ঢাকা ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

সাহিত্যিক কামালউদ্দীন আহমদ খান

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৪৭ পিএম
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৩ পিএম
সাহিত্যিক কামালউদ্দীন আহমদ খান
সাহিত্যিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক কামালউদ্দীন খান

আমাদের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবনে কত যে প্রতিভাধর, ত্যাগী উদারমনা মানুষ আছেন একেবারে প্রচার বিমুখ নীরবে-নিভৃতে তাদের ক’জনকে জানি ও চিনি আমরা? কোনো দিন লোকচক্ষুর সামনে আসেননি, নিজেদের সহজ-সরল মনে সানন্দচিত্তে ত্যাগ করেছেন, মিশিয়ে দিয়েছেন নিজেকে নির্বিবাদের অন্তরালেই। এমনই এক মহৎ ব্যক্তিত্ব হলেন সাহিত্যিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক কামালউদ্দীন খান। 

গবেষক শামসুজ্জামান খানের ভাষায়, ‘কামালউদ্দীন খান ছিলেন আধুনিক বাঙালি মুসলিম সমাজের এক আত্মপ্রচার বিমুখ সৎ সজ্জন এবং ধীমান চিন্তাজীবী, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তার আজীবনের চিন্তাজগৎ বিজ্ঞানের আলোয় ছিল আলোকিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার ইতিহাসবোধ, যুক্তিশীলতা ও সমাজ চেতনার দীপ্রতা। ফলে তাকে আমরা পেয়েছি একজন অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিক চৈতন্যে ভাস্বর লেখক ও ভাবুক, সামাজিক শ্রেয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ হিসেবে।’

হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদ চট্টগ্রামের পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও দিগন্ত প্রসারিত বেলাভূমি বেষ্টিত চট্টগ্রামের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতী গ্রামের ডেপুটি বাড়িতে বিস্মৃত প্রায় বাঙালি মনীষা, বাঙালির ইতিহাসের বিরল উত্তরাধিকারী আলোকিত মানুষ কামালউদ্দীন আহমদ খান ২৮ বৈশাখ ১৩১১ বঙ্গাব্দ এবং ১৯০৫ সালের ১১ মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তৈয়বুল্লাহ খান এবং মাতা মোসলেমা খাতুন। পিতামহ খান বাহাদুর নাসিরউদ্দিন খান।

স্থানীয় গ্রামের পারিবারিক মক্তবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। স্থানীয় স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপ্যাধায়ের প্রশংসিত ও স্নেহাধন্য প্রতিভাধর ছাত্র হিসেবে তিনি সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন কামাল উদ্দীন খান মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯৩১ সালে সাহিত্য সমাজের সভায় তিনি ‘সভ্যতার উত্তরাধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখান থেকেই সাহিত্য জগতে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র ‘শিখা’সহ প্রভৃতি পত্রিকায় ও সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকীতে সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লেখেন। 

শিক্ষাজীবন শেষে সরকারের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। চাকরি জীবনে কলকাতা, বর্ধমান এবং ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতায় অবস্থানকালীন হাবীবুল্লাহ বাহার এবং শামসুন্নাহার মাহামুদ সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩৯ সালে তিনি বরিশাল অঞ্চলে অভিজাত পরিবারের সন্তান বেগম সুফিয়া এন হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কামালউদ্দীনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়েটা বিদ্রোহ কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রস্তাবেই হয়েছিল। বিদ্রোহী কবি প্রায়শ সওগাত অফিসে এসে পড়েন। এমনই এক দিন শুভাকাঙ্ক্ষীদের আলোচনায় সব কথা শুনে তিনি নির্দিধায় বলেন, ‘সুফিয়াকে কামালউদ্দীনের সঙ্গে বিয়ে দিতে, কথাটা সবাই ভালো করে বোঝার আগেই কবি ঝড়ের মতো যেভাবে এসেছিলেন তেমনি ঝড়ের মতোই চলে গেলেন। বিবাহ-পরবর্তী সময়ে যিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় বেগম সুফিয়া কামাল হিসেবে সুপরিচিত। ইতিপূর্বে তার বিবাহ হয়েছিল। এক সন্তানের মা হওয়ার পর তিনি বিধবা হন। সে সন্তানের নাম আমেনা (দুলু) কামাল উদ্দীন খান ছিলেন তার দ্বিতীয় স্বামী।

