শীতের আগমন না ঘটলেও হালকা ঠান্ডাই প্রকৃতি জানিয়ে দিচ্ছে শীত আসন্ন। এ সময় ঠোঁট বেশ শুকনো লাগে, হাত-পা খসখসে হয়ে চামড়ায় টান ধরে । ঠিক সময়ে ত্বকের যত্ন না নিলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এখনই আপনার ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ত্বকের দেখভালের জন্য যেমন সঠিক পণ্য বেছে নেওয়া দরকার, তেমনি সঠিক উপায়ে ত্বকের যত্ন নেওয়া জরুরি। এ সময় ত্বকের যত্ন কীভাবে নেবেন, তা নিয়ে এবারের আয়োজন।
ত্বক পরিষ্কার
সুস্থ ত্বকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করা। বাইরের ধুলা-ময়লা মিশে ত্বককে নিষ্প্রাণ করে দেয়। তাই ঋতু বদলের এই আবহাওয়ায় দিনে দুবার ত্বকের খোলা অংশ পরিষ্কার করা জরুরি। এ ছাড়া অবশ্যই প্রতিদিন গোসল করতে হবে।
ক্লিনজার ব্যবহার
এ সময় ত্বককে সুস্থ রাখতে ত্বকের আর্দ্রভাবও বজায় রাখতে হবে। ফোম-ভিত্তিক অর্থাৎ ফেনাযুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে। তার পরিবর্তে স্টেরাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে সিটাইল-সমৃদ্ধ ক্লিনজার ব্যবহার করলে ভালো ফল পাবেন। এগুলো ত্বক যেমন পরিষ্কার করবে, তেমনি ত্বককে হাইড্রেটেডও রাখবে। ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখার পাশাপাশি ত্বকের তৈলাক্ত ভাবকে কখনো মুছে দেবে না। বাড়িতে কাঁচা দুধে তুলা ভিজিয়ে ঘরোয়াভাবে ত্বক পরিষ্কার করতে পারেন। রাতে ত্বক পরিষ্কারের ক্ষেত্রে ডাবল ক্লিনজিং করতে হবে। এ জন্য প্রথমে ক্লিনজিং অয়েল ম্যাসাজ করতে হবে। এতে ত্বকের ভেতরের ময়লা ও মৃত কোষ নরম হয়ে ফেসওয়াশের কাজ সহজ হবে। অয়েল ম্যাসাজ হলে টিস্যু দিয়ে বাড়তি তেল মুছে ফেসওয়াশ দিয়ে ত্বক ধুয়ে ফেলুন। হাত ও পায়ের জন্য ফেসওয়াশের বদলে সোপ ফ্রি বডি ওয়াশ ব্যবহার করতে পারেন। শীতে ত্বকে সাবান ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে ত্বক বেশি শুষ্ক হয়ে পড়ে।
এক্সফোলিয়েশন বা ত্বকের মৃত কোষ অপসারণ
শীতে খুব দ্রুত ত্বকে মৃত কোষ তৈরি হয়। ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ ও নিস্তেজ দেখায়। ত্বকের জেল্লা বাড়ানোর জন্য এক্সফোলিয়েশন জরুরি। কিন্তু শীতকালে ত্বক খুব বেশি এক্সফোলিয়েট করে ফেললে সমস্যায় পড়তে হয়। তাই হালকা এক্সফোলিয়েট ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। ত্বক তৈলাক্ত হলে সপ্তাহে দুই-তিন দিন এক্সফোলিয়েট করতে হবে।
অতিরিক্ত শুষ্ক বা স্পর্শকাতর যাদের ত্বক, তাদের মাসে দুবার এক্সফোলিয়েট করা প্রয়োজন। এক্সফোলিয়েশনের জন্য ল্যাকটিক অ্যাসিড, গ্লাইকোলিক অ্যাসিড বা স্যালিসিলিক অ্যাসিডের মতো উপাদানও ব্যবহার করা ভালো।
ময়েশ্চারাইজার
ত্বক ফাটার অন্যতম কারণ শুষ্কতা। এ জন্য এখন থেকেই ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার শুরু করা জরুরি। অয়েলবেসড ময়েশ্চারাইজারে এ সময় বেশি উপকার পাওয়া যাবে। দিনে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন; রাতের জন্য অয়েলবেসড নাইটক্রিম লাগাতে পারেন। অ্যাভোকাডো অয়েল, মিনারেল অয়েল, রোজ অয়েল, আমন্ড অয়েল, শিয়া অয়েলসমৃদ্ধ ময়েশ্চারাইজার বেছে নিতে পারেন। এতে ত্বক বেশি আর্দ্র ও কোমল থাকবে। ত্বকের যত্নের জন্য হায়ালুরোনিক অ্যাসিডের সিরাম বেশ উপকারী। ময়েশ্চারাইজার লাগানোর আগেও হায়ালুরোনিক অ্যাসিড সিরাম ব্যবহার করতে পারেন। এ উপাদানটি পানি ধরে রাখে এবং লক করে আপনার ত্বককে হাইড্রেটেড রাখবে। এ ছাড়া এ সময় সূর্য খুব বেশি প্রখর না থাকলেও সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি বেশ ক্ষতিকর। প্রতিদিন সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় এসপিএফ-যুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে। এতে ত্বক আর্দ্র ও সুরক্ষিত থাকবে।
পেট্রোলিয়াম জেলি
ঠোঁট ফাটা রোধে পেট্রোলিয়াম জেলি হতে পারে আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী। এ সময় পেট্রোলিয়াম জেলি বা লিপবাম সঙ্গে রাখুন। লিপস্টিক লাগানোর আগে ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে তার পর লিপস্টিক লাগালে দীর্ঘসময় ঠোঁট সতেজ থাকবে। রাতে শোবার আগে গালে হালকা ভ্যাসলিন বা লিপবাম লাগিয়ে নিলে ভালো উপকার পাবেন। এ সময়ে অনেকের ঠোঁট কালো হয়ে গেলে এসপিএফ-সমৃদ্ধ লিপবাম ব্যবহার করতে পারেন। বাইরে বের হলে তো অবশ্যই, ঘরে থাকলেও ঠোঁটে সানস্ক্রিনযুক্ত লিপবাম লাগিয়ে নিলে উপকার পাবেন।
ত্বকের আর্দ্রতায় লোশন বা তেল
