ঢাকা ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলাম
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলাম

নব ঋত্বিক নবযুগের!
নমস্কার! নমস্কার!
আলোকে তোমার পেনু আভাস
নওরোজের নব ঊষার!
তুমি গো বেদনা-সুন্দরের
দরদ্-ই-দিল্, নীল মানিক,
তোমার তিক্ত কণ্ঠে গো
ধ্বনিল সাম বেদনা-ঋক্।
...................................
মানুষের কবি! যদি মাটির
এই মানুষ বাঁচিয়া রয় –
রবে প্রিয় হয়ে হৃদি-ব্যাথায়,
সর্বলোক গাহিবে জয়।

অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ‘শরৎচন্দ্র’ নামাঙ্কিত এই কবিতাটি রচনা করেন। উক্ত কবিতাটি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে আশ্বিনের নওরোজে প্রকাশিত হয়। পাদটীকায় বলা হয়: ‘স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দ্বিপঞ্চাশৎ বর্ষ জন্মোৎসব উপলক্ষে রচিত।’ রচনার স্থান ও তারিখ: কৃষ্ণনগর, ২৯ ভাদ্র, ১৩৩৪। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর কবিতাটি ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে মাঘের বুলবুলে পুনর্মুদ্রিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরও একবার ফিরে দেখা বাংলা সাহিত্যজগতের দুই খ্যাতনামা চিন্তক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ককে। জীবদ্দশায় একাধিকবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল, তা সত্যিই শিক্ষণীয়। সেরকমই কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম:

১) ২৪শে জুলাই, ১৯২২ সালে কলেজ স্কোয়ারে বঙ্গীয় থিওসফিক্যাল সোসাইটির হলে সরস্বতী ইনস্টিটিউশন আয়োজিত এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সত্যেন্দ্র-স্মৃতিসভায় কাজী নজরুল ইসলাম স্বরচিত শোক সঙ্গীত ‘চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে’ গেয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্মরণসভায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য দেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, চারু চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

২) কাজী নজরুল ইসলামের একক সম্পাদনায় ২৬শে শ্রাবণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে (১১ই আগস্ট, ১৯২২) সপ্তাহে দুবার প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শিবপুর থেকে ৯ই আগস্ট, ১৯২২ সালে ধূমকেতুর প্রকাশ উপলক্ষে নজরুলকে দেওয়া এক শুভেচ্ছা পত্রে লেখেন:
                                            ২৪শে শ্রাবণ,১৩২৯ 
                                                      শিবপুর  
পরম কল্যাণীয়বরেষু,
তোমার কাগজের দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া তোমাকে একটিমাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্ব্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার। তারপরে ভগবান তোমার কাগজের ভার আপনি বহন করিবেন।
                                        তোমাদের-
                          শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

৩) ১৭ই মে, ১৯২৩ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীমতী লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে পত্রখানি লেখেন:
হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল উপোস করিয়া মর-মর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজী হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখি না। একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া বোধহয় এখন কেহ আর এত বড় কবি নাই।...
                                                      দাদা

শরৎচন্দ্র শিবপুর থেকে এসে হুগলি জেলে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে সচেষ্ট হন, কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় নজরুলকে অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানাতে পারেন নি।      

৪) ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সালে শরৎচন্দ্রের ৫২তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় নজরুল অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বরচিত ‘কোন শরতে পূর্ণিমা চাঁদ আসিলে এ ধরাতল’ গানটি পরিবেশন করে শরৎচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। গানটি হলো - 

কোন শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল।
কে মথিল তব তরে কোন্ সে ব্যথার সিন্ধু-জল।।
দুয়ার-ভাঙা জাগল জোয়ার বেদনার ঐ দরিয়ায়।
আজ ভারতী অশ্রুমতী মধ্যে দুলে টলমল।।
কখন তেমার বাজল বেণু প্রাণের বংশী-বট-ছায়।
মরা গাঙের ভাঙা ঘাটে ঘট ভরে গোপিনীদল।।
বিদ্যুতের বাঁকা হাসি হাসিয়া কালো মেঘে,
আসিলে কে অভিমানী বহায়ে মরুতে ঢল।।
লয়ে হাতে জিয়ন-কাঠি আসিলে কে রূপ-কুমার
উঠল জেগে রূপ-কুমারী আঁধারে ঐ ঝলমল।।
আকাশে চকোরী কাঁদে, তড়াগে চাহে কুমুদ
ঝরুক আঁখির শেফালিকা ছুঁয়ে তব পদতল।।

৫) ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ সালে (৩১ ভাদ্র, ১৩৩৫) প্রমথ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিরুপমা দেবী রচিত উদ্বোধনী সংগীত ‘তুমি যে মধুকর কমল বনে’ পরিবেশন কালে দিলীপ কুমার রায়, নলিনীকান্ত সরকার ও সাহানা দেবীর সঙ্গে নজরুল কন্ঠ দেন। গোপালচন্দ্র রায়ের ‘শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়- ১৩৩৫ সালের ৩১শে ভাদ্র শরৎচন্দ্রের ৫৩তম জন্মদিবসে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে এক মহতি সভায় সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। ঐ সভায় সভাপতি ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের ঐ সম্মাননা সভায় একটি বাণী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কবির সেই বানীটি এই-

শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্মাননা সভায় বাঙ্গলা দেশের সকল পাঠকের অভিনন্দনের সঙ্গে আমার অভিনন্দন বাক্যকে আমি সম্মিলিত করি। আজও সশরীরে পৃথিবীতে আছি, সেটাতে সময় লংঘনের অপরাধ প্রত্যহই প্রবল হচ্ছে, সে কথা স্মরণ করাবার নানা উপলক্ষ সর্বদাই ঘটে, আজ সভায় সশরীরে উপস্থিত থেকে সকলের আনন্দে যোগদান করতে পারলুম না, এও তারই মধ্যে একটা। বস্তুতঃ আমি আজ অতীতের প্রান্তে এসে উত্তীর্ণ - এখানকার প্রদোষান্ধকার থেকে ক্ষীণ কর প্রসারিত করে তাঁকে আমার আশীর্বাদ দিয়ে যাই, যিনি বর্তমান বাংলা সাহিত্যের উদয় শিখরে আপন প্রতিভা জ্যোতি বিকীর্ণ করছেন।

ড. অজিতকুমার ঘোষের লেখা ‘শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্য বিচার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়-
সংবর্ধনার উত্তরে শরৎচন্দ্রের বক্তব্য: ‘হেতু যত বড়ই হোক, মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মে যায় আমার লেখা কোনদিন যেন না এতবড় প্রশ্রয় পায়। কিন্তু অনেকেই তা আমার অপরাধ বলে গণ্য করেছেন এবং যে অপরাধে আমি বড় লাঞ্ছনা পেয়েছি, সে আমার এই অপরাধ। পাপীর চিত্র আমার তুলিতে মনোহর হয়ে উঠেছে। আমার বিরুদ্ধে তাঁদের সবচেয়ে বড় এই অভিযোগ। এ ভালো কি মন্দ আমি জানিনে, এতে মানবের কল্যাণ অপেক্ষা অকল্যাণ অধিক হয় কিনা এ বিচার করেও দেখিনি - শুধু সেদিন যাকে সত্য বলে অনুভব করেছিলাম তাকেই অকপটে প্রকাশ করেছি৷ এ সত্য চিরন্তন ও শাশ্বত কিনা এ চিন্তা আমার নয়। কালে যদি সে মিথ্যা হয়েও যায় - তা নিয়ে কারও সঙ্গে আমি বিবাদ করতে যাব না।’ 

সাহিত্যের চিরন্তনত্ব সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করিয়া তিনি সেই অভিভাষণে বলেন, ‘কোন দেশের কোন সাহিত্যই কখনো নিত্যকালের হয়ে থাকে না। বিশ্বের সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মত তারও জন্ম আছে, পরিণতি আছে, বিনাশের ক্ষণ আছে। মানুষের মন ছাড়া তো সাহিত্যের দাঁড়াবার জায়গা নেই, মানবচিত্তই তো একস্থানে নিশ্চল হয়ে থাকতে পায় না! তার পরিবর্তন আছে, বিবর্তন আছে, তার রসবোধ ও সৌন্দর্য বিচারের ধারার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই একযুগে যে মূল্য মানুষে খুশি হয়ে দেয় আর একযুগে তার অর্ধেক দাম দিতেও তার কুণ্ঠার অবধি থাকেনা।’

৬) ১২ই অক্টোবর, ১৯২৮ সালে সাপ্তাহিক সওগাতে ‘নজরুল-সম্বর্ধনা’ বিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হয়। নজরুল ইসলামকে সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য সভায় এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়, কমিটির সহসভাপতি হিসেবে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্বাচন করা হয়।

প্রকাশিত সংবাদ: 
গত ৯ই অক্টোবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে খান বাহাদুর মৌলবী আসাদুজ্জামান এম.এ.বি-এল সাহেবের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় এত লোকের সমাগম হইয়াছিল যে, সম্পূর্ণ হলে তিল ধারণের স্থান ছিল না। উপরন্তু হলের সম্মুখস্থ ও পিছনের বারান্দাও জনতায় ভরিয়া গিয়াছিল। সমবেত মুসলিম তরুণের ঘন ঘন আনন্দ করতালিতে সভাস্থল সরগরম হইয়া উঠিয়াছিল। এই সভায় তরুণ মুসলিমের যে প্রাণের সাড়া পাওয়া গিয়াছে, তাহা অপূর্ব। বাংলার যুগপ্রবর্তক কবি নজরুল ইসলামকে সমগ্র বাংলার পক্ষ হইতে সম্বর্ধনা দিবার জন্য সভায় এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইয়াছে। তাহাতে নিম্নলিখিত ভদ্র মহোদয়গণ কর্মকর্তা নির্বাচিত হইয়াছেন।

সভাপতি- মিঃ এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
সহ-সভাপতি- শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রায় শ্রী জলধর সেন বাহাদুর, মৌঃ এ.কে.ফজলুল হক, খান বাহাদুর মোলবী আসাদুজ্জামান, মিঃ দিলীপকুমার রায়, ডাঃ আর. আহমদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
সম্পাদক- শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ, সম্পাদক, কল্লোল; মৌঃ এম. নাসিরুদ্দীন, সম্পাদক, সওগাত।
সহ-সম্পাদক- সৈয়দ জালালুদ্দীন হাশেমী, শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্র, মৌঃ আবুল মনসুর আহমদ, মৌঃ মোয়ায়েদ বখত চোধুরী, মৌঃ আয়নুল হক খাঁ।
কোষাধ্যক্ষ-মিঃ এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
অভ্যর্থনা সমিতি অফিস- ১১নং ওয়েলেসলী স্ট্রীট, কলিকাতা।

৭) ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৩১ সালে নিউ থিয়েটার্সের প্রথম সবাক ছায়াছবি শরৎচন্দ্রের ‘দেনা পাওনা’ কলকাতার চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পায়। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত এই ছায়াছবির মহরত অনুষ্ঠানে নজরুল উপস্থিত ছিলেন এবং মহরত অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গানে অংশ নিয়েছিলেন।

৮) কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িতে ছিল নজরুলের নিত্য যাতায়াত। দুজনেই দাবা খেলতে খুব ভালবাসতেন। সেরকমই একদিনের ঘটনা - ‘‘নজরুল একদিন আমাকে ও আড্ডিকে সাহিত্যিক শরৎ চ্যাটার্জির বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। নির্দিষ্ট দিনে আমাদের দুইজনকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে সন্ধ্যার সময় মনোহরপুকুর রোডে শরৎ বাবুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ শরৎচন্দ্র দাবাগুটি সাজিয়ে একা একা বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। উনি বললেন, ‘তোমরাই দুজনে খেল, আমি শুধু দেখব।’ খেলা শুরু হল। আমাদের এক বাজী খেলতে খেলতেই রাত প্রায় বারোটা হয়ে গেল। শরৎবাবু মাঝে মাঝে উভয়দিকে দুই-একটা চাল বাতলাতে লাগলেন। দুইজনেই বুঝলাম উনি কেমন খেলেন। ভদ্রতার খাতিরে, ওঁর চাল গ্রহণ করলে পরিণাম কেমন দাঁড়াবে সেকথা বুঝিয়ে দিয়ে আমরা নিজেদের পছন্দ মত চালই দিতে লাগলাম। দুইজনেই খুব সতর্ক ভাবে খেলাতে শেষমেশ বাজীটা চটে গেল। শরৎবাবু ‘লাল মন্তি’ (লাল মন্ত্রী) - সম্বলিত একটা চমৎকার গল্প লিখেছেন বলে অনেকের ধারণা, তিনি মস্ত বড় দাবা খেলোয়াড়। কিন্তু আসলে তা নয় - তিনি মাঝারিগোছের খেলোয়াড় ছিলেন।’

