দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক। বিএনপির নেতা হওয়ার কারণে ১৯ বছর তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। শুধু তাই নয় মা, বাবা এবং ছোট ভাইয়ের লাশও দেশে এনে কবর দিতে পারেননি তিনি। এসব কষ্টের কথা সম্প্রতি দেশে ফিরে খবরের কাগজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি। গুলশানের একটি হোটেলে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের ডেপুটি বিজনেস এডিটর ফারজানা লাবনী।
খবরের কাগজ: ১৯ বছর আপনার দেশে না ফেরার কারণ কী?
এম এ মালিক: শুধু বিএনপির রাজনীতি করার কারণে ১৯ বছর আমাকে ও আমার পরিবারকে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে নিজের জন্মস্থানে আসতে দেয়নি। আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল, দেশের মাটিতে যেন তার কবর দেওয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা আমাদের সে সুযোগ দেননি। আমার মায়ের লাশ দেশে আনতে পারিনি। এমনকি আমার বাবা ও ছোট ভাইয়ের লাশও দেশে এনে কবর দিতে পারিনি। মাতৃভূমির জন্য মন কেঁদেছে। চোখের পানি ফেলেছি। দেশে আসতে পারিনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে এসেছি। ১৯ বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেছি। এ আনন্দ-অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
খবরের কাগজ: দেশে ফেরার পর অনুভূতি কী?
এম এ মালিক: কর্মী ছিলাম, এটাই অপরাধ। শেখ হাসিনার সরকার আমার পাসপোর্ট আটকে রেখেছিল। আপনি বলেন, কেমন লাগবে- যদি কাউকে নিজের আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনসহ বন্ধুদের সঙ্গে ১৯ বছর দেখা করতে না দেওয়া হয়! নিজের বাড়িঘর দেখতে দেওয়া না হয়! আমি এই দেশের, মাটির মানুষ। মাটির প্রতি টান অনুভব করতাম। ছুটে চলে আসতে ইচ্ছা করত। কিন্তু পারিনি। দেশে আপনজনদের অনেকে অসুস্থ হয়েছেন। আমার দেখতে ইচ্ছা করেছে। অনেকে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু পারিনি। আমার মা-বাবা ও ভাইকেও দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। তাদের অপরাধ ছিল, তারা আমার আপনজন। তারা বারবার দেশে আসতে চাইতেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, দেশে আসতে পারছেন না। তারা তখন আমাকে বলেছিলেন মারা গেলে দেশেই যেন কবর দেওয়া হয়। তাও সম্ভব হয়নি। অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাসপোর্ট ফিরে পেয়েছি। আমি দেশে আসার পর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও রাজনৈতিক নেতাসহ সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। আমি আবেগাপ্লুত।
খবরের কাগজ: শোনা যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন….
এম এ মালিক: আমি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার মানুষ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমার বাথরুমের কমোড পর্যন্ত খুলে নিয়ে গিয়েছে। এখন দল যদি যোগ্য মনে করে, নমিনেশন দেয়, তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। বিদেশে যাওয়ার আগে দেশে সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিদেশে গিয়েও বিএনপির রাজনীতিতেই যোগ দিয়েছি। একসময় যুক্তরাজ্য বিএনপি শাখা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছি।
খবরের কাগজ: বিদেশে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে কতটা সোচ্চার ছিলেন?
এম এ মালিক: আমি সব সময়েই জনমানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করেছি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সব সময়ে প্রতিবাদ করেছি। বিশেষভাবে ওয়ান-ইলেভেনের পরে যুক্তরাজ্যে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমরা প্রবাসে থেকেও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। প্রায় দিনই দেশের মানুষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। আন্দোলনের রূপরেখা দিয়েছি। ২০২৩ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের সময় ওয়াশিংটনে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছি। সে সময় কর্মসূচি প্রত্যাহার করার জন্য আমাকে আলোচনায় বসতে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দি করে রেখে আমাকে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়। আমার নেতা তারেক রহমানকে প্রবাসে থাকতে বাধ্য করেছে। তার সঙ্গে কিসের চা খাওয়া! গত ১৭ বছর এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সুমনসহ বিএনপির ৬ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। দেশটাকে একটা দল ও পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল। যারা তথাকথিত উন্নয়নের নামে আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে দেড় লাখ টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে হাজার হাজার, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সব সময় আমি সোচ্চার ছিলাম।
খবরের কাগজ: আগামী দিনে বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে?
