ঢাকা ২৪ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস গোপনীয়

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৯ পিএম
আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
গোপনীয়
চিত্রশিল্পী: নাজমুল মাসুম

পর্ব-০৫

রজনী গভীরা। পুরো ঢাকা শহর গেছে ঘুমিয়ে। তবে এ সময়ও কয়েক কিছিমের প্রাণী জেগে আছে। দূরপাল্লার বাস-ট্রাকের চালক, গলি-ঘুপচিতে লুকিয়ে থাকা ছিনতাইকারী, মহাসড়কে বনবীথির আড়ালে রাহাজান, সিঁদ কাটা চোরের দল আর থানা এবং তার পুলিশ। শহরের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবশ্য অন্য এক প্রাণীদের চলাচলের জন্যও এ সময় প্রশস্ত। মানুষের চলাচল স্তিমিত হয়ে পড়লে তারা বের হয়। বের হয়ে নির্ধারিত পথে শুরু করে তাদের অশরীরী চলাফেরা- কেউ দেখে কেউ দেখে না।
তবে আজ এ সময়ে নতুন দুই মানুষের চোখেও ঘুম নেই- নবীন লেখক সজীব চৌধূরী আর চারুপল্লির চারু।
পল্লির সেন্ট্রি তাদের চূড়ান্ত মুহূর্তের মুখে বমাল ধরেছে, ধরে এনে রাধামাধব থানায় দিয়ে গেছে। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হচ্ছে। তারা দুজন বিচিত্র ধরনের সব মানুষের সঙ্গে ওসি সাহেবের অপেক্ষায় উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত পার করছে। ঘুম নেই কারও চোখে।
সজীব এই মুহূর্তে লেখকসত্তা হারিয়ে পলায়নপর এক ব্যাকুল যুবকে পরিণত হয়েছে। তার নিঃশ্বাস হয়েছে দীর্ঘতর। দীর্ঘ বারান্দার মতো রুমের এক কোণে বসে আছে সে, যেন রুমে উপস্থিত কারও চোখে না পড়ে। একটি প্রাচীনকালের ফ্যান দোল খাচ্ছে ছাদে। তার বাতাস গায়ে লাগে কি লাগে না। দেয়ালে বহুদিনের পুরনো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের এক ক্ষয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডার। সেখানে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এক অশান্ত সাগরের বুকে দিনের ক্লান্ত সূর্য ‘অস্ত যাইতেছে’।
সজীবের মনে কবিত্বের হাতছানি। আর সে বসে আছে রাধামাধব অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণ নামের থানায়। কিন্তু নামে যত প্রেম প্রেম ভাবই থাক, থানা থানাই। তবে তার মনে হলো, থানার নাম এমন হলে সে থানার লোকজন তথা পুলিশমহলের মনের অন্দরে নিজেদের অজানিতে এক টুকরো কোমল প্রেম উথলে উঠলেও উঠতে পারে।

সজীবের কবিত্ব কল্পনা মুহূর্তে উধাও হলো। ভয়ংকর দর্শন কয়েকজন পুলিশ এসে তাদের আরও বড় এক রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। নির্বিকার চারু চলল সঙ্গে। এখানে কেউ নেই। অন্ধকার বিজন কক্ষে নিজেদের একাকী আবিষ্কার করল  দুজন। একটু পর আঁধার সয়ে এলে, চারু বলল, এটি কয়েদখানা। সজীব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কী হতে কী হয়ে গেল, ঠাহর করতে পারল না সে।
তবে এ যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। একটু পর তাদের ডাক পড়ল বাইরের মাঠে গানের আসরে। হ্যাঁ সজীবের যৌক্তিক মস্তিষ্কের আবরণী ভেদ করে দূরাগত গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গায়ক কোনো এক অচিন সুরে কী জানি কী ভেবে এই ইট-কাঠ-পাথরের নির্মম থানার চত্বরে রাত্রির মধ্যযামে গেয়ে চলেছে-
    ও চড়ই তোঁয়ার বাড়ি কই-
    উড়ন চরণ ভুলি কারে, ভাব গাছর আগাত বই...
যেতে যেতে সজীব আর চারু বুঝতে পারল, থানার মাঠে, থানারই এক কয়েদি দরদ দিয়ে গাইছে চট্টগ্রামের এই মরমি গান। আর শ্রোতা হিসেবে ওসি সাহেব জড়ো করেছেন থানার সব বন্দি, কয়েদি, পুলিশ সদস্যদের। জানা গেল, এ গান চালু হওয়ার পর চট্টগ্রামের ছেলে-যুবারা মেয়েদের চড়ই বলে ইভ-টিজিং করছে। তাই দাবি উঠেছে এ গান ব্যান্ড করার। ওসি সাহেব বুঝে উঠতে চাইছেন, এ গানে চড়ই শব্দের মানে কী আর এর মাধ্যমে কীভাবে মেয়েদের ইভ-টিজিং করা যায়।
কিন্তু সাহিত্যিক সজীবের মন এসবে নেই। নিজের দুরবস্থা, থানার আবদ্ধ পরিবেশ, মামলা-মোকাদ্দমা, ডান্ডাবেরী পেরিয়ে তার কর্ণকুহুরে একটানা বেজে চলেছে মধ্যরাতের রাগ রাগেশ্রী-
    স র জ্ঞ ম প ধ ণ
    স জ্ঞ ম ধ ণ স
    ম ণ ধ ম প
    ধ ম জ্ঞ র সা।
আঁই তো বুঝির তুঁই প্রেমত পইজ্জু কিয়ার লই...
রাত্রির শেষ যাম। দাগি আসামি, বাদী-বিবাদী, অস্ত্র-গুলিতে সরগরম রাধামাধব থানা নিস্তব্ধ করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে গায়ক একমনে গেয়ে চলেছেন গানের সরগাম-
জাতর সাপ গাতত মরে ফয়েজ মরে ঘরত বই,
ধর্ম সংসার গরে, নাই দেহ-ঘরত মন-চড়ই,
প্রেমিক ডোবে চোখের জলে আব্দুল আলিম বুঝল কই!

