
২০২৪ সাল শেষ হতে চলেছে, এ বছর দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাশন জগতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এবং পোশাকে নতুন ট্রেন্ড দেখা গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেরর পর পোশাকে ফুটে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। যা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এছাড়া আরামদায়ক ফ্রেবিকে উজ্জ্বল রঙের পোশাকের আধিপত্য দেখা গেছে। চলতি ধারার পোশাকের ফ্যাশনের ডিজাইন ও মোটিফ নিয়ে হয়েছে বিভিন্ন কাটাছেঁড়া।

শাড়িতে বিভিন্নতা
শাড়ির প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ এবং শাড়িকে নতুন আঙ্গিকে পরার ধারা দেখা গেছে। নতুন প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর ডিজাইনাররা বিভিন্ন ডিজাইনে শাড়ি নকশা করেছিলেন। কাপড়ের বুনন ও নকশায় এনেছে বৈচিত্র্য। রঙের ব্যবহারে ছিল নতুনত্ব। সুতির শাড়িতে হাতের কাজ, মেশিনের কাজ, স্ক্রিন বা ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ড পেইন্ট নকশা আলোচনায় ছিল বছরজুড়ে। এমনকি ফ্লোরাল ও জিওমেট্রিক প্যাটার্নও শাড়ির জমিনে জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরার জন্য মসলিন শাড়ির কদর লক্ষ্য করা গেছে। এবারের শাড়িতে সুতি, লিনেন, ভয়েল, স্লাব, ভিসকসের মতো আরামদায়ক ফেব্রিক ব্যবহার করে ফ্লোরাল প্রিন্ট, ট্রপিক্যাল প্রিন্ট, আবার ছিমছাম পলকা ডট কিংবা সাধারণ জ্যামিতিক মোটিফ ফুটে উঠেছিল।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পর ফ্যাশন
আমাদের ফ্যাশনে জুলাইয়ের পর যুক্ত হয়েছে গণআন্দোলন অনুপ্রাণিত পোশাক। যা আমাদের শিখিয়েছে, ফ্যাশন শুধু বাহ্যিক স্টাইল নয়, এটি পরিবেশ এবং মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতারও প্রতীক। আমাদের দেশের ডিজাইনাররা মোটিফ তুলে ধরেছেন জুলাইয়ের আন্দলনের শহিদদের রঙিন পোর্ট্রেট, আন্দোলনে নিহতদের বিভিন্ন ডায়ালগ গুলো রিকশা পেইন্ট এবং গামছার মতো ঐতিহ্যবাহী উপকরণে মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

সাসটেইনেবল ফ্যাশন
এ বছর আমাদের দেশে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের দিকে মনোযোগ বেড়েছে। সাসটেইনেবল ফ্যাশন এবং লোকশিল্পের পুনরুত্থানের মতো বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর ক্যাম্পেইনগুলোতে। পাশাপশি আমাদের কারুশিল্পের প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। দেশের অনেক ডিজাইনাররা টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ নিয়ে পোশাক ডিজাইন করেছে। সেইসঙ্গে জামদানি, নকশিকাঁথা, রাজশাহী সিল্ক এবং খাদি নিয়ে নতুন ভাবে কাজ করছেন । আন্তর্জাতিক মঞ্চে জামদানি ও নকশিকাঁথাকে তুলে ধরেতে দেখা গেছে। যা আমাদের জন্য ছিল গর্বের বিষয়।
জেন-জিদের নতুন পোশাক
হালে বিশ্বজুড়ে জেন-জি প্রজন্ম বদলে দিচ্ছে ফ্যাশনের সংজ্ঞা, পোশাকের পরিভাষা। ভিনটেজ, রেট্রো, অতিরিক্ত বড় আকারের পোশাক এবং টেকসই কাপড়ের মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যকে উপস্থাপন করেছে। লিঙ্গ নিরপেক্ষ পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। পোশাকে নারী-পুরুষের সীমানা মুছে দিচ্ছে তারা। এটাও ফ্যাশনের নতুন ধারা। তাদের পোশাক, জুতা, অনুষঙ্গ- সবকিছুতেই দেখা গেছে আশির দশকের প্রভাব। ফিউশন, ইউনিসেক্স কিংবা কিছুটা ওল্ড স্কুল ফ্যাশন সবই ছিল এ বছরে জেন-জি ফ্যাশনের অন্তর্ভুক্ত।

ঢিলেঢালা এবং ওভারসাইজড ফ্যাশন
এ বছরও ঢিলেঢালা পোশাক ট্রেন্ডে ছিল। কামিজ বা কুর্তিতে ওভারসাইজড বা ফ্রি সাইজ ছিল ফ্যাশনের আরেক নাম। পোশাকে কমফোর্ট খোঁজেন যারা, তাদের জন্য ওভারসাইজড পোশাক ছিল পছন্দের ফ্যাশন। সামনে কুচি দেওয়া ফ্রক প্যাটার্নের ঢিলা পোশাক, কাফতান বা কুর্তিতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিয়েছেন ফ্যাশন সচেতনরা।
কো-অর্ডের আধিপত্য
পোশাকের ফ্যাশনধারায় এ বছর কো-অর্ড সেট বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্টাইল ফ্যাশন দুনিয়ায় কো-অর্ড সেট ছিল বেশ রমরমা। কো-অর্ড নতুন কিছু নয়। তবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে শুধু প্যাটার্ন আর কাট। সাদা, বেবি পিংক, আকাশি, ধূসর, হলুদ বা যেকোনো প্যাস্টেল শেডের কো-অর্ডগুলোয় দেখা গেছে নিত্যনতুন সব রূপ।
নকশায় আধুনিকতা
এ বছরের পোশাকের নকশা বা প্যাটার্নে নানা ধরনের ধারা দেখা গেছে। পাঞ্জাবি ও কামিজের প্যাটার্নে পরিবর্তন বিশেষ লক্ষণীয়। ট্র্যাডিশনাল মোটিফে সমসাময়িক আধুনিক প্যাটার্নে কাজ হয়েছে। শাড়িতে বুননে, সারফেস অর্নামেন্টেশন ও লে-আউটে, মোটিফের ব্যবহার এবং কালারের বিন্যাসে বৈচিত্র্য ছিল। আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো যার যার নিজস্ব ধারা ব্যবহারে করে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের পোশাক ডিজাইন করেছে। যা বিভিন্ন উৎসবে নিয়ে এসেছিল উৎসবের আমেজ।

উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য
পুরো বছর ধরে উজ্জ্বল রঙের রাজত্ব করতে দেখা গেছে। ক্যাজুয়াল থেকে বিয়ের পোশাক- সবকিছুতেই দেখা গেছে উজ্জ্বল উপস্থিতি। লাল, সাদা ও বাসন্তী এ ধরনের চিরাচরিত রংগুলোর বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত রংগুলোর ঝলকও দেখা গেছে। এ ছাড়া ছেলেমেয়েদের পোশাকে প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করেও অনেক নকশা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ বছর প্রিন্টের পাশাপাশি এমব্রয়ডারির কাজ বেশ দেখা গেছে।
ম্যাচিং পোশাক
দুজনে মিলিয়ে পোশাক পরার ফ্যাশন পুরোনো। তবে এবারও বিশেষ উৎসবে জুটি বেঁধে পোশাক পরতে দেখা গেছে। কখনো রং মিলিয়ে তো কখনো মিল নকশায়, মোটিফে। আবার বৈপরীত্যেও মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেক ডিজাইনার। শুধু যে দুজনেই সীমাবদ্ধ ছিল তা না, পরিবারের সবাই মিলে, বন্ধুরা কিংবা সহকর্মীরা মিলেও একই রকম পোশাক পরতে দেখা গেছে।
কুর্তি ও টপস
দেশীয় পোশাকে বিদেশি বিভিন্ন নকশা, কাট ও প্যাটার্নের ফিউশন পোশাক ছিল। টপস, কাফতান, জিন্স, টি-শার্ট, ফিউশনের মতো পোশাকগুলো বছরজুড়ে ছিল আলোচনায়। হালকা ও উজ্জ্বল রঙের সংমিশ্রণে তৈরি এ পোশাকগুলো তাদের স্টাইলিশ বৈচিত্র্যের জন্য সবার নজর কেড়েছে। ক্লাস, আড্ডা, হ্যাংআউট, টিউশন, বেড়ানো– সব পরিবেশে সহজে পরা যায় বলে সবাই, এমন পোশাকেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। এছাড়া পালাজ্জোর সঙ্গে লং, শর্ট বা রাউন্ড যেকোনো কুর্তি ছিল আকর্ষণের কেন্দ্র। স্কার্ট পালাজ্জো, হারেম প্যান্ট, পাতিওয়ালা সালোয়ার ইত্যাদি সব ধরনের প্যান্ট ট্রেন্ডে ছিল।

ভিন্ন কাটের স্কার্ট
স্কার্ট জনপ্রিয় অনেক আগে থেকেই। স্কার্টে দেখা যাচ্ছে নতুন রূপ। জায়গা বুঝে সহজে মানিয়ে যায় বলে স্কার্ট সব বয়সী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় পেয়েছে। স্কার্টের সঙ্গে টি-শার্ট, ফতুয়া তো পরা হয়ই- বাড়তি আকর্ষণ যোগ করেছিল বিভিন্ন কাটের কামিজ। স্কার্ট পোশাক হিসেবে আরামদায়ক। স্কার্টের মধ্যে বোহেমিয়ান বা জিপসি স্কার্ট বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এগুলোর ঘের ও কুঁচি বেশি থাকায় খাটো টপের সঙ্গে ভালো মানিয়ে গেছে।
ম্যাক্সিমালিজমের রাজত্ব
বিশ্বে মিনিমালিজম পোশাক রাজত্ব করেছে দীর্ঘদিন। এই বছর মিনিমালিজম পোশাকের ট্রেন্ড নতুন ভাবে দেখা গেছে। মিনিমালিজমের পাশাপাশি ম্যাক্সিমালিজমের পোশাক নিয়ে এসেছিল নতুনত্ব । উৎসবের তো বটেই, দৈনন্দিন পোশাকও মুখর ছিল ম্যাক্সিমালিজমে। টেকসই তত্ত্বের যোগাযোগের খোঁজ পাওয়া যায় মিনিমালিস্টিক ফ্যাশনের সঙ্গে।
পুরোনো কাপড় পুনর্ব্যবহার
আমাদের দেশে পুরোনো কাপড় দিয়ে পোশাক বানানো নতুন কিছু নয়। তবে বিশ্ব ফ্যাশনে পুরোনো কাপড় নতুন কবে ব্যবহার বেশ দেখা গেছে। ফলে আমাদের দেশে তরুণ উদ্যোক্তারা পুরোনো কাপড় পুনর্ব্যবহার করে নতুন পোশাক তৈরি করছেন। পুরোনো জামাকাপড় দিয়ে শার্ট, গাউন, টপস, ফতুয়া বানিয়ে পোশাকে নিয়ে এসেছিল নতুনত্ব।
পায়জামার নতুনত্ব
পায়জামার হেমলাইন, নকশা এবং কাটছাঁটেও এসেছিল পরিবর্তন। ঘেরওয়ালা পায়জামা বা ধুতি-পায়জামা তো বটেই, সোজা কাটের পায়জামা ও পালাজ্জোর মতো ঢিলেঢালা পায়জামায় দেখা গেছে। পালাজ্জোতে স্কার্টের মতো ঘের, কম ঘের ও মাঝামাঝি ঘের রেখে ডিজাইন করা হয়েছিল। কয়েক স্তরের কুঁচি দেওয়া সারারা ছাড়াও ডিজাইন করা হয়েছে বায়াস কাটের সারারা। এ ছাড়া কুঁচি দেওয়া একাধিক স্তরের পায়জামা ডিজাইন করা হয়েছে, যা ছিল খুবই ফ্যাশনেবল।
কলি