ঢাকা ২৬ বৈশাখ ১৪৩২, শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
English

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০১:০৫ পিএম
আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০১:০৫ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

আগরতলায় স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের খবরটি শুধু ভারতের সংবাদপত্রে নয়, সারা বিশ্বেই প্রচারিত হয়। আগতলার দৈনিক সংবাদ-এর ১৩ এপ্রিলের ব্যানার হেডলাইনটি ছিল কী রকম- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষিত-।’ রথীন বাবুর আজও মনে আছে, ‘সাব-হেডলাইন’ ছিল এ রকম : ‘তাজউদ্দিন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বে স্বাধীন বাংলার মন্ত্রিসভা: যুগ্ম-যৌথ নেতৃত্ব। কুষ্টিয়ায় সদর দপ্তর স্থাপন: স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণা: বিশ্বে নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা।’ 

এ পর্যন্ত বলেই সার্জন রথীন দত্ত কাশতে শুরু করলেন। চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন। দুই ঠোক পানি গিললেন। প্রস্তুতি দেখে বোঝা গেল তিনি এবার দোতলায় যাবেন। সত্যি সত্যি সিঁড়িতে পা রাখলেন তিনি। যাওয়ার সময় বলে গেলেন- আজ না হয় এ পর্যন্তই থাক, কী বল? তবে তোমরা যদি চাও তা হলে অপেক্ষা করতে পার। আমাকে এখন স্নান সারতে হবে, ওষুধ-পথ্য নিতে হবে। বয়স হয়েছে তো।

বয়সের হেরফের থাকলেও মল্লিকা ও ক্যামেরাম্যান গৌরব ঘোষ নতুন প্রজন্মের মানুষ। মল্লিকার আটাশ, গৌরবের পঁয়ত্রিশ। একাধিক টিভি চ্যানেল কলকাতায়- কম্পিটিশনের শেষ নেই। ওদের আসল আগ্রহ একটা ভালো ইন্টারভিও নেওয়া, যাতে একটা ভালো রিপোর্ট বেরিয়ে আসে। অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে মল্লিকার এক ধরনের বাড়তি আগ্রহ থাকলেও গৌরবের তেমন কিছু নেই। 

সার্জন দত্ত দোতলায় উঠে গেলে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। মল্লিকা বলে- গৌরব দা, দেখ, সব মিলিয়ে দুবার আমি বাংলাদেশে গেছি, ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পরেই কেমন যেন লাগে! এক মানুষ, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক বাংলা, অথচ দুই দেশ! তিন পুরুষ আগে পদ্মা-ধলেশ্বরীর পাড়ে মুন্সীগঞ্জের কোনো গ্রাম থেকে আমার পূর্ব পুরুষ নদীয়ায় চলে আসে। বড় কষ্টের স্মৃতি তাদের। আর কখনো যায়নি ওরা ঘরবাড়ি দেখতে। হয়তো সুযোগ বা সাহস কোনোটাই হয়নি। ঠাম্মা-ঠাকুরদা চলে যাওয়ার পর বাবারও আগ্রহ কমে যায়। শরীরও খারাপ হতে থাকে। কিন্তু আমি মনে মনে একটা ইচ্ছে পুষে রেখেছিলাম, একবার অন্তত যাব, পিতৃপুরুষের ঘরবাড়ি খুঁজে বার করব। কিন্তু বাংলাদেশ গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম পদ্মা আমাদের বাড়িভিটে, এমনকি গ্রামটিও গিলে ফেলেছে- কোনো চিহ্ন নেই ! দেখ, আমি তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ। আমার তেমন ইমোশন থাকার কথা নয়, তারপরও...।

ক্যামেরাম্যান গৌরব ঘোষের এরই মধ্যে নামডাক হয়েছে। বছরখানেক হলো নতুন চ্যানেলে যোগ দিয়েছে। বলল, শুনেছি ব্রিটিশ আমলে আমাদের পূর্ব পুরুষ সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রাম থেকে এসেছিল। প্রথমে আগরতলায় পরে কলকাতায়। বহুকালই কেউ নেই আমাদের ওখানে। স্বাধীনতা সংগ্রামী উল্লাস কর দত্তের নাম জানিস তো, শুনেছি, তিনিও একই গ্রামের মানুষ। সত্যি বলতে কী- তেমন একটা আবেগ নেই আমার। তবে সুযোগ হলে একবার কালিকচ্ছ গ্রামটা দেখে আসব। 

এতক্ষণ ধরে দত্ত বাবুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল মল্লিকা ও গৌরব। বিস্ময়কর দিনের বিস্ময়কর সব গল্প! একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে ঘটনাগুলো শুনতে শুনতে ওদের মধ্যে এক ধরনের অনুভূতির জন্ম হয়। ওরা ভাবতে থাকে একটি বছর কীভাবে এপার ওপারকে এক করে দিল! কীভাবে 
মানুষে মানুষে, বাঙালি বাঙালিতে একাকার হয়ে গেল! 
কেন, কীসের জন্য? 

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীরা বৈরী প্রতিবেশী পায়নি বরং বন্ধু-সহযোগী পেয়েছিল। সে কারণে এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে অবাধে জায়গা করে নিতে পেরেছিল ভারতীয় রাজ্যগুলোতে। পরিবেশটা সুবিধেজনক ছিল আরও এ কারণে যে, কী পশ্চিমবাংলা, কী আসাম, কী মেঘালয়, কী ত্রিপুরা, সব সীমান্তেই তারা পেয়েছিল প্রায় একই ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারার মানুষ। 

বাঙালিরা সাচ্চা মুসলমান নয়, হবেও না কখনো- এই অপবাদে- একটি জাতির ওপর চাপানো হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ এক গণহত্যা, চালানো হয়েছিল নির্বিচার নারী ধর্ষণ। ৩০ লাখ মানুষকে খুন করা হয়েছে, প্রায় ৪ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করা হয়েছে। ওরা চেয়েছিল মাটি- মানুষ নয়। আরও চেয়েছিল ধর্ষণে ধর্ষণে বেয়াড়া বাঙালি জাতির রক্ত পরিবর্তন করতে! আর সবই করেছে ওরা ধর্ম রক্ষার নামে! কিন্তু ইতিহাসের গতিধারা কখনো ঘাতক-নিপীড়কদের সমর্থন করে না। করেনি উনিশ শ একাত্তর। 