পোড় খাওয়া ওসি ইজ্জত আলী জমাদ্দার। অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য কী অলংকার শাস্ত্র যে তার অধিতব্য বিষয় হতে পারে তা কোনোদিন ভেবে ওঠেননি। শুধু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত- এ তিন রকম ছন্দের সংজ্ঞা মুখস্ত করেছিলেন। সাহিত্যের বাকি অধীত বিষয়গুলো স্মৃতি থেকে ধুয়ে-মুছে গেছে কতকাল। শুধু কেমন করে, তিনি নিজেও জানেন না, স্মৃতি আঁকড়ে রয়ে গেছে একটি কথা- রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ কোনো কবিতার বই নয়; এটি একটি উপন্যাস। 
তিনি ভাবছেন তাঁর এই একমাত্র সাহিত্য জ্ঞান দিয়ে এত বড় সাহিত্য জিজ্ঞাসার সমাধান অসম্ভব। কিন্তু নিজের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বও বজায় রাখা চাই। তাই যে কোনো সুধী সমাবেশে তিনি যেভাবে শুরু করেন, আজও সেভাবেই আরম্ভ করলেন-
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শেষের কবিতা’ নামক উপন্যাসে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, এ জন্য অনেকে শেষের কবিতাকে মনে করেন একটি কাব্যগ্রন্থ। আবার অনেকে না জেনে শুধু নাম শুনে বলেন, এটি একটি কবিতার বই। কাজেই সাহিত্য বিচারের আগে প্রয়োজন সাহিত্যের নিবিড় অধ্যয়ন। কী বলেন আপনারা? 
উপস্থিত কেউ কিছু বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। ওপরে শেষ রাত্রির আকাশ, চতুর্দিকে থানার ঘেরাওয়ের মাঝে সংগীতের আসর। তারা কী করবে, কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। তবে থানার পুলিশ সদস্যদের সহজ উপলব্ধি, তাদের স্যার অনেক জ্ঞানী এক মানুষ। ওসি ইজ্জত আলী জমদ্দার তার সহকর্মীদের এ মনোভাব জানেন। কিন্তু সহস্র অপরাধ মাথায় থানায় আসা শত অপরাধীর মনে তার এ ভাষণ কী আলোড়ন তুলছে তা তিনি কেমন করে বুঝবেন, বুঝতে পারবেন? গায়েবের সেই খবরের মালিক তো একমাত্র তিনিই।
অবিদ্যাপল্লির সেন্ট্রির হাতে ধরা পড়ার পর থেকে সমাজে নিজের সম্ভ্রম আর সম্মানের কী হবে সেই চিন্তা সজীবকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যদি পুলিশের হাতে বন্দি হন, নির্যাতিত হন, যদি জেলে পাঠানো হয়- কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সমাজ জানে, দশজন জানে- লেখক সজীব চৌধূরী অবিদ্যাপল্লিতে... সজীব আর ভাবতে পারেন না।

কিন্তু সজীব আশ্চর্য হয়ে যায়, ওসি সাহেবের ভাষণের পর এই অকল্পনীয় ভরাডুবির কিনারায় দাঁড়িয়ে, আসন্ন পতনের মুখে কীভাবে, কেমন করে তার মনে পড়ল জনৈক ক্ষমতাধর নেতার ভরা পল্টনে সরকারের পদলেহী কবিদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ: ‘রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার পর বাংলা সাহিত্যে কোনো ভালো কাব্যগ্রন্থ কেউ লিখতে পারেনি। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি যদি কেউ পারেন শেষের কবিতার মতো একটি কবিতার বই লিখে দেখান’।
এই ধরনের সবজান্তা নেতাদের নিয়ে কত দিন বন্ধুসভায় নির্মল আনন্দে কেটেছে, সজীব ভাবে। কিন্তু সে ভেবে উঠতে পারে না, এ কঠিন আনপড়া মফস্বলের এক ওসি কেন সেই ভুল করলেন না। এ কি কোনো নতুন ষড়যন্ত্র! 
সজীবের চিন্তায় সময় বাধা পড়ল। সজীব দেখল তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে নব্য লেখক শাহাদাত আহসান।
সজীব তাকে ভালো করেই চেনে। তার লেখা আর যাই হোক সাহিত্য নয়, সজীব এবং সজীবের মতো ধ্রুপদী লেখকরা সবাই একথা জানে। কিন্তু সবাই একথাও জানে, আজকাল এই লঘু, চটুল লেখারই রমরমা চলছে। বিশ্বসাহিত্যের আসরে বাংলার ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার এ ধ্বংসাত্মক ধারা দেখে তারা মর্মাহত হয় বটে কিন্তু কিছুই বলে না অথবা বলতে পারে না। জনপ্রিয়তার বাজার বলে কথা।
কিন্তু সজীব আশ্চর্য হয়ে দেখল, উঠতি বয়সী আর মুনাফালোভী প্রকাশকদের মতো রাধামাধব থানার ওসি সাহেবও এ লেখকের ভক্ত। নইলে এ নিশি রাইতে একটি সংগীতের দোষ-গুণ বিচারের জন্য সংগীত শাস্ত্রের এক ব অক্ষর গোমাংস লেখককে তিনি ডেকে আনবেন কেন!
কিছু একটা বলতে হয় বলে সজীব বলল,
-হ্যালো শাহাদাত, এত রাতে থানায়?
-ওসি সাহেব ডেকে নিয়ে আসলেন কী একটা সংগীতের গুণ বিচার করতে হবে। তা তুমি কেন এত রাতে থানায়?
সজীবের অন্তরাত্মা ধক করে উঠল। কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-বুঝে নাও, কেন এসেছি।
নব্য লেখক শাহাদাত মনে হলো কিছুটা আহত হলো। থানার ওসি সাহেবেরাও কি আজকাল সিরিয়াস লেখার ভক্ত হতে শুরু করেছে! তার চিন্তাগুলো বুকের বন্দরে তড়পায়, কিন্তু মুখে আসতে পারে না।
এসময় দূর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসায় বাঁচোয়া। শাহাদাত সেদিকে চলে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচে সজীব। চারু অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওপরের আকাশে চাঁদ বেদনার্ত আলো বিলিয়ে যায়।
সমস্ত কিছু আচ্ছন্ন করে সজীবের মনে আবার সেই ভয় জেগে ওঠে। যদি দুনিয়া জেনে যায়, কী হবে তার!

এদিকে থানার চত্বরে সমবেত ছোট্ট জনতা শেষ রাত্রির সংগীত সুধায় বিদুর। তারা সংগীতজ্ঞ নয়। কিন্তু সংগীতের গুণ বিচারের এই অযাচিত অনুষ্ঠানে ওসি সাহেব তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কাজেই এই অভাবিত প্রতিষ্ঠানে এরকম অশ্রুতপূর্ব গানের আসর তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল।
অবশ্য সংগীতের এ আসর জমাতে ওসি সাহেবকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সন্ধ্যারাতেই জনৈকা কুমকুম চৌধূরী ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগ নিয়ে থানায় এসে হাজির। তার অভিযোগ, মেয়েদের ইদানীং ‘চড়ই’ বলে ইভ-টিজিং করা হচ্ছে এবং চট্টগ্রামের একটি গান এজন্য দায়ী। এ গানটি নিষিদ্ধ হলে ইভ-টিজিং বন্ধ হতে পারে।
ওসি ইজ্জত উদ্দিন জমাদ্দার সংগীতের সমজদার। কিন্তু সংগীতজ্ঞ নন কিছুতেই। তবে থানার ওসিদের বিচিত্রসব বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। আজ সেরকম একজন মানুষের মুখোমুখি বসে আছেন তিনি।
ফিল্ডে একটি অপারেশন শেষ করে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। স্বেদসিক্ত হয়ে তার রুমে এসে দেখলেন, তার ঘরে বসা স্বর্গের অপসরী। আর তাকে ঘিরে থানার পুলিশের দল। অপসরীর পাশে বসা উনি কে? স্বামী না কি প্রেমিক? ওসি উজ্জত আলীর পোড় খাওয়া চোখে কিছুই ধরা পড়ছে না। তিনি কি একটু ঈর্ষা বা অসুয়ায় কাতর হয়ে পড়লেন? সেই ভদ্রলোকই মুখ খুললেন,
-অ চড়ই তোঁয়ার বাড়ি কই গান গেয়ে আমার বন্ধুকে গলির মোড়ে ছেলেরা ইভ-টিজিং করছে কয়েকদিন ধরে। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি কিছুই করল না, তাই আপনার কাছে আসা।
-বন্ধু! স্বগতোক্তি করলেন ওসি সাহেব। তার একবার ইচ্ছে হলো কী রকম বন্ধু জিজ্ঞেস করেন। মেয়ে বন্ধু? বাগদত্তা? নাকি শরৎচন্দ্রের দত্তা? 
বাইরে রজনী গভীর। টুপটাপ শিশির ঝরছে। দূরে রেলস্টশনে শান্টিং চলছে। আর বাকি পৃথিবীকে ঘুম পাড়িয়ে শুধু রাধামাধব থানায় কতিপয় প্রাণী জেগে আছে।

