
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা। জন্মেছিলেন ৩ জুলাই ১৮৮৩ সালে, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে। মাত্র নয়টি পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখেছিলেন ফ্রানৎস কাফকা। বাদবাকি সবগুলোই ছিল অসম্পূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি অসমাপ্ত উপন্যাস (মৃত্যুর পর বের হয় ১. দ্য ট্রায়াল ১৯২৫, ২. দ্য ক্যাসল ১৯২৬ এবং ৩. দ্য আমেরিকা ১৯২৭), কয়েকটি বড় গল্প, কিছু মুক্তগদ্য, ডায়েরি ও চিঠি। জীবদ্দশায় সাতটি রচনা বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে দ্য মেটামরফসিস বা রূপান্তর সবচেয়ে বিখ্যাত। যোগ্যতা ছিল কিন্তু নোবেল পাননি এরকম লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আর এ যাবৎ শতাধিক নোবেলপ্রাপ্ত লেখকের মধ্যে প্রায় ৪০ জন লেখক তাদের লেখায় কাফকার সরাসরি প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। বিখ্যাত এই লেখক মৃত্যুবরণ করেন ৩ জুন ১৯২৪ সালে।
কাফকা অকৃতদার ছিলেন। নানা ধরনের সংশয়ে ভুগতেন সবসময়। বিয়ে করে সংসার শুরু করলে, সন্তান এলে, সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে- এই ভয় ছিল মারাত্মক। কিন্তু নারীসঙ্গ পছন্দ করতেন। বিছানার দক্ষতা নিয়ে তার সংশয় কখনোই কাটেনি। অথচ বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের ভাষায়, কাফকা যৌন কামনার হাতে উৎপীড়িত হতেন। বিয়ের কথা উঠলে তার বাবা তাকে গণিকালয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি অনেকবার গণিকাসঙ্গও উপভোগ করেছিলেন।
১৯১৩ সালের ১৩ আগস্ট বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় গিয়ে তারই আত্মীয় এক তরুণীর প্রেমে পড়লেন কাফকা। তরুণীর নাম ফেলিৎসে বাউয়ার। বুদ্ধিদীপ্ত, ভালো চাকরি করা বার্লিনের মেয়ে। কাফকা তাকে অনুভব করতেন কিন্তু কামনা করতেন না। বছর ছয়েক সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সাকল্যে তিন-চারবার। পুরো যোগাযোগ ছিল চিঠিতে। ১৯১৫ সালে ফেলিৎসের সঙ্গে সময় কাটানোর পর ডায়েরিতে কাফকা লেখেন, ‘চিঠির ভুবন ছাড়া বাস্তবে আমি কখনো ফেলিৎসের সঙ্গে সম্পর্কের এই মধুরতাটুকু অনুভব করিনি, যা মানুষ প্রেমিকার সঙ্গে করে, তার প্রতি আমার শুধু অসীম ভক্তি’। ফেলিৎসেকে লেখা ৫০০ চিঠি নিয়ে পরবর্তীতে বের হয়েছে ‘লেটার টু ফেলিৎসে’। যা কতটা প্রেমপত্র আর কতটা কাফকার আত্মবিশ্লেষণ তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। ফেলিৎসের সঙ্গে প্রেমপর্বের ওই বছরেই তার কলম থেকে বের হয়েছে মেটামরফসিস, ট্রায়াল, স্টোকার জাজমেন্ট, আমেরিকার মতো একের পর এক লেখা। ফেলিৎসের সঙ্গে ১৯১৪ সালে তার বাগদানও সম্পন্ন হয়। কিন্তু ফেলিৎসেই সেটা ভেঙে দেন। দ্বিতীয়বার বাগদান হয় ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে। সেটিও ভেঙে যায়।
ফেলিৎসের সঙ্গে প্রেমপর্ব চলার সময়ই কাফকা গোপনে ফেলিৎসেরই প্রিয় বান্ধবী গ্রেটা ব্রুখের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। বন্ধু ম্যাক্স ব্রড দাবি করেছেন, গ্রেটার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল কাফকার।
১৯২০ সালে যখন রীতিমতো যক্ষ্মা জেঁকে বসেছে কাফকার ফুসফুসে তখন অসুস্থ অবস্থায়ই কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক মিলেনা এসেন্সকার। মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো নিয়ে পরবর্তীতে বের হয়েছে ‘লেটার্স টু মিলেনা’। মিলেনা ছিলেন বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে। কাফকা চেয়েছিলেন মিলেনা তার সঙ্গে এসে থাকুক। কিন্তু মিলেনা বিবাহবিচ্ছেদ চাননি। শেষমেষ সম্পর্কোচ্ছেদ হয়ে যায়। এই সম্পর্ক চলার সময়ই লিখেছিলেন দ্য ক্যাসেল। এক চিঠিতে কাফকা মিলেনাকে লিখেছিলেন, ‘লিখিত চুম্বনেরা কখনো গন্তব্যে পৌঁছয় না। মাঝপথে ভূতেরা এসে তাদের পান করে নেয়। আর নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছের সংবরণ করতে করতেই জীবনটা কেটে গেল।’
