জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার। বাংলাদেশের নদ-নদী ও পানি প্রবাহ নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। আগস্টের আকস্মিক বন্যায় ফেনীসহ ১২ জেলা প্লাবিত হওয়ার পর আলোচনায় আসে বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন ও অভিন্ন নদী চুক্তির বিষয়গুলো। বাংলাদেশ কেন নদী রাজনীতিতে পিছিয়ে আছে? বাংলাদেশের সঙ্গে নদী চুক্তিতে ভারতের অনীহা কেন? চীনের আগ্রহ কেন তিস্তাতে? এসব বিষয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের হেড অব ডিজিটাল গোলাম রাব্বানী।
খবরের কাগজ: সম্প্রতি ফেনীসহ দেশের ১১ জেলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। ভারত নিজেও স্বীকার করেছে যে, তারা মুহুরী নদীর বাঁধ খুলে দিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশকে আগাম বার্তা না দিয়ে এভাবে কী নদীর বাঁধ হুট করে খুলে দেওয়া যায়?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: আমি বলব যে, বাঁধ বানানো তাদের অন্যায় হয়েছে। আমাদের অনুমতি নিয়ে বাঁধটা বানানো উচিত ছিল। তারা তো আমাদের আপার রায়পেরিয়ান কান্ট্রি। আমরা ডাউন রায়পেরিয়ান কান্ট্রি। আমাদের যে ইন্টারন্যাশনাল ড্রেনেজ সিস্টেম/বেসিন, নদী, নালা-খাল-বিল, এগুলোর প্রবাহ অবিচ্ছেদ্য। উজান থেকে ভাটি অঞ্চলের মধ্য দিয়েই আমাদের বঙ্গোপসাগরে ভারতের অতিরিক্ত পানিসহ সব ময়লা-আবর্জনা, সিল্টস-সেডিমেন্টস প্রবাহিত হয়, যার ফলে ভারত হয় পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত! একবার ভেবে দেখুন তো এই প্রবাহ পথ যদি কোনো কারণে সংকুচিত কিংবা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভারতের কী অবস্থা হবে! আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, পারস্পরিক সম্পর্ক-সহযোগিতা ও প্রকৃত সাহায্য ও শ্রদ্ধাবোধ কত জরুরি। কাজেই বাংলাদেশের অবস্থান ভাটির দেশ বলে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা প্রতিবেশীর একেবারেই অনুচিত হবে। ফলে দুটো বন্ধুপ্রতিম দেশের পানি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন একই প্রাকৃতিক বন্ধনে ঐতিহাসিকভাবেই গড়া। এ গভীর সত্যকে উপলব্ধি করেই ভাটির দেশের সমস্যা সমাধানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
আপার রায়পেরিয়ান দেশ ভারত আমাদের পানিপ্রবাহকে বন্ধ করার জন্য বা উইথড্রো করার জন্য অথবা রিজার্ভ করার জন্য যেসব বাঁধ দিয়েছে, তা অবিলম্বে পুনর্মূল্যায়ন করবে সেটাই ডাউন রায়পেরিয়ান বাংলাদেশের মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও গভীর সত্যনির্ভর প্রত্যাশা। এসব একতরফা বাঁধ নির্মাণের ইম্প্যাক্ট তো ড্রাই সিজনে আমাদের ওপরে পড়েছে ও পড়বে। আপার রায়পেরিয়ান ড্রাই সিজনে পানিশূন্যতা মোকাবিলা করার জন্য তারা রিজার্ভ করে রাখছে, অ্যাট দ্য কস্ট অব ‘বাংলাদেশের প্রাপ্য নিয়মিত সাপ্লাই’, অর্থাৎ ফ্লো-টা যখন আসত বাংলাদেশই সেটা পেত। আমাদের নদীবিধৌত হতো, আমাদের এখানে কৃষি থেকে শুরু করে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ত। তো তারা যে কাজটা করেছে প্রথমে সেই স্থাপনাগুলো করাটাই ঠিক হয়নি।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের মানুষকে পানির কষ্ট দেয়। বন্যাতে অধিক পানি ছেড়ে দেয় আর শীত মৌসুমে পানির সংকট তৈরি করে। জনগণের এই সাইকোলজিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে না করলেও এটা তাদের স্বার্থ ও যৌথ পানি ব্যবস্থাপনার ওপরে তাদের যে প্রমিনেন্স বা ডমিনেন্স এটি বজায় রাখার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আর তার মারাত্মক প্রভাব জীবন ও আমাদের জনপদ ও জলপথের ওপর ডেট্রিমেন্টাল ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যাডভার্স অ্যাফেক্টস হিসেবে বাংলাদেশের ওপর পড়তে শুরু করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে বন্যা মোকাবিলা করলাম, যা ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম। তো এই ইস্যুটা এখন মানুষের মনে আরও বেশি নাড়া দিচ্ছে যে, এত পানি কীভাবে অত্যন্ত তীব্র বেগে ওপর থেকে এল। একে শুধু অতিবৃষ্টির কারণ হিসেবেই দেখা যায় না।
বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টর আমাদের মনে করতে হবে। একটা হলো যে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেছে কি না। আমি বলব যে, ‘না’। আমি যেটা মনে করি ইচ্ছাকৃত না হলেও ভারতের কারণেই যে এটা ঘটেছে সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় আমাদের নেই। ভারতের এটা করা উচিত ছিল না। কারণ ‘জাতিসংঘের নন নেভিগেশনাল ওয়াটার রিসোর্সের যে ‘কনভেনশনাল ক্লজেজ’ আছে, সেখানে কিন্তু স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে যে রাইপেরিয়ান কান্ট্রিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক ড্রেনেজ বেসিনগুলো আছে সে বেসিনগুলোর ওপরে কোনো স্থাপনা উভয় দেশের সম্মতিজ্ঞাপন ছাড়া একতরফা ভাবে করা যাবে না।’ ভারত যে বাঁধগুলো তৈরি করেছে সেগুলোতে আমাদের অনুমোদন নেই। তো এই জায়গাগুলোতে তারা পানি রিজার্ভ করে রাখছে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন করেই চলেছে; ত্রিপুরার কথা যদি ধরি, আবার একইভাবে আপনারা দেখবেন যে, তিস্তার গজলডোবায় তারা এই কাজটা করেছে, তো টিপাইমুখ বাঁধের কথাও বলুন, এরকম অনেক বাঁধ কিন্তু উজানে একতরফা ভাবেই তৈরি হয়েছে।
খবরের কাগজ: দুই দেশের পানির ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠার জন্য যৌথ নদী কমিশন গঠন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। কিন্তু এই কমিশনও কার্যত নিষ্ক্রিয়...এই কমিশন কি দুই দেশের নদী সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: এই কমিশনের দুই বছর পর পর বা বছরে একটি মিটিং করার কথা। কিন্তু কার্যকর গবেষণা, গবেষণা দল বা কোথায় গবেষণার ফলাফল তার কিছুই আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
এসব ক্ষেত্রে তো আমাদের মানুষের মাঝে বিশ্বাসহীনতার একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে এই কারণে যে, দীর্ঘদিন তারা এই তিস্তা করবে করবে বলছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি।
খবরের কাগজ: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একমত হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না...। এর থেকে বের হওয়ার অন্য কোনো পথ আছে কী বাংলাদেশের?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: অবশ্যই আছে। এটাকে বলে ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি। আমরা বলছি আমরা মিটিং করব, তো দ্বিপক্ষীয় সভা করতে পারি আমরা মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে; মিটিং করে আমরা কেন আমাদের সমস্যার ভয়াবহতা দেখাতে পারছি না। কেন মমতা ব্যানার্জিকে আমরা এখানে আমন্ত্রণ করে আনতে পারলাম না। কোনো একটা সমস্যা তো ছিলই, সেটা হয়তো রাজনীতির অপসংস্কৃতি!
হ্যাঁ ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো অবিভক্ত বাংলার অংশ ছিল এই সেদিন অবধি। আমি মনে করি আমাদের সমঝোতার জায়গাটা বাড়াতে হবে। অতঃপর আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। আমাদের পানি ব্যবস্থাপনা কীভাবে আমরা সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারি। আমরা পার্টনারশিপে যেতে পারি চায়নার সঙ্গে, যেটা আমরা করেছি ইতোমধ্যে, যেভাবে এগোচ্ছিল সরকার তাকে বাস্তবতার নিরিখে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উইন-উইন অবস্থা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে পারি।
খবরের কাগজ: চীনের আগ্রহ রয়েছে তিস্তা নিয়ে, আমাদের নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে চীন কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: চীনের সঙ্গে আমাদের নেগোসিয়েশনের জায়গাগুলো ক্লিয়ার করতে হবে। এই জায়গাটা কীভাবে উইন-উইন সিচুয়েশনে যাওয়া যায় সেটা দেখতে হবে। তবে চীনের এসব বিষয়ে ভালো দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। চায়না বলছিল যে দুই পাশে বাঁধ করবে এবং বাঁধ করে নদীকে ছোট করে দেবে, যদিও গভীরতা বৃদ্ধি করেই করতে ইচ্ছুক। কিন্তু নদী ছোট করবে কী কারণে? বরং নদীকে আপনি আরও গভীর করেন, গভীর করলে স্রোত বাড়বে। নদীর দুই তীর দখলের মাধ্যমে কোনো কনস্ট্রাকশন করার পরিকল্পনা আইনসংগত হবে না। শুধু বাঁধ যেটা পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করে যদি টেকসই করা যায়, তবেই করবে। কারণ বর্ষায় পানি ধারণ করাটাই কিন্তু বড় কথা না। একটা রিজার্ভ হিসেবে ও এটাকে এমন প্যারালালওয়েতে করতে হবে যে, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের পানি শুষ্কতা ও নাব্যহীন অবস্থাকে যেন দূর করা যায়। তো সেরকম করে নদীর সোপানটা যদি আমরা করতে পারি, সেটা নিয়েই মনে হয় আমাদের আরও তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন আছে। আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, গবেষক আছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা এগোতে পারি।
