
মৃদুভাষী কবি আহসান হাবীব, যিনি দেশভাগের আগেই সুখ্যাত ও কৃতবিদ্য পুরুষ, আধুনিক বাংলা কবিতার একক ও অদ্বিতীয় কবি। নিজস্বতা ও স্বকীয় কাব্যভাষা নিয়ে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। লাজুক, নম্রতা, রোমান্টিকতা, ছন্দনৈপুণ্য, শ্রেণি সচেতনতা এবং প্রকরণ-স্নিগ্ধতা তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তার কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামী চেতনা ও সমকালীন যুগযন্ত্রণা তার লেখায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ সমকালে প্রশংসিত। ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ ফেলেছে তার প্রতিটি লেখায়। উত্তরকালে ক্ল্যাসিকের মর্যাদাও পেয়েছেন। তার লেখা বাংলা কাব্যপ্রেমীদের জন্য অনবদ্য উপহার। ঘনিষ্ঠ পাঠকমাত্রেই উপলব্ধি করতে পারবেন- প্রায় ৫০ বছরের কাব্য চক্রতীর্থে আহসান হাবীব কতটা সতেজ, কতটা আধুনিকতার অনন্য উদাহরণ।...
রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম যে ভিন্ন কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই সেটা নজরুলেরই। ত্রিশের দশকের কবিরা অবশ্য রুচিতে-মেজাজে তার চেয়ে একেবারেই আলাদা। চর্যাগীতি থেকে ভারতচন্দ্র-ঈশ্বরগুপ্ত পর্যন্ত কাব্যের যে সংজ্ঞা ও রীতি প্রচলিত ছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তা দিলেন পাল্টে। মুক্ত হলো প্রায় হাজার বছরের বন্দি কাব্যাত্মা। তিনি যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন, জন্ম দিলেন যে আধুনিকতার, সেটি রবীন্দ্রনাথ কথিত নদীর বাঁকের মতো পরিবর্তিত হয়ে ভিন্নতর নতুন মাত্রা পেল রবীন্দ্রনাথের হাতেই। চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতার একজন প্রধান পুরুষ আহসান হাবীবও এড়াতে পারেননি এই নেতি-নৈরাশ্যের ছায়াকে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ‘ছায়াহরিণ’ (১৯৬২), ‘সরাদপুর’ (১৯৬৪), ‘আশার বসতি’ (১৯৭৪), ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ (১৯৭৬), ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’ (১৯৮০), ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৮১), ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ (১৯৮৫)। লিখেছেন বড়দের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ছোটদের জন্যও লিখেছেন, অবার অনুবাদ করেছেন অনেক। কিছু আছে সম্পাদনা। সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ২৫-এর মতো। সুদীর্ঘ আটত্রিশ বছরে আটটি কাব্যগ্রন্থ ও দু শ ছত্রিশটি কবিতা সংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়। এমনিতেই তিনি কম লিখতেন। মৃদুভাষী, অন্তর্মুখী, নিম্নকণ্ঠের হলেও গাঢ় উচ্চারণকারী এই কবির ক্রম-বিবর্তনের ধারাটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় এবং বিস্ময়কর। কবিতার বিচারে মৃদুভাষী কবি আহসান হাবীবের কবিতার কিছু অংশ-
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই।
এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।...
এক একটি বাক্যগ্রন্থ থেকে অন্য কাব্যগ্রন্থে তার উত্তরণ খুব সূক্ষ্মদৃষ্টির সঙ্গে লক্ষ্য না করলে বোঝা যাবে না। প্রকাশগত দিক থেকে দুটি কাব্যে তিনি কখনো কখনো অভিন্ন থাকলেও, চেতনাগত দিক থেকে নিজেকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছেন। যা মানুষ প্রকৃতি সময় ঐতিহ্য ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান সভ্যতা যান্ত্রিকতা রাজনীতি প্রভৃতি শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে।
ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র এবং ইংরেজ কবি টি এস এলিয়টের প্রবর্তনায় যে আধুনিকতার উদ্বোধন বাংলা কবিতায় ঘটেছিল তিরিশের দশকের কবিদের রচনাকর্মে তারই যথার্থ উত্তরপুরুষ আমাদের কবি আহসান হাবীব। ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন : তিনি... ‘প্রথম প্রকৃত আধুনিক কবি। আহসান হাবীব তাঁর রচনায় ব্যক্ত করেন প্রবল আশাবাদ। কবিতায় স্বদেশলগ্নতা ও পুনঃমানবিকীকরণের উদ্বোধন ঘটান তিনি’। আহসান হাবীব ‘রক্তের অক্ষরে পথে স্বাক্ষরিত বহু ইতিহাস’-এর স্মৃতি নিয়ে কবিতার অন্য একটি পর্যায়ে উপনীত হন। কর্ডোভা, মিসর বা দূর ব্যাবিলনের স্মৃতিচারণ করে সভ্যতার এক-একটি সংঘাত ও পরিণামকেই যেন চিহ্নিত করেন। ইতিহাসের শিক্ষাকে তিনি হতাশার কার্যকারণ হিসেবে গ্রহণ করেননি, শুনিয়েছেন ইতিবাচক হিসেবেই। কাল প্রবহমান ও বৈনাশিক হলেও তিনি তার সঙ্গেই থাকতে চান।
আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি, বরিশাল জেলার (তৎকালীন) পিরোজপুর মহকুমার শঙ্করপাশা গ্রামে। পিতা হামিজউদ্দিন হাওলাদার এবং মাতা জমিলা খাতুন। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর কলেজে ভর্তি। কিছুটা পিতার সঙ্গে মনোমালিন্য, বাকিটা কবি হওয়ার বাসনা- এই দুইয়ের মিলিত কারণে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমানো, সেটা ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে। এরপর আর কখনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা অর্জনের চেষ্টা করেননি। পেশা প্রথম থেকেই সাংবাদিকতা। কিছুদিন আকাশবাণী কলকাতায় কাজ করেছেন, ১৯৫০-এ ঢাকায় ফিরে আসার পর দৈনিক পাকিস্তান (স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা)-এ। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে এ দেশে তার খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তার হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে আহসান হাবীবের প্রচেষ্টা ছিল অগ্রগণ্য। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬১), ‘একুশে পদক’ (১৯৭৮) এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (১৯৯৪)-সহ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেয়েছেন। মৃত্যু ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই। তিনি বেঁচে থাকবেন পাঠক সমাজের কাছে, আধুনিকতার কবি হয়ে।