ডাক্তার রথীন দত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটির আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না রিপোর্টার মল্লিকা সেনগুপ্তের। গৌরব ঘোষের তো নয়ই। কিন্তু আজ মনে হলো বাঙালির ইতিহাসের সুবিশাল এই মাইলফলক নিয়ে জানা প্রয়োজন বৈকি। 

মল্লিকা তাই গৌরবের দিকে তাকিয়ে বলল- বুঝলে গৌরব দা, বেশ লাভ হলো ইন্টারভিউটা নিয়ে। বলতে গেলে এক অর্থে মূর্খই ছিলাম। এতকিছু জানা ছিল না। 

গৌরব ঘোষ নিজেও যে কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেছে তা বোঝা গেল ওর কথায়। বলল, একটা অ্যাসাইন্টমেনট নিয়ে চল একবার বাংলাদেশ ঘুরে আসি। অ্যাসাইন্টমেন্ট না পেলেই বা কি, ডাইরেক্ট ট্রেন আছে, সরাসরি বাস চলে, ত্রিপুরাতেও যায়। কয়েক ঘণ্টার তো জার্নি মাত্র। ভাবছি একবার ঘুরে আসব। 

মল্লিকা সেনগুগুপ্ত এ সময় একটা অদ্ভুত কথা বলে ওঠে। বলে- গৌরব দা, একটা সত্যি কথা বলি তোকে। ধর, আমি যদি তখন থাকতাম, মানে এই বয়সের থাকতাম, পশ্চিমবঙ্গে থাকতাম, তাহলে নির্ঘাৎ আমি জয়বাংলার যুদ্ধে নামতাম। 

গৌরব ঘোষ: তুই তো ভারতীয়, কী করে পারতি? 
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ভারতীয় অনস্বীকার্য, কিন্তু আমার বাঙালি পরিচয় তো আদি ও অকৃত্রিম। সে পরিচয়েই ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকে যেতাম। বেশি কিছু না জানলেও মল্লিকা শুনেছে কলকাতার পাশে গোদরাতে বাংলাদেশের একটি নারী বাহিনী গড়ে তুলতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছিল। বহু নারী অস্ত্র ট্রেনিংও পেয়েছিল। 

বাংলাদেশ নির্মাণের সশস্ত্র যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্য কতটা জড়িয়ে ছিল তার একটি চিত্র অনুমান করা যাবে একটা হিসাবের দিকে তাকালে। এই রাজ্যঘেঁষে বাংলাদেশের মোট ১১টি যুদ্ধ সেক্টরের ৫টি সেক্টর গড়ে ওঠে। ১ নম্বর সেক্টরের সীমানা ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার কিছু অংশ নিয়ে। এর অধিনায়ক ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল ৫টি। এখানে নিয়মিত বাহিনীর মোট সংখ্যা ছিল ২১০০, যার মধ্যে ১৫০০ ইপিআর, ২০০ পুলিশ, ৩০০ সেনা সদস্য, ১০০ নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য। ছাত্র ও সাধারণ যুবতারুণ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গেরিলা সদস্যের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব

১২তম পর্ব

১৩তম পর্ব

১৪তম পর্ব

অচেনা সত্যজিৎ

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ০৪:৫৮ পিএম
আপডেট: ০২ মে ২০২৫, ০৫:০২ পিএম
অচেনা সত্যজিৎ
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

বাঙালি সমাজের একটা প্রথা, বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই, তাকে বিদায় দেওয়ার সময়ে, সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। এপার বাংলায় তিনজন বাঙালিকে এই প্রথা অবলম্বন করতে দেখা যেত। প্রথমজন হলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। দ্বিতীয় জন সত্যজিৎ রায় এবং তৃতীয় জন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র।

অন্নদাশঙ্কর রায় প্রায় শতবর্ষী হয়েছিলেন। শেষ দিকে শারীরিক কারণে অতিথিকে ফ্ল্যাটে দুয়ার অবধি পৌঁছে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। সত্যজিৎ রায় কিন্তু শেষবার বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত প্রথাটি বজায় রেখেছিলেন। এমনকি হিউস্টনে ডা. ডেন্টন কুলিকে দিয়ে বাইপাস অপারেশন করিয়ে আসার পরও। যেমনটা রেখেছিলেন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র।

একেবারে অজানা-অচেনা কোনো অনুরাগী-অনুগামী এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে। সাধারণত নিজের হাতেই দরজা খুলতেন এবং আলাপের পর ঘর থেকে সদর দুয়ার পর্যন্ত নিজে পৌঁছে দিতেন। আর সত্যজিৎ রায়ের সময়টা ছিল ল্যান্ডফোনের কাল। বাড়িতে থাকলে ফোন বাজলে, সেই ফোনটা তিনি নিজের হাতে ধরতেন। বহু অনুরাগী-অনুগামী এভাবে সরাসরি ফোন করে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হয়েছিলেন। তা ছাড়া কোনো অনুরাগী যদি তাকে চিঠি লিখতেন, একটু দেরি হলেও, নিজের হাতে লিখে চিঠির উত্তর দিতেন। কোনো মামুলি উত্তর কিন্তু নয়। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতেন। কারণ সময়ের অভাবে বড় চিঠি লেখা মুশকিল। কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবনার স্বাক্ষর থাকত তার চিঠিতে।

এক অনুরাগী পুত্রের জন্মের পর সত্যজিৎ রায়ের কাছে আবদার করে চিঠি লিখেছেন, পুত্রের নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। সত্যজিৎ নিজের হাতে লিখে সে চিঠিটির উত্তরে বললেন; মনোযোগ সহকারে মহাভারত পড়ুন, বহু নাম পাবেন। সত্যজিতের সময়কালে এপার বাংলায় অনেক বাঙালি সেলিব্রেটি ছিলেন, যারা সেকালের চল সাইক্লোস্টাইল কপিতে অনুরাগীদের উত্তর দিতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাজ করার জন্য তাদের ছিল বেতন করা কর্মী।

