মন কাঁদে, দেহও কাঁদে
দু-কূলপ্লাবী প্লাবনে ঝরে কত টালবাহানা;
অঘ্রাণ আসে, অঘ্রাণেরা হাসে
তালবীথিকায় তবুও অখণ্ডিত থাকে কিছু কৈফিয়ত;
কুম্ভশালায় নানান পট! সত্রশিখায়
কিছু হাসি কিছু দুঃখ মেশানো;
রাতের চরণধ্বনির অপেক্ষায়
গুণমোহিত শুকতারা।
মন কাঁদে, দেহও কাঁদে
দু-কূলপ্লাবী প্লাবনে ঝরে কত টালবাহানা;
অঘ্রাণ আসে, অঘ্রাণেরা হাসে
তালবীথিকায় তবুও অখণ্ডিত থাকে কিছু কৈফিয়ত;
কুম্ভশালায় নানান পট! সত্রশিখায়
কিছু হাসি কিছু দুঃখ মেশানো;
রাতের চরণধ্বনির অপেক্ষায়
গুণমোহিত শুকতারা।
পর্ব: ০৬
ওসি সাহেবের এ দর্শনচিন্তার মাঝে সেই বন্ধুর প্রশ্ন-
-শুধু বন্ধুত্বের দায় মেটানোর জন্য এত রাতে এখানে আসিনি। এটা আমার-আপনার সবার দায়। এটা সমাজের দায়।
এইবার ওসি সাহেব আর নীরব থাকতে পারলেন না। যে প্রশ্ন আসি আসি করে হৃদয় থেকে মুখে এসে বারবার আটকে পড়ছিল, এইবার তা মুখ ফুটে বেরিয়ে পড়ল-
-আপনি বন্ধুর কথা বলছিলেন। কেমন বন্ধু আপনার?
-আমার মেয়ে বন্ধু।
-মানে গার্ল ফ্রেন্ড?
-বন্ধুর আবার গার্ল বা জেন্টস কি! বন্ধু তো বন্ধুই।
-আমিও আপনার সঙ্গে সহমত। তবে কি-না আমাদের সমাজের মত হলো উল্টা। আপনি যদি চাহেন তো এই মাঠে উপস্থিত অন্তত শখানেক সমাজের প্রতিনিধির সামনে আপনাদের দুজনকে নিয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি উনার মেয়ে বন্ধু। আমি বললাম, গার্লফ্রেন্ড কি-না। উনি বললেন ফ্রেন্ড তো ফ্রেন্ডই। ফ্রেন্ড আবার গার্ল বা জেন্টস হয় না কি! আপনারা কি বলেন?
ওসির কথায় তবদা খেয়ে যান ভদ্রলোক। রুমের পরিবেশ ভারী হয়ে আসে। ওপরে ব্রিটিশ আমলের ফ্যানটি ধীরে, অতি ধীরে চলতে থাকে। আর কোনো শব্দ নেই। নিঃশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আসে দুই আগন্তুকের।
ভালো জব্ধ করা গেছে বুঝে ওসি সাহেব শান্তি পান। দাগি আসামিদের সঙ্গে তার কাজ কারবার। এসব তো নস্যি। কাকে কীভাবে জব্দ করা যায় তিনি ভালো করেই জানেন। তবে এও জানেন, তারা যে মামলাটি নিয়ে এসেছে, তার সুরাহা করতে না পারলে তার থানায় আগুন জ্বলবে। মিছিল-মিটিংয়ে ভরে উঠবে পথঘাট। অগত্যা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
-এসব নিজেদের মধ্যে বলা আর কি! চলুন দেখা যাক, মানুষ গানটি দিয়ে কীভাবে ইভ-টিজিং করে দেখা যাক; চলুন মাঠে চলুন।
এদিকে শেষ রাত্রির অন্ধকার তাড়াতে থানার মাঠে হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। রাতের আলোয় রাতের কূয়াশা যেন শ্রাবণের বাদল ধারা। আর সবকিছু ছাপিয়ে একদল সংগীত-অজ্ঞ মানুষের সংগীতজ্ঞ হওয়ার আয়োজন।
অভিযোগকারিণী এবং তার বন্ধুর সঙ্গে থানার মাঠে এসেই ওসি সাহেব এসআই আল্লামা সিদ্দিকের কাছে শোননেন, একে একে অনেকেই এ গান গাওয়ার পরীক্ষা দিয়েছে। তবে থানার কোনো পুলিশই ভালো গাইতে পারল না।
এসময় লেখক শাহাদাত আহসানের গলা শোনা গেল, এতক্ষণ যার গান শুনলাম তিনি তো ভালোই গাইলেন।
ওসি প্রশ্নবোধক চিহ্নে আল্লামার দিকে তাকালেন। আল্লামা ফিসফিসিয়ে বললেন-
-সমস্যা তো ওখানেই স্যার। ও ট্রিপল মর্ডারের আসামি। আজকে চুনতির জঙ্গলে লোহাধরা ফাঁড়ির টহলদলের হাতে ধরা পড়ে এখানে এসেছে।
-বলেন কি!
-হ্যাঁ, স্যার।
-আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। এত সুন্দর গানের গলা, ও খুনি হয় কীভাবে!
-আপনার মতো ইমন মিয়াও আশ্চর্য হয়ে আছে।
-ইমন মিয়া কে?
-ওই যে যার গানের কথা বলছেন। ট্রিপল মার্ডারের আসামি।
-সে কী বলে?
-সে বলে সে সংগীতের এক সাধক। মিয়া তানসেন না কোনো এক বিখ্যাত ওস্তাদের নামে তার বাবা নাম রেখেছেন মিয়া। আর ইমন নাকি একটি রাগের নাম।
-এখানে রাগারাগির প্রশ্ন আসে কীভাবে?
-রাগ নাকি সংগীতের এক প্রকার ভেদের নাম।
-আখেরি জমানায় আরও কত কিছু শুনব। সংগীত হচ্ছে কোমল, নরম জিনিস, এখানে রাগের মতো কঠিন বিষয় কীভাবে আসবে! যত্তসব।
ওসি সাহেব আর এসআইয়ের আলোচনা আরও গভীরে চলে যাচ্ছিল। এসময় লেখক শাহাদাত আহসান গলা খাকারি দিয়ে সংগীত শুরু করতে তাগাদা দিলেন। বললেন, শেষ রাতে তার এক বন্ধুর বাড়িতে পানের দাওয়াত আছে। তার পর তিনি দিনের মধ্যভাগ অবধি ঘুমায়ে শেষভাগে লেখায় হাত দেবেন।
পান খেতে শেষ রাতে বন্ধুর বাড়িতে কেন যেতে হবে- এ ধরনের প্রশ্নে ওসি ইজ্জত আলী জমাদ্দারের মাথা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। আজ রাতে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার। তবে হালের জনপ্রিয় লেখক শাহাদাতের শেষ রাত্তিরে পান খেতে বন্ধুর বাড়ি গমন তিনি তদন্ত করবেন একদিন, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলেন।
এদিকে ততক্ষণে মঞ্চে গান শুরু হয়ে গেছে।
তোঁয়ারে দেখি মনত আঁর জাগি উডের পুরাণ দুঃখ,
ভাসি উডের প্রেমর কথা হাসি উডের সে সোনামুখ;
ন জানি তেঁই বাঁচি আছে না কি মারা গেয়ি গই!
অ চড়ই তোঁয়ার বাড়ি কই!
গান শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন নবীন লেখক শাহাদাত আহসান। হাত তালি দেন। থানার পরিবেশ, নিস্তব্ধ জনতা, শেষ রাত্রির নির্জনতা সব বিস্মৃত হয়ে তিনি তালি দিতে থাকেন। কিন্তু বিরক্ত ওসি কিছু বলবার আগেই তার কণ্ঠ বিদীর্ণ হয়-
-ওয়াও। এত সুন্দর গান কতদিন শুনিনি।
কিন্তু উচ্ছ্বাসে যোগ না দিয়ে উপেক্ষার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান ওসি সাহেব। কানে কানে কিছু একটা বলেন। কান-কথা শুনে থতমত খেয়ে যান নব্য লেখক, তবে সাহস হারান না। বলেন, এখানে উপস্থিত সজীব চৌধূরীর মতামত নিতে পারেন।
-সজীব চৌধূরী কে?
-উনাকে চেনেন না? তিনি তো বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ধ্রুপদী লেখক। ওই যে উনি বসে আছেন। মনে হয় থানা থেকে উনার মতামত নেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে।
সাহাদাত আহসানের আশা, এ পরীক্ষার মাধ্যমে সজীব চৌধূরীকে ভালোই জব্ধ করা যাবে। কিন্তু নিজের আসন্ন বিপদ চিন্তায় আচ্ছন্ন সজীব ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলে অবলীলায় উত্তর দেয়,
-গানটি তো ভালোই, কিন্তু এ গানে ব্যবহৃত চড়ই শব্দটি মেয়েদের ইভ-টিজিং করতে ব্যবহার হয় কিনা তা আদালত নির্ধারণ করতে পারে। থানায় সে সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। অন্তত আমার, আপনার জন্য ভালো।
ওসি সাহেব মনে হলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তার স্বস্তি অস্বস্তিতে পরিণত হতে সময় লাগল না। সজীব তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হলো, জ্যোৎস্না বিস্নাত চাঁদনী রাতে উদ্ভাসিত চন্দ্রিমা আহিস্থা আহিস্থা রাহুর অন্ধকার গ্রাস করে নিল। আশ্চর্য বিস্ময়ে সে একবার ওসি সাহেবের পরিবর্তনশীল মুখের দিকে আরেকবার তার পাশে বিরাজিত মর্তের বুকে নেমে আসা আকাশের চাঁদ চারুর দিকে তাকিয়ে থাকল। ওসি সাহেবের মুখ যে এখন সেদিকে ঘুরে গেছে! ওসি এবং সজীব দুজনই দেখল, সে মুখে নিভু নিভু জীবনের ব্যাকুল পিয়াসা ভোরের শিশিরে ফোটা শিউলির মতো নির্মল হাসিতে আচ্ছন্ন।
ওসি সাহেব বুঝলেন, এ মানুষ শুধু সাহিত্যক নন, সমঝদার মানুষও বটে, তার ওপর নির্ভর করা চলে।
তার নির্মল হাসি সংক্রামিত হলো সজীবের মুখে। সজীবের মনে হলো, শেষ পর্যন্ত খোদা তার দিকে মুখ ফিরে তাকিয়েছেন, তার দুর্দশা শেষ হতে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় আবেগে তার মাথা নুয়ে এল সেই মহামহীমের প্রতি। স্বগত: উচ্চারিত হলো মুখে, খোদা, আখেরে তুমিই তো রক্ষাকারী।
গানের সুরে উন্মাতাল জনতা হঠাৎ পতিত উল্কার মতো নিস্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। সজীব চারুর হাত ধরে বলল, চলো যাই। ওসি সাহেবের সঙ্গে হাত মিলাল সে। কিন্তু চারুর মুখে তখনো অস্তমিত সন্ধ্যার সেই বিষণ্ন হাসি লেপ্টে আছে।
যেতে যেতে পেছন ফিরে সজীব দেখল, ওসি সাহেবের কানে কানে সেই এসআই কিছু বলছেন। তার পর সামনে ফিরে এগিয়ে যেতে থাকল। কৌতূহলী জনতার চোখের খিদা মিটছে না। তাদের দৃষ্টি মর্ত্যের অপসরী চারুর দিকে। মানুষ এমন সুন্দরও হয়!
থানার চৌহদ্দি প্রায় পেরিয়ে এল দুজন। খোলা গেট দিয়ে পূর্বকাশে ঊষার লালিমা দেখা যাচ্ছে। সুবহে সাদেক!
এসময় ফিসফিসিয়ে পেছনে কেউ বলে উঠল, এক্সকিউজ মি, ওসি সাহেব আপনাদের তার রুমে সালাম দিয়েছেন।
ওসি সাহেবের কক্ষ এতক্ষণের উন্মুক্ত পরিবেশের বিপরীতে শীতার্ত রাত্রির নিষ্পত্র বৃক্ষের মতো নীরব; সংগীতবিহিন। বহু বহুক্ষণ অপেক্ষার পর ওসি সাহেবের আগমন হলো।
কী হবে এখন! সজীবের মনে আবার সেই ভয় এসে উপস্থিত হয়েছে। যদি পৃথিবী জানে সে চারুপল্লিতে গেছে, গিয়ে বমাল ধরা খেয়েছে এক পতিতার সঙ্গে পালানোর সময়। কীভাবে সমাজে, বন্ধুমহলে মুখ দেখাবে সে; কীভাবে!
কৌতূহলী দর্শকের দল উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলে গেছে। রুমজুড়ে শেষ রাত্রির নীরবতার মধ্যে সজীব তার জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দুলছে। চারুর চোখেমুখে যথারীতি সেই নৈঃশব্দের নির্লিপ্তি।
ওসি সাহেব সজীবকে ডেকে তার টেবিলের সামনে এনে বসালেন। সজীব মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। ওসি সাহেব তার দিকে ঝুঁকে এলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন, ওস্তাদ, এই কাজ কেন করতে গেলেন; এখন যে আপনার মৃত্যু ঘোষণা করা ছাড়া আমার উপায় নেই। কিছু বলার আছে আপনার?
‘ও কিছু বলবে না। তবে আমার কিছু বলার আছে আপনাকে’। সজীব দেখল, তার পেছনে কখন যেন চারু এসে দাঁড়িয়েছে। আর তার সেই হরিণী কোমল চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব বাক্যহারা হয়ে গেছেন।
-ক্বী ক্বী বলবেন আপনি? কোনোমতে উচ্চারণ করতে পারলেন ওসি।
-আপনার খাসরুমে গিয়ে বলব, চলুন, নির্বিকার চারুর নিষ্পাপ উত্তর।
সজীব কিছু বলল না, অথবা বলতে পারল না। তবে একবারের জন্য সেই মহামহিমের ওপর অভিমান বসে উচ্চারণ করল, আমাকে নিয়ে, আমার সম্ভ্রমকে এরকম খাদের কিনারায় নিয়ে পরীক্ষা করার কী দরকার ছিল, মালিক?
সজীব দেখল, সেই দুই জোড়া চোখ এখনো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা নেই, শব্দ নই, নিঃশ্বাস পর্যন্ত নেই। সজীব দেখল, চারুর মুখ কথা বলছে-
-এ চোখ দুটি কি পরিচিত মনে হয় জনাব ইজ্জত আলী জমাদ্দার?
আবারও অনেকক্ষণ নীরবতা ভর করল নীরব রুমটিতে। তার পর ওসি সাহেবের ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা যায়,
-হ্যাঁ মানে আমি বলতে চাইছি, ব্যক্তিগত জিনিস অফিসে আলোচনা না করলে নয়?
-হুম, আমিও তাই চাইছি। আমার আর ওর ব্যক্তিগত জিনিসও ব্যক্তিগতই থাক। কী বলেন?
-হ্যাঁ, মানে হ্যাঁ। তা তো বটেই।
-চলো সজীব।
অনেকক্ষণ পর সজীব বুঝল, চারুর শেষের কথাটি তার উদ্দেশেই। পুত্তলিকার মতো উঠল সে, উঠে চারুর পেছন, পেছন থানার বাইরে এসে দাঁড়াল। তার পর চারুর হাত ধরে পা বাড়াল সামনের পৃথিবীতে। ইজ্জতের জমাদার ইজ্জত আলী জমাদ্দার তখনো পলকহীন তাকিয়ে আছেন। তখন থানার বাইরে দিকে দিকে সুবহে সাদিকের ওয়াক্তে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ফজরের আজান ‘ভাসিয়া আসিতেছিল’-
‘আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান নাউম
-নিশ্চয়ই নিদ্রার চাইতে সালাত উত্তম। অতএব, সালাতের পথে, কল্যাণের পথে এসো, হে মুমিন।
চলবে…
‘সখ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই যেমন একরকম নই- বৈচিত্র্যই আমাদের অনন্যতা দান করেছে, ঠিক তেমনই আমাদের সখও একেকজনের একেকরকম। পৃথিবীর বহু গুণী মানুষের সখ সম্পর্কে আমরা কৌতূহলী। যাঁরা নজরুলপ্রেমী, মাঝে মাঝে তাঁদের মনের মধ্যেও এই প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি- আমাদের প্রাণের কবির সখ কী ছিল? সত্যিই তো, এ নিয়ে আলোচনা বোধহয় কমই হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম- যাঁর জীবন এত বৈচিত্র্যময়, তাঁর সখও যে নিতান্তই আমার-আপনার মতো খুব সাধারণ কিছু হবে না- এ বিষয়ে সন্দেহ কি? আসাদুল হকের লেখা ‘নজরুল যখন বেতারে’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়- ‘হস্তরেখা গণনা করা’ ছিল নজরুলের একটি সখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই তাঁদের স্মৃতিকথায় এ সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ১৯৪১ সালের ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে বেতারে নজরুলের একটি বক্তৃতা প্রচারিত হয়। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘হাতের রেখা দেখে গণনা আমার একটি সখ’। এ ছাড়া কবির হয়তো অন্যান্য সখও ছিল, কিন্তু এই প্রবন্ধে ‘নজরুলের জ্যোতিষচর্চা’ সম্বন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সুস্থ অবস্থায় নজরুল যাঁদের হাত দেখেছেন, বলাই বাহুল্য যাঁরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের স্মৃতিকথাই এই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।
কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত প্রিয় মানুষদের তালিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের বাহার-নাহার, দুই ভাইবোন। নজরুল তাঁর সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থটি তাঁদেরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে নজরুল লিখেছিলেন-
‘‘- আমার এই লেখাগুলো
বাহার ও নাহারকে দিলাম।-
কে তোমাদের ভালো?
‘বাহার’ আনো গুল্শানে গুল্, ‘নাহার’ আনো আলো।
‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,
‘নাহার’ এলে রাত্রি চিরে জ্যোতির অভিযান।
তোমরা দুটি ফুলের দুলাল, আলোর দুলালী,
একটি বোঁটায় ফুট্লি এসে, নয়ন ভুলালি!
নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী,
তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি!’’
মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, নজরুল যখন চট্টগ্রামে যান তখনো পামিস্ট্রির চর্চা করতেন। ওখানে বসেই কাজী সাহেব একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা; অন্যদিকে তাঁর সখও পূরণ করেছেন। বাহার লিখেছেন- ‘‘কাজী সাহেব চট্টগ্রামে আমাদের বাড়িতে গিয়েছেন কয়েকবার। যে ক’দিন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে, মনে হতো বাড়িখানি যেন ভেঙ্গে পড়বে। রাত্রি ১০টায় থারমোফ্লাস্কে ভরে চা, বাটাভরা পান, কালিভরা ফাউন্টেন পেন, আর মোটা মোটা খাতা দিয়ে তাঁর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতাম। সকালে উঠে দেখতাম, খাতা ভর্তি কবিতা। এক-এক করে ‘সিন্ধু’, ‘তিন তরঙ্গ’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলী’, ‘মিলন মোহনায়’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘নবীনচন্দ্র’, ‘বাংলার আজিজ’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সাতভাই চম্পা’ আরও কত কবিতা লিখেছেন আমাদের বাড়িতে বসে। চট্টগ্রামের নদী, সমুদ্র, পাহাড়, আমাদের বাড়ির সুপারি গাছগুলো আজ অমর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যে। সারারাত কবি চা আর পান খেতেন- আর খাতা ভর্তি করতেন কবিতা দিয়ে। আর দুপুরে কখনো কিছু পড়তেন, কখনো করতেন পামিস্ট্রির চর্চা, কখনো বা মশগুল্ হতেন দাবা খেলায়। বিকেলে দল বেঁধে যেতাম নদীতে, সমুদ্রে। সাম্পানওয়ালারা এসে জুটত, সুর করে চলত সাম্পানের গান। সবাই মিলে গান করতাম, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী’ ‘গহীন জলের নদী’, এক এক সময় চট্টগ্রামী সাম্পানওয়ালারা গাইত ‘বঁধুর আমার চাটি গাঁ বাড়ী- বঁধুর আমার নন্দীর কূলে ঘর।’
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আবদুল আযীয আল-আমানের ‘নজরুল পরিক্রমা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভবিষ্যৎ-জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে নাহার নজরুলকে হাত দেখিয়েছিলেন।
আবদুল আযীয আল-আমান লিখেছেন- ‘‘কবি বাহার-নাহার ভাই-বোনদের ভাগ্যলিপি পৃথকভাবে কাগজে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজের ভাগ্য জানার জন্য স্বভাবতঃই মানুষ কৌতূহলী। নাহার সাহেবাও একবার ঐকান্তিক আগ্রহে নিজের হাতখানি পর্দার আড়াল হতে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ‘দেখুন তো কবিদা, কতখানি পড়াশোনা লেখা আছে আমার হাতে?’ কবি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে হাত দেখে যে সুদীর্ঘ ভাগ্যলিপি রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি বিশেষ বক্তব্য এই ‘...স্বাস্থ্যভঙ্গ...প্রাণ নিয়ে টানাটানি... প্রিয়জন-বিয়োগ...’ সবশেষে লিখেছিলেন- ‘স্নেহ-মমতার অভাব হবে না কোনদিন,...Partial satisfaction of ambition... ইত্যাদি। কবি অনেকের হাত দেখে এ ধরনের মন্তব্য করতেন, এ জন্য তাঁর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী জনাব মুজফ্ফর আহ্মদের কাছে মাঝে মাঝে ভর্ৎসনা শুনতেন, তবুও নিরস্ত হতেন না। তাঁর কাছে হস্তরেখা গণনা এবং জ্যোতিষ চর্চা অনেকখানি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।’
নজরুল-সুহৃদ, মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধিচর্চার অন্যতম কাণ্ডারী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই চিঠিগুলো থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের কী গভীর প্রেম। ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে নজরুল চিঠি লেখেন মিস ফজিলতুন্নেসাকে। নজরুল তাঁর প্রকাশিতব্য ‘সঞ্চিতা’ তাঁকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সবাই জানি পরবর্তীতে তিনি ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেছিলেন বিশ্বকবিসম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
ফজিলতুন্নেসাকে নজরুল চিঠিতে লেখেন- ‘‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া। খুব সম্ভব আর একমাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে। আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এ জন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব? সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না- এই আমার আকুল প্রার্থনা।’’
কিন্তু ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কীভাবে? তার বর্ণনা দিতে গিয়েই কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ‘হস্তরেখা গণনা’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন - ‘‘ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না-অথবা ‘বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অংকের এমএ এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন শৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মতো সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।’’
এই স্মৃতিকথা থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, নজরুল নিতান্তই সখের বশে এই কাজ করলেও যথেষ্ট নিবেদিত ছিলেন।
১৯২৮ সালের ১০ মার্চ তারিখে ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলকাতা থেকে নজরুল চিঠি লেখেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘‘আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ীর ‘ভ্রমর’ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বৌ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তর তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনী-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় এক একবার। দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতীন না ঠাওরান!’’
এই চিঠিতে নজরুল নিজেই লিখেছেন, তিনি হস্তরেখা গণনা করতে পারতেন। হস্তরেখা দেখে চমৎকার ভবিষ্যৎ গণনাও করতে পারতেন।
একবার কলকাতায় ওয়েলেসলি স্কোয়ারে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরুল মোতাহার হোসেনের ও তাঁর শ্যালকদের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক শ্যালককে বলেছিলেন, তাঁর ভাগ্যে বিদেশযাত্রা আছে। এ কথা পরে ঠিকই হয়েছিল। আর একজনের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এ বহুদূর দেশে চলে যাবে, অজ্ঞাতবাসের মত।’ - এর মৃত্যু ঘটেছিল।
প্রিয় মোতাহার সম্বন্ধেও বলেছিলেন, ‘তোমার যশো রেখা খুব স্পষ্ট, বিদেশযাত্রাও হবে, কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধক উত্তীর্ণ হয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে।’ নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকাংশেই মিলে যেত। এর স্বপক্ষে বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
গ্রামোফোনের রিহার্সেল রুমে মাঝে মাঝে নজরুল হাত দেখার বই জোগাড় করে তাই নিয়ে মেতে থাকতেন। এই হাত দেখা নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন বিখ্যাত নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী আঙুরবালা দেবী। একটি বিশেষ ঘটনার কথা তাঁর লেখনীতেই তুলে ধরলাম- ‘‘আমাদের সময়ে গ্রামোফোনে একজন তবলা বাজিয়ে ছিলেন। নাম রাসবিহারী শীল। খুব গুণী লোক। রাসবিহারী বাবুর তবলা সঙ্গত না থাকলে আমাদের গান যেন জমতেই চাইতো না। একদিন শোনা গেল, জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী মশায় নৌকাযোগে কোথায় যেন গান গাইতে যাবেন, আর তাঁর সঙ্গে তবলা বাজাবার জন্য যাবেন সেই রাসবিহারী বাবু। সেদিন যথারীতি রিহার্সাল রুমে কাজীদার সঙ্গে আমরা গান-বাজনা নিয়ে মেতে রয়েছি। রাসবিহারী বাবু আমাদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করছেন। গান-বাজনার ক্ষণিক বিরতিতে তিনি কাজীদার সামনে ডান হাতটি মেলে ধরলেন: ‘কাজীদা আমার হাতটা একটু দেখুন না।’ এটা তাঁর জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বাইরে যাবার আগের দিনের ঘটনা। কাজীদার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। সেই হাসিমুখেই তিনি রাসবিহারী বাবুর হাত দেখায় মন দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠলো। একসময় রাসবিহারী বাবুর হাত ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সবাই চুপচাপ। হঠাৎ কাজীদার এই ভাবান্তর দেখে আমরাও অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসবিহারী বাবু হাসিমুখে বললেন- ‘কই কাজীদা হাতে কি দেখলেন, বললেন না তো!’ কাজীদা তবুও নিরুত্তর। রাসবিহারী বাবু আবার বললেন ‘বলুন না কাজীদা কি দেখলেন। খারাপ কিছু?’ এবার কাজীদার মুখে মৃদু করুণ হাসি ফুটে উঠলো। রাসবিহারী বাবুকে তাঁর গুণের জন্য কাজীদা খুবই স্নেহ করতেন। তাই ধীরে ধীরে তাঁর পিঠ চাপড়ে বললেন- ‘দূর পাগল খারাপ কেন হবে। ভালোই তো, সব ভালো।’
এই কথার পর কাজীদা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তখনকার নামকরা গায়ক ধীরেন দাস সেদিন ঐ ঘরে উপস্থিত ছিলেন। রাসবিহারী বাবু চলে যাবার পর ধীরেন বাবু কাজীদাকে চেপে ধরলেন, ‘বলুন না কাজীদা ওর হাতে কি দেখলেন?’ কাজীদা বললেন, ‘একটু খারাপ জিনিসই দেখলাম।’ নজরুলের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। ক’দিন পর জ্ঞানবাবু গান গেয়ে ফিরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু শোনা যায়, রাসবিহারী বাবুর জ্বর হয়েছিল। এর ক’দিন পর খবর আসে তাঁর সামান্য জ্বর নিউমোনিয়ায় দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করা হয় কিন্তু তাঁর সে নিউমোনিয়া আর ভালো করা যায়নি। মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রাসবিহারী শীল মারা গেলেন। নজরুল পরে ধীরেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বেদনার হাসি হেসে জবাব দিয়েছিলেন,‘হ্যাঁ, আমি সেদিন ওর হাতে মৃত্যুযোগ দেখেছিলাম। বুঝেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়ত রাসবিহারীর মহাবিপদ আসছে। আর সেই জন্যেই আমি কিছু বলিনি সেদিন।’
উপরোক্ত ঘটনা থেকে সহজেই ধারণা করা যায়- অবসর সময়ে নজরুল তাঁর প্রিয়জনদের হস্তরেখা গণনা করে সুন্দর সময় কাটাতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবন আলো-আঁধারের মিশেল। তাই এই বিশেষ গুণের অধিকারী নজরুল কখনো কখনো প্রিয় মানুষদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে অগ্রিম জেনে যাওয়ায়, তাঁর মন হতো বিষাদে পরিপূর্ণ।
তথ্যঋণ:
নজরুলের কবিতা-সমগ্র
নজরুলের পত্রাবলি: শাহাবুদ্দীন আহ্মদ সম্পাদিত
কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুল চর্চা: তপন বাগচী সম্পাদিত
নজরুল যখন বেতারে : আসাদুল হক
নজরুল স্মৃতি: বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
নজরুল পরিক্রমা: আবদুল আযীয আল-আমান
লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)
ঘরের ভেতর মূল্যবান জিনিস, বইয়ের মতো সুন্দর নয়। বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এমনটিও নয়। সংরক্ষণে রাখতে হয় নতুন প্রজন্মের জন্য। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।’…
সাংবিধানিক চেতনায় মুক্তির অন্বেষা
মু. আবদুল হাকিম
প্রকাশন: কবি প্রকাশনী, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৬০, মূল্য: ৪০০ টাকা
মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনার নির্যাস এ বই। বইটিতে আছে ওয়েস্ট মিনস্টার গণতন্ত্রের সারমর্ম তুলে ধরার প্রয়াস। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারদলীয় এবং নির্দলীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি সুষম মিশ্রণ। সংসদ, মন্ত্রিসভা এবং মন্ত্রণালয় হলো সরকারের শক্তিশালী তিনটি দলীয় প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলো সরকারের নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান। দলীয় এবং নির্দলীয় কর্মকাণ্ডের এই সীমান্তরেখা না মানলে বিপন্ন হতে পারে বহুদলীয় গণতন্ত্র। স্থানীয় সরকার এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে দলীয়করণ করলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে সংসদীয় গণতন্ত্র। রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য উচ্চকক্ষ, উচ্চশিক্ষা কমিশন, রাজনীতি কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন, অপরাধ দমন কমিশন এবং সাংবিধানিক আদালতের প্রয়োজনীয়তা বইটিতে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
সর্বদলীয় সমঝোতা বা চুক্তি সংসদীয় গণতন্ত্রের জীবনপ্রদীপ। লেখক এই গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এ দেশে রাজপথে সবসময় শক্তির মহড়া চলে। রাজপথে যারা জয়ী তারা ক্ষমতাসীন হয় এবং ক্ষমতায় টিকে থাকে। এ দেশে কোনো দলের ভিতর গণতন্ত্রের অনুশীলন নেই। মসজিদ থেকে শুরু করে গুলশান ক্লাব পর্যন্ত কোথাও ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় না। ফলে আমজনতা গণতন্ত্রের সুফল ঘরে তুলতে পারে না। দলীয় ইশতেহারে জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা যাতে কোনো দল ভঙ্গ করতে না পরে তার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে মানবাধিকার আদালত গঠন করা যেতে পারে। ক্ষমতা অনুপাতে জবাবদিহির কাঠামো মজবুত করতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে।’
Tell Me Everything
টেল মি এভরিথিং
এলিজাবেথ স্ট্রাউট
প্রকাশক: র্যান্ডম হাউস, নিউইয়র্ক
প্রকাশকাল: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩৫২, মূল্য: ২১ ডলার
পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী কথাসাহিত্যিক এলিজাবেথ স্ট্রাউট নতুন উপন্যাসে বন্ধুত, পুরোনো ভালোবাসা এবং পৃথিবীতে নিজের চিহ্ন রেখে যাওয়া মানব আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন। এলিজাবেথ তার এ উপন্যাসও স্থাপন করেছেন মেইনের ক্রসবি শহরে। কাহিনিতে বলা হয়, এক শরতে আইনজীবী বব বার্জেস আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে বাঁচানোর কাজে। লোকটার বিরুদ্ধে তার মাকে খুনের অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে নারী লেখক লুসি বার্টনের বন্ধুত্বের সম্পর্কেও জড়ায় বব বার্জেস। অবসর সময়ে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তারা নিজেদের জীবন সম্পর্কে, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আফসোস, ভয়-সন্দেহ- সবকিছু সম্পর্কে কথা বলে। লুসির পরিচয় হয় অলিভ কিটারিজ নামের আরেকজনের সঙ্গে; সেও একা থাকে অবসর যাপন করা লোকদের সমাজে, শহরের এক কোনায়। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা অলিভের বাসায় তার সঙ্গে সময় কাটায় লুসি। তখনো একজন আরেকজনকে নিজের জীবনের গল্প বলে। পরিচিত মানুষদের কথাও বলে। লুসির মতে, ‘ভালোবাসা বিভিন্ন অবয়বে বারবার আসে। তবে ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা হয়েই থাকে।’ এলিজাবেথের এ উপন্যাস মানুষের জন্য মানুষের সমবেদনার কথা বলে।
টিভিতে খবর দেখলাম- সব থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে।
তখন আমার মনে পড়ল, একটা জিডি করা প্রয়োজন।
কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বৈদ্যুতিক পোস্টপেইড মিটার চুরি হয়েছে। জিডি না করলে নতুন মিটার মিলবে না। অগত্যা জিডি লিখে নিয়ে স্থানীয় থানায় গেলাম।
রিসিভ কপি নেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘কত দেব?’
‘জিডি করতে টাকা লাগে না স্যার।’ দায়িত্বে থাকা পুলিশ জানাল।
মনে মনে বললাম, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এর আগে যতবার থানায় এসেছি, টাকা না দিলে জিডি হতোই না।
নতুন বাংলাদেশের এ এক নতুন রূপ!
বের হয়ে যাব ভাবছি, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
‘স্যার, ও স্যার। একটু শুনে যান।’
বাম পাশে হাজতখানা। তার ভেতর থেকে কে যেন ডাকছে।
‘আমাকে বলছেন?’
‘জি স্যার। একটু এদিকে আসবেন।’
এগিয়ে যেতেই দেখি, এই এলাকার প্রাক্তন এমপি। বুঝলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে এনেছে।
‘কিছু বলবেন?’
‘জি স্যার। আমাদের দলের জামান উকিলকে খবর দিতে পারবেন? আমার জামিনের আবেদনটা করাতাম।’
মনে পড়ল, একবার এই এমপি সাহেবের কাছে একটা প্রয়োজনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই, আমার কাজটা যদি করে দিতেন, খুব উপকার হয়। তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ভাই কীসের, স্যার বলুন। স্যার।’
সেই তিনি এখন আমাকেই ‘স্যার’ ডাকছেন।
‘আপনি লিডার মানুষ। দলের লোকজন আপনাকে দেখতে আসবেই। তাদেরকে উকিল ডেকে দিতে বলতে পারেন।’
‘ওরা কেউ আসবে না স্যার। বিপদে পড়েছি। বিপদে পড়লে এসব মধুলোভী মৌমাছিরা কেউ পাশে থাকে না।’
‘আপনি পালিয়ে যেতে পারতেন। সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি পারলেন না?’
‘দিয়েছিলাম স্যার। বাধ্য হয়ে ধরা দিয়েছি।’
গল্পের গন্ধ পেলাম। বাইরে আরও জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
‘কী ঘটেছিল? কীভাবে ধরা পড়েছিলেন?’ জানতে চাইলাম।
তিনি বলতে শুরু করলেন-
“আমি বা আমার দলের কেউই ভাবিনি, তিনি আমাদের অথই জলের মধ্যে এভাবে ফেলে পালিয়ে যাবেন। তার পালানোর খবর যখন পেলাম, তখন আমি মাত্র দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। শহরের চারদিক থেকে মারামারির খবর আসছিল। আমার ছেলেরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মন মনে ক্ষীণ আশা ছিল, যেহেতু সেনাবাহিনী মাঠে আছে শেষপর্যন্ত আমরাই জিতব।
তার পালানোর খবর শুনে সবার আগে মাথায় এল আমাকেও পালাতে হবে। দুপুরের খাওয়া আর হলো না। পরিবারের সবাইকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। টাকা-পয়সা, গহনা, সঞ্চয়পত্রসহ যা যা পারল, ওরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওরা চলে যাওয়ার পর শূন্য ঘরটিতে আমি তাকালাম। স্মৃতিবিজড়িত কত কিছুই না থেকে গেল। আমার বাসাসংলগ্ন একটা ঘরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। সেই ঘরে গেলাম। আলমারিতে সাজানো থরে থরে ক্রেস্ট আর মেডেলগুলোর দিকে তাকালাম।
মনে হলো, ক্রেস্টের লেখাগুলো আমাকে উপহাস করছে। দাঁত বের করে হাসছে।
জনদরদি নেতা!
কৃষকের বন্ধু!
মহান নেতা!
গরিবের বন্ধু!
কত উপমাই না লেখা হয়েছে আমাকে ঘিরে।
মোবাইল বেজে উঠল। এসপির কল।
‘স্যার, এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যান। পাবলিক আপনার বাসার দিকে এগিয়ে আসছে।’
চমকে উঠলাম।
বাসা থেকে বের হতে হবে। দ্রুত।
নিজেকে তাড়া দিলাম। তখনই আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরল।
গত পনেরো বছরে সবসময় অন্যের পরামর্শে চলেছি। এখন আমার পাশে কেউ নেই। আমি কোথায় যাব? কে আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবে।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
আবার ফোন।
‘মামা, তাড়াতাড়ি পালান।’ ভাগ্নের গলা।
পালালাম আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বাসার পেছন দিক দিয়ে। রাস্তায় বের হওয়ার মুখে বাধা পেলাম। একের পর এক মিছিল যাচ্ছে। আবার অন্যদিক থেকেও আসছে।
সবাই আমার বিরুদ্ধে। আমি এক জায়গায় লুকিয়ে পড়লাম।
ফলে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারলাম। শেষে ঠিক করলাম, বর্ডার এলাকায় চলে যাব। ওখানে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা আছে।
সবার আগে মোবাইলটা ফেলে দিলাম। ফেলে দিতে অবশ্য মায়াই লাগল। অত দামি একটা ফোন।
উপহার হিসেবে পাওয়া।
তবু জান বাঁচানো ফরজ ভেবে নিজেকে বুঝ দিলাম। সন্ধ্যার পর রওনা হলাম।
খালার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা। আমার ডাক শুনে সবাই জেগে উঠল।
আমি বেঁচে আছি দেখে সবাই স্বস্তি প্রকাশ করল।
‘এখন কী করবেন ভাইজান?’ নাজমুল বলল। খালাতো ভাই।
‘বর্ডার পার হব। ইন্ডিয়া যেতে পারলে বেঁচে যাব।’
‘যাবেন কীভাবে ভাইজান? বর্ডারে খুব কড়াকড়ি।’
‘যেভাবে পারিস ভাই। যত টাকা লাগে দেব। তুই শুধু ম্যানেজ কর।’
অনুনয় করলাম।
‘আচ্ছা দেখছি ভাই।’ বেরিয়ে গেল নাজমুল।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরল সে।
‘ভাই, আজ রাতে ভোরে পার হওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যার পর চেষ্টা করতে হবে।’
‘আজ কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়?’
কাঁটাতারের বেড়া। সার্চলাইট। আর বিএসএফের পাহারা। সব মিলিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে ভাইজান?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
‘আমার সঙ্গে আসেন ভাইজান।’
নাজমুল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমাদের বাসায় রাখা যাবে না। তাই আপনাকে অন্য জায়গায় রেখে আসতে যাচ্ছি।’
‘কার বাসায়?’
‘কারও বাসায় না ভাইজান। সেটা রিস্ক হয়ে যাবে।’
‘তাহলে?’
‘এখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে না? আজ রাতে ওখানে থাকুন। কেউ সন্দেহ করবে না।’
আবছাভাবে আমার মনে পড়ল। পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। জঙ্গল দিয়ে ভরা।
‘ওই জঙ্গলভরা বাসায় কীভাবে থাকব?’ সংশয় প্রকাশ করলাম।
‘জঙ্গল আর নেই ভাইজান। আমরাই কেটে সাফ করেছি।’
‘কেন?’
‘ওই জমিদার বাড়িটা দেখতে অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে। তখন স্থানীয়রা মিলে নিজেরাই পরিষ্কার করেছি।’
‘রাতে থাকার মতো ব্যবস্থা?’
‘ওখানে নেশাখোররা আস্তানা বানাতে চেয়েছিল। তাই আমরা পালা করে ওই জমিদার বাড়িতে থাকি।’
‘আজ কি আমি একাই থাকব?’
‘না ভাইজান। আমি বাইরের ঘরে আপনাকে পাহারা দেব।’
স্বস্তি পেলাম। যত দূরের সম্পর্কই হোক, ভাই তো। আজ রাতটা কোনোমতে কাটুক।
জমিদার বাড়িটা পুরোনো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। চার্জার লাইট রেখে আমাকে আমার বিছানা দেখিয়ে নাজমুল বের হয়ে গেল।
‘ভাইজান, দরকার হলে ফোন দিয়েন।’
শুয়ে পড়লাম আমি। চারপাশে অন্ধকার। দূরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। পাতার সর সর শব্দ। টের পেলাম দুচোখে ঘুম আসছে না।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।
‘ক্যামন আছেন?’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল কে যেন।
হিমশীতল আতঙ্ক বয়ে গেল আমার সারা শরীরে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। একে তো ক্ষমতা হারানোর শোক। তার ওপর রাজকীয় জীবন হঠাৎ হারিয়ে ভিখারির জীবনে প্রবেশ। আর এখন মাঝরাতে অজানা নির্জন জমিদার বাড়িতে বসে ভূতুড়ে গলার আওয়াজ আতঙ্কে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।
‘বললেন না ক্যামন আছেন?’
‘ভা...লো...নে...ই।’
‘কেন?’
‘ক্ষ...ম...তা হারিয়েছি। ইন্ডিয়া পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আজ রাতের মধ্যে। সীমান্তের কড়াকড়ির জন্য পারছি না।’
‘আমিও পারছি না। সেই কবে থেকে চেষ্টা করছি।’ অন্ধকার চিরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভেসে এল।
‘আপনিও কি আমার মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
তার জবাব শুনে ভরসা পেলাম। যাক, আমি তাহলে একা নই।
‘আপনি কী করেন?’ জানতে চাইলাম।
‘জিজ্ঞেস করুন কী করতাম না। ড্রাগস, চোরাচালান, মাদক।’
‘তাহলে তো পুলিশ আপনাকে খুঁজবেই।’
বলার পরই বুঝতে পারলাম শব্দটা পুলিশ হবে না। পুলিশও তো আমার মতো পালিয়েছে।
‘পুলিশ না। আমি পালিয়েছি জনতার ভয়ে।’
আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি সেটা স্মরণ করলাম।
‘কখন বের হয়েছেন বাসা থেকে?’
‘বেশ কিছুদিন হলো।’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাটি বলল।
সন্দেহ হলো। সরকার পতন হলো আজ আর ব্যাটা বলে কিনা কয়েকদিন আগে পালিয়েছে।
‘এই কয়দিনে বর্ডার পার হতে পারেননি?’
‘না। দালালটা বলল আমি সন্ধ্যায় এসে আপনাকে নিয়ে যাব। পরে আর এলই না। আমার টাকা-পয়সা সব নিয়ে ভেগেছে।’
‘কত তারিখে এসেছেন আপনি?’
‘ছয় ডিসেম্বর।’
চমকে গেলাম।
আজ পাঁচ আগস্ট। আর উনি কি না বলছেন ডিসেম্বরে এসেছেন!
রেগে গেলাম। ‘কত সালে?’
‘উনিশ শ নব্বই সালে।’
উনিশ শ নব্বই সালের ছয় ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়েছিল। আমিও সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম।’
কিছু একটা বলতে যাব তার আগেই প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো।
সেই বজ্রপাতের ক্ষণিকের আলোয় দেখলাম আমার সামনে একটা কংকাল বসে আছে। যেন দাঁত বের করে হাসছে। পড়িমড়ি করে বের হয়ে এলাম। ছুটতে ছুটতে কখন যে সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছি নিজেও জানি না।’
একনাগাড়ে বলার পর থামলেন নেতা।
‘সামান্য একটা কংকাল দেখে পালিয়ে এলেন।’ হেসে জানতে চাইলাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। নির্জন জমিদার বাড়িতে ভূতের হাতে অপঘাতে মরার চেয়ে জেলখানায় থাকা অনেক ভালো। একদিন না একদিন জামিন পাবই।’
হেসে ফেললাম।
‘আপনি এখন জেলেই আছেন।’
‘কে ওখানে?’ একজন কনস্টেবল এগিয়ে এল।
নিজের পরিচয় দিলাম।
‘বৃষ্টির জন্য আটকে পড়েছি।’
‘হাজাতির সঙ্গে আলাপ করা নিষেধ।’ বলল কনস্টেবল।
‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে ডাকলেন।’
‘নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে ভূতুড়ে জমিদার বাড়ির গল্পটা বলেছে আপনাকে?’
‘বানানো?’
‘আমাদের স্যাররা বর্ডার থেকে অনেক কষ্ট করে ধরে এনেছেন তাঁকে।’
‘উনি নাকি নিজে নিজেই ধরা দিয়েছেন।’
‘ক্ষমতা হারাইছে তো। মাথাটাথা আউলায় গেছে।’ হেসে বলল কনস্টেবল।
নির্লজ্জ সময়ের কাছে তোমাকে সপে দিলাম
মৃত্যুকে ঐ দূরবর্তী কোনো নক্ষত্র ভেবে আলিঙ্গন করিও
দংশিত শরীর পুড়ছে পুড়ুক তবুও চিৎকার দিতে নেই
কোন্দলে কোন্দলে মলিন হোক মুখোশ পরিহিত
সার্কাসের ক্রাউন...
আমার পিঠ এখনো শক্ত- ঘাড় করেছি মজবুত
সহ্য শক্তিও বেড়েছে অনেক- পূর্বপুরুষের মতো-
কাকে তুমি মৃত্যু বলো?
গভীর অন্ধকার- উল্লাসে উল্লাসে পুড়ে যাচ্ছে বাড়ি।
খড়ের বিছানার কথা বলে যারা বেছে নেয় মকমল
তারাও জানত আলো আসবে- উৎকট গন্ধ
যতই ছড়িয়ে পড়ুক চারিপাশ-
দুর্যোগ-কান্নায় যখন তুমি তাকাও আমার দিকে
প্রকম্পিত ঠৌঁট, চোখে ছলছল জল-
বড় একাকিত্বের বেদনায় রক্ত ঝড়ায়-ফকির-সন্ত...