
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাময়িক উপকার পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল নিয়ে সংশয় রয়েছে। পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা না গেলে জলাবদ্ধতার সমস্যা সহজে সমাধান হবে না। এ নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিডিএর ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ইফতেখারুল ইসলাম
খবরের কাগজ: চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে যে প্রকল্পের কাজ চলছে তার সুফল নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
মো. আবু ঈসা আনছারী: জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পে সাময়িক উপকার হলেও দীর্ঘমেয়াদি এর সুফল নিয়ে সংশয় রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরের মতো একটি শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প যতটা টেকসই হওয়া দরকার, বর্তমানে চলমান প্রকল্পটি ততটা টেকসই নয় বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
খবরের কাগজ: সংশয়ের কারণ কী?
মো. আবু ঈসা আনছারী: ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার অনেক পরে সেই মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে কিছু কাজ করা হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যানটি যখন তৈরি করা হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপট এবং চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চিত্রের মধ্যে তুলনা করলে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি খুব বেশি সুফল আশা করা ঠিক হবে না। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ চলে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম ওয়াসা সেই পরিকল্পনাটা স্টাডি করে কিছু পরিকল্পনার কথা বলেছে। সিডিএ তাদের সেই প্রস্তাবনাটা নিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এখানে নতুন কিছু নেই।
খবরের কাগজ: আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?
মো. আবু ঈসা আনছারী: ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামের চিত্রটা যদি একবার চিন্তা করেন, সেসময় আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, বগারবিল, অক্সিজেনের আশপাশসহ এমন অনেক নিচু এলাকা ছিল, যেখানে শহরের পানি ধারণ করতো। সে সময় শহরের পানি প্রথমে সেখানে জমা হতো। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ত। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হলেও শহরের কোনো সমস্যা হতো না। গত তিন দশকে সেসব নিচু এলাকা ভরাট হয়ে আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। পানি ধারণ করার জায়গাগুলোতে স্থাপনা হয়ে গেছে। সেই পানি এখন উপচে পড়ছে আশপাশের এলাকায়।
খবরের কাগজ: সমস্যা সমাধানের উপায় কী?
মো. আবু ঈসা আনছারী: বর্ষায় কর্ণফুলীতে পানি নেই। অথচ শহরে জলাবদ্ধতা। তার মানে কোথাও পানিটা আটকে আছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। পানির একটি সাধারণ ধর্ম হলো, উঁচু থেকে নিচের দিকে যাবে। নিচু এলাকার পানি উঁচু জমিতে আসতে পারবে না। নিচু জমিগুলো ভরাট করে উঁচু করা হয়েছে। নগরায়ণের মাধ্যমে মালভূমি তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে বেশ কিছু নতুন খাল খননের প্রস্তাবনা ছিল। এ ছাড়া বেশ কিছু জলাধার খননেরও প্রস্তাব ছিল। ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সময় তাদের ধারণা ছিল, নিচু এলাকাগুলোতেও একসময় নগরায়ণ হবে। সেটা ধরে নিয়েই তারা নতুন খাল এবং জলাধার খননের প্রস্তাব রেখেছিল। তা ছাড়া বিদ্যমান খালগুলো বড় করতে বলেছে। যেমন: বাড়ৈপাড়া খালের পাশে ৯ হেক্টরের একটি জলাধার খননের প্রস্তাব মাস্টারপ্ল্যানে ছিল। কারণ পরিকল্পনাবিদরা তখন মনে করেছিলেন, বারৈপাড়া খাল হয়তো দ্রুত পানি নিষ্কাশন করতে পারবে না। তাই কিছুক্ষণের জন্য পানি জমা রাখতে এই জলাধারের প্রস্তাব। পানির সঙ্গে যানবাহনের গতিকে মেলাতে পারেন। সেখানে পার্থক্য হলো, গাড়ি উপচে পড়ে না। পানি উপচে পড়ে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম শহরে অনেক নতুন সড়ক হয়েছে। ছোট সড়কগুলোর প্রশস্ততা বেড়েছে। কিন্তু নতুন কয়টি খাল খনন হয়েছে? কয়টি জলাধার খনন হয়েছে? ৭২টি খালের কথা বলা হচ্ছে। কখনো ৫৭টি খালের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে সেটা হওয়া উচিত ছিল, দ্বিগুণেরও বেশি খাল। স্বাধীনতার পর খাল খনন করা হয়নি। বরং ভরাট করা হয়েছে। নগরায়ণ হওয়া স্বাভাবিক। এটাকে আটকানোর সুযোগ নেই। তার সঙ্গে সঙ্গে নতুন খাল, জলাধার খনন করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক খাল থেকে অন্য খালে পানি নেওয়ার জন্যও খাল দরকার। সেটা কখনো হয়নি। সেই কাজটি করতে হবে।
খবরের কাগজ: ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানের নতুন যে তিনটি খাল খননের প্রস্তাব ছিল, তা কি এখনো কার্যকর?
মো. আবু ঈসা আনছারী: হ্যাঁ। এর মধ্যে তো একটি খাল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন খনন করছে। সেটি বহদ্দারহাট বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত। এ ছাড়া চান্দগাঁও শমসেরপাড়া আইইউসি ডেন্টাল কলেজের পাশ দিয়ে একটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব ছিল। শমসের পাড়া লেভেল ক্রসিং থেকে বাহির সিগন্যাল পর্যন্ত ২ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। সেটি হয়নি। এ ছাড়া সল্টগোলা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত ৩ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার খাল খননের পাশাপাশি কিছু সেকেন্ডারি খালের প্রস্তাব ছিল, যা কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি। এসব করতে পারলে শহরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পাবে।