‘সখ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই যেমন একরকম নই- বৈচিত্র্যই আমাদের অনন্যতা দান করেছে, ঠিক তেমনই আমাদের সখও একেকজনের একেকরকম। পৃথিবীর বহু গুণী মানুষের সখ সম্পর্কে আমরা কৌতূহলী। যাঁরা নজরুলপ্রেমী, মাঝে মাঝে তাঁদের মনের মধ্যেও এই প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি- আমাদের প্রাণের কবির সখ কী ছিল? সত্যিই তো, এ নিয়ে আলোচনা বোধহয় কমই হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম- যাঁর জীবন এত বৈচিত্র্যময়, তাঁর সখও যে নিতান্তই আমার-আপনার মতো খুব সাধারণ কিছু হবে না- এ বিষয়ে সন্দেহ কি? আসাদুল হকের লেখা ‘নজরুল যখন বেতারে’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়- ‘হস্তরেখা গণনা করা’ ছিল নজরুলের একটি সখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই তাঁদের স্মৃতিকথায় এ সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ১৯৪১ সালের ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে বেতারে নজরুলের একটি বক্তৃতা প্রচারিত হয়। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘হাতের রেখা দেখে গণনা আমার একটি সখ’। এ ছাড়া কবির হয়তো অন্যান্য সখও ছিল, কিন্তু এই প্রবন্ধে ‘নজরুলের জ্যোতিষচর্চা’ সম্বন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সুস্থ অবস্থায় নজরুল যাঁদের হাত দেখেছেন, বলাই বাহুল্য যাঁরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের স্মৃতিকথাই এই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।
কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত প্রিয় মানুষদের তালিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের বাহার-নাহার, দুই ভাইবোন। নজরুল তাঁর সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থটি তাঁদেরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে নজরুল লিখেছিলেন-
‘‘- আমার এই লেখাগুলো
বাহার ও নাহারকে দিলাম।-
কে তোমাদের ভালো?
‘বাহার’ আনো গুল্শানে গুল্, ‘নাহার’ আনো আলো।
‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,
‘নাহার’ এলে রাত্রি চিরে জ্যোতির অভিযান।
তোমরা দুটি ফুলের দুলাল, আলোর দুলালী,
একটি বোঁটায় ফুট্লি এসে, নয়ন ভুলালি!
নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী,
তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি!’’
মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, নজরুল যখন চট্টগ্রামে যান তখনো পামিস্ট্রির চর্চা করতেন। ওখানে বসেই কাজী সাহেব একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা; অন্যদিকে তাঁর সখও পূরণ করেছেন। বাহার লিখেছেন- ‘‘কাজী সাহেব চট্টগ্রামে আমাদের বাড়িতে গিয়েছেন কয়েকবার। যে ক’দিন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে, মনে হতো বাড়িখানি যেন ভেঙ্গে পড়বে। রাত্রি ১০টায় থারমোফ্লাস্কে ভরে চা, বাটাভরা পান, কালিভরা ফাউন্টেন পেন, আর মোটা মোটা খাতা দিয়ে তাঁর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতাম। সকালে উঠে দেখতাম, খাতা ভর্তি কবিতা। এক-এক করে ‘সিন্ধু’, ‘তিন তরঙ্গ’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলী’, ‘মিলন মোহনায়’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘নবীনচন্দ্র’, ‘বাংলার আজিজ’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সাতভাই চম্পা’ আরও কত কবিতা লিখেছেন আমাদের বাড়িতে বসে। চট্টগ্রামের নদী, সমুদ্র, পাহাড়, আমাদের বাড়ির সুপারি গাছগুলো আজ অমর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যে। সারারাত কবি চা আর পান খেতেন- আর খাতা ভর্তি করতেন কবিতা দিয়ে। আর দুপুরে কখনো কিছু পড়তেন, কখনো করতেন পামিস্ট্রির চর্চা, কখনো বা মশগুল্ হতেন দাবা খেলায়। বিকেলে দল বেঁধে যেতাম নদীতে, সমুদ্রে। সাম্পানওয়ালারা এসে জুটত, সুর করে চলত সাম্পানের গান। সবাই মিলে গান করতাম, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী’ ‘গহীন জলের নদী’, এক এক সময় চট্টগ্রামী সাম্পানওয়ালারা গাইত ‘বঁধুর আমার চাটি গাঁ বাড়ী- বঁধুর আমার নন্দীর কূলে ঘর।’
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আবদুল আযীয আল-আমানের ‘নজরুল পরিক্রমা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভবিষ্যৎ-জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে নাহার নজরুলকে হাত দেখিয়েছিলেন।
আবদুল আযীয আল-আমান লিখেছেন- ‘‘কবি বাহার-নাহার ভাই-বোনদের ভাগ্যলিপি পৃথকভাবে কাগজে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজের ভাগ্য জানার জন্য স্বভাবতঃই মানুষ কৌতূহলী। নাহার সাহেবাও একবার ঐকান্তিক আগ্রহে নিজের হাতখানি পর্দার আড়াল হতে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ‘দেখুন তো কবিদা, কতখানি পড়াশোনা লেখা আছে আমার হাতে?’ কবি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে হাত দেখে যে সুদীর্ঘ ভাগ্যলিপি রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি বিশেষ বক্তব্য এই ‘...স্বাস্থ্যভঙ্গ...প্রাণ নিয়ে টানাটানি... প্রিয়জন-বিয়োগ...’ সবশেষে লিখেছিলেন- ‘স্নেহ-মমতার অভাব হবে না কোনদিন,...Partial satisfaction of ambition... ইত্যাদি। কবি অনেকের হাত দেখে এ ধরনের মন্তব্য করতেন, এ জন্য তাঁর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী জনাব মুজফ্ফর আহ্মদের কাছে মাঝে মাঝে ভর্ৎসনা শুনতেন, তবুও নিরস্ত হতেন না। তাঁর কাছে হস্তরেখা গণনা এবং জ্যোতিষ চর্চা অনেকখানি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।’
নজরুল-সুহৃদ, মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধিচর্চার অন্যতম কাণ্ডারী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই চিঠিগুলো থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের কী গভীর প্রেম। ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে নজরুল চিঠি লেখেন মিস ফজিলতুন্নেসাকে। নজরুল তাঁর প্রকাশিতব্য ‘সঞ্চিতা’ তাঁকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সবাই জানি পরবর্তীতে তিনি ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেছিলেন বিশ্বকবিসম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
ফজিলতুন্নেসাকে নজরুল চিঠিতে লেখেন- ‘‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া। খুব সম্ভব আর একমাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে। আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এ জন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব? সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না- এই আমার আকুল প্রার্থনা।’’
কিন্তু ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কীভাবে? তার বর্ণনা দিতে গিয়েই কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ‘হস্তরেখা গণনা’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন - ‘‘ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না-অথবা ‘বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অংকের এমএ এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন শৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মতো সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।’’
এই স্মৃতিকথা থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, নজরুল নিতান্তই সখের বশে এই কাজ করলেও যথেষ্ট নিবেদিত ছিলেন।
১৯২৮ সালের ১০ মার্চ তারিখে ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলকাতা থেকে নজরুল চিঠি লেখেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘‘আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ীর ‘ভ্রমর’ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বৌ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তর তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনী-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় এক একবার। দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতীন না ঠাওরান!’’
এই চিঠিতে নজরুল নিজেই লিখেছেন, তিনি হস্তরেখা গণনা করতে পারতেন। হস্তরেখা দেখে চমৎকার ভবিষ্যৎ গণনাও করতে পারতেন।
একবার কলকাতায় ওয়েলেসলি স্কোয়ারে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরুল মোতাহার হোসেনের ও তাঁর শ্যালকদের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক শ্যালককে বলেছিলেন, তাঁর ভাগ্যে বিদেশযাত্রা আছে। এ কথা পরে ঠিকই হয়েছিল। আর একজনের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এ বহুদূর দেশে চলে যাবে, অজ্ঞাতবাসের মত।’ - এর মৃত্যু ঘটেছিল।