পড়ুন: ৪র্থ পর্ব

চলবে...

পাখির অভিমান

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
পাখির অভিমান
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বুকের চেয়ে বড় কোনো ডাকঘর নেই, এই অধিবিদ্যার পৃথিবীতে
যেখানে দিনে-রাতে, কত চিঠি আসে আর যায়...

একই  শহরে থাকি আমি ও আমার অস্থির নীরবতা

খুঁজিনি কখনো বৃক্ষের বুকে কান রেখে আমারি নিশ্বাস। 
তবু মনের ভুবনে এই পৃথিবীর অদ্ভুত সন্ধ্যা এসে থামে; 
খোঁজ করে কোনো এক বৃক্ষের সংসারে এই আমাকে। 
আমি ব্যস্ত তখন, এক অকালপ্রয়াত বটবৃক্ষের নিহত সংসারে।

বিষণ্ন আঙিনাজুড়ে উড়ে পড়ছে একদল পাখির অভিমান। 
আজ হয়তো গাছে গাছে শুরু হবে পাখিদের শোকসভা। 
হাওয়ায় হাওয়ায় আরও মিলে যাবে বৃক্ষশ্রোতা। 
এই মহান পাখি সম্মেলনে আমিও মিলে যেতে 
চাই অন্তরের অনুলিপি হয়ে। 

দৈনিক বাতাস বিচিত্রায় আজ ছাপা হলো বৃক্ষ হত্যার প্রতিবাদ। 
সেই বৃক্ষের মৃত্যুতে গাছে গাছে ঝুলছে দেখি পাখিদের শোক প্রস্তাব।

বিজড়িত

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
বিজড়িত
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আঁধার আমার ভালো লাগে, 
তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ 
বড় প্রিয় গান 

তুমি যে সূর্যসম্ভব 

কালের নিয়মে তেজ ম্লান হয় 
লোহিত নক্ষত্রের গান 
শ্বেত বামন শুধু ম্লান হতে থাকে 

নিভে যায় সব...

গুঁড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে যায় 
কণিকা সম্ভার 

শূন্য জুড়ে তাই এত টান 

যাকে ‘মায়া’ বলে ডাকি।

কবিতা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

এই হাত
মুজিবুল হক কবীর

এই হাত
পতন ঠেকাতে জানে,
এই হাত ইস্পাত
পুড়ে যায় যজ্ঞে-আগুনে।

এই হাত মেতে ওঠে
মিছিলে-আন্দোলনে
এই হাত প্রতিবাদী
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে।

এই হাত নিয়ে আসে স্বর্গের পারিজাত
এ হাত থামিয়ে দেয় জলের প্রপাত।

হৃদয়ের যত গ্লানি মুছে দেয় এই হাত,
কার ইশারায় চলে যায় অহল্যারও অভিসম্পাত।

দ্বন্দ্ব ও কোলাহল, যুদ্ধ-
কখনো নেয়নি মেনে নানক ও বুদ্ধ।
এ জগৎ-সংসার একটি রজ্জুতে বাঁধা
কোথায় কৃষ্ণ আর কোথায় বা রাধা।

এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ডুবে আছে জলে,
তবু সব কিছু আজ
ঈশ্বরেরই করতলে।

