পর্ব-০৫
রজনী গভীরা। পুরো ঢাকা শহর গেছে ঘুমিয়ে। তবে এ সময়ও কয়েক কিছিমের প্রাণী জেগে আছে। দূরপাল্লার বাস-ট্রাকের চালক, গলি-ঘুপচিতে লুকিয়ে থাকা ছিনতাইকারী, মহাসড়কে বনবীথির আড়ালে রাহাজান, সিঁদ কাটা চোরের দল আর থানা এবং তার পুলিশ। শহরের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবশ্য অন্য এক প্রাণীদের চলাচলের জন্যও এ সময় প্রশস্ত। মানুষের চলাচল স্তিমিত হয়ে পড়লে তারা বের হয়। বের হয়ে নির্ধারিত পথে শুরু করে তাদের অশরীরী চলাফেরা- কেউ দেখে কেউ দেখে না।
তবে আজ এ সময়ে নতুন দুই মানুষের চোখেও ঘুম নেই- নবীন লেখক সজীব চৌধূরী আর চারুপল্লির চারু।
পল্লির সেন্ট্রি তাদের চূড়ান্ত মুহূর্তের মুখে বমাল ধরেছে, ধরে এনে রাধামাধব থানায় দিয়ে গেছে। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হচ্ছে। তারা দুজন বিচিত্র ধরনের সব মানুষের সঙ্গে ওসি সাহেবের অপেক্ষায় উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত পার করছে। ঘুম নেই কারও চোখে।
সজীব এই মুহূর্তে লেখকসত্তা হারিয়ে পলায়নপর এক ব্যাকুল যুবকে পরিণত হয়েছে। তার নিঃশ্বাস হয়েছে দীর্ঘতর। দীর্ঘ বারান্দার মতো রুমের এক কোণে বসে আছে সে, যেন রুমে উপস্থিত কারও চোখে না পড়ে। একটি প্রাচীনকালের ফ্যান দোল খাচ্ছে ছাদে। তার বাতাস গায়ে লাগে কি লাগে না। দেয়ালে বহুদিনের পুরনো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের এক ক্ষয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডার। সেখানে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এক অশান্ত সাগরের বুকে দিনের ক্লান্ত সূর্য ‘অস্ত যাইতেছে’।
সজীবের মনে কবিত্বের হাতছানি। আর সে বসে আছে রাধামাধব অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণ নামের থানায়। কিন্তু নামে যত প্রেম প্রেম ভাবই থাক, থানা থানাই। তবে তার মনে হলো, থানার নাম এমন হলে সে থানার লোকজন তথা পুলিশমহলের মনের অন্দরে নিজেদের অজানিতে এক টুকরো কোমল প্রেম উথলে উঠলেও উঠতে পারে।
সজীবের কবিত্ব কল্পনা মুহূর্তে উধাও হলো। ভয়ংকর দর্শন কয়েকজন পুলিশ এসে তাদের আরও বড় এক রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। নির্বিকার চারু চলল সঙ্গে। এখানে কেউ নেই। অন্ধকার বিজন কক্ষে নিজেদের একাকী আবিষ্কার করল দুজন। একটু পর আঁধার সয়ে এলে, চারু বলল, এটি কয়েদখানা। সজীব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কী হতে কী হয়ে গেল, ঠাহর করতে পারল না সে।
তবে এ যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। একটু পর তাদের ডাক পড়ল বাইরের মাঠে গানের আসরে। হ্যাঁ সজীবের যৌক্তিক মস্তিষ্কের আবরণী ভেদ করে দূরাগত গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গায়ক কোনো এক অচিন সুরে কী জানি কী ভেবে এই ইট-কাঠ-পাথরের নির্মম থানার চত্বরে রাত্রির মধ্যযামে গেয়ে চলেছে-
ও চড়ই তোঁয়ার বাড়ি কই-
উড়ন চরণ ভুলি কারে, ভাব গাছর আগাত বই...
যেতে যেতে সজীব আর চারু বুঝতে পারল, থানার মাঠে, থানারই এক কয়েদি দরদ দিয়ে গাইছে চট্টগ্রামের এই মরমি গান। আর শ্রোতা হিসেবে ওসি সাহেব জড়ো করেছেন থানার সব বন্দি, কয়েদি, পুলিশ সদস্যদের। জানা গেল, এ গান চালু হওয়ার পর চট্টগ্রামের ছেলে-যুবারা মেয়েদের চড়ই বলে ইভ-টিজিং করছে। তাই দাবি উঠেছে এ গান ব্যান্ড করার। ওসি সাহেব বুঝে উঠতে চাইছেন, এ গানে চড়ই শব্দের মানে কী আর এর মাধ্যমে কীভাবে মেয়েদের ইভ-টিজিং করা যায়।
কিন্তু সাহিত্যিক সজীবের মন এসবে নেই। নিজের দুরবস্থা, থানার আবদ্ধ পরিবেশ, মামলা-মোকাদ্দমা, ডান্ডাবেরী পেরিয়ে তার কর্ণকুহুরে একটানা বেজে চলেছে মধ্যরাতের রাগ রাগেশ্রী-
স র জ্ঞ ম প ধ ণ
স জ্ঞ ম ধ ণ স
ম ণ ধ ম প
ধ ম জ্ঞ র সা।
আঁই তো বুঝির তুঁই প্রেমত পইজ্জু কিয়ার লই...
