
তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের মতো মেয়র হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন। শপথ নেয়ার আগে খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার নতুন স্বপ্ন, পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের মাধ্যমে নান্দনিক চট্টগ্রাম গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খবরের কাগজের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ইফতেখারুল ইসলাম।
খবরের কাগজ: কখনো চিন্তা করেছিলেন, আপনাকে মেয়র ঘোষণা করা হবে?
ডা. শাহাদাত হোসেন: আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। অরাজকতা, ভোট ডাকাতির একদিন অবসান হবেই। কারণ সবকিছুরই শেষ আছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলেও দেখা যায় স্বৈরাচার, একদলীয় শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন টিকতে পারেনি। যেমন এরশাদের পতন হয়েছিল। এদেরও একদিন না একদিন পতন হবে, সেই বিশ্বাস আমার ছিল। যে কারণে কেউ মামলা না করলেও আমি করেছি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ৬টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন হয়। সে সময় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি আসনেও ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে আমি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করি। যেকারণে ইভিএম সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা হয়। চসিক নির্বাচনও ইভিএমের মাধ্যমে হয়। তারা মনে করেছিল আমি ভোটের ফলাফল সংগ্রহ করব না, কিংবা ফলাফল না দেখে প্রত্যাখ্যান করব। তাদের কাছে নির্বাচনের ফলাফল চাইলে তারা আমাকে তা হাতে লিখে দেন। হাতে লেখা ফল না মেনে আমি আদালতের আশ্রয় নিয়েছি। সাড়ে তিন বছর আইনি লড়াই করার পর আদালত আমাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন। আসলে সবকিছু আল্লাহতায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন।
খবরের কাগজ: দায়িত্ব নিয়ে কোন কাজটি প্রথমে শুরু করবেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: জনগণের যে কাজে সবচেয়ে বেশি চাহিদা সেই কাজটিতে হাত দিতে চাই। তা হলো জলাবদ্ধতা নিরসন। এর মূল কারণ চিহ্নিত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। যদিও প্রকল্পটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের জন্য বিশাল সরকারি বরাদ্দ রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা বেশকিছু অর্থ খরচও করেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার জন্য সৃষ্ট দুর্ভোগের দায় সাধারণ মানুষ চসিকের ওপর চাপায়। এই দায়বদ্ধতা থেকেই চউকের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতি শুষ্ক মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন করতে চাই। মানুষ যাতে দৃশ্যমান একটি রেজাল্ট পায় সেই চেষ্টা থাকবে।
খবরের কাগজ: অতীতে যারা চসিকের মেয়র ছিলেন তারাও চউকের সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফলতা সেভাবে আসেনি। আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ডা. শাহাদাত হোসেন: মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। সিটি গভর্নমেন্ট যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে সব নাগরিকসেবা এক জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ হতো। তখন পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব হতো। চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন সিটি গভর্নমেন্ট বাস্তবায়ন হবে। সিটি গভর্নমেন্টের মূল কনসেপ্ট হলো সব সেবা সংস্থা এক ছাতার নিচে থাকবে। সব সেবাদানকারী সংস্থার সিদ্ধান্ত এক জায়গা থেকেই হবে। বর্তমানে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন একটি সড়কের সংস্কার কাজ করল। এরপর চট্টগ্রাম ওয়াসা এসে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দিল। পরে এল পিডিবি। কারণ কে কখন কোন সড়কে কাজ করবে তা অন্য সংস্থা জানে না। যদি সিদ্ধান্তটা এক জায়গা থেকে হতো তাহলে সব খোঁড়াখুঁড়ি শেষ করার পর সড়কটির সংস্কার করা হলে রাষ্ট্রের অর্থ যেমন বাঁচত, তেমনি জনদুর্ভোগও অনেক কম হতো।
খবরের কাগজ: বর্তমান প্রেক্ষাপটে চসিকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কোনটি?
