ঢাকা ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
English
বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৪, ০২:১৫ পিএম
আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৮ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

গত সংখ্যার পর

তুমি জানবে হয়তো, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তা একটি গোপন বেতার কেন্দ্র চালু করেন। কেন্দ্রটির নাম দেন তারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন বেতার ভবনটি পাকিস্তান বাহিনী ধ্বংস করে দিলে প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন তারা। এরপর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও ট্রান্সমিটার নিয়ে আগরতলায় চলে আসেন। রাজ্য সরকারের সুপারিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় আগরতলার শালবাগানে নতুন করে চালু করা হয় কেন্দ্রটি। পরের দিকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়ে পুরোদমে সম্প্রচার শুরু না করা পর্যন্ত বেতার কেন্দ্রটি আগরতলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কাজ চালিয়ে গেছে। 

তোমাকে আরও একটি ঘটনার কথা বলি। 

সম্ভবত ২৭ মার্চ ১৯৭১। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুনীর আহমদ নামের একজন ছাত্র বর্ডার পাড়ি দিয়ে সর্বপ্রথম আগরতলায় পৌঁছে। ওর সঙ্গী কলকাতার দুজন সাংবাদিক- দীপক ব্যানার্জি ও সুরজিৎ ঘোষাল। কোনোরকম বিপদের কথা না ভেবে পরিস্থিতি দেখার আগ্রহে ওই দুই ভারতীয় সাংবাদিক, এক অর্থে, জীবনবাজি রেখেই পূর্ববঙ্গে ঢুকে পড়ে। সোনামুড়া দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে আটক হয় ওরা। প্রাইমারি ইন্টারগেশনের পর ওদের আগরতলায় আনা হয় এবং একপর্যায়ে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের নাম বলায় পরিস্থিতি অনুকূলে আসে। ত্রিপুরা বিএসএফের আইজি ছিলেন তখন মি. ভি কে কালিয়া। আমকে ও অনিল বাবুকে- দুজনকেই মি. কালিয়া চিনতেন। মূলত অনিলই বিএসএফ-কে বুঝিয়ে ওদের ছাড়াবার ব্যবস্থা করে এবং সরাসরি ওর মেলারমাঠের বাড়িতে নিয়ে তোলে। বুঝলে, সরকারি এই বাড়িটা ঠিক অনিলের নয়, বরাদ্দ ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তরের কর্মচারী, মানে ওর স্ত্রী সুনন্দার নামে। এই বাড়িটিই শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা-কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বড় ঠিকানা হয়ে ওঠে। আগে বলেছি কি না মনে পড়ে না, সুনন্দা আমার স্ত্রীর বিভাগেই চাকরি করত, একই হাসপাতালে। যাই হোক, খবরটা জানতে পেরে আমি দ্রুত মেলারমাঠে পৌঁছি। ওদের কাছেই সর্বপ্রথম পাকিস্তান সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পাই। 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কলকাতার দুজন সাংবাদকর্মী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং নিহত হন, মল্লিকা ব্যাপারটা জানে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে ওদের নাম-পরিচয়ও আছে। কিন্তু অনিল ভট্টাচার্যির বাড়িতে সার্জন দত্ত তাদের দেখেছেন, এটি জেনে মল্লিকার আগ্রহ বেড়ে যায়। 

বলেন- স্যার, যতটা শুনেছি পরের দিকে ওরা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। 

হ্যাঁ, ওরা দুজনেই নিহত হয়। অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে কাপড়চোপড় রেখে, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবারও ঢুকে পড়ে ওরা পূর্ববঙ্গে। আরও কিছু খবর ও ছবি সংগ্রহ করবে। কুমিল্লা কিংবা কাছাকাছি কোনো জায়গায় গিয়ে হঠাৎই সৈন্যদের একটি টহল টিমের সামনে পড়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমে ওদের নামপরিচয় জানতে চায়। ওরা কেউ মিথ্যে বলেনি। একদিকে হিন্দু এবং ভারতীয়, অতএব সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। বুঝলে, এখনো খুব মনে পড়ে, বেশি কিছু বয়স নয়, টকবগে তরুণ। ওই দুজনকে আজও ভুলতে পারিনি আমি। ওদের ব্যাগ, জামাকাপড়, বছরের পর বছর পড়েছিল সুনন্দা-অনিলের মেলারমাঠের বাড়িতে। 

