অরুণোদয়ের আগেই উদয় পালের বাড়িতে মৃত্তিকায় তৈরি বাসনকোসন পোড়ানোর ভাটার হাপর জ্বলছে। পালবাড়ির বড় ছেলে রাতুল পাল আর ছেলের বউয়ের ঘুম ভেঙেছে সবার আগে। পালবাড়ির ভেতরে ছোট্ট একটা মন্দির। সেখানে বসে উদয় পালের স্ত্রী মিনতি পাল প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় শিঙা বাজায়। আজও শিঙা বাজাচ্ছে। বড় ছেলের বউ রেণুকা পাল জ্বলন্ত ভাটার হাপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। করাত কলের গুঁড়ো আর খড়ি যখন একসঙ্গে জ্বলে তখন ভাটার হাপরে দপ্ দপ্ শব্দ হয়। শব্দটা বুকে এসে লাগে রেণুকার। রতন পালের সঙ্গে এক বছর আগে পরিণয় সূত্রে এ বাড়িতে এসেই মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে রেণুকা। সময় সময় রতন পালের ওপর খুব রাখ হয় রেণুকার। সে ভাবে, লোকটা একেবারেই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে করতে সেও মাটির মতো সর্বংসহা হয়ে গেছে। এত কটু কথা কই, এত বকাঝকা করি তবুও উচ্চবাচ্য করে না। ঘরে আর দুই দিন পরেই লোকটা বলেছিল, শোনো রেণু, মাটি আর সুতা দুটোই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে ধৈর্য থাকতে হয়, মাটির মতো নরম হতে হয়। সুতার সঙ্গে একই আচরণ করা লাগে। একটু টান লাগলেই সুতা ছিঁড়ে যায়। কুমার আর তাঁতিদের ধৈর্যহারা হলে চলে না। রাগও মাটি করতে হয়। সেদিন থেকেই বুঝে গেছি লোকটার স্বভাব। মানুষ নরম হয়, তাই বলে এত নরম হয়!
রতন ভাটার হাপরে খড়ি দিচ্ছে। রেণুকার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। দইয়ের মালসা, ঢাকুন, ঢোকসা, হাঁড়িপাতিল পোড়াচ্ছে রতন। বোশেখ মাসে ভাটা বন্ধ থাকে। ভাটায় আগুন জ্বলে না। তার পর বৃষ্টির সময় ঠিকমতো কাজ করা যায় না। শীতকালটা কাজের উপযোগী সময়। এ সময় এঁটেল মাটির অভাব হয় না। মাটি ক্রয় করা, তা কেটে এনে মাটির টিবি বানিয়ে জমা রাখা। এ সময় রাতদিন কাজ করতে হয়। বোশেখ আসার আগেই কলস, কয়েলদানি, খোলা-বালেন, কোলা, মাটির ব্যাংকসহ নিত্যব্যবহার্য বাসনকোসন তৈরি করে ঘরে মজুত করে রাখা লাগে। রেণুকা বাড়িতে আসার পর রতনের শনৈ শনৈ উন্নতি হচ্ছে। রেণুকা ফুলদানি, রঙিন মাছ, খেলনা পুতুল, কলমদানিসহ নানারকম মাটির জিনিস তৈরি করতে পারে। রেণুকার প্রতি পরিবারের সবাই খুশি। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। শ্বশুরবাড়িতে রেণুর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তার কথামতো সবকিছু হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুর কথার বাইরে কিছু করে না। এক বছরে সবার মন জয় করে শ্বশুরবাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে।
রতন অনেকক্ষণ পর রেণুকার দিকে নেত্রপল্লব ফেরালো। রেণুকে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রতন বলল, কিছু কবা-
-কী কব? তুমি কি কথা কও। বোবার সঙ্গে থাকতি থাকতি বোবা হয়ে যাচ্ছি।
-কাম করব না কতা কব। গত কয় মাসে কী কষ্টই না গেল। এঁটেল মাটি কিনে বাড়িতি আনা, টিবি বানানো, মাটি ছেনা, চড়কায় তোলা, জিনিসপত্র বানানো, কত্ত কাম।
-তুমি বিয়ে করিছিলে ক্যা, কও তো?
-কী সব আবোল-তাবোল কতা কচ্ছ। তুমার কোনোটার কমতি আছে?
-তোমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই মাটির সঙ্গে আছি। মাটির গন্ধ নিয়ে আছি। মাটি নিয়ে খেলছি। তুমিও তো মাটিরই, তোমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি না। তোমাকে নিয়ে খেলার সময় দিলে কই?
-বাব্বা, ভালোই তো কতা শিখিছ। সামনের বোশেখে তুমাক সময় দিব। বোশেখ মাস বিয়ের মাস। দেখতি দেখতি এক বছর হতে চলল। কী খুশি তো?
-তুমি আমাক সময় দিবা, তুমি তো কাঁচা খড়ির মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাও।
-আঘাত দিয়ে কথা কচ্ছ রেণু। তুমাক ভালোবাসি। জানের মিদি রাখি। তুমি আমন কতা কলি বাঁচপো না রেণু।
রেনু এগিয়ে গিয়ে রতনের ঘেমে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
-আরে বাপু টোকা দিয়ে দেখলাম। মন খারাপ করিছ। ইতিউতি চেয়ে রতনের কপালে আলতো করে চুমো খেল রেণু।
রেণুকার চুমো পেয়েও খুশি ছড়াল না রতনের বিষণ্ন মুখে। করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো রেণুকার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল রতন। ভাবনারা এসে মাথার ভিতর নাড়া দিতে লাগল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সংসারের হাল ধরা। সেই শুরু। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর পড়া হয়নি। ছোট ভাইটি বিএ পাস করেছে। সে এখন চাকরি করে। বাইরে থাকে। ছোট বোনটা এসএসি পাস করেছে। চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গে বিয়েও হয়েছে। মা সুস্থ থাকলেও বাবাকে দেখতে তার সময় চলে যায়। সংসারের কাজকর্ম করে মাটির কজে সাহায্য করতে হয় রেণুকাকে। তারও কষ্টের অন্ত নেই। সত্যি তো, এক বছরে একদিনের জন্যও রেণুকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়িতে কাজের চাপ দেখে শ্বশুরও রেণুকাকে না নিয়ে ফিরে গেছে।
দুপুরের পর ভাটায় খড়ি দেওয়া বন্ধ হলে রতন উঠে স্নানের জন্য বাড়ির পাশে নিস্তরঙ্গ ডাকুয়া নদীতে চলে গেল। রেণুর খোঁচামারা কথা শুনে রতন আর কথা বলছে না। রেণুর মনটা ভাটায় পোড়ানো কলসের মতো পোড়ে। উপায়ান্তর না দেখে রেণুও রতনের পেছন পেছন নদীতে গেল। রেণু ভাবে- কাজপাগল লোকটাকে কথার ঘায়ে কষ্ট দিলাম। সাধারণত দুপুরের পরে নদীর ঘাটে স্নান করতে যায় কুমারপাড়ার লোকেরা। এখন ফাঁকা ঘাট। রতনের গা ঘেঁষে বসে রেণুকা। তার পর ভগ্নকণ্ঠে বলে, আরে আমি তো তুমার সঙ্গে ইয়ারকি করতিছিলাম।
রেণুকার কথা না শোনার ভান করে স্রোতহীন মজা ডাকুয়ার স্বচ্ছ জলের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকল রতন।
মুহূর্তে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রতনকে মোহিত করার ক্ষমতা রেণুকা রাখে। সে কেয়া সাবান দিয়ে রতনের মুখ, মাথা ঘষতে লাগল। এর আগেও এ কাজ অনেকবার করেছে রেণুকা। বুক-পিঠে সাবান ঘষতে গিয়ে দুষ্টুমি করে ও। হেসে ফেলে রতন। রতনের প্রাণময় হাসিতে খুশি ছড়ালো রেণুকার মুখে।
রেণুকা রতনের মুখের ওপর মুখ রেখে বলল, ভাটার হাপর ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে। দেখলে তো তোমাকে ঠাণ্ডা করে ফেললাম কত অল্প সময়ে।
-আবারও উল্টাপাল্টা কতা কচ্ছ। তুমি আমার চেয়ে বেশি লেখাপড়া জানো ঠিক আছে। দশ ক্লাস পড়িছ। কিন্তু তুমার ঢাকনা দেওয়া কতা বুঝার ক্ষমতা আমার আছে।
সত্যি বলছি। আমি খারাপ অর্থে কিছু বলিনি। তুমি যা বোঝ তা ঠিক নাও হতে পারে। চলো এরপর থেকে আর কোনো
খুনসুটি নয়।
স্নান সেরে ওরা ডাকুয়া নদীর কূলে ওঠে। রতন আগে, পেছনে রেণু হাঁটছে। রতন বলে, রেণু তুমি সামনে যাও। আমি পেছনে হাঁটি।
-কেন?
-তুমাক দেখতি দেখতি যাই। আর শোনো, আমার দাদু অনেক দিন বেঁচে ছিল। দাদু মজার মজার গল্প করত। কত রকম গল্প। দাদির গল্প বেশি বেশি করত। দাদি তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। দাদু কইত, কাঁচা মাটির এক রকম গন্ধ, হাত-পা দিয়ে ছেনার পর মাটির এক রকম গন্ধ আর পোড়ালি হয় এক রকম গন্ধ। মাটি ছেনার পর যে গন্ধ মাটি দিয়ে বের হয় সেই গন্ধ নাকি যৈবতী মাটির গন্ধ। ভাটায় ওঠার আগে নাকি মাটির শরীরে যৌবন আসে। গন্ধ ছড়িয়ে যায়। দাদা এসব কতা কইত। এসব কতা বিশ্বাস করো রেণু।
তুমি সবকিছুই বোঝ, শুধু পালবধূর মন বুঝতে পার না। মাটির এত গন্ধের খবর রাখো, ঘরের মাটির খবর রাখো না। দাদার মতো যৈবতী মাটির গন্ধ ভালোবাসতে পারলে না।
ওদের গা ঘেঁষে প্রতিবেশী মালতি দাদি নদীতে যাওয়ার পথে ভাঙা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, তুরা হচ্চিস পালপাড়ার রাধা-কৃঞ্চ। তোরে দেখে আমার প্রাণডা আইটাই করে, তোর দাদার কতা মনে পড়ে। বুঝলি রেণুবালা, তোর দাদাও রতনের মতো নরম মানুষ ছিল।
-তুমি কী করে বুঝলে রতন নরম মানুষ?
