
দেশের আইসক্রিম কোম্পানিগুলো আগের তুলনায় অনেক আধুনিক। কিন্তু তারপরও মাথাপিছু আইসক্রিমের চাহিদা উন্নত দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য। আইসক্রিমের পরিবেশ, গুণগত মান, চাহিদা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে বাংলাদেশ আইসক্রিম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ রানার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন।
খবরের কাগজ: বর্তমানে আইসক্রিমের বাজার সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাসুদ রানা: একটা সময় ছিল যখন গ্রামের পথে পথে আইসক্রিম বিক্রি করা হতো। চাল বা ফেলে দেওয়ার পণ্য দিয়ে বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই সেই আইসক্রিম খেতেন। গ্রামের কোনো একটি বরফ কলে বরফ তৈরি করা হতো, সেখানেই দুধ এবং চিনি মিশিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে গ্রামের পথে প্রান্তে বিক্রি হতো। সেই ধারণা থেকেই এখন আইসক্রিমে বাণিজ্যিক বিনিয়োগ হচ্ছে। শত শত কোটি টাকা ব্যবসা হচ্ছে। আমরা যেটা চাই সেটি হচ্ছে, আইসক্রিম যেহেতু একটি ভোগ্যপণ্য। তাই এর মান যেন অবশ্যই ঠিক থাকে। কারণ আইসক্রিম অন্য যেকোনো খাবারের চেয়ে আলাদা। পণ্যটি যখন আইসযুক্ত থাকে তখন এক ধরনের টেস্ট থাকে, আর সেটি যদি আপনি পাঁচ মিনিট কুলারের বাইরে রাখেন তাহলে এর টেস্ট সম্পূর্ণ বদলে যাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি খাবারের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। তাই আমরা আমাদের পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোর কাছে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি, আইসক্রিমের মান নিয়ে কোনো আপস করা যাবে না।
খবরের কাগজ: দেশে বর্তমানে কোন ব্র্যান্ডগুলো আইসক্রিম তৈরি করছে। এ খাতে বিনিয়োগ কেমন?
মাসুদ রানা: দেশে অনেকগুলো ব্র্যান্ডের আইসক্রিম এখন বাজারজাত হচ্ছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে ইগলু, পোলার। এ ছাড়া গত পাঁচ সাত বছরে লাভেলা, কোয়ালিটি, জা এন জি, ব্লুপ ও স্যাভয় বাংলাদেশের বাজারে আইসক্রিম বাজারজাত করছে। ঢাকায় বা শহরাঞ্চলে যেসব কোম্পানিগুলো আইসক্রিম তৈরি করে বাজারজাত করছে তাদের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকগুলো সংস্থা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের ভিন্নতা পাওয়া গেলে ক্রেতারাই সেগুলো নিয়ে অভিযোগ করে প্রতিকার পাচ্ছেন। কিন্তু শহরের বাইরে যেসব লোকাল কোম্পানিগুলো আইসক্রিম তৈরি করছে সেগুলোর মান যাচাই করা হয় না। কিন্তু সেসব আইসক্রিমেরও একটি বড় বাজার আছে, যা বাচ্চারা খাচ্ছে। ফলে মান শুধু শহরের দিনে যাচাই না করে গ্রামাঞ্চলেও উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আমরা সে কাজটিই করার জন্য বেশি জোর দিচ্ছি। সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করছি।
খবরের কাগজ: দেশের বর্তমানে আইসক্রিমের চাহিদা কেমন?
মাসুদ রানা: আইসক্রিম যেহেতু একটি গ্রীষ্মকালীন পণ্য। তাই দেশে যখন গরম আবহাওয়া বেশি হয় তখনই এর চাহিদা বাড়ে। আমাদের যেহেতু ছয় ঋতুর দেশ তাই বছর ধরে এর চাহিদা থাকে না। বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়টিকে আইসক্রিম কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক সময় হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। যদিও কম বেশি সারা বছরই আইসক্রিমের চাহিদা থাকে। আমাদের দেশে কোভিডের সময় বলা হয়েছিল সব ব্যবসা স্থবির হয়ে গেছে। কিন্তু সে সময়ে আমি থাইল্যান্ডের একটি আইসক্রিম কোম্পানিতে কাজ করেছি। কিন্তু সেখানে কিন্তু ব্যবসা বন্ধ হয়নি। কোভিডের সময়ে মানুষ ঘরে সময় কাটিয়েছে। ফলে তারা রিল্যাক্সের সময় কোন ধরনের আইসক্রিম খেতে পছন্দ করবে সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, গবেষণা হয়েছে। তখন আমরা তরমুজ আর আনারস ফ্লেভারের দুটি পণ্য বাজারজাত করি। এটির খুবই সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের দেশের প্রতি বছর মাথাপিছু আইসক্রিম খাওয়ার চাহিদা মাত্র ৩৩ গ্রাম। মানে প্রতি বছরে একজন মানুষ মাত্র ৩৩ গ্রাম করে আইসক্রিম খেয়ে থাকে। যেখানে নিউজিল্যান্ডে মাথাপিছু আইসক্রিম খাওয়ার চাহিদা ২৮ কেজি। আমাদের এই সেক্টরের নতুন বিনিয়োগ বলেন আর কোম্পানি সম্প্রসারণ বলেন, দুটির জন্যই কিন্তু আগে আইসক্রিমের বৈচিত্র্যতা আনতে হবে। তাহলেই এখানে নতুন বিনিয়োগ হবে। মানুষের আইসক্রিম খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হবে।
খবরের কাগজ: বাচ্চাদের জন্য আর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একই আইসক্রিম, এটা কি যৌক্তিক?
