সেদিন ছিল ঈদের দিন। ভাড়াটিয়ারা অনেকেই ছানাপোনাসহ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গেছে। বাড়িটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আমার নিঃসন্তান হৃদয়ে এই শূন্যতা মুহুর্মুহু আহাজারিতে গুমরে মরছে। কেননা, আমি মানুষটা কোলাহলের, নিরালার নই। তবে ঈদ-আনন্দ গ্রামে উপভোগ করতে চাই আমিও। কিন্তু আমার যে সন্তান হচ্ছে না। এই না হওয়ার হাজারো অপবাদ আর অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি বড্ড ক্লান্ত।
ভেজা চুল ঝেড়েমুছে তোয়ালেটা নিয়ে মাত্র বের হলাম। হঠাৎ আমার ভাড়াটিয়া সুমির মা এসে বলল- ‘আফা, সকাল থাইকা পিচ্চিটা আফনেগো গেটের ভেতরে খাড়ায়ে রইছে। তা-ই লইয়া আইলাম।’ ছেলেটির বয়স বড়জোড় আড়াই-তিন বছর হবে হয়তো। গায়ের রং কালো। পরনে লাল প্রিন্টের শার্ট-প্যান্ট। মুখমণ্ডল গোলাকার। ফোলাফোলা টোলপড়া গালে শ্লেষ্মার আঁটলি। মায়ামায়া চোখযুগল। আমি আদর করে কোলে নিলাম। সে তার চোখের গোল কর্নিয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। নাম জানতে চাইলাম। কিছুই বলে না। সম্ভবত স্বল্পবাক। ওর টোপাটোপা গালে শ্লেষ্মা-আঁটলি দেখে আমার স্বামী বলল- দেখছ কী? ওরে গায়-গোসল করিয়ে আগে খেতে দাও। পরে খোঁজ-খবর নিয়ে না হয় একটা বিহিত-ব্যবস্থা করব।
গোসল করিয়ে সাজুগুজু করালাম। বাহ! এখন খুব সুন্দর লাগছে। খাওয়ালাম। শান্ত সুবোধ শিশুটি সুন্দর করে খেল। ওমা! দেখি, খাবার মুখে নিয়েই ও ঘুমে ঢলে পড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে শোয়ালাম। ও আরামসে ঘুমিয়ে গেল। কোনো কান্নাকাটি নেই। অস্থিরতা নেই। নেই মনস্তাপ। শান্ত, নিটোল শিশুটির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। আহা রে, না জানি পাগলপ্রায় মা-বাবা হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। ঈদের দিনেও বুকচাপড়ে কাঁদছে। এদিকে অবোধ মানিকসোনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তার পর মাইকিং করাব। অনেকক্ষণ পর মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ওর মাথায় হাত রাখি। আমার আলতো স্পর্শেই ও জেগে উঠল। ওয়াশরুমে নিয়ে ওকে প্রসাব করলাম। ভুনাখিচুড়ি আর কলিজাভুনা দিয়ে ওকে খাওয়ালাম।
প্রাক-সন্ধ্যার আলো-আঁধারী। সন্ধ্যারাগের সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠল! ভাবছি, এখন অবধি কোনো খবর হলো না। অমনি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল তিন-চারজন। এসেই বাচ্চাটির মায় খাট থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। ওকে নাকে-মুখে, গাল-ঠোঁটে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল। বুকে ঠেসে ধরে জড়িয়ে কেঁদে দিল। আহা রে! হারানো সন্তানপ্রাপ্তির এক মায়ের সন্তান বাৎসল্যের আকুতির গভীরতা কতটা স্পর্শকাতর! আরও অনুভব করছি, বাঙালি মায়েদের মাতৃত্বের ভাণ্ডার বুঝি এমনই বিশ্বজনীন স্নেহ-মায়া-মমতায় ভরপুর থাকে।
তাছাড়া, বাচ্চাটির মুখাবয়বের উজ্জ্বলতায়ও বলে দিচ্ছে সেও মনে মনে আনন্দিত। ওর কাজলদিঘি চোখ এখন প্রাপ্তির পূর্ণতায় উদ্ভাসিত। ওরা যেমন আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকল তেমনি আকস্মিকভাবেই-না ছোঁ মেরে ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিথি! অথচ রেখে গেল স্মৃতির ক্যানভাস-জমিনে মায়াময় স্মৃতি! আমার অবচেতন মনে কখন জানি ওর প্রতি মাতৃত্ব জেগে উঠেছে জানি না। তাই কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ ছিলাম। যাওয়ার সময় ওরা অবশ্য বলেছে, ‘আফনেগো মাঝমধ্যিখানে আইয়া দেখাইয়া নিয়া যামু।’
জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। হঠাৎ একটি ফুটফুটে ছয়- সাত বছরের মেয়ে এল। বলল- আফা, আমি আফনেগো স্কুলে পড়ি। আমরা গরিব। বাবায় কয়, খোরাকির টাকাই জোগাইতে পারি না। পড়ামু কেমনে? তাই আমি আফনেগো কাম করমু আর পড়মু। অনাহারশীর্ণ মেয়েটির কথা আমার অন্তর্মূলকে বিদ্ধ করল। এই বয়সে মেয়েটির কষ্টের অনুভূতির অনুধাবন ক্ষমতা এতটা সংবেদনশীল? আমি বিস্ময়াভিভূত!