ডা. শাহাদাত হোসেন: দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিচ্ছন্নতা। সাধারণ মানুষ যাতে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলতে না পারে সেজন্য সচেতনতা কর্মসূচির পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান চালানো হবে। কোনো দোকানের সামনে ময়লা থাকলে ওই দোকানদারকে শাস্তি দেওয়া হবে। ককশিট এবং পলিথিনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব। আমার নেতা-কর্মীসহ দলমত নির্বিশেষে শহরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এই আন্দোলনে শামিল করব। সবাইকে নিয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই। তা ছাড়া পচনশীল আবর্জনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তা সম্পদে পরিণত হয়। এগুলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। সেটি নিয়ে ভাবব। মোট কথা, একটি নান্দনিক চট্টগ্রাম গড়ে তুলব।
খবরের কাগজ: দেশের একমাত্র সিটি করপোরেশন হলো চসিক যেখানে নগরবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। একজন চিকিৎসক হিসেবে এই খাতের উন্নয়নে আপনি কি করবেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগের অবস্থা খুবই বাজে। এখানে ৪১টি ওয়ার্ডে যেসব কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল সেসবের কাঠামোগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। পাশাপাশি চসিকের মেমন হাসপাতাল যেখানে মাতৃসেবা এবং শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এই হাসপাতালের অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। এগুলোকে সেবাদানের উপযোগী করা হবে। স্বাস্থ্যসেবাকে গতিশীল করব।
খবরের কাগজ: চসিক এখনো চলছে মান্ধাতার আমলের জনবলকাঠামো দিয়ে। এখানে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: জনবল কাঠামো নিয়ে আমি স্টাডি করা শুরু করছি। জনবলের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। কোথাও ছদ্ম বেকার আছে কি না, কিংবা কেউ কাজ না করে বেতন নিয়ে যাচ্ছে কি না সবকিছু গুরুত্বসহকারে দেখব। কারণ আমি নগর পিতা নই, সেবক হতে এসেছি। চসিকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেবকের মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে।
খবরের কাগজ: চসিকের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি নেই। অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
ডা. শাহাদাত হোসেন: আয়বর্ধক যেসব প্রকল্প নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলোকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে এনে চসিকের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করব। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চসিক যে রাজস্ব পায় তা ন্যায্য নয়। তারা এতদিন ধরে চসিককে ঠকিয়ে যাচ্ছে। অথচ বন্দরের সব ধরনের ভারী যানবাহন চসিকের সড়কগুলো ব্যবহার করছে। তাতে সড়কগুলো নষ্ট হচ্ছে। সড়ক মেরামতে চসিককে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আমরা বন্দরকে যে লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছি আশা করছি তার বিনিময় তারাও চসিককে দেবে।
খবরের কাগজ: নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার সব মনে আছে?
ডা. শাহাদাত হোসেন: ‘নগর পিতা নয়, নগর সেবক হতে চাই’ এই স্লোগানে ইশতেহার ঘোষণা করেছিলাম। ২০২১ সালে নির্বাচনে স্বাস্থ্যবান্ধব নগর গড়তে জলাবদ্ধতা নিরসন, শিশু হাসপাতাল, মাতৃসদন, ট্রমা সেন্টার ও বিশেষায়িত হাসপাতাল, গ্রিন ও ক্লিন সিটি, মাদক সন্ত্রাস নির্মূলসহ আমার ৭৫টি প্রতিশ্রুতি ছিল। অল্প সময়ে তা বাস্তবায়ন কঠিন হলেও চেষ্টা করে যাব।
খবরের কাগজ: সরকার পতনের পর চসিকে এখন কাউন্সিলর নেই। তাদের ছাড়া কাজ কীভাবে আগাবেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি তারা যথেষ্ট দক্ষ ও আন্তরিক। তাদের নিয়ে কাজ করতে তেমন অসুবিধা হবে না।
খবরের কাগজ: চসিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিম্নমুখী। এ বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
ডা. শাহাদাত হোসেন: শিক্ষার মান বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রয়োজনে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেব। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি এবং ক্লাসের পড়া ক্লাসে যাতে আদায় হয় তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করব। নিজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারপ্রাইজ ভিজিট করব।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. শাহাদাত হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।