
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে চলছে নানামুখী আলোচনা। রাষ্ট্র সংস্কারে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ৬টি কমিশনের একটি হলো ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’। সেই কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আগামীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের নানা দিক নিয়ে তিনি খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ বন্ধ করার পরামর্শ দেবে কমিশন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ পারভীন এলিস।
খবরের কাগজ: আপনি ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ এর প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত হতে যাওয়া এই কমিশনে আর কতজন থাকবেন? বাকি সদস্য কারা হতে পারেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: প্রধান উপদেষ্টা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এ জন্য সম্মানিত বোধ করছি। এটিকে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের স্বীকৃতি মনে করি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আমার অর্জিত অভিজ্ঞতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি আইনি কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছি। কমিশনে কতজন থাকবেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেনি, কার্যপরিধিও নির্ধারণ করা হয়নি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে এ মাসেই পুরো কমিশন গঠিত হবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার ঘুণে ধরা অচলাবস্থা মেরামতে আমরা কাজ করব। এই দেশে আর যাতে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ না থাকে- সেসব বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরব।
খবরের কাগজ: নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে আপনার কমিশনের কর্মপরিকল্পনা কীভাবে এগোবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: কমিশন গঠনের পর আলোচনা করে আমাদের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে। কার্যপরিধির সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন মাস। এই সময়ে আমরা কিছু সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারকে দেব। এর আগে নির্বাচন কমিশনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো রাজনৈতিক দল। তাদের সহযোগিতা না থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
খবরের কাগজ: ইসি নিয়োগে ২০২২ সালের বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: ইসি নিয়োগে ২০২২ সালে করা ওই আইনটি ত্রুটিপূর্ণ, অগ্রহণযোগ্য। ওই আইনের ৯ ধারায় বিগত কমিশনার নিয়োগে দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। তা ছাড়া আইনটি ব্যবহার করে সার্চ কমিটিতে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট দুজন নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বিগত কমিশন নিয়োগের সময় কমিটিতে যুক্ত ছিলেন এবং পরে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন; যা নীতিবহির্ভূত।
খবরের কাগজ: এখনো তো সার্চ কমিটি হয়নি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে কতটা সময় লাগতে পারে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এ বিষয়ে দুই ধরনের মতামত আসছে। কারও মতে দ্রুত সময়ে কমিশন গঠন করা দরকার। আবার কারও মতে খুব কাছাকাছি সময়ে যেহেতু নির্বাচন নাই, সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে কমিশন গঠিত হলে মন্দ হয় না। দেশে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন পর্যায়ক্রমে আসবে।
খবরের কাগজ: কমিশন গঠনের সার্চ কমিটিতে কোন কোন সেক্টরের ব্যক্তিদের প্রাধান্য থাকবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সার্চ কমিটিতে আমরা সরকারের অনুগত কোনো ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখতে চাই না। ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, বিরোধীদলীয় নেতার একজন, তৃতীয় বৃহত্তর দলের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি, নাগরিক (সুশীল) ও ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আইনটি এমনভাবে করতে চাই যাতে ভবিষ্যতে পরিবর্তনের দরকার না হয়।
খবরের কাগজ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিগত আউয়াল কমিশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিগত ওই কমিশন গঠিত হয়েছিল পক্ষপাতদুষ্ট ওই আইনেই। আর বিগত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (গণতন্ত্র)কে রক্ষা করা হয়নি, কারণ ইসির ক্ষমতা ছিল নির্বাচনটা বন্ধ করার, সেটা তারা করেনি। উপরন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারের অনুকূলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হঠাৎ গজিয়ে উঠা অখ্যাত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিয়েছে- যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমরা নতুন আইনি খসড়া করতে চাচ্ছি- যাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। যাতে সার্চ কমিটি ও কমিশনে আগের মতো সরকারের অনুগতদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ না থাকে।
খবরের কাগজ: আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: তাদের সময়কার তিন নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তারা নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
খবরের কাগজ: দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্ভব হতে হবে। তা না হলে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম তারই পুনরাবৃত্তি হবে। আইনি দুর্বলতার চেয়েও বড় ঘাটতি রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। কারণ বর্তমান আইনি কাঠামো দিয়েও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আচরণ বদলায়। শুধু আইনি কাঠামো পরিবর্তন করে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করি না। সম্প্রতি যে গণ-আন্দোলন হলো, বিগত সরকারের যে পরিণতি হলো- সেসব থেকে সব দলকে শিক্ষা নিতে হবে।
খবরের কাগজ: দেখা যাচ্ছে, নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: ভিত্তিহীন মামলা কোনো সময়েই কাম্য নয়। একই সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের ছাড় দেওয়া যাবে না। আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
খবরের কাগজ: প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি ইসিসহ কোনো নিয়োগই দিতে পারেন না- এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটাকে বলা যায় প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার ব্যবস্থা। মূলত রাষ্ট্রপতির হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে সংবিধানে বলাই আছে- প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এর ফলে রাষ্ট্রপতি পদটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। এর পরিবর্তন দরকার মনে করি। সেক্ষেত্রে আশা করি সংবিধান সংস্কারে আমাদের যে কমিশন গঠিত হয়েছে- তারা এ বিষয়ে নজর দেবেন।
খবরের কাগজ: সরকার পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের সবস্তরের একসঙ্গে অপসারণ করা হলো। এটা কতটা প্রয়োজনীয় ছিল?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: যে পরিস্থিতিতে সেটা করা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক কোনো প্রেক্ষাপট নয়। বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিই আত্মগোপনে ছিলেন। আর কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি পলাতক, আর কারা পলাতক নন- বেছে বেছে তাদের অপসারণ করা সম্ভবপর ছিল না, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘটেছে। এখন এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব নির্বাচনই হবে।
খবরের কাগজ: পরিকল্পনাধীন নতুন কমিশনে যারা আসবেন তাদের সততা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের মানদণ্ড কী হবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটা তো পাল্লা দিয়ে মাপার বিষয় না। তবে কমিশনে যাদের বিবেচনা করা হবে- তাদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। এর ফলে এই সব ব্যক্তির ব্যাপারে যদি কোনো অভিযোগ বা অপকর্ম থাকে সেগুলো জানার সুযোগ হবে। বিতর্কিত লোকদের ইসির কমিশনে দায়িত্বে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
খবরের কাগজ: কমিশন গঠনের পর কোন নির্বাচন আগে হবে- পরিকল্পনা কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সেটা সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। যেটা মনে হচ্ছে- রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দাবি মিটিয়ে জাতীয় নির্বাচন করতে সময়ের দরকার হবে। কাজেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনই আগে করতে হবে। সেটা সিটি করপোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হতে পারে। সিটি নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদও শেষের দিকে। কারণ প্রশাসক নিয়োজিত থাকবে ৬ মাসের জন্য। অনেকগুলো নির্বাচনই সামনে করতে হবে। নতুন কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।
খবরের কাগজ: বিগত কমিশনের সিইসি রাষ্ট্র পরিচালনায় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। এই সংস্কার প্রস্তাব তিনি ছাড়া আরও অনেকেই করেছেন। অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরাও এমন প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সংসদে একদলের আধিপত্যসহ কিছু সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আছে আবার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কারের কমিটিকেও বিবেচনা করতে বলব।
খবরের কাগজ: একটি প্রশ্নাতীত স্বচ্ছ নির্বাচনব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এই ব্যবস্থা হঠাৎ করে নিশ্চিত করা সম্ভব না। দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে সঠিক নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে- যারা দক্ষ, সাহসী, সুষ্ঠু নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখেন। একই সঙ্গে দরকার হবে প্রশাসনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সর্বাত্মক পক্ষপাতমুক্ত সহযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা সদাচরণ করবেন- তারা ভোট কেনার চেষ্টা ও পেশিশক্তি প্রয়োগ করবেন না। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সত্য ও সঠিক তথ্য তুলে ধরবে। বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় যেটা তারা করতে পারেনি। ভোটার এবং নাগরিক সমাজকে এক্ষেত্রে তাদের ভোটাধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে।
খবরের কাগজ: আওয়ামী লীগ এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত একটি দল। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনি সুষ্ঠু পরিবেশের কোনো ব্যত্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমি আশা করি, আগামীতে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে দলটি পুনর্গঠিত হবে। নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।
খবরের কাগজ: খবরের কাগজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: খবরের কাগজের জন্য শুভকামনা।