মেয়েটিকে বললাম, আগামীকাল জানাব। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলাম। আসার পথে মেয়েটির বাড়িওয়ালার বাড়িতে গেলাম। একজন বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আফা, ওর বাবা বছরব্যারামি। কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। সংসারের পোষ বেশি। ঘরে খাওন নাই। কষ্টে আছে। মাইয়াডারে আফনে নিয়া নেন আফা। এই কথা শুনে ওই দিনই ওকে নিয়ে নিলাম।
ওর নাম মাসুমা। সুন্দরী ও সুশ্রী। দুধে-আলতা গায়ের রং। ডাগর-ডাগর চোখের ভ্রুগুলো যেন চিরুনিটানা। ওর গোলাকৃতি মুখের হাসিটাও সুন্দর। আপেলরাঙা ভরাটগাল। দাঁতগুলো ঝকঝকে। জীর্ণবস্ত্র, শীর্ণকায় শরীরটা যেন ধনুকের মতো বেঁকে আছে। পেট চুপসে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে। আমি তড়িঘড়ি ঘরে গিয়ে ওকে খেতে দিলাম। ক্ষুধার্ত মেয়েটির খাওয়ার আকুলতা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।
সেই থেকে মাসুমা আমার কাছেই আছে। ও এখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
বছর দুয়েক পর। আমি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সেই সুমির মা-ই এসে বলল, আফা, পিচ্চিটা সহাল থাইকা ঘুরঘুর করছে। এর লাইগা লইয়া আইলাম। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আমার সঙ্গে এমনটি কেন ঘটছে?
মাসুমাকে বললাম, ওকে রুটি-হালুয়া খাওয়াতে। রুটি হাতে নিয়ে ও সুমির সঙ্গে ওদের ঘরে গেল। দেখলাম, ও একটি চেয়ারে বসে পা ঝোলাচ্ছে আর খাচ্ছে। ওর সঙ্গে সুমিও। ওরা হাসছে, খেলছে। তাই আমি নিশ্চিন্তে স্কুলে গেলাম।
ফার্স্ট শিফট ছুটি। হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে একটু বাসায় গেলাম। ইতোমধ্যে আমার স্বামী এক ডজন সাগর কলা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি শুয়ে কলা খাচ্ছে। আমি আরেকটি কলা দিলাম। কলা পেয়ে ওর সেকি আনন্দ! ও আমার স্বামীকে বলছে, ‘তুই আমার লাইগা এত্তগুলান কলা আনছস!’ এই বলে আমার স্বামীর শরীরের ওপর দিয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমরা ওর মা-বাবা। তুই-তোকারি সম্বোধনে বুঝলাম, ও মা-বাপের বড্ড আদুরে মেয়ে।
ওর দায়িত্ব সুমির মায়ের ওপর দিয়ে আমি মাসুমাকে নিয়ে স্কুলে এলাম। এরেই মধ্যে কয়েকটা মসজিদ থেকে মেয়েটির সম্পর্কে ঘোষণা করানো হয়েছে। ভাবছি, বিকেলে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করব। দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আবারও বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সুমির মা গোসল