এরই মধ্যে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা সীমান্ত অতিক্রম করলেন। এপ্রিলের ২ তারিখে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে নিজের গাড়ি করে আগরতলায় প্রবেশ করলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক এবং খুলনার মহসিন সাহেব। অনিলের বাড়িতেই ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এর পর থেকেই শুরু হয় বিপুল হারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আগমন। রামগড় হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবদুল হান্নান, এম আর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ-আল-হারুন ও মোশাররফ হোসেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আরও অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পৌঁছলেন। আওয়ামী লীগের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা যার যার সুবিধাজনক পথে হয় পশ্চিমবঙ্গ, নয় মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করলেন। 

ত্রিপুরা তখন ইউনিয়ন টেরিটরি- পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়নি। শচীন্দ্র লাল সিংহের কংগ্রেস ক্ষমতায়। নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রধান বিরোধী দল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিএম। যার যার রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষা করেও সবাই সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াল। একদিকে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ লাখ লাখ শরণার্থীকে আগলে রাখে, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমর্থনে গণসমর্থন সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় আগতলার সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নামেন। ঢাকার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ১ এপ্রিল ১৯৭১ লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা আগরতলার পোস্ট অফিস চৌমুহনী থেকে মিছিল বের করেন। ৩ এপ্রিল ১২ ঘণ্টার ‘ত্রিপুরা বন্ধ’ পালিত হয় ছাত্র যুবক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে। 

ঢাকায় ২৫ মার্চের সামরিক আগ্রাসন এবং গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। ভূপেন দত্ত ভৌমিকের দৈনিক সংবাদ কার্যত বাংলাদেশের পত্রিকা হয়ে যায়। দৈনিক দেশের কথা, জাগরণ ও সাপ্তাহিক সমাচার পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে জয় বাংলার খবর। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের সবকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিধানসভায় আলোচনার দাবি তোলে। ২৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বিধানসভায় বাংলাদেশের সমর্থনে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন। সরকার ও বিরোধীদলের মোট ১৫ জন বিধায়ক আলোচনায় অংশ নেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন, শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানান। 

গণসমর্থন সেখানেই থেমে থাকে না। ঢাকার মাটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ছয় দিনের মাথায় ৩১ মার্চ ১৯৭১ রাজ্য আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস করে। সে প্রস্তাবে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহমর্মিতা জানানো হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরা বিধানসভা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের কাছে দাবি জানায়। 

কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো যায় না। গোটা পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে প্রতিদিন বর্ডার পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। এরা সব ধর্মের, সব পেশার; শহরের, বন্দরের, গ্রামের। বিদ্যমান শরণার্থী সংকট মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি শরণার্থীদের জন্য আশু সাহায্যের আবেদন জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে জরুরি বার্তা পাঠান। শরণার্থী সমস্যাকে ‘জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জোর সুপারিশ তোলেন।

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব

তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্প: কুষ্টিয়ার জমিদার

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম
তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্প: কুষ্টিয়ার জমিদার

পার্থিব বা বৈষয়িক অপ্রতুলতা সৃষ্টিশীল মানুষকে হীনম্মন্য করে তোলে না। তার সৃ‌ষ্টি দিয়েই তিনি অতিক্রম করেন সব অপ্রতুলতা। প্রতিষ্ঠান, অর্থ, রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকলেই কেউ সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সৃষ্টিশীলতা এক দৈব বা জৈব রসায়ন। তেমন একজন মানুষ এই সময়ের অন্যতম লেখক, গবেষক ড. মুহাম্মদ এমদাদ হাসনায়েন। তিনি এ কালের একজন অগ্রণী চিন্তক, গবেষক- বিনা তর্কেই এটা মেনে নেওয়া যায়। লেখকের জন্মস্থান কুষ্টিয়ায়। ফলতঃ তার গবেষণার বিষয়বস্তু কুষ্টিয়াকে কেন্দ্র করে। কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করা লেখকদের লেখা গ্রন্থের একটা সুষ্ঠু পরিচয় এ কালের পাঠকদের সামনে তুলে ধরা লেখকের অন্যতম উদ্দেশ্য। দশকের অধিককাল তার গবেষণা, ভাবনা-চিন্তা কুষ্টিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমী পাঠকদের কাছে অক্লান্তভাবে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