খবরের কাগজ: অনেকেই এখন আলোচনা করছেন বাঁধের বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়া নিয়ে। সেটা কি আদৌ সম্ভব?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: আমাদের অংশে তো আমাদের বাঁধ দিতে হবে। আমাদের সেই বাঁধে ভারতের তো কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু ভারত যদি মনে করে বাংলাদেশ নিচে আছে তার যখন ইচ্ছা পানি আসবে ছেড়ে দিবে, তারা বলছে যে উপচে ওপর দিয়ে পানি এসেছে। তাহলে বাঁধ করার কি প্রয়োজন ছিল? এখন এই বাঁধের প্রভাব পড়ছে সাউথ ইস্টার্ন রিজিওনে। জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের পানি সম্পদ নিয়ে যে কনভেনশন আছে সেটার সরাসরি লঙ্ঘন করছে ভারত। সেখানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে, ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তে যে ৫৪টি নদী আছে সবগুলো থেকে একমত হয়ে উভয় পক্ষ সমান সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে। কিন্তু ভারত এর উল্টোটা করছে। তারা বলছে বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। এটা অবশ্যই অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। একটা কমিশন গঠন সেটা অনুসন্ধান করে দেখা হোক যে, ভারত সেখানে কেন বাঁধ নির্মাণ করেছে। যতই তারা বলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, পানির সংরক্ষণ করছে, কিন্তু বাঁধ নির্মাণের সময় তারা বাংলাদেশের কোনো অনুমোদন নেয়নি বলেই তার অবস্থান জানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ কখনোই মনে করে না যে আমরা বন্যার প্রাদুর্ভাব থেকে একেবারেই মুক্ত হতে পারব। ভারতও তা হতে পারবে না। কারণ জলবায়ুজনিত যে পরিবর্তন এখন এসেছে, আর জলবায়ু পরিবর্তন যারা করছে: আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন, যাদের সঙ্গে ভারতও কিন্তু দায়ী। আন্তর্জাতিক আদালতে তারা কিন্তু দোষী সাব্যস্ত। তারা আমাদের নদী দূষণ করছে! এবং তাদের থেকেও বয়ে-আসা পানিতে আমাদের অর্থনৈতিক ও কৃষি খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার বিনাশ ঘটেই চলেছে এখানে!
খবরের কাগজ: পানি বণ্টন রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল, এ কথাটা আসলে কতটা সত্য?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: হ্যাঁ, কথাটা সত্য। তবে সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। বাংলাদেশের যারা পার্টনারশিপে এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই দুর্বল অবস্থানে থাকে এবং সেটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, যা দেশের মানুষ এখন বলছে, সরকারের যা করা উচিত ছিল তা করেনি। এবং আমরা এমন একটা সরকার চাই, যারা সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল প্রাকৃতিক/পাবলিক সম্পদ/সম্পত্তি রক্ষায় জনগণের জন্য কাজ করবে। আমরা সঠিক ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি করতে পারিনি; যার কারণে আমাদের যে সফলতাটা দেখতে চাচ্ছিলাম সেটির দোরগোড়ায় গিয়েও আমরা ঝুলে আছি।
খবরের কাগজ: যৌথ নদী কমিশন নিষ্ক্রিয় কেন?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: যৌথ নদী কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। এই কমিশনের কোন মানে নেই বলে পর্যালোচনায় সবাই মিলে দাবি তুলছে। এটা ঝুলিয়ে রেখে আমাদের সমস্যা আর কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমাদের যে চুক্তি, তা হচ্ছে জি-টু-জি। কিন্তু না, এটা হতে হবে স্টেট-টু-স্টেট। এবং ইন্টারন্যাশনাল যে কনভেনশন সেখানে বলে দেওয়া আছে যে রাষ্ট্র-টু-রাষ্ট্র সমাধান করবে। প্রধানমন্ত্রী-টু-প্রধানমন্ত্রী এগুলো সমাধান হবে না। এটার কোনো গোপন দলিল হওয়া উচিত নয়। যতটুকু তারা জানাবে ততটুকুই জানা যাবে, এর বাইরে কিছু জানা যাবে না- এটা কেন? নদী, নালা, খাল-বিল স্রষ্টার দেওয়া সম্পদ, এই সম্পদ সবার।
খবরের কাগজ: অনেকেই মনে করছেন ভারতের আশায় বসে না থেকে নদীর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানে আমাদের তৃতীয় পক্ষের কাছে যাওয়া উচিত। যেমন বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ অনুষ্ঠিত হয়েছে... এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার সময় কী হয়েছে আমাদের?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: অবশ্যই পারি। তিস্তা প্রকল্পে যেহেতু ভারত এগিয়ে আসছে না এবং চীন আগ্রহ দেখিয়েছে সেখানেও আমরা বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা নিতে পারি। এবং এ প্রকল্পে আমি বলব নেপাল-ভুটান তারাও আমাদের সঙ্গে জয়েন করুক। আমরা যেমন ভারতের জনগণেরও সুযোগ-সুবিধা চাই, তারা সুখে থাকুক, ভালো থাকুক, সঙ্গে আমরাও। আমরা শেয়ার করব। আমাদের নদী পথ রক্ষা করতে হলে, কোন জায়গায় কতটুকু কীভাবে উন্নয়ন অত্যাবশ্যক এটা নিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি স্পারসোরও বাস্তবভিত্তিক স্টাডি করা জরুরি । শত বছরের পুরোনো ডেটা থেকে শুরু করে নিকট অতীত ও বর্তমান এবং আগামী দিনে কী হতে পারে এসব ডেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