-এই ছেড়ি, পঞ্চাশ বছর পুরুষ মানুষ নিয়ে কাটালাম, আর নরম-গরম বুঝিনে।
এবার যাও, স্নান করগে। কথা বাড়াল না রেণু। ওরা দ্রুত হাঁটা ধরল বাঁশবাগানের সরু পথ দিয়ে।
শুক্লাদ্বাদশী। ঘুম নেই রতনের চোখে। একদিকে রেণুর কথার ঝাল, অন্যদিকে পাড়শি দাদির টিপ্পনি। রতনের মনটা মর্মপীড়ায় বিষণ্ন। বাঁশবাগনে রাত জাগা পাখির করুন আর্তনাদ। মধ্য রাত হবে হয়তো। রতন ভাবে, সকালবেলা ভাটার পোড়ানো মাল নামাতে হবে। ঘরে সাজাতে হবে। বেঁচে যাওয়া মাটির ঢিবি পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। চৈত্র মাসের আজ উনত্রিশ দিন। দুই দিন পর থেকে হাতে কাজও নেই। এখন শুধু মালপত্র বিক্রির পালা। বোশেখে ধান ঘরে উঠলি কৃষকরা ধান দিয়ে খোলা-বালেন, ঢাকুন-ঢোকসা কেনে। সারা দিন খাটুনির পর চোখের পাতা এক সময় জোড়া লাগে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রতন। রতন স্বপ্ন পরাবৃত। ও দেখে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ঘরের রোয়াকে পত্রাসনের ওপর বসে আছে। পাশে কেউ নেউ। ঘোমটায় ঢাকা তার মুখ। তার চারপাশে হাঁড়ি-কলসির ভাঙা খাপরার কুচি। খাপরার কুচি নিয়ে কী করছে মেয়েটি? রতন মেয়েটির মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। ঘোমটা সরে গেল মেয়েটির মাথা থেকে। পেছনে মুখ করে বসা মেয়েটি। কেশবতী মেয়েটির মাথার কেশগুচ্ছ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে রেণুকা বিছানায় নেই। মেয়েটি কী রেণু! বলদেব এসে ভর করে রতনের মাথায়। উদ্বেলিত সে। উজবুকের মতো ও উঠে মেয়েটিকে জাপটে ধরতে গেলে মেয়েটিই উঠে রতনকে জাপটে ধরে। উচ্ছল মেয়েটির তুলোর মতো শরীরের মধ্যে রতন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। ভয়ে রতন চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে শব্দে ঘুম ভাঙে রেণুর। রতনকে বুকের সঙ্গে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- অমন করছ কেন? কী হয়েছে তুমার? রেণুকা রতনকে এমনভাবে আদর করতে থাকে যেন সে শক্তি ফিরে পায়। গভীর ধ্বনি দ্বারা নিনাদিত রেণু। মন্দ্রিত সে। মন্দাকিনীর জলে ভিজে যায় জমিন। অতিশয় আনন্দিত সে। রসোদ্গারের স্মৃতি ভুলে যায় রতন। রতনও সাহসী সুকানি হয়ে ওঠে। এখন সে রূপোন্মাদ। উর্বর মাটিতে ফসল রোয়াতে তৎপর হয়ে ওঠে ও।
কতক্ষণ পর রেণু আলুলায়িত কেশদামে কবরী বাঁধতে বাঁধতে আদরণীয় কণ্ঠে রতনের দিকে স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে বলল, অনুভব করতে পারছ, মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে ভাটার চিমনিও ঠাণ্ডা হয়েছে গো। চলো এবার গা শীতল করা ডাকুয়ার জলে যাই। পবিত্র হয়ে ভাটার মালপত্র নামিয়ে ঘরে তুলি।
বিস্ময়াবিভূত রতন রেণুর অত্যুজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো, স্বপ্নে দেখা ওই সুন্দরী মেয়েটি আমাকে দৈবশক্তি দান করে গেছে।
-তুমি কী বলছ এসব! ওরে বলদ, তোমার স্বপ্নে দেখা ওই নাগরী মেয়েটি তো আমিই ছিলাম।
ঘোর কাটে না রতনের। অপ্সরীর মতো দেখতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তার চোখের সামনে ছায়া হয়ে মন্দ্র মাতাল নাচতে থাকল।