রাত্রির শেষ যাম। দাগি আসামি, বাদী-বিবাদী, অস্ত্র-গুলিতে সরগরম রাধামাধব থানা নিস্তব্ধ করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে গায়ক একমনে গেয়ে চলেছেন গানের সরগাম-
জাতর সাপ গাতত মরে ফয়েজ মরে ঘরত বই,
ধর্ম সংসার গরে, নাই দেহ-ঘরত মন-চড়ই,
প্রেমিক ডোবে চোখের জলে আব্দুল আলিম বুঝল কই!
পোড় খাওয়া ওসি ইজ্জত আলী জমাদ্দার। অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য কী অলংকার শাস্ত্র যে তার অধিতব্য বিষয় হতে পারে তা কোনোদিন ভেবে ওঠেননি। শুধু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত- এ তিন রকম ছন্দের সংজ্ঞা মুখস্ত করেছিলেন। সাহিত্যের বাকি অধীত বিষয়গুলো স্মৃতি থেকে ধুয়ে-মুছে গেছে কতকাল। শুধু কেমন করে, তিনি নিজেও জানেন না, স্মৃতি আঁকড়ে রয়ে গেছে একটি কথা- রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ কোনো কবিতার বই নয়; এটি একটি উপন্যাস।
তিনি ভাবছেন তাঁর এই একমাত্র সাহিত্য জ্ঞান দিয়ে এত বড় সাহিত্য জিজ্ঞাসার সমাধান অসম্ভব। কিন্তু নিজের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বও বজায় রাখা চাই। তাই যে কোনো সুধী সমাবেশে তিনি যেভাবে শুরু করেন, আজও সেভাবেই আরম্ভ করলেন-
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শেষের কবিতা’ নামক উপন্যাসে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, এ জন্য অনেকে শেষের কবিতাকে মনে করেন একটি কাব্যগ্রন্থ। আবার অনেকে না জেনে শুধু নাম শুনে বলেন, এটি একটি কবিতার বই। কাজেই সাহিত্য বিচারের আগে প্রয়োজন সাহিত্যের নিবিড় অধ্যয়ন। কী বলেন আপনারা?
উপস্থিত কেউ কিছু বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। ওপরে শেষ রাত্রির আকাশ, চতুর্দিকে থানার ঘেরাওয়ের মাঝে সংগীতের আসর। তারা কী করবে, কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। তবে থানার পুলিশ সদস্যদের সহজ উপলব্ধি, তাদের স্যার অনেক জ্ঞানী এক মানুষ। ওসি ইজ্জত আলী জমদ্দার তার সহকর্মীদের এ মনোভাব জানেন। কিন্তু সহস্র অপরাধ মাথায় থানায় আসা শত অপরাধীর মনে তার এ ভাষণ কী আলোড়ন তুলছে তা তিনি কেমন করে বুঝবেন, বুঝতে পারবেন? গায়েবের সেই খবরের মালিক তো একমাত্র তিনিই।
অবিদ্যাপল্লির সেন্ট্রির হাতে ধরা পড়ার পর থেকে সমাজে নিজের সম্ভ্রম আর সম্মানের কী হবে সেই চিন্তা সজীবকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যদি পুলিশের হাতে বন্দি হন, নির্যাতিত হন, যদি জেলে পাঠানো হয়- কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সমাজ জানে, দশজন জানে- লেখক সজীব চৌধূরী অবিদ্যাপল্লিতে... সজীব আর ভাবতে পারেন না।
কিন্তু সজীব আশ্চর্য হয়ে যায়, ওসি সাহেবের ভাষণের পর এই অকল্পনীয় ভরাডুবির কিনারায় দাঁড়িয়ে, আসন্ন পতনের মুখে কীভাবে, কেমন করে তার মনে পড়ল জনৈক ক্ষমতাধর নেতার ভরা পল্টনে সরকারের পদলেহী কবিদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ: ‘রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার পর বাংলা সাহিত্যে কোনো ভালো কাব্যগ্রন্থ কেউ লিখতে পারেনি। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি যদি কেউ পারেন শেষের কবিতার মতো একটি কবিতার বই লিখে দেখান’।
এই ধরনের সবজান্তা নেতাদের নিয়ে কত দিন বন্ধুসভায় নির্মল আনন্দে কেটেছে, সজীব ভাবে। কিন্তু সে ভেবে উঠতে পারে না, এ কঠিন আনপড়া মফস্বলের এক ওসি কেন সেই ভুল করলেন না। এ কি কোনো নতুন ষড়যন্ত্র!