ক্রমশ দীন হতে থাকা ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষণাধর্মী সারস্বত জগৎ এখন মাত্র যে কয়েকজন লেখককে নিয়ে গর্ব করতে পারে, ড. মুহাম্মদ এমদাদ হাসনায়েন তাদের অন্যতম। আমি লেখকের অমূল্য সৃষ্টি ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গবেষণাধর্ম গ্রন্থটি অনেকদিন ধরে পড়ছি। কুষ্টিয়ার জমিদারদের গোড়াপত্তন, শাসন, নির্মাণশিল্প গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু। তৎকালীন কুষ্টিয়ার জমিদারদের ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি, জীবনের অগ্রগতি ও অবসান নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। এই গ্রন্থটি পড়া শুরু করার পর মনের মধ্যে জমে থাকা বেশ কিছু জটিল অঙ্কের সমাধান হয়ে গেছে। কেবল তাই নয়, একটা নতুন খিদের জন্ম দিয়েছে। খিদেটা তৎকালীন জমিদারদের শাসন, শিল্পকলা, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের একটা চিত্রের জোরালো আভাস পাওয়ার বাসনা। গ্রন্থটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ শেষে আমার সেই মনোবাসনা পূর্ণও হয়েছে।

গ্রন্থটি আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্পের লেখকের নিখুঁত বর্ণনা। লেখক তৎকালীন জমিদারদের বিলাসী জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে মিহি সুতিবস্ত্র, উৎকৃষ্ট রেশমবস্ত্র ও পণ্য, রত্নালঙ্কার, কারুকার্যখচিত তরবারি ও স্থানীয় নানা শিল্প ও কারুকলা এবং ক্ষুদ্রশিল্পকে সবিশেষ বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে কুষ্টিয়ার নামকরণ ও জমিদারি প্রথা আর দ্বিতীয় পর্বে তার বিস্তারিত বর্ণনা। জমিদারের জমিদারি প্রথার বর্ণনায় প্রত্যেক জমিদারের প্রাসাদ ও স্থাপত্যের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। লেখক গ্রন্থটিতে কুষ্টিয়ার তৎকালীন জমিদারদের গোড়াপত্তন, বিস্তার, পারিবারিক জীবন, শাসনপদ্ধতি, স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি সামাজিক এবং ধর্মীয় উৎসবপরবে কুষ্টিয়ার জমিদারদের ব্যয়বহুল সমাজে সম্পদের সঞ্চালনকেও কমবেশি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, কুষ্টিয়ার জমিদারদের দরবার ছিল নবাব দরবারের অনুকরণে নির্মিত, যা আগে পাঠকদের অন্য কোনো গবেষণাধর্মী গ্রন্থ থেকে জানার সুযোগ হয়নি। তাদের পোশাকপরিচ্ছদ, খানাপিনা, শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলা চর্চার কারণে তুর্কি-ফার্সি এবং দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সমম্বয়ের পথই প্রশস্ত হয়। গ্রন্থটির অন্যতম আকর্ষণ ‘জমিদার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ 

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে জমিদারি ক্রয় করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথের হাত ঘুরে নদীয়ার বিরাহিমপুর ও কালীগ্রামের জমিদারির দায়িত্ব পান ৭ মে ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান। প্রজাবৎসল জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের দরবারে এসে যখন দেখেন মুসলমানরা মাটিতে আর হিন্দুরা আসন পেতে বসা, তখন তিনি বলেন, যেখানে এমন বৈষম্য ব্যবস্থা সেই দরবারে তিনি যোগ দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারি।’ 

গ্রন্থটিতে লেখক মানবিক শিল্পমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে তুলে এনেছেন। কুষ্টিয়ার প্রতিটি জমিদারের জমিদারি শাসনব্যবস্থা ও শিল্পগুণের অসংখ্য বর্ণনায় ঠাসা লেখকের ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গ্রন্থটি।

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আউল-বাউল মিলে কুষ্টিয়ার রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গ্রন্থে সব বিষয়ের বর্ণনা যেন ক‍্যানভাসে আঁকা ছবি। গবেষণা গ্রন্থের ভাষাশৈলী খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থটির ভাষাশৈলী তৎকালীন সময়ের সঙ্গে অত‍্যন্ত সাযুজ‍্যপূর্ণ। বিভিন্ন বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনায় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ত্রিমাত্রিক দৃশ‍্যপট রচিত হয়েছে। একটি গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে হয়তো শতভাগ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি কিন্তু জমিদার আমলের কুষ্টিয়ার প্রাচীন পথ, জনসমাজ, স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষা, পুথিসাহিত্য, গ্রামীণ উৎসব এবং প্রত্নকীর্তি- সব মিলিয়ে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আকর।

নিঃশব্দ কান্না

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৮ পিএম
নিঃশব্দ কান্না
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

