ঢাকা ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

ব্যবসা চাঙা করতে চাই প্রণোদনা

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ এএম
ব্যবসা চাঙা করতে চাই প্রণোদনা
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া

ডলারসংকটের কারণে মোটরসাইকেলের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। বাড়তি দামের কারণে এটি জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিক্রি না বাড়ায় এ ব্যবসায় চলছে মন্দাভাব। পরিস্থিতি উত্তরণে এ খাতকে চাঙা করতে প্রণোদনা চান ব্যবসায়ীরা। খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে বাজাজ মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরর্সের চট্টগ্রাম সেল সেন্টারের শাখা প্রধান মুজিবর রহমান ভুঁইয়া মোটরসাইকেল ব্যবসার বিস্তারিত দিক তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রাম অফিসের স্টাফ রিপোর্টার আবদুস সাত্তার। 

খবরের কাগজ : মোটরসাইকেল ব্যবসা কেমন চলছে ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া: মোটরসাইকেল ব্যবসা এখন আগের মতো নেই বললে চলে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে মোটরসাইকেল। দিন দিন দাম বেড়ে যাচ্ছে। এক সময় সর্বনিম্ন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। এখন সেই গাড়িগুলো দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। বাড়তি দামের প্রভাব পড়েছে মোটরসাইকেল বিক্রিতে। 

খবরের কাগজ : মোটরসাইকেল ব্যবসা মন্দা হওয়ার কারণ কি ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। আবার গাড়ির দাম বৃদ্ধিরও প্রভাব পড়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের প্রভাবও পড়েছে। এখন কম দামে গাড়িতো দেওয়া যাচ্ছে না। মানুষের চাহিদা টাকার ওপরও নির্ভর করে। গাড়ির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা কমে গেছে। 

খবরের কাগজ : বাজাজ মোটরসাইকেলের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দাম কত ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : বাজাজ মোটরসাইকেল ১০০ সিসির গাড়ি সর্বনিম্ন দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। আবার ২৫০ সিসির গাড়ি আছে সেগুলো ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। বলতে গেলে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার মধ্যে বাজাজ গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। বাজাজ গাড়ির গুণ ও মানের কথা বিবেচনায় এ দাম রাখা হয়েছে। 

খবরের কাগজ : বাজাজের গাড়ি বিদেশে রপ্তানি হয় কি ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : বাজাজের গাড়ি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয় না। আমাদের ঢাকার মোটরসাইকেল কারখানাতে গাড়ি গুলো অ্যাসেম্বলি হয়। বাজাজের মূল কারখানা ভারতে। 

খবরের কাগজ : বাজাজ পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয় গাড়ি প্রস্তুত করছে কি ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : অবশ্যই বাজাজের সব গাড়ি পরিবেশবান্ধব। জ্বালানি সাশ্রয় করে ১০০ ও ১২৫ সিসির বাইকগুলো বানানো। কিন্তু বেশি দামি বাইকগুলোতে জ্বালানি সাশ্রয় করা যাবে না। বেশি সিসির গাড়িগুলো সর্বসাধারণের জন্যও নয়। এগুলো স্পেশাল। এ গাড়িগুলো যারা চালাবে তারা জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করবে না। 

খবরের কাগজ : বাংলাদেশের চাহিদার ওপর নির্ভর করে নতুন গাড়ি প্রস্তুত করা হবে কি না ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : আমাদের দেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে নতুন গাড়ি আনার প্রক্রিয়া চলছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রেখে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব গাড়ি আনা হবে। আবার বেশ কিছু ফ্যাশনেবল গাড়িও আসবে। তবে এ গাড়িগুলো মডেল বা মাইলেস এখানে বলা যাবে না। বাজাজ একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড তাই গুণগত মান ধরে রেখে নতুন গাড়ি আনা হবে। 

খবরের কাগজ : ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কোনো ঝামেলা বা হয়রানি পোহাতে হয় কি না ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : উত্তরা মোটরসের সব গাড়ি শত ভাগ ভ্যাট ও ট্যাক্স পরিশোধের মাধ্যমে আমদানি ও বাজারজাত হয়ে থাকে। সুতরাং এখানে ভ্যাট ও ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের ঝামেলা করার মতো কিছুই নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়রানি করার চেষ্টা করা হলেও কাগজপত্র ঠিক থাকায় হয়রানির স্বীকার কম হতে হয়। 

খবরের কাগজ : কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন কি পরিমাণ গাড়ি বিক্রি হয় ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : করোনার আগে চট্টগ্রামে প্রতি বছর গড়ে ৭ হাজার পিস করে বাইক বিক্রি হয়েছে। সেটি নামতে নামতে এখন প্রতি বছর ৩০০০ পিসে চলে এসেছে। করোনা পরিস্থিতির পর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সেটির প্রভাব পড়েছে এই শিল্পে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আর ক্রয়ক্ষমতা কমার ফলে মোটরসাইকেল বিক্রি কমে গেছে।

খবরের কাগজ : বাইক ব্যবসায় মন্দাভাবকে চাঙা করতে আপনার পরামর্শ কি ? 
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বাজাজ ছাড়াও যেসব কোম্পানির বাইক বাজারে পাওয়া যায় সবার অবস্থা একই। কারোর ব্যবসা ভালো না। সুতরাং এই মন্দাভাবকে চাঙা করতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। 

খবরের কাগজ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মুজিবর রহমান ভুঁইয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকারে সারজিস আলম বিভাজিত হলে ফ্যাসিস্টরা সুযোগ নেবে

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩১ পিএম
বিভাজিত হলে ফ্যাসিস্টরা সুযোগ নেবে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধিদের ভূমিকা, নতুন সরকারের কাছে চাওয়া-পাওয়া, ছাত্ররাজনীতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আরিফ জাওয়াদ ও সাব এডিটর তামিম আহসান

খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনায় দুজন ছাত্র প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। তরুণ বয়সে বড় পরিসরে তাদের এ দায়িত্ব পালন কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

সারজিস আলম: দেশ পরিচালনায় প্রবীণদের অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি নবীনদের যে উদ্যম, তারও প্রয়োজন রয়েছে। যদি দুটির সমন্বয় করা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দেশের জন্য সেটি ভালো। সাধারণত যেটি দেখা যায়, পলিসি মেকিংয়ের জায়গাটিতে যারা থাকেন তাদের সবার বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। সেখানে তরুণ প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। সেই জায়গাতে যদি সমন্বয় করা হয়, তাহলে আমাদের মানসিক ও চিন্তার যে দূরত্ব, সেটি ঘুচে গিয়ে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারে যে দুজন তরুণ উপদেষ্টা রয়েছেন তারা কিন্তু অন্য উপদেষ্টাদের তুলনায় কোনো অংশে খারাপ করছেন না। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটে বেড়াচ্ছেন এবং অনেক সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, যেটি অন্য উপদেষ্টাদের সেভাবে করতে দেখা যায়নি। তাই তরুণ দুই উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকে আমরা বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছি।

খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু আন্দোলন পরিচালনায় ঐকমত্যটা কীভাবে হতো? গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?

সারজিস আলম: আমাদের আন্দোলন ছাত্রদের যৌক্তিক কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়, যেখানে সব পর্যায়ের শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে যখন এই আন্দোলন অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তখন সবার ছিল এক দাবি। দাবি একটি হওয়াতে আমাদের যোগাযোগটি সহজ হয়ে যায় এবং সবাই আমাদের ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নামে। যদিও বিষয়টি এমন না যে সব জায়গাতে অফিশিয়ালি যোগাযোগ হয়েছে। যেসব জায়গায় আমরা কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, সেই জায়গাগুলোতে কথা বলেছি। তবে একটি জায়গায় মিল ছিল, এই এক দফা ছিল গণমানুষের প্রাণের দাবি এবং সেই জায়গা থেকে সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। এখন কিন্তু অনেকে আছে যারা রাজনৈতিক বিভাজনগুলোকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে এখনো আমরা আলোচনা করছি যে, আমরা যদি বিভাজিত হই; এই বিভাজনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার নীল নকশা করবে এবং পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করবে। আমাদের মধ্যে ছোটখাটো মান-অভিমান, মতানৈক্য, বিভাজন থাকতে পারে; কিন্তু দেশের মানুষের বৃহৎ স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি এবং ঐক্যবদ্ধ থাকব।

খবরের কাগজ: সম্প্রতি দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি একজন সমন্বয়ক ছিলেন, বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনেও তাকে দেখা গেছে। আপনারা বিষয়টি আগে থেকে জানতেন কি না? 

সারজিস আলম: এই আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট দলের ছিল না। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল-মত, বর্ণ-ধর্ম, বয়সের মানুষের একটি গণ-আন্দোলন ছিল এটি। এর ফলে কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই আলাদাভাবে কারও থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন করা- এগুলো থাকা উচিত না বলে আমি মনে করি।

খবরের কাগজ: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগে প্রকাশ্যে শিবিরের কার্যক্রম দেখা যায়নি। ইদানীং প্রশাসনের সঙ্গে তারা বৈঠকে অংশ নিচ্ছে। বিষয়টি আপনারা কীভাবে দেখছেন?

সারজিস আলম: বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে শিবির ট্যাগ দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। একাত্তর থেকে শুরু করে যেসব ইতিহাস মানুষের সামনে এনেছে, সবগুলোই আসলে সত্য ইতিহাস ছিল না। বরং সেগুলো আওয়ামী লীগের ইতিহাস ছিল, ছিল তাদের নিজেদের উপস্থাপন করার ইতিহাস। একইভাবে আমরা দেখেছি, জামায়াত-শিবির-বিএনপি কিংবা ইসলামিক যেসব দল রয়েছে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্যাগ এবং বাজে স্লোগানও দেওয়া হয়েছে; আমরা কখনো এসব সমর্থন করি না। আমাদের জায়গা থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা, শিবির যদি নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠন হয়, তাহলে সেই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো অপকর্মে জড়িত থাকার তেমন প্রমাণ না থাকলে, দুই-একজনের কর্মকাণ্ড দিয়ে কোনো ছাত্রসংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। সেই জায়গাতে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। যদি সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রোপাগান্ডা হয়, তাহলে তো কাউকে আমরা সংগঠন করার যে অধিকার সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে কি না, এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা হতে পারে সরকারের জায়গা থেকে। তবে কোনো সংগঠন দেশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে, সেই স্বাধীনতাও তার থাকা উচিত। এখন ছাত্রশিবিরই কেন! ছাত্রদল-ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র ফেডারেশন-ছাত্র ফ্রন্ট যেই হোক না কেন, যেই সংগঠনের বিরুদ্ধে বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ থেকে থাকে, সেই অপরাধের আইনগত প্রক্রিয়ায় বিচার হওয়া উচিত এবং মানুষ অবশ্যই তাদের নিয়ে প্রশ্ন করবে। এখন সরাসরি কোনো অভিযোগ দিয়ে কাউকে নিষিদ্ধ করা হবে, এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত- সেটি করার আমাদের অধিকার রয়েছে কি না।

খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিরোধিতা করে। এর পেছনে কী কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

সারজিস আলম: এর পেছনে ভারতের যেমন দায় রয়েছে, ঠিক তেমনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বড় দায় রয়েছে। বিগত ১৬ বছরে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারি বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিভিন্নভাবে সমর্থন ও নিরাপত্তা দিয়ে ক্ষমতায় রাখতে ভারত সহায়তা করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এ দেশের মানুষের ওপর যে নির্যাতন, অত্যাচার, হয়রানি এবং অন্যায় করেছে; মানুষ মনে করে এর দায় পরোক্ষভাবে ভারতের ওপরও যায়, সেই জায়গা থেকে একধরনের ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, ভারতের মতো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় দেশের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থাকা উচিত না, তাদের আচরণ হবে প্রতিবেশী দেশের মতো এবং পররাষ্ট্রনীতি হবে সমতার। সেটি তারা না করে একটি দলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে এবং সীমাবদ্ধ পরাষ্ট্রনীতি দিয়ে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা আশা করি, ভারত সেই সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তাদের সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে, কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়।

খবরের কাগজ: বিএনপির সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে? ভবিষ্যতে বিরোধের কোনো আশঙ্কা আছে কি না।

সারজিস আলম: বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় রাজনৈতিক দল, তাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি প্ল্যাটফর্ম, এটি কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না। এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে, যেখানে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের প্রতিপক্ষ হওয়ার কোনো প্রশ্নেই আসে না, বরং তারাসহ বাকি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সব সময় কথা বলার চেষ্টা করি এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য যেসব কাজ করা দরকার তা করার চেষ্টা করছি। আমাদের জায়গা থেকে আমরা মনে করি, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, তবেই ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটি বজায় রাখা সম্ভব হবে এবং সবাই যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা করি, সে বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

খবরের কাগজ: ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে সব পক্ষই এখন সরব। আপনারা বলেছিলেন লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। এ বিষয়ে এখন আপনার অবস্থান কী? ডাকসু কি ছাত্ররাজনীতির বিকল্প? 

সারজিস আলম: দেখুন, আমি আমার জায়গা থেকে সব সময় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান করি। কারণ আমি গণরুম ও গেস্টরুমের যে কালচার, অত্যাচার-নিপীড়নের যে কালচার তার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমার শিক্ষাজীবনের ছয় বছরে হাজার হাজার ঘণ্টা কীভাবে একজনকে একটি সালাম দেওয়ার জন্য, কোনো একজন নেতাকে প্রটোকল দেওয়ার জন্য নষ্ট হয়েছে সেটি আমি জানি। আমি চাই না আমার পরবর্তী প্রজন্মের সেরা মেধাবীরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো এভাবে নষ্ট করুক, এসব সংস্কৃতির কারণে শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্য দিয়ে বড় হোক, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ নষ্ট হোক, সেটি আমি চাই না। সে জায়গা থেকে আমার স্পষ্ট চাওয়া- এই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমি চাই প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলো হোক এবং এর মাধ্যমেই নেতৃত্ব তৈরি হোক এবং এর মাধ্যমেই ছাত্ররাজনীতির নতুন একটি আইডিয়া আসুক, এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হোক, এই মেধাবী তরুণরাই পরবর্তী সময়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেতৃত্ব দিক এবং পলিসি তৈরির জন্য সংসদে গিয়ে কথা বলুক। কারণ এই মেধাবী তরুণ প্রজন্ম যদি সংসদে গিয়ে কথা না বলে, তাহলে দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গিয়ে বসবে তাদের চেয়ে তুলনামূলক অযোগ্যরা, যারা সিন্ডিকেট চালায়, চাঁদাবাজি করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যেটি আমরা ভবিষ্যতে আর দেখতে চাই না। 

খবরের কাগজ: আপনাদের রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে কি না। থাকলে কোন ভিশন নিয়ে সেটি করতে চান?

