গত সংখ্যার পর
তোমরা আজ হয়তো ভাবতে পারবে না- এ সময় দিনেরাতে নদীর স্রোতের মতো ছিন্নমূল মানুষ প্রবেশ করতে থাকে ত্রিপুরার নানা অঞ্চল দিয়ে। এত বড় শরণার্থী বিপর্যয় আগে কোথাও ঘটেনি পৃথিবীতে! একটি হিসাব থেকে বুঝতে পারবে ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের যুদ্ধের দাহন কতটা ভোগ করেছে। ১৯৭১ সালে রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা যেখানে ১৫.৫৬ লাখ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩.৪২ লাখ বা প্রায় ১৪ লাখ। পরের দিকে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে ত্রিপুরার জনজীবন ও অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। কী করবে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, একটি প্রশ্ন করি। সমাজ, অর্থনীতিতে এই যে ভয়ংকর রকম চাপ, সাধারণ মানুষের এত যে কষ্ট, এর পরও কেন সবকিছু মেনে নেয় ত্রিপুরার মানুষ?
রথীন দত্ত: সঠিক প্রশ্নই করেছ। ব্যাপারটা স্বভাবতই ভাববার। তবে আমার কী মনে হয় জান, প্রকৃতির, মাটির একটা টান আছে, যা ভঙ্গুর নয়, নানা টানাপোড়েনে ভূখণ্ড ভাগ হয়ে গেলেও সেই অবিভাজ্য টান ধরে রাখে প্রকৃতি। এর মধ্যে আছে ভাষা-সংস্কৃতি ও জলবায়ুর এক গন্ধ। হয়তো সে কারণেই কষ্টকে কষ্ট বলে ভাবেনি ত্রিপুরাবাসী।
ইতিহাসগতভাবে ত্রিপুরায় যে বাঙালি তার ৯৫ ভাগ পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে- প্রায় সবাই ওপারের মানুষ- বলতে পার দেশ ভাগে বিতাড়িত মানুষ। এই মানুষদের সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন ভারতে পাড়ি দিয়েছে ১৯৪৭-এর দাবানলে পুড়ে। আবার এমন অনেকে আছেন যাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজ দরবারের কর্মচারী। কিন্তু এদের সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাগ-বিরাগ বৈশিষ্ট্য এক। অতএব, ১৯৪৭-এর আগে-পরের যে বিভেদ তা টিকে থাকেনি- নিমিশে উবে গেছে! হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি ও নানা ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মুসলমান এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিবাদে ঠাঁই করে নিয়েছে- মানুষের ভেতরে মানুষ যেভাবে ঠাঁই করে নেয়! এই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও কলোনিয়াল লিগেসি বিরোধ টানেনি। ধর্ম যে ব্যক্তির একান্ত আপনার বিষয়, রাষ্ট্র বা সমাজের নয় এবং ধর্ম বিশ্বাস যে ভাষা-সংস্কৃতির বিভাজন মানে না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা নতুন করে শিখিয়ে দিয়েছে।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: হয়তো তাই হবে। কিন্তু এপার ওপারে দুই পারেই যেভাবে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন করে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, তাতে কিন্তু শঙ্কার কারণ আছে।
সার্জন রথীন দত্ত: নিশ্চয়ই, শঙ্কার কারণ তো আছেই। দেখ, ১৯৭১ কেবল বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও সমানভাবে। ভারতের সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী। অকাতরে প্রাণ দিয়েছে মুক্তিবাহিনী, রক্ত গেছে মিত্রবাহিনীরও। অতএব, দুই দেশকে এক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল ১৯৭১, নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই ভাতৃত্বকে উগ্র ধর্মবাদ চর্চা দিয়ে বিনষ্ট করা কখনো সমীচীন নয়।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ঠিক বলেছেন, স্যার। এবার তাহলে আগের প্রসঙ্গে যাই আমরা।
সার্জন রথীন দত্ত আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরলেন। ফেরার আগে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলেন।
বুঝলে, পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে তখন। কী হবে, কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যাবে? ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত কতটা নামবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে- কিছুই নিশ্চিত নয়। মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সশরীরে থাকলে পরিস্থিতি একরকম হতো। কিন্তু তিনি তো নেই। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তাদের দেখাশোনা করছে। অন্য নেতাদের কেউ কেউ গোপন পথে মেঘালয় ও আসামে পাড়ি দিয়েছেন। কে কোথায় উঠেছেন কেউ খবর রাখে না। একটা সুখবর খবর হলো তাজউদ্দীন আহমদ এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বুঝতেই পার সাক্ষাৎকারটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ- ভারতের সমর্থনের প্রশ্নে কত বড় ইতিবাচক ঘটনা।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা আছে, থাকবেও। তবু শ্রীমতি গান্ধী সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
সার্জন রথীন দত্ত: দেখ, আমি রাজনীতির মানুষ নই। মিসেস গান্ধীর রাজনৈতিক বিরোধীরা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। কিন্তু যদি ১৯৭১ সালের কথা বল, তাহলে আমার মতামত খুবই স্পষ্ট। আমার মনে হয় কি জান, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে যদি অন্য কেউ থাকতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির সঠিক রূপয়ানে গুরুত্ব না দিত এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক মূল্যায়ন মস্কোর ভূমিকা যথার্থ না হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হওয়ার কারণ ছিল।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: বুঝলাম স্যার, এবার আগের কথায় ফিরি আমরা।
শোন, তাজউদ্দীনের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর পরপর দুটি বৈঠক হয়। বিস্তারিত আলোচনার পর স্থির হয়, অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হবে, যে সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আরও ঠিক হয় ভারত তার ভূমি ব্যবহার করে রেডিওসহ সব ধরনের প্রচার কাজ চালাতে দেবে। আরও বড় সিদ্ধান্ত হয় ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠবে- যার দেখাশোনা করবে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিল বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে বিএসএফ সহায়তা করল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো।
এদিকে আগরতলায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা, বিশেষ করে যারা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ বা এমপিএ হয়েছেন তারা পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিলেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন মেলারমাঠে অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে।
সেদিনের বৈঠকটি ছিল পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, যা এক মাইলফলক। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমএলএ সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর সামনে একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করলেন। বিবৃতিটি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট-এর কাছে। Stop this Genocide- ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথম যৌথ বিবৃতিটি।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর নিজস্ব প্রতিনিধি অমর রাহা এটি রচনা করতে সহায়তা করেন। এরা সবাই তখন আগরতলায়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) বার্তা সংস্থার অফিসের একটি পুরনো টাইপ রাইটারে এই বিবৃতি টাইপ করা হয়। পিটিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মধুসুধন গুহ রায় তখন বাংলাদেশের যুদ্ধ ‘কভার’ করতে আগরতলায় আছেন। মধুবাবু টেলিফোনে কলকাতায় হেয়ার স্ট্রিটের পিটিআই অফিসে খবরটি পাঠিয়ে দিলেন। এটি ছিল তার ‘স্কুপ নিউজ’। কারণ অন্য কাউকেই খবরটি তখনো দেওয়া হয়নি। পরদিন সব জাতীর স্তরের খবরের কাগজে খবরটি ফলাও হয়ে বেরোল। এরপর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল।
চলবে...