এ সম্পর্কে বেগম জওশন আরা রহমান লিখেন, ‘নব পরিণীতা মামানী সুফিয়া কামালকে নিয়ে মামা কামালউদ্দীন খান নিজ বাড়ি চুনতী গ্রামে আসলেন। মায়ের মুখে শুনেছি মামানী আমার নানার বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই এক মুঠো মাটি কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন, এ মাটি আমার তীর্থ ভূমি। এ পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যাতে চিরদিন সুমধুর থাকে এই প্রার্থনা করি।’

বলাবাহুল্য যে, তারা দীর্ঘ সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের মোট পাঁচ সন্তান রয়েছে। তারা হলেন যথাক্রমে শাহেদ আহমদ কামাল, আহমদ কামাল, সাজেদ কামাল, সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল। 

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও কামালউদ্দীন খান বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন একনিষ্ঠভাবে নীরব একজন কর্মী, ফলে কোনো সরকারই তার প্রতি সুবিচার করেননি। তার কাজের যথাযথ মূল্যায়নও হয়নি। বরং পদে পদে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু কখনো আপন দেশ-জাতির সেবার মনোভাবের কোনো বদল ঘটাননি এবং নিজে যেমন, তেমনি কবি সুফিয়া কামালকেও প্রভাবিত করেননি। পেশাগত জীবনে যেমন ওয়াসায় কাজ করেছেন, তেমনি আত্মিক টানে পালন করেছেন বিখ্যাত ফ্রাঙ্কলিন বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা। তাছাড়া ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠাতায়ও তার ভূমিকা রয়েছে।

কামালউদ্দীন খানের লেখালেখির জগৎ একরৈখিক নয়, বহুমাত্রিক প্রবন্ধ, কবিতা, সনেট, একাঙ্কিকা, ছোটগল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা, গ্রন্থ পর্যালোচনা সবই তার লেখালেখির জগৎকে সমৃদ্ধ ও চিৎপ্রকর্ষমণ্ডিত করেছে। তার অনুবাদ দক্ষতাও তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অনবদ্য, ছোটদের জন্য তার অনুবাদ প্রন্থ ‘পরদেশিয়া’ অসাধারণ। এ ছাড়া কামালউদ্দীনের জ্ঞান-সাধনার মধ্যে সুফিবাদী ধারার প্রভাব স্পষ্ট। তার জীবনচরণ ও অবয়বের মধ্যেও এক রকমের সুফি ও ঋষিভাব লক্ষণীয়। জ্ঞান চর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার সমন্বিত ধারা তার পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ।

তার প্রকাশনা তালিকা দেখলে বোঝা যায় যে, তিনি কতটা মননশীল, উদার যুক্তিবাদী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি নীরবে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তার যুক্তিবাদী মননশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। সর্বোপরি বেগম সুফিয়া কামালের খ্যাতির পেছনে তার যে নীরব ভূমিকা ছিল সে কথাই বলাবাহুল্য। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে কামালউদ্দীন খান একজন উজ্জ্বল প্রতিভা।

ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান বিষয়ে কামাল উদ্দীন খান শতাধিক মৌলিক প্রবন্ধ লিখেছেন। নানা মনীষীর ইংরেজি রচনার বাংলা অনুবাদও করেছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিভিন্ন কারণে তার রচনাবলি সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। সাহিত্যিক হিসেবে তার প্রকাশিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা এখানে প্রদান করা হলো। যদিওবা এ তালিকা পরিপূর্ণ নয়। 
একাঙ্কিকা: ‘অতি বিবাহ’, জয়তী, বৈশাখ ১৩৩৭, কলিকাতা।
প্রবন্ধ: ‘সভ্যতার উত্তরাধিকার’, শিখা, পঞ্চমবর্ষ ১৩৩৮, ঢাকা।
ছোটগল্প: ‘যে জীবন সম্ভোগস্পৃহায়’ জয়তী, ১৩৩৭।
প্রবন্ধ: ‘বস্তু রহস্য’ বুলবুল, ভাদ্র-অগ্রহায়ণ ১৩৪০, কলিকাতা, ‘আধুনিক আল কিমিয়া’, বুলবুল, শ্রাবণ ১৩৪৩।
অনুবাদ: ‘The Reconstruction of Religious Thought in Islam’ by Sir Muhammad Iqbal. ‘ইসলাম ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’, পাকিস্তান পাবলিকেশনস, ঢাকা-১৯৫৭।
অনুবাদ: Six Lectures on the Reconstruction of Religious Thought in Islam and Is Religion Possible? by Sir Allama Iqbal, Oxford University Press। ওই গ্রন্থের ভূমিকা এবং চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তম পরিচ্ছেদের অনুবাদ।
অনুবাদ: ‘কোয়েটা’, রূপময় পশ্চিম পাকিস্তান, পাকিস্তান পাবলিকেশনস, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭০।
কবিতা: ‘ওরে পথহারা অন্ধ’ ‘নিশি যে কাটিতে নাহি চায়’, ‘নিশীথের প্রিয়তমা’ বুলবুল পত্রিকা ও শামসুল হুদা সম্পাদিত ‘কয়েকটি কবিতা’ সংকলন ১৯৪৬।
সনেট : ‘আজি তুমি গৃহলক্ষ্মী’ আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘সনেট শতক’, পৌষ ১৩৮০ প্রভৃতি।

‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন তার স্মৃতিচারণে বলেন, ‘কামালউদ্দীন খান ছিলেন এক প্রতিভাধর লেখক। সাহিত্যে তার অবদান আছে অথচ মূল্যায়নের সুযোগ মেলেনি। তার লেখা ছিল ঋদ্ধ; সমৃদ্ধ। কিন্তু তিনি খুব বেশি লেখেননি। খালুজান মনে হয় ত্যাগই স্বীকার করেছেন স্ত্রীর জন্য। সুফিয়া কামালকে সম্পূর্ণ কবি সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার মানুষ হতে কামালউদ্দীন খান নিজস্ব চিন্তা ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি। বেগম সুফিয়া কামাল কবিখ্যাতি ও জনসেবক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনে তার অকুণ্ঠ সমর্থন সর্বাত্মক সহযোগিতা ত্যাগেরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।’

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বেগম সুফিয়া কামাল ও কামালউদ্দীন খান সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা একতলা বাড়ি ৬৫৮ এ, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ৩২ নম্বর রাস্তায় চলে আসেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ‘সাঁঝের মায়া’ নামক বাড়িটি ছিল লেখক সাহিত্যিকদের আড্ডা ও মিলন ক্ষেত্র। অত্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন এ বাড়িটিতে সকাল-সন্ধ্যা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মুক্তিচিন্তার আধুনিকমনস্ক, দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত মানুষদের আসা যাওয়ায় মুখরিত ছিল।

সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন তার স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “তারাবাগ ছেড়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে কামালউদ্দিন ‘সাঁঝের মায়া’য় উঠে আসলেন। সীমানা ছাড়িয়ে জীবন নির্ভরতার প্রশস্ত প্রাঙ্গণে তখনো কামাল উদ্দীন খান একইভাবে সচেতন সতর্ক সংগঠক। মুখমণ্ডল আর শুভ্র দেহাবয়ব বিশিষ্ট যে মানুষটি তারাবাগের প্রকৃতিঘেরা পরিবেশে বাস করতেন, তিনি তার পারিবারিক শুচিস্নিগ্ধ পরিবেশ তৈরি করে নতুন বাসাটিকেও প্রকৃতির বনানী কিংবা বাগিচায় পরিণত করেছিলেন, এই বাসর বারান্দায় সুফিয়া কামাল মহিলা পরিষদ, ছায়ানট ইত্যকার নানা সংগঠনের কর্ণধার হিসেবে তৎপর থেকেছেন। নিরত এই উদার বাস্তববাদী মানুষটি নীরবেই কিংবা আড়ালেই থেকে গেছেন। কেউ জানেননি তার কীর্তির কথা ও কাজ।’ 

প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের এবং জীবন কর্মে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার অগ্রণী পুরুষ কামালউদ্দীন আহমদ খান ৪ কার্ত্তিক ১৩৮৩ বাংলা ৪ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।