সত্যজিৎ কিন্তু সেভাবে কোনোদিনও চলেননি। নিজের হাতে সব সময় ভক্তদের চিঠির উত্তর দিতেন। বহু ক্ষেত্রে তার ভক্তরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইত। সাধারণত কাউকেই তিনি নিরাশ করতেন না। পাঁচ মিনিট হলেও অনুরাগীকে সময় দিতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরিচিত অনুরাগী এলেও সত্যজিতের পরিবারের পক্ষ থেকে চা বা মিষ্টি দিয়ে আগন্তুককে আপ্যায়িত করা হতো। তবে সত্যজিতের সময়ানুবর্তিতা ছিল দেখার মতো। সেই সঙ্গে স্মৃতিশক্তি।

যদি কাউকে সময় দিয়ে থাকেন অমুকটার সময়ে আসতে, ঠিক সেই সময়েই তিনি কিন্তু অপেক্ষা করতেন সেই আগন্তুকের জন্য। খুব বেশি সময় এদিক-ওদিক হয়ে গেলে বিরক্ত অনুভব করতেন। আবার একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে যদি কোনো অচেনা আগন্তুক আসতেন, খুশি হতেন। সেই আগন্তুক, যাকে তিনি কখনো দেখেননি কিন্তু আগে থেকে টেলিফোন বা অন্য কোনো মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নির্দিষ্ট হয়ে আছে। সেটি স্মরণ করে অতিথি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, কোথা থেকে এসেছেন ইত্যাদি ব্যাপারে অনায়াসে তিনি বলে দিয়ে, অতিথির কাছে প্রশ্ন করতেন বা উত্তর দিতেন -- এমনটাই ছিল সত্যজিৎ রায়ের স্মরণ শক্তি।

অন্নদাশঙ্কর রায় খুব বলতেন; প্রতিটি মুহূর্তকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটা শেখা উচিত মানিককে দেখে। অন্নদাশঙ্কর বলতেন; দেখবে মানিক একটা মুহূর্তও অপচয় করে না। হয় সে পড়ছে। নয় সে লিখছে। নয় সে ছবি আঁকছে। নয় সে তার ছবির সুর তৈরি করছে। কোনো না কোনো একটা কাজে সে সব সময় নিজেকে ব্যাবৃত্ত রাখে। সেই সঙ্গে যদি কোনো বাইরের মানুষ আসেন, সেই মানুষটির সঙ্গেও অনর্গল কথা বলে চলেছে। অন্নদাশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়ের মেধাশক্তির এই দিকটার প্রতিও বারবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

অপরপক্ষে সত্যজিৎ নিজে বলতেন; তোমরা মেশো মশাইকে (অন্নদাশঙ্কর) গুরুত্ব দাও। সেটা সমুচিত কাজ করো। কিন্তু মেশো মশাইকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই হয়তো যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার মাসিমার (লীলা রায়) প্রতি, সেটা তোমরা দাও না। মাসিমারও কিন্তু অবদান কম নয়। প্রসঙ্গত এখানে বলতে হয়, সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি – অশনি সংকেত থেকে গণশত্রু, প্রতিটি ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল কিন্তু লীলা রায়ের করা। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সেসব অনবদ্য সাবটাইটেল সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মকে বাংলা না জানা মানুষদের কাছে মেলে ধরবার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

সত্যজিৎ রায় অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অন্নদাশঙ্করকে। তার এবং লীলা রায়ের জন্মদিনে বহুবার এসেছেন অন্নদাশঙ্করের বাসায়। অন্নদাশঙ্কর যখন যোধপুর পার্কে থাকতেন, তখন এই আসাটা ছিল নিয়মিত। আশুতোষ চৌধুরী অ্যাভিনিউয়ে অন্নদাশঙ্কর চলে আসার পরে ও তাদের জন্মদিনে এসেছেন। পরে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিয়মিত অন্নদাশঙ্করের কাছে, তার বা লীলা রায়ের জন্মদিনে আর আসা সম্ভব হয়নি সত্যজিৎ রায়ে। তবে যতবার এসেছেন, প্রায় প্রতিবারই সস্ত্রীক এসেছেন।

সত্যজিৎ কি খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন? নিজেকে নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা একজন সাধারণ মানুষেরও যে ধরনের ব্যক্তি জীবন থাকে, তা থেকে কি তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন?

এমন ধারণা বহু মানুষের আছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে যাদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক জীবনশৈলীতে তরল ব্যাপার কিছু ছিল না। তার মানে এই নয় যে, তিনি রসিক ছিলেন না বা আত্মজনের কাছে নিজের গাম্ভীর্যের আবরণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

সত্যজিৎ যখন বাড়িতে থাকতেন অনেক সময় নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অসাধারণ শিস দিতেন। আর সে শিসের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের গানের সুর মেলে ধরা - সেটা বাংলা গানই হোক বা মুম্বাইয়ের বিনোদন জগতের কোনো ধরনের গানই হোক কিংবা পাশ্চাত্যের সুর, এই শিস দেওয়ার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ মুনশিয়ানা ছিল সত্যজিতের- এটা যারা তাকে খুব কাছ থেকে না দেখেছেন, তাদের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা ব্যাপার হিসেবেই থেকে গেছে।

স্নানের ঘরে ঢুকবার আগে বাথরুমের চৌকাঠ থেকে বা চৌকাঠ পার হয়ে চলে গিয়ে, সামনের একটা প্যাসেজে নিজের দুপাটি চটি খানিকটা ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে ছুড়ে দেওয়া ছিল সত্যজিতের একটা ভীষণ প্রিয় খেলা। যেমন তেমন করে ছুড়ে দিলে চলত না! যতক্ষণ না দুপাটি স্লিপার একদম পাশাপাশি থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বারবার তিনি গিয়ে সেই চটি পরে আবার বাথরুমে ঢুকে, চটিটা ছুড়তেন। এটা ছিল তার একটা ভীষণ মজার একটা খেলা।

