যখন পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন চলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, ’৪৩-এর মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে হত্যার নানারকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থার মধ্যে মধ্যবিত্তের জীবন বহু ধরনের জটিলতার শিকার, ঠিক সেই সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এসব বিষয়কে উপন্যাসের উপজীব্য না করে, বেছে নিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার। একেবারে গ্রামীণ পটভূমি। যেখানে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নানা কুসংস্কারে বিশ্বাসী, আবার এও বলা যায়, কুসংস্কারের শিকার। আবার এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষকশ্রেণি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এসব বিষয়কে উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে অসামান্য শিল্প-দক্ষতায় সৃষ্টি করলেন কালোত্তীর্ণ উপন্যাস লালসালু।...
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার প্রথম উপন্যাস লালসালুতে সমাজের দগদগে ক্ষত শিল্পিত আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। সেই সময়কালে ধর্মীয় কুসংস্কারকে এমন সাবলীলভাবে প্রকাশ করাটা সহজ ছিল না। এমনকি বর্তমানেও নয়। সমাজের এ এক কঠিন ব্যাধি। ফলে এটা অনিবার্য যে, লেখকের দুঃসাহসী শিল্প-প্রচেষ্টার অভিনব সৃষ্টি লালসালু উপন্যাস। এ উপন্যাসটি এমন এক সময়ে রচিত যখন মধ্যবিত্ত বাঙালিজীবন নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত, অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।
বাংলা সাহিত্যে কবর বা মাজারকে কেন্দ্র করে কবিতা, নাটক, উপন্যাস আছে। বিষয়ের হয়তো ভিন্নতা আছে। কিন্তু সেখানে কবর বা মাজারকে কেন্দ্র করেই সেসব বিষয় গুরুত্ব লাভ করেছে। ধর্মের নামে একশ্রেণির ভণ্ড ধর্মগুরুরা কীভাবে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়, এর উদাহরণ হতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অহিংসা, আবুল মনসুর আহমদের ছোটগল্প ‘হুযুর কেবলা’ ও শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটগল্প ‘দেবতার জন্ম’। এসব গল্প-উপন্যাসে ভণ্ড-চতুর ধর্মগুরুদের প্রকৃত চেহারার প্রকাশ ঘটেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একটি মাজারকে কেন্দ্র করে লেখা লালসালু উপন্যাসে ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। সেই সঙ্গে চিনিয়ে দিয়েছেন সমাজের শঠ-প্রতারক-শোষকদের।
‘কবর’, ‘সমাধি’ ও ‘মাজার’- আমাদের কাছে চির পরিচিত। কবরের সাধারণ বিশেষ যত্ন হয় না। অধিকাংশ কবরের কোনো চিহ্ন থাকে না। সমাধি নির্মিত হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বরেণ্য ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, তাদের কবরকে সমাধিতে পরিণত করা হয় বিশেষ মর্যাদা বা সম্মানের স্মারক হিসেবে রাখার জন্য। মাজার হচ্ছে পীর-দরবেশের সমাধি- যার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী থাকে। মাজার পবিত্র ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাজার লালসালুতে ঢাকা থাকে। একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী অধিকাংশ মাজারকেই ধর্ম-ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। মাজার বলতে ধর্মীয় আবহের ভাবমূর্তির যে পবিত্র ছবি মানসপটে ভেসে ওঠে, বাস্তবে সেসব মাজারে ধর্মীয় পবিত্রতা কতটা রক্ষিত হয়তা নিয়েও রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। লালসালুতেও সেই একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। শস্যসমৃদ্ধ প্রত্যন্ত মহব্বতনগর গ্রামে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার আলো পৌঁছেনি। মজিদ হঠাৎ একদিন ওই গ্রামে পরিত্যক্ত সাধারণ একটি কবরকে খুবই চতুরতার সঙ্গে মাজারে পরিণত করে। এর পর সে একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাতে পরিণত হয় সম্পূর্ণ মিথ্যের ওপর। সমাজে তার নির্দেশ মানেই অবশ্য পালনীয় হয়ে ওঠে। মজিদের জীবনযাপন, গোপন অভিপ্রায় ও কার্যকলাপ তাকে আর দশজন গ্রামবাসী থেকে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে তোলে। মজিদের মূল শক্তি মাজারটি এবং কুসংস্কারে বন্দি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের ধর্মভীরুতা। এর ফলে খুব সহজেই অনায়াসে সে অর্থ-সম্মান-প্রভাব-নারী লাভ করতে সক্ষম হয়। তার ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন হওয়ার আশঙ্কায় আধুনিক শিক্ষিত তরুণ আক্কাসকে পরিকল্পিতভাবে অপমান করে, যাতে সে এই গ্রামে আধুনিক শিক্ষার আলো কোনোভাবেই ছড়াতে না পারে।
বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী ‘লালসালু’কে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের ধারণা, লালসালুতে ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে, ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘লালসালু’তে মজিদ যে একজন ভণ্ড ধর্মগুরু, একটি সাধারণ কবরকে একরকম অভিনয়ের মাধ্যমে মাজারে পরিণত করে, ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের অর্থনৈতিক সুবিধা, সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি, কৌশলে একাধিক বিয়ে করে মনে গোপন বাসনা পূরণ করে- সবই যে মিথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে একটা বিশেষ গোষ্ঠী মাজার ভাঙার সংস্কৃতি চালু করেছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভেঙেছে। তাদের ধারণা, মাজারে যেসব কর্মকাণ্ড সাধিত হয় তা ইসলামবিরোধী। ফলে তাদের উন্মত্ততায় মাজার ভাঙার সংস্কৃতি ব্যাপকতা লাভ করেছে। মাজার মানেই যে ইসলামবিরোধী তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে বিশ্বাস বড় কথা। ধর্মের মূল কথাও বিশ্বাস। কারও বিশ্বাসে আঘাত করার রীতি ইসলামে নেই। এ কথাও ঠিক, মজিদের মতো অনেকেই আছেন, তারা তাদের হীন ব্যক্তিস্বার্থে পরিকল্পিকভাবে মাজার গড়ে তোলে, ধর্মের নামে ব্যবসা করে। এটিও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে যেভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, এই সময়কালেও যে এরকমটি নেই, তা এককথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পীরপ্রথা ও মাজার সংস্কৃতি আছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটের মতো শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিভিন্ন ওলি-আউলিয়াদের মাজার রয়েছে। এগুলো মানুষের বিশ্বাসের ওপর গড়ে উঠেছে। এসব বিশ্বাসে আঘাত করা সমীচীন নয়। বর্তমানে অনেক জায়গায় মাজার ভাঙা হচ্ছে ধর্মের অন্ধত্বে ও প্রতিহিংসার কারণে। এটা অপসংস্কৃতি। এই দেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, বিভিন্ন মত, বিভিন্ন ধমের্র মানুষের একসঙ্গে বসবাস। প্রত্যেকের নিজস্ব বিশ্বাস, নিজস্ব মত ধারণ ও প্রকাশের অধিকার আছে। জোর করে অন্য ধর্মের অন্য মতের মানুষকে যেমন আঘাত করা উচিত নয়, তেমনি কবর-সমাধি-মাজার ভাঙার এই অপসংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। মজিদের মতো ভণ্ডদের সমাজে চিহ্নিত করে, তাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজন।
আক্কাসদের মতো শিক্ষিত তরুণদের প্রয়োজন, তাদের হেরে গেলে চলবে না। যেভাবে হেরেছে আক্কাস নিজেই। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধ ধর্মভীরুতা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সমাজের শঠ, প্রতারক, স্বার্থান্বেষীদের উপজীব্য করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।