সেদিন ছিল ঈদের দিন। ভাড়াটিয়ারা অনেকেই ছানাপোনাসহ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গেছে। বাড়িটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আমার নিঃসন্তান হৃদয়ে এই শূন্যতা মুহুর্মুহু আহাজারিতে গুমরে মরছে। কেননা, আমি মানুষটা কোলাহলের, নিরালার নই। তবে ঈদ-আনন্দ গ্রামে উপভোগ করতে চাই আমিও। কিন্তু আমার যে সন্তান হচ্ছে না। এই না হওয়ার হাজারো অপবাদ আর অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি বড্ড ক্লান্ত।    

ভেজা চুল ঝেড়েমুছে তোয়ালেটা নিয়ে মাত্র বের হলাম। হঠাৎ আমার ভাড়াটিয়া সুমির মা এসে বলল- ‘আফা, সকাল থাইকা পিচ্চিটা আফনেগো গেটের ভেতরে খাড়ায়ে রইছে। তা-ই লইয়া আইলাম।’ ছেলেটির বয়স বড়জোড় আড়াই-তিন বছর হবে হয়তো। গায়ের রং কালো। পরনে লাল প্রিন্টের শার্ট-প্যান্ট। মুখমণ্ডল গোলাকার। ফোলাফোলা টোলপড়া গালে শ্লেষ্মার আঁটলি। মায়ামায়া চোখযুগল। আমি আদর করে কোলে নিলাম। সে তার চোখের গোল কর্নিয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। নাম জানতে চাইলাম। কিছুই বলে না। সম্ভবত স্বল্পবাক। ওর টোপাটোপা গালে শ্লেষ্মা-আঁটলি দেখে আমার স্বামী বলল- দেখছ কী? ওরে গায়-গোসল করিয়ে আগে খেতে দাও। পরে খোঁজ-খবর নিয়ে না হয় একটা বিহিত-ব্যবস্থা করব। 

গোসল করিয়ে সাজুগুজু করালাম। বাহ! এখন খুব সুন্দর লাগছে। খাওয়ালাম। শান্ত সুবোধ শিশুটি সুন্দর করে খেল। ওমা! দেখি, খাবার মুখে নিয়েই ও ঘুমে ঢলে পড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে শোয়ালাম। ও আরামসে ঘুমিয়ে গেল। কোনো কান্নাকাটি নেই। অস্থিরতা নেই। নেই মনস্তাপ। শান্ত, নিটোল শিশুটির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। আহা রে, না জানি পাগলপ্রায় মা-বাবা হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। ঈদের দিনেও বুকচাপড়ে কাঁদছে। এদিকে অবোধ মানিকসোনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তার পর মাইকিং করাব। অনেকক্ষণ পর মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ওর মাথায় হাত রাখি। আমার আলতো স্পর্শেই ও জেগে উঠল। ওয়াশরুমে নিয়ে ওকে প্রসাব করলাম। ভুনাখিচুড়ি আর কলিজাভুনা দিয়ে ওকে খাওয়ালাম।      

প্রাক-সন্ধ্যার আলো-আঁধারী। সন্ধ্যারাগের সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠল! ভাবছি, এখন অবধি কোনো খবর হলো না। অমনি  হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল তিন-চারজন। এসেই বাচ্চাটির মায় খাট থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। ওকে নাকে-মুখে, গাল-ঠোঁটে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল। বুকে ঠেসে ধরে জড়িয়ে কেঁদে দিল। আহা রে! হারানো সন্তানপ্রাপ্তির এক মায়ের সন্তান বাৎসল্যের আকুতির গভীরতা কতটা স্পর্শকাতর! আরও অনুভব করছি, বাঙালি মায়েদের মাতৃত্বের ভাণ্ডার বুঝি এমনই বিশ্বজনীন স্নেহ-মায়া-মমতায় ভরপুর থাকে। 

তাছাড়া, বাচ্চাটির মুখাবয়বের উজ্জ্বলতায়ও বলে দিচ্ছে সেও মনে মনে আনন্দিত। ওর কাজলদিঘি চোখ এখন প্রাপ্তির পূর্ণতায় উদ্ভাসিত। ওরা যেমন আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকল তেমনি আকস্মিকভাবেই-না ছোঁ মেরে ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিথি! অথচ রেখে গেল স্মৃতির ক্যানভাস-জমিনে মায়াময় স্মৃতি! আমার অবচেতন মনে কখন জানি ওর প্রতি মাতৃত্ব জেগে উঠেছে জানি না। তাই কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ ছিলাম। যাওয়ার সময় ওরা অবশ্য বলেছে, ‘আফনেগো মাঝমধ্যিখানে আইয়া দেখাইয়া নিয়া যামু।’

জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। হঠাৎ একটি ফুটফুটে ছয়- সাত বছরের মেয়ে এল। বলল- আফা, আমি আফনেগো স্কুলে পড়ি। আমরা গরিব। বাবায় কয়, খোরাকির টাকাই জোগাইতে পারি না। পড়ামু কেমনে? তাই আমি আফনেগো কাম করমু আর পড়মু। অনাহারশীর্ণ মেয়েটির কথা আমার অন্তর্মূলকে বিদ্ধ করল। এই বয়সে মেয়েটির কষ্টের অনুভূতির অনুধাবন ক্ষমতা এতটা সংবেদনশীল? আমি বিস্ময়াভিভূত!  

মেয়েটিকে বললাম, আগামীকাল জানাব। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলাম।  আসার পথে মেয়েটির বাড়িওয়ালার বাড়িতে গেলাম। একজন বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আফা, ওর বাবা বছরব্যারামি। কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। সংসারের পোষ বেশি। ঘরে খাওন নাই। কষ্টে আছে। মাইয়াডারে আফনে নিয়া নেন আফা। এই কথা শুনে ওই দিনই ওকে নিয়ে নিলাম।

ওর নাম মাসুমা। সুন্দরী ও সুশ্রী। দুধে-আলতা গায়ের রং। ডাগর-ডাগর চোখের ভ্রুগুলো যেন চিরুনিটানা। ওর গোলাকৃতি মুখের হাসিটাও সুন্দর। আপেলরাঙা ভরাটগাল। দাঁতগুলো ঝকঝকে। জীর্ণবস্ত্র, শীর্ণকায় শরীরটা যেন ধনুকের মতো বেঁকে আছে। পেট চুপসে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে। আমি তড়িঘড়ি ঘরে গিয়ে ওকে খেতে দিলাম। ক্ষুধার্ত মেয়েটির খাওয়ার আকুলতা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।

সেই থেকে মাসুমা আমার কাছেই আছে। ও এখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। 

বছর দুয়েক পর। আমি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সেই সুমির মা-ই এসে  বলল, আফা, পিচ্চিটা সহাল থাইকা  ঘুরঘুর করছে। এর লাইগা লইয়া আইলাম। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আমার সঙ্গে এমনটি কেন ঘটছে?  

মাসুমাকে বললাম, ওকে রুটি-হালুয়া খাওয়াতে। রুটি হাতে নিয়ে ও সুমির সঙ্গে ওদের ঘরে গেল। দেখলাম, ও একটি চেয়ারে বসে পা ঝোলাচ্ছে আর খাচ্ছে। ওর সঙ্গে সুমিও। ওরা হাসছে, খেলছে। তাই আমি নিশ্চিন্তে স্কুলে গেলাম। 

ফার্স্ট শিফট ছুটি। হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে একটু বাসায় গেলাম। ইতোমধ্যে আমার স্বামী এক ডজন সাগর কলা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি শুয়ে কলা খাচ্ছে। আমি আরেকটি কলা দিলাম। কলা পেয়ে ওর সেকি আনন্দ! ও আমার স্বামীকে বলছে, ‘তুই আমার লাইগা এত্তগুলান কলা আনছস!’ এই বলে আমার স্বামীর শরীরের ওপর দিয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমরা ওর মা-বাবা। তুই-তোকারি সম্বোধনে বুঝলাম, ও মা-বাপের বড্ড আদুরে মেয়ে। 

ওর দায়িত্ব সুমির মায়ের ওপর দিয়ে আমি মাসুমাকে নিয়ে স্কুলে এলাম। এরেই মধ্যে কয়েকটা মসজিদ থেকে মেয়েটির সম্পর্কে ঘোষণা করানো হয়েছে। ভাবছি, বিকেলে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করব। দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আবারও বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সুমির মা গোসল করিয়ে  মুখে পাউডার, চোখে কাজল দিয়েছে। ওর ফ্রকটা ধুয়ে সুমির ফ্রক পরিয়েছে। ভাত খাইয়েছে। শুনলাম- সুমির মা ওকে পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাতে পাকুতি বুড়ি বলে- আমার মা আমারে পাছায় জোরেজোরে থাপ্পড় দিত। তুমিও এমনি কইরা দেও। তাইলে আমি ঘুমামু। তা শুনে আমিও হেসে লুটোপুটি। স্কুলে এসে কাজে মন দিলাম। 
স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। আমরাও বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে একজন মহিলা কান্নাকাটি করতে করতে স্কুলে ঢুকেছে। এসেই বলছে-  আমাগো মাইডারে নাকি এই স্কুলের আপার বাসায় আছে। আমি এগিয়ে এসে বললাম, হ্যাঁ।  তিনি জানালেন, ওর মা ভোরে হাসপাতালে গেছে। যাওয়ার সময় ও যাইতে চাইছিল। ওর মা কাঁন্দাইয়া থুইয়া গেছে। কোন ফাঁকে ও  ফ্রক হাতে লইয়া বাইর হইয়া গেছে। আমরা টেরই পাইনি।