তিনি সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদায় অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অনুকরণযোগ্য সৎ, নিরহংকার, সজ্জন। সেকি সামাজিক ও বংশগৌরবের দেয়াল তুলে নিজেকে জাহির করা বিকৃত রুচিতে আসক্ত ছিলেন না মোটেই। তিনি আজীবন মনুষ্যত্বের সাধনা করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘জ্ঞান সাধনার ভেতরে মানুষের জন্য অনন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ ফলে তিনি হয়ে উঠেন বাঙালির চিন্তাবিচার কিংবা মানবিক বোধের জাগরণের এক মহান ঋত্মিক।

কামালউদ্দীন খানের মতো একজন নীরব মানবকল্যাণ সাধকের মহতী জীবন সেই কথাটিই আমাদের প্রজন্মের জন্য জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

[email protected]

কবিতা

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
কবিতা

আমরা পুতুল

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমরা তো আজীবন পুতুলের প্রতিশব্দ, কত
ভাঙাগড়া আমাদের, দিনরাত অন্দর সদর,
যা খেলি জানি না খেলা গড়ে কে নেপথ্য কারিগর।
আজ রাজসিংহাসনে, কাল হয় মুহূর্তে পতন।
মন্বন্তরে মরি না তো, সাপ বাঘ নিয়ে খেলা করি,
চাল নেই চুলো নেই, তবু চড়ি সোনার সাম্পান,
স্বপ্নে কত জর্দা চুন ছাড়া খাই ভুলরঙা পান।
অলীক জীবনটাকে কে বাঁচায়, কোন ধন্বন্তরী?
জন্মদাতা পিতামাতা, ভাইবোন পুতুল, পুতুল!
প্রেমিকার ওষ্ঠে মধু, বুকে মধুরতরতা জানি,
তার ঋতুমতী নদীটিকে ঘিরে আমি মহাজন
মহান মূর্খের শাহজাদা, নিজেকেই বলি, ‘শোন,
প্রাণপাখি উড়ে গেলে থাকবে কেবল খাঁচাখানি,
সেই দিন দেখা দেবে পুতুলনির্মাতা নির্ভুল।’

প্রকৃতির পরিহাস

মো. ইমদাদুল হক মিলন

সব নক্ষত্র আজ জেগে আছে
ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবী ক্লান্তির বিছানায়।
তারাদের আজ বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে।
বেমানান? হ্যাঁ আলোহীন আঁধার রাতে
রাতের রানি  হাসনাহেনাকে আজ
আরও বেশি বিধুর লাগছে
তার সৌরভ সন্দিগ্ধ হীন যাপনে।

নিশুতি রাতের লক্ষ্মীপেঁচা
আর আগের মতো ঘূতকার
শব্দে ভীতির বদন্যতা বয়ে আনে না।
হার মেনেছে শালিকের শান্ত চাহুনি
তারাহীন বিভূঁইয়ে রাত শেষ ভোরে।
প্রভাতী শ্যামা আগের মতো নতুন ভোরের স্বপ্নে
দোয়েলের শিসে মেশে না।

কোকিলের ডাকে বিরহী বাতাস আজ আর বহে না।
আগমনী আহ্বানে কোকিল কণ্ঠের 
কামনার কুহু রবে ধ্বনিত প্রতিধ্বনি বিম্বিত হয় না।
হবে কি হবে বৃষ্টি বিলাসী বাগিচায় বুলবুলি,
সব পাখির কলরব, নতুন বন্ধনে আগমনী ভোরে।

ইন্দ্রিয়লব্ধ বোধ

তানজীনা ফেরদৌস

পাকস্থলী ভরা আগুন নিয়ে বেঁচে থাকি
তবু মুখাগ্নির ভয়ে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক যাযাবর আমি।

জীবনে যদি কোনো সাধকের দেখা মেলে-
তবে তার ধ্যানেই নিজেকে সঁপে দিতে চাই। 
শুনেছি সাধক থেকে মন্ত্র নিলে দ্রুত লাভ করা যায় সিদ্ধি…

পৃথিবীতে আমরা কতকিছুর পেছনে ছুটে চলি
কিন্তু ঘুরেফিরে সবাই একটি জায়গায় স্থির হই…
মাটিতে আমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হয়
অথচ মাটির ওপর ছুটে চলা যে অনর্থক তা কেবল মাটিতে মিশেই বোধগম্য হয়।
শ্মশান কিংবা সমাধির ভয়ে কত শত জীবন্ত লাশ 
ঘুরতে থাকে পরম্পরায়।