প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল
কবি মুহম্মদ ইকবাল

কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ ইকবালের জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক মুসলিম পরিবারে ৯ নভেম্বর ১৮৭৭। মৃত্যু ২১ এপ্রিল ১৯৩৮। পিতা শেখ নূর মুহম্মদ। মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ ইকবালের কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি এবং উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদি’ (১৯১৫) পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে, ইকবাল পিএইচডিতে অধ্যয়ন করার জন্য জার্মানিতে চলে যান এবং ১৯০৮ সালে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ডক্টরেট থিসিসটির শিরোনাম ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া’। ১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসে লাহোরের সরকারি কলেজে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইন ব্যবসা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমিক। সাহিত্যের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন। উর্দু ভাষা ও কাব্যকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। সে জন্য তাকে শায়ের এ মাশায়েও বলা হয়। তার কাব্যমুগ্ধ পাঠককূল তাকে আল্লামা উপাধি দিয়েও সম্মানিত করেন।

শ্রীধরনামা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ পিএম
শ্রীধরনামা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শ্রীধর আমাদের বন্ধু মহলের এক চির বিস্ময়। সে-কালে, মানে যে-কালে এই শিল্পাঞ্চলে, যে শিল্পাঞ্চল ঘিরে সমরেশ বসু ‘জগদ্দল’ বা তারও আগে ‘উত্তরঙ্গ’ হয়ে ‘শ্রীমতী কাফে’ হয়ে ‘খণ্ডিতা’ পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, ১৯৮৮ সালের মার্চের ১২ তারিখ, সেই মহাসর্বনেষে তারিখটা না এলে হয়তো বিধুভূষণ বন্দোঘঁটি, শ্রীধরের জন্মদাতা, তিনিও দোলা-শ্রীধর বা কালুর বৌয়ের সঙ্গে শ্রীধরের আশনাই বা সমরেশ বসুরই বন্ধু, ভীমরুলের নাদনি, সেই পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবী, দীপক সাহার চায়ের দোকানে বসে, শ্রীধরের নিচের নয়, বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল- তা নিয়ে একালে এত হট্টগোল হতো না।

হুগলীর আনাচে-কানাচে সেই নিতম্বিনী দেবীর, নিতম্বের ভারে ঝপঝপে হয়ে যাওয়া শব্দের আওয়াজ, থমথমে হয়ে যাওয়ার ঠিক প্রদোষকালে, কখনো ঠাওর করে উঠতে পেরেছিল। সমরেশ বসুর লেখা ঝেঁপে, কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার হাউসে দিগ্বিদিক ভুলে সুরো ভটচায্যির গলিতে হাবুডুবু খাওয়া, রেখা পালের সমাজে স্বীকৃতি না পাওয়া দাদা, নিরোজ, নিরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সমরেশ বসুর দৌলতে যে কলিকালের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন, সেই নিরোজের সঙ্গে দোলার, ‘মাস্সাই’সুলভ সম্পর্ক ঘিরে সেই দোলার পেটে জন্ম নেওয়া শিশুকে, ‘আমার বৌয়ের সন্তান’ না বলে, ‘আমার শালীর মেয়ে’ বলে চালিয়ে যাবে, চালিয়েই যাবে শ্রীধর বন্দোঘঁটি?

আচ্ছা এই যে, ‘ভীমরুলের নাদনি’ শব্দটা ব্যবহার করা হলো, এই শব্দটা আপনারা পাঠকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন কী? এই যে টিপিকাল ‘ঘঁটি’ লব্জ, শাঁটুল গুপ্তের প্রজন্মের পর খাস বাগবাজারি ঘঁটিরাও কি এখন এমন শব্দের ব্যবহার ধরে রেখেছে? কিন্তু বিধুভূষণ বন্দ্যোঘঁটি, ঘঁটি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে আমাদের শাঁটুলবাবুর থেকে এক কাটি বেশি ছিলেন বই কম ছিলেন না।

বিধুভূষণ কখনো ‘পেপার’ বলতেন না। বলতেন, ‘খবরের কাগজ’। কখনোই তিনি ভুলবশতও গোটা জীবনে ‘চুঁজরো’ বই ‘চুচুঁড়া’ উচ্চারণ করেননি। কস্মিনকালেও গনগনে গরম চাভর্তি চাপ ঠোঁটের সামনে এনে গলায় চালান করবার সময়ে ‘উঁহুউউউ’ করে আওয়াজ করেননি। 

তাই তিনি ‘নাতনি’ কে ‘নাদনি’ বলবেন- এটা কিন্তু কখনোই আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো বিষয় আদৌ নয়। বিধুভূষণ বাংলা খেয়ে যখন ড্রেনের ধারে গড়াগড়ি খেত, তখন ওর নাতনি, যাকে শ্রীধরের বন্ধুরা, সেই সেকালে ‘নাতনি’র দেহের ভঙ্গিমা দেখে ‘পিঁয়াজি’ বলত, সেই হাফ গেরস্তকে যখন শ্রীধর, মেয়েদের নয়, ছেলেদের তানপুরো তৈরি করে দিল কালুর বউয়ের তানপুরো ফাটানোর বিনিময়ে, তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল, সে-কালের শ্রীধর আর এ-কালের শ্রীধরের মধ্যে জাপানি বন্ধুদের প্রভাবের আগে আর পরে এতটা ফারাক ঘটবে?

‘পিঁয়াজি’র দিকে শ্রীধরের বাপ, মানে শ্রীধরের বিকাশমান লালিত্যের সে-কালের উদ্ভাষক ক্ষিরুমামার একটা বিশেষ রকমের প্রভাব ছিল। প্রতিপত্তিও ছিল। আসলে ক্ষিরুর পৈতৃক সূত্রে একটা দখল করা বাড়ি ছিল সেকালের মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায়। এখন ক্ষিরুমামার আট মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি হলেও ‘পিঁয়াজি’কে নিয়ে যখন শ্রীধর, ওয়াই কে টু-র প্রবলেম সল্ভ করতে ক্ষিরুমামার ঠাকুর্দা, মানে শ্রীধরের পরদাদা, অশ্বিনীকুমার ঘোরপাড়ুইয়ের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যেত, তখন রিপোজ নার্সিংহোমের সামনে রীতিমতো লোক জমে যেত পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবীকে দেখতে।

পিঁয়াজিবালা এখন রীতিমতো আগুনখেঁকো নেত্রী। ব্যান্ডেল চার্চপাড়ায় এককালে যিনি দাপুটে কাউন্সিলর ছিলেন, সেই মাস্টারমশাই জ্ঞানদাকে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতে হয় পিঁয়াজিবালার আগমন এবং নিষ্ক্রমণ ঘিরে। জ্ঞানদার সঙ্গে শ্রীধরের পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে, শ্রীধর নিশ্চয়ই শুধাতো- দেবীর কি সে আগমন? আর নিষ্ক্রমণই বা কীসে? 

আচ্ছা  পিঁয়াজিবালার স্কুটির পেছনে শ্রীধর কখনো সাওয়ারি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি কখনো শ্রীধর তানপুরোতে তিনটে আঙুলের, কসরতে সুরলহরি তুলে ছায়াহিন্দোল গেয়েছে?

পিঁয়াজিবালা সেদিন লোটে মাছের ছালুন রেঁধেছিল বেলডাঙার মরিচ দিয়ে। ঝালের জন্য এদিকে বেলডাঙার মরিচের বেশ নামডাক আছে। সেই নুন দিয়ে নুচি খাওয়ার কালে শ্রীধর ব্যান্ননে মরিচ দেখলে তা আর মুখেই তুলত না। দীপক সাহার দোকানে পিঁয়াজিবালা প্রথম যেদিন শ্রীধরের কোলে বসে, শ্রীধরেরই বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল, সেদিনই দীপক সাহা নিজের হাতে দুটো কাঁচা মরিচ দেওয়া ডবল ডিমের ওমলেট খাইয়েছিল ছেলেটাকে।
লোটে মাছের ছালুন দিয়ে মাখা ভাতের লোকমাটা মুখে চালান করতে করতেই শ্রীধর বলে উঠল- 

বুঝলি কুমড়ি, এই লোটে মাছে প্রচুর ফসফরাস থাকে। ফসফারাসে চোখ ভালো হয়।

পিঁয়াজিবালাকে ডাক নামে ডাকতেই ভালোবাসে শ্রীধর। তবে কালুর বৌ থেকে ক্ষিরুর আপিসের সেই লাবণ্যলতা হয়ে চিনে হাঁদুর বর্তমান ভাগনেবৌ, সবাইকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে শ্রীধর ‘হেকেটি’ বলতে ভালোবাসে। কারণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’তে নাকি লেখা আছে, রবীন্দ্রনাথ, তার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ বলে ডাকতেন।

বড় বড় জিনিস দেখে তোমার এখন চোখ বড়তেই সয়ে গেছে গো শ্রীধরদা। নতুন করে আর তোমার এখন চোখ ভালো করবার দরকার নেই। চোখের জ্যোতি তোমার কালুদা আর ভবান বৌদি, দুজনেই মেজেঘসে বেশ চকচকে করেই রেখে দিয়েছে।

পিঁয়াজিবালা নোয়াখাইল্যা হলেও সমরেশ বসুর ‘ভানুমতী’র দেশে থেকে ফরাসডাঙার ‘হ্যাঁ গো’, ‘কী গো’ বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। যদিও হাওড়ার ঘঁটি কেতা ভুলে এখন শ্রীধর হাবুডুবু খাচ্ছে কালু জানুলম্বিত ঘণ্টার তালে তালে।

শ্রীধর মাঝেমধ্যে বেশ উদাস হয়ে যায় জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ কষতে গিয়ে। ছেলেটা খুব যে একটা হিসেবি, তা বলা যায় না। অন্ততপক্ষে এলাকার নেতা দুই তরফের দুই নেতা- মলয় ভট্টাচার্য আর শমিত ঘোষ, যারা দুবেলা যাদবপুর থেকে ঠেঙিয়ে নৈহাটি আসা শ্রীধরকে তাদের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখে, তারা কখনো ছেলেটাকে তেমন একটা হিসেবি বলে না।

আসলে বলে না, নাকি বলতে চায় না- এটা নিয়ে আবার সুনীতিদাদের ঠেকে বেশ তক্কবিতক্ক আছে। ওই যে সুনীতিদের সঙ্গে ঠেক মারা রেলের রিটায়ার্ড বুকিং ক্লার্ক তপুবাবু, রাত্রিক নাট্যসংস্থায় চা, জল বয়ে এনে নিজেকে নাট্যকর্মী বলে দাবি করে শহরের বুকে নাট্যোৎসব হলে ঠিক টুক করে মন্ত্রীর পাশের সিটটা দখল করে নেয়, সেই তপুবাবু, নিজের চাকরি জীবনে যেভাবে হাতের ভাঁজে একটা পাত্তি পকেটস্থ করতেন, ঠিক সেই স্টাইলে শ্রীধরকে রোজ একটা করে গোল্ড ফ্লেক সিগারেট দেয়।

কালু সম্ভবত মহাদেবের চা-খানায় এককালে সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে দুপুর আড়াইটের সময় শ্রীধরকে একা একা আড্ডা মারতে দেখে বাড়ি গিয়ে ভবানীকে ব্যাপারটা বলে ফেলে। আসলে সেদিন কালুরই ব্যাংকিংয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছিল। সবিতা। কালুর ছোটভাইয়ের বৌ, হাজার পাঁচেক টাকা চেয়েছিল। পেনশনভোগী কালু মাসের যত তারিখই হোক না কেন, সবিতা টাকা চাইলে কখনো না করতে পারে না। হাসির ছলে ভেসে যাওয়া দিনের কথা মনে করে হৃদয়ের দয়ার ঘটটা কালুর ছলছলিয়ে ওঠে ছোটভাইয়ের অসহায় বৌটার জন্য। 

নিজে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল সেদিন কালু টাকাটা পাঠাতে সবিতাকে। কিছুতেই অনলাইন ট্রানজাকশন হচ্ছে না। আবার বাড়িতে বসে বেশি সময় ধরে চেষ্টা করলে পাছে ভবানী জানতে চায়, মোবাইলে অতক্ষণ ধরে কী করছ খুটখুট করে? 

তাই পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে নেমে নেদু সান্যালের বাড়িটা পেরোতেই কালুর মনে পড়ে গেল, এই রে, শ্রীধর তো আবার বলবে; আরে কালুদা, আবার ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে এসেছেন? পুজোর তো এখন অনেক দেরি!

কালু অনেক বলবার চেষ্টা করেছে শ্রীধরকে বোঝাতে, ঘণ্টা যত নড়বে, হাওয়া তত বইবে, আলো আরও খেলবে। বলব বলব করেও অবশ্য কথাগুলো শ্রীধরকে বলে উঠতে পারেনি কালু। না বলবার কারণ হলো, পাছে শ্রীধর জেনে যায় অনুর জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব!

মহাদেবের দোকানে কালুর সমস্যা সল্ভ করে শ্রীধর, কিন্তু যেহেতু সে নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, খুব একটা পাত্তা দেয় না কালুকে। শ্রীধরের এই পাত্তা না দেওয়াটা বেশ একটু বেশি পরিমাণেই আঁতে লাগে কালুর। মটকা গরম হয়ে গেলেও মুখে কিছু না বলে মহাদেবের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে আবার সুরো ভটচায্যির গলি পেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মনে তখন কালুর একটাই তৃপ্তি, শ্রীধর খুব একা পাত্তা দিক আর না দিক, ওর দৌলতে সবিতাকে পাঁচ হাজার টাকা শেষ পর্যন্ত পাঠানো গেছে।

আজ সকালে যখন মলয় ভটচায্যি বললেন, শ্রীধরকে নিয়ে অক্ষয়কুমারী দেবী রোডের আশপাশে ঘুরতে দেখেছেন, একদম উল্টো রাজনৈতিক শিবিরের শমিত যখন এককথায় সমর্থন করল মলয়ের সেই কথা, শ্রীধর অবশ্য তখনো দাঁতের ডাক্তার রণজিৎ সরকারের বাড়িতে সে গেছিল, এই যুক্তিতেই একদম এঁটুলির মতো এঁটে রইল।

আসলে মিথ্যে কথাটা শ্রীধরের ঠিক আসে না। মিথ্যে বললেই কেমন যেন ওর মুখটা ভ্যাদাই মাছের মতো বোকা বোকা হয়ে যায়। আর তেমনটা হলেই, ডাল মে যে থোরা থোরা কালা- সেটা মালুম করে নিতে কারও খুব একটা অসুবিধা হয় না।

সাত সকালে আজ হেকেটি ফোন করেছে শ্রীধরকে। ট্রেনটা তখনো শিয়ালদা সাউথ সেকশনে ঢোকেইনি। এই সময়ে শ্রীধর সাধারণত ফোন-টোন ধরে না। সবাই জানে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরুর আগেই স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নৈহাটিতে মহাদেবের চায়ের দোকানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের কেয়ার না করে আড্ডা দিতে চলে আসে শ্রীধর। আবার বিকেলে, পাঁচটা বাইশের নৈহাটি লোকাল ধরে যাদবপুরে শেষ ক্লাসটা নিয়ে, ইউনিভার্সিটির ঘরগুলোর সব তালা ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে নাকি সেটা টেনেটুনে দেখে, বাপ্পার দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে, শঙ্কুরবাড়ি পাশ কটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে সে পৌঁছায়।

সুরঞ্জন দাশ নাকি শ্রীধরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; তা কত ইস্তক এ কাজ কোরচেন? 

শ্রীধর জবাব দিয়েছিল; একুনে সেই ত্রিগুণা সেনের আমল থেকে।

তার পর থেকে নাকি আর কেউ যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ঘিরে শ্রীধরকে কোনো কথা শুধোতে সাহস করেনি।

তাই এমন অসময়ে কালুদার বৌ ফোন করাতে যুগপৎ বিরক্ত আর বিস্মিত হলো শ্রীধর। তবে ছেলেটার সব থেকে বড়ো একটা গুণ হলো, রেগে গেলেও ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু ধরা যায় না, আনন্দেও নয়। তাই তো কালুর বৌ একদিন নিজের পরম তৃপ্তির পর শ্রীধরকে বেশ ন্যাকা ন্যাকা সুরেই শুধিয়েছিল; আর ইউ ওকে শ্রীধর? 

কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা কালুর ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে সাইকেলের তালা খুলে সটান মহাদেবের চায়ের দোকানের পাশে মাছের আড়তের বড় বেদিটার ওপর বসে পড়ে জোরে হাঁক দিয়েছিল, সোমনাথ একটা ছোট চা।

ভবানীর গলার স্বরটা আজ আদৌ রসেবশে নেই। বেশ একটু কর্কশই। শ্রীধর একটু জোর করলে যেমন চেঁচিয়ে উঠতে অভ্যস্ত কালুর বৌ, অনেকটা তেমন। অবশ্য শ্রীধরের ধারণা, হেকেটির এই চেঁচানিটা একটু আর্টিফিসিয়াল। লোক দেখানো। আসলে নদী যখন তীরে এসে আছড়ে পড়ে, জলের ইচ্ছে না থাকলেও জলে জলে কোলাকুলিতে যেমন নদীর পাড়ে ঢেউয়ের আছড়ে পরবার একটা আওয়াজ হয়, কালুর বৌয়ের সময় বিশেষের আওয়াজটাকে অমনটাই মনে হয় শ্রীধরের। তাই ফোনের ও-প্রান্ত থেকে যখন একটু খ্যাঁককুটে গলাতেই প্রশ্ন এল- ক্লাসে? 

নিজেকে একটু সেফসাইডে রেখেই ব্যাট করতে নামল শ্রীধর। কারণ, ওর তখন মন বলছে, বলটা গুগলিই হবে। আর গুগলি বলে ভালো ব্যাট করতে কোনোদিনই শ্রীধর পারে না। এককালে ছক্কা হাঁকানো শ্রীধর, সেই পিঁয়াজিবালার শ্রীধর, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়েই ফোনের ও-প্রান্তের দিকে উত্তর পাঠাল- হ্যাঁ, বলুন বৌদি।

দুই তরফেই খানিকটা নিস্তবদ্ধতা। শ্রীধর ভাবছে, সময় সম্বন্ধে তো হেকেটির অসাধারণ মাত্রাজ্ঞান। এই সময়ে তো খুব বড় কিছু দরকার না হলে, কেবল আমড়াগাছি করতে এই সময়ে হেকেটি ফোন করে না।

হ্যাঁ বৌদি, কালুদা ঠিক আছে তো? 

ও প্রান্ত থেকে একটাই উত্তর, টুকুদির ছেলের বৌয়ের প্রেগ কালার টেস্টের রিপোর্ট আমার হাতে।

ঝপ করে ফোনটা কেটে দিল শ্রীধর।