ত্বক শুষ্ক হলে অলিভ অয়েল, বডি লোশন ব্যবহার করা যায়। তবে সবচেয়ে উপকারী হলো প্রাকৃতিক অলিভ অয়েল। এতে কোনো ধরনের রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত থাকে না। গোসলের পর অলিভ অয়েল ব্যবহার করা ভালো। তবে সরিষার তেল ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে অনেক সময় বিশুদ্ধ নারিকেল তেল ব্যবহার করা যায়। শীতকালে যেহেতু পানি কম ব্যবহার করা হয়, সে কারণে খোসপাঁচড়া বা চুলকানির প্রকোপ বাড়ে, যা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। দীর্ঘদিন চুলকানি থাকলে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ হয় এবং জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এ ধরনের চুলকানি হলে দেরি না করে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নেওয়া দরকার। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে ত্বকে কালচে দাগের উপস্থিতি চোখে পড়ে। কালচে দাগ দূর করতে নিয়মিত লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ্লিসারিনের ব্যবহার
ত্বকচর্চায় নিয়মিত গ্লিসারিনের ব্যবহার ত্বকের প্রায় সব সমস্যার সমাধান করবে। এ সময় গ্লিসারিন ব্যবহারের পাশাপাশি গ্লিসারিন মেশানো প্রসাধনীসামগ্রী ব্যবহার করলে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে। গ্লিসারিন ও ভ্যাসেলিন ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রেখে ত্বক কোমল ও নরম করে। যাদের ত্বকের শুষ্কতা বেশি, তাদের ঘন গ্লিসারিন ব্যবহার করা ভালো। একটি স্প্রে বোতলে ৫ : ১ অনুপাতে গোলাপ জল আর গ্লিসারিন ভরে নিন। এই মিশ্রণ মুখের ত্বক থেকে পায়ের ত্বক পর্যন্ত পুরো শরীরের ত্বককে সুরক্ষা দেবে। ত্বক পরিষ্কারের পর ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহারের আগে ত্বকে গ্লিসারিন-গোলাপ জলের মিশ্রণ স্প্রে করতে পারেন। শুকিয়ে গেলে তার পর ময়েশ্চারাইজার লাগান। এ ছাড়া ফেসপ্যাকে দুই থেকে তিন ফোঁটা গ্লিসারিন মিশিয়ে নিলে এর কার্যকারিতা বেড়ে যাবে অনেক গুণ।
ফেস প্যাক
এ সময়ে ত্বক ভালো রাখতে ফেস প্যাকের জুড়ি নেই। সপ্তাহে অন্তত দুবার দুধের সর, মধু ও বেসনের মিশ্রণ ব্যবহারে ত্বকের আর্দ্রতা বাড়বে। পাশাপাশি এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও সাহায্য করবে। এ ছাড়া টক দই, বেসন ও হলুদের মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত পানি পান করা
এ সময়ে পিপাসা কম লাগে। এ জন্য পানি পান কম হয়। এতে ত্বক আরও বেশি রুক্ষ হয়ে ওঠে। আর্দ্র ত্বকের জন্য তো বটেই, শরীর সুস্থ রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। নিয়মিত পানি পান শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থকে বের করে দিতে সাহায্য করে। ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস উষ্ণ লেবুপানি পান করতে পারেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, ডাবের পানি ও জুস শীতের জন্য এখন থেকেই সুরক্ষাবলয় গড়ে তুলবে শরীরে।
গায়ে রোদ লাগানো
প্রতিদিন কিছুক্ষণ রোদে থাকা দরকার। সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে ন্যূনতম ১৫ মিনিটের জন্য রোদে যেতে পারেন। এতে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি পাবে। ভিটামিন ডি ত্বককে সুন্দর ও মসৃণ করে এবং বার্ধক্য রোধ করে।
পোশাক
টাইটফিট এবং সিনথেটিক পোশাক ত্বককে আরও শুষ্ক ও রুক্ষ করে এবং অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। কাজেই আরামদায়ক এবং প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি পোশাক পরুন। পলিয়েস্টার, লিলেন, নাইলন ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
ডায়েটিং ও শরীরচর্চা
এ সময়ে ত্বক সুন্দর রাখার আরেকটি উপায় হলো নিয়মিত ডায়েটিং ও ব্যায়াম করা। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার মাধ্যমে সহজেই শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। খাবারের তালিকায় অতিরিক্ত তেল ও চর্বি পরিহার করতে হবে। এ সময়ে খাবারের তালিকায় অতিরিক্ত আমিষ না রেখে শাক-সবজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। সবুজ শাক-সবজির ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে বেশ কার্যকর। সালাদ স্যুপ বা রান্না করে খেলে শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়। প্রতিদিন নিয়ম করে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। এ ছাড়া যোগব্যায়াম দেহের রক্ত সঞ্চালনকে ত্বরান্বিত করে। ফলে দেহ পায় বাড়তি অক্সিজেন আর উপকারী ফ্রি র্যাডিকেল।
কলি