
গত সংখ্যার পর
“১৯৬৩ সালে আমার ভাই এমএলএ উমেশ লাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে ১০ (দশ) জন ত্রিপুরার পশ্চিম জিলার খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার বাংলা বাড়িতে রাত্রি ১২ ঘটিকায় আগমন করে। প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর আমার বাংলা বাড়ী হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়ীতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। তারপর মুজিব ভাই-এর প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন চীফ সেক্রেটারী শ্রীরমন। তাকে (শ্রীরমনকে) শ্রীভান্ডারিয়ার (বিদেশ সচিব) ঘরে রাখিয়া আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। নেহরু মুজিবর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে দিতে রাজী হন নাই। কারণ চীনের সাথে যুদ্ধের পরে তিনি এত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ (পনের) দিন থাকিয়া তিনি সোনামুড়া দিয়া ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরার এক মহকুমা, কুমিল্লার সাথে সংলগ্ন। শেখ মুজিবকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।” স্বাক্ষর: শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ত্রিপুরা। সূত্র: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: ফিরে দেখা, হরিভূষণ পাল।
তবে আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল শওকত আলী মামলাটিকে সত্য মামলা বলে দাবি করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু নন, আগরতলায় গিয়েছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ আলী রেজাসহ কয়েকজন।
সে যাই হোক, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানীকে ঘিরে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ যে ৩৫ জন বাঙালি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রজু করে, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রমবর্ধমান জনবিক্ষোভ দমন করা। পাকিস্তানি শাসকচক্র তাদের ‘শত্রুদেশ’ ভারতকে জড়িয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে মারার ফন্দি এঁটেছিল। তারা চেয়েছিল গণনন্দিত রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব দেশবাসীর কাছে ‘দেশদ্রোহী’ বিবেচিত হোক।
কিন্তু ওদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। স্বাধিকারের আন্দোলন বেগবান হয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে যখন শহর-বন্দর-গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন ফিল্ড মার্শালের লেজ গোটানো ছাড়া উপায় থাকেনি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে বন্দি অবস্থায় গুলি করা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ঢাকা সেনানিবাস বাঙালি দেশপ্রেমিকের রক্তে ভাসল। প্রাণ দিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক, মারাত্মক জখম নিয়েও বেঁচে গেলেন সার্জেন্ট ফজলুল হক। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে নেতা শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে অসীম দুশ্চিন্তায় পড়ল মানুষ। তিনি কি বেঁচে ফিরবেন নাকি গুলির শিকার হবেন? অতএব, গণ আন্দোলন তুঙ্গে উঠল- এক সময় তা গণবিস্ফোরণে পরিণত হলো। আগরতলা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এস রহমানের বাড়ি পর্যন্ত যখন বিক্ষুব্ধ জনতা আক্রমণ করে বসল, শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি যখন গণমানুষের বুক নিংড়ানো আকাঙ্ক্ষার অলঙ্ঘনীয় দাবিতে পরিণত হলো, তখন উঠিয়ে নেওয়া হলো সব অভিযোগ। আগরতলা মামলা তুলে নিয়ে স্বসম্মানে মুক্তি দেওয়া হলো শেখ মুজিবুর রহমানকে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে কারামুক্ত শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হবে। এক সময় নেতা উপস্থিত হলেন। এই জনসভায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলেন নেতাকে। সেদিন থেকেই শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
মোটকথা, আগরতলা নামটি পাকিস্তানিরা যেভাবে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা নিয়েছিল- তা ধোপে টেকেনি। পরবর্তী নানা ঐতিহাসিক ঘটনায় আগরতলা হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অলিখিত সমর রাজধানী; মাত্র দুই বছরের মাথায়, পালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধানতম কেন্দ্রস্থলের ভূমিকা। সেই ধর্মনগর থেকে সাব্রুম- ত্রিপুরার প্রতিটি মানুষের কাছে, কী জাতি, কী উপজাতি ‘জয়বাংলা’ হয়ে ওঠে ভালোবাসার স্পন্দন। আগরতলার মোড়ে মোড়ে উড়তে থাকে নতুন বাংলাদেশের পতাকা। সবার মুখে জয় বাংলা। মোড়ে মোড়ে বাজতে থাকে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসী’, বাজতে থাকে শচীন কর্তার অমর গানের কলি ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই/আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই /বাংলাদেশের ঢোল।’ ছোট্ট একটি রাজ্য, ভারতের অন্যতম পিছিয়ে পড়া জনপদ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেই ত্রিপুরার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায় ভৌগোলিক-ব্যবচ্ছেদে বিভক্ত আরেক ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার জন্য প্রায় এক বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ!
ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থানটাও রীতিমতো অদ্ভুত। ভারত যেখানে বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ধরে রেখেছে- বাংলাদেশ সেখানে তিন দিক থেকে আলিঙ্গন করে আছে ত্রিপুরাকে। রাজ্যের মোট ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৮৩৯ কিলোমিটার যুক্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। বাকি ৫৭ কিলোমিটার আসাম এবং ২১ কিলোমিটার মিজোরামের সঙ্গে। এসব কারণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামের সশস্ত্র পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের চাইতে ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে ওঠে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
চলবে...