মাসুদ রানা: আমি এজন্যই আইসক্রিমের বৈচিত্র্যতার কথা বলছিলাম। বাচ্চাদের বা শিশু খাদ্য আর প্রাপ্তবয়স্কদের খাদ্য কখনো এক হতে পারে না। আইসক্রিমের যখন বিজ্ঞাপন দেখানো হয় তখনো কিন্তু বাচ্চাদের সঙ্গে বড়রা আইসক্রিম খাচ্ছে সেটিই দেখানো হয়। মানে এই আইসক্রিম সবাই খেতে পারবে। আমরা মনে করি, এটা কখনো সত্য না। বরং কোম্পানিগুলোর অবশ্যই বাচ্চাদের জন্য আলাদা ফ্লেভারের আইসক্রিম বাজারজাত করা উচিত। এবং বড়দের জন্য আলাদা। আপনি দেখবেন আইসক্রিম যখন মোড়কজাত থাকে বা ফ্রিজিং বক্সে থাকে তখন এক রকম থাকে। এর স্বাদ এক ধরনের থাকে। কিন্তু আপনি যদি সেই আইসক্রিমই পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে রাখেন বা খোলা বাতাসে রেখে দেন তাহলে সেটির প্রকৃতিই পরিবর্তন হয়ে যাবে। এমনো হতে পারে, সেটি আর খাওয়ার উপযুক্তই থাকে না। আপনি যদি স্ট্রবেরি আইসক্রিমের কথা বিবেচনা করেন, তাহলে এর মধ্যে যে সল্ট থাকে বা সে পরিমাণ কেমিক্যাল থাকে সেটি বাচ্চাদের জন্য কখনো উপযুক্ত হতে পারে না। কিন্তু সেগুলো বাচ্চাদের খাওয়ানো হচ্ছে বা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাই নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র বলতে গেলে, কোম্পানিগুলোকে এদিকে নজর দেওয়া উচিত। তাহলেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদাও বাড়ানো সম্ভব হবে।
খবরের কাগজ: এ শিল্পের বিনিয়োগ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বলবেন?
মাসুদ রানা: বাংলাদেশের আইসক্রিম শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বর্তমানে বাজারের বার্ষিক আকার প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার এবং এটি প্রতি বছর গড়ে ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক কোল্ড চেইন অবকাঠামো, ডেলিভারি সিস্টেম ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের প্রসার এই প্রবৃদ্ধিকে আরও বেগবান করছে। উন্নত প্রযুক্তি, ইনোভেটিভ ফ্লেভার, স্বাস্থ্যবান্ধব উপাদান এবং রিটেইল/ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তারা সহজেই বাজারে প্রবেশ করতে পারে। তা ছাড়া দেশের বাইরে (বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও প্রবাসী-বাংলাদেশিদের জন্য) ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ডেড’ আইসক্রিম রপ্তানির সম্ভাবনাও ভবিষ্যতের জন্য এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হতে পারে। সরকার যদি শুল্ক ও কর কাঠামোতে বিনিয়োগবান্ধব সুবিধা দেয় এবং কোল্ড চেইন অবকাঠামোতে সহায়তা করে, তাহলে এটি একটি এক্সপোর্ট-ওরিয়েন্টেড শিল্পেও পরিণত হতে পারে।
খবরের কাগজ: আইসক্রিমের স্বাস্থ্যগত দিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মাসুদ রানা: দেশীয় কোম্পানিগুলো বিএসটিআই, বিএফএসএ, ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদিত উপাদান ব্যবহার করে। তবে আইসক্রিমে যদি ইমালসিফায়ার ও স্টেবিলাইজার নিরাপদ মাত্রায় ব্যবহৃত হলে সেটিকে ঝুঁকিমুক্ত বলা যায়। এ ছাড়া রং ব্যবহারেরও নীতিমালা আছে। সেটিও মেনে চলা উচিত।
খবরের কাগজ: আপনাদের পক্ষ থেকে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর কোন ধরনের দুর্বলতা পেয়েছেন?