এম এ মালিক: বিএনপি জনগণের দল। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফ্যাসিস্ট সরকার তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে দেয়নি। কিন্তু তাকে কি দেশের জনগণের ভালোবাসা থেকে দূরে রাখতে পেরেছে? পারেনি। তারেক রহমান সারা দেশের লাখ-কোটি বিএনপির নেতা-কর্মীর সঙ্গে যুক্ত আছেন। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি এমনভাবে দলটিকে গড়ে তুলেছেন যে বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপি। সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী। তারেক রহমান সব আইনি বিষয় মোকাবিলা করে অচিরেই বাংলাদেশে আসবেন ইন্আশাল্লাহ।
খবরের কাগজ: বিএনপি সাধারণ মানুষের কতটা কাছের দল?
এম এ মালিক: শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে দেশ থেকে পালিয়ে যাননি। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বহুবার বিদেশে গিয়ে আরাম-আয়েশে জীবন কাটানোর সুযোগ পেয়েও যাননি। তিনিও জীবনবাজি রেখে দেশ গড়ার কাজ করেছেন। ফ্যাসিস্ট সরকার তার সঙ্গে কী করেছেন, তা আপনার দেখেছেন। তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এরই নাম দেশপ্রেম। এমন দুই ব্যক্তির সন্তান তারেক রহমান। তার নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ। তারেক রহমান কখনো দেশ বিক্রি করে দেবেন না- এই বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যায়।
খবরের কাগজ: ভারতের সঙ্গে বিএনপির কি বৈরী সম্পর্ক? ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকলে সমস্যা হওয়ার কথা। এ বিষয়ে বিএনপির নীতিগত অবস্থান কী?
এম এ মালিক: বিএনপি কারও সঙ্গে বৈরিতায় বিশ্বাস করে না। ভারতের সঙ্গেও না। তবে সম্পর্ক হবে সম্মান ও বন্ধুত্বের। কারও কাছে নতিস্বীকার করে নয়। সেটা যত বড় রাষ্ট্রই হোক। কেউ বলতে পারবেন না যে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কারও কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। একই কথা বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কেও কেউ বলতে পারবেন না। ভারতের কাছে নতিস্বীকার করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বিএনপি চায় না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ বজায় রেখে সম্পর্ক রাখতে চায় বিএনপি।
খবরের কাগজ: বিএনপি দেশের কেমন সংস্কার দেখতে চায়?
এম এ মালিক: আমার নেতা তারেক রহমান এরই মধ্যে জানিয়েছেন, বিএনপি সেই সংস্কার করতে চায় যার মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। যে সংস্কার করলে বেকার সমস্যার সমাধান, নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। যে সংস্কার করলে দেশের সন্তানরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
খবরের কাগজ: আগামী নির্বাচনের পরে দেশ পরিচালনায় বিএনপি কী ভাবছে?
এম এ মালিক: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস অতিদ্রুত দেশে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন বলে বিএনপি আশা করে। তারেক রহমান জানিয়েছেন, প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন অথচ দেশ গঠন, উন্নয়ন ও পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী এমন অসংখ্য জ্ঞানী মানুষকে দেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত করা হবে। বিশেষ করে গুণী শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, চিকিৎসক, কারিগরি বিশেষজ্ঞ, মানবতাকর্মীদের কাজে লাগানো হবে। তাদের সেবা আর অবদান দেশের কাজে লাগাতে বিএনপি পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত করতে চায়। বিএনপি দেশ গড়তে প্রশ্নহীন জাতীয় ঐক্য করতে চায়। জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি আগামীতে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত করতে চায় বলে এরই মধ্যে আমার নেতা তারেক রহমান জানিয়েছেন। এ দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরও বিএনপি মূল্যায়ন করবে।