
ভৌগোলিক কারণেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলেরই সফল কৃষি উদ্যোক্তা মুনজের আলম মানিক। ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ-আইসিএমএবি থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে যোগ দেন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে গড়ে তুলেছেন বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ। সেখানে তিনি আমসহ হাঁস, মুরগি ও নানা জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। আমের উৎপাদন, দাম, বাজার ও রপ্তানি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে মুনজের আলম মানিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম।
খবরের কাগজ: এবার আমের ফলন কেমন হয়েছে। দাম কেমন হবে?
মুনজের আলম মানিক: চলতি বছরে আমের ফলন ভালো হয়নি। বৈরী আবহাওয়া আর প্রচণ্ড তাপে মুকুল ঝরে গেছে। আবার বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে চাহিদামতো পানি সরবরাহ করা হয়নি। অনেকে কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহার করছেন। এসব কারণে আমের উৎপাদন কম হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব থেকে শুরু করে বাগানমালিকরাও বলছেন এবার আমের উৎপাদন অনেক কম হবে। পুরোনো গাছের আম চার ভাগের এক ভাগে নেমে যাবে। আর নতুন গাছের আম অর্ধেক হবে। তাই সব মিলে বলা যায় এবার আমের উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কম হবে। তাই আমের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি হবে।
খবরের কাগজ: ঢাকাতে আমে ভরে গেছে। এগুলো কেমন আম। ভালো আম কখন পাওয়া যাবে?
মুনজের আলম মানিক: ঢাকাতে কী আম পাওয়া যাচ্ছে তা দেখার বিষয় না। অনেকে বলছেন, সাতক্ষীরার আম। কিন্তু কয়েকদিন আগে তো দেখলাম সাতক্ষীরাতেই কেমিক্যাল যুক্ত আম ধ্বংস করা হয়েছে। সরকার আমের ক্যালেন্ডার ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী আম পাড়তে হবে, বাজারজাত করতে হবে। দেখার বিষয় হচ্ছে পরিপক্ব, রসালো ও সুস্বাদু আম কি না। এই সুস্বাদু আম পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এবারের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গোপালভোগ আম মে মাসের শেষে পাওয়া যাবে। খুবই পছন্দের খিরসাপাত আম পাওয়া যাবে মের শেষ দিন বা ৩-৫ জুনে। তারপর ন্যাংড়া, ফজলি আসবে বাজারে। এসব সময়ে ভালো আম পাওয়া যাবে।
খবরের কাগজ: ভেজাল আম চিনব কীভাবে? স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি জেনেও কেন এসব বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে?
মুনজের আলম মানিক: ভেজালের মূল কারণ হলো অতি মুনাফা। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অসময়ে কেমিক্যাল বা কার্বাইড রং মিশিয়ে আম বিক্রি করে। অসময়ে এভাবে রং মেশানোর কারণে আমের রং ফ্যাকাশে হলদে হয়ে যায়। প্রকৃতগতভাবে পাকা আম কখনো এভাবে হলুদ হবে না। মৌসুমের সময় যে আমের রং তা এত হলুদ হবে না। ভোক্তারা একটু সচেতন হলেই ভেজাল আম চিহ্নিত করতে পারবেন। এক কথায় যে আম যখন পাকার কথা তার আগে বাজারে পাওয়া গেলেই বুঝতে হবে এটা ভেজাল আম। কেমিক্যাল যাতে না মেশানো হয়, সে জন্য কঠোর নজরদারি করছেন জেলা প্রশাসকরা।
খবরের কাগজ: আম সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। কোল্ড স্টোরেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে এটা রোধ করা সম্ভব কি?