সারজিস আলম: এখনই আমরা রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো পরিকল্পনা করিনি বা এই বিষয়ে কোনো আলোচনা করিনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ চায়, আমরা আমাদের জায়গা থেকে চাই- দুই দলের (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) মধ্যে (রাজনীতি) সীমাবদ্ধ থাকার ও জিম্মি থাকার যে প্রক্রিয়া সেটি থেকে বাংলাদেশের বের হয়ে আসা উচিত। এখানে আরও একাধিক নতুন বড় দল আসা উচিত। তাহলে এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই শুধু নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাদের মধ্যে যদি জনগণের জন্য কাজ করার প্রতিযোগিতা বাড়ে, নিজেদের ভালোভাবে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে দিন শেষে এটি জনগণের জন্যই ভালো। আর জনগণের জন্য ভালো হলে সেটি বৃহৎ স্বার্থে বাংলাদেশের জন্যই ভালো।

খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? সামনে কি এটির কোনো কমিটি দেওয়া হবে?

সারজিস আলম: হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই মনে করি প্রতিটি জেলায় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কাঠামো থাকা উচিত। এটি থাকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ রয়েছে। আমরা দেখছি যে সমন্বয়ক নাম ভাঙিয়ে অনেকে অপকর্ম করছে অথচ তারা সরাসরি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। ৫ আগস্টের পর তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য সমন্বয়ক সাজার চেষ্টা করছে। সে জায়গায় সত্যিকার অর্থে যারা ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের সুস্পষ্ট একটি তালিকা থাকা প্রয়োজন। তাহলে আমরা যেমন ভুয়া সমন্বয়কদের আলাদা করতে পারব আবার আমাদের ভেতরের কেউ যদি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে আমরা তাদের বহিষ্কার করে আইনগত শাস্তির আওতায় আনতে পারব। পাশাপাশি আমাদের ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের একটি কাঠামো বা গঠনতন্ত্র থাকা উচিত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা মনে করি, যতদিন এই অন্তর্বর্তী সরকার আছে, ততদিন একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার জন্য অফিশিয়ালি একটি কাঠামো থাকা প্রয়োজন। তাই আমরা কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করছি।

খবরের কাগজ: কোন মানদণ্ড অনুসরণ করে এই কমিটি করা হবে?

সারজিস আলম: দেখুন, আমরা যখন এই মানুষগুলোকে নির্বাচন করব, তখন আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব একেবারে প্রথম দিন তথা ৫ জুনের পর থেকে কাদের পেয়েছি, কাদের আমরা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে পেয়েছি; যেমন ১৮ ও ১৯ জুলাই ইত্যাদি দিনগুলোতে যাদের পেয়েছি, যারা আমাদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে একমত ছিল, বিশেষত যারা এক দফার সঙ্গে একমত ছিল তাদের এই কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করব। আবার যারা এই কথাটি বলেছে যে ‘আপনাদের কোটা সংস্কারের যে দাবি ছিল, সেটির পক্ষে ছিলাম; কিন্তু এখন এক দফার (স্বৈরাচার পতন) যে দাবি করছেন তার পক্ষে নেই’, তাদের রাখব কি না তা আমরা পর্যালোচনা করব। আমরা দেখব ৩, ৪ ও ৫ আগস্ট তারিখে কাদের স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্পষ্ট অংশগ্রহণ ছিল। আমরা দেখব ৫ আগস্টের পরে কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি এবং কারা সত্যিকার অর্থে অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে প্রত্যেকটি জায়গায় কাজ করার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে যাদের আমরা উপযুক্ত মনে করব, তাদেরই এই দলে বা কাঠামোতে নিয়ে আসব।

খবরের কাগজ: জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত ও প্ল্যাটফর্মের অভিমত কী? 

সারজিস আলম: আমরা চাই যে বাংলাদেশে একটি নির্ধারিত সময়ে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং তার আগে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ যে সিস্টেমগুলো একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল; নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সংবিধান- যেটি আওয়ামী সংবিধানে পরিণত হয়েছিল, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেগুলো আওয়ামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, সে জায়গাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভালোভাবে সংস্কার করে একটি আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে এবং তার পরই আমরা অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। একটি সত্যি কথা বলি, যদি সিস্টেমগুলো সংস্কার না করতে পারি এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন না করতে পারি, তাহলে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে চেতনা, সেটি একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমরা এটি কখনোই বলব না যে নির্বাচন হতে চার-পাঁচ বছর সময় দিতে হবে, এটা আমাদের কাছে যৌক্তিক না। আবার এটিও কখনো বলা উচিত নয় যে ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে সব সিস্টেম সংস্কার করে নির্বাচন হয়ে যাবে। অবশ্যই আমরা চাই নির্বাচন একটি যৌক্তিক সময়ে হোক এবং সংস্কার হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার হোক। 

খবরের কাগজ: আপনি ভবিষ্যতে নিজেকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?

সারজিস আলম: আমি সব সময়ই চেয়েছি দেশের মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে। এই আন্দোলনের আগে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেহেতু সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে, তাই সে জায়গায় যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। সে জায়গা থেকে আমরা এত বড় একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমার মনে হয়েছে যে দেশের মানুষের জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করার কোনো ক্ষেত্র থাকে তাহলে সে জায়গায় আমি কাজ করতে চেষ্টা করব। 

খবরের কাগজ: গণ-ত্রাণ তহবিলের টাকার সর্বশেষ অবস্থা কী? 

সারজিস আলম: আমরা গত ১ অক্টোবর দেখেছি সর্বশেষ আমাদের কাছে দুটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ক্যাশ ছিল ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে আমরা ৮ কোটি টাকা সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন্যার্তদের পুনর্বাসনের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে হস্তান্তর করেছি। সেখানে আমাদের ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছে এবং বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে সরকারের যে টিম রয়েছে, সেখানেও আমরা ছাত্র প্রতিনিধি দিয়েছি। জনগণের দেওয়া প্রতিটি টাকা যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, সেটি আমরা সর্বোচ্চ সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব। বাকি ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা দিয়ে উত্তরবঙ্গের বন্যাকবলিত যে জেলাগুলো রয়েছে, সেখানে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। সেসব জায়গার জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা কাজ করবে, সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণ করবে।
 
খবরের কাগজ: বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকবে বলা হচ্ছে, সেটি কীভাবে?

সারজিস আলম: সেটি ওই নির্দিষ্ট জেলার যারা এই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সেটি জেলা পর্যায়ে হোক বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হোক কিংবা যারা ভুক্তভোগী তাদের সমন্বয়ে। যারা ওই সব জায়গায় কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো আউটপুট দিতে পারবে, যাদের ওই সব এলাকা সম্পর্কে ধারণা আছে, তারাই ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। 

খবরের কাগজ: নির্বাচনের পর নতুন সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী থাকবে?

