
সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। শহর বন্দর হোক কিংবা গ্রাম। পাখির উপস্থিতি নেই এমন জায়গা খুব কম। পাখি পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক আছে কি না, তা মাপার ব্যারোমিটার। যে অঞ্চলে পাখির বৈচিত্র্য বেশি বুঝতে হবে সেখানে পরিবেশের অন্যান্য উপাদান ঠিক মাত্রায় রয়েছে। আমাদের দেশের প্রায় ২০ শতাংশ পাখি বিলুপ্তির পথে। এর কারণ নগরায়ণ, নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির বিভিন্ন আয়োজন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না পৃথিবী যতটুকু মানবজাতির ততটুকুই প্রাণীদের ও এই প্রকৃতি পরিবেশে ওদেরও অংশ রয়েছে। আমরা পশুদের অংশীদারত্বের কিছুটা স্বীকৃতি দিলেও পাখির অংশীদারত্ব একদমই মানি না। যেকোনো উন্নয়নের নাম করেই গাছ কাটা শুরু করি। আমাদের দেশে প্রায় ৭৫০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে প্রায় ১০টি প্রজাতি অতি বিপন্ন, ১২টি প্রজাতি বিপন্ন আর ১৭টি প্রজাতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে অধিকসংখ্যক পাখির বাসস্থান জলাশয়ে। এ দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ করা হয় জলাশয় ভরাট করে। তাই একসময় খাল, পুকুর ও বিভিন্ন জলাশয়ে বসবাস করা পাখিদের বাসস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে সঙ্গে তাদের অস্তিত্বেরও। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে বাংলাদেশ বনবিভাগ জাতীয় পাখি দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ইতিহাস
১৮৯৪ সালে অয়েল সিটির স্কুল সুপারিনটেনডেন্ট চার্লস আলমানজো ব্যাবকক দ্বারা পাখি দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাবকক এটিকে একটি নৈতিক মূল্য হিসেবে পাখি সংরক্ষণকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য করেছিলেন। এটি প্রতি বছরের ৪ মে পালিত হয়। তবে এতে জনসচেতনতা আশানুরূপ না বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০২ সাল থেকে তারা ক্রিসমাসের ছুটিতে একটা দিন পাখি দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতি বছর জানুয়ারির ৫ তারিখ তারা জাতীয় পাখি দিবস পালন করে আসছে ২০০২ থেকে। সেই দিবসের আলোকে ভারত ও বাংলাদেশ ও ৫ জানুয়ারিকে পাখি দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর আমাদের উপমহাদেশে জানুয়ারিকে পাখি দিবস হিসেবে উদযাপন করার আরও একটা কারণ হচ্ছে শীতকালে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে বাংলাদেশে। শুধু স্থানীয় পাখির জন্য সহমর্মিতা অনুভব করাই যথেষ্ট নয় পরিযায়ী পাখি ও পরিবেশে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা বোঝানোও জনগণকে স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সচেতন করা।
উদ্দেশ্য
বিশ্বজুড়ে কমছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই পালন করা হয় বিশেষ দিনটি। বর্তমানে বিশ্বের ২০ শতাংশেরও বেশি পাখি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। সংখ্যার নিরিখে যা প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির সমান। এই বিশালসংখ্যক প্রজাতিকে বাঁচাতেই জাতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নগরায়ণ ও নানা কারণে পাখিদের সংখ্যা দিন দিন কমছে শহর এলাকায়। এ ছাড়া নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ইকোসিস্টেম। সেই ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতেই এই বিশেষ দিন উদযাপন করা হয়। এ ছাড়া পাখি ধরা, খাওয়া, বিক্রয়, বিপণন নিষিদ্ধ করা ও এ সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সচেতন করতে।
আয়োজন
প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাখি মেলার আয়োজন করে। যেখানে পাখির ছবি প্রদর্শন, পাখি দেখা প্রতিযোগিতা, পাখি চেনা কার্যক্রম ও নতুন প্রজাতির পাখি বা বিরল প্রজাতির পাখির ছবি তোলার জন্য বিগ বার্ড অ্যাওয়ার্ড দিয়ে উৎসাহিত করা হয়। এ ছাড়া পাখির অস্বস্তি রক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। উক্ত অনুষ্ঠানে শিক্ষক ছাত্র গবেষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেতে পারে। এ ছাড়া চ্যানেল আই প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানে পাখি দিবস উপলক্ষে পাখিদের অভয়ারণ্য ও কোথায় কোন পাখি পাওয়া যায় শীর্ষক আলোচনা রাখে ও প্রমাণ্যচিত্র প্রচার করে। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকরা উপস্থিত হন এবং সর্বসাধারণের বোঝার উপযোগী করে আমাদের ও পাখিদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন।
পাখি দিবস কেন পালন করা উচিত
আমরা ছাত্র জীবনে একটা কথা শুনে বড় হয়েছি তা হলো যারা পাখির ছবি তোলে তাদের ডিপ্রেশন কম হয়। এটা প্রমাণিত যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে থাকলে মানুষ মানসিক চাপ কম অনুভব করে। আর পাখিদের মধ্যে এত বৈচিত্র্য রয়েছে যে, এসব বৈচিত্র্য আত্মস্থ করতে করতে দুঃখিত হওয়ার সময়ই পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে ঋতুভেদে ভিন্ন পাখি দেখা যায়। এ ছাড়া একই পাখি প্রজননের সময় ও পরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায়। তাই মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য পাখি দেখা একটা ভালো অভ্যাস। এ ছাড়া পাখি দেখতে গেলে ধৈর্য ও অধ্যাবসায় শেখা হয়। যারা পাখি নিয়ে কাজ করে বা পাখির ছবি তোলে তাদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে তারা একটা পাখির জন্য কত সময় ধরে নিঃশব্দে একটা স্থানে বসে থেকেছে এবং কোন কথা বলে কত ঘণ্টা কাটিয়েছে। মূলত পাখিরা মানুষের উপস্থিতিকে ভয় পায় তাই তাদের জীবনযাপনকে ব্যাহত না করে কাজ করতে হলে হইচই করা যাবে না। এ ছাড়া তাদের বিভিন্ন আচরণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারলে ভীষণ আনন্দ অনুভূত হয়।
প্রকৃতির মাঝে থাকাটাই আনন্দের তবে প্রকৃতির প্রাণ পাখির মাঝে থাকা আরও আনন্দের। তাদের শিকার করার পদ্ধতি, উড়ার পদ্ধতি, যৌনাচরণ সবকিছুই আকর্ষণীয় ও সুন্দর। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পাখির জন্য ভালোবসা শেখাতে ও এতদসম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সচেতন করতে আমাদের পাখি দিবস পালন করা উচিত। এ ছাড়া বিপন্ন, অতিবিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ পাখিদের সংরক্ষণের বিভিন্ন পন্থা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে দিবসটি সর্বসাধারণের মধ্যে আরও বড় পরিসরে পালন করতে হবে।
কলি