মুনজের আলম মানিক: মুকুল ধরার পর পাকার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ৪০ শতাংশ আম ঝরে পড়ে। বয়স না হলে আম পাকে না। অনেকে কেমিক্যাল নিয়ে রং করে বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু কোনো স্বাদ পাওয়া যায় না। আবার আম পাকার সময় হলে তাকে গাছে ধরে রাখা যায় না। গাছ থেকে পাড়তে বা নামাতে হবে। এরপর হাত বদল হয়ে বাজারে বা হাটে বিক্রি হয়। স্বাভাবিকভাবেই তা সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন থাকে। এ পর্যায়ে ১০ শতাংশ আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আলু বা ফলের মতো সংরক্ষণ করে কোল্ড স্টোরেজে রাখা যায় না। ভারতসহ পৃথিবীর কোনো দেশেও এটা সম্ভব হচ্ছে না। তা সম্ভব হলে আমাদের দেশে অনেকের যে কোল্ড স্টোরেজ আছে তারা সংরক্ষণ করতেন।
খবরের কাগজ: কোন এলাকার আম বেশি ভালো। কখন পাওয়া যাবে।
মুনজের আলম মানিক: এক সময় আমের রাজধানী নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি ছিল। রাজশাহী জেলার আওতাভুক্ত হওয়ায় অনেকে রাজশাহীর আম বলে। কিন্তু আসলে ভারতের মালদহ জেলাঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমই সেরা। শিল্পমন্ত্রণালয়ের সিআই সনদ প্রাপ্ত আমের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত, ন্যাংড়া, ফজলি ও আশ্বিনা আমও স্থান পেয়েছে। অন্য জেলার আম তো এত জিআই সনদ পায়নি। এটাও একটা ভালো আমের নির্ধারক বলা যায়।
খবরের কাগজ: প্রতিবছর আমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দাম কমছে না কেন? প্রতিবছরই বাড়ছে দাম।
মুনজের আলম মানিক: আগে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আমের বাগান করত। কিন্তু গত এক দশক থেকে উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে আমের বাগান হচ্ছে। এতে বাগানের পরিচর্যাসহ কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহারও বহুগুণ বেড়ে গেছে। গত বছর খিরসাপাত আম ১৮০০ টাকা মন শুরু করে শেষ পর্যন্ত ৫০০০ টাকায় ঠেকে। গোপালভোগও ১৮০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত মন বিক্রি হয়। এবার অনেক বেশি হবে। শুরুটাই ৩০০০ টাকা মন ছাড়িয়ে যাবে। কারণ আমের ফলন একেবারে কম হয়েছে।
খবরের কাগজ: আমের বাজার কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায়? সে ধরনের কাজে সরকারের কি সহযোগিতার দরকার আছে?
মুনজের আলম মানিক: আম পাকলে যেহেতু বেশি দিন বাগানে ধরে রাখা যায় না। তাই আলুর মতো আমেরও বাই-প্রোডাক্ট বা বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ খাবার উৎপাদন করা দরকার। বাচ্চাদের যেমন বিভিন্ন কোম্পানি চিপসের আয়োজন করেছে। আমেরও আচার, আমসত্ত্ব, পাউডার, পিঠা, জ্যাম, জেলি প্রক্রিয়াকরণ খাবারের ব্যবস্থা করা হলে বাজার বাড়বে। সরকারের রাজস্বও আদায় হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাগানের মালিক ও শ্রমিকদের (যারা আম পাড়ে) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার স্বল্প মেয়াদে আম রাখারও ব্যবস্থা করতে হবে। এসব কাজ করলে আমের বাজার চার থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
খবরের কাগজ: চীন আম আমদানির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। রপ্তানিতে সম্ভাবনা কেমন।
মুনজের আলম মানিক: আমাদের ভালো মানের আম উৎপাদন হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শীর্ষ ১০ এর মধ্যে পৌঁছে গেছি। এটা গর্বের বিষয়। আমের জাতেরও পরিবর্তন হচ্ছে। এক সময়ে আম্রপালি কল্পনা মনে হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই আম সবার নজর কেড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই আম খুবই জনপ্রিয়তা লাভ কমেছে। পাশের জেলা নওগাঁ, রাজশাহী জেলাতেও ভালো উৎপাদন হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন জেলাতে ভালো মানের আম উৎপাদন হওয়ায় রপ্তানির সম্ভাবনাও বাড়ছে। কারণ চীন, রাশিয়া ও বেলারুশ আম নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। সে দেশের প্রতিনিধি সরকারের বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শন করে এই আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু রপ্তানির সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কারণ একমাত্র শ্যামপুরের প্যাকেজিং হাউস থেকে সব জেলার আম রপ্তানি সম্ভব না। চাঁপাইনবাবগঞ্জেই সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয়। তাই এখানেই আরও একটা ওয়্যার হাউস করাতে হবে।