আগের মতোই, প্রথম প্রেমের মতোই, মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময় কাফকা প্রেমে পড়েন এক হোটেল পরিচারিকার। নাম ইউলি ওরিৎসেকের। ১৯১৯ সালের এক ছুটিতে তাদের পরিচয়। একপর্যায়ে তাদের বাগদান হয়। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা হয় সংসার যাপনের উদ্দেশে। বিয়ের তারিখও ঠিক করা হয়। কিন্তু ইউলির সামাজিক অবস্থানের জন্য কাফকার ওপর আবার খেপে যান তার বাবা। তখন কাফকাকে প্রয়োজনে গণিকালয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি। এ ঘটনা থেকেই জন্ম কাফকার বিখ্যাত ‘বাবাকে লেখা চিঠি’র। ইউলিকে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেন কাফকা। আবার ঝুঁকে পড়েন মিলেনার প্রতি। ইউলি তাকে এক হৃদয়ছেঁড়া চিঠি লেখেন, ‘তুমি কি সত্যিই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’
ইউলি ও মিলেনার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর অসুস্থতা বাড়তে লাগল কাফকার। ১৯২৩ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বাল্টিক সাগরের ধারে এক রিসোর্টে পরিচয় হলো ডোরা ডিয়ামান্টের সঙ্গে। খুব অসুস্থ, নিঃসঙ্গ, অবসন্ন, ভগ্নহৃদয় কাফকা তখন তার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট ডোরাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তার সর্বস্ব দিয়ে। ডোরাও কাফকার হৃদয়ের হাহাকার ও ডাক বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিও সাড়া দিয়েছিলেন সর্বস্ব দিয়ে।
যক্ষ্মায় ধুঁকতে থাকা আপাত ব্যর্থ লেখকের সঙ্গে সমাজবহির্ভূত সংসার পাতলেন ডোরা। তিনি একাই রোজগার করেন। ডোরা কাজে বের হলে কাফকা লেখার খাতা নিয়ে বসতেন। সন্ধ্যায় ফিরে এলে বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে তাকে শোনাতেন নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি। কখনো দস্তয়েভস্কি থেকে কখনো গ্যেটের বই থেকে কবিতা।
এই ডোরার সঙ্গে পাকাপাকি জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন কাফকা। পরিকল্পনা করেছিলেন দুজনে পালিয়ে যাবেন ফিলিস্তিনে। শুরু করবেন হোটেলের ব্যবসা। ডোরা হবেন রাঁধুনি আর কাফকা ওয়েটার। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। কাফকার শারীরিক অবস্থার খুব অবনতি হয়। খবর দেওয়া হয় প্রাগে- তার বাড়িতে। বাড়ির লোকজন এসে কাফকাকে বার্লিন থেকে প্রাগে নিয়ে যান। প্রাগে গিয়ে নিঃসঙ্গ কাফকা প্রতিদিন দুটি করে চিঠি লেখেন ডোরাকে।
এরপর অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে ডোরা চলে আসেন প্রাগে, বার্লিন থেকে। চিকিৎসক ডক্টর ক্লপস্টকের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করেন কাফকা। তিনটি উপায় বের করেছিলেন তার মৃত্যু নিয়ে। এক. তাকে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে। দুই. ডোরা ও তিনি একসঙ্গে মারা যাবেন। তিন. তার অন্তিম মুহূর্ত আসার আগেই ডোরাকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যাতে কাফকার মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে দেখতে না হয়। ডাক্তার তৃতীয় ব্যবস্থাটি মেনে নেন। সেই মতো, ১৯২৪ সালের ৩ জুন ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার অছিলায় বাইরে পাঠানো হয় ডোরাকে। কিন্তু তাকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন কাফকা। তার অনুরোধেই দৌড় দিয়ে ডোরাকে ডেকে আনলেন কেউ। এদিকে ক্লপস্টককেও মিনতি করলেন, ‘আমাকে ছেড়ে যেও না।’ ক্লপস্টক বললেন, ‘আমি যাচ্ছি না।’ কাফকা উত্তরে বললেন, ‘কিন্তু আমি যাচ্ছি।’ এরপর চোখ বন্ধ করলেন। সে চোখ আর খুললেন না।
ডোরা ততক্ষণে চলে এসেছেন। তার হাতে ফুল। চোখে অশ্রুধারা। ফুলের গন্ধ নেওয়া হলো না কাফকার, দেখাও হলো না ডোরার অশ্রুধারা।
কাফকা মিলেনাকে লিখেছিলেন, ‘যৌনতার জন্য তার তাড়নার কারণে তার নিজেকে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ইহুদি বলে মনে হয়, অর্থহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি অর্থহীন নোংরা এক পৃথিবীর পথে। কিন্তু একই সঙ্গে যৌনতার মধ্যে রয়েছে স্বর্গ থেকে পতনের আগে স্বর্গের যে হাওয়ায় আমরা শ্বাস নিতাম সেরকম হাওয়ার কিছু একটা।’
অবিবাহিত থেকেও নারীসঙ্গ উপভোগ করা কাফকা সেই স্বর্গীয় হাওয়ায় কতটা নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলেন, কে জানে!