বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধিদের ভূমিকা, নতুন সরকারের কাছে চাওয়া-পাওয়া, ছাত্ররাজনীতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আরিফ জাওয়াদ ও সাব এডিটর তামিম আহসান
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনায় দুজন ছাত্র প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। তরুণ বয়সে বড় পরিসরে তাদের এ দায়িত্ব পালন কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সারজিস আলম: দেশ পরিচালনায় প্রবীণদের অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি নবীনদের যে উদ্যম, তারও প্রয়োজন রয়েছে। যদি দুটির সমন্বয় করা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দেশের জন্য সেটি ভালো। সাধারণত যেটি দেখা যায়, পলিসি মেকিংয়ের জায়গাটিতে যারা থাকেন তাদের সবার বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। সেখানে তরুণ প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। সেই জায়গাতে যদি সমন্বয় করা হয়, তাহলে আমাদের মানসিক ও চিন্তার যে দূরত্ব, সেটি ঘুচে গিয়ে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারে যে দুজন তরুণ উপদেষ্টা রয়েছেন তারা কিন্তু অন্য উপদেষ্টাদের তুলনায় কোনো অংশে খারাপ করছেন না। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটে বেড়াচ্ছেন এবং অনেক সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, যেটি অন্য উপদেষ্টাদের সেভাবে করতে দেখা যায়নি। তাই তরুণ দুই উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকে আমরা বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছি।
খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু আন্দোলন পরিচালনায় ঐকমত্যটা কীভাবে হতো? গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?
সারজিস আলম: আমাদের আন্দোলন ছাত্রদের যৌক্তিক কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়, যেখানে সব পর্যায়ের শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে যখন এই আন্দোলন অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তখন সবার ছিল এক দাবি। দাবি একটি হওয়াতে আমাদের যোগাযোগটি সহজ হয়ে যায় এবং সবাই আমাদের ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নামে। যদিও বিষয়টি এমন না যে সব জায়গাতে অফিশিয়ালি যোগাযোগ হয়েছে। যেসব জায়গায় আমরা কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, সেই জায়গাগুলোতে কথা বলেছি। তবে একটি জায়গায় মিল ছিল, এই এক দফা ছিল গণমানুষের প্রাণের দাবি এবং সেই জায়গা থেকে সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। এখন কিন্তু অনেকে আছে যারা রাজনৈতিক বিভাজনগুলোকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে এখনো আমরা আলোচনা করছি যে, আমরা যদি বিভাজিত হই; এই বিভাজনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার নীল নকশা করবে এবং পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করবে। আমাদের মধ্যে ছোটখাটো মান-অভিমান, মতানৈক্য, বিভাজন থাকতে পারে; কিন্তু দেশের মানুষের বৃহৎ স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি এবং ঐক্যবদ্ধ থাকব।
খবরের কাগজ: সম্প্রতি দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি একজন সমন্বয়ক ছিলেন, বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনেও তাকে দেখা গেছে। আপনারা বিষয়টি আগে থেকে জানতেন কি না?
সারজিস আলম: এই আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট দলের ছিল না। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল-মত, বর্ণ-ধর্ম, বয়সের মানুষের একটি গণ-আন্দোলন ছিল এটি। এর ফলে কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই আলাদাভাবে কারও থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন করা- এগুলো থাকা উচিত না বলে আমি মনে করি।
খবরের কাগজ: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগে প্রকাশ্যে শিবিরের কার্যক্রম দেখা যায়নি। ইদানীং প্রশাসনের সঙ্গে তারা বৈঠকে অংশ নিচ্ছে। বিষয়টি আপনারা কীভাবে দেখছেন?
