
যৌন হয়রানি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচ্য ও ভয়াবহ বিষয়। বিকৃত রুচির মানুষ তাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণে শিশুদের ব্যবহার করতে চায়। যেহেতু শিশুরা এসব বিষয়ে গুছিয়ে বলতে পারে না, তাই তাদের সহজেই ব্যবহার করা যায়। এসব বিষয় সম্পর্কে শিশুদের তেমন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা বুঝতে পারে না তাদের সঙ্গে কী হচ্ছে। হয়তো বড় হওয়ার পর বুঝতে পারে তখন তারা অপরাধবোধে ভোগে অথবা মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যায়। অনেক শিশু ভীতু হয়ে বড় হয়। তাই শিশুদের জানাতে হবে যৌন হয়রানি সম্পর্কে। তাদের শেখাতে হবে গুড টাচ ও ব্যাড টাচ কী।
গুড টাচ ব্যাড টাচ কী
স্পর্শ ভালোবাসা প্রকাশের একটা মাধ্যম। স্পর্শের মাধ্যমে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশ হয়। যেসব স্পর্শ শিশুদের ভালোবাসার অনুভূতি দেয় ও নিরাপদ অনুভব করায় তাই গুড টাচ। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তি নিজের বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য যদি শিশুকে স্পর্শ করে তাই ব্যাড টাচ। ব্যাড টাচ খুবই অস্বস্তিকর ও মানসিক পীড়াদায়ক। বাড়িতে কাজ করার জন্য বাইরের লোক আসে, এ ছাড়া আত্মীয়-স্বজন আসা-যাওয়া করে তারা হয়তো শিশুর সঙ্গে শুরুর দিকে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করে এবং পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস অর্জন করে পরে শিশুদের নানাভাবে হয়রানি করে।
কত বছর বয়স থেকে শিখাবেন
সাধারণত দুই বছর বয়স থেকে শিশুরা তাদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। আপনি প্রতিদিন একটু একটু করে খেলার ছলে প্রত্যেকটি অঙ্গ সম্পর্কে তাকে চেনান। ছবি এঁকে কোনটি হাত, পা, মাথা, চোখ এভাবেও শিখাতে পারেন। তারপর ধীরে ধীরে তাকে প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে জানান। কাপড় বদলানো এবং গোসল করার সময়ও তাকে এই ব্যাপারে অবহিত করুন।
.jpg)
যেভাবে বোঝাবেন ও শিখাবেন
শুধু শিশুকেই নয়, আপনার পরিবারের সদস্যদেরও এই বিষয় সম্পর্কে জানানো এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি এমনকি কোনো আত্মীয় যদি ভালোভাবে আদর করে বা চুমু দেয় যেটা তার ভালো লাগে এবং কমফোর্ট ফিল করে সেটি গুড টাচ। শিশু কাকে কাকে আদর করতে পারবে এটাও শিখাতে হবে। বাসায় সে তার পরিবারের সদস্যকে যেভাবে ট্রিট করে বাইরে যেন এমনটি না করে জানিয়ে রাখুন এ বিষয়েও।
- কোনো সংস্পর্শে শিশু যদি ভয় বা ব্যথা পায় এবং অস্বস্তি বোধ করে বা কেউ অকারণে তার প্রাইভেট পার্টসে হাত রাখে সেটা ব্যাড টাচ।
- কেউ যদি আপনার শিশুকে চকলেট বা অন্য কিছুর লোভ দেখিয়ে আলাদা রুমে বা কেউ নেই এমন জায়গায় নিয়ে যায়, তাহলে বলে রাখুন সে যেন না যায়।
- শিশু মানা করার সত্ত্বেও যদি বারবার তাকে স্পর্শ করে এটাও ব্যাড টাচ।
- এসব ঘটনার সম্মুখীন হলে সে যেন কাউকে বলে অথবা জোরে চিৎকার করে সে ব্যাপারে তাকে শিক্ষা দিন।
- পরিবারের কোন কোন সদস্য শিশুকে গোসল করানো, টয়লেট করানো বা কাপড় বদলিয়ে দিতে পারবে তা বুঝিয়ে বলুন।
- গুড টাচ ও ব্যাড টাচ নিয়ে এখন প্রচুর বই ও ভিডিও পাওয়া যায়। বই পড়ে গল্পের ছলে, ছবি এঁকে অথবা একসঙ্গে বসে ভিডিও দেখে প্র্যাক্টিক্যালি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। এতে শিশুও ধীরে ধীরে টাচ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবে।
- খেলার ছলে পরিবারের সদস্যরা প্রাইভেট পার্টসে হাত দেবেন না। এতে শিশু বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করবে এবং এ জাতীয় ঘটনা কারও সঙ্গে শেয়ার করবে না।
কী কী করণীয়