নতুন বই

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
নতুন বই

ভাষা চিন্তার পোশাক, আর বই সভ্যতার চাবি। বই পড়া একদিকে যেমন মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায়, অন্যদিকে উন্নততর হয় মানুষের ভাষাজ্ঞান। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো বই, যার সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হতে পারে না।…

ইসলামে নারী ও বেগম রোকেয়া
ড. মাহবুবা রহমান
প্রকাশন: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: জুন ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৬৭২, মূল্য: ৪৩০ টাকা

বাঙালি নারী জাতির ভাগ্যোন্নয়নের কথা সর্বপ্রথম বেগম রোকেয়াই চিন্তা করেন এবং নারীদের মানবিক অধিকার লাভের জন্য সর্বপ্রথম তিনিই জনসমক্ষে আলোচনা করেন বা তুলে ধরেন। তার লেখনীতে নারী অধিকারের বিষয়টি ছিল মুখ্য। বাঙালি নারীদের জন্য বেগম রোকেয়া আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হন। শিক্ষালাভ করা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীদের শিক্ষা অর্জন ছিল সুকঠিন বিষয়। তৎকালে পর্দার নামে নারীদের বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। তাদের শিক্ষালাভ এবং আর্থিক সুবিধা অর্জন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

উত্তরাধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা কারও নেই। একমাত্র ইসলামেই নারীর যথোপযুক্ত অধিকার স্বীকৃত। তবে পুরুষশাসিত মুসলিম সমাজে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বেগম রোকেয়া সারাটি জীবন নারীদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। তার লেখনীতে নারীদের বঞ্চিত হওয়ার নানা গল্প ও ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। গ্রন্থের লেখক ইসলাম যে নারীর বহুমুখী অধিকার নিশ্চিত করেছেন এবং বেগম রোকেয়া সারা জীবন নারীদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তা তথ্যসমৃদ্ধভাবে ও সুন্দর সাবলিল ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

Triangle 
ট্রায়াঙ্গল 
ডানিয়েল স্টিল 
প্রকাশক: ডেলাকোর্ট প্রেস, নিউইয়র্ক  
প্রকাশকাল: ১ অক্টোবর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ২৫৬, মূল্য: ২০.২৮ ডলার 

নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার কথাসাহিত্যিক ডানিয়েল স্টিলের নতুন উপন্যাসের নাম ‘ট্রায়াঙ্গল’। স্টিলের এই নতুন উপন্যাসের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে রহস্য। কাহিনিতে বলা হয়েছে, শিল্পরসিক নারী আমান্ডা ডেলানো হঠাৎ করেই একজন অচেনা-অজানা লোকের কাছ থেকে বিশেষ বার্তা পেতে থাকে। ফরাসি ব্যবসায়ী বাবা এবং আমেরিকান মডেল মায়ের একমাত্র সন্তান আমান্ডা। দুজনের কেউ আর বেঁচে নেই। চল্লিশ বছর বয়সে তার দেখা হয় লেখক-প্রকাশক অলিভিয়ের সেইন্ট আলবিনের সঙ্গে। একই সময়ে দীর্ঘদিন পর দেখা হয় পুরনো বন্ধু টম কুইনলিনের সঙ্গেও। বিশ বছর আগে তারা একসঙ্গে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। সুদর্শন অলিভিয়েরের আরও কাছাকাছি আসার পর আমান্ডা জানতে পারে, সে আসলে নারীদের মুগ্ধ করতে ওস্তাদ এবং সে আসলে বিবাহিত। একদিকে অলিভিয়ের, অন্যদিকে টম এবং রহস্যজনক বার্তা। এসবের জট ছাড়ানোর জন্য আমান্ডা দারস্থ হয় কৌতুকপ্রিয় বন্ধু পাসক্যাল লেব্লাঙ্কের। এর মধ্যে তার বাড়িতে হানা দেয় সন্ত্রাসীরা। আমান্ডার জীবনে প্রেম আর আতঙ্ক আসে সমান্তরাল পথে। নারীর নিজস্ব নীতিতে অটল থাকা এবং ভালোবাসায় সাড়া দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ডানিয়েল স্টিলের ‘ট্রায়াঙ্গল’।

তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৬ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী উত্তাল কালপর্বে আত্মপ্রকাশ প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালী গ্রামে; মৃত্যু ১৯৯১ সালের ২১ জুন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণ-আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতৃপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। মাটি, মানুষ ও ঐতিহ্যের প্রতি আমৃত্যু দায়বোধ তার কাব্যকে দিয়েছে মৃত্তিকালগ্ন ও শিকড়স্পর্শী চারিত্র্য। নিজেকে ‘শব্দ-শ্রমিক’ উল্লেখ করে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের নিষ্ঠা। তাই তার কবিতায় সব অসাম্য, শোষণ, নিপীড়ন, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও নব্য-ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বারবার ঝলসে উঠেছে অগ্নিক্ষরা প্রতিবাদ। ঈর্ষণীয় সংখ্যক কবিতা, গল্প, গদ্য; একটি কাব্যনাট্য ও চিত্রনাট্য। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ (১৯৭৯)। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০, ১৯৮১) ও মরণোত্তর একুশে পদক (২০২৪)। পিতা ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মাতা শিরিয়া বেগম।

সুবর্ণরেখা

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
সুবর্ণরেখা

মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোস্তফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত। স্কুলজীবনেই কবির সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’ প্রকাশিত হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিচের দুই লাইন কবিতার মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেছিলেন- “তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি, মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।” সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা।...’ গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের বেশির ভাগের মূল বিষয় ইসলামি আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। তিনি তার প্রবন্ধে লেখেন, ‘যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসাদের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিল কোনো স্বাতন্ত্র্য, না ছিল কোনো স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মনন শক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। জাতির অন্তরমূর্তি ছায়া ফেলে তার সাহিত্যের মনো-মুকুরে। সাহিত্য তাই জাতির মনের প্রতিধ্বনি। সাহিত্যের ভেতর দিয়েই গোটা জাতির সাচ্চা চেহারা দেখা যায়। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানের কোনো সাহিত্যই তখন রচনা হয়নি। আমি তাই ছোটবেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে।’

সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ বাউলসম্রাট ফকির লালন

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০১ পিএম
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৮ পিএম
বাউলসম্রাট ফকির লালন
ফকির লালনের জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র। ৫ মে ১৮৮৯ সালে শিলাইদহে পদ্মা বোটের ওপর বসা অবস্থায় এঁকেছিলেন চিত্রশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ছবির ওপর নাম লিখেছেন 'লালন ফকির'

লালন ছিলেন মানবতাবাদী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ফকির, বাউলসম্রাট- বিভিন্ন উপাধিতে ভক্ত ও সুধী-সাধারণের মধ্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক সাধক, বাউল ঘরানার মরমি সাধক, বাউল, মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারক এবং দার্শনিক। লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে, যা তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘মহাত্মা লালন’ নিবন্ধে প্রথম লালনজীবনী রচয়িতা শ্রীবসন্ত কুমার পাল বলেছেন: ‘সাঁইজি হিন্দু কী মুসলমান, এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।’...

লালন গবেষকরা তাদের গবেষণায় লালনের জীবনদর্শন থেকে শুরু করে শৈল্পিক ও কবিত্বশক্তি উদঘাটনে এবং শিল্পীসত্তার মূল্যায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লালনের গান বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ, লালন-সাধনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, সুফিদর্শন, বৈষ্ণবশাস্ত্র সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান, দিব্যদৃষ্টি সবই তার অসামান্য অবদান। লালন দেশের কাঁটাতার ছিন্ন করে বিশ্ববাসীর হৃদয়েও তুলেছেন সুরের প্রাণবন্ত মূর্ছনা:

‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে’...

লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম প্রধান ও ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার যুগান্তকারী গানের মাধ্যমে উনিশ শতকে বাউল গান অধিকতর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য আঠারো শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান যেমন মানুষের জীবনদর্শনসম্পৃক্ত, বিশেষ সুরসমৃদ্ধ ধারা, তেমনই বাউলরা জীবনযাপনও করেন সাদামাটা। 

রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব ছিল। গীতাঞ্জলির অনেক গানে তার জীবনদর্শনে লালন তাকে প্রভাবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণায় Lalon is the king of the Bauls. সবচেয়ে বড় মরমি-শ্রেষ্ঠ বাউল। বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন: ‘আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন; সম্প্রদায়ের ধর্ম্ম-মতানুসারে ইহার কোনো সন্তান-সন্ততি হয় নাই। ...ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।’ লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। লালন গবেষণার পথিকৃত শ্রীবসন্ত কুমার পালের মতে, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাঁড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। কালীগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মওলানা মলম শাহ। মওলানা মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান বিবি তাকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ছেঁউড়িয়ায় পালিত মাতা-পিতার অনুরোধে লালন বসবাস শুরু করেন এবং ছেঁউড়িয়াতেই থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গার সাধক-সন্ন্যাসীরা তার এখানে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এই সময় সিরাজ সাঁই নামক একজন সুফি দরবেশ ব্যক্তির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। লালনের অনেক পদে ‘দরবেশ সিরাজ সাঁই’-এর নাম উল্লেখ আছে। 

লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘কাঙ্গাল হরিনাথ তাকে জানতেন, মীর মশাররফ তাকে চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক রায় বাহাদুর জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাকে সামনাসামনি দেখেছেন, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেননি লালনের জাত পরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।’ লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’ লালন বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে বহু ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাধু বাউল এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির (আরবি ‘সাধু’) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন: ‘শরীয়তবাদী মুসলমানগণ লালনকে ভালো চোখে কোনদিনই দেখেন নাই। এ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল লালনের খ্যাতি-প্রতিপত্তির দিনেও তাঁহাকে নিন্দা করিয়াছে।... এই বাউল-পন্থী নেড়ার ফকিরেরা চিরকাল... অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়াছে।’ অতঃপর লালন সবিশেষ একটি গানে আক্ষেপ করে বলেছেন-

‘এ দেশেতে এই সুখ হলো, আবার কোথা যাই না জানি’...

আহমদ শরীফ, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুধীর চক্রবর্তীর মতো বিদ্বজ্জনরা লালন বিষয়ক প্রবন্ধাদি মারফত লালন গবেষণায় যুক্ত করেছেন গতি ও নতুন অভিঘাত। আমরা লালন-রচিত প্রায় এক হাজার গানের সন্ধান পেয়েছি। এসব গান সংগ্রহের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ পথিকৃৎ। শ্রীবসন্ত কুমার পাল, ‘হারামনি’ প্রণেতা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, লালন গবেষক ম. মনিরউজ্জামান, মুহম্মদ আবু তালিব, ড. আনোয়ারুল করীম, খোন্দকার রিয়াজুল হক, শক্তিনাথ ঝা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ পণ্ডিত-গবেষক প্রাণান্ত শ্রম-মেধা-মনন দিয়ে লালনের গানের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন।
 
একথা সত্য, লালনের গান এখন ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে বেরিয়ে, নদীয়ার ভূগোল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। লালন এখন বাঙাল মুলুকে তো বটেই, বাঙালির বিশ্বঅভিবাসনের নিমিত্তে পৃথিবীব্যাপীই গেছে ছড়িয়ে। বেড়েছে লালনপ্রেমী গবেষক, শুভানুধ্যায়ী, অনুরাগীর সংখ্যা। দেশ বিভাজনের সীমারেখা ছাড়িয়ে, কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারেও লালন খুঁজে ফিরছেন মনের মানুষ। 

বাংলার বাউলের প্রাণপুরুষ মহাত্মা লালন নিয়ে গবেষণা থেমে নেই। যুগে যুগে লালন গবেষণার পরিধি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন একাডেমি থেকে বের হয়ে তামাম পৃথিবীর লালন বিশেষজ্ঞ ও আপামর মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ফকির লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায় নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালীন তার বিচিত্রতা লক্ষণীয়! আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে নিবন্ধকার রাইচরণ দাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন: ‘ইনি ১১৬ বৎসর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।... মরণের পূর্ব্বে রাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া ভোর ৫টার সময় শিষ্যগণকে বলেন ‘আমি চলিলাম’।...