সারজিস আলম: বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে শিবির ট্যাগ দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। একাত্তর থেকে শুরু করে যেসব ইতিহাস মানুষের সামনে এনেছে, সবগুলোই আসলে সত্য ইতিহাস ছিল না। বরং সেগুলো আওয়ামী লীগের ইতিহাস ছিল, ছিল তাদের নিজেদের উপস্থাপন করার ইতিহাস। একইভাবে আমরা দেখেছি, জামায়াত-শিবির-বিএনপি কিংবা ইসলামিক যেসব দল রয়েছে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্যাগ এবং বাজে স্লোগানও দেওয়া হয়েছে; আমরা কখনো এসব সমর্থন করি না। আমাদের জায়গা থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা, শিবির যদি নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠন হয়, তাহলে সেই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো অপকর্মে জড়িত থাকার তেমন প্রমাণ না থাকলে, দুই-একজনের কর্মকাণ্ড দিয়ে কোনো ছাত্রসংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। সেই জায়গাতে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। যদি সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রোপাগান্ডা হয়, তাহলে তো কাউকে আমরা সংগঠন করার যে অধিকার সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে কি না, এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা হতে পারে সরকারের জায়গা থেকে। তবে কোনো সংগঠন দেশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে, সেই স্বাধীনতাও তার থাকা উচিত। এখন ছাত্রশিবিরই কেন! ছাত্রদল-ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র ফেডারেশন-ছাত্র ফ্রন্ট যেই হোক না কেন, যেই সংগঠনের বিরুদ্ধে বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ থেকে থাকে, সেই অপরাধের আইনগত প্রক্রিয়ায় বিচার হওয়া উচিত এবং মানুষ অবশ্যই তাদের নিয়ে প্রশ্ন করবে। এখন সরাসরি কোনো অভিযোগ দিয়ে কাউকে নিষিদ্ধ করা হবে, এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত- সেটি করার আমাদের অধিকার রয়েছে কি না।
খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিরোধিতা করে। এর পেছনে কী কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সারজিস আলম: এর পেছনে ভারতের যেমন দায় রয়েছে, ঠিক তেমনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বড় দায় রয়েছে। বিগত ১৬ বছরে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারি বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিভিন্নভাবে সমর্থন ও নিরাপত্তা দিয়ে ক্ষমতায় রাখতে ভারত সহায়তা করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এ দেশের মানুষের ওপর যে নির্যাতন, অত্যাচার, হয়রানি এবং অন্যায় করেছে; মানুষ মনে করে এর দায় পরোক্ষভাবে ভারতের ওপরও যায়, সেই জায়গা থেকে একধরনের ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, ভারতের মতো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দেশের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থাকা উচিত না, তাদের আচরণ হবে প্রতিবেশী দেশের মতো এবং পররাষ্ট্রনীতি হবে সমতার। সেটি তারা না করে একটি দলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে এবং সীমাবদ্ধ পরাষ্ট্রনীতি দিয়ে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা আশা করি, ভারত সেই সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তাদের সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে, কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়।
খবরের কাগজ: বিএনপির সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে? ভবিষ্যতে বিরোধের কোনো আশঙ্কা আছে কি না।
সারজিস আলম: বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় রাজনৈতিক দল, তাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি প্ল্যাটফর্ম, এটি কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না। এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে, যেখানে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের প্রতিপক্ষ হওয়ার কোনো প্রশ্নেই আসে না, বরং তারাসহ বাকি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সব সময় কথা বলার চেষ্টা করি এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য যেসব কাজ করা দরকার তা করার চেষ্টা করছি। আমাদের জায়গা থেকে আমরা মনে করি, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, তবেই ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটি বজায় রাখা সম্ভব হবে এবং সবাই যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা করি, সে বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
খবরের কাগজ: ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে সব পক্ষই এখন সরব। আপনারা বলেছিলেন লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। এ বিষয়ে এখন আপনার অবস্থান কী? ডাকসু কি ছাত্ররাজনীতির বিকল্প?