মাসুদ রানা: দেশে যেসব ব্র্যান্ডের আইসক্রিম পাওয়া যায় সেগুলো নিয়ে আমরা অনেকবার কাজ করেছি। সব কোম্পানির আইসক্রিমের এক ধরনের সমস্যা আমরা পাইনি। বরং একেক কোম্পানির আইসক্রিমে একেক ধরনের সমস্যা পেয়েছি। যেমন পোলার ব্র্যান্ডের আইসক্রিম দেশে অনেক জনপ্রিয়। এই কোম্পানির সুগার ফ্রি কোনো পণ্য নেই। তারা যদি বাজারে সুগার ফ্রি আইসক্রিম বাজারজাত করে তাহলে হয়তো তাদের বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। ইগলু ব্র্যান্ড দেশে-বিদেশে সমানভাবে জনপ্রিয়। এই কোম্পানিটি ইউরোপিয়ান মানদণ্ড ফলো করে এবং তাদের পণ্যের ফ্লেভারও আন্তর্জাতিক মানের। তবে এই কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল দুর্বল। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে তাদের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল আরও জোরদার করা উচিত। বেলিসিমো ব্র্যান্ডের আইসক্রিমও বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে। তারা মূলত প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বাজারজাত করে থাকে। উচ্চ মূল্য ছাড়া তাদের পণ্যের গুণগত মান ভালো। লাভেলো আইসক্রিমের বিরুদ্ধে কৃত্রিম রং ব্যবহারের অভিযোগ আছে এবং স্যাভয় আইসক্রিমের যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সে তুলনায় তাদের পণ্যের মান আরও বাড়ানো উচিত।
খবরের কাগজ: আইসক্রিম তৈরিতে পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এ সম্পর্কে আপনাদের কোনো পরামর্শ আছে কি না।
মাসুদ রানা: আইসক্রিম তৈরির জন্য পানি অত্যাবশ্যক একটি উপাদান। কোম্পানিগুলো দুটি উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে। একটি প্রাকৃতিক উৎস অপরটি অভ্যন্তরীণ উৎস। কোম্পানিগুলো যে পানি ব্যবহার করে সেটিও বিএসটিআই টেস্ট হয়। এবং তারা যে পানি প্রক্রিয়াজাত করে আইসক্রিম তৈরির জন্য নির্বাচন করে প্রথম সেই পানি দিয়ে আইসক্রিম তৈরি করা হয়। সেই আইসক্রিম আবার তারা তাদের নিজস্ব ল্যাবে বা বিএসটিআই দিয়ে পরীক্ষা করায়। ফলে আপনি যে ফ্লেভারের আইসক্রিম তৈরি করতে চাচ্ছেন বা যে কোয়ালিটির আইসক্রিম তৈরি করতে চাচ্ছেন সেটি অনেকটাই এই পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থেই পানিকে সর্বোচ্চ প্রক্রিয়াকরণ করে ব্যবহার উপযুক্ত করে থাকে। তবে, লোকালে যেসব আইসক্রিম তৈরি হয় সেগুলোর আবার ভিন্ন। সেখানে আমাদের কাজ করার জায়গা আছে। আমরা সে কাজটিও করছি।
খবরের কাগজ: আইসক্রিম শিল্পের উন্নয়নে কী কী উদ্যোগ নিচ্ছেন, সে সম্পর্কে বলবেন?
মাসুদ রানা: আমরা বাংলাদেশ আইসক্রিম ফোরাম গঠন করেছি। দেশের আইসক্রিম শিল্পকে আধুনিক, টেকসই ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা নিয়মিতভাবে উদ্যোক্তা, পেশাজীবী এবং নতুন আগ্রহীদের জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করছি, যাতে তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং মান নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী হন। স্থানীয় আইসক্রিম পণ্যের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য আমরা গবেষণা, পরামর্শ এবং মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকি। ফোরামটি দেশের ভেতর ও বাইরে আইসক্রিম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করছে, যা বাজার সম্প্রসারণ ও জ্ঞান বিনিময়ে সহায়ক। আমরা নতুন উদ্যোক্তাদের আইডিয়া ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যান্ডিং ও বাজার বিশ্লেষণে সহায়তা দিচ্ছি, যেন তারা টেকসইভাবে বাজারে প্রবেশ করতে পারেন। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে আমরা শিল্পবান্ধব নীতিমালা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছি।