ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

কাফকার পাঁচ প্রেয়সী: নীল নৈঃশব্দের গোপন নিঃশ্বাস

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
কাফকার পাঁচ প্রেয়সী: নীল নৈঃশব্দের গোপন নিঃশ্বাস
লেখক ফ্রানৎস কাফকা

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা। জন্মেছিলেন ৩ জুলাই ১৮৮৩ সালে, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে। মাত্র নয়টি পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখেছিলেন ফ্রানৎস কাফকা। বাদবাকি সবগুলোই ছিল অসম্পূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি অসমাপ্ত উপন্যাস (মৃত্যুর পর বের হয় ১. দ্য ট্রায়াল ১৯২৫, ২. দ্য ক্যাসল ১৯২৬ এবং ৩. দ্য আমেরিকা ১৯২৭), কয়েকটি বড় গল্প, কিছু মুক্তগদ্য, ডায়েরি ও চিঠি। জীবদ্দশায় সাতটি রচনা বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে দ্য মেটামরফসিস বা রূপান্তর সবচেয়ে বিখ্যাত। যোগ্যতা ছিল কিন্তু নোবেল পাননি এরকম লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আর এ যাবৎ শতাধিক নোবেলপ্রাপ্ত লেখকের মধ্যে প্রায় ৪০ জন লেখক তাদের লেখায় কাফকার সরাসরি প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। বিখ্যাত এই লেখক মৃত্যুবরণ করেন ৩ জুন ১৯২৪ সালে।

কাফকা অকৃতদার ছিলেন। নানা ধরনের সংশয়ে ভুগতেন সবসময়। বিয়ে করে সংসার শুরু করলে, সন্তান এলে, সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে- এই ভয় ছিল মারাত্মক। কিন্তু নারীসঙ্গ পছন্দ করতেন। বিছানার দক্ষতা নিয়ে তার সংশয় কখনোই কাটেনি। অথচ বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের ভাষায়, কাফকা যৌন কামনার হাতে উৎপীড়িত হতেন। বিয়ের কথা উঠলে তার বাবা তাকে গণিকালয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি অনেকবার গণিকাসঙ্গও উপভোগ করেছিলেন।

১৯১৩ সালের ১৩ আগস্ট বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় গিয়ে তারই আত্মীয় এক তরুণীর প্রেমে পড়লেন কাফকা। তরুণীর নাম ফেলিৎসে বাউয়ার। বুদ্ধিদীপ্ত, ভালো চাকরি করা বার্লিনের মেয়ে। কাফকা তাকে অনুভব করতেন কিন্তু কামনা করতেন না। বছর ছয়েক সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সাকল্যে তিন-চারবার। পুরো যোগাযোগ ছিল চিঠিতে। ১৯১৫ সালে ফেলিৎসের সঙ্গে সময় কাটানোর পর ডায়েরিতে কাফকা লেখেন, ‘চিঠির ভুবন ছাড়া বাস্তবে আমি কখনো ফেলিৎসের সঙ্গে সম্পর্কের এই মধুরতাটুকু অনুভব করিনি, যা মানুষ প্রেমিকার সঙ্গে করে, তার প্রতি আমার শুধু অসীম ভক্তি’। ফেলিৎসেকে লেখা ৫০০ চিঠি নিয়ে পরবর্তীতে বের হয়েছে ‘লেটার টু ফেলিৎসে’। যা কতটা প্রেমপত্র আর কতটা কাফকার আত্মবিশ্লেষণ তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। ফেলিৎসের সঙ্গে প্রেমপর্বের ওই বছরেই তার কলম থেকে বের হয়েছে মেটামরফসিস, ট্রায়াল, স্টোকার জাজমেন্ট, আমেরিকার মতো একের পর এক লেখা। ফেলিৎসের সঙ্গে ১৯১৪ সালে তার বাগদানও সম্পন্ন হয়। কিন্তু ফেলিৎসেই সেটা ভেঙে দেন। দ্বিতীয়বার বাগদান হয় ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে। সেটিও ভেঙে যায়।

ফেলিৎসের সঙ্গে প্রেমপর্ব চলার সময়ই কাফকা গোপনে ফেলিৎসেরই প্রিয় বান্ধবী গ্রেটা ব্রুখের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। বন্ধু ম্যাক্স ব্রড দাবি করেছেন, গ্রেটার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল কাফকার।

১৯২০ সালে যখন রীতিমতো যক্ষ্মা জেঁকে বসেছে কাফকার ফুসফুসে তখন অসুস্থ অবস্থায়ই কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক মিলেনা এসেন্সকার। মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো নিয়ে পরবর্তীতে বের হয়েছে ‘লেটার্স টু মিলেনা’। মিলেনা ছিলেন বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে। কাফকা চেয়েছিলেন মিলেনা তার সঙ্গে এসে থাকুক। কিন্তু মিলেনা বিবাহবিচ্ছেদ চাননি। শেষমেষ সম্পর্কোচ্ছেদ হয়ে যায়। এই সম্পর্ক চলার সময়ই লিখেছিলেন দ্য ক্যাসেল। এক চিঠিতে কাফকা মিলেনাকে লিখেছিলেন, ‘লিখিত চুম্বনেরা কখনো গন্তব্যে পৌঁছয় না। মাঝপথে ভূতেরা এসে তাদের পান করে নেয়। আর নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছের সংবরণ করতে করতেই জীবনটা কেটে গেল।’