সব শুনে হেডস্যার বলছেন, আপা, সুমির মাকে বলেন, মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে আসতে। এখান থেকেই ওকে অভিভাকের হাতে তুলে দেব। খবর পেয়েই সুমির মা নিয়ে এল ওকে। ওর গায়ে ধোয়া ফ্রক-প্যান্ট। মুখে স্নো-পাউডার। কপালে কাজলের টিপ। আঁচড়ানো পরিপাটি চুল। বেশ ফুটফুটে লাগছে। ওমা! আপারা সবাই এর কোল থেকে ওর কোলে নিচ্ছে। ও যাচ্ছে নিঃসংকোচে। 

হেডস্যার বললেন, ওর বাবা কিংবা মা একজনকে আসতে হবে। কিছুক্ষণ পরই ওর বাবা আরও একজন মুরুব্বি কিছিমের লোক নিয়ে সরাসরি এলেন। ও তখন ওর জেঠিমার কোলে। ওর বাবাকে দেখেই বলে, এত্তক্ষণে তর মনে অইল আমার কতা? অভিমানী মেয়েটি এই বলে কেঁদে ফেলে। বুঝলাম, শিশুর মনেও অভিমানের দহন থাকে। পাকুতি বুড়ির পাকানো কথা শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তার পর স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ওর বাবার কোলে মেয়েটিকে তুলে দিলাম। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সবাইকে মায়াময় ভালোবাসায় জড়ায়ে গেল। আমার মাতৃ হৃদয়েও একটা শূন্যতার ঝোড়ো হাওয়ায় তোলপাড় করছে। ভেতর থেকে অবদমিত কান্না ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি। ওরা বলেছিল, মাঝেমধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসবে ওকে। কিন্তু কেউ-ই কথা রাখেনি। না আসুক, তাতে কী? বাচ্চা দুটোর মা-বাবার কাছে ওদের তুলে দিতে পেরেছি, এতেই আমার শান্তি। একজন গেল নীরব ভালোবাসায় জড়ায়ে। আরেকজন গেল সরব ভালোবাসায় কাঁদায়ে। এই কান্না একান্তই আমার। নিঃসন্তান হৃদয়ে অন্তর্নিহিত অস্তিত্বে গুমড়ে ওঠা অদৃশ্যমান এক নিঃশব্দ কান্না!  

এরই মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে চাষাঢ়া রেললাইন ধরে হাঁটছি। মাসুমা আমাদের রেখে আগেভাগে যাচ্ছে। আমরা পেছন থেকে ডাকছি। ও হাত নেড়ে শুধু আগাচ্ছে। একসময় মাসুমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমন তো সবসময়ই করে। আগে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয়। আমরা এটাই ভাবছি। কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখি মাসুমা যায়নি। তা শুনে আমার মাথায় চক্কর খেল! আমি হতবিহ্বল! তার পর খোঁজাখুঁজি আর  কান্নাকাটি! আমার বুকটায় যেন হাতুড়িপেটানোর মতো ধাপুস-ধুপুস শব্দ হচ্ছে। অজানা আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপছে। ভয়ে-ভয়ে ওর মাকে ফোনে খোলাসা করে ঘটনাটা বলি। ওর মা বিশ্বাস করছে না। বলে, কত মানুষ গুম কইরা রাইখ্যা মিছা কতা কয়। ধানাইপানাই থুইয়া, ঠিকানা দেন তাড়াতাড়ি। এত সহজে ছাড়মু না। ওর কথার ধার শুনে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিলাম। মায়ের মন তো, এমনটি বলা স্বাভাবিক। রাগ করলাম না। এতক্ষণ মসজিদে মাইকিং করেও কোনো খোঁজ পাইনি।