শিশুকে গুড টাচ ও ব্যাড টাচ সম্পর্কে শিখানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু দায়িত্বও আপনাকে পালন করতে হবে। যেমন-
শিশুকে পর্যবেক্ষণ করুন
আপনার শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভালোভাবে লক্ষ করুন। সে লাজুক, রাগী, সেনসিটিভ নাকি হাসিখুশি খেয়াল করুন। সব শিশুকে এই বিষয়ে একভাবে বোঝানো যাবে না। তাই তার মতো করেই তাকে সেভাবে শিক্ষা দিন। অনেক শিশু যেকোনো পরিবেশে সহজেই মিশে যায়। তাই তাকে তার সার্কেল সম্পর্কে অবহিত করুন। কারণ, এসব শিশুকে যে কেউ কোনো কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তার ক্ষতি করতে পারে। যে শিশুটি চুপচাপ থাকে তার সঙ্গে কিছু ঘটলে হতে পারে সে তা নাও বলতে পারে। তাই আপনার শিশুর মনোভাব অনুযায়ী গুড টাচ ও ব্যাড টাচের শিক্ষা দিন।
অতিরিক্ত ভরসা করা থেকে বিরত থাকুন
শিশুরা খুব কাছের মানুষ মাধ্যমেও অ্যাবিউজের শিকার হতে পারে। সে এসে হয়তো তার সম্পর্কে আপনাকে জানাল। আর সেই ব্যক্তিকে আপনি ভরসা করেন বলে উল্টো শিশুকে বকা দিলেন মিথ্যা বলার জন্য। এতে কিন্তু তার ওপর বিরূপ একটি প্রভাব পড়বে। এমনটি একদমই করবেন না। আপনার সন্তান কার কার সঙ্গে মিশছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, কার আচরণ কেমন এ ব্যাপারে সতর্ক হোন।
শিশুর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন
অনেক সময় কাজের চাপে বা যেকোনো কারণে বাবা-মা শিশুকে বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক বাবা-মা অল্পতেই রেগে যান। আপনার শিশু কী বলতে চায় সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করুন, যেন মন খুলে সে যেকোনো কিছু শেয়ার করতে পারে। আপনিই যদি তাকে কো-অপারেট না করেন, তাহলে শিশু কোনো অপ্রস্তুত ঘটনার শিকার হলেও বলতে চাইবে না।
শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলুন
শিশুদের সেলফ কনফিডেন্স শিখানো ভীষণ জরুরি। এতে যেকোনো খারাপ সময় সে ফাইট ব্যাক করতে পারবে। তাকে বোঝান, তার শরীর একান্তই তার। কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলে সে যেন না ভাবে যে তার ভুল। ভয় পেয়ে যেন সে দূরে সরে না যায়। এই আত্মবিশ্বাস যদি শিশুর মাঝে গড়ে ওঠে তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেকে সামলে নিতে পারবে।
লজ্জা না পেয়ে রুখে দাঁড়ান
অনেক সময় শিশুর চেয়ে মা-বাবাই এসব বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা পান। উল্টো শিশুকেই চুপ করিয়ে দেন লোকে কী বলবে এটা ভেবে। জেনে রাখুন, এতে আপনি নিজের অজান্তেই শিশুকে অনেক বড় দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। শিশুর পাশাপাশি আপনাকেও প্রতিবাদ করতে হবে এই বিষয়ে। লজ্জা পেয়ে বা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এই ভেবে এখন যদি কিছু না বলেন, তাহলে একদিন হয়তো পরিস্থিতি আর হাতের মুঠোয় থাকবে না। তাই এসব পরিস্থিতিতে সন্তানের পাশে দাঁড়ান এবং অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
যে বিষয়গুলো দেখলে সাবধান হতে হবে
বাচ্চারা অনেক কিছু শেয়ার করতে পারে না বা বলতে চায় না। সেক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে সে কোনো অপ্রীতিকর সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কি না। যে লক্ষণগুলো দেখলে আপনাকে সাবধান হতে হবে এবং শিশুর সঙ্গে কথা বলতে হবে-
ঘুমের মাঝে শিশু চিৎকার করলে
ভয়ে রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেললে
চঞ্চলতা কমে গিয়ে একদম চুপচাপ হয়ে গেলে
কাজে অমনোযোগী হয়ে গেলে
সব সময় নার্ভাস হলে বা ভয়ে ভয়ে থাকলে
সন্তানের সুস্থ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠা নিশ্চিত করতে হলে অভিভাবক হিসেবে আপনাকে একটু সচেতন হতে হবে। একটি সুস্থ প্রজন্মের জন্য মানসিকভাবে সুস্থ শিশু আবশ্যক।
কলি