খবরের কাগজ: ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে এই নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টনের জন্য আমাদের দ্রুত কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানি সুষম বণ্টনের জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। সেসব মিটিংয়ে কী কী তথ্য-উপাত্ত (ডকুমেন্ট) উপস্থাপন করতে হবে, সেসব নিয়ে আগে থেকে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি নিতে হবে। শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের আশায় থাকলে কার্যকর ফল আসবে না। নদী বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দেশের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানে না। আমি শুধু বলতে চাই আমাদেরকে নিজের স্বার্থের ব্যাপারে দায়িত্ববোধের সৎ, সাহসী ও নির্ভীক হতে হবে। সত্য কথা সাহস নিয়ে দায়িত্ববোধের সঙ্গে বলতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনি বলছিলেন আমরা ডিপ্লোমেটিক জায়গায় খানিকটা দুর্বল। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
মুজিবুর রহমান হাওলাদার: উত্তরণের জন্য প্রথমেই ৫৪টি নদীর কী অবস্থা তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হবে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ, তবে খুব জরুরি। শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ ৫-৭টি নদীর হাইড্রোমরফলজিক্যাল, জিও টেকনিক্যাল স্টাডিজ এবং ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট স্টাডি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। এরপর আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আগে দূর করতে হবে। দুর্যোগে শুধু অন্যদের দোষ দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা দুই পক্ষেই রয়েছে। ভারত থেকে পানি এসেছে বিষয়টি যেমন সত্যি, তেমনি আমাদের দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও এই বন্যার জন্য দায়ী। আমাদের নদী-খালগুলো যদি আরও প্রশস্ত আর গভীর হতো তাহলে এত মৃত্যুর মিছিল আজ দেখতে হতো না। ভারত থেকে বন্যার পানি এলেও তা সহজেই বঙ্গোপসাগরে নেমে যেত। তাই আমি মনে করি প্রথম কাজ হচ্ছে আমাদের নিজেদের কাজটুকু সঠিকভাবে করা। এই সংকট কিন্তু বারবার ফিরে আসবে। তাই এখন যারা সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন বিশেষ করে উপদেষ্টামণ্ডলীর সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী-খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর আইন রয়েছে তার প্রয়োগ করতে হবে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। এই জায়গায়ও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এবারের বন্যা মোকাবিলায় ছাত্ররা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, সেটা অবশ্যই প্রসংশনীয়। তবে আমাদের বন্যা ব্যবস্থাপনার পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। উপকূলে যেমন সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে তেমন ফ্লাড রেসকিউ সেন্টার/ টাওয়ার তৈরি করতে হবে। হঠাৎ বন্যা হলে মানুষ যেন সহজেই সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া বন্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব যেমন বোট, নৌকা, লাইফজ্যাকেটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকবে সেখানে।
এত গেল ভেতরের কথা। আন্তর্জাতিকভাবে ভারত, চীন, ভুটান অর্থাৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিলে আকস্মিক এই বন্যার কারণ খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্বনেতাদের সাহায্য চাইতে হবে। এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই বন্যার কারণ এবং প্রভাবের রিপোর্ট জাতিসংঘের কাছে পেশ করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় আইন কার্যকর না হলে আন্তর্জাতিক আইনে যেভাবে বলা আছে সেভাবেই আমরা নিজেদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই।