ঢাকা ২৪ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু: সেকাল-একাল

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪২ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪২ পিএম
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু: সেকাল-একাল
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

যখন পুরো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন চলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, ’৪৩-এর মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে হত্যার নানারকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থার মধ্যে মধ্যবিত্তের জীবন বহু ধরনের জটিলতার শিকার, ঠিক সেই সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এসব বিষয়কে উপন্যাসের উপজীব্য না করে, বেছে নিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার। একেবারে গ্রামীণ পটভূমি। যেখানে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নানা কুসংস্কারে বিশ্বাসী, আবার এও বলা যায়, কুসংস্কারের শিকার। আবার এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষকশ্রেণি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এসব বিষয়কে উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে অসামান্য শিল্প-দক্ষতায় সৃষ্টি করলেন কালোত্তীর্ণ উপন্যাস লালসালু।...

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার প্রথম উপন্যাস লালসালুতে সমাজের দগদগে ক্ষত শিল্পিত আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। সেই সময়কালে ধর্মীয় কুসংস্কারকে এমন সাবলীলভাবে প্রকাশ করাটা সহজ ছিল না। এমনকি বর্তমানেও নয়। সমাজের এ এক কঠিন ব্যাধি। ফলে এটা অনিবার্য যে, লেখকের দুঃসাহসী শিল্প-প্রচেষ্টার অভিনব সৃষ্টি লালসালু উপন্যাস। এ উপন্যাসটি এমন এক সময়ে রচিত যখন মধ্যবিত্ত বাঙালিজীবন নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত, অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।

বাংলা সাহিত্যে কবর বা মাজারকে কেন্দ্র করে কবিতা, নাটক, উপন্যাস আছে। বিষয়ের হয়তো ভিন্নতা আছে। কিন্তু সেখানে কবর বা মাজারকে কেন্দ্র করেই সেসব বিষয় গুরুত্ব লাভ করেছে। ধর্মের নামে একশ্রেণির ভণ্ড ধর্মগুরুরা কীভাবে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়, এর উদাহরণ হতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অহিংসা, আবুল মনসুর আহমদের ছোটগল্প ‘হুযুর কেবলা’ ও শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটগল্প ‘দেবতার জন্ম’। এসব গল্প-উপন্যাসে ভণ্ড-চতুর ধর্মগুরুদের প্রকৃত চেহারার প্রকাশ ঘটেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একটি মাজারকে কেন্দ্র করে লেখা লালসালু উপন্যাসে ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। সেই সঙ্গে চিনিয়ে দিয়েছেন সমাজের শঠ-প্রতারক-শোষকদের। 

‘কবর’, ‘সমাধি’ ও ‘মাজার’- আমাদের কাছে চির পরিচিত। কবরের সাধারণ বিশেষ যত্ন হয় না। অধিকাংশ কবরের কোনো চিহ্ন থাকে না। সমাধি নির্মিত হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বরেণ্য ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, তাদের কবরকে সমাধিতে পরিণত করা হয় বিশেষ মর্যাদা বা সম্মানের স্মারক হিসেবে রাখার জন্য। মাজার হচ্ছে পীর-দরবেশের সমাধি- যার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী থাকে। মাজার পবিত্র ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাজার লালসালুতে ঢাকা থাকে। একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী অধিকাংশ মাজারকেই ধর্ম-ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। মাজার বলতে ধর্মীয় আবহের ভাবমূর্তির যে পবিত্র ছবি মানসপটে ভেসে ওঠে, বাস্তবে সেসব মাজারে ধর্মীয় পবিত্রতা কতটা রক্ষিত হয়তা নিয়েও রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। লালসালুতেও সেই একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। শস্যসমৃদ্ধ প্রত্যন্ত মহব্বতনগর গ্রামে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার আলো পৌঁছেনি। মজিদ হঠাৎ একদিন ওই গ্রামে পরিত্যক্ত সাধারণ একটি কবরকে খুবই চতুরতার সঙ্গে মাজারে পরিণত করে। এর পর সে একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাতে পরিণত হয় সম্পূর্ণ মিথ্যের ওপর। সমাজে তার নির্দেশ মানেই অবশ্য পালনীয় হয়ে ওঠে। মজিদের জীবনযাপন, গোপন অভিপ্রায় ও কার্যকলাপ তাকে আর দশজন গ্রামবাসী থেকে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে তোলে। মজিদের মূল শক্তি মাজারটি এবং কুসংস্কারে বন্দি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের ধর্মভীরুতা। এর ফলে খুব সহজেই অনায়াসে সে অর্থ-সম্মান-প্রভাব-নারী লাভ করতে সক্ষম হয়। তার ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন হওয়ার আশঙ্কায় আধুনিক শিক্ষিত তরুণ আক্কাসকে পরিকল্পিতভাবে অপমান করে, যাতে সে এই গ্রামে আধুনিক শিক্ষার আলো কোনোভাবেই ছড়াতে না পারে। 

বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী ‘লালসালু’কে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের ধারণা, লালসালুতে ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে, ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘লালসালু’তে মজিদ যে একজন ভণ্ড ধর্মগুরু, একটি সাধারণ কবরকে একরকম অভিনয়ের মাধ্যমে মাজারে পরিণত করে, ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের অর্থনৈতিক সুবিধা, সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি, কৌশলে একাধিক বিয়ে করে মনে গোপন বাসনা পূরণ করে- সবই যে মিথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে একটা বিশেষ গোষ্ঠী মাজার ভাঙার সংস্কৃতি চালু করেছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভেঙেছে। তাদের ধারণা, মাজারে যেসব কর্মকাণ্ড সাধিত হয় তা ইসলামবিরোধী। ফলে তাদের উন্মত্ততায় মাজার ভাঙার সংস্কৃতি ব্যাপকতা লাভ করেছে। মাজার মানেই যে ইসলামবিরোধী তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে বিশ্বাস বড় কথা। ধর্মের মূল কথাও বিশ্বাস। কারও বিশ্বাসে আঘাত করার রীতি ইসলামে নেই। এ কথাও ঠিক, মজিদের মতো অনেকেই আছেন, তারা তাদের হীন ব্যক্তিস্বার্থে পরিকল্পিকভাবে মাজার গড়ে তোলে, ধর্মের নামে ব্যবসা করে। এটিও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণার জাল বিস্তারের মাধ্যমে যেভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, এই সময়কালেও যে এরকমটি নেই, তা এককথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পীরপ্রথা ও মাজার সংস্কৃতি আছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটের মতো শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিভিন্ন ওলি-আউলিয়াদের মাজার রয়েছে। এগুলো মানুষের বিশ্বাসের ওপর গড়ে উঠেছে। এসব বিশ্বাসে আঘাত করা সমীচীন নয়। বর্তমানে অনেক জায়গায় মাজার ভাঙা হচ্ছে ধর্মের অন্ধত্বে ও প্রতিহিংসার কারণে। এটা অপসংস্কৃতি। এই দেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, বিভিন্ন মত, বিভিন্ন ধমের্র মানুষের একসঙ্গে বসবাস। প্রত্যেকের নিজস্ব বিশ্বাস, নিজস্ব মত ধারণ ও প্রকাশের অধিকার আছে। জোর করে অন্য ধর্মের অন্য মতের মানুষকে যেমন আঘাত করা উচিত নয়, তেমনি কবর-সমাধি-মাজার ভাঙার এই অপসংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। মজিদের মতো ভণ্ডদের সমাজে চিহ্নিত করে, তাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজন।

আক্কাসদের মতো শিক্ষিত তরুণদের প্রয়োজন, তাদের হেরে গেলে চলবে না। যেভাবে হেরেছে আক্কাস নিজেই। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধ ধর্মভীরুতা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সমাজের শঠ, প্রতারক, স্বার্থান্বেষীদের উপজীব্য করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

পাখির অভিমান

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
পাখির অভিমান
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বুকের চেয়ে বড় কোনো ডাকঘর নেই, এই অধিবিদ্যার পৃথিবীতে
যেখানে দিনে-রাতে, কত চিঠি আসে আর যায়...

একই  শহরে থাকি আমি ও আমার অস্থির নীরবতা

খুঁজিনি কখনো বৃক্ষের বুকে কান রেখে আমারি নিশ্বাস। 
তবু মনের ভুবনে এই পৃথিবীর অদ্ভুত সন্ধ্যা এসে থামে; 
খোঁজ করে কোনো এক বৃক্ষের সংসারে এই আমাকে। 
আমি ব্যস্ত তখন, এক অকালপ্রয়াত বটবৃক্ষের নিহত সংসারে।

বিষণ্ন আঙিনাজুড়ে উড়ে পড়ছে একদল পাখির অভিমান। 
আজ হয়তো গাছে গাছে শুরু হবে পাখিদের শোকসভা। 
হাওয়ায় হাওয়ায় আরও মিলে যাবে বৃক্ষশ্রোতা। 
এই মহান পাখি সম্মেলনে আমিও মিলে যেতে 
চাই অন্তরের অনুলিপি হয়ে। 

দৈনিক বাতাস বিচিত্রায় আজ ছাপা হলো বৃক্ষ হত্যার প্রতিবাদ। 
সেই বৃক্ষের মৃত্যুতে গাছে গাছে ঝুলছে দেখি পাখিদের শোক প্রস্তাব।

বিজড়িত

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
বিজড়িত
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আঁধার আমার ভালো লাগে, 
তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ 
বড় প্রিয় গান 

তুমি যে সূর্যসম্ভব 

কালের নিয়মে তেজ ম্লান হয় 
লোহিত নক্ষত্রের গান 
শ্বেত বামন শুধু ম্লান হতে থাকে 

নিভে যায় সব...

গুঁড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে যায় 
কণিকা সম্ভার 

শূন্য জুড়ে তাই এত টান 

যাকে ‘মায়া’ বলে ডাকি।

কবিতা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

এই হাত
মুজিবুল হক কবীর

এই হাত
পতন ঠেকাতে জানে,
এই হাত ইস্পাত
পুড়ে যায় যজ্ঞে-আগুনে।

এই হাত মেতে ওঠে
মিছিলে-আন্দোলনে
এই হাত প্রতিবাদী
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে।

এই হাত নিয়ে আসে স্বর্গের পারিজাত
এ হাত থামিয়ে দেয় জলের প্রপাত।

হৃদয়ের যত গ্লানি মুছে দেয় এই হাত,
কার ইশারায় চলে যায় অহল্যারও অভিসম্পাত।

দ্বন্দ্ব ও কোলাহল, যুদ্ধ-
কখনো নেয়নি মেনে নানক ও বুদ্ধ।
এ জগৎ-সংসার একটি রজ্জুতে বাঁধা
কোথায় কৃষ্ণ আর কোথায় বা রাধা।

এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ডুবে আছে জলে,
তবু সব কিছু আজ
ঈশ্বরেরই করতলে।

প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল
কবি মুহম্মদ ইকবাল

কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ ইকবালের জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক মুসলিম পরিবারে ৯ নভেম্বর ১৮৭৭। মৃত্যু ২১ এপ্রিল ১৯৩৮। পিতা শেখ নূর মুহম্মদ। মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ ইকবালের কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি এবং উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদি’ (১৯১৫) পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে, ইকবাল পিএইচডিতে অধ্যয়ন করার জন্য জার্মানিতে চলে যান এবং ১৯০৮ সালে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ডক্টরেট থিসিসটির শিরোনাম ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া’। ১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসে লাহোরের সরকারি কলেজে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইন ব্যবসা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমিক। সাহিত্যের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন। উর্দু ভাষা ও কাব্যকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। সে জন্য তাকে শায়ের এ মাশায়েও বলা হয়। তার কাব্যমুগ্ধ পাঠককূল তাকে আল্লামা উপাধি দিয়েও সম্মানিত করেন।

শ্রীধরনামা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ পিএম
শ্রীধরনামা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শ্রীধর আমাদের বন্ধু মহলের এক চির বিস্ময়। সে-কালে, মানে যে-কালে এই শিল্পাঞ্চলে, যে শিল্পাঞ্চল ঘিরে সমরেশ বসু ‘জগদ্দল’ বা তারও আগে ‘উত্তরঙ্গ’ হয়ে ‘শ্রীমতী কাফে’ হয়ে ‘খণ্ডিতা’ পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, ১৯৮৮ সালের মার্চের ১২ তারিখ, সেই মহাসর্বনেষে তারিখটা না এলে হয়তো বিধুভূষণ বন্দোঘঁটি, শ্রীধরের জন্মদাতা, তিনিও দোলা-শ্রীধর বা কালুর বৌয়ের সঙ্গে শ্রীধরের আশনাই বা সমরেশ বসুরই বন্ধু, ভীমরুলের নাদনি, সেই পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবী, দীপক সাহার চায়ের দোকানে বসে, শ্রীধরের নিচের নয়, বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল- তা নিয়ে একালে এত হট্টগোল হতো না।

হুগলীর আনাচে-কানাচে সেই নিতম্বিনী দেবীর, নিতম্বের ভারে ঝপঝপে হয়ে যাওয়া শব্দের আওয়াজ, থমথমে হয়ে যাওয়ার ঠিক প্রদোষকালে, কখনো ঠাওর করে উঠতে পেরেছিল। সমরেশ বসুর লেখা ঝেঁপে, কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার হাউসে দিগ্বিদিক ভুলে সুরো ভটচায্যির গলিতে হাবুডুবু খাওয়া, রেখা পালের সমাজে স্বীকৃতি না পাওয়া দাদা, নিরোজ, নিরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সমরেশ বসুর দৌলতে যে কলিকালের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন, সেই নিরোজের সঙ্গে দোলার, ‘মাস্সাই’সুলভ সম্পর্ক ঘিরে সেই দোলার পেটে জন্ম নেওয়া শিশুকে, ‘আমার বৌয়ের সন্তান’ না বলে, ‘আমার শালীর মেয়ে’ বলে চালিয়ে যাবে, চালিয়েই যাবে শ্রীধর বন্দোঘঁটি?

আচ্ছা এই যে, ‘ভীমরুলের নাদনি’ শব্দটা ব্যবহার করা হলো, এই শব্দটা আপনারা পাঠকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন কী? এই যে টিপিকাল ‘ঘঁটি’ লব্জ, শাঁটুল গুপ্তের প্রজন্মের পর খাস বাগবাজারি ঘঁটিরাও কি এখন এমন শব্দের ব্যবহার ধরে রেখেছে? কিন্তু বিধুভূষণ বন্দ্যোঘঁটি, ঘঁটি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে আমাদের শাঁটুলবাবুর থেকে এক কাটি বেশি ছিলেন বই কম ছিলেন না।

বিধুভূষণ কখনো ‘পেপার’ বলতেন না। বলতেন, ‘খবরের কাগজ’। কখনোই তিনি ভুলবশতও গোটা জীবনে ‘চুঁজরো’ বই ‘চুচুঁড়া’ উচ্চারণ করেননি। কস্মিনকালেও গনগনে গরম চাভর্তি চাপ ঠোঁটের সামনে এনে গলায় চালান করবার সময়ে ‘উঁহুউউউ’ করে আওয়াজ করেননি। 

তাই তিনি ‘নাতনি’ কে ‘নাদনি’ বলবেন- এটা কিন্তু কখনোই আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো বিষয় আদৌ নয়। বিধুভূষণ বাংলা খেয়ে যখন ড্রেনের ধারে গড়াগড়ি খেত, তখন ওর নাতনি, যাকে শ্রীধরের বন্ধুরা, সেই সেকালে ‘নাতনি’র দেহের ভঙ্গিমা দেখে ‘পিঁয়াজি’ বলত, সেই হাফ গেরস্তকে যখন শ্রীধর, মেয়েদের নয়, ছেলেদের তানপুরো তৈরি করে দিল কালুর বউয়ের তানপুরো ফাটানোর বিনিময়ে, তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল, সে-কালের শ্রীধর আর এ-কালের শ্রীধরের মধ্যে জাপানি বন্ধুদের প্রভাবের আগে আর পরে এতটা ফারাক ঘটবে?

‘পিঁয়াজি’র দিকে শ্রীধরের বাপ, মানে শ্রীধরের বিকাশমান লালিত্যের সে-কালের উদ্ভাষক ক্ষিরুমামার একটা বিশেষ রকমের প্রভাব ছিল। প্রতিপত্তিও ছিল। আসলে ক্ষিরুর পৈতৃক সূত্রে একটা দখল করা বাড়ি ছিল সেকালের মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায়। এখন ক্ষিরুমামার আট মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি হলেও ‘পিঁয়াজি’কে নিয়ে যখন শ্রীধর, ওয়াই কে টু-র প্রবলেম সল্ভ করতে ক্ষিরুমামার ঠাকুর্দা, মানে শ্রীধরের পরদাদা, অশ্বিনীকুমার ঘোরপাড়ুইয়ের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যেত, তখন রিপোজ নার্সিংহোমের সামনে রীতিমতো লোক জমে যেত পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবীকে দেখতে।

পিঁয়াজিবালা এখন রীতিমতো আগুনখেঁকো নেত্রী। ব্যান্ডেল চার্চপাড়ায় এককালে যিনি দাপুটে কাউন্সিলর ছিলেন, সেই মাস্টারমশাই জ্ঞানদাকে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতে হয় পিঁয়াজিবালার আগমন এবং নিষ্ক্রমণ ঘিরে। জ্ঞানদার সঙ্গে শ্রীধরের পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে, শ্রীধর নিশ্চয়ই শুধাতো- দেবীর কি সে আগমন? আর নিষ্ক্রমণই বা কীসে? 

আচ্ছা  পিঁয়াজিবালার স্কুটির পেছনে শ্রীধর কখনো সাওয়ারি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি কখনো শ্রীধর তানপুরোতে তিনটে আঙুলের, কসরতে সুরলহরি তুলে ছায়াহিন্দোল গেয়েছে?

পিঁয়াজিবালা সেদিন লোটে মাছের ছালুন রেঁধেছিল বেলডাঙার মরিচ দিয়ে। ঝালের জন্য এদিকে বেলডাঙার মরিচের বেশ নামডাক আছে। সেই নুন দিয়ে নুচি খাওয়ার কালে শ্রীধর ব্যান্ননে মরিচ দেখলে তা আর মুখেই তুলত না। দীপক সাহার দোকানে পিঁয়াজিবালা প্রথম যেদিন শ্রীধরের কোলে বসে, শ্রীধরেরই বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল, সেদিনই দীপক সাহা নিজের হাতে দুটো কাঁচা মরিচ দেওয়া ডবল ডিমের ওমলেট খাইয়েছিল ছেলেটাকে।
লোটে মাছের ছালুন দিয়ে মাখা ভাতের লোকমাটা মুখে চালান করতে করতেই শ্রীধর বলে উঠল- 

বুঝলি কুমড়ি, এই লোটে মাছে প্রচুর ফসফরাস থাকে। ফসফারাসে চোখ ভালো হয়।

পিঁয়াজিবালাকে ডাক নামে ডাকতেই ভালোবাসে শ্রীধর। তবে কালুর বৌ থেকে ক্ষিরুর আপিসের সেই লাবণ্যলতা হয়ে চিনে হাঁদুর বর্তমান ভাগনেবৌ, সবাইকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে শ্রীধর ‘হেকেটি’ বলতে ভালোবাসে। কারণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’তে নাকি লেখা আছে, রবীন্দ্রনাথ, তার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ বলে ডাকতেন।

বড় বড় জিনিস দেখে তোমার এখন চোখ বড়তেই সয়ে গেছে গো শ্রীধরদা। নতুন করে আর তোমার এখন চোখ ভালো করবার দরকার নেই। চোখের জ্যোতি তোমার কালুদা আর ভবান বৌদি, দুজনেই মেজেঘসে বেশ চকচকে করেই রেখে দিয়েছে।

পিঁয়াজিবালা নোয়াখাইল্যা হলেও সমরেশ বসুর ‘ভানুমতী’র দেশে থেকে ফরাসডাঙার ‘হ্যাঁ গো’, ‘কী গো’ বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। যদিও হাওড়ার ঘঁটি কেতা ভুলে এখন শ্রীধর হাবুডুবু খাচ্ছে কালু জানুলম্বিত ঘণ্টার তালে তালে।

শ্রীধর মাঝেমধ্যে বেশ উদাস হয়ে যায় জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ কষতে গিয়ে। ছেলেটা খুব যে একটা হিসেবি, তা বলা যায় না। অন্ততপক্ষে এলাকার নেতা দুই তরফের দুই নেতা- মলয় ভট্টাচার্য আর শমিত ঘোষ, যারা দুবেলা যাদবপুর থেকে ঠেঙিয়ে নৈহাটি আসা শ্রীধরকে তাদের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখে, তারা কখনো ছেলেটাকে তেমন একটা হিসেবি বলে না।

আসলে বলে না, নাকি বলতে চায় না- এটা নিয়ে আবার সুনীতিদাদের ঠেকে বেশ তক্কবিতক্ক আছে। ওই যে সুনীতিদের সঙ্গে ঠেক মারা রেলের রিটায়ার্ড বুকিং ক্লার্ক তপুবাবু, রাত্রিক নাট্যসংস্থায় চা, জল বয়ে এনে নিজেকে নাট্যকর্মী বলে দাবি করে শহরের বুকে নাট্যোৎসব হলে ঠিক টুক করে মন্ত্রীর পাশের সিটটা দখল করে নেয়, সেই তপুবাবু, নিজের চাকরি জীবনে যেভাবে হাতের ভাঁজে একটা পাত্তি পকেটস্থ করতেন, ঠিক সেই স্টাইলে শ্রীধরকে রোজ একটা করে গোল্ড ফ্লেক সিগারেট দেয়।

কালু সম্ভবত মহাদেবের চা-খানায় এককালে সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে দুপুর আড়াইটের সময় শ্রীধরকে একা একা আড্ডা মারতে দেখে বাড়ি গিয়ে ভবানীকে ব্যাপারটা বলে ফেলে। আসলে সেদিন কালুরই ব্যাংকিংয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছিল। সবিতা। কালুর ছোটভাইয়ের বৌ, হাজার পাঁচেক টাকা চেয়েছিল। পেনশনভোগী কালু মাসের যত তারিখই হোক না কেন, সবিতা টাকা চাইলে কখনো না করতে পারে না। হাসির ছলে ভেসে যাওয়া দিনের কথা মনে করে হৃদয়ের দয়ার ঘটটা কালুর ছলছলিয়ে ওঠে ছোটভাইয়ের অসহায় বৌটার জন্য। 

নিজে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল সেদিন কালু টাকাটা পাঠাতে সবিতাকে। কিছুতেই অনলাইন ট্রানজাকশন হচ্ছে না। আবার বাড়িতে বসে বেশি সময় ধরে চেষ্টা করলে পাছে ভবানী জানতে চায়, মোবাইলে অতক্ষণ ধরে কী করছ খুটখুট করে? 

তাই পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে নেমে নেদু সান্যালের বাড়িটা পেরোতেই কালুর মনে পড়ে গেল, এই রে, শ্রীধর তো আবার বলবে; আরে কালুদা, আবার ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে এসেছেন? পুজোর তো এখন অনেক দেরি!

কালু অনেক বলবার চেষ্টা করেছে শ্রীধরকে বোঝাতে, ঘণ্টা যত নড়বে, হাওয়া তত বইবে, আলো আরও খেলবে। বলব বলব করেও অবশ্য কথাগুলো শ্রীধরকে বলে উঠতে পারেনি কালু। না বলবার কারণ হলো, পাছে শ্রীধর জেনে যায় অনুর জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব!

মহাদেবের দোকানে কালুর সমস্যা সল্ভ করে শ্রীধর, কিন্তু যেহেতু সে নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, খুব একটা পাত্তা দেয় না কালুকে। শ্রীধরের এই পাত্তা না দেওয়াটা বেশ একটু বেশি পরিমাণেই আঁতে লাগে কালুর। মটকা গরম হয়ে গেলেও মুখে কিছু না বলে মহাদেবের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে আবার সুরো ভটচায্যির গলি পেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মনে তখন কালুর একটাই তৃপ্তি, শ্রীধর খুব একা পাত্তা দিক আর না দিক, ওর দৌলতে সবিতাকে পাঁচ হাজার টাকা শেষ পর্যন্ত পাঠানো গেছে।

আজ সকালে যখন মলয় ভটচায্যি বললেন, শ্রীধরকে নিয়ে অক্ষয়কুমারী দেবী রোডের আশপাশে ঘুরতে দেখেছেন, একদম উল্টো রাজনৈতিক শিবিরের শমিত যখন এককথায় সমর্থন করল মলয়ের সেই কথা, শ্রীধর অবশ্য তখনো দাঁতের ডাক্তার রণজিৎ সরকারের বাড়িতে সে গেছিল, এই যুক্তিতেই একদম এঁটুলির মতো এঁটে রইল।

আসলে মিথ্যে কথাটা শ্রীধরের ঠিক আসে না। মিথ্যে বললেই কেমন যেন ওর মুখটা ভ্যাদাই মাছের মতো বোকা বোকা হয়ে যায়। আর তেমনটা হলেই, ডাল মে যে থোরা থোরা কালা- সেটা মালুম করে নিতে কারও খুব একটা অসুবিধা হয় না।