আগের মতোই, প্রথম প্রেমের মতোই, মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময় কাফকা প্রেমে পড়েন এক হোটেল পরিচারিকার। নাম ইউলি ওরিৎসেকের। ১৯১৯ সালের এক ছুটিতে তাদের পরিচয়। একপর্যায়ে তাদের বাগদান হয়। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা হয় সংসার যাপনের উদ্দেশে। বিয়ের তারিখও ঠিক করা হয়। কিন্তু ইউলির সামাজিক অবস্থানের জন্য কাফকার ওপর আবার খেপে যান তার বাবা। তখন কাফকাকে প্রয়োজনে গণিকালয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি। এ ঘটনা থেকেই জন্ম কাফকার বিখ্যাত ‘বাবাকে লেখা চিঠি’র। ইউলিকে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দেন কাফকা। আবার ঝুঁকে পড়েন মিলেনার প্রতি। ইউলি তাকে এক হৃদয়ছেঁড়া চিঠি লেখেন, ‘তুমি কি সত্যিই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

ইউলি ও মিলেনার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর অসুস্থতা বাড়তে লাগল কাফকার। ১৯২৩ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বাল্টিক সাগরের ধারে এক রিসোর্টে পরিচয় হলো ডোরা ডিয়ামান্টের সঙ্গে। খুব অসুস্থ, নিঃসঙ্গ, অবসন্ন, ভগ্নহৃদয় কাফকা তখন তার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট ডোরাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তার সর্বস্ব দিয়ে। ডোরাও কাফকার হৃদয়ের হাহাকার ও ডাক বুঝতে পেরেছিলেন।  তিনিও সাড়া দিয়েছিলেন সর্বস্ব দিয়ে।

যক্ষ্মায় ধুঁকতে থাকা আপাত ব্যর্থ লেখকের সঙ্গে সমাজবহির্ভূত সংসার পাতলেন ডোরা। তিনি একাই রোজগার করেন। ডোরা কাজে বের হলে কাফকা লেখার খাতা নিয়ে বসতেন। সন্ধ্যায় ফিরে এলে বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে তাকে শোনাতেন নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি। কখনো দস্তয়েভস্কি থেকে কখনো গ্যেটের বই থেকে কবিতা।

এই ডোরার সঙ্গে পাকাপাকি জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন কাফকা। পরিকল্পনা করেছিলেন দুজনে পালিয়ে যাবেন ফিলিস্তিনে। শুরু করবেন হোটেলের ব্যবসা। ডোরা হবেন রাঁধুনি আর কাফকা ওয়েটার। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। কাফকার শারীরিক অবস্থার খুব অবনতি হয়। খবর দেওয়া হয় প্রাগে- তার বাড়িতে। বাড়ির লোকজন এসে কাফকাকে বার্লিন থেকে প্রাগে নিয়ে যান। প্রাগে গিয়ে নিঃসঙ্গ কাফকা প্রতিদিন দুটি করে চিঠি লেখেন ডোরাকে। 

এরপর অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে ডোরা চলে আসেন প্রাগে, বার্লিন থেকে। চিকিৎসক ডক্টর ক্লপস্টকের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করেন কাফকা। তিনটি উপায় বের করেছিলেন তার মৃত্যু নিয়ে। এক. তাকে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে। দুই. ডোরা ও তিনি একসঙ্গে মারা যাবেন। তিন. তার অন্তিম মুহূর্ত আসার আগেই ডোরাকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যাতে কাফকার মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে দেখতে না হয়। ডাক্তার তৃতীয় ব্যবস্থাটি মেনে নেন। সেই মতো, ১৯২৪ সালের ৩ জুন ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার অছিলায় বাইরে পাঠানো হয় ডোরাকে। কিন্তু তাকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন কাফকা। তার অনুরোধেই দৌড় দিয়ে ডোরাকে ডেকে আনলেন কেউ। এদিকে ক্লপস্টককেও মিনতি করলেন, ‘আমাকে ছেড়ে যেও না।’ ক্লপস্টক বললেন, ‘আমি যাচ্ছি না।’ কাফকা উত্তরে বললেন, ‘কিন্তু আমি যাচ্ছি।’ এরপর চোখ বন্ধ করলেন। সে চোখ আর খুললেন না। 

ডোরা ততক্ষণে চলে এসেছেন। তার হাতে ফুল। চোখে অশ্রুধারা। ফুলের গন্ধ নেওয়া হলো না কাফকার, দেখাও হলো না ডোরার অশ্রুধারা।
কাফকা মিলেনাকে লিখেছিলেন, ‘যৌনতার জন্য তার তাড়নার কারণে তার নিজেকে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ইহুদি বলে মনে হয়, অর্থহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি অর্থহীন নোংরা এক পৃথিবীর পথে। কিন্তু একই সঙ্গে যৌনতার মধ্যে রয়েছে স্বর্গ থেকে পতনের আগে স্বর্গের যে হাওয়ায় আমরা শ্বাস নিতাম সেরকম হাওয়ার কিছু একটা।’

অবিবাহিত থেকেও নারীসঙ্গ উপভোগ করা কাফকা সেই স্বর্গীয় হাওয়ায় কতটা নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলেন, কে জানে!