সারজিস আলম: ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের মানুষ যে স্পিরিট নিয়ে, জীবন বাজি রেখে পথে নেমেছিল, সে স্পিরিটকে ধারণ করে যেমন বাংলাদেশ আমরা এখন চাই, সে রকম একটি রাষ্ট্রের প্রত্যাশা আমরা আগামীর সরকারের কাছে করি। সেটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবে, জনগণের জন্য কাজ করবে, জনগণের কাছে জবাবদিহি করার জন্য প্রস্তুত থাকবে, জনগণের প্রশ্ন শোনার মানসিকতা থাকবে এবং দিন শেষে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থ এক পাশে রেখে কাজ করবে। এমন মানসিকতার সরকার আমরা প্রত্যাশা করি।

ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি
পা-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুব আলম

এক সময় দেশে টাইলস আমদানি করে চাহিদা মেটানো হতো। এখন সময় বদলেছে। চাহিদার ৮০ শতাংশই দেশীয় কোম্পানি উৎপাদন করছে। কেউ কেউ আবার রপ্তানিও করছে সীমিত পরিসরে। দেশের বড় বড় করপোরেট কোম্পানিও বিনিয়োগ করেছে এই শিল্পে। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে টাইলস ব্যবসা উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। এর কারণ কী? এ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও সফল উদ্যোক্তা পা-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুব আলমের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম

খবরের কাগজ: টাইলস শিল্প কেমন চলছে?
এস এম মাহবুব আলম: সিরামিক পণ্য মানুষের মৌলিক চাহিদানির্ভর না। মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের আগেই গত সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সিরামিক শিল্পে খারাপ যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ছয় মাস যেতে না যেতেই সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তন হয়। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ রাজনৈতিক সহিংসতা চলে। এমন অবস্থার মধ্যে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো টাইলস ব্যবসাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

খবরের কাগজ: বিক্রি কমে যাওয়ায় ডিলাররা লোকশান গুনছেন। এ অবস্থায় দাম কমিয়ে বিক্রি বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি? 
এস এম মাহবুব আলম: ডিলাররা শতকরা ২-৩ টাকা কমিশন পান। অর্থাৎ ১০০ টাকার টাইলস বিক্রি করলে তারা ৩ টাকা কমিশন পান। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে টাইলসের বিক্রি কমে গেছে। কিন্তু দোকান ভাড়া কর্মচারীদের বেতন কমেনি। এর ফলে তারা লোকশান গুনছেন। তারা বিপদে আছেন। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু কোম্পানিগুলো কয়েক শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়েছে। এটাও সত্য। কারণ বড় বড় কোম্পানির কোটি টাকারও বেশি বেতন দিতে হচ্ছে। যে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে তাকে কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা বেতন দিতে হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলতো রয়েছেই। অন্যান্য খরচও রয়েছে। ব্যাংকের ঋণের সুদ রয়েছে। ঋণের সুদও বেড়ে গেছে ১৫-১৬ শতাংশ। ডিলারদের মতো মালিকদেরও খারাপ অবস্থা চলছে। 

খবরের কাগজ: টাইলস শিল্পের বিনিয়োগ কত। এই শিল্প আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব কী?
এস এম মাহবুব আলম: টাইলস শিল্পে একেক কোম্পানি একেকভাবে বিনিয়োগ করেছে। কারও ১০০ কোটি টাকা হবে। কারও বা ১ হাজার কোটি টাকা হবে। গড়ে ৪০০-৫০০ কোটি টাকা হলে তা ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা হবে। বড় বড় করপোরেট কোম্পানিও বিনিয়োগ করেছে। চাহিদা বাড়ছে। কাজেই এই বাজার আরও সম্প্রসারণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

খবরের কাগজ: ডিলাররা বলছেন, বিক্রিতো অনেক কমে গেছে। উৎপাদন কেমন হচ্ছে। 
এস এম মাহবুব আলম: ১২ হাজার কোটি টাকার বাজার অর্থাৎ মাসে হাজার কোটি টাকার উৎপাদন হতো। কিন্তু সমসাময়িক ঘটনায় সারা দেশে ভয়ে আতঙ্কে পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচামাল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। ফলে উৎপাদন ৬০ শতাংশ কমে গেছে। মানে ৪০ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে। ৩৩টির মধ্যে এ মুহূর্তে ২৫টি কারখানা চালু আছে। 

খবরের কাগজ: টাইলস রপ্তানি কি পর্যায়ে। কোনো টাইলস কি রপ্তানি হচ্ছে ? 
এস এম মাহবুব আলম: আমাদের দেশে টাইলস উৎপাদনের জন্য তেমন কোনো কাঁচামাল নেই। এ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৮০-৮৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। উৎপাদন খরচ বেশি। আবার কনটেইনার ভাড়াও বেশি। চীন, ইউরোপেও ভাড়া বেশি। বিদেশে সরাসরি ও দ্রুত পণ্য পৌঁছানোর যথাযথ কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে আমাদের পণ্য বিশ্ববাজারে পৌঁছতে অনেক বেশি মূল্য পড়ে যায়। তাই সহজে কেউ রপ্তানি করছেন না। হয়তো কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে রপ্তানি করতে পারে। ওয়াল টাইলসের কাঁচামাল পাওয়া যায় দেশে। তবে ফ্লোর টাইলসের শতভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। 

খবরের কাগজ: কারখানা চালাতে গিয়ে এ মুহূর্তে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কী?
এস এম মাহবুব আলম: আগে থেকেই ডলারসংকট আছে। তবে এই সরকার আসার পর আগের মতো নেই। বর্তমানে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। আগের মতো অতো আপ-ডাউন করে না। 

খবরের কাগজ: সর্বশেষ কখন টাইলসের দাম বেড়েছে। বিক্রি বাড়াতে দাম কি কমানো হবে।
এস এম মাহবুব আলম: গত ৬ মাসে টাইলসের দাম বাড়েনি। তবে গত বছর একবার দাম বেড়েছে। সেটাই চলছে। কমাতে চাইলেও হয়তো সম্ভব না। কারণ ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়েছে। অন্যান্য খরচও বাড়ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিক্রি বাড়বে। 

খবরের কাগজ: আপনার প্রতিষ্ঠান কেমন চলছে ?
এস এম মাহবুব আলম: আমার ১৯৯৫ সালে সিরামিক শিল্পে যাত্রা। এ জন্য ২০১৭ সালে শুরু করি পা-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। এটা দেশের অর্থনীতি-কর্মসংস্থানে বিরাট ভূমিকা রাখছে। বগুড়ার বনানীতে প্রতিষ্ঠিত সর্বাধুনিক স্বয়ংক্রিয় মেশিনে প্রস্তুত হয় রোমা টাইলস। সারা দেশে ক্রেতা চাহিদা পূরণ করছে এ ব্র্যান্ড। 

খবরের কাগজ: সরকার কি উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে মনে করছেন ?
এস এম মাহবুব আলম: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের আশা অনেক। তাই একটি সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে সবার আশা পূরণ করবে এই সরকার- এটাই সবার প্রত্যাশা। স্বল্প সময়ে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন নয়, লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে এ সরকারকে। ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। 

সাক্ষাৎকারে ড. বদিউল আলম মজুমদার স্বৈরশাসনের সুযোগ বন্ধের পরামর্শ দেব

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
স্বৈরশাসনের সুযোগ বন্ধের পরামর্শ দেব
ড. বদিউল আলম মজুমদার

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে চলছে নানামুখী আলোচনা। রাষ্ট্র সংস্কারে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ৬টি কমিশনের একটি হলো ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’। সেই কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আগামীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের নানা দিক নিয়ে তিনি খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ বন্ধ করার পরামর্শ দেবে কমিশন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ পারভীন এলিস

খবরের কাগজ: আপনি ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ এর প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত হতে যাওয়া এই কমিশনে আর কতজন থাকবেন? বাকি সদস্য কারা হতে পারেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: প্রধান উপদেষ্টা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এ জন্য সম্মানিত বোধ করছি। এটিকে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের স্বীকৃতি মনে করি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আমার অর্জিত অভিজ্ঞতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি আইনি কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছি। কমিশনে কতজন থাকবেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেনি, কার্যপরিধিও নির্ধারণ করা হয়নি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে এ মাসেই পুরো কমিশন গঠিত হবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার ঘুণে ধরা অচলাবস্থা মেরামতে আমরা কাজ করব। এই দেশে আর যাতে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ না থাকে- সেসব বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরব।