করিয়ে মুখে পাউডার, চোখে কাজল দিয়েছে। ওর ফ্রকটা ধুয়ে সুমির ফ্রক পরিয়েছে। ভাত খাইয়েছে। শুনলাম- সুমির মা ওকে পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাতে পাকুতি বুড়ি বলে- আমার মা আমারে পাছায় জোরেজোরে থাপ্পড় দিত। তুমিও এমনি কইরা দেও। তাইলে আমি ঘুমামু। তা শুনে আমিও হেসে লুটোপুটি। স্কুলে এসে কাজে মন দিলাম।
স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। আমরাও বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে একজন মহিলা কান্নাকাটি করতে করতে স্কুলে ঢুকেছে। এসেই বলছে- আমাগো মাইডারে নাকি এই স্কুলের আপার বাসায় আছে। আমি এগিয়ে এসে বললাম, হ্যাঁ। তিনি জানালেন, ওর মা ভোরে হাসপাতালে গেছে। যাওয়ার সময় ও যাইতে চাইছিল। ওর মা কাঁন্দাইয়া থুইয়া গেছে। কোন ফাঁকে ও ফ্রক হাতে লইয়া বাইর হইয়া গেছে। আমরা টেরই পাইনি।
সব শুনে হেডস্যার বলছেন, আপা, সুমির মাকে বলেন, মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে আসতে। এখান থেকেই ওকে অভিভাকের হাতে তুলে দেব। খবর পেয়েই সুমির মা নিয়ে এল ওকে। ওর গায়ে ধোয়া ফ্রক-প্যান্ট। মুখে স্নো-পাউডার। কপালে কাজলের টিপ। আঁচড়ানো পরিপাটি চুল। বেশ ফুটফুটে লাগছে। ওমা! আপারা সবাই এর কোল থেকে ওর কোলে নিচ্ছে। ও যাচ্ছে নিঃসংকোচে।
হেডস্যার বললেন, ওর বাবা কিংবা মা একজনকে আসতে হবে। কিছুক্ষণ পরই ওর বাবা আরও একজন মুরুব্বি কিছিমের লোক নিয়ে সরাসরি এলেন। ও তখন ওর জেঠিমার কোলে। ওর বাবাকে দেখেই বলে, এত্তক্ষণে তর মনে অইল আমার কতা? অভিমানী মেয়েটি এই বলে কেঁদে ফেলে। বুঝলাম, শিশুর মনেও অভিমানের দহন থাকে। পাকুতি বুড়ির পাকানো কথা শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তার পর স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ওর বাবার কোলে মেয়েটিকে তুলে দিলাম। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সবাইকে মায়াময় ভালোবাসায় জড়ায়ে গেল। আমার মাতৃ হৃদয়েও একটা শূন্যতার ঝোড়ো হাওয়ায় তোলপাড় করছে। ভেতর থেকে অবদমিত কান্না ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি। ওরা বলেছিল, মাঝেমধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসবে ওকে। কিন্তু কেউ-ই কথা রাখেনি। না আসুক, তাতে কী? বাচ্চা দুটোর মা-বাবার কাছে ওদের তুলে দিতে পেরেছি, এতেই আমার শান্তি। একজন গেল নীরব ভালোবাসায় জড়ায়ে। আরেকজন গেল সরব ভালোবাসায় কাঁদায়ে। এই কান্না একান্তই আমার। নিঃসন্তান হৃদয়ে অন্তর্নিহিত অস্তিত্বে গুমড়ে ওঠা অদৃশ্যমান এক নিঃশব্দ কান্না!