আর এই ঘটনা যখন ঘটত তখন বুঝতে পারা যেত সত্যজিতের মন-মেজাজ খুব ফুরফুরে রয়েছে। শারদ উৎসবের পর থেকেই পাতলা ভাগলপুরী এন্ডির চাদর গায়ে দেওয়া ছিল সত্যজিতের খুব প্রিয় বিষয়। আর এই চাদর গায়ে দিয়ে নিজের কাজ করতে করতে, অর্থাৎ ছবি আঁকাই হোক, গল্প লেখাই হোক, স্ক্রিপ্ট লেখাই হোক- এই ধরনের তার বিশেষ পছন্দের কাজ করতে করতে, দাঁত দিয়ে সেই এন্ডির চাদরটাকে একটু একটু করে ছেঁড়া --এটা ছিল সত্যজিৎ রায়ের একটা বিশেষ রকমের মুদ্রা দোষ। এভাবে অল্প দিনেই একটা চাদর নষ্ট হয়ে যেত। তাই বড়বাজার থেকে বিজয়া রায়, তার জন্য একেবারে গাঁটরি ধরে এন্ডির চাদর কিনে আনতেন।

অমন পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ সত্যজিৎ রায়। তিনি কিন্তু যখন শিশুদের সঙ্গে মিশতেন, তখন তার এই ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্যের দিকটা কোথায় যেন হারিয়ে যেত। শিশু মনস্তত্ত্বের কতখানি গভীরে একজন মানুষ গেলে পরে এটা সম্ভব তা আমরা বুঝি তার শিশুতোষ লেখাগুলো পড়ে। এজন্যই হয়তো সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে শিশুতোষ রচনাগুলি সৃষ্টি করা যে সম্ভব হয়েছিল- সেগুলো খুব গভীরভাবে পড়লেই আমরা বুঝতে পারি।

কিন্তু যে কথাটা বারবার মনে হয়, একটি শিশুর সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে তার মনকে বোঝার যেভাবে চেষ্টা করতেন সত্যজিৎ- এমনটা বোধহয় তুলনা চলে তার আত্মীয়া লীলা মজুমদার বা অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। শিশু সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে শিশু মনস্তত্ত্বের যে অনুভূতিটাকে আত্মস্থ করতে হবে- এই বোধের অনুসরণের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ বেশ কিছুটা হাতে-কলমে প্রয়োগের ধারণাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই একজন শিশুর অভিভাবকরা যখন খানিকটা মর্যাদা সম্মান এবং ভয় থেকে তাদের মানিক দাকে একটু দূরে দূরে থেকে নিরীক্ষণ করছেন, তখনই তার সন্তানরা যে কি অবলীলায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাটা খুব শক্ত হয়ে যায়। শিশুদের কাছে তিনি ছিলেন এক পরম বন্ধু।

তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্প: কুষ্টিয়ার জমিদার

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম
তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্প: কুষ্টিয়ার জমিদার

পার্থিব বা বৈষয়িক অপ্রতুলতা সৃষ্টিশীল মানুষকে হীনম্মন্য করে তোলে না। তার সৃ‌ষ্টি দিয়েই তিনি অতিক্রম করেন সব অপ্রতুলতা। প্রতিষ্ঠান, অর্থ, রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকলেই কেউ সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সৃষ্টিশীলতা এক দৈব বা জৈব রসায়ন। তেমন একজন মানুষ এই সময়ের অন্যতম লেখক, গবেষক ড. মুহাম্মদ এমদাদ হাসনায়েন। তিনি এ কালের একজন অগ্রণী চিন্তক, গবেষক- বিনা তর্কেই এটা মেনে নেওয়া যায়। লেখকের জন্মস্থান কুষ্টিয়ায়। ফলতঃ তার গবেষণার বিষয়বস্তু কুষ্টিয়াকে কেন্দ্র করে। কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করা লেখকদের লেখা গ্রন্থের একটা সুষ্ঠু পরিচয় এ কালের পাঠকদের সামনে তুলে ধরা লেখকের অন্যতম উদ্দেশ্য। দশকের অধিককাল তার গবেষণা, ভাবনা-চিন্তা কুষ্টিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমী পাঠকদের কাছে অক্লান্তভাবে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

ক্রমশ দীন হতে থাকা ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষণাধর্মী সারস্বত জগৎ এখন মাত্র যে কয়েকজন লেখককে নিয়ে গর্ব করতে পারে, ড. মুহাম্মদ এমদাদ হাসনায়েন তাদের অন্যতম। আমি লেখকের অমূল্য সৃষ্টি ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গবেষণাধর্ম গ্রন্থটি অনেকদিন ধরে পড়ছি। কুষ্টিয়ার জমিদারদের গোড়াপত্তন, শাসন, নির্মাণশিল্প গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু। তৎকালীন কুষ্টিয়ার জমিদারদের ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি, জীবনের অগ্রগতি ও অবসান নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। এই গ্রন্থটি পড়া শুরু করার পর মনের মধ্যে জমে থাকা বেশ কিছু জটিল অঙ্কের সমাধান হয়ে গেছে। কেবল তাই নয়, একটা নতুন খিদের জন্ম দিয়েছে। খিদেটা তৎকালীন জমিদারদের শাসন, শিল্পকলা, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের একটা চিত্রের জোরালো আভাস পাওয়ার বাসনা। গ্রন্থটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ শেষে আমার সেই মনোবাসনা পূর্ণও হয়েছে।