তাই গেলাম ফতুল্লা থানায় জিডি করতে। ওসি সাহেব বললেন, ঘণ্টাখানেক বসেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, ও আবার ঠিকানাও জানে। এরই মধ্যে হয়তো খবর পেতে পারেন। আমি পাগলের মতো ঘড়ি দেখছি। ভাবছি, না পাওয়া গেলে কী হবে আমাদের? এত সুন্দরী, গায়-গতরে ডাঙ্গর-ডোঙ্গর। খারাপ ছেলেদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে। তাহলে তো আমি ফেঁসে যাব। এই ভয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি। আল্লাহকে শুধুই ডাকছি। গলা, জিহ্বা ও ঠোঁট শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে। আমি তো ওকে ফুলের টবে রাখা গাছের মতো করে বড় করেছি। ওর কোনো চাহিদা আমি অপূর্ণ রাখিনি। পোশাক-আশাক দেখে সবাই বলত আমাদের মেয়ে। আমরাও তা-ই বলেছি। এসব মনে করে এখন কপাল চাপড়াচ্ছি।

হঠাৎ মোবাইলে রিং হলো। সুমির মা মোবাইলে জানাচ্ছে, আফা মাসুমাকে দুজন বেডায়  নিয়া আইছে। আফনেরা তাড়াতাড়ি আইয়েন। হে আল্লাহ! সত্যি সত্যিই তুমি আছ গো আল্লাহ! আমার ডাক কবুল করেছ। আমার ধরে যেন প্রাণ ফিরে এল।   
ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনাদের ভাগ্য ভালো। এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।’ আসতে আসতে বুঝলাম, যে নারী জন্ম দেয় সে মাতা। 
কিন্তু মাতৃত্ব আসে হৃদয় থেকে। সন্তান জন্ম না দিয়ে, মাতা না হয়েও মাতৃত্ব আসতে পারে। এটা কিছুটা হৃদয়ঘটিত, কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।  

সন্তানহীনা মায়েরা অষ্টপ্রহর কষ্টের দ্যোতনা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। তাদের মুখাবয়বে একটা বিষণ্নতার অমোচনীয় কালোছায়ার আবরণ থাকে চিরদিন। তবুও মিছে মায়ায় বাসায় এসে মাসুমাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ-মমতা উজার করে চমু খাই। আনন্দে কেঁদে ফেলি। যে মাসুমাকে নিয়ে এসেছে ও রেলওয়েতে মাস্টাররোলে চাকরি করছে। বয়স সম্ভবত ৩৫-৩৬। কথাবার্তায় বুঝলাম, লেখাপড়া কিছু জানে। আমি বললাম, তুমি আজ আমার মেয়েটির মানসম্মান, ইজ্জত রক্ষা করেছ। কী চাও ভাই তুমি? লোকটি বলল, ভাইবোনের মধ্যে লেনদেন কেন আপা? ও তো আমার মেয়ের মতো মনে করেই নিয়ে এলাম। কেননা, সমাজে হারানো, চুরি-যাওয়া, পাচার হওয়া ছেলেদের ঘরে তোলে। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই তোলে না। কারণ, সমাজের চর্মচক্ষুতে তারা অচ্ছ্যুত। এ জন্য আজই মুরুব্বিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনে মনে বলছি, এত ছোট চাকরি করা একজন গরিব মানুষ! তার মুখে এত মূল্যবান কথা! তা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে। সে চিত্তে বিত্তবান একজন মহতী মনের মানুষ। ওর যা আছে এ দেশের অধিকাংশ কোটিপতিরও তা নেই। মন থেকে তাকে শুধু সহস্রবার স্যালুট জানালাম! 

মাতৃস্নেহের সবটুক সুধা ঢেলে মাসুমাকে বড় করেছি। হয় তো ওকেও ওর অভিভাবক নিয়ে যাবে। তবুও আমি বহুত খুশি। এর আগে আমি আরও দুজন হারানো বাচ্চাকে তাদের অভিভাবকদের কাছে সযত্নে তুলে দিয়েছিলাম। বিধাতা মাসুমাক ফিরে দিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। মাসুমা চলে গেলে আমি সারা জীবন মনোকষ্টে ভুগবো সত্যি। তখন না হয় ‘নিঃশব্দ কান্না’ই হবে আমার নিঃসন্তান জীবনের অনুষঙ্গী।

ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেট

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২২ পিএম
ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেট

অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যবাহী শিল্প-পর্যটন-শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে সিলেট মহানগর। ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেটের ওপর গবেষণামূলক প্রকাশনা খুবই সীমিত। মূলত সিলেট মহানগরের ওপর গবেষণা প্রকাশনার এই অপূর্ণতা দূর করতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বহুশাস্ত্রীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্মানিক সভাপতি প্রবীণ ভূগোলবিদ, নগরবিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং তার প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা শীর্ষক গবেষণা সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গ্রন্থটিতে ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেট মহানগরের প্রাকৃতিক ও মানবিক বিষয়াবলির ওপর সময়োপযোগী গবেষণা নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে। সিলেট মহানগরের (সিলেট সিটি করপোরেশনভুক্ত সমগ্র প্রশাসনিক এলাকা) ভৌত পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা, মানবস্বাস্থ্য, দূষণ ও ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ও জনদুর্ভোগ ইত্যাদি বিষয়াবলির ওপর মাঠপর্যায়ের পর্যালোচনাভিত্তিক উচ্চমানসম্মত সমসাময়িক ১৮টি ভৌগোলিক গবেষণা প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ/পরিবেশবিদ্যা বিভাগ-এর বিদগ্ধ শিক্ষকদের মতামত ও পরিমার্জন প্রবন্ধগুলোকে আরও পরিশীলিত করেছে।

গ্রন্থটিতে সিলেট মহানগরে পরিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বন্যা, ভূমিকম্প, পানিনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মাজার-কর্মকাণ্ড, মণিপুরী কুটির শিল্পকেন্দ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা, মাতৃস্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, পর্যটন এবং নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। 

গ্রন্থটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রমথেশ দাস পুলক। অত্যন্ত সূচারুভাবে মুদ্রিত সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা সংকলন গ্রন্থটি শহরের টেকসই উন্নয়নে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের উপকৃত করবে এবং আগ্রহী পাঠকদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে সমর্থ্য হবে বলে মনে করি।

‘সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা’, সম্পাদনায় ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ড. অলোক পাল, প্রকাশক নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা ও চন্দ্রাবতী একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ২০২৫, পৃষ্ঠা ৩৬০, হার্ড কভার, মূল্য: ৮০০ টাকা।

পূর্বাচল

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
পূর্বাচল
এইখানে একদিন আদিবাসী মানুষের
নিবিড় বসতি ছিল,
নাড়ীর শেকড় পোঁতা সহস্র বছর মৃত্তিকা গভীরে!
 
নগরসভ্যতা হবে: তিলোত্তমা, আলো ঝলমল!
এমনিতর আকাঙ্ক্ষার বলি প্রদোষী স্বজন আজ-
শুকনো খড়ের মতো ভাসে চৈতি হাওয়ায়!
 
এইখানে একদিন ঘুঘু ডাকা গ্রাম ছিল;
এইখানে একদিন জোনাকির আলো ছিল-
রঙে ঝিলমিল!
এইখানে একদিন সিংহকেশী কাঁশফুল ছিল-
           দুরন্ত নিবিড়!
এইখানে একদিন বাঁশের বাঁশিতে সুর ছিল-
   ছিল মাঝিকণ্ঠে গান!
এইখানে একদিন সুলতানি মানুষ ছিল-
         তামাটে কঠিন!
মেঠোপথে নগ্নপদী রূপসীর কলহাস্যধ্বনি!
 
এইখানে একদিন অরণ্যবিনাশী সভ্যতা দাঁড়াবে-
                  শির উঁচু করা,
        অর্ধসভ্য মানুষের গুঢ় প্রয়োজনে!

মেঘের বাড়ি

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
মেঘের বাড়ি

এসেছে অতিথি পাখি, খোলা সেই জলের ডিঙ্গিতে; সেই সাথে আমি।
বলো তুমি কাকে নেবে, কোন সে উদাসে
চিবুকে আঁকবে তিল; শীতের খেয়ালে?
বিবর্ণ হলুদ পাতায় টুকরো শিশির 
উড়ে যাচ্ছে বাদামি রঙের রোদ, পাশাপাশি দুটি গাঙচিল।

আমি মটরশুঁটির মতো গুটিশুটি ভোরের আঁচলে 
কেবলই নিজেকে খুলি, কেবলই শঙ্খধোয়া জলে
উদোম করি নিজেরই ডানা।

ও সুখ ও আমার প্রিয় ক্রিসেনথিমাম
এসো এই দুধধোয়া ফরফর উতল উজানে-

এসো হরিণের চোখ হই ঘুঘুদের বুক হই
নকশিকাঁথার সুই, হেঁটে হেঁটে কুয়াশায়
নির্জন মেঘের বাড়ি।