প্রিয় মোতাহার সম্বন্ধেও বলেছিলেন, ‘তোমার যশো রেখা খুব স্পষ্ট, বিদেশযাত্রাও হবে, কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধক উত্তীর্ণ হয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে।’ নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকাংশেই মিলে যেত। এর স্বপক্ষে বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
গ্রামোফোনের রিহার্সেল রুমে মাঝে মাঝে নজরুল হাত দেখার বই জোগাড় করে তাই নিয়ে মেতে থাকতেন। এই হাত দেখা নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন বিখ্যাত নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী আঙুরবালা দেবী। একটি বিশেষ ঘটনার কথা তাঁর লেখনীতেই তুলে ধরলাম- ‘‘আমাদের সময়ে গ্রামোফোনে একজন তবলা বাজিয়ে ছিলেন। নাম রাসবিহারী শীল। খুব গুণী লোক। রাসবিহারী বাবুর তবলা সঙ্গত না থাকলে আমাদের গান যেন জমতেই চাইতো না। একদিন শোনা গেল, জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী মশায় নৌকাযোগে কোথায় যেন গান গাইতে যাবেন, আর তাঁর সঙ্গে তবলা বাজাবার জন্য যাবেন সেই রাসবিহারী বাবু। সেদিন যথারীতি রিহার্সাল রুমে কাজীদার সঙ্গে আমরা গান-বাজনা নিয়ে মেতে রয়েছি। রাসবিহারী বাবু আমাদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করছেন। গান-বাজনার ক্ষণিক বিরতিতে তিনি কাজীদার সামনে ডান হাতটি মেলে ধরলেন: ‘কাজীদা আমার হাতটা একটু দেখুন না।’ এটা তাঁর জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বাইরে যাবার আগের দিনের ঘটনা। কাজীদার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। সেই হাসিমুখেই তিনি রাসবিহারী বাবুর হাত দেখায় মন দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠলো। একসময় রাসবিহারী বাবুর হাত ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সবাই চুপচাপ। হঠাৎ কাজীদার এই ভাবান্তর দেখে আমরাও অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসবিহারী বাবু হাসিমুখে বললেন- ‘কই কাজীদা হাতে কি দেখলেন, বললেন না তো!’ কাজীদা তবুও নিরুত্তর। রাসবিহারী বাবু আবার বললেন ‘বলুন না কাজীদা কি দেখলেন। খারাপ কিছু?’ এবার কাজীদার মুখে মৃদু করুণ হাসি ফুটে উঠলো। রাসবিহারী বাবুকে তাঁর গুণের জন্য কাজীদা খুবই স্নেহ করতেন। তাই ধীরে ধীরে তাঁর পিঠ চাপড়ে বললেন- ‘দূর পাগল খারাপ কেন হবে। ভালোই তো, সব ভালো।’
এই কথার পর কাজীদা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তখনকার নামকরা গায়ক ধীরেন দাস সেদিন ঐ ঘরে উপস্থিত ছিলেন। রাসবিহারী বাবু চলে যাবার পর ধীরেন বাবু কাজীদাকে চেপে ধরলেন, ‘বলুন না কাজীদা ওর হাতে কি দেখলেন?’ কাজীদা বললেন, ‘একটু খারাপ জিনিসই দেখলাম।’ নজরুলের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। ক’দিন পর জ্ঞানবাবু গান গেয়ে ফিরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু শোনা যায়, রাসবিহারী বাবুর জ্বর হয়েছিল। এর ক’দিন পর খবর আসে তাঁর সামান্য জ্বর নিউমোনিয়ায় দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করা হয় কিন্তু তাঁর সে নিউমোনিয়া আর ভালো করা যায়নি। মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রাসবিহারী শীল মারা গেলেন। নজরুল পরে ধীরেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বেদনার হাসি হেসে জবাব দিয়েছিলেন,‘হ্যাঁ, আমি সেদিন ওর হাতে মৃত্যুযোগ দেখেছিলাম। বুঝেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়ত রাসবিহারীর মহাবিপদ আসছে। আর সেই জন্যেই আমি কিছু বলিনি সেদিন।’
উপরোক্ত ঘটনা থেকে সহজেই ধারণা করা যায়- অবসর সময়ে নজরুল তাঁর প্রিয়জনদের হস্তরেখা গণনা করে সুন্দর সময় কাটাতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবন আলো-আঁধারের মিশেল। তাই এই বিশেষ গুণের অধিকারী নজরুল কখনো কখনো প্রিয় মানুষদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে অগ্রিম জেনে যাওয়ায়, তাঁর মন হতো বিষাদে পরিপূর্ণ।
তথ্যঋণ:
নজরুলের কবিতা-সমগ্র
নজরুলের পত্রাবলি: শাহাবুদ্দীন আহ্মদ সম্পাদিত
কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুল চর্চা: তপন বাগচী সম্পাদিত
নজরুল যখন বেতারে : আসাদুল হক
নজরুল স্মৃতি: বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
নজরুল পরিক্রমা: আবদুল আযীয আল-আমান
লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)