গ্রন্থটি আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে তৎকালীন জমিদারদের স্থাপত্য শিল্পের লেখকের নিখুঁত বর্ণনা। লেখক তৎকালীন জমিদারদের বিলাসী জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে মিহি সুতিবস্ত্র, উৎকৃষ্ট রেশমবস্ত্র ও পণ্য, রত্নালঙ্কার, কারুকার্যখচিত তরবারি ও স্থানীয় নানা শিল্প ও কারুকলা এবং ক্ষুদ্রশিল্পকে সবিশেষ বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে কুষ্টিয়ার নামকরণ ও জমিদারি প্রথা আর দ্বিতীয় পর্বে তার বিস্তারিত বর্ণনা। জমিদারের জমিদারি প্রথার বর্ণনায় প্রত্যেক জমিদারের প্রাসাদ ও স্থাপত্যের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। লেখক গ্রন্থটিতে কুষ্টিয়ার তৎকালীন জমিদারদের গোড়াপত্তন, বিস্তার, পারিবারিক জীবন, শাসনপদ্ধতি, স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি সামাজিক এবং ধর্মীয় উৎসবপরবে কুষ্টিয়ার জমিদারদের ব্যয়বহুল সমাজে সম্পদের সঞ্চালনকেও কমবেশি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, কুষ্টিয়ার জমিদারদের দরবার ছিল নবাব দরবারের অনুকরণে নির্মিত, যা আগে পাঠকদের অন্য কোনো গবেষণাধর্মী গ্রন্থ থেকে জানার সুযোগ হয়নি। তাদের পোশাকপরিচ্ছদ, খানাপিনা, শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলা চর্চার কারণে তুর্কি-ফার্সি এবং দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সমম্বয়ের পথই প্রশস্ত হয়। গ্রন্থটির অন্যতম আকর্ষণ ‘জমিদার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ 

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে জমিদারি ক্রয় করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথের হাত ঘুরে নদীয়ার বিরাহিমপুর ও কালীগ্রামের জমিদারির দায়িত্ব পান ৭ মে ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান। প্রজাবৎসল জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের দরবারে এসে যখন দেখেন মুসলমানরা মাটিতে আর হিন্দুরা আসন পেতে বসা, তখন তিনি বলেন, যেখানে এমন বৈষম্য ব্যবস্থা সেই দরবারে তিনি যোগ দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারি।’ 

গ্রন্থটিতে লেখক মানবিক শিল্পমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে তুলে এনেছেন। কুষ্টিয়ার প্রতিটি জমিদারের জমিদারি শাসনব্যবস্থা ও শিল্পগুণের অসংখ্য বর্ণনায় ঠাসা লেখকের ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গ্রন্থটি।

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আউল-বাউল মিলে কুষ্টিয়ার রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। ‘কুষ্টিয়ার জমিদার’ গ্রন্থে সব বিষয়ের বর্ণনা যেন ক‍্যানভাসে আঁকা ছবি। গবেষণা গ্রন্থের ভাষাশৈলী খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থটির ভাষাশৈলী তৎকালীন সময়ের সঙ্গে অত‍্যন্ত সাযুজ‍্যপূর্ণ। বিভিন্ন বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনায় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ত্রিমাত্রিক দৃশ‍্যপট রচিত হয়েছে। একটি গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে হয়তো শতভাগ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি কিন্তু জমিদার আমলের কুষ্টিয়ার প্রাচীন পথ, জনসমাজ, স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষা, পুথিসাহিত্য, গ্রামীণ উৎসব এবং প্রত্নকীর্তি- সব মিলিয়ে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আকর।

নিঃশব্দ কান্না

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৮ পিএম
নিঃশব্দ কান্না
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

সেদিন ছিল ঈদের দিন। ভাড়াটিয়ারা অনেকেই ছানাপোনাসহ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গেছে। বাড়িটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আমার নিঃসন্তান হৃদয়ে এই শূন্যতা মুহুর্মুহু আহাজারিতে গুমরে মরছে। কেননা, আমি মানুষটা কোলাহলের, নিরালার নই। তবে ঈদ-আনন্দ গ্রামে উপভোগ করতে চাই আমিও। কিন্তু আমার যে সন্তান হচ্ছে না। এই না হওয়ার হাজারো অপবাদ আর অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি বড্ড ক্লান্ত।    

ভেজা চুল ঝেড়েমুছে তোয়ালেটা নিয়ে মাত্র বের হলাম। হঠাৎ আমার ভাড়াটিয়া সুমির মা এসে বলল- ‘আফা, সকাল থাইকা পিচ্চিটা আফনেগো গেটের ভেতরে খাড়ায়ে রইছে। তা-ই লইয়া আইলাম।’ ছেলেটির বয়স বড়জোড় আড়াই-তিন বছর হবে হয়তো। গায়ের রং কালো। পরনে লাল প্রিন্টের শার্ট-প্যান্ট। মুখমণ্ডল গোলাকার। ফোলাফোলা টোলপড়া গালে শ্লেষ্মার আঁটলি। মায়ামায়া চোখযুগল। আমি আদর করে কোলে নিলাম। সে তার চোখের গোল কর্নিয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। নাম জানতে চাইলাম। কিছুই বলে না। সম্ভবত স্বল্পবাক। ওর টোপাটোপা গালে শ্লেষ্মা-আঁটলি দেখে আমার স্বামী বলল- দেখছ কী? ওরে গায়-গোসল করিয়ে আগে খেতে দাও। পরে খোঁজ-খবর নিয়ে না হয় একটা বিহিত-ব্যবস্থা করব। 

গোসল করিয়ে সাজুগুজু করালাম। বাহ! এখন খুব সুন্দর লাগছে। খাওয়ালাম। শান্ত সুবোধ শিশুটি সুন্দর করে খেল। ওমা! দেখি, খাবার মুখে নিয়েই ও ঘুমে ঢলে পড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে শোয়ালাম। ও আরামসে ঘুমিয়ে গেল। কোনো কান্নাকাটি নেই। অস্থিরতা নেই। নেই মনস্তাপ। শান্ত, নিটোল শিশুটির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। আহা রে, না জানি পাগলপ্রায় মা-বাবা হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। ঈদের দিনেও বুকচাপড়ে কাঁদছে। এদিকে অবোধ মানিকসোনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তার পর মাইকিং করাব। অনেকক্ষণ পর মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ওর মাথায় হাত রাখি। আমার আলতো স্পর্শেই ও জেগে উঠল। ওয়াশরুমে নিয়ে ওকে প্রসাব করলাম। ভুনাখিচুড়ি আর কলিজাভুনা দিয়ে ওকে খাওয়ালাম।      

প্রাক-সন্ধ্যার আলো-আঁধারী। সন্ধ্যারাগের সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠল! ভাবছি, এখন অবধি কোনো খবর হলো না। অমনি  হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল তিন-চারজন। এসেই বাচ্চাটির মায় খাট থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। ওকে নাকে-মুখে, গাল-ঠোঁটে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল। বুকে ঠেসে ধরে জড়িয়ে কেঁদে দিল। আহা রে! হারানো সন্তানপ্রাপ্তির এক মায়ের সন্তান বাৎসল্যের আকুতির গভীরতা কতটা স্পর্শকাতর! আরও অনুভব করছি, বাঙালি মায়েদের মাতৃত্বের ভাণ্ডার বুঝি এমনই বিশ্বজনীন স্নেহ-মায়া-মমতায় ভরপুর থাকে। 

তাছাড়া, বাচ্চাটির মুখাবয়বের উজ্জ্বলতায়ও বলে দিচ্ছে সেও মনে মনে আনন্দিত। ওর কাজলদিঘি চোখ এখন প্রাপ্তির পূর্ণতায় উদ্ভাসিত। ওরা যেমন আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকল তেমনি আকস্মিকভাবেই-না ছোঁ মেরে ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিথি! অথচ রেখে গেল স্মৃতির ক্যানভাস-জমিনে মায়াময় স্মৃতি! আমার অবচেতন মনে কখন জানি ওর প্রতি মাতৃত্ব জেগে উঠেছে জানি না। তাই কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ ছিলাম। যাওয়ার সময় ওরা অবশ্য বলেছে, ‘আফনেগো মাঝমধ্যিখানে আইয়া দেখাইয়া নিয়া যামু।’

জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। হঠাৎ একটি ফুটফুটে ছয়- সাত বছরের মেয়ে এল। বলল- আফা, আমি আফনেগো স্কুলে পড়ি। আমরা গরিব। বাবায় কয়, খোরাকির টাকাই জোগাইতে পারি না। পড়ামু কেমনে? তাই আমি আফনেগো কাম করমু আর পড়মু। অনাহারশীর্ণ মেয়েটির কথা আমার অন্তর্মূলকে বিদ্ধ করল। এই বয়সে মেয়েটির কষ্টের অনুভূতির অনুধাবন ক্ষমতা এতটা সংবেদনশীল? আমি বিস্ময়াভিভূত!  

মেয়েটিকে বললাম, আগামীকাল জানাব। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলাম।  আসার পথে মেয়েটির বাড়িওয়ালার বাড়িতে গেলাম। একজন বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আফা, ওর বাবা বছরব্যারামি। কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। সংসারের পোষ বেশি। ঘরে খাওন নাই। কষ্টে আছে। মাইয়াডারে আফনে নিয়া নেন আফা। এই কথা শুনে ওই দিনই ওকে নিয়ে নিলাম।

ওর নাম মাসুমা। সুন্দরী ও সুশ্রী। দুধে-আলতা গায়ের রং। ডাগর-ডাগর চোখের ভ্রুগুলো যেন চিরুনিটানা। ওর গোলাকৃতি মুখের হাসিটাও সুন্দর। আপেলরাঙা ভরাটগাল। দাঁতগুলো ঝকঝকে। জীর্ণবস্ত্র, শীর্ণকায় শরীরটা যেন ধনুকের মতো বেঁকে আছে। পেট চুপসে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে। আমি তড়িঘড়ি ঘরে গিয়ে ওকে খেতে দিলাম। ক্ষুধার্ত মেয়েটির খাওয়ার আকুলতা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।

সেই থেকে মাসুমা আমার কাছেই আছে। ও এখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। 

বছর দুয়েক পর। আমি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সেই সুমির মা-ই এসে  বলল, আফা, পিচ্চিটা সহাল থাইকা  ঘুরঘুর করছে। এর লাইগা লইয়া আইলাম। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আমার সঙ্গে এমনটি কেন ঘটছে?  

মাসুমাকে বললাম, ওকে রুটি-হালুয়া খাওয়াতে। রুটি হাতে নিয়ে ও সুমির সঙ্গে ওদের ঘরে গেল। দেখলাম, ও একটি চেয়ারে বসে পা ঝোলাচ্ছে আর খাচ্ছে। ওর সঙ্গে সুমিও। ওরা হাসছে, খেলছে। তাই আমি নিশ্চিন্তে স্কুলে গেলাম। 

ফার্স্ট শিফট ছুটি। হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে একটু বাসায় গেলাম। ইতোমধ্যে আমার স্বামী এক ডজন সাগর কলা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি শুয়ে কলা খাচ্ছে। আমি আরেকটি কলা দিলাম। কলা পেয়ে ওর সেকি আনন্দ! ও আমার স্বামীকে বলছে, ‘তুই আমার লাইগা এত্তগুলান কলা আনছস!’ এই বলে আমার স্বামীর শরীরের ওপর দিয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমরা ওর মা-বাবা। তুই-তোকারি সম্বোধনে বুঝলাম, ও মা-বাপের বড্ড আদুরে মেয়ে। 

ওর দায়িত্ব সুমির মায়ের ওপর দিয়ে আমি মাসুমাকে নিয়ে স্কুলে এলাম। এরেই মধ্যে কয়েকটা মসজিদ থেকে মেয়েটির সম্পর্কে ঘোষণা করানো হয়েছে। ভাবছি, বিকেলে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করব। দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আবারও বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সুমির মা গোসল করিয়ে  মুখে পাউডার, চোখে কাজল দিয়েছে। ওর ফ্রকটা ধুয়ে সুমির ফ্রক পরিয়েছে। ভাত খাইয়েছে। শুনলাম- সুমির মা ওকে পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাতে পাকুতি বুড়ি বলে- আমার মা আমারে পাছায় জোরেজোরে থাপ্পড় দিত। তুমিও এমনি কইরা দেও। তাইলে আমি ঘুমামু। তা শুনে আমিও হেসে লুটোপুটি। স্কুলে এসে কাজে মন দিলাম। 
স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। আমরাও বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে একজন মহিলা কান্নাকাটি করতে করতে স্কুলে ঢুকেছে। এসেই বলছে-  আমাগো মাইডারে নাকি এই স্কুলের আপার বাসায় আছে। আমি এগিয়ে এসে বললাম, হ্যাঁ।  তিনি জানালেন, ওর মা ভোরে হাসপাতালে গেছে। যাওয়ার সময় ও যাইতে চাইছিল। ওর মা কাঁন্দাইয়া থুইয়া গেছে। কোন ফাঁকে ও  ফ্রক হাতে লইয়া বাইর হইয়া গেছে। আমরা টেরই পাইনি।

সব শুনে হেডস্যার বলছেন, আপা, সুমির মাকে বলেন, মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে আসতে। এখান থেকেই ওকে অভিভাকের হাতে তুলে দেব। খবর পেয়েই সুমির মা নিয়ে এল ওকে। ওর গায়ে ধোয়া ফ্রক-প্যান্ট। মুখে স্নো-পাউডার। কপালে কাজলের টিপ। আঁচড়ানো পরিপাটি চুল। বেশ ফুটফুটে লাগছে। ওমা! আপারা সবাই এর কোল থেকে ওর কোলে নিচ্ছে। ও যাচ্ছে নিঃসংকোচে। 

হেডস্যার বললেন, ওর বাবা কিংবা মা একজনকে আসতে হবে। কিছুক্ষণ পরই ওর বাবা আরও একজন মুরুব্বি কিছিমের লোক নিয়ে সরাসরি এলেন। ও তখন ওর জেঠিমার কোলে। ওর বাবাকে দেখেই বলে, এত্তক্ষণে তর মনে অইল আমার কতা? অভিমানী মেয়েটি এই বলে কেঁদে ফেলে। বুঝলাম, শিশুর মনেও অভিমানের দহন থাকে। পাকুতি বুড়ির পাকানো কথা শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তার পর স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ওর বাবার কোলে মেয়েটিকে তুলে দিলাম। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সবাইকে মায়াময় ভালোবাসায় জড়ায়ে গেল। আমার মাতৃ হৃদয়েও একটা শূন্যতার ঝোড়ো হাওয়ায় তোলপাড় করছে। ভেতর থেকে অবদমিত কান্না ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি। ওরা বলেছিল, মাঝেমধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসবে ওকে। কিন্তু কেউ-ই কথা রাখেনি। না আসুক, তাতে কী? বাচ্চা দুটোর মা-বাবার কাছে ওদের তুলে দিতে পেরেছি, এতেই আমার শান্তি। একজন গেল নীরব ভালোবাসায় জড়ায়ে। আরেকজন গেল সরব ভালোবাসায় কাঁদায়ে। এই কান্না একান্তই আমার। নিঃসন্তান হৃদয়ে অন্তর্নিহিত অস্তিত্বে গুমড়ে ওঠা অদৃশ্যমান এক নিঃশব্দ কান্না!  

এরই মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে চাষাঢ়া রেললাইন ধরে হাঁটছি। মাসুমা আমাদের রেখে আগেভাগে যাচ্ছে। আমরা পেছন থেকে ডাকছি। ও হাত নেড়ে শুধু আগাচ্ছে। একসময় মাসুমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমন তো সবসময়ই করে। আগে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয়। আমরা এটাই ভাবছি। কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখি মাসুমা যায়নি। তা শুনে আমার মাথায় চক্কর খেল! আমি হতবিহ্বল! তার পর খোঁজাখুঁজি আর  কান্নাকাটি! আমার বুকটায় যেন হাতুড়িপেটানোর মতো ধাপুস-ধুপুস শব্দ হচ্ছে। অজানা আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপছে। ভয়ে-ভয়ে ওর মাকে ফোনে খোলাসা করে ঘটনাটা বলি। ওর মা বিশ্বাস করছে না। বলে, কত মানুষ গুম কইরা রাইখ্যা মিছা কতা কয়। ধানাইপানাই থুইয়া, ঠিকানা দেন তাড়াতাড়ি। এত সহজে ছাড়মু না। ওর কথার ধার শুনে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিলাম। মায়ের মন তো, এমনটি বলা স্বাভাবিক। রাগ করলাম না। এতক্ষণ মসজিদে মাইকিং করেও কোনো খোঁজ পাইনি।

তাই গেলাম ফতুল্লা থানায় জিডি করতে। ওসি সাহেব বললেন, ঘণ্টাখানেক বসেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, ও আবার ঠিকানাও জানে। এরই মধ্যে হয়তো খবর পেতে পারেন। আমি পাগলের মতো ঘড়ি দেখছি। ভাবছি, না পাওয়া গেলে কী হবে আমাদের? এত সুন্দরী, গায়-গতরে ডাঙ্গর-ডোঙ্গর। খারাপ ছেলেদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে। তাহলে তো আমি ফেঁসে যাব। এই ভয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি। আল্লাহকে শুধুই ডাকছি। গলা, জিহ্বা ও ঠোঁট শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে। আমি তো ওকে ফুলের টবে রাখা গাছের মতো করে বড় করেছি। ওর কোনো চাহিদা আমি অপূর্ণ রাখিনি। পোশাক-আশাক দেখে সবাই বলত আমাদের মেয়ে। আমরাও তা-ই বলেছি। এসব মনে করে এখন কপাল চাপড়াচ্ছি।

হঠাৎ মোবাইলে রিং হলো। সুমির মা মোবাইলে জানাচ্ছে, আফা মাসুমাকে দুজন বেডায়  নিয়া আইছে। আফনেরা তাড়াতাড়ি আইয়েন। হে আল্লাহ! সত্যি সত্যিই তুমি আছ গো আল্লাহ! আমার ডাক কবুল করেছ। আমার ধরে যেন প্রাণ ফিরে এল।   
ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনাদের ভাগ্য ভালো। এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।’ আসতে আসতে বুঝলাম, যে নারী জন্ম দেয় সে মাতা। 
কিন্তু মাতৃত্ব আসে হৃদয় থেকে। সন্তান জন্ম না দিয়ে, মাতা না হয়েও মাতৃত্ব আসতে পারে। এটা কিছুটা হৃদয়ঘটিত, কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।  

সন্তানহীনা মায়েরা অষ্টপ্রহর কষ্টের দ্যোতনা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। তাদের মুখাবয়বে একটা বিষণ্নতার অমোচনীয় কালোছায়ার আবরণ থাকে চিরদিন। তবুও মিছে মায়ায় বাসায় এসে মাসুমাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ-মমতা উজার করে চমু খাই। আনন্দে কেঁদে ফেলি। যে মাসুমাকে নিয়ে এসেছে ও রেলওয়েতে মাস্টাররোলে চাকরি করছে। বয়স সম্ভবত ৩৫-৩৬। কথাবার্তায় বুঝলাম, লেখাপড়া কিছু জানে। আমি বললাম, তুমি আজ আমার মেয়েটির মানসম্মান, ইজ্জত রক্ষা করেছ। কী চাও ভাই তুমি? লোকটি বলল, ভাইবোনের মধ্যে লেনদেন কেন আপা? ও তো আমার মেয়ের মতো মনে করেই নিয়ে এলাম। কেননা, সমাজে হারানো, চুরি-যাওয়া, পাচার হওয়া ছেলেদের ঘরে তোলে। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই তোলে না। কারণ, সমাজের চর্মচক্ষুতে তারা অচ্ছ্যুত। এ জন্য আজই মুরুব্বিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনে মনে বলছি, এত ছোট চাকরি করা একজন গরিব মানুষ! তার মুখে এত মূল্যবান কথা! তা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে। সে চিত্তে বিত্তবান একজন মহতী মনের মানুষ। ওর যা আছে এ দেশের অধিকাংশ কোটিপতিরও তা নেই। মন থেকে তাকে শুধু সহস্রবার স্যালুট জানালাম! 

মাতৃস্নেহের সবটুক সুধা ঢেলে মাসুমাকে বড় করেছি। হয় তো ওকেও ওর অভিভাবক নিয়ে যাবে। তবুও আমি বহুত খুশি। এর আগে আমি আরও দুজন হারানো বাচ্চাকে তাদের অভিভাবকদের কাছে সযত্নে তুলে দিয়েছিলাম। বিধাতা মাসুমাক ফিরে দিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। মাসুমা চলে গেলে আমি সারা জীবন মনোকষ্টে ভুগবো সত্যি। তখন না হয় ‘নিঃশব্দ কান্না’ই হবে আমার নিঃসন্তান জীবনের অনুষঙ্গী।

ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেট

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২২ পিএম
ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেট

অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যবাহী শিল্প-পর্যটন-শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে সিলেট মহানগর। ঐতিহাসিক ও সাস্কৃতিক শহর সিলেটের ওপর গবেষণামূলক প্রকাশনা খুবই সীমিত। মূলত সিলেট মহানগরের ওপর গবেষণা প্রকাশনার এই অপূর্ণতা দূর করতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বহুশাস্ত্রীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্মানিক সভাপতি প্রবীণ ভূগোলবিদ, নগরবিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং তার প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা শীর্ষক গবেষণা সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গ্রন্থটিতে ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেট মহানগরের প্রাকৃতিক ও মানবিক বিষয়াবলির ওপর সময়োপযোগী গবেষণা নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে। সিলেট মহানগরের (সিলেট সিটি করপোরেশনভুক্ত সমগ্র প্রশাসনিক এলাকা) ভৌত পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা, মানবস্বাস্থ্য, দূষণ ও ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ও জনদুর্ভোগ ইত্যাদি বিষয়াবলির ওপর মাঠপর্যায়ের পর্যালোচনাভিত্তিক উচ্চমানসম্মত সমসাময়িক ১৮টি ভৌগোলিক গবেষণা প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ/পরিবেশবিদ্যা বিভাগ-এর বিদগ্ধ শিক্ষকদের মতামত ও পরিমার্জন প্রবন্ধগুলোকে আরও পরিশীলিত করেছে।

গ্রন্থটিতে সিলেট মহানগরে পরিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বন্যা, ভূমিকম্প, পানিনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মাজার-কর্মকাণ্ড, মণিপুরী কুটির শিল্পকেন্দ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা, মাতৃস্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, পর্যটন এবং নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। 

গ্রন্থটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রমথেশ দাস পুলক। অত্যন্ত সূচারুভাবে মুদ্রিত সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা সংকলন গ্রন্থটি শহরের টেকসই উন্নয়নে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের উপকৃত করবে এবং আগ্রহী পাঠকদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে সমর্থ্য হবে বলে মনে করি।

‘সিলেট মহানগর: ভৌগোলিক সমীক্ষা’, সম্পাদনায় ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ড. অলোক পাল, প্রকাশক নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা ও চন্দ্রাবতী একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ২০২৫, পৃষ্ঠা ৩৬০, হার্ড কভার, মূল্য: ৮০০ টাকা।

পূর্বাচল

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
পূর্বাচল
এইখানে একদিন আদিবাসী মানুষের
নিবিড় বসতি ছিল,
নাড়ীর শেকড় পোঁতা সহস্র বছর মৃত্তিকা গভীরে!
 
নগরসভ্যতা হবে: তিলোত্তমা, আলো ঝলমল!
এমনিতর আকাঙ্ক্ষার বলি প্রদোষী স্বজন আজ-
শুকনো খড়ের মতো ভাসে চৈতি হাওয়ায়!
 
এইখানে একদিন ঘুঘু ডাকা গ্রাম ছিল;
এইখানে একদিন জোনাকির আলো ছিল-
রঙে ঝিলমিল!
এইখানে একদিন সিংহকেশী কাঁশফুল ছিল-
           দুরন্ত নিবিড়!
এইখানে একদিন বাঁশের বাঁশিতে সুর ছিল-
   ছিল মাঝিকণ্ঠে গান!
এইখানে একদিন সুলতানি মানুষ ছিল-
         তামাটে কঠিন!
মেঠোপথে নগ্নপদী রূপসীর কলহাস্যধ্বনি!
 
এইখানে একদিন অরণ্যবিনাশী সভ্যতা দাঁড়াবে-
                  শির উঁচু করা,
        অর্ধসভ্য মানুষের গুঢ় প্রয়োজনে!