নব ঋত্বিক নবযুগের!
নমস্কার! নমস্কার!
আলোকে তোমার পেনু আভাস
নওরোজের নব ঊষার!
তুমি গো বেদনা-সুন্দরের
দরদ্-ই-দিল্, নীল মানিক,
তোমার তিক্ত কণ্ঠে গো
ধ্বনিল সাম বেদনা-ঋক্।
...................................
মানুষের কবি! যদি মাটির
এই মানুষ বাঁচিয়া রয় –
রবে প্রিয় হয়ে হৃদি-ব্যাথায়,
সর্বলোক গাহিবে জয়।
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ‘শরৎচন্দ্র’ নামাঙ্কিত এই কবিতাটি রচনা করেন। উক্ত কবিতাটি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে আশ্বিনের নওরোজে প্রকাশিত হয়। পাদটীকায় বলা হয়: ‘স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দ্বিপঞ্চাশৎ বর্ষ জন্মোৎসব উপলক্ষে রচিত।’ রচনার স্থান ও তারিখ: কৃষ্ণনগর, ২৯ ভাদ্র, ১৩৩৪। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর কবিতাটি ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে মাঘের বুলবুলে পুনর্মুদ্রিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরও একবার ফিরে দেখা বাংলা সাহিত্যজগতের দুই খ্যাতনামা চিন্তক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ককে। জীবদ্দশায় একাধিকবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল, তা সত্যিই শিক্ষণীয়। সেরকমই কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম:
১) ২৪শে জুলাই, ১৯২২ সালে কলেজ স্কোয়ারে বঙ্গীয় থিওসফিক্যাল সোসাইটির হলে সরস্বতী ইনস্টিটিউশন আয়োজিত এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সত্যেন্দ্র-স্মৃতিসভায় কাজী নজরুল ইসলাম স্বরচিত শোক সঙ্গীত ‘চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে’ গেয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্মরণসভায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য দেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, চারু চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
২) কাজী নজরুল ইসলামের একক সম্পাদনায় ২৬শে শ্রাবণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে (১১ই আগস্ট, ১৯২২) সপ্তাহে দুবার প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শিবপুর থেকে ৯ই আগস্ট, ১৯২২ সালে ধূমকেতুর প্রকাশ উপলক্ষে নজরুলকে দেওয়া এক শুভেচ্ছা পত্রে লেখেন:
২৪শে শ্রাবণ,১৩২৯
শিবপুর
পরম কল্যাণীয়বরেষু,
তোমার কাগজের দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া তোমাকে একটিমাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্ব্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার। তারপরে ভগবান তোমার কাগজের ভার আপনি বহন করিবেন।
তোমাদের-
শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩) ১৭ই মে, ১৯২৩ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীমতী লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে পত্রখানি লেখেন:
হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল উপোস করিয়া মর-মর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজী হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখি না। একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া বোধহয় এখন কেহ আর এত বড় কবি নাই।...
দাদা
শরৎচন্দ্র শিবপুর থেকে এসে হুগলি জেলে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে সচেষ্ট হন, কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় নজরুলকে অনশন ভঙ্গের অনুরোধ জানাতে পারেন নি।
৪) ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সালে শরৎচন্দ্রের ৫২তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় নজরুল অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বরচিত ‘কোন শরতে পূর্ণিমা চাঁদ আসিলে এ ধরাতল’ গানটি পরিবেশন করে শরৎচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। গানটি হলো -
