ঢাকা ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

শরীর কাব্য

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৮ পিএম
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫ পিএম
শরীর কাব্য
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

প্রেম কর? 
প্রশ্নটা শুনেই হকচকিয়ে গেল সুবর্ণা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, জি না। 
আজহার মাহমুদ অবাক কণ্ঠে বললেন, সত্যি তুমি প্রেম কর না?
সুবর্ণা আবার একই কথা বলল, জি না। 
আজহার মাহমুদ জোর দিয়ে বললেন, তুমি মিথ্যা বলতেছ কেন? তোমার শরীর দেখে মনে হচ্ছে তুমি প্রেম কর। 

সুবর্ণা এবার আরও বিব্রত হলো। কোনো নারীর শরীর দেখে কি বোঝার উপায় আছে, সে প্রেম করে কি করে না। আজহার মাহমুদ তো দেখি মানুষ হিসেবে সুবিধার না। লুচ্চা টাইপের মানুষ। তিনি কি সুবর্ণার শরীর স্ক্যান করতে শুরু করেছেন। সুবর্ণার শরীরে কোনো কাপড় নেই। সুবর্ণা উলঙ্গ... ছি ছি, এসব কী ভাবছে সুবর্ণা। 

তার মনে হলো আজহার মাহমুদ লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে সুবর্ণার বুকের দিকে লম্পটের মতো তাকিয়ে আছেন। 
আজহার মাহমুদ মৃদু হেসে বললেন, তুমি এখন কী ভাবতেছ বলব? 
সুবর্ণা হ্যাঁ না কিছুই বলল না। 
আজহার মাহমুদ বললেন, আমাকে তুমি লুচ্চা টাইপের মানুষ ভাবতেছ। মনে মনে আমার ওপর অনেক রুষ্ট তুমি। কথা সত্যি কিনা বল। 
হ্যাঁ। মাথা নাড়ল সুবর্ণা। 

আজহার মাহমুদ খুশি হয়ে বললেন, তোমার সাহস দেখে আমি মুগ্ধ। এবার আসল কথাটা বলি। আমি কীভাবে বুঝলাম তুমি প্রেম কর? শুনবে?
সুবর্ণা কোনো কথা বলল না। তবে আজহার মাহমুদের প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে গেল। একটা মেয়ে প্রেম করে কি করে না, সেটা কি তার শরীর দেখে বলে দেওয়া সম্ভব? 

আজহার মাহমুদ বললেন- শোনো সুবর্ণা, তোমাকে একটা কথা বলি। প্রেম করতে গিয়ে মেয়েরা প্রথম যে ভুলটা করে, প্রেমিকের কাছে শরীর বিলিয়ে দেয়। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হলেই প্রেমিক যে কাজটা করে, ছলে বলে কৌশলে প্রেমিকার স্তনে হাত দেওয়ার সুযোগ খোঁজে। দলাই মতলাই করে। এভাবেই তার সর্বনাশ শুরু হয়। বিয়ের আগেই স্তন ঝুলে যায়। তোমাকে সর্বনাশের একটা গল্প বলি। আমার এক পরিচিত লোক, বাসর রাতেই বউয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করে। কথায় আছে বিড়াল প্রথম রাতেই মারতে হয়। এখানে বিড়াল নামটা কেন ইউজ করলাম নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেছ? তো বিড়াল মারতে যাবে। স্ত্রী তার শরীর থেকে শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা খুলে ফেলেছে। হঠাৎ স্বামী চিৎকার দিয়ে উঠল। কী সর্বনাশ। অ্যাই তোমার ‘দুধ’ এমনে ঝ্যালঝ্যালা কেন?

স্ত্রী ‘দুধ’ শব্দটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। তাই অবাক হয়ে জানতে চাইল- ‘দুধ’ মানে কী? 
‘দুধ’ মানে বুঝ নাই? দুধ মানে স্তন। তোমার স্তন এত ঝ্যালঝ্যালা কেন? নিশ্চয়ই কোনো পুরুষের হাত পড়েছে। অ্যাই তুমি কি কারও সঙ্গে প্রেম করতা? সত্য কথা বল। সত্য কথা বললে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এই পর্যন্ত বলে সুবর্ণার দিকে তাকালেন আজহার মাহমুদ। ধারণা করে বল, ওদের বিয়েটা কী শেষ পর্যন্ত টিকেছিল? 

আজহার মাহমুদের কথা শুনে লজ্জা, অপমানে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সুবর্ণা। প্রথম সাক্ষাতে কোনো পুরুষ কি একজন নারীর 
সামনে এভাবে যৌনতা নিয়ে কথা বলে? নিশ্চয়ই এই লোকের মানসিক সমস্যা আছে। 
আজহার মাহমুদ আবার একই প্রশ্ন করলেন- তোমার কী ধারণা, ওদের বিয়েটা টিকেছিল? 
সুবর্ণা হ্যাঁ না কিছুই বলল না।
 
আজহার মাহমুদ মৃদু হেসে বলললেন, ওদের বিয়েটা টিকেছে। ওরা এখনো সুখে-শান্তিতে সংসার করছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে বিশ্বাসের কারণে। সেদিন বাসর রাতে জীবনের সব কিছু খুলে বলেছিল স্ত্রী। এক তরুণের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দেখা হলেই স্তনে হাত দিতে চাইত। সুবর্ণা মাইন্ড কর না। আমার ধারণা তোমার কেসটাও একই রকম। তোমার প্রেমিক তোমার স্তনের প্রতিই বেশি অনুরক্ত। দেখা হলেই স্তন ধরে ঝুলে পড়তে চায়। 

লজ্জা, অপমানে সুবর্ণার দুই কান রীতিমতো গরম হয়ে উঠেছে। না, এই লোকের সামনে আর একদণ্ডও বসে থাকা ঠিক হবে না। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুবর্ণা। সিদ্ধান্ত নিল এই অফিসে সে কাজ করবে না। অসম্ভব। আজহার মাহমুদের মতো লুচ্চাটাইপের মানুষের সঙ্গে একই অফিসে কাজ করা ঠিক হবে না। আজহার মাহমুদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হন হন করে তার রুম থেকে বেরিয়ে গেল সুবর্ণা। 

বাসায় ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সুবর্ণা। সুবর্ণার মা মিসেস সুরাইয়া মেয়ের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দুপুরের খাবার খেতে খেতে সুবর্ণার চাকরির প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা শুনবেন এমনটাই পরিকল্পনা ছিল সুরাইয়ার। কিন্তু সুবর্ণা এভাবে হন হন করে নিজের ঘরে ঢুকল কেন? অফিসে কি কিছু হয়েছে। কেউ কি তাকে অপমান করেছে? দরজায় টোকা দিলেন সুরাইয়া- সুবর্ণা? অ্যাই সুবর্ণা? কী হয়েছে? দরজা বন্ধ করলি কেন? দরজা খোল। সুবর্ণা।

ভেতর থেকে সুবর্ণা বলল, মা আমার কিছু হয়নি। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব। 
একা থাকবি মানে? তোর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। দরজা খোল মা। লক্ষ্মী মা আমার। দরজা খোল... সুবর্ণা! 
সুবর্ণা আবার একই কথা বলল- মা বললাম তো আমার কিছু হয়নি। ঝামেলা কোরো না তো। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব, প্লিজ মা... 

সুবর্ণার মনে হলো গোসল করলে বোধ করি শরীর-মন দুটোই শান্ত হবে। বাথরুমে ঢুকে শরীরের সব কাপড় খুলে ফেলল সুবর্ণা। বাথরুমের আয়নায় তার নগ্ন শরীর দেখা যাচ্ছে। এর আগে বাথরুমের আয়নায় শরীর দেখার ইচ্ছে হয়নি। আজ হচ্ছে। বিশেষ করে নিজের স্তন দেখার আগ্রহ বেড়ে গেল। সুবর্ণার শরীর কাঁপছে। আজহার মাহমুদ ঝ্যালঝ্যালা স্তনের কথা বলেছেন। সুবর্ণার স্তনের তো একই অবস্থা। এতদিন সে খেয়াল করেনি। তার স্তন দেখলে যে কেউ ভাববে সুবর্ণা একাধিক সন্তানের মা। অথচ সুবর্ণার তো বিয়েই করেনি। ঝরনার কল ছেড়ে অনেকক্ষণ গোসল করল সুবর্ণা। স্তন দুটিকে বারবার উঁচিয়ে ধরে সুডৌল আকার দিতে চাইল। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনেকক্ষণ বিছানায় নগ্ন শরীরে বসে রইল সুবর্ণা। তার কেবলই মনে হচ্ছে শরীর তার অথচ শরীরের নিয়ন্ত্রণ শপে দিয়েছে অন্য কাউকে। এটা ঠিক হয়নি। মারাত্মক ভুল করেছে সুবর্ণা। 

মোবাইল ফোনে রিং হচ্ছে। রিমন ফোন দিয়েছে। সুবর্ণা ভাবল রিমনের সঙ্গে আজ একটা বোঝাপড়া করতেই হবে। 
হ্যালো... কে? সুবর্ণা ইচ্ছে করেই কে শব্দটা উচ্চারণ করল। 
রিমন অবাক হয়ে বলল, সুবর্ণা আমি? চিনতে পারছ না?
ও তুমি? বল!
চাকরির প্রথম দিন কেমন গেল? 
ভালো না। 
কেন? 
সাক্ষাতে বলব। 

কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে রিমন বলল, এখনই বল। অফিসে কোনো ঝামেলা হয়েছে? 
হ্যাঁ। 
কী ধরনের ঝামেলা? 
বললাম তো সাক্ষাতে বলব। 
তুমি কি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ। 
কেন?
ফোনে এতকিছু বলতে পারব না। রিমন...? 
বলো। 
তুমি কি এখন ফ্রি? সিরিয়াস কিছু কথা বলব? 
বলো। আমি ফ্রি। 
আমার কথা শুনে হুট করে কোনো ডিসিশন দেবে না। ভেবে ডিসিশন দেবে। 
ঠিক আছে বল। 

তুমি আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে কী ভাবছ? 
কী ভাবছি মানে? কথা ক্লিয়ার করো। 
আমরা বিয়ে করছি কবে?
বিয়ে? ভূত দেখার মতো চমকে উঠল রিমন। সুবর্ণা অবাক হয়ে বলল, বিয়ের কথা শুনে তুমি এভাবে চমকালে কেন? তার মানে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস না?
রিমন ইতস্তত করে বলল, হঠাৎ বিয়ের কথা উঠছে কেন? আমাদের মধ্যে কি এমন কোনো ডিসিশন হয়েছে। 

সুবর্ণার মনে হলো তার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ছে। তারই নগ্ন শরীর বিদ্রূপ করছে তাকে। কত করে বলেছিলাম এভাবে শরীর খুলিস না। বিপদে পড়বি। বিছানার চাদর টেনে নিয়ে শরীর ঢাকতে ঢাকতে সুবর্ণা বলল, রিমন তুমি কি বুঝেশুনে আমার সঙ্গে কথা বলছ? 
রিমন এতটুকু বিচলিত না হয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ আমি বুঝেশুনেই কথা বলছি। 

তার মানে আমরা বিয়ে করছি না? 
না। এখনই আমি বিয়ের কথা ভাবছি না। 
এখন না ভাব, ভবিষ্যতে... 
ভবিষ্যতের কথাও বলতে পারব না। 
তার মানে তোমার কাছে আমাদের বিয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই? 
রিমন কোনো উত্তর দিল না। 
ফোন কেটে দিল সুবর্ণা। 

কিছুদিন পরের ঘটনা। অফিস কক্ষে সহকর্মীদের সঙ্গে একটি নতুন অনুষ্ঠান বিষয়ে আলাপ করছিলেন আজহার মাহমুদ। হঠাৎ সুবর্ণা এসে হাজির। আজহার মাহমুদ তো অবাক। তার সঙ্গে অন্যরাও অবাক। তবে আজহার মাহমুদ সুবর্ণাকে কিছু বুঝতে দিলেন না। 
তুমি সুবর্ণা না? চেনা মানুষকে অচেনা প্রশ্ন করলেন। 

সুবর্ণা মৃদু হেসে বলল- হ্যাঁ আমি সুবর্ণা। আমাকে আপনারা এভাবেই ভুলে গেছেন? সুবর্ণার কণ্ঠে একটু যেন অভিমান। আজহার মাহমুদ বললেন- তোমাকে আমরা মনে রাখব কোন কারণে? বল? তোমাকে কেন্দ্র করে আমরা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য একটা অনুষ্ঠান সাজালাম, প্রথম পর্বে উপস্থাপক হিসেবে ভালোই করলে। তার পর বলা নেই, কওয়া নেই তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে। এটা তো ভাই কাজের কথা হলো না। 

সুবর্ণা একটু বিব্রত। চোখ তুলে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। আজহার মাহমুদ ছাড়া আর যারা অফিস কক্ষে এতক্ষণ কথা বলছিল তারা সবাই চলে গেল। এবার যেন সাহস পেল সুবর্ণা। আজহার মাহমুদের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ভাই আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। 
ক্ষমা, কেন? 
আপনাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। 

কষ্ট তুমি দাওনি। আমি দিয়েছি। তবে সেদিনের কথাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। তুমি প্রেম করো কিনা- এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করেছিলাম জানো? তুমি অফিসের কাজে কতটা মনোযোগ দিতে পারবে সেটা যাচাই করার জন্য। তরুণী মেয়েদের প্রেমিক থাকলে ওরা অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। ব্যাপারটা সিওর হতে চেয়েছিলাম। তবে তোমার বুক নিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলাম ওটা ছিল প্রেডিকশন। তোমার সহ্যক্ষমতা যাচাই করতে চেয়েছিলাম। এবার বল, হঠাৎ কী মনে করে? প্রেম ঠিক আছে তো, নাকি? 

সুবর্ণা হঠাৎ মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলল। আজহার মাহমুদ অস্থির হয়ে বললেন- অ্যাই মেয়ে, তুমি কাঁদতেছ কেন? ছ্যাঁকা খাইছ?
সুবর্ণা কোনো উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে হেচকি তুলে কাঁদতে থাকল।
অনেকক্ষণ কাঁদল, তার পর যাওয়ার সময় মুখ তুলে আজহার উদ্দিনকে বলল, আমি যদি মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসি তাহলে আপনি কি বিরক্ত হবেন? মাইন্ড করবেন?

আজহার মাহমুদ মৃদু হেসে বললেন, না মাইন্ড করব না। তুমি এলে আমার ভালোই লাগবে। 
এর পর অনেকদিন সুবর্ণার সঙ্গে দেখা হয়নি আজহার মাহমুদের। মাস ছয়েক পর হঠাৎ একদিন সকালে আজহার মাহমুদের মিরপুরের বাসায় হাজির সুবর্ণা। কাজের মেয়ে ময়না দরজা খুলে দিয়েছে। 
কাকে চান? 

আজহার ভাই আছেন?
আছেন। ঘুমাচ্ছেন। 
আমি একটু ড্রয়িংরুমে বসি। উনার ঘুম ভাঙলে বলবেন মালিবাগ থেকে সুবর্ণা এসেছে। 
নাম বললেই চিনবে? 
হ্যাঁ চিনবে। 

আপনি বসেন। সুবর্ণাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে পাশের রুমের দিকে পা বাড়াল ময়না। কয়েক মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন আজহার মাহমুদ। তাকে দেখে সুবর্ণা শোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল- স্লামালেকুম। 
ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি হঠাৎ? আমার বাসা খুঁজে পেলে কীভাবে? দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।  
সুবর্ণা বলল- বসব না। আমার সঙ্গে আপনাকে এক জায়গায় যেতে হবে। 

এক জায়গায় যেতে হবে মানে? অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন আজহার মাহমুদ। 
সুবর্ণা দমভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলল, আমার পরিচিত একজন ডাক্তার আছেন। আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাব। 
ডাক্তারে কাছে আমাকে? কেন?
আপনার চিকিৎসা করাব। 
আমার চিকিৎসা? আমার কী হয়েছে? 

সুবর্ণা হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি শুনেছি আপনি নাকি শারীরিকভাবে অক্ষম। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার পরিচিত ডাক্তার বলেছেন চিকিৎসা করলে অক্ষম পুরুষও সক্ষম হয়ে ওঠে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। প্রমাণ করতে চাই আপনি অক্ষম নন। প্লিজ আপনি আমাকে সহায়তা করুন। আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আজহার মাহমুদকে জড়িয়ে ধরল সুবর্ণা। উভয় সংকটে পড়ে গেলেন আজহার মাহমুদ।

বিশেষ একটি কারণে তার বিয়েভীতি আছে। বাসর রাতে তার বড় ভাইয়ের বিয়ে ভেঙে যায়। শারীরিক অক্ষমতাকে দায়ী করে প্রথমে রাতেই স্বামীকে তালাক দেয় নববধূ। বড় ভাই আর বিয়ে করেননি। বড় ভাইয়ের ঘটনাটা আজহার মাহমুদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। তাই বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন। আজহার মাহমুদের মেয়েবন্ধুর সংখ্যা অনেক। মেয়েরা তার সান্নিধ্য খোঁজে। এদের মধ্যে বিবাহিত আছে কয়েকজন। 

শারমিন নামে একজন কোটিপতির বউ আজহার মাহমুদকে অফার করেছিল- আসেন একদিন লড়াই করি। আপনার বিয়েভীতি দূর হয়ে যাবে। রাজি হননি আজহার মাহমুদ। কিন্তু সুবর্ণাকে ফিরিয়ে দিতে মন চাইছে না। সুবর্ণা পরম মমতায় আজহার মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে আছে। কাঁদছে সুবর্ণা। ‘আমি আপনার অপমান সইতে পারছি না। আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব কিছু ঠিক করে দেব।’ 

সুবর্ণাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে আজহার মাহমুদের। তার মনে হলো ভয় কেটে যাচ্ছে... ।

কবিতা

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
কবিতা

আমরা পুতুল

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমরা তো আজীবন পুতুলের প্রতিশব্দ, কত
ভাঙাগড়া আমাদের, দিনরাত অন্দর সদর,
যা খেলি জানি না খেলা গড়ে কে নেপথ্য কারিগর।
আজ রাজসিংহাসনে, কাল হয় মুহূর্তে পতন।
মন্বন্তরে মরি না তো, সাপ বাঘ নিয়ে খেলা করি,
চাল নেই চুলো নেই, তবু চড়ি সোনার সাম্পান,
স্বপ্নে কত জর্দা চুন ছাড়া খাই ভুলরঙা পান।
অলীক জীবনটাকে কে বাঁচায়, কোন ধন্বন্তরী?
জন্মদাতা পিতামাতা, ভাইবোন পুতুল, পুতুল!
প্রেমিকার ওষ্ঠে মধু, বুকে মধুরতরতা জানি,
তার ঋতুমতী নদীটিকে ঘিরে আমি মহাজন
মহান মূর্খের শাহজাদা, নিজেকেই বলি, ‘শোন,
প্রাণপাখি উড়ে গেলে থাকবে কেবল খাঁচাখানি,
সেই দিন দেখা দেবে পুতুলনির্মাতা নির্ভুল।’

প্রকৃতির পরিহাস

মো. ইমদাদুল হক মিলন

সব নক্ষত্র আজ জেগে আছে
ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবী ক্লান্তির বিছানায়।
তারাদের আজ বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে।
বেমানান? হ্যাঁ আলোহীন আঁধার রাতে
রাতের রানি  হাসনাহেনাকে আজ
আরও বেশি বিধুর লাগছে
তার সৌরভ সন্দিগ্ধ হীন যাপনে।

নিশুতি রাতের লক্ষ্মীপেঁচা
আর আগের মতো ঘূতকার
শব্দে ভীতির বদন্যতা বয়ে আনে না।
হার মেনেছে শালিকের শান্ত চাহুনি
তারাহীন বিভূঁইয়ে রাত শেষ ভোরে।
প্রভাতী শ্যামা আগের মতো নতুন ভোরের স্বপ্নে
দোয়েলের শিসে মেশে না।

কোকিলের ডাকে বিরহী বাতাস আজ আর বহে না।
আগমনী আহ্বানে কোকিল কণ্ঠের 
কামনার কুহু রবে ধ্বনিত প্রতিধ্বনি বিম্বিত হয় না।
হবে কি হবে বৃষ্টি বিলাসী বাগিচায় বুলবুলি,
সব পাখির কলরব, নতুন বন্ধনে আগমনী ভোরে।

ইন্দ্রিয়লব্ধ বোধ

তানজীনা ফেরদৌস

পাকস্থলী ভরা আগুন নিয়ে বেঁচে থাকি
তবু মুখাগ্নির ভয়ে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক যাযাবর আমি।

জীবনে যদি কোনো সাধকের দেখা মেলে-
তবে তার ধ্যানেই নিজেকে সঁপে দিতে চাই। 
শুনেছি সাধক থেকে মন্ত্র নিলে দ্রুত লাভ করা যায় সিদ্ধি…

পৃথিবীতে আমরা কতকিছুর পেছনে ছুটে চলি
কিন্তু ঘুরেফিরে সবাই একটি জায়গায় স্থির হই…
মাটিতে আমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হয়
অথচ মাটির ওপর ছুটে চলা যে অনর্থক তা কেবল মাটিতে মিশেই বোধগম্য হয়।
শ্মশান কিংবা সমাধির ভয়ে কত শত জীবন্ত লাশ 
ঘুরতে থাকে পরম্পরায়।

নতুন বই

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
নতুন বই

ভাষা চিন্তার পোশাক, আর বই সভ্যতার চাবি। বই পড়া একদিকে যেমন মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায়, অন্যদিকে উন্নততর হয় মানুষের ভাষাজ্ঞান। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো বই, যার সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হতে পারে না।…

ইসলামে নারী ও বেগম রোকেয়া
ড. মাহবুবা রহমান
প্রকাশন: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: জুন ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৬৭২, মূল্য: ৪৩০ টাকা

বাঙালি নারী জাতির ভাগ্যোন্নয়নের কথা সর্বপ্রথম বেগম রোকেয়াই চিন্তা করেন এবং নারীদের মানবিক অধিকার লাভের জন্য সর্বপ্রথম তিনিই জনসমক্ষে আলোচনা করেন বা তুলে ধরেন। তার লেখনীতে নারী অধিকারের বিষয়টি ছিল মুখ্য। বাঙালি নারীদের জন্য বেগম রোকেয়া আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হন। শিক্ষালাভ করা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীদের শিক্ষা অর্জন ছিল সুকঠিন বিষয়। তৎকালে পর্দার নামে নারীদের বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। তাদের শিক্ষালাভ এবং আর্থিক সুবিধা অর্জন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

উত্তরাধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা কারও নেই। একমাত্র ইসলামেই নারীর যথোপযুক্ত অধিকার স্বীকৃত। তবে পুরুষশাসিত মুসলিম সমাজে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বেগম রোকেয়া সারাটি জীবন নারীদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। তার লেখনীতে নারীদের বঞ্চিত হওয়ার নানা গল্প ও ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। গ্রন্থের লেখক ইসলাম যে নারীর বহুমুখী অধিকার নিশ্চিত করেছেন এবং বেগম রোকেয়া সারা জীবন নারীদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তা তথ্যসমৃদ্ধভাবে ও সুন্দর সাবলিল ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

Triangle 
ট্রায়াঙ্গল 
ডানিয়েল স্টিল 
প্রকাশক: ডেলাকোর্ট প্রেস, নিউইয়র্ক  
প্রকাশকাল: ১ অক্টোবর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ২৫৬, মূল্য: ২০.২৮ ডলার 

নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার কথাসাহিত্যিক ডানিয়েল স্টিলের নতুন উপন্যাসের নাম ‘ট্রায়াঙ্গল’। স্টিলের এই নতুন উপন্যাসের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে রহস্য। কাহিনিতে বলা হয়েছে, শিল্পরসিক নারী আমান্ডা ডেলানো হঠাৎ করেই একজন অচেনা-অজানা লোকের কাছ থেকে বিশেষ বার্তা পেতে থাকে। ফরাসি ব্যবসায়ী বাবা এবং আমেরিকান মডেল মায়ের একমাত্র সন্তান আমান্ডা। দুজনের কেউ আর বেঁচে নেই। চল্লিশ বছর বয়সে তার দেখা হয় লেখক-প্রকাশক অলিভিয়ের সেইন্ট আলবিনের সঙ্গে। একই সময়ে দীর্ঘদিন পর দেখা হয় পুরনো বন্ধু টম কুইনলিনের সঙ্গেও। বিশ বছর আগে তারা একসঙ্গে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। সুদর্শন অলিভিয়েরের আরও কাছাকাছি আসার পর আমান্ডা জানতে পারে, সে আসলে নারীদের মুগ্ধ করতে ওস্তাদ এবং সে আসলে বিবাহিত। একদিকে অলিভিয়ের, অন্যদিকে টম এবং রহস্যজনক বার্তা। এসবের জট ছাড়ানোর জন্য আমান্ডা দারস্থ হয় কৌতুকপ্রিয় বন্ধু পাসক্যাল লেব্লাঙ্কের। এর মধ্যে তার বাড়িতে হানা দেয় সন্ত্রাসীরা। আমান্ডার জীবনে প্রেম আর আতঙ্ক আসে সমান্তরাল পথে। নারীর নিজস্ব নীতিতে অটল থাকা এবং ভালোবাসায় সাড়া দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ডানিয়েল স্টিলের ‘ট্রায়াঙ্গল’।

তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৬ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী উত্তাল কালপর্বে আত্মপ্রকাশ প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালী গ্রামে; মৃত্যু ১৯৯১ সালের ২১ জুন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণ-আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতৃপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। মাটি, মানুষ ও ঐতিহ্যের প্রতি আমৃত্যু দায়বোধ তার কাব্যকে দিয়েছে মৃত্তিকালগ্ন ও শিকড়স্পর্শী চারিত্র্য। নিজেকে ‘শব্দ-শ্রমিক’ উল্লেখ করে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের নিষ্ঠা। তাই তার কবিতায় সব অসাম্য, শোষণ, নিপীড়ন, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও নব্য-ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বারবার ঝলসে উঠেছে অগ্নিক্ষরা প্রতিবাদ। ঈর্ষণীয় সংখ্যক কবিতা, গল্প, গদ্য; একটি কাব্যনাট্য ও চিত্রনাট্য। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ (১৯৭৯)। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০, ১৯৮১) ও মরণোত্তর একুশে পদক (২০২৪)। পিতা ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মাতা শিরিয়া বেগম।

সুবর্ণরেখা

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
সুবর্ণরেখা

মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত। স্কুলজীবনেই কবির সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’ প্রকাশিত হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিচের দুই লাইন কবিতার মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেছিলেন- “তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি, মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।” সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা।...’ গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের বেশির ভাগের মূল বিষয় ইসলামি আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। তিনি তার প্রবন্ধে লেখেন, ‘যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসাদের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিল কোনো স্বাতন্ত্র্য, না ছিল কোনো স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মনন শক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। জাতির অন্তরমূর্তি ছায়া ফেলে তার সাহিত্যের মনো-মুকুরে। সাহিত্য তাই জাতির মনের প্রতিধ্বনি। সাহিত্যের ভেতর দিয়েই গোটা জাতির সাচ্চা চেহারা দেখা যায়। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানের কোনো সাহিত্যই তখন রচনা হয়নি। আমি তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে।’

সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ বাউলসম্রাট ফকির লালন

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০১ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৮ পিএম
বাউলসম্রাট ফকির লালন
ফকির লালনের জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র। ৫ মে ১৮৮৯ সালে শিলাইদহে পদ্মা বোটের ওপর বসা অবস্থায় এঁকেছিলেন চিত্রশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ছবির ওপর নাম লিখেছেন 'লালন ফকির'

লালন ছিলেন মানবতাবাদী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ফকির, বাউলসম্রাট- বিভিন্ন উপাধিতে ভক্ত ও সুধী-সাধারণের মধ্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক সাধক, বাউল ঘরানার মরমি সাধক, বাউল, মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারক এবং দার্শনিক। লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে, যা তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘মহাত্মা লালন’ নিবন্ধে প্রথম লালনজীবনী রচয়িতা শ্রীবসন্ত কুমার পাল বলেছেন: ‘সাঁইজি হিন্দু কী মুসলমান, এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।’...

লালন গবেষকরা তাদের গবেষণায় লালনের জীবনদর্শন থেকে শুরু করে শৈল্পিক ও কবিত্বশক্তি উদঘাটনে এবং শিল্পীসত্তার মূল্যায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লালনের গান বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ, লালন-সাধনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, সুফিদর্শন, বৈষ্ণবশাস্ত্র সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান, দিব্যদৃষ্টি সবই তার অসামান্য অবদান। লালন দেশের কাঁটাতার ছিন্ন করে বিশ্ববাসীর হৃদয়েও তুলেছেন সুরের প্রাণবন্ত মূর্ছনা:

‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে’...

লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম প্রধান ও ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার যুগান্তকারী গানের মাধ্যমে উনিশ শতকে বাউল গান অধিকতর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য আঠারো শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান যেমন মানুষের জীবনদর্শনসম্পৃক্ত, বিশেষ সুরসমৃদ্ধ ধারা, তেমনই বাউলরা জীবনযাপনও করেন সাদামাটা। 

রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব ছিল। গীতাঞ্জলির অনেক গানে তার জীবনদর্শনে লালন তাকে প্রভাবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণায় Lalon is the king of the Bauls. সবচেয়ে বড় মরমি-শ্রেষ্ঠ বাউল। বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন: ‘আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন; সম্প্রদায়ের ধর্ম্ম-মতানুসারে ইহার কোনো সন্তান-সন্ততি হয় নাই। ...ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।’ লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। লালন গবেষণার পথিকৃত শ্রীবসন্ত কুমার পালের মতে, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাঁড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। কালীগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মওলানা মলম শাহ। মওলানা মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান বিবি তাকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ছেঁউড়িয়ায় পালিত মাতা-পিতার অনুরোধে লালন বসবাস শুরু করেন এবং ছেঁউড়িয়াতেই থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গার সাধক-সন্ন্যাসীরা তার এখানে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এই সময় সিরাজ সাঁই নামক একজন সুফি দরবেশ ব্যক্তির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। লালনের অনেক পদে ‘দরবেশ সিরাজ সাঁই’-এর নাম উল্লেখ আছে। 

লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘কাঙ্গাল হরিনাথ তাকে জানতেন, মীর মশাররফ তাকে চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক রায় বাহাদুর জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাকে সামনাসামনি দেখেছেন, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেননি লালনের জাত পরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।’ লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’ লালন বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে বহু ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাধু বাউল এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির (আরবি ‘সাধু’) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন: ‘শরীয়তবাদী মুসলমানগণ লালনকে ভালো চোখে কোনদিনই দেখেন নাই। এ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল লালনের খ্যাতি-প্রতিপত্তির দিনেও তাঁহাকে নিন্দা করিয়াছে।... এই বাউল-পন্থী নেড়ার ফকিরেরা চিরকাল... অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়াছে।’ অতঃপর লালন সবিশেষ একটি গানে আক্ষেপ করে বলেছেন-

‘এ দেশেতে এই সুখ হলো, আবার কোথা যাই না জানি’...

আহমদ শরীফ, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুধীর চক্রবর্তীর মতো বিদ্বজ্জনরা লালন বিষয়ক প্রবন্ধাদি মারফত লালন গবেষণায় যুক্ত করেছেন গতি ও নতুন অভিঘাত। আমরা লালন-রচিত প্রায় এক হাজার গানের সন্ধান পেয়েছি। এসব গান সংগ্রহের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ পথিকৃৎ। শ্রীবসন্ত কুমার পাল, ‘হারামনি’ প্রণেতা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, লালন গবেষক ম. মনিরউজ্জামান, মুহম্মদ আবু তালিব, ড. আনোয়ারুল করীম, খোন্দকার রিয়াজুল হক, শক্তিনাথ ঝা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ পণ্ডিত-গবেষক প্রাণান্ত শ্রম-মেধা-মনন দিয়ে লালনের গানের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন।
 
একথা সত্য, লালনের গান এখন ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে বেরিয়ে, নদীয়ার ভূগোল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। লালন এখন বাঙাল মুলুকে তো বটেই, বাঙালির বিশ্বঅভিবাসনের নিমিত্তে পৃথিবীব্যাপীই গেছে ছড়িয়ে। বেড়েছে লালনপ্রেমী গবেষক, শুভানুধ্যায়ী, অনুরাগীর সংখ্যা। দেশ বিভাজনের সীমারেখা ছাড়িয়ে, কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারেও লালন খুঁজে ফিরছেন মনের মানুষ। 

বাংলার বাউলের প্রাণপুরুষ মহাত্মা লালন নিয়ে গবেষণা থেমে নেই। যুগে যুগে লালন গবেষণার পরিধি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন একাডেমি থেকে বের হয়ে তামাম পৃথিবীর লালন বিশেষজ্ঞ ও আপামর মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ফকির লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায় নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালীন তার বিচিত্রতা লক্ষণীয়! আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে নিবন্ধকার রাইচরণ দাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন: ‘ইনি ১১৬ বৎসর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।... মরণের পূর্ব্বে রাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া ভোর ৫টার সময় শিষ্যগণকে বলেন ‘আমি চলিলাম’।...