এরই মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে চাষাঢ়া রেললাইন ধরে হাঁটছি। মাসুমা আমাদের রেখে আগেভাগে যাচ্ছে। আমরা পেছন থেকে ডাকছি। ও হাত নেড়ে শুধু আগাচ্ছে। একসময় মাসুমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমন তো সবসময়ই করে। আগে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয়। আমরা এটাই ভাবছি। কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখি মাসুমা যায়নি। তা শুনে আমার মাথায় চক্কর খেল! আমি হতবিহ্বল! তার পর খোঁজাখুঁজি আর কান্নাকাটি! আমার বুকটায় যেন হাতুড়িপেটানোর মতো ধাপুস-ধুপুস শব্দ হচ্ছে। অজানা আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপছে। ভয়ে-ভয়ে ওর মাকে ফোনে খোলাসা করে ঘটনাটা বলি। ওর মা বিশ্বাস করছে না। বলে, কত মানুষ গুম কইরা রাইখ্যা মিছা কতা কয়। ধানাইপানাই থুইয়া, ঠিকানা দেন তাড়াতাড়ি। এত সহজে ছাড়মু না। ওর কথার ধার শুনে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিলাম। মায়ের মন তো, এমনটি বলা স্বাভাবিক। রাগ করলাম না। এতক্ষণ মসজিদে মাইকিং করেও কোনো খোঁজ পাইনি।
তাই গেলাম ফতুল্লা থানায় জিডি করতে। ওসি সাহেব বললেন, ঘণ্টাখানেক বসেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, ও আবার ঠিকানাও জানে। এরই মধ্যে হয়তো খবর পেতে পারেন। আমি পাগলের মতো ঘড়ি দেখছি। ভাবছি, না পাওয়া গেলে কী হবে আমাদের? এত সুন্দরী, গায়-গতরে ডাঙ্গর-ডোঙ্গর। খারাপ ছেলেদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে। তাহলে তো আমি ফেঁসে যাব। এই ভয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি। আল্লাহকে শুধুই ডাকছি। গলা, জিহ্বা ও ঠোঁট শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে। আমি তো ওকে ফুলের টবে রাখা গাছের মতো করে বড় করেছি। ওর কোনো চাহিদা আমি অপূর্ণ রাখিনি। পোশাক-আশাক দেখে সবাই বলত আমাদের মেয়ে। আমরাও তা-ই বলেছি। এসব মনে করে এখন কপাল চাপড়াচ্ছি।
হঠাৎ মোবাইলে রিং হলো। সুমির মা মোবাইলে জানাচ্ছে, আফা মাসুমাকে দুজন বেডায় নিয়া আইছে। আফনেরা তাড়াতাড়ি আইয়েন। হে আল্লাহ! সত্যি সত্যিই তুমি আছ গো আল্লাহ! আমার ডাক কবুল করেছ। আমার ধরে যেন প্রাণ ফিরে এল।
ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনাদের ভাগ্য ভালো। এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।’ আসতে আসতে বুঝলাম, যে নারী জন্ম দেয় সে মাতা।
কিন্তু মাতৃত্ব আসে হৃদয় থেকে। সন্তান জন্ম না দিয়ে, মাতা না হয়েও মাতৃত্ব আসতে পারে। এটা কিছুটা হৃদয়ঘটিত, কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
সন্তানহীনা মায়েরা অষ্টপ্রহর কষ্টের দ্যোতনা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। তাদের মুখাবয়বে একটা বিষণ্নতার অমোচনীয় কালোছায়ার আবরণ থাকে চিরদিন। তবুও মিছে মায়ায় বাসায় এসে মাসুমাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ-মমতা উজার করে চমু খাই। আনন্দে কেঁদে ফেলি। যে মাসুমাকে নিয়ে এসেছে ও রেলওয়েতে মাস্টাররোলে চাকরি করছে। বয়স সম্ভবত ৩৫-৩৬। কথাবার্তায় বুঝলাম, লেখাপড়া কিছু জানে। আমি বললাম, তুমি আজ আমার মেয়েটির মানসম্মান, ইজ্জত রক্ষা করেছ। কী চাও ভাই তুমি? লোকটি বলল, ভাইবোনের মধ্যে লেনদেন কেন আপা? ও তো আমার মেয়ের মতো মনে করেই নিয়ে এলাম। কেননা, সমাজে হারানো, চুরি-যাওয়া, পাচার হওয়া ছেলেদের ঘরে তোলে। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই তোলে না। কারণ, সমাজের চর্মচক্ষুতে তারা অচ্ছ্যুত। এ জন্য আজই মুরুব্বিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনে মনে বলছি, এত ছোট চাকরি করা একজন গরিব মানুষ! তার মুখে এত মূল্যবান কথা! তা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে। সে চিত্তে বিত্তবান একজন মহতী মনের মানুষ। ওর যা আছে এ দেশের অধিকাংশ কোটিপতিরও তা নেই। মন থেকে তাকে শুধু সহস্রবার স্যালুট জানালাম!
মাতৃস্নেহের সবটুক সুধা ঢেলে মাসুমাকে বড় করেছি। হয় তো ওকেও ওর অভিভাবক নিয়ে যাবে। তবুও আমি বহুত খুশি। এর আগে আমি আরও দুজন হারানো বাচ্চাকে তাদের অভিভাবকদের কাছে সযত্নে তুলে দিয়েছিলাম। বিধাতা মাসুমাক ফিরে দিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। মাসুমা চলে গেলে আমি সারা জীবন মনোকষ্টে ভুগবো সত্যি। তখন না হয় ‘নিঃশব্দ কান্না’ই হবে আমার নিঃসন্তান জীবনের অনুষঙ্গী।