সারজিস আলম: দেখুন, আমি আমার জায়গা থেকে সব সময় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান করি। কারণ আমি গণরুম ও গেস্টরুমের যে কালচার, অত্যাচার-নিপীড়নের যে কালচার তার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমার শিক্ষাজীবনের ছয় বছরে হাজার হাজার ঘণ্টা কীভাবে একজনকে একটি সালাম দেওয়ার জন্য, কোনো একজন নেতাকে প্রটোকল দেওয়ার জন্য নষ্ট হয়েছে সেটি আমি জানি। আমি চাই না আমার পরবর্তী প্রজন্মের সেরা মেধাবীরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো এভাবে নষ্ট করুক, এসব সংস্কৃতির কারণে শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্য দিয়ে বড় হোক, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ নষ্ট হোক, সেটি আমি চাই না। সে জায়গা থেকে আমার স্পষ্ট চাওয়া- এই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমি চাই প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলো হোক এবং এর মাধ্যমেই নেতৃত্ব তৈরি হোক এবং এর মাধ্যমেই ছাত্ররাজনীতির নতুন একটি আইডিয়া আসুক, এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হোক, এই মেধাবী তরুণরাই পরবর্তী সময়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেতৃত্ব দিক এবং পলিসি তৈরির জন্য সংসদে গিয়ে কথা বলুক। কারণ এই মেধাবী তরুণ প্রজন্ম যদি সংসদে গিয়ে কথা না বলে, তাহলে দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গিয়ে বসবে তাদের চেয়ে তুলনামূলক অযোগ্যরা, যারা সিন্ডিকেট চালায়, চাঁদাবাজি করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যেটি আমরা ভবিষ্যতে আর দেখতে চাই না।
খবরের কাগজ: আপনাদের রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে কি না। থাকলে কোন ভিশন নিয়ে সেটি করতে চান?
সারজিস আলম: এখনই আমরা রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো পরিকল্পনা করিনি বা এই বিষয়ে কোনো আলোচনা করিনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ চায়, আমরা আমাদের জায়গা থেকে চাই- দুই দলের (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) মধ্যে (রাজনীতি) সীমাবদ্ধ থাকার ও জিম্মি থাকার যে প্রক্রিয়া সেটি থেকে বাংলাদেশের বের হয়ে আসা উচিত। এখানে আরও একাধিক নতুন বড় দল আসা উচিত। তাহলে এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই শুধু নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাদের মধ্যে যদি জনগণের জন্য কাজ করার প্রতিযোগিতা বাড়ে, নিজেদের ভালোভাবে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে দিন শেষে এটি জনগণের জন্যই ভালো। আর জনগণের জন্য ভালো হলে সেটি বৃহৎ স্বার্থে বাংলাদেশের জন্যই ভালো।
খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? সামনে কি এটির কোনো কমিটি দেওয়া হবে?
সারজিস আলম: হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই মনে করি প্রতিটি জেলায় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কাঠামো থাকা উচিত। এটি থাকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ রয়েছে। আমরা দেখছি যে সমন্বয়ক নাম ভাঙিয়ে অনেকে অপকর্ম করছে অথচ তারা সরাসরি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। ৫ আগস্টের পর তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য সমন্বয়ক সাজার চেষ্টা করছে। সে জায়গায় সত্যিকার অর্থে যারা ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের সুস্পষ্ট একটি তালিকা থাকা প্রয়োজন। তাহলে আমরা যেমন ভুয়া সমন্বয়কদের আলাদা করতে পারব আবার আমাদের ভেতরের কেউ যদি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে আমরা তাদের বহিষ্কার করে আইনগত শাস্তির আওতায় আনতে পারব। পাশাপাশি আমাদের ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের একটি কাঠামো বা গঠনতন্ত্র থাকা উচিত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা মনে করি, যতদিন এই অন্তর্বর্তী সরকার আছে, ততদিন একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার জন্য অফিশিয়ালি একটি কাঠামো থাকা প্রয়োজন। তাই আমরা কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করছি।
খবরের কাগজ: কোন মানদণ্ড অনুসরণ করে এই কমিটি করা হবে?
সারজিস আলম: দেখুন, আমরা যখন এই মানুষগুলোকে নির্বাচন করব, তখন আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব একেবারে প্রথম দিন তথা ৫ জুনের পর থেকে কাদের পেয়েছি, কাদের আমরা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে পেয়েছি; যেমন ১৮ ও ১৯ জুলাই ইত্যাদি দিনগুলোতে যাদের পেয়েছি, যারা আমাদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে একমত ছিল, বিশেষত যারা এক দফার সঙ্গে একমত ছিল তাদের এই কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করব। আবার যারা এই কথাটি বলেছে যে ‘আপনাদের কোটা সংস্কারের যে দাবি ছিল, সেটির পক্ষে ছিলাম; কিন্তু এখন এক দফার (স্বৈরাচার পতন) যে দাবি করছেন তার পক্ষে নেই’, তাদের রাখব কি না তা আমরা পর্যালোচনা করব। আমরা দেখব ৩, ৪ ও ৫ আগস্ট তারিখে কাদের স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্পষ্ট অংশগ্রহণ ছিল। আমরা দেখব ৫ আগস্টের পরে কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি এবং কারা সত্যিকার অর্থে অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে প্রত্যেকটি জায়গায় কাজ করার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে যাদের আমরা উপযুক্ত মনে করব, তাদেরই এই দলে বা কাঠামোতে নিয়ে আসব।
খবরের কাগজ: জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত ও প্ল্যাটফর্মের অভিমত কী?