খবরের কাগজ: নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে আপনার কমিশনের কর্মপরিকল্পনা কীভাবে এগোবে? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: কমিশন গঠনের পর আলোচনা করে আমাদের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে। কার্যপরিধির সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন মাস। এই সময়ে আমরা কিছু সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারকে দেব। এর আগে নির্বাচন কমিশনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো রাজনৈতিক দল। তাদের সহযোগিতা না থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। 

খবরের কাগজ: ইসি নিয়োগে ২০২২ সালের বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: ইসি নিয়োগে ২০২২ সালে করা ওই আইনটি ত্রুটিপূর্ণ, অগ্রহণযোগ্য। ওই আইনের ৯ ধারায় বিগত কমিশনার নিয়োগে দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। তা ছাড়া আইনটি ব্যবহার করে সার্চ কমিটিতে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট দুজন নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বিগত কমিশন নিয়োগের সময় কমিটিতে যুক্ত ছিলেন এবং পরে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন; যা নীতিবহির্ভূত।

খবরের কাগজ: এখনো তো সার্চ কমিটি হয়নি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে কতটা সময় লাগতে পারে?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এ বিষয়ে দুই ধরনের মতামত আসছে। কারও মতে দ্রুত সময়ে কমিশন গঠন করা দরকার। আবার কারও মতে খুব কাছাকাছি সময়ে যেহেতু নির্বাচন নাই, সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে কমিশন গঠিত হলে মন্দ হয় না। দেশে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন পর্যায়ক্রমে আসবে। 

খবরের কাগজ: কমিশন গঠনের সার্চ কমিটিতে কোন কোন সেক্টরের ব্যক্তিদের প্রাধান্য থাকবে?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সার্চ কমিটিতে আমরা সরকারের অনুগত কোনো ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখতে চাই না। ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, বিরোধীদলীয় নেতার একজন, তৃতীয় বৃহত্তর দলের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি, নাগরিক (সুশীল) ও ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আইনটি এমনভাবে করতে চাই যাতে ভবিষ্যতে পরিবর্তনের দরকার না হয়।

খবরের কাগজ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিগত আউয়াল কমিশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিগত ওই কমিশন গঠিত হয়েছিল পক্ষপাতদুষ্ট ওই আইনেই। আর বিগত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (গণতন্ত্র)কে রক্ষা করা হয়নি, কারণ ইসির ক্ষমতা ছিল নির্বাচনটা বন্ধ করার, সেটা তারা করেনি। উপরন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারের অনুকূলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হঠাৎ গজিয়ে উঠা অখ্যাত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিয়েছে- যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমরা নতুন আইনি খসড়া করতে চাচ্ছি- যাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। যাতে সার্চ কমিটি ও কমিশনে আগের মতো সরকারের অনুগতদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ না থাকে। 

খবরের কাগজ: আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: তাদের সময়কার তিন নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তারা নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

খবরের কাগজ: দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্ভব হতে হবে। তা না হলে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম তারই পুনরাবৃত্তি হবে। আইনি দুর্বলতার চেয়েও বড় ঘাটতি রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। কারণ বর্তমান আইনি কাঠামো দিয়েও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আচরণ বদলায়। শুধু আইনি কাঠামো পরিবর্তন করে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করি না। সম্প্রতি যে গণ-আন্দোলন হলো, বিগত সরকারের যে পরিণতি হলো- সেসব থেকে সব দলকে শিক্ষা নিতে হবে। 

খবরের কাগজ: দেখা যাচ্ছে, নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: ভিত্তিহীন মামলা কোনো সময়েই কাম্য নয়। একই সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের ছাড় দেওয়া যাবে না। আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। 

খবরের কাগজ: প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি ইসিসহ কোনো নিয়োগই দিতে পারেন না- এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটাকে বলা যায় প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার ব্যবস্থা। মূলত রাষ্ট্রপতির হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে সংবিধানে বলাই আছে- প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এর ফলে রাষ্ট্রপতি পদটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। এর পরিবর্তন দরকার মনে করি। সেক্ষেত্রে আশা করি সংবিধান সংস্কারে আমাদের যে কমিশন গঠিত হয়েছে- তারা এ বিষয়ে নজর দেবেন। 

খবরের কাগজ: সরকার পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের সবস্তরের একসঙ্গে অপসারণ করা হলো। এটা কতটা প্রয়োজনীয় ছিল?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: যে পরিস্থিতিতে সেটা করা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক কোনো প্রেক্ষাপট নয়। বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিই আত্মগোপনে ছিলেন। আর কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি পলাতক, আর কারা পলাতক নন- বেছে বেছে তাদের অপসারণ করা সম্ভবপর ছিল না, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘটেছে। এখন এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব নির্বাচনই হবে।

খবরের কাগজ: পরিকল্পনাধীন নতুন কমিশনে যারা আসবেন তাদের সততা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের মানদণ্ড কী হবে?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটা তো পাল্লা দিয়ে মাপার বিষয় না। তবে কমিশনে যাদের বিবেচনা করা হবে- তাদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। এর ফলে এই সব ব্যক্তির ব্যাপারে যদি কোনো অভিযোগ বা অপকর্ম থাকে সেগুলো জানার সুযোগ হবে। বিতর্কিত লোকদের ইসির কমিশনে দায়িত্বে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। 

খবরের কাগজ: কমিশন গঠনের পর কোন নির্বাচন আগে হবে- পরিকল্পনা কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সেটা সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। যেটা মনে হচ্ছে- রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দাবি মিটিয়ে জাতীয় নির্বাচন করতে সময়ের দরকার হবে। কাজেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনই আগে করতে হবে। সেটা সিটি করপোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হতে পারে। সিটি নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদও শেষের দিকে। কারণ প্রশাসক নিয়োজিত থাকবে ৬ মাসের জন্য। অনেকগুলো নির্বাচনই সামনে করতে হবে। নতুন কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।

খবরের কাগজ: বিগত কমিশনের সিইসি রাষ্ট্র পরিচালনায় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। এই সংস্কার প্রস্তাব তিনি ছাড়া আরও অনেকেই করেছেন। অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরাও এমন প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সংসদে একদলের আধিপত্যসহ কিছু সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আছে আবার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কারের কমিটিকেও বিবেচনা করতে বলব।

খবরের কাগজ: একটি প্রশ্নাতীত স্বচ্ছ নির্বাচনব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এই ব্যবস্থা হঠাৎ করে নিশ্চিত করা সম্ভব না। দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে সঠিক নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে- যারা দক্ষ, সাহসী, সুষ্ঠু নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখেন। একই সঙ্গে দরকার হবে প্রশাসনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সর্বাত্মক পক্ষপাতমুক্ত সহযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা সদাচরণ করবেন- তারা ভোট কেনার চেষ্টা ও পেশিশক্তি প্রয়োগ করবেন না। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সত্য ও সঠিক তথ্য তুলে ধরবে। বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় যেটা তারা করতে পারেনি। ভোটার এবং নাগরিক সমাজকে এক্ষেত্রে তাদের ভোটাধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে। 

খবরের কাগজ: আওয়ামী লীগ এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত একটি দল। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনি সুষ্ঠু পরিবেশের কোনো ব্যত্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমি আশা করি, আগামীতে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে দলটি পুনর্গঠিত হবে। নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। 

খবরের কাগজ: খবরের কাগজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: খবরের কাগজের জন্য শুভকামনা।

সংবিধান পুনরায় লিখতে হতে পারে: আখতার হোসেন

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৬ এএম
সংবিধান পুনরায় লিখতে হতে পারে: আখতার হোসেন
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন

দেশের রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্ত নির্ধারণ করতে গত ৮ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির উদ্যোগে ৫৫ সদস্যের নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছে। কমিটিতে থাকা তরুণ সদস্যদের নিয়ে একটি ফোর্স গঠন করতে যাচ্ছে এই নাগরিক কমিটি। রাষ্ট্র সংস্কার, পুনর্গঠন কিংবা সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে চায় কমিটি। খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন এ বিষয়ে নানা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক জিয়াউদ্দিন রাজু

খবরের কাগজ: নাগরিক কমিটির লক্ষ্য আগামীতে কী থাকবে?