সজীবের চিন্তায় সময় বাধা পড়ল। সজীব দেখল তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে নব্য লেখক শাহাদাত আহসান।
সজীব তাকে ভালো করেই চেনে। তার লেখা আর যাই হোক সাহিত্য নয়, সজীব এবং সজীবের মতো ধ্রুপদী লেখকরা সবাই একথা জানে। কিন্তু সবাই একথাও জানে, আজকাল এই লঘু, চটুল লেখারই রমরমা চলছে। বিশ্বসাহিত্যের আসরে বাংলার ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার এ ধ্বংসাত্মক ধারা দেখে তারা মর্মাহত হয় বটে কিন্তু কিছুই বলে না অথবা বলতে পারে না। জনপ্রিয়তার বাজার বলে কথা।
কিন্তু সজীব আশ্চর্য হয়ে দেখল, উঠতি বয়সী আর মুনাফালোভী প্রকাশকদের মতো রাধামাধব থানার ওসি সাহেবও এ লেখকের ভক্ত। নইলে এ নিশি রাইতে একটি সংগীতের দোষ-গুণ বিচারের জন্য সংগীত শাস্ত্রের এক ব অক্ষর গোমাংস লেখককে তিনি ডেকে আনবেন কেন!
কিছু একটা বলতে হয় বলে সজীব বলল,
-হ্যালো শাহাদাত, এত রাতে থানায়?
-ওসি সাহেব ডেকে নিয়ে আসলেন কী একটা সংগীতের গুণ বিচার করতে হবে। তা তুমি কেন এত রাতে থানায়?
সজীবের অন্তরাত্মা ধক করে উঠল। কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-বুঝে নাও, কেন এসেছি।
নব্য লেখক শাহাদাত মনে হলো কিছুটা আহত হলো। থানার ওসি সাহেবেরাও কি আজকাল সিরিয়াস লেখার ভক্ত হতে শুরু করেছে! তার চিন্তাগুলো বুকের বন্দরে তড়পায়, কিন্তু মুখে আসতে পারে না।
এসময় দূর থেকে গানের শব্দ ভেসে আসায় বাঁচোয়া। শাহাদাত সেদিকে চলে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচে সজীব। চারু অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওপরের আকাশে চাঁদ বেদনার্ত আলো বিলিয়ে যায়।
সমস্ত কিছু আচ্ছন্ন করে সজীবের মনে আবার সেই ভয় জেগে ওঠে। যদি দুনিয়া জেনে যায়, কী হবে তার!
এদিকে থানার চত্বরে সমবেত ছোট্ট জনতা শেষ রাত্রির সংগীত সুধায় বিদুর। তারা সংগীতজ্ঞ নয়। কিন্তু সংগীতের গুণ বিচারের এই অযাচিত অনুষ্ঠানে ওসি সাহেব তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কাজেই এই অভাবিত প্রতিষ্ঠানে এরকম অশ্রুতপূর্ব গানের আসর তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল।
অবশ্য সংগীতের এ আসর জমাতে ওসি সাহেবকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সন্ধ্যারাতেই জনৈকা কুমকুম চৌধূরী ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগ নিয়ে থানায় এসে হাজির। তার অভিযোগ, মেয়েদের ইদানীং ‘চড়ই’ বলে ইভ-টিজিং করা হচ্ছে এবং চট্টগ্রামের একটি গান এজন্য দায়ী। এ গানটি নিষিদ্ধ হলে ইভ-টিজিং বন্ধ হতে পারে।
ওসি ইজ্জত উদ্দিন জমাদ্দার সংগীতের সমজদার। কিন্তু সংগীতজ্ঞ নন কিছুতেই। তবে থানার ওসিদের বিচিত্রসব বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। আজ সেরকম একজন মানুষের মুখোমুখি বসে আছেন তিনি।
ফিল্ডে একটি অপারেশন শেষ করে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। স্বেদসিক্ত হয়ে তার রুমে এসে দেখলেন, তার ঘরে বসা স্বর্গের অপসরী। আর তাকে ঘিরে থানার পুলিশের দল। অপসরীর পাশে বসা উনি কে? স্বামী না কি প্রেমিক? ওসি উজ্জত আলীর পোড় খাওয়া চোখে কিছুই ধরা পড়ছে না। তিনি কি একটু ঈর্ষা বা অসুয়ায় কাতর হয়ে পড়লেন? সেই ভদ্রলোকই মুখ খুললেন,
-অ চড়ই তোঁয়ার বাড়ি কই গান গেয়ে আমার বন্ধুকে গলির মোড়ে ছেলেরা ইভ-টিজিং করছে কয়েকদিন ধরে। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি কিছুই করল না, তাই আপনার কাছে আসা।
-বন্ধু! স্বগতোক্তি করলেন ওসি সাহেব। তার একবার ইচ্ছে হলো কী রকম বন্ধু জিজ্ঞেস করেন। মেয়ে বন্ধু? বাগদত্তা? নাকি শরৎচন্দ্রের দত্তা?
বাইরে রজনী গভীর। টুপটাপ শিশির ঝরছে। দূরে রেলস্টশনে শান্টিং চলছে। আর বাকি পৃথিবীকে ঘুম পাড়িয়ে শুধু রাধামাধব থানায় কতিপয় প্রাণী জেগে আছে।
চলবে...