা করবে?
ফরহাদ মজহার: আমি জানি না। আমি আমার কথা বলে যাচ্ছি। আমি জনগণের পক্ষে কথা বলব। আমি সরকারের প্রতিনিধি না। এখন আমরা যেভাবে আইন বুঝতে অভ্যস্ত সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি ড.ইউনূস শুধু ঘোষণা দিয়ে বলবেন, এখন যা কিছু আইন আমাদের সমাজে আছে বা চলে আসছে তাদের সব আইনই নতুন বাংলাদেশ বহাল থাকবে। তবে কথা আছে। সেটা হোল যেসব আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক- সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে বিচারপতিরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ অবধি বিচার চালাবেন, আদালত চলবে, সব প্রশাসন চলবে।
খবরের কাগজ: সরকারের এখন কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
ফরহাদ মজহার: প্রধান প্রায়োরিটি সিকিউরিটি। ড. ইউনূস দ্রুততম সময়ে যেটা করতে পারতেন একটা ন্যাশনাল ইয়ুথ সিকিউরিটি কাউন্সিল। বা বিপ্লবী তরুণ তরুণদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল। তারাই মুক্ত বাংলাদেশকে পাহারা দেবে। গণ অভ্যুত্থান যেন নস্যাৎ করা করা না যায় তার জন্য দিবারজনী তারাই বাংলাদেশ পাহারা দেবে। এটা তাদের বিপ্লব, তারাই সেটা রক্ষ করবে। যে তরুণরা বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, তাদেরকে বিপ্লবী গার্ড হিসেবে রাখা যেতে পারে- যেন কেউ প্রতিবিপ্লব করতে না পারে।
ইউনূসকে কে বলেছে এরকম একটা সরকার গঠন করতে? তিনি কি তরুণদের সঙ্গে পরামর্শ করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন? তাহলে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ কেন? শেখ হাসিনার সংবিধানে কোথায় আছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যায়? তরুণদের তিনি রাষ্ট্র শাসনে বা নতুন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় রাখতে চাইছেন না, অথচ তরুণদের কি তিনি ট্রাফিক পুলিশ বানাতে চান? আমরা কি এত বেকুব? আমরা কি এতোই গর্দভ? না, এটা হবে না।
ভারত যদি এখানে আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণ করতে পারে যে শেখ হাসিনা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তাহলে আমরা কি করব? তারা আগে কেন বলেনি? তারা ভেবেছে, এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার, ফলে একটা বিপ্লবী সরকারই হবে, শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনস্থ সরকার নয়। কিন্তু তারা এখন দেখছে এরা বাংলাদেশে তো সবাই বোকা, এদেরকে তো আমরা আবারও চাইলে ফেলে দিতে পারব। ফলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলছে, শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী। আপনি তার মুখ বন্ধ করবেন কীভাবে? আবার শেখ হাসিনা কী বলছেন- ‘আমি যাবার সময় কিছু বক্তব্য দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।’ আওয়ামী লীগের ভাষায়, ‘সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারকে আপনি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করেছেন, আপনি তো আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ করেছেন।’
এরপর ছাত্রদের বলা হোল, উনি যে পদত্যাগ করেছেন তার কাগজ আছে। কই সেই পদত্যাগ পত্র? এই কাগজ যদি সরকার দেখাতে না পারেন, আজকে আপনি দিল্লিকে ঠেকাবেন কীভাবে?
আপনি এখন পুলিশকে ডাকছেন, পুলিশ আসো রে, যোগদান কর রে, পুলিশ শেখ হাসিনার আমলে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছে সে আবার আপনার চাকরি করতে আসবে কেন? এ পুলিশ তো শেখ হাসিনার পুলিশ! আপনি তাদের ডাকছেন কেন? যারা চলে গেছে তাদের দ্রুত ‘পলাতক’ ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর অধীনে আমাদের ছেলেদের ট্রেনিং দেন কীভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এর ফলে আমাদের শক্তিশালী একটা জনসম্পদ তৈরি হবে।
খবরের কাগজ: প্রতিবিপ্লবের একটা কথা শোনা যাচ্ছে। আপনি এই প্রসঙ্গে কথা বলছেন, তো প্রতিবিপ্লব সরকার ঠেকাতে পারবে কি?