সাত সকালে আজ হেকেটি ফোন করেছে শ্রীধরকে। ট্রেনটা তখনো শিয়ালদা সাউথ সেকশনে ঢোকেইনি। এই সময়ে শ্রীধর সাধারণত ফোন-টোন ধরে না। সবাই জানে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরুর আগেই স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নৈহাটিতে মহাদেবের চায়ের দোকানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের কেয়ার না করে আড্ডা দিতে চলে আসে শ্রীধর। আবার বিকেলে, পাঁচটা বাইশের নৈহাটি লোকাল ধরে যাদবপুরে শেষ ক্লাসটা নিয়ে, ইউনিভার্সিটির ঘরগুলোর সব তালা ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে নাকি সেটা টেনেটুনে দেখে, বাপ্পার দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে, শঙ্কুরবাড়ি পাশ কটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে সে পৌঁছায়।

সুরঞ্জন দাশ নাকি শ্রীধরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; তা কত ইস্তক এ কাজ কোরচেন? 

শ্রীধর জবাব দিয়েছিল; একুনে সেই ত্রিগুণা সেনের আমল থেকে।

তার পর থেকে নাকি আর কেউ যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ঘিরে শ্রীধরকে কোনো কথা শুধোতে সাহস করেনি।

তাই এমন অসময়ে কালুদার বৌ ফোন করাতে যুগপৎ বিরক্ত আর বিস্মিত হলো শ্রীধর। তবে ছেলেটার সব থেকে বড়ো একটা গুণ হলো, রেগে গেলেও ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু ধরা যায় না, আনন্দেও নয়। তাই তো কালুর বৌ একদিন নিজের পরম তৃপ্তির পর শ্রীধরকে বেশ ন্যাকা ন্যাকা সুরেই শুধিয়েছিল; আর ইউ ওকে শ্রীধর? 

কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা কালুর ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে সাইকেলের তালা খুলে সটান মহাদেবের চায়ের দোকানের পাশে মাছের আড়তের বড় বেদিটার ওপর বসে পড়ে জোরে হাঁক দিয়েছিল, সোমনাথ একটা ছোট চা।

ভবানীর গলার স্বরটা আজ আদৌ রসেবশে নেই। বেশ একটু কর্কশই। শ্রীধর একটু জোর করলে যেমন চেঁচিয়ে উঠতে অভ্যস্ত কালুর বৌ, অনেকটা তেমন। অবশ্য শ্রীধরের ধারণা, হেকেটির এই চেঁচানিটা একটু আর্টিফিসিয়াল। লোক দেখানো। আসলে নদী যখন তীরে এসে আছড়ে পড়ে, জলের ইচ্ছে না থাকলেও জলে জলে কোলাকুলিতে যেমন নদীর পাড়ে ঢেউয়ের আছড়ে পরবার একটা আওয়াজ হয়, কালুর বৌয়ের সময় বিশেষের আওয়াজটাকে অমনটাই মনে হয় শ্রীধরের। তাই ফোনের ও-প্রান্ত থেকে যখন একটু খ্যাঁককুটে গলাতেই প্রশ্ন এল- ক্লাসে? 

নিজেকে একটু সেফসাইডে রেখেই ব্যাট করতে নামল শ্রীধর। কারণ, ওর তখন মন বলছে, বলটা গুগলিই হবে। আর গুগলি বলে ভালো ব্যাট করতে কোনোদিনই শ্রীধর পারে না। এককালে ছক্কা হাঁকানো শ্রীধর, সেই পিঁয়াজিবালার শ্রীধর, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়েই ফোনের ও-প্রান্তের দিকে উত্তর পাঠাল- হ্যাঁ, বলুন বৌদি।

দুই তরফেই খানিকটা নিস্তবদ্ধতা। শ্রীধর ভাবছে, সময় সম্বন্ধে তো হেকেটির অসাধারণ মাত্রাজ্ঞান। এই সময়ে তো খুব বড় কিছু দরকার না হলে, কেবল আমড়াগাছি করতে এই সময়ে হেকেটি ফোন করে না।

হ্যাঁ বৌদি, কালুদা ঠিক আছে তো? 

ও প্রান্ত থেকে একটাই উত্তর, টুকুদির ছেলের বৌয়ের প্রেগ কালার টেস্টের রিপোর্ট আমার হাতে।

ঝপ করে ফোনটা কেটে দিল শ্রীধর।