৯) ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁকে সংবর্ধনা প্রদানের বিশাল আয়োজন করে। এ উপলক্ষে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘শরৎ-শর্বরী’ অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের উপস্থিতিতে নজরুল স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় এটিই ছিল তাঁর শেষ জন্মোৎসব। ড. অজিতকুমার ঘোষের লেখা ‘শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্য বিচার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় - ‘১৩৪৪ সালের ৩১শে ভাদ্র জীবিত শরৎচন্দ্রের শেষ জন্মোৎসব পালিত হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটু ঘটা করিয়া শরৎচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁহাকে সংবর্ধনা জানাইবার আয়োজন করা হইয়াছিল। স্টেশন-ডিরেক্টর মি. স্টেপলটন এই সংবর্ধনায় বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হইয়াছিল শরৎ-শর্বরী। এই অনুষ্ঠানটি সম্বন্ধে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, ‘কোলকাতা বেতারে সেদিনকার শরৎ-শর্বরী সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই শরৎচন্দ্রের দীর্ঘ জীবন কামনা করে কিছু কিছু বক্তৃতা দান করেন। সকলেরই ভাষণ খুব আন্তরিকতাপূর্ণ হয়েছিল। সকলের বলা শেষ হলে, শরৎচন্দ্র তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে অল্প কথায় কিছু বলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন প্রার্থণা সম্বন্ধে তিনি যা বলেছিলেন তার মোটামুটি কথা এই যে, দীর্ঘ জীবন বাইরে থেকে সাধারণত দেখতে ভালো হলেও সব সময়ে ও সব ক্ষেত্রে উহা কাম্য নয়। যদি স্বাস্থ্য, শান্তি ও কর্মশক্তি অটুট থাকে, দেশ, সমাজ ও লোকসেবা করবার ক্ষমতা থাকে, কোনদিকে কোনরূপ অশান্তি না থাকে তবেই দীর্ঘ জীবন কাম্য। কিন্তু মানসিক অশান্তি ও দৈহিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যে, দীর্ঘ জীবন - তেমন দীর্ঘ জীবনকে তিনি ভাগ্যের অভিসম্পাত বলেই মনে করেন। ব্যাধিপীড়িত হয়ে কর্মশক্তি হারিয়ে তিনি একদিনও বাঁচতে চান না।’

‘বেতার-জগৎ’-এ অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল তা উদ্ধৃত হলো, ‘‘গত ১৭ই সেপ্টেম্বর শুক্রবারের সান্ধ্য অনুষ্ঠানে সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের জন্মতিথি উপলক্ষে শরৎ-শর্বরীর অধিবেশন অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে সুসম্পন্ন হয়ে গেছে। এই অধিবেশনে নাটোরের মহারাজা, কাশিমবাজারের মহারাজা, রায়বাহাদুর জলধর সেন, রায়বাহাদুর এন কে সেন, শ্রীযুক্ত কালিদাস রায়, শ্রীযুক্ত গিরিজাকুমার বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র দেব, শ্রীযুক্ত মুকুলচন্দ্র দে, শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্র কুমার রায়, শ্রীযুক্ত অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলেছিলেন। শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য বলেছিলেন অতি সংক্ষেপে ও প্রাণ-স্পর্শী ভাষায়। স্বয়ং শরৎচন্দ্র ও সমাগত সুধী ব্যক্তিরা খুবই খুশি হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র রচিত ‘সতী’ গল্পের নাট্যরূপ ও অভিনয় দর্শনে।’’

গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা ‘শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থ থেকেও এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। উক্ত অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের অনুভূতি - ‘‘৬২ বৎসর বয়সে পা দিয়ে আমার জন্মতিথি উপলক্ষে সকলের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেবার পূর্বে আমার গুরুদেব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, যিনি আজ রোগশয্যায়, তাঁকে প্রণাম করি। এ জগতে সাহিত্য-সাধনায় তাঁর আশীর্বাদ এটি শুধু আমার নয়, প্রতি সাহিত্যিকের পরম সম্পদ। সেই আশীর্বাদ আজকের দিনে চেয়ে নিলাম। 
নিজের সাহিত্য-সাধনার ব্যাপার নিজের মুখে কিছু বলা যায় না। শুধু এইটুকু ইঙ্গিতে বলতে পারি যে, অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে এই সাধনায় ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছি।... আমি আপনাদের মাঝে বেশিদিন থাকি বা না থাকি, আমার এ কথাটা হয়ত আপনাদের মাঝে মাঝে মনে পড়বে যে, অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য-সাধনা ধীরে ধীরে বাধা ঠেলে চলেছিল।’’

শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবর্ধনা প্রদানের তথ্য যখন সামনে আসে, তখন অবধারিতভাবেই শরৎচন্দ্রের রেডিওপ্রীতির কথা মনে পড়ে। শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ের বাড়িতে রেডিও ছিল। সেই নির্জন গ্রামে বসে তিনি রেডিওতে গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন। এ সম্পর্কে একবার তিনি লিখেছিলেন - ‘শহর হইতে দূরে গ্রামের মধ্যে আমার বাস। অতীতের নানা প্রকার আমোদ ও আনন্দের প্রাত্যহিক আয়োজন গ্রামে আর নেই, পল্লী এখন নির্জীব নিরানন্দ। কর্মক্লান্ত দিনের কত সন্ধ্যায় এই নিঃসঙ্গ পল্লী ভবনে বেতারের জন্য উৎসুক আগ্রহে অপেক্ষা করিয়াছি। শ্রাবণের ঘন মেঘে চারিদিক আছন্ন হইয়া আসে, কর্দমাক্ত জনহীন গ্রাম্যপথ নিতান্ত দুর্গম, নিবিড় অন্ধকার ভারের মত বুকের পরে চাপিয়া বসে, তখন বেতার-বাহিত গানের পালায় মনে হয় যেন দূরে থাকিয়াও আসরের ভাগ পাইতেছি।
আবার কোনদিন ক্ষান্তবর্ষণ আকাশে লঘু মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো দেখা দেয়, বর্ষার সুবিস্তীর্ণ নদীজলে মলিন জ্যোৎস্না ছড়াইয়া পড়ে, আমি তখন প্রাঙ্গণের একান্তে নদীতটে আরাম কেদারায় চোখ বুঝিয়া বসি। তামাকের ধূঁয়ার সঙ্গে মিশিয়া বেতারে বাঁশির সুর যেন মায়াজাল রচনা করে। দু-একজন করিয়া প্রতিবেশী জুটিতে থাকে, ঘাটে বাঁধা নৌকায় দূরের যাত্রী, কৌতূহলী দাঁড়ি মাঝির দল নিঃশব্দে আসিয়া ঘিরিয়া বসে, আবার শেষ হইলে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া যে যাহার আলয়ে চলিয়া যায়। এই আনন্দের অংশ আমি পাই।’

১০) শরৎচন্দ্রের প্রয়াণে বাংলাসহ ভারতবর্ষের বহু জায়গায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু গুণী মানুষ তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কবিতা লেখেন। কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন- 

সেদিন দেখেছি আকাশের শোভা 
শরৎ-চন্দ্র তিলকে।
শূন্য গগন বিষাদ মগন
সে তিলক মুছি দিল কে।।

তথ্যঋণ:
১. নজরুল কবিতা সমগ্র এবং নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ 
২. নজরুল তারিখ অভিধান: মাহবুবুল হক
৩. সমকালে নজরুল ইসলাম: মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
৪. কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুলচর্চা, সংকলন ও সম্পাদনা: তপন বাগচী
৫. শরৎচন্দ্র: গোপালচন্দ্র রায়
৬. শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্যবিচার: ড. অজিত কুমার ঘোষ

লেখক: নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

নজরুলের সখ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:১১ পিএম
আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৪ পিএম
নজরুলের সখ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘সখ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই যেমন একরকম নই- বৈচিত্র্যই আমাদের অনন্যতা দান করেছে, ঠিক তেমনই আমাদের সখও একেকজনের একেকরকম। পৃথিবীর বহু গুণী মানুষের সখ সম্পর্কে আমরা কৌতূহলী। যাঁরা নজরুলপ্রেমী, মাঝে মাঝে তাঁদের মনের মধ্যেও এই প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি- আমাদের প্রাণের কবির সখ কী ছিল? সত্যিই তো, এ নিয়ে আলোচনা বোধহয় কমই হয়। 

কাজী নজরুল ইসলাম- যাঁর জীবন এত বৈচিত্র্যময়, তাঁর সখও যে নিতান্তই আমার-আপনার মতো খুব সাধারণ কিছু হবে না- এ বিষয়ে সন্দেহ কি? আসাদুল হকের লেখা ‘নজরুল যখন বেতারে’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়- ‘হস্তরেখা গণনা করা’ ছিল নজরুলের একটি সখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই তাঁদের স্মৃতিকথায় এ সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ১৯৪১ সালের ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে বেতারে নজরুলের একটি বক্তৃতা প্রচারিত হয়। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘হাতের রেখা দেখে গণনা আমার একটি সখ’। এ ছাড়া কবির হয়তো অন্যান্য সখও ছিল, কিন্তু এই প্রবন্ধে ‘নজরুলের জ্যোতিষচর্চা’ সম্বন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সুস্থ অবস্থায় নজরুল যাঁদের হাত দেখেছেন, বলাই বাহুল্য যাঁরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের স্মৃতিকথাই এই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।

কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত প্রিয় মানুষদের তালিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের বাহার-নাহার, দুই ভাইবোন। নজরুল তাঁর সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থটি তাঁদেরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে নজরুল লিখেছিলেন-
‘‘- আমার এই লেখাগুলো
বাহার ও নাহারকে দিলাম।-
কে তোমাদের ভালো?
‘বাহার’ আনো গুল্শানে গুল্, ‘নাহার’ আনো আলো।
‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,
‘নাহার’ এলে রাত্রি চিরে জ্যোতির অভিযান।
তোমরা দুটি ফুলের দুলাল, আলোর দুলালী,
একটি বোঁটায় ফুট্লি এসে, নয়ন ভুলালি!
নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী,
তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি!’’

মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, নজরুল যখন চট্টগ্রামে যান তখনো পামিস্ট্রির চর্চা করতেন। ওখানে বসেই কাজী সাহেব একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা; অন্যদিকে তাঁর সখও পূরণ করেছেন। বাহার লিখেছেন- ‘‘কাজী সাহেব চট্টগ্রামে আমাদের বাড়িতে গিয়েছেন কয়েকবার। যে ক’দিন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে, মনে হতো বাড়িখানি যেন ভেঙ্গে পড়বে। রাত্রি ১০টায় থারমোফ্লাস্কে ভরে চা, বাটাভরা পান, কালিভরা ফাউন্টেন পেন, আর মোটা মোটা খাতা দিয়ে তাঁর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতাম। সকালে উঠে দেখতাম, খাতা ভর্তি কবিতা। এক-এক করে ‘সিন্ধু’, ‘তিন তরঙ্গ’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলী’, ‘মিলন মোহনায়’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘নবীনচন্দ্র’, ‘বাংলার আজিজ’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সাতভাই চম্পা’ আরও কত কবিতা লিখেছেন আমাদের বাড়িতে বসে। চট্টগ্রামের নদী, সমুদ্র, পাহাড়, আমাদের বাড়ির সুপারি গাছগুলো আজ অমর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যে। সারারাত কবি চা আর পান খেতেন- আর খাতা ভর্তি করতেন কবিতা দিয়ে। আর দুপুরে কখনো কিছু পড়তেন, কখনো করতেন পামিস্ট্রির চর্চা, কখনো বা মশগুল্ হতেন দাবা খেলায়। বিকেলে দল বেঁধে যেতাম নদীতে, সমুদ্রে। সাম্পানওয়ালারা এসে জুটত, সুর করে চলত সাম্পানের গান। সবাই মিলে গান করতাম, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী’ ‘গহীন জলের নদী’, এক এক সময় চট্টগ্রামী সাম্পানওয়ালারা গাইত ‘বঁধুর আমার চাটি গাঁ বাড়ী- বঁধুর আমার নন্দীর কূলে ঘর।’

ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আবদুল আযীয আল-আমানের ‘নজরুল পরিক্রমা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভবিষ্যৎ-জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে নাহার নজরুলকে হাত দেখিয়েছিলেন।

আবদুল আযীয আল-আমান লিখেছেন- ‘‘কবি বাহার-নাহার ভাই-বোনদের ভাগ্যলিপি পৃথকভাবে কাগজে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজের ভাগ্য জানার জন্য স্বভাবতঃই মানুষ কৌতূহলী। নাহার সাহেবাও একবার ঐকান্তিক আগ্রহে নিজের হাতখানি পর্দার আড়াল হতে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ‘দেখুন তো কবিদা, কতখানি পড়াশোনা লেখা আছে আমার হাতে?’ কবি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে হাত দেখে যে সুদীর্ঘ ভাগ্যলিপি রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি বিশেষ বক্তব্য এই ‘...স্বাস্থ্যভঙ্গ...প্রাণ নিয়ে টানাটানি... প্রিয়জন-বিয়োগ...’  সবশেষে লিখেছিলেন- ‘স্নেহ-মমতার অভাব হবে না কোনদিন,...Partial satisfaction of ambition... ইত্যাদি। কবি অনেকের হাত দেখে এ ধরনের মন্তব্য করতেন, এ জন্য তাঁর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী জনাব মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কাছে মাঝে মাঝে ভর্ৎসনা শুনতেন, তবুও নিরস্ত হতেন না। তাঁর কাছে হস্তরেখা গণনা এবং জ্যোতিষ চর্চা অনেকখানি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।’

নজরুল-সুহৃদ, মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধিচর্চার অন্যতম কাণ্ডারী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই চিঠিগুলো থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের কী গভীর প্রেম। ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে নজরুল চিঠি লেখেন মিস ফজিলতুন্নেসাকে। নজরুল তাঁর প্রকাশিতব্য ‘সঞ্চিতা’ তাঁকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সবাই জানি পরবর্তীতে তিনি ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেছিলেন বিশ্বকবিসম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

ফজিলতুন্নেসাকে নজরুল চিঠিতে লেখেন- ‘‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া। খুব সম্ভব আর একমাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে। আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এ জন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব? সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না- এই আমার আকুল প্রার্থনা।’’

কিন্তু ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কীভাবে? তার বর্ণনা দিতে গিয়েই কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ‘হস্তরেখা গণনা’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন - ‘‘ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না-অথবা ‘বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অংকের এমএ এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন শৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মতো সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।’’ 

ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত

এই স্মৃতিকথা থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, নজরুল নিতান্তই সখের বশে এই কাজ করলেও যথেষ্ট নিবেদিত ছিলেন।

১৯২৮ সালের ১০ মার্চ তারিখে ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলকাতা থেকে নজরুল চিঠি লেখেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘‘আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ীর ‘ভ্রমর’ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বৌ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তর তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনী-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় এক একবার। দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতীন না ঠাওরান!’’ 

এই চিঠিতে নজরুল নিজেই লিখেছেন, তিনি হস্তরেখা গণনা করতে পারতেন। হস্তরেখা দেখে চমৎকার ভবিষ্যৎ গণনাও করতে পারতেন। 

একবার কলকাতায় ওয়েলেসলি স্কোয়ারে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরুল মোতাহার হোসেনের ও তাঁর শ্যালকদের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক শ্যালককে বলেছিলেন, তাঁর ভাগ্যে বিদেশযাত্রা আছে। এ কথা পরে ঠিকই হয়েছিল। আর একজনের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এ বহুদূর দেশে চলে যাবে, অজ্ঞাতবাসের মত।’ - এর মৃত্যু ঘটেছিল। 

প্রিয় মোতাহার সম্বন্ধেও বলেছিলেন, ‘তোমার যশো রেখা খুব স্পষ্ট, বিদেশযাত্রাও হবে, কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধক উত্তীর্ণ হয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে।’ নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকাংশেই মিলে যেত। এর স্বপক্ষে বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।

গ্রামোফোনের রিহার্সেল রুমে মাঝে মাঝে নজরুল হাত দেখার বই জোগাড় করে তাই নিয়ে মেতে থাকতেন। এই হাত দেখা নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন বিখ্যাত নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী আঙুরবালা দেবী। একটি বিশেষ ঘটনার কথা তাঁর লেখনীতেই তুলে ধরলাম- ‘‘আমাদের সময়ে গ্রামোফোনে একজন তবলা বাজিয়ে ছিলেন। নাম রাসবিহারী শীল। খুব গুণী লোক। রাসবিহারী বাবুর তবলা সঙ্গত না থাকলে আমাদের গান যেন জমতেই চাইতো না। একদিন শোনা গেল, জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী মশায় নৌকাযোগে কোথায় যেন গান গাইতে যাবেন, আর তাঁর সঙ্গে তবলা বাজাবার জন্য যাবেন সেই রাসবিহারী বাবু। সেদিন যথারীতি রিহার্সাল রুমে কাজীদার সঙ্গে আমরা গান-বাজনা নিয়ে মেতে রয়েছি। রাসবিহারী বাবু আমাদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করছেন। গান-বাজনার ক্ষণিক বিরতিতে তিনি কাজীদার সামনে ডান হাতটি মেলে ধরলেন: ‘কাজীদা আমার হাতটা একটু দেখুন না।’ এটা তাঁর জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বাইরে যাবার আগের দিনের ঘটনা। কাজীদার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। সেই হাসিমুখেই তিনি রাসবিহারী বাবুর হাত দেখায় মন দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠলো। একসময় রাসবিহারী বাবুর হাত ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সবাই চুপচাপ। হঠাৎ কাজীদার এই ভাবান্তর দেখে আমরাও অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসবিহারী বাবু হাসিমুখে বললেন- ‘কই কাজীদা হাতে কি দেখলেন, বললেন না তো!’ কাজীদা তবুও নিরুত্তর। রাসবিহারী বাবু আবার বললেন ‘বলুন না কাজীদা কি দেখলেন। খারাপ কিছু?’ এবার কাজীদার মুখে মৃদু করুণ হাসি ফুটে উঠলো। রাসবিহারী বাবুকে তাঁর গুণের জন্য কাজীদা খুবই স্নেহ করতেন। তাই ধীরে ধীরে তাঁর পিঠ চাপড়ে বললেন- ‘দূর পাগল খারাপ কেন হবে। ভালোই তো, সব ভালো।’ 

এই কথার পর কাজীদা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তখনকার নামকরা গায়ক ধীরেন দাস সেদিন ঐ ঘরে উপস্থিত ছিলেন। রাসবিহারী বাবু চলে যাবার পর ধীরেন বাবু কাজীদাকে চেপে ধরলেন, ‘বলুন না কাজীদা ওর হাতে কি দেখলেন?’ কাজীদা বললেন, ‘একটু খারাপ জিনিসই দেখলাম।’ নজরুলের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। ক’দিন পর জ্ঞানবাবু গান গেয়ে ফিরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু শোনা যায়, রাসবিহারী বাবুর জ্বর হয়েছিল। এর ক’দিন পর খবর আসে তাঁর সামান্য জ্বর নিউমোনিয়ায় দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করা হয় কিন্তু তাঁর সে নিউমোনিয়া আর ভালো করা যায়নি। মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রাসবিহারী শীল মারা গেলেন। নজরুল পরে ধীরেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বেদনার হাসি হেসে জবাব দিয়েছিলেন,‘হ্যাঁ, আমি সেদিন ওর হাতে মৃত্যুযোগ দেখেছিলাম। বুঝেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়ত রাসবিহারীর মহাবিপদ আসছে। আর সেই জন্যেই আমি কিছু বলিনি সেদিন।’ 

উপরোক্ত ঘটনা থেকে সহজেই ধারণা করা যায়- অবসর সময়ে নজরুল তাঁর প্রিয়জনদের হস্তরেখা গণনা করে সুন্দর সময় কাটাতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবন আলো-আঁধারের মিশেল। তাই এই বিশেষ গুণের অধিকারী নজরুল কখনো কখনো প্রিয় মানুষদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে অগ্রিম জেনে যাওয়ায়, তাঁর মন হতো বিষাদে পরিপূর্ণ।

তথ্যঋণ:
নজরুলের কবিতা-সমগ্র
নজরুলের পত্রাবলি: শাহাবুদ্দীন আহ্‌মদ সম্পাদিত
কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুল চর্চা: তপন বাগচী সম্পাদিত
নজরুল যখন বেতারে : আসাদুল হক
নজরুল স্মৃতি: বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
নজরুল পরিক্রমা: আবদুল আযীয আল-আমান

লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

এ সপ্তাহের নতুন বই

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৪ পিএম
এ সপ্তাহের নতুন বই

ঘরের ভেতর মূল্যবান জিনিস, বইয়ের মতো সুন্দর নয়। বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এমনটিও নয়। সংরক্ষণে রাখতে হয় নতুন প্রজন্মের জন্য। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।’…

সাংবিধানিক চেতনায় মুক্তির অন্বেষা
মু. আবদুল হাকিম
প্রকাশন: কবি প্রকাশনী, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৬০, মূল্য: ৪০০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনার নির্যাস এ বই। বইটিতে আছে ওয়েস্ট মিনস্টার গণতন্ত্রের সারমর্ম তুলে ধরার প্রয়াস। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারদলীয় এবং নির্দলীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি সুষম মিশ্রণ। সংসদ, মন্ত্রিসভা এবং মন্ত্রণালয় হলো সরকারের শক্তিশালী তিনটি দলীয় প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলো সরকারের নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান। দলীয় এবং নির্দলীয় কর্মকাণ্ডের এই সীমান্তরেখা না মানলে বিপন্ন হতে পারে বহুদলীয় গণতন্ত্র। স্থানীয় সরকার এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে দলীয়করণ করলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে সংসদীয় গণতন্ত্র। রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য উচ্চকক্ষ, উচ্চশিক্ষা কমিশন, রাজনীতি কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন, অপরাধ দমন কমিশন এবং সাংবিধানিক আদালতের প্রয়োজনীয়তা বইটিতে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

সর্বদলীয় সমঝোতা বা চুক্তি সংসদীয় গণতন্ত্রের জীবনপ্রদীপ। লেখক এই গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এ দেশে রাজপথে সবসময় শক্তির মহড়া চলে। রাজপথে যারা জয়ী তারা ক্ষমতাসীন হয় এবং ক্ষমতায় টিকে থাকে। এ দেশে কোনো দলের ভিতর গণতন্ত্রের অনুশীলন নেই। মসজিদ থেকে শুরু করে গুলশান ক্লাব পর্যন্ত কোথাও ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় না। ফলে আমজনতা গণতন্ত্রের সুফল ঘরে তুলতে পারে না। দলীয় ইশতেহারে জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা যাতে কোনো দল ভঙ্গ করতে না পরে তার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে মানবাধিকার আদালত গঠন করা যেতে পারে। ক্ষমতা অনুপাতে জবাবদিহির কাঠামো মজবুত করতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে।’  

Tell Me Everything 
টেল মি এভরিথিং 
এলিজাবেথ স্ট্রাউট
প্রকাশক: র‌্যান্ডম হাউস, নিউইয়র্ক  
প্রকাশকাল: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩৫২, মূল্য: ২১ ডলার 

পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী কথাসাহিত্যিক এলিজাবেথ স্ট্রাউট নতুন উপন্যাসে বন্ধুত, পুরোনো ভালোবাসা এবং পৃথিবীতে নিজের চিহ্ন রেখে যাওয়া মানব আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন। এলিজাবেথ তার এ উপন্যাসও স্থাপন করেছেন মেইনের ক্রসবি শহরে। কাহিনিতে বলা হয়, এক শরতে আইনজীবী বব বার্জেস আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে বাঁচানোর কাজে। লোকটার বিরুদ্ধে তার মাকে খুনের অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে নারী লেখক লুসি বার্টনের বন্ধুত্বের সম্পর্কেও জড়ায় বব বার্জেস। অবসর সময়ে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তারা নিজেদের জীবন সম্পর্কে, জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আফসোস, ভয়-সন্দেহ- সবকিছু সম্পর্কে কথা বলে। লুসির পরিচয় হয় অলিভ কিটারিজ নামের আরেকজনের সঙ্গে; সেও একা থাকে অবসর যাপন করা লোকদের সমাজে, শহরের এক কোনায়। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা অলিভের বাসায় তার সঙ্গে সময় কাটায় লুসি। তখনো একজন আরেকজনকে নিজের জীবনের গল্প বলে। পরিচিত মানুষদের কথাও বলে। লুসির মতে, ‘ভালোবাসা বিভিন্ন অবয়বে বারবার আসে। তবে ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা হয়েই থাকে।’ এলিজাবেথের এ উপন্যাস মানুষের জন্য মানুষের সমবেদনার কথা বলে।

ক্ষমতা

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২০ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২১ পিএম
ক্ষমতা
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

টিভিতে খবর দেখলাম- সব থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে। 
তখন আমার মনে পড়ল, একটা জিডি করা প্রয়োজন। 
কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বৈদ্যুতিক পোস্টপেইড মিটার চুরি হয়েছে। জিডি না করলে নতুন মিটার মিলবে না। অগত্যা জিডি লিখে নিয়ে স্থানীয় থানায় গেলাম।

রিসিভ কপি নেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘কত দেব?’
‘জিডি করতে টাকা লাগে না স্যার।’ দায়িত্বে থাকা পুলিশ জানাল।

মনে মনে বললাম, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এর আগে যতবার থানায় এসেছি, টাকা না দিলে জিডি হতোই না। 
নতুন বাংলাদেশের এ এক নতুন রূপ! 
বের হয়ে যাব ভাবছি, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।

বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। 
‘স্যার, ও স্যার। একটু শুনে যান।’

বাম পাশে হাজতখানা। তার ভেতর থেকে কে যেন ডাকছে।
‘আমাকে বলছেন?’
‘জি স্যার। একটু এদিকে আসবেন।’

এগিয়ে যেতেই দেখি, এই এলাকার প্রাক্তন এমপি। বুঝলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে এনেছে।
‘কিছু বলবেন?’
‘জি স্যার। আমাদের দলের জামান উকিলকে খবর দিতে পারবেন? আমার জামিনের আবেদনটা করাতাম।’

মনে পড়ল, একবার এই এমপি সাহেবের কাছে একটা প্রয়োজনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই, আমার কাজটা যদি করে দিতেন, খুব উপকার হয়। তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ভাই কীসের, স্যার বলুন। স্যার।’

সেই তিনি এখন আমাকেই ‘স্যার’ ডাকছেন।
‘আপনি লিডার মানুষ। দলের লোকজন আপনাকে দেখতে আসবেই। তাদেরকে উকিল ডেকে দিতে বলতে পারেন।’
‘ওরা কেউ আসবে না স্যার। বিপদে পড়েছি। বিপদে পড়লে এসব মধুলোভী মৌমাছিরা কেউ পাশে থাকে না।’
‘আপনি পালিয়ে যেতে পারতেন। সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি পারলেন না?’
‘দিয়েছিলাম স্যার। বাধ্য হয়ে ধরা দিয়েছি।’

গল্পের গন্ধ পেলাম। বাইরে আরও জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
‘কী ঘটেছিল? কীভাবে ধরা পড়েছিলেন?’ জানতে চাইলাম।
তিনি বলতে শুরু করলেন-

“আমি বা আমার দলের কেউই ভাবিনি, তিনি আমাদের অথই জলের মধ্যে এভাবে ফেলে পালিয়ে যাবেন। তার পালানোর খবর যখন পেলাম, তখন আমি মাত্র দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। শহরের চারদিক থেকে মারামারির খবর আসছিল। আমার ছেলেরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মন মনে ক্ষীণ আশা ছিল, যেহেতু সেনাবাহিনী মাঠে আছে শেষপর্যন্ত আমরাই জিতব।

তার পালানোর খবর শুনে সবার আগে মাথায় এল আমাকেও পালাতে হবে। দুপুরের খাওয়া আর হলো না। পরিবারের সবাইকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। টাকা-পয়সা, গহনা, সঞ্চয়পত্রসহ যা যা পারল, ওরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে যাওয়ার পর শূন্য ঘরটিতে আমি তাকালাম। স্মৃতিবিজড়িত কত কিছুই না থেকে গেল। আমার বাসাসংলগ্ন একটা ঘরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। সেই ঘরে গেলাম। আলমারিতে সাজানো থরে থরে ক্রেস্ট আর মেডেলগুলোর দিকে তাকালাম।

মনে হলো, ক্রেস্টের লেখাগুলো আমাকে উপহাস করছে। দাঁত বের করে হাসছে। 
জনদরদি নেতা!
কৃষকের বন্ধু!
মহান নেতা!
গরিবের বন্ধু! 
কত উপমাই না লেখা হয়েছে আমাকে ঘিরে।

মোবাইল বেজে উঠল। এসপির কল।
‘স্যার, এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যান। পাবলিক আপনার বাসার দিকে এগিয়ে আসছে।’
চমকে উঠলাম।
বাসা থেকে বের হতে হবে। দ্রুত।
নিজেকে তাড়া দিলাম। তখনই আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরল। 

গত পনেরো বছরে সবসময় অন্যের পরামর্শে চলেছি। এখন আমার পাশে কেউ নেই। আমি কোথায় যাব? কে আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবে।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
আবার ফোন।
‘মামা, তাড়াতাড়ি পালান।’ ভাগ্নের গলা। 
পালালাম আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বাসার পেছন দিক দিয়ে। রাস্তায় বের হওয়ার মুখে বাধা পেলাম। একের পর এক মিছিল যাচ্ছে। আবার অন্যদিক থেকেও আসছে।

সবাই আমার বিরুদ্ধে। আমি এক জায়গায় লুকিয়ে পড়লাম।
ফলে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারলাম। শেষে ঠিক করলাম, বর্ডার এলাকায় চলে যাব। ওখানে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা আছে।
সবার আগে মোবাইলটা ফেলে দিলাম। ফেলে দিতে অবশ্য মায়াই লাগল। অত দামি একটা ফোন। 
উপহার হিসেবে পাওয়া। 

তবু জান বাঁচানো ফরজ ভেবে নিজেকে বুঝ দিলাম। সন্ধ্যার পর রওনা হলাম।
খালার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা। আমার ডাক শুনে সবাই জেগে উঠল।
আমি বেঁচে আছি দেখে সবাই স্বস্তি প্রকাশ করল।

‘এখন কী করবেন ভাইজান?’ নাজমুল বলল। খালাতো ভাই।
‘বর্ডার পার হব। ইন্ডিয়া যেতে পারলে বেঁচে যাব।’
‘যাবেন কীভাবে ভাইজান? বর্ডারে খুব কড়াকড়ি।’
‘যেভাবে পারিস ভাই। যত টাকা লাগে দেব। তুই শুধু ম্যানেজ কর।’
অনুনয় করলাম।

‘আচ্ছা দেখছি ভাই।’ বেরিয়ে গেল নাজমুল।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরল সে।
‘ভাই, আজ রাতে ভোরে পার হওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যার পর চেষ্টা করতে হবে।’
‘আজ কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়?’
কাঁটাতারের বেড়া। সার্চলাইট। আর বিএসএফের পাহারা। সব মিলিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে ভাইজান?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। 

‘আমার সঙ্গে আসেন ভাইজান।’
নাজমুল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমাদের বাসায় রাখা যাবে না। তাই আপনাকে অন্য জায়গায় রেখে আসতে যাচ্ছি।’
‘কার বাসায়?’
‘কারও বাসায় না ভাইজান। সেটা রিস্ক হয়ে যাবে।’
‘তাহলে?’

‘এখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে না? আজ রাতে ওখানে থাকুন। কেউ সন্দেহ করবে না।’
আবছাভাবে আমার মনে পড়ল। পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। জঙ্গল দিয়ে ভরা।
‘ওই জঙ্গলভরা বাসায় কীভাবে থাকব?’ সংশয় প্রকাশ করলাম।
‘জঙ্গল আর নেই ভাইজান। আমরাই কেটে সাফ করেছি।’
‘কেন?’

‘ওই জমিদার বাড়িটা দেখতে অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে। তখন স্থানীয়রা মিলে নিজেরাই পরিষ্কার করেছি।’ 
‘রাতে থাকার মতো ব্যবস্থা?’
‘ওখানে নেশাখোররা আস্তানা বানাতে চেয়েছিল। তাই আমরা পালা করে ওই জমিদার বাড়িতে থাকি।’
‘আজ কি আমি একাই থাকব?’
‘না ভাইজান। আমি বাইরের ঘরে আপনাকে পাহারা দেব।’

স্বস্তি পেলাম। যত দূরের সম্পর্কই হোক, ভাই তো। আজ রাতটা কোনোমতে কাটুক।
জমিদার বাড়িটা পুরোনো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। চার্জার লাইট রেখে আমাকে আমার বিছানা দেখিয়ে নাজমুল বের হয়ে গেল।
‘ভাইজান, দরকার হলে ফোন দিয়েন।’

শুয়ে পড়লাম আমি। চারপাশে অন্ধকার। দূরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। পাতার সর সর শব্দ। টের পেলাম দুচোখে ঘুম আসছে না।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।

‘ক্যামন আছেন?’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল কে যেন।
হিমশীতল আতঙ্ক বয়ে গেল আমার সারা শরীরে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। একে তো ক্ষমতা হারানোর শোক। তার ওপর রাজকীয় জীবন হঠাৎ হারিয়ে ভিখারির জীবনে প্রবেশ। আর এখন মাঝরাতে অজানা নির্জন জমিদার বাড়িতে বসে ভূতুড়ে গলার আওয়াজ আতঙ্কে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।

‘বললেন না ক্যামন আছেন?’
‘ভা...লো...নে...ই।’
‘কেন?’
‘ক্ষ...ম...তা হারিয়েছি। ইন্ডিয়া পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আজ রাতের মধ্যে। সীমান্তের কড়াকড়ির জন্য পারছি না।’
‘আমিও পারছি না। সেই কবে থেকে চেষ্টা করছি।’ অন্ধকার চিরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভেসে এল।
‘আপনিও কি আমার মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’

তার জবাব শুনে ভরসা পেলাম। যাক, আমি তাহলে একা নই।
‘আপনি কী করেন?’ জানতে চাইলাম।
‘জিজ্ঞেস করুন কী করতাম না। ড্রাগস, চোরাচালান, মাদক।’
‘তাহলে তো পুলিশ আপনাকে খুঁজবেই।’
বলার পরই বুঝতে পারলাম শব্দটা পুলিশ হবে না। পুলিশও তো আমার মতো পালিয়েছে।
‘পুলিশ না। আমি পালিয়েছি জনতার ভয়ে।’
আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি সেটা স্মরণ করলাম।

‘কখন বের হয়েছেন বাসা থেকে?’
‘বেশ কিছুদিন হলো।’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাটি বলল।
সন্দেহ হলো। সরকার পতন হলো আজ আর ব্যাটা বলে কিনা কয়েকদিন আগে পালিয়েছে।
‘এই কয়দিনে বর্ডার পার হতে পারেননি?’
‘না। দালালটা বলল আমি সন্ধ্যায় এসে আপনাকে নিয়ে যাব। পরে আর এলই না। আমার টাকা-পয়সা সব নিয়ে ভেগেছে।’

‘কত তারিখে এসেছেন আপনি?’
‘ছয় ডিসেম্বর।’
চমকে গেলাম। 

আজ পাঁচ আগস্ট। আর উনি কি না বলছেন ডিসেম্বরে এসেছেন!
রেগে গেলাম। ‘কত সালে?’
‘উনিশ শ নব্বই সালে।’ 
উনিশ শ নব্বই সালের ছয় ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়েছিল। আমিও সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম।’

কিছু একটা বলতে যাব তার আগেই প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো।
সেই বজ্রপাতের ক্ষণিকের আলোয় দেখলাম আমার সামনে একটা কংকাল বসে আছে। যেন দাঁত বের করে হাসছে। পড়িমড়ি করে বের হয়ে এলাম। ছুটতে ছুটতে কখন যে সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছি নিজেও জানি না।’
একনাগাড়ে বলার পর থামলেন নেতা।

‘সামান্য একটা কংকাল দেখে পালিয়ে এলেন।’ হেসে জানতে চাইলাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। নির্জন জমিদার বাড়িতে ভূতের হাতে অপঘাতে মরার চেয়ে জেলখানায় থাকা অনেক ভালো। একদিন না একদিন জামিন পাবই।’
হেসে ফেললাম। 
‘আপনি এখন জেলেই আছেন।’
‘কে ওখানে?’ একজন কনস্টেবল এগিয়ে এল।
নিজের পরিচয় দিলাম। 
‘বৃষ্টির জন্য আটকে পড়েছি।’ 

‘হাজাতির সঙ্গে আলাপ করা নিষেধ।’ বলল কনস্টেবল।
‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে ডাকলেন।’
‘নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে ভূতুড়ে জমিদার বাড়ির গল্পটা বলেছে আপনাকে?’
‘বানানো?’

‘আমাদের স্যাররা বর্ডার থেকে অনেক কষ্ট করে ধরে এনেছেন তাঁকে।’
‘উনি নাকি নিজে নিজেই ধরা দিয়েছেন।’
‘ক্ষমতা হারাইছে তো। মাথাটাথা আউলায় গেছে।’ হেসে বলল কনস্টেবল।

মাজার-ফকির-সন্ত

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৩ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
মাজার-ফকির-সন্ত

নির্লজ্জ সময়ের কাছে তোমাকে সপে দিলাম
মৃত্যুকে ঐ দূরবর্তী কোনো নক্ষত্র ভেবে আলিঙ্গন করিও
দংশিত শরীর পুড়ছে পুড়ুক তবুও চিৎকার দিতে নেই
কোন্দলে কোন্দলে মলিন হোক মুখোশ পরিহিত
   সার্কাসের ক্রাউন...
আমার পিঠ এখনো শক্ত- ঘাড় করেছি মজবুত
সহ্য শক্তিও বেড়েছে অনেক- পূর্বপুরুষের মতো-
কাকে তুমি মৃত্যু বলো?
গভীর অন্ধকার- উল্লাসে উল্লাসে পুড়ে যাচ্ছে বাড়ি।
খড়ের বিছানার কথা বলে যারা বেছে নেয় মকমল
তারাও জানত আলো আসবে- উৎকট গন্ধ
যতই ছড়িয়ে পড়ুক চারিপাশ-
দুর্যোগ-কান্নায় যখন তুমি তাকাও আমার দিকে
প্রকম্পিত ঠৌঁট, চোখে ছলছল জল-
বড় একাকিত্বের বেদনায় রক্ত ঝড়ায়-ফকির-সন্ত...

আমার ঘ্রাণের কোনো মালিকানা নেই

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১১ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
আমার ঘ্রাণের কোনো মালিকানা নেই

আমার ঘ্রাণের কোনো মালিকানা নেই। 
পরিধি বিস্তৃত, সুবর্ণ রেখার মতো 
কোনদিকে, কোথায় থেমেছে, কে জানে কী পরিমাপ। 
রক্তে গন্ধ থাকে না জেনে হৃদয় কেটে রক্তস্রোতে 
আমাকে ভাসাই। সারা দেহ পরিপ্লুত, আবৃত পোশাকে 
নিবৃত্ত করতে ব্যতিব্যস্ত। অথচ আমার প্রাণে 
যে ঘ্রাণ অনবরত কাঁদে, তার কাছে ঋণী। 
কেননা সে সর্বত্র বিরাজমান 
ছুটে ছুটে যায় তোমার অন্দরে, বন্দরে বন্দরে 
খেতখামার কিংবা হাটবাজার।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে।