গত সংখ্যার পর
আমাদের হাসপাতালের ওয়ার্ডের পর ওয়ার্ডে ভিড় করে ছিল পূর্ববঙ্গের শিশু, বৃদ্ধ, জোয়ান; নারী ও পুরুষ। এরা কেউ গুলিতে কেউ বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে; গৃহবধূ ও বালিকারা বেশির ভাগ এসেছিল দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়ে। গাইনোকোলজি বিভাগ ভরে ওঠে ওপারের রোগীতে। রাজ্যের সবগুলো হাসপাতাল, ডিসপেনসারি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্মুক্ত করা হয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
মোটকথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্যের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার ক্ষত নিয়ে প্রায় প্রতিদিন ঢুকতে থাকে মানুষ ত্রিপুরায়। কেউ থাকে রিফিউজি ক্যাম্পে, কেউ রাস্তাঘাটে, কেউবা পাহাড়ে-জঙ্গলে। রাজ্যের সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যখনই কলকাতা থেকে ত্রিপুরা আসেন তখনই তারা হাসপাতালে গেছেন, আহতদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ডাক্তার-নার্সদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
এই দুর্বিপাকের মধ্যে বর্ডারের ওপার থেকে আবার মর্টার শেল এসে ফাটতে থাকে। বহু ভারতীয় গায়ে গুলি ও বোমার স্প্লিন্টার নিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালে। ভয়ে স্থানীয়রা নিজেদের ঘরবাড়ির জানালার কাচে কাগজ এটে দেয়। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে খাটের নিচে শুয়ে থাকে। কয়েক সপ্তাহেই যুদ্ধ ভয়ংকর রূপ নেয়। হাজার হাজার মানুষ বর্ডার পাড়ি দিতে থাকে প্রাণ বাঁচাতে। কেউ আসে পায়ে হেঁটে, জঙ্গল পেরিয়ে, জলকাদা পেরিয়ে। কেউ না খেয়ে অসুস্থ হয়ে, কেউ দূষিত জল ও খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে, কেউ আহত হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায়। কেউ ‘স্ট্রেচার’-এ করে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে। এরা হাসপাতালে ভর্তি হয়। মহকুমা হাসপাতালগুলোতেও তখন অগণিত মানুষ। অনেকের ডিসেন্ট্রি, ডায়রিয়া, চিকেন পক্স। চিকিৎসরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাঁপিয়ে ওঠেন হাসপাতালের নার্স এবং স্টাফরা। গঠন করা হয় মেডিকেল টিম। এরও প্রধান ডা. রথীন্দ্র দত্ত। অন্য সদস্যরা ছিলেন ডা. এইচ এস রায়চৌধুরী, ডা. বিকাশ ভট্টাচার্য, ডা. বিভাস পাল চৌধুরী, ডা. জে এল রায় ও ডা. অলোকা ভৌমিক। এবং সঙ্গে থাকেন ডা. ইলা লোধ।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও একই রকম। নিজেদের প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে অসংখ্য মানবদরদি চিকিৎসক এগিয়ে আসেন। আসেন কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। ডা. মেজর দত্ত, ডা. খগেশ নন্দী, ডা. দ্বিগেন ব্যানার্জি- এরা রাতদিন সেবা দিয়ে চললেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ত্রিপুরায় প্রবেশ করা কিছু চিকিৎসও এরই মধ্যে দলে যোগ দিলেন। সবাই মিলে আহত, অসুস্থদের চিকিৎসাসেবার জন্য গড়ে তুললেন ল ‘সার্জিক্যাল অপারেশন’ টিম, গড়ে তোলা হলো ‘সার্জিক্যাল বোর্ড’। ডা. রথীন দত্তের নেতত্বে এদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই হাজার হাজার শরণার্থী ও স্বাধীনতা যোদ্ধার জীবন রক্ষা পেয়েছে। জীবনরক্ষা পেয়েছে অগণিত পূর্ব বাংলাবাসীর, আসন্ন প্রসবা মা-জননীদের। শুধু বাংলাভাষী নয়, ত্রিপুরার পাহাড়-কন্দরের অধিবাসীরাও তাদের বাড়িঘরে সাদরে আশ্রয় দেন বিপন্ন শরণার্থীদের। পুরো নয় মাস ত্রিপুরা হয়ে ওঠে মহামানবের মিলনক্ষেত্র। আত্মিক সেই মেলবন্ধনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে সাহায্য জোগায়, প্রেরণা ও সাহস জোগায়।
এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে লন্ডন থেকে ত্রিপুরায় আসেন ডা. এম এ মুবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেনাবাহিনীর ডাক্তার মেজর আখতার আহমদও এসে পৌঁছলেন ত্রিপুরায়। এরা সবাই মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হাসপাতাল গড়ে তুলবেন- সিদ্ধান্ত নিলেন এ রকম। কিন্তু রাজ্য ও ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অতএব, তারা সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের শরণাপন্ন হলেন। মেজর খালেদ প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেন, সবাইকে নিয়ে পৌঁছলেন জিবি হাসপাতালের সার্জন রথীন দত্তের কাছে।
প্রস্তাব শুনেই ডা. দত্ত সানন্দে সম্মতি দিলেন। সরকারি সম্মতিও মিলল তারই জোর সুপারিশে। ফলে বিশ্রামগঞ্জের হাবুল ব্যানার্জির লিচু বাগানে বাংলাদেশ হাসপাতাল নামে সব চাইতে বড় ফিল্ড হাসপাতালটি গড়ে উঠল। মাত্র ২৫ আসন দিয়ে শুরু হলেও দ্রুত ৪৮০ জনের জন্য সম্প্রসারিত করা হলো। এর ফলে ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ কিছুটা হলেও কমল। এই ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরা বেশির ভাগ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া পূর্ব পাকিস্তানের মেডিকেল ছাত্র। কবি বেগম সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামালের মতো বেশ কয়েকজন নারীও সেবিকার কাজে যোগ দিলেন- আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেবেন বলে।
রথীন দত্ত দিনের বেশির ভাগ সময় নিজের হাসপাতালে কাটান। সার্জারিতে অংশ নেন, রোগী দেখেন এবং হাসপাতাল তদারকি করেন। বড় সার্জারির দরকার হলে বিশ্রামগ্রঞ্জের ফিল্ড হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে তার ডাক পড়ে। তিনি শ্রম দেন বটে কিন্তু শান্তি লাভ করেন।
কুমিল্লার ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাস কয়েক আগে দুজন তরুণ বাঙালি সেনা অফিসার বড় ধরনের জখম নিয়ে জিবি হাসপাতালে আসেন। প্রাণান্ত চেষ্টা চলে ওদের সরিয়ে তোলার। কয়েক সপ্তাহে ওরা সেরেও ওঠেন। ঢাকায় ২৫ মার্চের আর্মি ক্র্যাকডাউনের একদিন পর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিকভাবে ময়নামতীর বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেয়, অস্ত্র জমার পর সমস্ত বাঙলি সৈন্যদের আটক করা হয়। এরপর নির্বিচারে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় বেশির ভাগকে- রক্তাক্ত দেহগুলো মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়! এই দুজন তরুণ অফিসার কোনোভাবে জীবন নিয়ে মৃত্যুর ভাগার থেকে বেঁচে যান। বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে থেকে প্রাণান্ত চেষ্টায় তারা বর্ডারের কাছে পৌঁছেন। বিএসএফ সদস্যরা এরপর তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন। সুস্থ হওয়ার পর ওরা দুজন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
চলবে...