কোন শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল।
কে মথিল তব তরে কোন্ সে ব্যথার সিন্ধু-জল।।
দুয়ার-ভাঙা জাগল জোয়ার বেদনার ঐ দরিয়ায়।
আজ ভারতী অশ্রুমতী মধ্যে দুলে টলমল।।
কখন তেমার বাজল বেণু প্রাণের বংশী-বট-ছায়।
মরা গাঙের ভাঙা ঘাটে ঘট ভরে গোপিনীদল।।
বিদ্যুতের বাঁকা হাসি হাসিয়া কালো মেঘে,
আসিলে কে অভিমানী বহায়ে মরুতে ঢল।।
লয়ে হাতে জিয়ন-কাঠি আসিলে কে রূপ-কুমার
উঠল জেগে রূপ-কুমারী আঁধারে ঐ ঝলমল।।
আকাশে চকোরী কাঁদে, তড়াগে চাহে কুমুদ
ঝরুক আঁখির শেফালিকা ছুঁয়ে তব পদতল।।
৫) ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ সালে (৩১ ভাদ্র, ১৩৩৫) প্রমথ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিরুপমা দেবী রচিত উদ্বোধনী সংগীত ‘তুমি যে মধুকর কমল বনে’ পরিবেশন কালে দিলীপ কুমার রায়, নলিনীকান্ত সরকার ও সাহানা দেবীর সঙ্গে নজরুল কন্ঠ দেন। গোপালচন্দ্র রায়ের ‘শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়- ১৩৩৫ সালের ৩১শে ভাদ্র শরৎচন্দ্রের ৫৩তম জন্মদিবসে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে এক মহতি সভায় সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। ঐ সভায় সভাপতি ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের ঐ সম্মাননা সভায় একটি বাণী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কবির সেই বানীটি এই-
শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্মাননা সভায় বাঙ্গলা দেশের সকল পাঠকের অভিনন্দনের সঙ্গে আমার অভিনন্দন বাক্যকে আমি সম্মিলিত করি। আজও সশরীরে পৃথিবীতে আছি, সেটাতে সময় লংঘনের অপরাধ প্রত্যহই প্রবল হচ্ছে, সে কথা স্মরণ করাবার নানা উপলক্ষ সর্বদাই ঘটে, আজ সভায় সশরীরে উপস্থিত থেকে সকলের আনন্দে যোগদান করতে পারলুম না, এও তারই মধ্যে একটা। বস্তুতঃ আমি আজ অতীতের প্রান্তে এসে উত্তীর্ণ - এখানকার প্রদোষান্ধকার থেকে ক্ষীণ কর প্রসারিত করে তাঁকে আমার আশীর্বাদ দিয়ে যাই, যিনি বর্তমান বাংলা সাহিত্যের উদয় শিখরে আপন প্রতিভা জ্যোতি বিকীর্ণ করছেন।
ড. অজিতকুমার ঘোষের লেখা ‘শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্য বিচার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়-
সংবর্ধনার উত্তরে শরৎচন্দ্রের বক্তব্য: ‘হেতু যত বড়ই হোক, মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মে যায় আমার লেখা কোনদিন যেন না এতবড় প্রশ্রয় পায়। কিন্তু অনেকেই তা আমার অপরাধ বলে গণ্য করেছেন এবং যে অপরাধে আমি বড় লাঞ্ছনা পেয়েছি, সে আমার এই অপরাধ। পাপীর চিত্র আমার তুলিতে মনোহর হয়ে উঠেছে। আমার বিরুদ্ধে তাঁদের সবচেয়ে বড় এই অভিযোগ। এ ভালো কি মন্দ আমি জানিনে, এতে মানবের কল্যাণ অপেক্ষা অকল্যাণ অধিক হয় কিনা এ বিচার করেও দেখিনি - শুধু সেদিন যাকে সত্য বলে অনুভব করেছিলাম তাকেই অকপটে প্রকাশ করেছি৷ এ সত্য চিরন্তন ও শাশ্বত কিনা এ চিন্তা আমার নয়। কালে যদি সে মিথ্যা হয়েও যায় - তা নিয়ে কারও সঙ্গে আমি বিবাদ করতে যাব না।’
সাহিত্যের চিরন্তনত্ব সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করিয়া তিনি সেই অভিভাষণে বলেন, ‘কোন দেশের কোন সাহিত্যই কখনো নিত্যকালের হয়ে থাকে না। বিশ্বের সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মত তারও জন্ম আছে, পরিণতি আছে, বিনাশের ক্ষণ আছে। মানুষের মন ছাড়া তো সাহিত্যের দাঁড়াবার জায়গা নেই, মানবচিত্তই তো একস্থানে নিশ্চল হয়ে থাকতে পায় না! তার পরিবর্তন আছে, বিবর্তন আছে, তার রসবোধ ও সৌন্দর্য বিচারের ধারার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই একযুগে যে মূল্য মানুষে খুশি হয়ে দেয় আর একযুগে তার অর্ধেক দাম দিতেও তার কুণ্ঠার অবধি থাকেনা।’
৬) ১২ই অক্টোবর, ১৯২৮ সালে সাপ্তাহিক সওগাতে ‘নজরুল-সম্বর্ধনা’ বিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হয়। নজরুল ইসলামকে সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য সভায় এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়, কমিটির সহসভাপতি হিসেবে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্বাচন করা হয়।
প্রকাশিত সংবাদ:
গত ৯ই অক্টোবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে খান বাহাদুর মৌলবী আসাদুজ্জামান এম.এ.বি-এল সাহেবের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় এত লোকের সমাগম হইয়াছিল যে, সম্পূর্ণ হলে তিল ধারণের স্থান ছিল না। উপরন্তু হলের সম্মুখস্থ ও পিছনের বারান্দাও জনতায় ভরিয়া গিয়াছিল। সমবেত মুসলিম তরুণের ঘন ঘন আনন্দ করতালিতে সভাস্থল সরগরম হইয়া উঠিয়াছিল। এই সভায় তরুণ মুসলিমের যে প্রাণের সাড়া পাওয়া গিয়াছে, তাহা অপূর্ব। বাংলার যুগপ্রবর্তক কবি নজরুল ইসলামকে সমগ্র বাংলার পক্ষ হইতে সম্বর্ধনা দিবার জন্য সভায় এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইয়াছে। তাহাতে নিম্নলিখিত ভদ্র মহোদয়গণ কর্মকর্তা নির্বাচিত হইয়াছেন।
সভাপতি- মিঃ এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
সহ-সভাপতি- শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রায় শ্রী জলধর সেন বাহাদুর, মৌঃ এ.কে.ফজলুল হক, খান বাহাদুর মোলবী আসাদুজ্জামান, মিঃ দিলীপকুমার রায়, ডাঃ আর. আহমদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
সম্পাদক- শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ, সম্পাদক, কল্লোল; মৌঃ এম. নাসিরুদ্দীন, সম্পাদক, সওগাত।
সহ-সম্পাদক- সৈয়দ জালালুদ্দীন হাশেমী, শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্র, মৌঃ আবুল মনসুর আহমদ, মৌঃ মোয়ায়েদ বখত চোধুরী, মৌঃ আয়নুল হক খাঁ।
কোষাধ্যক্ষ-মিঃ এস. ওয়াজেদ আলী বি-এ (ক্যান্টাব), বার এট-ল, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
অভ্যর্থনা সমিতি অফিস- ১১নং ওয়েলেসলী স্ট্রীট, কলিকাতা।
৭) ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৩১ সালে নিউ থিয়েটার্সের প্রথম সবাক ছায়াছবি শরৎচন্দ্রের ‘দেনা পাওনা’ কলকাতার চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পায়। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত এই ছায়াছবির মহরত অনুষ্ঠানে নজরুল উপস্থিত ছিলেন এবং মহরত অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গানে অংশ নিয়েছিলেন।
৮) কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িতে ছিল নজরুলের নিত্য যাতায়াত। দুজনেই দাবা খেলতে খুব ভালবাসতেন। সেরকমই একদিনের ঘটনা - ‘‘নজরুল একদিন আমাকে ও আড্ডিকে সাহিত্যিক শরৎ চ্যাটার্জির বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। নির্দিষ্ট দিনে আমাদের দুইজনকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে সন্ধ্যার সময় মনোহরপুকুর রোডে শরৎ বাবুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ শরৎচন্দ্র দাবাগুটি সাজিয়ে একা একা বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। উনি বললেন, ‘তোমরাই দুজনে খেল, আমি শুধু দেখব।’ খেলা শুরু হল। আমাদের এক বাজী খেলতে খেলতেই রাত প্রায় বারোটা হয়ে গেল। শরৎবাবু মাঝে মাঝে উভয়দিকে দুই-একটা চাল বাতলাতে লাগলেন। দুইজনেই বুঝলাম উনি কেমন খেলেন। ভদ্রতার খাতিরে, ওঁর চাল গ্রহণ করলে পরিণাম কেমন দাঁড়াবে সেকথা বুঝিয়ে দিয়ে আমরা নিজেদের পছন্দ মত চালই দিতে লাগলাম। দুইজনেই খুব সতর্ক ভাবে খেলাতে শেষমেশ বাজীটা চটে গেল। শরৎবাবু ‘লাল মন্তি’ (লাল মন্ত্রী) - সম্বলিত একটা চমৎকার গল্প লিখেছেন বলে অনেকের ধারণা, তিনি মস্ত বড় দাবা খেলোয়াড়। কিন্তু আসলে তা নয় - তিনি মাঝারিগোছের খেলোয়াড় ছিলেন।’
৯) ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁকে সংবর্ধনা প্রদানের বিশাল আয়োজন করে। এ উপলক্ষে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘শরৎ-শর্বরী’ অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের উপস্থিতিতে নজরুল স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় এটিই ছিল তাঁর শেষ জন্মোৎসব। ড. অজিতকুমার ঘোষের লেখা ‘শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্য বিচার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় - ‘১৩৪৪ সালের ৩১শে ভাদ্র জীবিত শরৎচন্দ্রের শেষ জন্মোৎসব পালিত হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটু ঘটা করিয়া শরৎচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁহাকে সংবর্ধনা জানাইবার আয়োজন করা হইয়াছিল। স্টেশন-ডিরেক্টর মি. স্টেপলটন এই সংবর্ধনায় বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হইয়াছিল শরৎ-শর্বরী। এই অনুষ্ঠানটি সম্বন্ধে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, ‘কোলকাতা বেতারে সেদিনকার শরৎ-শর্বরী সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই শরৎচন্দ্রের দীর্ঘ জীবন কামনা করে কিছু কিছু বক্তৃতা দান করেন। সকলেরই ভাষণ খুব আন্তরিকতাপূর্ণ হয়েছিল। সকলের বলা শেষ হলে, শরৎচন্দ্র তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে অল্প কথায় কিছু বলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন প্রার্থণা সম্বন্ধে তিনি যা বলেছিলেন তার মোটামুটি কথা এই যে, দীর্ঘ জীবন বাইরে থেকে সাধারণত দেখতে ভালো হলেও সব সময়ে ও সব ক্ষেত্রে উহা কাম্য নয়। যদি স্বাস্থ্য, শান্তি ও কর্মশক্তি অটুট থাকে, দেশ, সমাজ ও লোকসেবা করবার ক্ষমতা থাকে, কোনদিকে কোনরূপ অশান্তি না থাকে তবেই দীর্ঘ জীবন কাম্য। কিন্তু মানসিক অশান্তি ও দৈহিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যে, দীর্ঘ জীবন - তেমন দীর্ঘ জীবনকে তিনি ভাগ্যের অভিসম্পাত বলেই মনে করেন। ব্যাধিপীড়িত হয়ে কর্মশক্তি হারিয়ে তিনি একদিনও বাঁচতে চান না।’
‘বেতার-জগৎ’-এ অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল তা উদ্ধৃত হলো, ‘‘গত ১৭ই সেপ্টেম্বর শুক্রবারের সান্ধ্য অনুষ্ঠানে সুপ্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের জন্মতিথি উপলক্ষে শরৎ-শর্বরীর অধিবেশন অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে সুসম্পন্ন হয়ে গেছে। এই অধিবেশনে নাটোরের মহারাজা, কাশিমবাজারের মহারাজা, রায়বাহাদুর জলধর সেন, রায়বাহাদুর এন কে সেন, শ্রীযুক্ত কালিদাস রায়, শ্রীযুক্ত গিরিজাকুমার বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র দেব, শ্রীযুক্ত মুকুলচন্দ্র দে, শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্র কুমার রায়, শ্রীযুক্ত অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলেছিলেন। শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্য বলেছিলেন অতি সংক্ষেপে ও প্রাণ-স্পর্শী ভাষায়। স্বয়ং শরৎচন্দ্র ও সমাগত সুধী ব্যক্তিরা খুবই খুশি হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র রচিত ‘সতী’ গল্পের নাট্যরূপ ও অভিনয় দর্শনে।’’
গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা ‘শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থ থেকেও এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। উক্ত অনুষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের অনুভূতি - ‘‘৬২ বৎসর বয়সে পা দিয়ে আমার জন্মতিথি উপলক্ষে সকলের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেবার পূর্বে আমার গুরুদেব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, যিনি আজ রোগশয্যায়, তাঁকে প্রণাম করি। এ জগতে সাহিত্য-সাধনায় তাঁর আশীর্বাদ এটি শুধু আমার নয়, প্রতি সাহিত্যিকের পরম সম্পদ। সেই আশীর্বাদ আজকের দিনে চেয়ে নিলাম।
নিজের সাহিত্য-সাধনার ব্যাপার নিজের মুখে কিছু বলা যায় না। শুধু এইটুকু ইঙ্গিতে বলতে পারি যে, অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে এই সাধনায় ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছি।... আমি আপনাদের মাঝে বেশিদিন থাকি বা না থাকি, আমার এ কথাটা হয়ত আপনাদের মাঝে মাঝে মনে পড়বে যে, অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য-সাধনা ধীরে ধীরে বাধা ঠেলে চলেছিল।’’
শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবর্ধনা প্রদানের তথ্য যখন সামনে আসে, তখন অবধারিতভাবেই শরৎচন্দ্রের রেডিওপ্রীতির কথা মনে পড়ে। শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ের বাড়িতে রেডিও ছিল। সেই নির্জন গ্রামে বসে তিনি রেডিওতে গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন। এ সম্পর্কে একবার তিনি লিখেছিলেন - ‘শহর হইতে দূরে গ্রামের মধ্যে আমার বাস। অতীতের নানা প্রকার আমোদ ও আনন্দের প্রাত্যহিক আয়োজন গ্রামে আর নেই, পল্লী এখন নির্জীব নিরানন্দ। কর্মক্লান্ত দিনের কত সন্ধ্যায় এই নিঃসঙ্গ পল্লী ভবনে বেতারের জন্য উৎসুক আগ্রহে অপেক্ষা করিয়াছি। শ্রাবণের ঘন মেঘে চারিদিক আছন্ন হইয়া আসে, কর্দমাক্ত জনহীন গ্রাম্যপথ নিতান্ত দুর্গম, নিবিড় অন্ধকার ভারের মত বুকের পরে চাপিয়া বসে, তখন বেতার-বাহিত গানের পালায় মনে হয় যেন দূরে থাকিয়াও আসরের ভাগ পাইতেছি।
আবার কোনদিন ক্ষান্তবর্ষণ আকাশে লঘু মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো দেখা দেয়, বর্ষার সুবিস্তীর্ণ নদীজলে মলিন জ্যোৎস্না ছড়াইয়া পড়ে, আমি তখন প্রাঙ্গণের একান্তে নদীতটে আরাম কেদারায় চোখ বুঝিয়া বসি। তামাকের ধূঁয়ার সঙ্গে মিশিয়া বেতারে বাঁশির সুর যেন মায়াজাল রচনা করে। দু-একজন করিয়া প্রতিবেশী জুটিতে থাকে, ঘাটে বাঁধা নৌকায় দূরের যাত্রী, কৌতূহলী দাঁড়ি মাঝির দল নিঃশব্দে আসিয়া ঘিরিয়া বসে, আবার শেষ হইলে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া যে যাহার আলয়ে চলিয়া যায়। এই আনন্দের অংশ আমি পাই।’
১০) শরৎচন্দ্রের প্রয়াণে বাংলাসহ ভারতবর্ষের বহু জায়গায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু গুণী মানুষ তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কবিতা লেখেন। কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন-
সেদিন দেখেছি আকাশের শোভা
শরৎ-চন্দ্র তিলকে।
শূন্য গগন বিষাদ মগন
সে তিলক মুছি দিল কে।।
তথ্যঋণ:
১. নজরুল কবিতা সমগ্র এবং নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ
২. নজরুল তারিখ অভিধান: মাহবুবুল হক
৩. সমকালে নজরুল ইসলাম: মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
৪. কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুলচর্চা, সংকলন ও সম্পাদনা: তপন বাগচী
৫. শরৎচন্দ্র: গোপালচন্দ্র রায়
৬. শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্যবিচার: ড. অজিত কুমার ঘোষ
লেখক: নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)