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম
বিষাদ বসুধা

গত সংখ্যার পর

শিল্পপতিরা পত্রিকা বের করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা সেটা জেনেও সেই হীনস্বার্থেই ব্যবহৃত হন। মূলত শিল্পপতিদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত তারা। শাহবাজ খানের কাছে একজন সম্পাদক আসিফ আহমেদ যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন, যেভাবে তার ন্যায়সঙ্গত কোনো যুক্তিই গ্রহণ না করে, কর্মচারী ছাঁটাইয়ের শক্ত শর্ত অনিবার্য করে তোলে, সেখানে আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিরূপায় হয়ে পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। লেখক আলোর নিচের কঠিন এক অন্ধকারকে পাঠকের সমানে উপস্থাপন করে মহৎ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। সত্যধারণ ব্যতিত কখনো কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না, সত্যকে অস্বীকার করে বা সত্যকে না দেখার ভান করে কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হলে কখনোই তা মহৎ শিল্পকর্মের মর্যাদা লাভ করে না। 

মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য শিল্পীকেও সত্যসাধক হতে হয়, বুকে হিম্মত থাকতে হয়। মোস্তফা কামাল ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাসে সত্য ধারণের হিম্মত দেখাতে পেরেছেন। কারণ তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিক। তার জন্য এই সত্য প্রকাশ আরও কঠিন। সেই কঠিনকে তিনি জয় করেছেন। আর সে কারণেই কালের যাত্রাই উপন্যাসটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। শিল্পদ্যোক্তারা নিজের পত্রিকার সংবাদকর্মীদের কর্পোরেট অফিসের কর্মচারী ব্যতীত অন্যকিছুই ভাবেন না। যে কারণে আসিফ আহমেদের মতো একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সম্পাদককেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে পারেন। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত দেখা না করে তাকে ফিরিয়েও দিতে পারেন। তাদের বিবেকে এগুলো কোনো কাজ করে না। তাদের কাছে মূলত অর্থ বিবেচ্য, সম্মানবোধ নয়। অথচ আসিফ আহমেদ অসম্ভবরকমের ধৈর্য্য নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এখানে আমরা নানাভাবে অপচয় বন্ধ করে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে আনতে পারি। সেটা করলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। দাম্ভিক শাহবাজ খানের মাথায় একটাই- চিন্তা লোক ছাঁটাই করা, কোনো টাকা দিতে পারবেন না। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বকেয়া কোটি কোটি টাকা তাও পরিশোধ করবেন না। করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও শাহবাজ খান সম্পূর্ণভাবে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনিই আবার মোহিনীর জন্মদিনে ফুল পাঠিয়েছেন। অদ্ভুত ভয়ানক ও বীভৎস চরিত্রের শাহবাজ খান রূপশ্রী বান্ধবী মোহিনীর জন্মাদিন মনে রাখেন এবং ফুল পাঠান। 

অথচ পুরো দেশে তখন করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসংকট প্রবলভাবে। নিজের পত্রিকার লোকজন তখন অনিশ্চয়তায় ভাসছেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই শ্রেণির শিল্পপতিদের কাছে সাধারণ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই স্পর্শ করে না। বরং সুযোগ পেলে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েই আনন্দ লাভ করেন। শাহবাজ খান সেই নির্মম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের শিল্পপতিরা এখনো যে সাংবাদিকদের নিছক কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, কঠিন এই সত্য উপন্যাসটিতে আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কারণে আসিফ আহমেদ আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ পদত্যাগে তার বুকের পাঁজর কতটা ভেঙেছে, কতটা ব্যথিত হয়েছেন, তা সহজেই অনুধাবন করা যায় লেখকের ভাষায়, ‘আসিফ আহমেদ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেক যত্নে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেটি তাকে আজ ছেড়ে যেতে হবে। গভীর এই মর্মবেদনা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। তিনি চলে গেলে যদি সবার চাকরি থাকত তাহলেও তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। তিনি চলে যাওয়ামাত্রই ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে। কতজন যে চাকরি হারাবে কে জানে!’ এখানে খুব সহজেই আসিফ আহমেদের হৃদয়ের যন্ত্রণাদগ্ধ রক্তক্ষরণ অনুভব করা যায়, একই সঙ্গে শাহবাজ খানের হীন-মানসিকতার স্বরূপটিও সহজেই চিনে নিতে পারি। একদিকে তিনি নিজের পত্রিকার লোকজনকে করোনায় মহাবিপদে ঠেলে দিচ্ছেন, আর একদিকে তিনি ঘুমের ভেতর ‘মোহিনী’কে ডাকছেন। মোহিনী তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একসময় মোহিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বন্ধুত্বে যতটুকু মানায় ততটুকুই থেকেছেন। মাঝে দীর্ঘ যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ নতুন করে সেই সম্পর্ক তাজা হয়ে ওঠে। তা অনেকটাই শাহবাজ খানের কারণেই। এটি আরও বেশি প্রাণ পায় শাহবাজ খান যখন জানতে পারেন আরেফিন মারা গেছেন। আগ্রহ অগ্নিতে রূপ নেয়। সেটা তার ঘুমের ভেতরও দখল নেয়। শাহবাজ খান অসংখ্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, এ নিয়ে পরিবারে স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে তার প্রকট সমস্যা। তার চারিত্রিক এই ত্রুটি নীলিমা খান মেনে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে অপমানে শাহবাজ খানকে ছেড়ে চলে যান তিনি। শাহবাজ খানের মধ্য দিয়েই লেখক সমাজের উঁচুস্তরের একশ্রেণির মানুষের দুর্গন্ধভরা কদর্য রূপ অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উন্মোচিত করেছেন।

করোনাকালীন চিকিৎসাব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটিকে আরও বড় সত্য করে প্রতিষ্ঠিত করেছে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবায় যখন পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, স্বার্থমন্ত্রী চাকরি রক্ষা করতে সাহেদ করিমের ফাঁদে পা দেন। সাহেদ করিম নিয়মিত টিভি টক শ করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ দামিনামি ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি। এসব দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে নিজের ত্রাণকর্তা ভেবে বসেন। এবং করোনা টেস্টের অনুমতির চুক্তি করেন সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে।  সাহেদ করিম এখানে পুরো দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কোনোরকম করোনা টেস্ট না করে রিপোর্ট দিতে থাকেন। মানুষ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। জনমন থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের মনে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে সাহেদ করিমের প্রতারণা। এরকম অসংখ্য প্রতারণা ও দুর্নীতি খবরে যখন টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা সয়লাব হয়ে ওঠে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। পারিবারিকভাবেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সাহেদ করিমকেও তিনি আর পাশে পান না। তিনি মন্ত্রী হয়ে সাহেদ করিমের অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভনে নিজেকে অসহায় ভেবেছেন, তার কথাতেই তার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহেদ করিমের সঙ্গে যখন প্রথম প্রথম কথা হতো, তাকে যখন টাকা ও ক্ষমতার গল্প শোনাতেন, তিনি বিস্মিত হতেন। আর বিস্ময়ের ভেতরেই নিজের মনের ভেতর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সাহেদ করিম চলে যাওয়ার পরে প্রবল ক্ষমতাধর এই মন্ত্রী সাহেদ করিমকে নিয়ে ভাবেন, একটা হাসপাতালের মালিক! তার কত টাকা! এই দেশে টাকা থাকলে কি না হয়! আমি ঘোড়ার ডিমের মন্ত্রী। আমাকে কেউ পোছেও না। উল্টো মানুষের গালমন্দ! মিডিয়ায় উল্টাপাল্টা রিপোর্ট। মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হলো! না, কিছু ভালো লাগে না।’ তার এই ভাবনার ভেতর গণমানুষের স্বার্থের কল্যাণকামী কোনো ভাবনা নেই, করোনা থেকে দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করবে সেই চিন্তা নেই, শুধু আছে নিজের হীনস্বার্থপরতার কথা, আছে সাহেদ করিমের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যর্থতার ভাবনা। এক অসম্ভব ব্যক্তিস্বার্থলোভী ঠুনকো এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তার পদত্যাগের জোরালো দাবিতেও তিনি নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছেন। মানুষের জীবন রক্ষা নয়, যে কোনো উপায়েই হোক মন্ত্রিত্ব রক্ষা করাই তার কাছে বড়। এবং তিনি সেটাই করেছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনাকালীন এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত ভেঙে পড়েছিল। নানাভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেবা পায়নি। বড় হাসাপাতালে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা হয়নি। টাকার বাণিজ্য চলেছে। রোগী না থাকলেও আইসিইউ ভাড়া করে রাখত একশ্রেণির ধনীরা, কখনো তাদের পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাদের সেবার জন্য। কোনো সভ্য দেশে এটা ভাবা যায়! অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিয়ে পরিবারের আপনজনরা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, ভর্তি করাতে পারেননি, সেবা পাননি। পথে পথেই মৃত্যু হয়েছে বহু রোগীর। এই কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভর্তি করলেও অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে, অক্সিজেন না দিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলা দেওয়া হয়েছে। 

চলবে...

 

কারাগার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম
কারাগার
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

কেরানির পোস্টে চাকরি করতেন কফিল উদ্দিন। অফিস থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কী তার অপরাধ, তিনি নিজেও জানতেন না। তবে চারদিকের পরিবেশ যে অশান্ত, তা টের পান। ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগের পর জেল থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে এসে প্রথম যে মুখটি তার মনে পড়ল তা হলো তার ছেলের মুখ। বিয়ের পর প্রায় পাঁচ বছর নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। একটা সন্তানের জন্য ভয়াবহ হাহাকার ছিল তার। ফলে এই পাঁচ বছর যে বা যারা যা পরামর্শ দিয়েছেন তাই মাথায় সমাদরে নিয়েছিলেন। কবিরাজি থেকে শুরু করে তাবিজ-তুম্বা, ঝাড়ফুঁক কিছুই বাদ যায়নি। অবশেষে একদিন তার স্ত্রী সুখবরটা দেন। কিন্তু বিধি যদি আপনাকে নিয়ে পরিহাস করে আপনি যা চাইবেন ঠিক সেভাবে পাবেন না। ছেলেটি জন্ম নিল প্রতিবন্ধী হয়ে। তবুও তো বাবা হতে পেরেছেন। আনন্দে আটখানা তিনি। কোলেকাঁখে নিয়ে ঘুরতেন। নিজ হাতে খাওয়াতেন। রাতে বুকের ওপর নিয়ে শুতেন। পেশাব-পায়খানা নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। প্রতি বছর প্রতিবেশীদের নিয়ে হইহুল্লোড় করে তার জন্মদিন পালন করতেন। বিষণ্ন বিকেল। ছেলের মুখ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

কানাগলির ভেতর একটা টিনশেড বাসায় পুত্রপরিজনসহ থাকেন তিনি। দুটো ছোট্ট রুম। সারাক্ষণ ঝুপঝুপ অন্ধকার। বারান্দা বলতে কিছু নেই। এ রকম গুমোট পরিবেশও তাকে অনাবিল আনন্দ এনে দেয় যখন তিনি ছেলের সঙ্গে হাতিঘোড়া নিয়ে খেলায় মত্ত থাকেন। সেই খেলনাগুলো প্রায় নষ্ট ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ছেলের কথা ভেবে ফুটপাত থেকে একটা নতুন হাতি কিনলেন। হাতি সাধারণত কালো রঙের হয়; কিন্তু এই হাতিটা বেশ রংচঙা। ঘোড়া-ট্রেনও কিনতে মন চাইছিল, কিন্তু তার পকেট তাকে সাবধান করে। অগত্যা অপূর্ণতা নিয়েই বাসায় ফিরলেন। দরজা ভেজানো ছিল। বাইরে থেকে বউয়ের নাম ধরে গলা ফাটালেন; কিন্তু সাড়া মিলছিল না। কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হলো। আস্তে করে দরজা ঠেললেন। জংধরা টিনের দরজা। ক্যাঁ-কোঁ শব্দ করে হাট হয়ে গেল। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল তার। খোঁজাখুঁজি করলেন। ছেলেটাকে খাটের নিচে পেশাব-পায়খানার ওপর নিথর পড়ে থাকতে দেখে তার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে বেরিয়ে এল চিৎকার। বউয়ের নাম ধরে আবারও ডাকলেন। বউ থাকলে তো! ছেলেকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করলেন। তার কপালে-শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলেন বেঁচে আছে তো! প্রাণের স্পর্শ পেলেন, কিন্তু তাপমাত্রা অনেক। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। কোলে উঠিয়েই ত্বরিত মহল্লার ডাক্তারখানায় গেলেন। 

মরতে মরতে বেঁচে গেছে! আর কয়েক ঘণ্টা দেরি করলেই শেষ! আপনারা মানুষ? এরকম ধমক ও ছেলের পরিষেবা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। প্রতিবেশীর কাছে শুনলেন, দুই দিন আগে থেকে মহিলা লাপাত্তা। একজন তরুণী ইতস্তত বোধ করলেও বলতে বাধ্য হলো, ভাবিকে এক যুবকের সঙ্গে রিকশায় দেখেছে সে। মাথাটা চক্কর দিল তার। এ জন্য দায়ী তিনি নিজে। কারাগারে যাওয়ার কয়েক মাস আগে বউকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলেন। মোবাইল পাওয়ার পর বউ সন্তান তো বটেই, খাওয়া-নাওয়া পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। টিকটক, ইউটিউব, চ্যাটিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত সে। বউকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন তিনি; তাই এসব বিষয় আমলে নেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। চোখে ঘোর অমানিশা। কী করবেন, দিশা পাচ্ছিলেন না। কারণ, এ প্রতিবন্ধী ছেলেকে কে দেখভাল করবে? কে তার দায়িত্ব নেবে? জেলে যাওয়ার কারণে চাকরিটা আছে কি না, সে চিন্তাও তার মাথায় কুটকুট করে কামড়াল। পরদিন, ছেলেকে কাঁধে নিয়ে অফিসে গেলেন। তার বস একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাপোর্টার। ভিন্নমতালম্বীদের সহ্য করতে পারেন না। তাকে বাইরে বসিয়ে রেখে বকেয়া পাওনা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শীতল মেজাজে ‘সরি’ বলেই তার পর্ব শেষ করলেন।

আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। একদিকে সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধ, আরেকদিকে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। একটা ছোটখাটো চাকরির জন্য অফিসের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। কতিপয় নোংরা মানুষের দুয়োধ্বনি ছাড়া কপালে কিছুই জুটল না। বেকারত্বের অভিশাপ যখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, ঠিক সে সময় তার এক বন্ধু এগিয়ে এলেন। তিনি স্টকমার্কেটের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। তবে ভাগ্যবান; যে স্টকেই বিনিয়োগ করেছেন, সেখান থেকেই প্রফিট ঘরে তুলেছেন। চাকরিবাকরি না করেও তার সংসার দিব্যি চলে। তার পরামর্শে যা সঞ্চয় ছিল, তা স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ করলেন। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কয়েকদিন হাউসে ঘুরলেন। শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকল তার স্টকের দাম। বাড়তে বাড়তে দেড় মাসের মধ্যে দ্বিগুণ। তার বন্ধু তাকে বেচার পরামর্শ দিলেন; কিন্তু তিনি কর্ণপাত করলেন না। ভয়ংকর লোভে পড়লেন। তার স্বপ্নের শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটাল। যে ছেলেকে ভালোমতো সময় দিতে পারেন না, মনের খুশিতে তাকে আদরযত্নে ভরিয়ে দিলেন। ছেলের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন টাকাটা তিন গুণ হলেই ইন্ডিয়ায় যাবেন। ভালো ডাক্তারের অধীনে তার চিকিৎসা করাবেন। এমনকি তার দেখভালের জন্য বেবিসিটার পর্যন্ত রাখবেন। তার কথার অর্থ ছেলে বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে তার গালে দুষ্টামি করে চিমটি কাটেন, মাথা ধরে ঝাঁকুনি দেন। 

কিন্তু তিনি যে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খাবেন, তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না; কারণ, স্টকমার্কেটে তার অভিজ্ঞতা জলে না নেমেই গভীরতা মাপার মতো। তার সুহৃদ বন্ধু আবারও তাকে বিক্রির পরামর্শ দিলে এবার তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন। ভাবলেন, তার বন্ধু তার ভালো চায় না। চাইলে এরকম জোরজবরদস্তি করে? ইচ্ছে করেই বন্ধুকে এড়িয়ে চললেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই মার্কেটে ধস। ব্যাপক দরপতন। যা বিনিয়োগ করেছিলেন, তা তলানিতে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব। স্বপ্ন চুরমার। মানসিক টানাপোড়েনে ধূমপান বাড়িয়ে দিলেন। একের পর এক সস্তা সিগ্রেট। সিগ্রেট কেনার পয়সা না পেলে যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। অ্যাশট্রে-তে জমানো ছাইভষ্ম হাতের তালুতে ঢেলে খেয়ে ফেলতেন। তাতেও স্বস্তি না মিললে রাস্তায় নামতেন। আটআনা, একটাকার মুদ্রা যা-ই কুড়িয়ে পেতেন, তা দিয়ে বিড়ি কিনতেন। কিন্তু ছেলের মুখে কী তুলে দেবেন? বিড়ি? নাহ! খাবার কিনতে পয়সা লাগে। যে বন্ধুটিকে সবচে’ কাছের ভাবতেন, তার কাছেও যেতে পারছেন না, কারণ, তিনি তার কথা শোনেননি। ধারদেনা করে কিছুদিন চললেন, তার পর আটকে গেলেন; একেবারে কাদায় গরুর গাড়ি আটকে যাওয়ার মতো। চোখে সরষে ফুল। অন্ধকার খাদে তার পৃথিবী যেন কঠিন গদ্যময়। চোখের নিচে কালি, গণ্ডদেশে কালশিটে। উসকোখুসকো চুল ক্রমশ জটার দিকে ধাবিত। তোবড়ানো মুখে চাপদাড়ি। সময়ের আগেই বয়সের ভারে বেশ ন্যুব্জ। হঠাৎ এতটাই পরিবর্তন, তাকে দেখলে পরিচিতরাও ভিড়মি খান। বিড়বিড় করেন, এই মানুষটার হলো কী!

বাড়িভাড়া দিতে না পারায় মালিক ঘনঘন দরজার কড়া নাড়েন। এই সামনের মাসে দেব, এক জায়গায় টাকা আটকে আছে, এসব কাকুতি-মিনতিতেও বাড়িঅলার মন গলে না। বাড়িছাড়ার তাগাদা দেন। এদিকে পাওনাদাররাও কম কীসে! হুমকির পর হুমকি। ফলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হোন। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার এবং তাদের বসবাস যেখানে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। পালিয়ে বেড়ানোই উত্তম। ডাস্টবিন থেকে খাদ্য-অখাদ্য কুড়িয়ে খান। ছেলেকেও খাওয়ান। প্রায়শ দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররা যে কসাই, বিনেপয়সায় কে তাদের চিকিৎসা করবে! পরিস্থিতি ভয়ানক নাজুক। কখনো খিদের কামড় সহ্য করতে না পেরে আমজনতার কাছে হাত পাতেন; কিন্তু তাদের করুণালাভে ব্যর্থ হোন। মাথা চুলকান। বুঝতে পারেন মাথাটা অকামের জঞ্জাল হয়ে উঠেছে। ভালো বুদ্ধি কাজ করে না। উপায়ান্তর না পেয়ে ছেলেকে রেললাইনের ধারে ফুটপাতের ওপর শুইয়ে দেন। তার পর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন: ভাই, কিছু সাহায্য করেন। লাশটাকে দ্যাশে নিতে চাই। কিন্তু সেখানেও বাগড়া। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে তাকে উঠিয়ে দেয়। জীবনযুদ্ধে এতটাই পর্যুদস্ত, এতটাই অসহায় রাগে-ক্ষোভে চরম বিরক্তিতে ছেলেকে নর্দমায় ফেলে দেন। পেছন ফিরে আর তাকান না। চলে আসেন খানিকদূর। হোক না প্রতিবন্ধী; হাজার হলেও ঔরসজাত। বুকটা ধড়ফড় করে, হৃৎপিণ্ড মোচড় দেয়, পা টলমল করে। পিতৃত্বের অমোঘ টানে আবার ফিরে আসেন নর্দমার কাছে। দেখেন, ছেলেটা মরেনি। দেহটা কাদার মধ্যে ডুবে গেলেও মাথাটা ওপরে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। যেন কারও দিকে তাকিয়েছিল সে। ছেলের আকুতিভরা নিষ্পাপ মুখ দেখার পর তার মৃতপ্রায় চোখদুটো ছলছল করে উঠল। এক পা-দু পা করে নিচে নেমে ছেলেকে টেনে তুললেন। তার পর বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বুক ফেটে কান্না আসছিল তার, কিন্তু কেঁদে কী লাভ? কান্না পাথরচাপা দিয়ে ছেলেকে কাঁধে নিলেন। 

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন শহরের একপ্রান্তে। কোথায় তার গন্তব্য, জানেন না তিনি। হৃদয়হীন সমাজে আঘাত পেতে পেতে তার মস্তিষ্ক পচে গেছে, গলে গেছে, তবুও সেখান থেকে বোধের চারা গজাল; আচ্ছা, ছেলেটাকে যদি তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! পরক্ষণে ভাবলেন, যে মা তার বিকলাঙ্গ সন্তানের চিন্তা না করে স্বীয় সুখের আশায় পরপুরুষের সঙ্গে গৃহত্যাগ করতে পারে, তার হৃদয় কতটা দয়াদ্র! এবার স্ত্রীকে না, নিজেকেই দোষারোপ করে তার ভাবনাকে গুরুত্ব দিলেন। শুনেছেন, এদিকেই তার প্রাক্তন স্ত্রী কোনো না কোনো বাড়িতে তার স্বামীর সঙ্গে থাকে। কীভাবে তাকে খুঁজে পাবেন, এলোমেলো ভাবনাগুলো হঠাৎ শিস দিল। তার প্রাক্তন স্ত্রীর এক বান্ধবী অনেক আগেই তার বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিল। সে মোতাবেক বাড়িটা হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। তখন প্রায় সন্ধ্যে। কাকতালীয়ভাবে সেই বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রকাণ্ড লোহার গেট। দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দরজার ওপর উপর্যুপরি ধাক্কাতে থাকেন। ধাক্কানোর শব্দ পৌঁছে যায় অন্দরমহল অবধি। এক সময় দরজা খোলেন এক ভদ্রমহিলা। কিন্তু তিনি তাদের দেখামাত্র বিপদ আঁচ করে দড়াম করে দরজা বন্ধ করেন তাদের মুখের ওপর। অপমান কী জিনিস, তা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। ভগ্ন হৃদয়ে সরে এসে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু ছেলেটা খিদের কারণে কুকুরের বাচ্চার মতো কুঁইকুঁই আওয়াজ তুলছিল। তার পেটও রাক্ষসে আচরণ করছিল। ছেলেকে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে হোটেলে খাবার চুরি করতে গেলেন। ধরা খেয়ে বেধড়ক পিটুনি। হোটেলবয়রা তাকে পুলিশে দিল। পুলিশের হাত-পা ধরেও যখন থানা থেকে ছাড়া পাচ্ছিলেন না, তখন মলমূত্র ত্যাগ করে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়ালেন। বমি করতে করতে পুলিশ অবশেষে গরাদের দরজা খুলে দিল। 

ততক্ষণে একরাত একদিন পেরিয়ে গেছে। ছেলের কাছে পৌঁছে দেখলেন তার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। ছেলেকে একবার স্পর্শও করলেন না। ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলল। সোজা চলে এলেন সেই হলুদ বাড়িতে। প্রাচীর টপকালেন। শ্বাসরোধ করে হত্যা করলেন পরস্ত্রী হরণকারীকে। তার প্রাক্তন তখন পুলিশকে মোবাইল করছিল, তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তার মুখে জোর করে মোবাইল ঢুকিয়ে একপ্রান্তে সজোরে আঘাত করলেন; সঙ্গে সঙ্গে গলায় আটকে গেল মোবাইলটা। তার পর তিনি নিজেই পুলিশে ধরা দিলেন। 

জেলগেটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো এ দেশ বিবেকশূন্য মানুষদের কারাগার, আর তার জীবন একটা বিষাক্ত কারাগার।

মুগ্ধতার জ্যামিতি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫১ পিএম
মুগ্ধতার জ্যামিতি

মুগ্ধতার কোনো জ্যামিতি হয় না।
এই ঘোরে কেউ পড়লে তন্ময় লেগে থাকে প্রেম অবধি। 
একবার ভালোবাসা হয়ে গেলে মুগ্ধতাকে অনেকদিন আগের সমুদ্র ভ্রমণের মতো মনে হয়।

দীর্ঘ খরা শেষে আজকে কেমন মিহি মিহি হাওয়া বহে মনের দক্ষিণা জানালায়। 
সজলপল্লবের মুখরতা দেখে বিকেল আঁড়ি করেছে সন্ধ্যার সাথে। 
আবারও আমি থালা সাজিয়েছি জল বাতাসা দিয়ে। 
মনের একতারায় বাজছে বাউলগান।

সকালের উলঙ্গ উঠোন অপেক্ষা করছে মারুলির আধ্যাত্মিক আদরের...
অনিঃশেষ গদ্যরা বুঝে গেছে আবারও মুগ্ধতায় প্রেমের কবিতা লেখা যায়।
পাণ্ডুলিপির ভয়াবহ ভাঁজে লুকিয়ে যাক বিরহ গাঁথা। 
কেমন যেন চক্রাকারে ঘুরছে দিন,
সদ্যজাত কোন দিনের পেটে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন সূর্য। 
আসলে প্রতিটি দরজার পেছনেই সমীকরণ থাকে এই সমীকরণকে আমরা সমাধান করি ভাগ্য দিয়ে।

বসন্তের সেমিনার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫০ পিএম
বসন্তের সেমিনার

বাসস্টপ থেকে রোজ রোজ ফিরে আসি
কখনো হেঁটে আসি পূর্বজন্ম থেকে 
তারপর ট্রাফিক জ্যামের কথা লিখে রাখি নতুন জামায়।
শহরের বুকে ফেরী হয় উপকথা।

আমি জলের ওপর ভরসা রেখেছিলাম
জলের আর এক নাম কি স্তব্ধতা?
ভোকাট্টা হয়ে উড়ে গেছে আমার ঘুড়ি।
ঘুড়ি থেকে ঘোড়া- আমি ব্যস্ত নিজস্ব দৌড়ে। 

পৃথিবীর হৃদপিণ্ডে তারপরও বসন্তের সেমিনার...

একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

পড়ন্ত বিকেলে তুমি কেঁদেছিলে।
অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তোমার মনে। 
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো তফাতই খুঁজে পাচ্ছিলে না তুমি। 
কিন্তু তোমার বেঁচে থাকা দরকার। 
না, নিজের জন্য নয়। 

বিকেলটা সেই থেকে একটা জগদ্দল পাথর হয়ে বুকে চেপে আছে।

তোমার ড্রয়িংরুমে তুমি যখন ভোরে চা নিয়ে বসো
পুবের জানালা দিয়ে সকালবেলার রোদ
তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।  
তুমি স্নান করো; তোমার সৌরভের লোভে
স্বর্গ থেকে নেমে আসে কিন্নর-কিন্নরী।
তুমি শাড়ি পরো; অপ্সরীরা বৃত্ত রচনা করে 
নৃত্য করতে করতে তোমাকে দেখে।

না, তোমার পায়ে সোনার নূপুর নেই
তবু তুমি যখন নামতে থাকো, সিঁড়িগুলো
নিক্কনে শিহরিত হয়

আর তুমি যখন মাটিতে পা রাখো
তোমার বারোমেসে শিউলিগাছটা 
নিত্যদিনের অভিনব বিস্ময় নিয়ে 
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

একটা মহাযান তোমাকে তুলে নিয়ে যায়
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে। সেখানে প্রণয় আছে, রক্তপাতও আছে।
তুমি হাসো, তুমি গাও। আর লড়াই করো- যেন পরীর ফিনফিনে ডানা
বসন্তের দখিনা বাতাসে যৎসামান্য স্পন্দিত হলো। 

অশ্বমেধযজ্ঞ শেষে ঘরে ফেরো। তখন ঘরই গন্তব্য। 
তখন শরীরে ক্লান্তি, মর্মে ধুলো। 
তখন তুলোর পুতুল চালচুলোয় মেতে ওঠে।
আর তখন সংসার সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। 
রণ হুঙ্কারে মাতালের মতো টলে ওঠে সমস্ত রঙিন দেয়াল। 

তোমার নিজস্ব আলোকিত দ্বীপ
এক ফুঁৎকারে নিভে যায়। 

না, আলো অত সহজে মরে না। 
পড়ন্ত বিকেলের সেই চোখের জল বজ্রবিদ্যুৎ হয়ে ফিরে আসে

তারপর শান্তি নামে, একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর 
দিকে দিকে আলোর পুষ্প হয়ে ফুটে ওঠে তোমার সন্ততি।