ফরহাদ মজহার: প্রতিবিপ্লব যদি আমরা ঠেকাতে চাই তাহলে দ্রুত ড. ইউনূসের হাতে সব ক্ষমতা দিতে হবে। আমাদের এখনকার যে রাষ্ট্রপতি তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। আইনগত এবং প্রশাসনিক যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললাম, এগুলো অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করুন। আপনি শেখ হাসিনার পুরোনো সংবিধান বহাল রাখবেন, তা হতে পারে না। এটা বিপজ্জনক।
খবরের কাগজ: কেউ কেউ এই সরকারকে বলছেন এনজিও সরকার। আবার অনেকে বলার চেষ্টা করছেন এটা এলিটদের সরকার, আপনি কী বলতে চান?
ফরহাদ মজহার: সরকারে কে আছে এটা দিয়ে কিন্তু সরকারের চরিত্র বোঝা যায় না। এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। ড. ইউনূস যদি এই সরকারের প্রধান হতেন, তাহলে কিন্তু এই প্রশ্নটা উঠত না। তখন ছাত্র-জনতা ঠিক করত সত্যিকারের সরকারের সদস্য বা মন্ত্রী কে হবেন, কিম্বা কাদের অতীতের ভূমিকার কারনে তারা হবেন না। এখন আপনাকে তিনটা কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে, একটা তালিকা এসেছে সেনাবাহিনী থেকে যেখানে ছিল পুরোনো আওয়ামী লীগের পছন্দের লোকগুলো, দ্বিতীয়টা এসেছে ছাত্রদের পক্ষ থেকে, আর তিন নম্বরটা এসেছে ড. ইউনূসের কাছ থেকে। তাকে যদি আমাদের প্রধান মানি তাহলে অবশ্যই তার পছন্দের তালিকা আমাদেরও পছন্দ হবে। আপনি বলতে পারবেন না এনজিও, এরা প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব কাজে স্বনামধন্য, ভালো কাজ আছে তাদের। তারা আমাদের সমাজের, দেশের সম্পদ। কিন্তু আপনি যদি এলিট ক্লাসের রিপ্রেজেন্টের কথা বলেন, তাহলে এটা তো সত্য, এখানে তো শ্রমিকের কোনো প্রতিনিধি নেই, কৃষকের প্রতিনিধি নেই, সাংবাদিকদের কোনো প্রতিনিধি নেই, আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির জগতের কোনো প্রতিনিধি নেই। তাহলে এ সরকারটা তো দুর্বল। এভাবে করলে হবে না।
খবরের কাগজ: গণমাধ্যম ভাঙচুর দখল চলছে। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কী?
ফরহাদ মজহার: আপনি এখন ৭১ টিভি ভেঙে দিবেন, সময় টেলিভিশন ভেঙে দিবেন, এটা কি আমরা চাই? এটা আমরা চাই না। আমরা চাই প্রত্যেক মিডিয়া থাকুক। কিন্তু অবশ্যই তাদের খাসিলত বদলাতে হবে। অতীতে কে কী করেছে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের খাতিতে তা ভুলে গিয়ে এখন একসঙ্গে কাজ করবার পরিবেশ তৈরি করা দরকার। পাশাপাশি দরকার কঠোর নজরদারি। যেন কেউ আবার ছোবল দিতে না পারে।
খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা দেশের ৫০ জন সাংবাদিকের একটি তালিকা তৈরি করে বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে।
ফরহাদ মজহার: না- ছাত্ররা এ তালিকা করেনি। ছাত্রদের ওপরে এর দোষ চাপাবেন না। ছাত্ররা ফ্যাসিস্ট না। এগুলো ফ্যাসিস্টরা করে। ইন্ডিয়ান বা হাসিনা সমর্থকরাই আমাদের বিভক্তিকে চিরস্থায়ী করবার জন্য এই সব নানান তালিকা ছড়াচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর, আমি দেখেছি এসব। একটা লোক অপরাধ করেছে ঠিক আছে, কিন্তু আপনি তো তাকে শোধরানোর সময় দেবেন। যারা ক্রিমিনাল , দাগী অপরাধী – তাদের কথা আলাদা। সেটা ভিন্ন জিনিস। ক্রিমিনালদের ডিল করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা সরকারের কাজ, আমাদের কাজ না। আমাদের কাজ হচ্ছে যারা ভুল করেছে বা যে কোন কারনে অন্যায় করেছে তাদের সংশোধিত হয়ে ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি করা।
(সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ পড়ুন আগামীকাল )