সারজিস আলম: আমরা চাই যে বাংলাদেশে একটি নির্ধারিত সময়ে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং তার আগে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ যে সিস্টেমগুলো একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল; নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সংবিধান- যেটি আওয়ামী সংবিধানে পরিণত হয়েছিল, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেগুলো আওয়ামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, সে জায়গাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভালোভাবে সংস্কার করে একটি আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে এবং তার পরই আমরা অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। একটি সত্যি কথা বলি, যদি সিস্টেমগুলো সংস্কার না করতে পারি এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন না করতে পারি, তাহলে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে চেতনা, সেটি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমরা এটি কখনোই বলব না যে নির্বাচন হতে চার-পাঁচ বছর সময় দিতে হবে, এটা আমাদের কাছে যৌক্তিক না। আবার এটিও কখনো বলা উচিত নয় যে ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে সব সিস্টেম সংস্কার করে নির্বাচন হয়ে যাবে। অবশ্যই আমরা চাই নির্বাচন একটি যৌক্তিক সময়ে হোক এবং সংস্কার হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার হোক।
খবরের কাগজ: আপনি ভবিষ্যতে নিজেকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
সারজিস আলম: আমি সব সময়ই চেয়েছি দেশের মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে। এই আন্দোলনের আগে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেহেতু সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে, তাই সে জায়গায় যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। সে জায়গা থেকে আমরা এত বড় একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমার মনে হয়েছে যে দেশের মানুষের জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করার কোনো ক্ষেত্র থাকে তাহলে সে জায়গায় আমি কাজ করতে চেষ্টা করব।
খবরের কাগজ: গণ-ত্রাণ তহবিলের টাকার সর্বশেষ অবস্থা কী?
সারজিস আলম: আমরা গত ১ অক্টোবর দেখেছি সর্বশেষ আমাদের কাছে দুটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ক্যাশ ছিল ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে আমরা ৮ কোটি টাকা সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন্যার্তদের পুনর্বাসনের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে হস্তান্তর করেছি। সেখানে আমাদের ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছে এবং বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে সরকারের যে টিম রয়েছে, সেখানেও আমরা ছাত্র প্রতিনিধি দিয়েছি। জনগণের দেওয়া প্রতিটি টাকা যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, সেটি আমরা সর্বোচ্চ সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব। বাকি ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা দিয়ে উত্তরবঙ্গের বন্যাকবলিত যে জেলাগুলো রয়েছে, সেখানে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। সেসব জায়গার জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা কাজ করবে, সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণ করবে।
খবরের কাগজ: বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকবে বলা হচ্ছে, সেটি কীভাবে?
সারজিস আলম: সেটি ওই নির্দিষ্ট জেলার যারা এই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সেটি জেলা পর্যায়ে হোক বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হোক কিংবা যারা ভুক্তভোগী তাদের সমন্বয়ে। যারা ওই সব জায়গায় কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো আউটপুট দিতে পারবে, যাদের ওই সব এলাকা সম্পর্কে ধারণা আছে, তারাই ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে।
খবরের কাগজ: নির্বাচনের পর নতুন সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী থাকবে?
সারজিস আলম: ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের মানুষ যে স্পিরিট নিয়ে, জীবন বাজি রেখে পথে নেমেছিল, সে স্পিরিটকে ধারণ করে যেমন বাংলাদেশ আমরা এখন চাই, সে রকম একটি রাষ্ট্রের প্রত্যাশা আমরা আগামীর সরকারের কাছে করি। সেটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবে, জনগণের জন্য কাজ করবে, জনগণের কাছে জবাবদিহি করার জন্য প্রস্তুত থাকবে, জনগণের প্রশ্ন শোনার মানসিকতা থাকবে এবং দিন শেষে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থ এক পাশে রেখে কাজ করবে। এমন মানসিকতার সরকার আমরা প্রত্যাশা করি।