আখতার হোসেন: রাজনৈতিক নানা পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সংলাপ আয়োজন করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে কাজ করবে নাগরিক কমিটি। রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক জবাবদিহির মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার কি এই জবাবদিহির আওতায় থাকবে? 

আখতার হোসেন: অবশ্যই থাকবে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারে যারা রয়েছেন, জবাবদিহির জায়গায় তাদেরও আনছি।

খবরের কাগজ: আগামীতে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তখন এই নাগরিক কমিটি কি অংশ নেবে? 

আখতার হোসেন: এটি কোনো রাজনৈতিক দল না যে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো নিবন্ধন নেবে বা নির্বাচনে অংশ নেবে।

খবরের কাগজ: তাহলে এই কমিটির উদ্দেশ্য কী?

আখতার হোসেন: এটি নাগরিক একটি প্ল্যাটফর্ম। তরুণ যুবকদের সঙ্গে নিয়ে এই প্ল্যাটফর্ম।

খবরের কাগজ: তাহলে এই প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রমে কী থাকবে?

আখতার হোসেন: প্ল্যাটফর্মের কাজ হবে সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে আনা এবং সহযোগিতা করা। জনস্বার্থের পলিসি নিয়ে ডিসকাশন করা। সরকারি পলিসি যেন জনগণের পক্ষেই হয় সে জন্য কাজ করা। পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনা। 

এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থাকবেন কমিটির সদস্যরা। রাষ্ট্র সংস্কারে নেতৃত্ব দেওয়া, বাংলাদেশের সব মানুষের মত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালু রাখা এবং একটি নতুন সংবিধানের জন্য কাজ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

খবরের কাগজ: নতুন সংবিধানের বিষয়টি কি আরেকটু পরিষ্কার করবেন?

আখতার হোসেন: দেশে যে বর্তমান সংবিধানটি রয়েছে, সেটি হয়তো সংশোধন করতে হবে। তা না হলে পুনর্লিখন করতে হবে। আলাপটি হচ্ছে এ জায়গায়। এই সংবিধান আর চলে না! আমি মনে করি, বাংলাদেশের একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। 

এ বিষয়টি তো একা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নয়। সব রাজনৈতিক পক্ষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের নিয়ে, বিশেষ করে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সংলাপ এবং আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এই জায়গাটায় পৌঁছাতে চাই। 

খবরের কাগজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এই কমিটিতে আসতে পারেন কি না?

আখতার হোসেন: আমরা এখন যেসব কথা আপনাদের সঙ্গে বলছি। সমন্বয়করা সেসব বিষয় নিয়ে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন। পরবর্তী সময়ে তাদের কমিটিতে আসার সুযোগ রয়েছে।

সাক্ষাৎকারে মুজিবুর রহমান হাওলাদার পানির হিস্যা বুঝে নিতে চাই

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৪ এএম
পানির হিস্যা বুঝে নিতে চাই
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার। বাংলাদেশের নদ-নদী ও পানি প্রবাহ নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। আগস্টের আকস্মিক বন্যায় ফেনীসহ ১২ জেলা প্লাবিত হওয়ার পর আলোচনায় আসে বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন ও অভিন্ন নদী চুক্তির বিষয়গুলো। বাংলাদেশ কেন নদী রাজনীতিতে পিছিয়ে আছে? বাংলাদেশের সঙ্গে নদী চুক্তিতে ভারতের অনীহা কেন? চীনের আগ্রহ কেন তিস্তাতে? এসব বিষয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের হেড অব ডিজিটাল গোলাম রাব্বানী

খবরের কাগজ: সম্প্রতি ফেনীসহ দেশের ১১ জেলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। ভারত নিজেও স্বীকার করেছে যে, তারা মুহুরী নদীর বাঁধ খুলে দিয়েছিল। প্রতিবেশী দেশকে আগাম বার্তা না দিয়ে এভাবে কী নদীর বাঁধ হুট করে খুলে দেওয়া যায়? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: আমি বলব যে, বাঁধ বানানো তাদের অন্যায় হয়েছে। আমাদের অনুমতি নিয়ে বাঁধটা বানানো উচিত ছিল। তারা তো আমাদের আপার রায়পেরিয়ান কান্ট্রি। আমরা ডাউন রায়পেরিয়ান কান্ট্রি। আমাদের যে ইন্টারন্যাশনাল ড্রেনেজ সিস্টেম/বেসিন, নদী, নালা-খাল-বিল, এগুলোর প্রবাহ অবিচ্ছেদ্য। উজান থেকে ভাটি অঞ্চলের মধ্য দিয়েই আমাদের বঙ্গোপসাগরে ভারতের অতিরিক্ত পানিসহ সব ময়লা-আবর্জনা, সিল্টস-সেডিমেন্টস প্রবাহিত হয়, যার ফলে ভারত হয় পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত! একবার ভেবে দেখুন তো এই প্রবাহ পথ যদি কোনো কারণে সংকুচিত কিংবা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভারতের কী অবস্থা হবে! আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, পারস্পরিক সম্পর্ক-সহযোগিতা ও প্রকৃত সাহায্য ও শ্রদ্ধাবোধ কত জরুরি। কাজেই বাংলাদেশের অবস্থান ভাটির দেশ বলে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা প্রতিবেশীর একেবারেই অনুচিত হবে। ফলে দুটো বন্ধুপ্রতিম দেশের পানি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন একই প্রাকৃতিক বন্ধনে ঐতিহাসিকভাবেই গড়া। এ গভীর সত্যকে উপলব্ধি করেই ভাটির দেশের সমস্যা সমাধানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

আপার রায়পেরিয়ান দেশ ভারত আমাদের পানিপ্রবাহকে বন্ধ করার জন্য বা উইথড্রো করার জন্য অথবা রিজার্ভ করার জন্য যেসব বাঁধ দিয়েছে, তা অবিলম্বে পুনর্মূল্যায়ন করবে সেটাই ডাউন রায়পেরিয়ান বাংলাদেশের মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও গভীর সত্যনির্ভর প্রত্যাশা। এসব একতরফা বাঁধ নির্মাণের ইম্প্যাক্ট তো ড্রাই সিজনে আমাদের ওপরে পড়েছে ও পড়বে। আপার রায়পেরিয়ান ড্রাই সিজনে পানিশূন্যতা মোকাবিলা করার জন্য তারা রিজার্ভ করে রাখছে, অ্যাট দ্য কস্ট অব ‘বাংলাদেশের প্রাপ্য নিয়মিত সাপ্লাই’, অর্থাৎ ফ্লো-টা যখন আসত বাংলাদেশই সেটা পেত। আমাদের নদীবিধৌত হতো, আমাদের এখানে কৃষি থেকে শুরু করে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ত। তো তারা যে কাজটা করেছে প্রথমে সেই স্থাপনাগুলো করাটাই ঠিক হয়নি।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের মানুষকে পানির কষ্ট দেয়। বন্যাতে অধিক পানি ছেড়ে দেয় আর শীত মৌসুমে পানির সংকট তৈরি করে। জনগণের এই সাইকোলজিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে না করলেও এটা তাদের স্বার্থ ও যৌথ পানি ব্যবস্থাপনার ওপরে তাদের যে প্রমিনেন্স বা ডমিনেন্স এটি বজায় রাখার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আর তার মারাত্মক প্রভাব জীবন ও আমাদের জনপদ ও জলপথের ওপর ডেট্রিমেন্টাল ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যাডভার্স অ্যাফেক্টস হিসেবে বাংলাদেশের ওপর পড়তে শুরু করেছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে বন্যা মোকাবিলা করলাম, যা ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম। তো এই ইস্যুটা এখন মানুষের মনে আরও বেশি নাড়া দিচ্ছে যে, এত পানি কীভাবে অত্যন্ত তীব্র বেগে ওপর থেকে এল। একে শুধু অতিবৃষ্টির কারণ হিসেবেই দেখা যায় না।

বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টর আমাদের মনে করতে হবে। একটা হলো যে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেছে কি না। আমি বলব যে, ‘না’। আমি যেটা মনে করি ইচ্ছাকৃত না হলেও ভারতের কারণেই যে এটা ঘটেছে সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় আমাদের নেই। ভারতের এটা করা উচিত ছিল না। কারণ ‘জাতিসংঘের নন নেভিগেশনাল ওয়াটার রিসোর্সের যে ‘কনভেনশনাল ক্লজেজ’ আছে, সেখানে কিন্তু স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে যে রাইপেরিয়ান কান্ট্রিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক ড্রেনেজ বেসিনগুলো আছে সে বেসিনগুলোর ওপরে কোনো স্থাপনা উভয় দেশের সম্মতিজ্ঞাপন ছাড়া একতরফা ভাবে করা যাবে না।’ ভারত যে বাঁধগুলো তৈরি করেছে সেগুলোতে আমাদের অনুমোদন নেই। তো এই জায়গাগুলোতে তারা পানি রিজার্ভ করে রাখছে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন করেই চলেছে; ত্রিপুরার কথা যদি ধরি, আবার একইভাবে আপনারা দেখবেন যে, তিস্তার গজলডোবায় তারা এই কাজটা করেছে, তো টিপাইমুখ বাঁধের কথাও বলুন, এরকম অনেক বাঁধ কিন্তু উজানে একতরফা ভাবেই তৈরি হয়েছে। 

খবরের কাগজ: দুই দেশের পানির ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠার জন্য যৌথ নদী কমিশন গঠন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। কিন্তু এই কমিশনও কার্যত নিষ্ক্রিয়...এই কমিশন কি দুই দেশের নদী সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: এই কমিশনের দুই বছর পর পর বা বছরে একটি মিটিং করার কথা। কিন্তু কার্যকর গবেষণা, গবেষণা দল বা কোথায় গবেষণার ফলাফল তার কিছুই আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

এসব ক্ষেত্রে তো আমাদের মানুষের মাঝে বিশ্বাসহীনতার একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে এই কারণে যে, দীর্ঘদিন তারা এই তিস্তা করবে করবে বলছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি।

খবরের কাগজ: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একমত হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না...। এর থেকে বের হওয়ার অন্য কোনো পথ আছে কী বাংলাদেশের?

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: অবশ্যই আছে। এটাকে বলে ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি। আমরা বলছি আমরা মিটিং করব, তো দ্বিপক্ষীয় সভা করতে পারি আমরা মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে; মিটিং করে আমরা কেন আমাদের সমস্যার ভয়াবহতা দেখাতে পারছি না। কেন মমতা ব্যানার্জিকে আমরা এখানে আমন্ত্রণ করে আনতে পারলাম না। কোনো একটা সমস্যা তো ছিলই, সেটা হয়তো রাজনীতির অপসংস্কৃতি!

হ্যাঁ ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো অবিভক্ত বাংলার অংশ ছিল এই সেদিন অবধি। আমি মনে করি আমাদের সমঝোতার জায়গাটা বাড়াতে হবে। অতঃপর আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। আমাদের পানি ব্যবস্থাপনা কীভাবে আমরা সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারি। আমরা পার্টনারশিপে যেতে পারি চায়নার সঙ্গে, যেটা আমরা করেছি ইতোমধ্যে, যেভাবে এগোচ্ছিল সরকার তাকে বাস্তবতার নিরিখে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উইন-উইন অবস্থা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে পারি।

খবরের কাগজ: চীনের আগ্রহ রয়েছে তিস্তা নিয়ে, আমাদের নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে চীন কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: চীনের সঙ্গে আমাদের নেগোসিয়েশনের জায়গাগুলো ক্লিয়ার করতে হবে। এই জায়গাটা কীভাবে উইন-উইন সিচুয়েশনে যাওয়া যায় সেটা দেখতে হবে। তবে চীনের এসব বিষয়ে ভালো দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। চায়না বলছিল যে দুই পাশে বাঁধ করবে এবং বাঁধ করে নদীকে ছোট করে দেবে, যদিও গভীরতা বৃদ্ধি করেই করতে ইচ্ছুক। কিন্তু নদী ছোট করবে কী কারণে? বরং নদীকে আপনি আরও গভীর করেন, গভীর করলে স্রোত বাড়বে। নদীর দুই তীর দখলের মাধ্যমে কোনো কনস্ট্রাকশন করার পরিকল্পনা আইনসংগত হবে না। শুধু বাঁধ যেটা পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করে যদি টেকসই করা যায়, তবেই করবে। কারণ বর্ষায় পানি ধারণ করাটাই কিন্তু বড় কথা না। একটা রিজার্ভ হিসেবে ও এটাকে এমন প্যারালালওয়েতে করতে হবে যে, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের পানি শুষ্কতা ও নাব্যহীন অবস্থাকে যেন দূর করা যায়। তো সেরকম করে নদীর সোপানটা যদি আমরা করতে পারি, সেটা নিয়েই মনে হয় আমাদের আরও তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন আছে। আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, গবেষক আছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা এগোতে পারি।

খবরের কাগজ: অনেকেই এখন আলোচনা করছেন বাঁধের বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়া নিয়ে। সেটা কি আদৌ সম্ভব? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: আমাদের অংশে তো আমাদের বাঁধ দিতে হবে। আমাদের সেই বাঁধে ভারতের তো কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু ভারত যদি মনে করে বাংলাদেশ নিচে আছে তার যখন ইচ্ছা পানি আসবে ছেড়ে দিবে, তারা বলছে যে উপচে ওপর দিয়ে পানি এসেছে। তাহলে বাঁধ করার কি প্রয়োজন ছিল? এখন এই বাঁধের প্রভাব পড়ছে সাউথ ইস্টার্ন রিজিওনে। জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের পানি সম্পদ নিয়ে যে কনভেনশন আছে সেটার সরাসরি লঙ্ঘন করছে ভারত। সেখানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে, ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তে যে ৫৪টি নদী আছে সবগুলো থেকে একমত হয়ে উভয় পক্ষ সমান সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে। কিন্তু ভারত এর উল্টোটা করছে। তারা বলছে বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। এটা অবশ্যই অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। একটা কমিশন গঠন সেটা অনুসন্ধান করে দেখা হোক যে, ভারত সেখানে কেন বাঁধ নির্মাণ করেছে। যতই তারা বলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, পানির সংরক্ষণ করছে, কিন্তু বাঁধ নির্মাণের সময় তারা বাংলাদেশের কোনো অনুমোদন নেয়নি বলেই তার অবস্থান জানিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ কখনোই মনে করে না যে আমরা বন্যার প্রাদুর্ভাব থেকে একেবারেই মুক্ত হতে পারব। ভারতও তা হতে পারবে না। কারণ জলবায়ুজনিত যে পরিবর্তন এখন এসেছে, আর জলবায়ু পরিবর্তন যারা করছে: আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন, যাদের সঙ্গে ভারতও কিন্তু দায়ী। আন্তর্জাতিক আদালতে তারা কিন্তু দোষী সাব্যস্ত। তারা আমাদের নদী দূষণ করছে! এবং তাদের থেকেও বয়ে-আসা পানিতে আমাদের অর্থনৈতিক ও কৃষি খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার বিনাশ ঘটেই চলেছে এখানে!

খবরের কাগজ: পানি বণ্টন রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল, এ কথাটা আসলে কতটা সত্য?

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: হ্যাঁ, কথাটা সত্য। তবে সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। বাংলাদেশের যারা পার্টনারশিপে এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই দুর্বল অবস্থানে থাকে এবং সেটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, যা দেশের মানুষ এখন বলছে, সরকারের যা করা উচিত ছিল তা করেনি। এবং আমরা এমন একটা সরকার চাই, যারা সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল প্রাকৃতিক/পাবলিক সম্পদ/সম্পত্তি রক্ষায় জনগণের জন্য কাজ করবে। আমরা সঠিক ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি করতে পারিনি; যার কারণে আমাদের যে সফলতাটা দেখতে চাচ্ছিলাম সেটির দোরগোড়ায় গিয়েও আমরা ঝুলে আছি। 

খবরের কাগজ: যৌথ নদী কমিশন নিষ্ক্রিয় কেন? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: যৌথ নদী কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। এই কমিশনের কোন মানে নেই বলে পর্যালোচনায় সবাই মিলে দাবি তুলছে। এটা ঝুলিয়ে রেখে আমাদের সমস্যা আর কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমাদের যে চুক্তি, তা হচ্ছে জি-টু-জি। কিন্তু না, এটা হতে হবে স্টেট-টু-স্টেট। এবং ইন্টারন্যাশনাল যে কনভেনশন সেখানে বলে দেওয়া আছে যে রাষ্ট্র-টু-রাষ্ট্র সমাধান করবে। প্রধানমন্ত্রী-টু-প্রধানমন্ত্রী এগুলো সমাধান হবে না। এটার কোনো গোপন দলিল হওয়া উচিত নয়। যতটুকু তারা জানাবে ততটুকুই জানা যাবে, এর বাইরে কিছু জানা যাবে না- এটা কেন? নদী, নালা, খাল-বিল স্রষ্টার দেওয়া সম্পদ, এই সম্পদ সবার।

খবরের কাগজ: অনেকেই মনে করছেন ভারতের আশায় বসে না থেকে নদীর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানে আমাদের তৃতীয় পক্ষের কাছে যাওয়া উচিত। যেমন বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ অনুষ্ঠিত হয়েছে... এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার সময় কী হয়েছে আমাদের? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: অবশ্যই পারি। তিস্তা প্রকল্পে যেহেতু ভারত এগিয়ে আসছে না এবং চীন আগ্রহ দেখিয়েছে সেখানেও আমরা বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা নিতে পারি। এবং এ প্রকল্পে আমি বলব নেপাল-ভুটান তারাও আমাদের সঙ্গে জয়েন করুক। আমরা যেমন ভারতের জনগণেরও সুযোগ-সুবিধা চাই, তারা সুখে থাকুক, ভালো থাকুক, সঙ্গে আমরাও। আমরা শেয়ার করব। আমাদের নদী পথ রক্ষা করতে হলে, কোন জায়গায় কতটুকু কীভাবে উন্নয়ন অত্যাবশ্যক এটা নিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি স্পারসোরও বাস্তবভিত্তিক স্টাডি করা জরুরি । শত বছরের পুরোনো ডেটা থেকে শুরু করে নিকট অতীত ও বর্তমান এবং আগামী দিনে কী হতে পারে এসব ডেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। 

খবরের কাগজ: ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে এই নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টনের জন্য আমাদের দ্রুত কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন? 

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানি সুষম বণ্টনের জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। সেসব মিটিংয়ে কী কী তথ্য-উপাত্ত (ডকুমেন্ট) উপস্থাপন করতে হবে, সেসব নিয়ে আগে থেকে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি নিতে হবে। শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের আশায় থাকলে কার্যকর ফল আসবে না। নদী বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দেশের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানে না। আমি শুধু বলতে চাই আমাদেরকে নিজের স্বার্থের ব্যাপারে দায়িত্ববোধের সৎ, সাহসী ও নির্ভীক হতে হবে। সত্য কথা সাহস নিয়ে দায়িত্ববোধের সঙ্গে বলতে হবে। 

খবরের কাগজ: আপনি বলছিলেন আমরা ডিপ্লোমেটিক জায়গায় খানিকটা দুর্বল। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মুজিবুর রহমান হাওলাদার: উত্তরণের জন্য প্রথমেই ৫৪টি নদীর কী অবস্থা তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হবে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ, তবে খুব জরুরি। শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ ৫-৭টি নদীর হাইড্রোমরফলজিক্যাল, জিও টেকনিক্যাল স্টাডিজ এবং ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট স্টাডি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। এরপর আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আগে দূর করতে হবে। দুর্যোগে শুধু অন্যদের দোষ দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা দুই পক্ষেই রয়েছে। ভারত থেকে পানি এসেছে বিষয়টি যেমন সত্যি, তেমনি আমাদের দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও এই বন্যার জন্য দায়ী। আমাদের নদী-খালগুলো যদি আরও প্রশস্ত আর গভীর হতো তাহলে এত মৃত্যুর মিছিল আজ দেখতে হতো না। ভারত থেকে বন্যার পানি এলেও তা সহজেই বঙ্গোপসাগরে নেমে যেত। তাই আমি মনে করি প্রথম কাজ হচ্ছে আমাদের নিজেদের কাজটুকু সঠিকভাবে করা। এই সংকট কিন্তু বারবার ফিরে আসবে। তাই এখন যারা সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন বিশেষ করে উপদেষ্টামণ্ডলীর সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী-খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর আইন রয়েছে তার প্রয়োগ করতে হবে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। এই জায়গায়ও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এবারের বন্যা মোকাবিলায় ছাত্ররা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, সেটা অবশ্যই প্রসংশনীয়। তবে আমাদের বন্যা ব্যবস্থাপনার পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। উপকূলে যেমন সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে তেমন ফ্লাড রেসকিউ সেন্টার/ টাওয়ার তৈরি করতে হবে। হঠাৎ বন্যা হলে মানুষ যেন সহজেই সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া বন্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব যেমন বোট, নৌকা, লাইফজ্যাকেটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকবে সেখানে। 

এত গেল ভেতরের কথা। আন্তর্জাতিকভাবে ভারত, চীন, ভুটান অর্থাৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিলে আকস্মিক এই বন্যার কারণ খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্বনেতাদের সাহায্য চাইতে হবে। এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই বন্যার কারণ এবং প্রভাবের রিপোর্ট জাতিসংঘের কাছে পেশ করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় আইন কার্যকর না হলে আন্তর্জাতিক আইনে যেভাবে বলা আছে সেভাবেই আমরা নিজেদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই।