ঢাকা ২৪ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪

নজরুলের সখ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:১১ পিএম
আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৪ পিএম
নজরুলের সখ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘সখ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই যেমন একরকম নই- বৈচিত্র্যই আমাদের অনন্যতা দান করেছে, ঠিক তেমনই আমাদের সখও একেকজনের একেকরকম। পৃথিবীর বহু গুণী মানুষের সখ সম্পর্কে আমরা কৌতূহলী। যাঁরা নজরুলপ্রেমী, মাঝে মাঝে তাঁদের মনের মধ্যেও এই প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি- আমাদের প্রাণের কবির সখ কী ছিল? সত্যিই তো, এ নিয়ে আলোচনা বোধহয় কমই হয়। 

কাজী নজরুল ইসলাম- যাঁর জীবন এত বৈচিত্র্যময়, তাঁর সখও যে নিতান্তই আমার-আপনার মতো খুব সাধারণ কিছু হবে না- এ বিষয়ে সন্দেহ কি? আসাদুল হকের লেখা ‘নজরুল যখন বেতারে’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়- ‘হস্তরেখা গণনা করা’ ছিল নজরুলের একটি সখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই তাঁদের স্মৃতিকথায় এ সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ১৯৪১ সালের ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে বেতারে নজরুলের একটি বক্তৃতা প্রচারিত হয়। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ‘হাতের রেখা দেখে গণনা আমার একটি সখ’। এ ছাড়া কবির হয়তো অন্যান্য সখও ছিল, কিন্তু এই প্রবন্ধে ‘নজরুলের জ্যোতিষচর্চা’ সম্বন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সুস্থ অবস্থায় নজরুল যাঁদের হাত দেখেছেন, বলাই বাহুল্য যাঁরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের স্মৃতিকথাই এই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।

কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত প্রিয় মানুষদের তালিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের বাহার-নাহার, দুই ভাইবোন। নজরুল তাঁর সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থটি তাঁদেরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে নজরুল লিখেছিলেন-
‘‘- আমার এই লেখাগুলো
বাহার ও নাহারকে দিলাম।-
কে তোমাদের ভালো?
‘বাহার’ আনো গুল্শানে গুল্, ‘নাহার’ আনো আলো।
‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,
‘নাহার’ এলে রাত্রি চিরে জ্যোতির অভিযান।
তোমরা দুটি ফুলের দুলাল, আলোর দুলালী,
একটি বোঁটায় ফুট্লি এসে, নয়ন ভুলালি!
নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী,
তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি!’’

মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, নজরুল যখন চট্টগ্রামে যান তখনো পামিস্ট্রির চর্চা করতেন। ওখানে বসেই কাজী সাহেব একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ গান ও কবিতা; অন্যদিকে তাঁর সখও পূরণ করেছেন। বাহার লিখেছেন- ‘‘কাজী সাহেব চট্টগ্রামে আমাদের বাড়িতে গিয়েছেন কয়েকবার। যে ক’দিন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে, মনে হতো বাড়িখানি যেন ভেঙ্গে পড়বে। রাত্রি ১০টায় থারমোফ্লাস্কে ভরে চা, বাটাভরা পান, কালিভরা ফাউন্টেন পেন, আর মোটা মোটা খাতা দিয়ে তাঁর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতাম। সকালে উঠে দেখতাম, খাতা ভর্তি কবিতা। এক-এক করে ‘সিন্ধু’, ‘তিন তরঙ্গ’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘অনামিকা’, ‘কর্ণফুলী’, ‘মিলন মোহনায়’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘নবীনচন্দ্র’, ‘বাংলার আজিজ’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সাতভাই চম্পা’ আরও কত কবিতা লিখেছেন আমাদের বাড়িতে বসে। চট্টগ্রামের নদী, সমুদ্র, পাহাড়, আমাদের বাড়ির সুপারি গাছগুলো আজ অমর হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যে। সারারাত কবি চা আর পান খেতেন- আর খাতা ভর্তি করতেন কবিতা দিয়ে। আর দুপুরে কখনো কিছু পড়তেন, কখনো করতেন পামিস্ট্রির চর্চা, কখনো বা মশগুল্ হতেন দাবা খেলায়। বিকেলে দল বেঁধে যেতাম নদীতে, সমুদ্রে। সাম্পানওয়ালারা এসে জুটত, সুর করে চলত সাম্পানের গান। সবাই মিলে গান করতাম, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী’ ‘গহীন জলের নদী’, এক এক সময় চট্টগ্রামী সাম্পানওয়ালারা গাইত ‘বঁধুর আমার চাটি গাঁ বাড়ী- বঁধুর আমার নন্দীর কূলে ঘর।’

ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আবদুল আযীয আল-আমানের ‘নজরুল পরিক্রমা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভবিষ্যৎ-জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে নাহার নজরুলকে হাত দেখিয়েছিলেন।

আবদুল আযীয আল-আমান লিখেছেন- ‘‘কবি বাহার-নাহার ভাই-বোনদের ভাগ্যলিপি পৃথকভাবে কাগজে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজের ভাগ্য জানার জন্য স্বভাবতঃই মানুষ কৌতূহলী। নাহার সাহেবাও একবার ঐকান্তিক আগ্রহে নিজের হাতখানি পর্দার আড়াল হতে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ‘দেখুন তো কবিদা, কতখানি পড়াশোনা লেখা আছে আমার হাতে?’ কবি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে হাত দেখে যে সুদীর্ঘ ভাগ্যলিপি রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি বিশেষ বক্তব্য এই ‘...স্বাস্থ্যভঙ্গ...প্রাণ নিয়ে টানাটানি... প্রিয়জন-বিয়োগ...’  সবশেষে লিখেছিলেন- ‘স্নেহ-মমতার অভাব হবে না কোনদিন,...Partial satisfaction of ambition... ইত্যাদি। কবি অনেকের হাত দেখে এ ধরনের মন্তব্য করতেন, এ জন্য তাঁর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী জনাব মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কাছে মাঝে মাঝে ভর্ৎসনা শুনতেন, তবুও নিরস্ত হতেন না। তাঁর কাছে হস্তরেখা গণনা এবং জ্যোতিষ চর্চা অনেকখানি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।’

নজরুল-সুহৃদ, মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধিচর্চার অন্যতম কাণ্ডারী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই চিঠিগুলো থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের কী গভীর প্রেম। ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে নজরুল চিঠি লেখেন মিস ফজিলতুন্নেসাকে। নজরুল তাঁর প্রকাশিতব্য ‘সঞ্চিতা’ তাঁকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সবাই জানি পরবর্তীতে তিনি ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করেছিলেন বিশ্বকবিসম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

ফজিলতুন্নেসাকে নজরুল চিঠিতে লেখেন- ‘‘আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া। খুব সম্ভব আর একমাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে। আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এ জন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব? সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পীড়া দিবেন না- এই আমার আকুল প্রার্থনা।’’

কিন্তু ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কীভাবে? তার বর্ণনা দিতে গিয়েই কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ‘হস্তরেখা গণনা’ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন - ‘‘ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না-অথবা ‘বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অংকের এমএ এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন শৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মতো সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।’’ 

ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত

এই স্মৃতিকথা থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, নজরুল নিতান্তই সখের বশে এই কাজ করলেও যথেষ্ট নিবেদিত ছিলেন।

১৯২৮ সালের ১০ মার্চ তারিখে ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলকাতা থেকে নজরুল চিঠি লেখেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘‘আমি হাত গুনতে পারি। আমি জানি, তুমি যেদিন শিশির ভাদুড়ীর ‘ভ্রমর’ দেখে এসেছিলে, সেদিন সারারাত বৌ-এর রসনা-সিক্ত মধু-বিষের আস্বাদ পেয়েছিলে। অন্তর তাঁর মাথার কাঁটাগুলোর চেয়ে বেশি বিঁধেছিল তাঁর কথাগুলো সেদিন তোমার বুকে। তারপর সেদিন চাঁদনী-রাতে কোনো অপরাধের জন্য সারারাত ‘দেহি পদ-পল্লবমুদারম’ গাইতে হয়েছিল শ্রীমতীর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে! তোমার বউ-এর ভাগ্য ভালো ভাই, হিংসে হয় এক একবার। দেখো, তোমার বউ-ও এই চিঠি লেখার আর প্রিয় সম্ভাষণের ঘটা দেখে আমায় সতীন না ঠাওরান!’’ 

এই চিঠিতে নজরুল নিজেই লিখেছেন, তিনি হস্তরেখা গণনা করতে পারতেন। হস্তরেখা দেখে চমৎকার ভবিষ্যৎ গণনাও করতে পারতেন। 

একবার কলকাতায় ওয়েলেসলি স্কোয়ারে কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরুল মোতাহার হোসেনের ও তাঁর শ্যালকদের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক শ্যালককে বলেছিলেন, তাঁর ভাগ্যে বিদেশযাত্রা আছে। এ কথা পরে ঠিকই হয়েছিল। আর একজনের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এ বহুদূর দেশে চলে যাবে, অজ্ঞাতবাসের মত।’ - এর মৃত্যু ঘটেছিল। 

প্রিয় মোতাহার সম্বন্ধেও বলেছিলেন, ‘তোমার যশো রেখা খুব স্পষ্ট, বিদেশযাত্রাও হবে, কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধক উত্তীর্ণ হয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে।’ নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকাংশেই মিলে যেত। এর স্বপক্ষে বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।

গ্রামোফোনের রিহার্সেল রুমে মাঝে মাঝে নজরুল হাত দেখার বই জোগাড় করে তাই নিয়ে মেতে থাকতেন। এই হাত দেখা নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন বিখ্যাত নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী আঙুরবালা দেবী। একটি বিশেষ ঘটনার কথা তাঁর লেখনীতেই তুলে ধরলাম- ‘‘আমাদের সময়ে গ্রামোফোনে একজন তবলা বাজিয়ে ছিলেন। নাম রাসবিহারী শীল। খুব গুণী লোক। রাসবিহারী বাবুর তবলা সঙ্গত না থাকলে আমাদের গান যেন জমতেই চাইতো না। একদিন শোনা গেল, জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী মশায় নৌকাযোগে কোথায় যেন গান গাইতে যাবেন, আর তাঁর সঙ্গে তবলা বাজাবার জন্য যাবেন সেই রাসবিহারী বাবু। সেদিন যথারীতি রিহার্সাল রুমে কাজীদার সঙ্গে আমরা গান-বাজনা নিয়ে মেতে রয়েছি। রাসবিহারী বাবু আমাদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করছেন। গান-বাজনার ক্ষণিক বিরতিতে তিনি কাজীদার সামনে ডান হাতটি মেলে ধরলেন: ‘কাজীদা আমার হাতটা একটু দেখুন না।’ এটা তাঁর জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বাইরে যাবার আগের দিনের ঘটনা। কাজীদার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। সেই হাসিমুখেই তিনি রাসবিহারী বাবুর হাত দেখায় মন দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠলো। একসময় রাসবিহারী বাবুর হাত ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সবাই চুপচাপ। হঠাৎ কাজীদার এই ভাবান্তর দেখে আমরাও অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসবিহারী বাবু হাসিমুখে বললেন- ‘কই কাজীদা হাতে কি দেখলেন, বললেন না তো!’ কাজীদা তবুও নিরুত্তর। রাসবিহারী বাবু আবার বললেন ‘বলুন না কাজীদা কি দেখলেন। খারাপ কিছু?’ এবার কাজীদার মুখে মৃদু করুণ হাসি ফুটে উঠলো। রাসবিহারী বাবুকে তাঁর গুণের জন্য কাজীদা খুবই স্নেহ করতেন। তাই ধীরে ধীরে তাঁর পিঠ চাপড়ে বললেন- ‘দূর পাগল খারাপ কেন হবে। ভালোই তো, সব ভালো।’ 

এই কথার পর কাজীদা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তখনকার নামকরা গায়ক ধীরেন দাস সেদিন ঐ ঘরে উপস্থিত ছিলেন। রাসবিহারী বাবু চলে যাবার পর ধীরেন বাবু কাজীদাকে চেপে ধরলেন, ‘বলুন না কাজীদা ওর হাতে কি দেখলেন?’ কাজীদা বললেন, ‘একটু খারাপ জিনিসই দেখলাম।’ নজরুলের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। ক’দিন পর জ্ঞানবাবু গান গেয়ে ফিরে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু শোনা যায়, রাসবিহারী বাবুর জ্বর হয়েছিল। এর ক’দিন পর খবর আসে তাঁর সামান্য জ্বর নিউমোনিয়ায় দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করা হয় কিন্তু তাঁর সে নিউমোনিয়া আর ভালো করা যায়নি। মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রাসবিহারী শীল মারা গেলেন। নজরুল পরে ধীরেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বেদনার হাসি হেসে জবাব দিয়েছিলেন,‘হ্যাঁ, আমি সেদিন ওর হাতে মৃত্যুযোগ দেখেছিলাম। বুঝেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়ত রাসবিহারীর মহাবিপদ আসছে। আর সেই জন্যেই আমি কিছু বলিনি সেদিন।’ 

উপরোক্ত ঘটনা থেকে সহজেই ধারণা করা যায়- অবসর সময়ে নজরুল তাঁর প্রিয়জনদের হস্তরেখা গণনা করে সুন্দর সময় কাটাতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবন আলো-আঁধারের মিশেল। তাই এই বিশেষ গুণের অধিকারী নজরুল কখনো কখনো প্রিয় মানুষদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে অগ্রিম জেনে যাওয়ায়, তাঁর মন হতো বিষাদে পরিপূর্ণ।

তথ্যঋণ:
নজরুলের কবিতা-সমগ্র
নজরুলের পত্রাবলি: শাহাবুদ্দীন আহ্‌মদ সম্পাদিত
কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুল চর্চা: তপন বাগচী সম্পাদিত
নজরুল যখন বেতারে : আসাদুল হক
নজরুল স্মৃতি: বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
নজরুল পরিক্রমা: আবদুল আযীয আল-আমান

লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

পাখির অভিমান

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
পাখির অভিমান
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বুকের চেয়ে বড় কোনো ডাকঘর নেই, এই অধিবিদ্যার পৃথিবীতে
যেখানে দিনে-রাতে, কত চিঠি আসে আর যায়...

একই  শহরে থাকি আমি ও আমার অস্থির নীরবতা

খুঁজিনি কখনো বৃক্ষের বুকে কান রেখে আমারি নিশ্বাস। 
তবু মনের ভুবনে এই পৃথিবীর অদ্ভুত সন্ধ্যা এসে থামে; 
খোঁজ করে কোনো এক বৃক্ষের সংসারে এই আমাকে। 
আমি ব্যস্ত তখন, এক অকালপ্রয়াত বটবৃক্ষের নিহত সংসারে।

বিষণ্ন আঙিনাজুড়ে উড়ে পড়ছে একদল পাখির অভিমান। 
আজ হয়তো গাছে গাছে শুরু হবে পাখিদের শোকসভা। 
হাওয়ায় হাওয়ায় আরও মিলে যাবে বৃক্ষশ্রোতা। 
এই মহান পাখি সম্মেলনে আমিও মিলে যেতে 
চাই অন্তরের অনুলিপি হয়ে। 

দৈনিক বাতাস বিচিত্রায় আজ ছাপা হলো বৃক্ষ হত্যার প্রতিবাদ। 
সেই বৃক্ষের মৃত্যুতে গাছে গাছে ঝুলছে দেখি পাখিদের শোক প্রস্তাব।

বিজড়িত

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
বিজড়িত
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আঁধার আমার ভালো লাগে, 
তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ 
বড় প্রিয় গান 

তুমি যে সূর্যসম্ভব 

কালের নিয়মে তেজ ম্লান হয় 
লোহিত নক্ষত্রের গান 
শ্বেত বামন শুধু ম্লান হতে থাকে 

নিভে যায় সব...

গুঁড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে যায় 
কণিকা সম্ভার 

শূন্য জুড়ে তাই এত টান 

যাকে ‘মায়া’ বলে ডাকি।

কবিতা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

এই হাত
মুজিবুল হক কবীর

এই হাত
পতন ঠেকাতে জানে,
এই হাত ইস্পাত
পুড়ে যায় যজ্ঞে-আগুনে।

এই হাত মেতে ওঠে
মিছিলে-আন্দোলনে
এই হাত প্রতিবাদী
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে।

এই হাত নিয়ে আসে স্বর্গের পারিজাত
এ হাত থামিয়ে দেয় জলের প্রপাত।

হৃদয়ের যত গ্লানি মুছে দেয় এই হাত,
কার ইশারায় চলে যায় অহল্যারও অভিসম্পাত।

দ্বন্দ্ব ও কোলাহল, যুদ্ধ-
কখনো নেয়নি মেনে নানক ও বুদ্ধ।
এ জগৎ-সংসার একটি রজ্জুতে বাঁধা
কোথায় কৃষ্ণ আর কোথায় বা রাধা।

এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ডুবে আছে জলে,
তবু সব কিছু আজ
ঈশ্বরেরই করতলে।

প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল
কবি মুহম্মদ ইকবাল

কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ ইকবালের জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক মুসলিম পরিবারে ৯ নভেম্বর ১৮৭৭। মৃত্যু ২১ এপ্রিল ১৯৩৮। পিতা শেখ নূর মুহম্মদ। মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ ইকবালের কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি এবং উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদি’ (১৯১৫) পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে, ইকবাল পিএইচডিতে অধ্যয়ন করার জন্য জার্মানিতে চলে যান এবং ১৯০৮ সালে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ডক্টরেট থিসিসটির শিরোনাম ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া’। ১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসে লাহোরের সরকারি কলেজে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইন ব্যবসা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমিক। সাহিত্যের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন। উর্দু ভাষা ও কাব্যকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। সে জন্য তাকে শায়ের এ মাশায়েও বলা হয়। তার কাব্যমুগ্ধ পাঠককূল তাকে আল্লামা উপাধি দিয়েও সম্মানিত করেন।

শ্রীধরনামা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ পিএম
শ্রীধরনামা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শ্রীধর আমাদের বন্ধু মহলের এক চির বিস্ময়। সে-কালে, মানে যে-কালে এই শিল্পাঞ্চলে, যে শিল্পাঞ্চল ঘিরে সমরেশ বসু ‘জগদ্দল’ বা তারও আগে ‘উত্তরঙ্গ’ হয়ে ‘শ্রীমতী কাফে’ হয়ে ‘খণ্ডিতা’ পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, ১৯৮৮ সালের মার্চের ১২ তারিখ, সেই মহাসর্বনেষে তারিখটা না এলে হয়তো বিধুভূষণ বন্দোঘঁটি, শ্রীধরের জন্মদাতা, তিনিও দোলা-শ্রীধর বা কালুর বৌয়ের সঙ্গে শ্রীধরের আশনাই বা সমরেশ বসুরই বন্ধু, ভীমরুলের নাদনি, সেই পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবী, দীপক সাহার চায়ের দোকানে বসে, শ্রীধরের নিচের নয়, বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল- তা নিয়ে একালে এত হট্টগোল হতো না।

হুগলীর আনাচে-কানাচে সেই নিতম্বিনী দেবীর, নিতম্বের ভারে ঝপঝপে হয়ে যাওয়া শব্দের আওয়াজ, থমথমে হয়ে যাওয়ার ঠিক প্রদোষকালে, কখনো ঠাওর করে উঠতে পেরেছিল। সমরেশ বসুর লেখা ঝেঁপে, কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার হাউসে দিগ্বিদিক ভুলে সুরো ভটচায্যির গলিতে হাবুডুবু খাওয়া, রেখা পালের সমাজে স্বীকৃতি না পাওয়া দাদা, নিরোজ, নিরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সমরেশ বসুর দৌলতে যে কলিকালের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন, সেই নিরোজের সঙ্গে দোলার, ‘মাস্সাই’সুলভ সম্পর্ক ঘিরে সেই দোলার পেটে জন্ম নেওয়া শিশুকে, ‘আমার বৌয়ের সন্তান’ না বলে, ‘আমার শালীর মেয়ে’ বলে চালিয়ে যাবে, চালিয়েই যাবে শ্রীধর বন্দোঘঁটি?

আচ্ছা এই যে, ‘ভীমরুলের নাদনি’ শব্দটা ব্যবহার করা হলো, এই শব্দটা আপনারা পাঠকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন কী? এই যে টিপিকাল ‘ঘঁটি’ লব্জ, শাঁটুল গুপ্তের প্রজন্মের পর খাস বাগবাজারি ঘঁটিরাও কি এখন এমন শব্দের ব্যবহার ধরে রেখেছে? কিন্তু বিধুভূষণ বন্দ্যোঘঁটি, ঘঁটি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে আমাদের শাঁটুলবাবুর থেকে এক কাটি বেশি ছিলেন বই কম ছিলেন না।

বিধুভূষণ কখনো ‘পেপার’ বলতেন না। বলতেন, ‘খবরের কাগজ’। কখনোই তিনি ভুলবশতও গোটা জীবনে ‘চুঁজরো’ বই ‘চুচুঁড়া’ উচ্চারণ করেননি। কস্মিনকালেও গনগনে গরম চাভর্তি চাপ ঠোঁটের সামনে এনে গলায় চালান করবার সময়ে ‘উঁহুউউউ’ করে আওয়াজ করেননি। 

তাই তিনি ‘নাতনি’ কে ‘নাদনি’ বলবেন- এটা কিন্তু কখনোই আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো বিষয় আদৌ নয়। বিধুভূষণ বাংলা খেয়ে যখন ড্রেনের ধারে গড়াগড়ি খেত, তখন ওর নাতনি, যাকে শ্রীধরের বন্ধুরা, সেই সেকালে ‘নাতনি’র দেহের ভঙ্গিমা দেখে ‘পিঁয়াজি’ বলত, সেই হাফ গেরস্তকে যখন শ্রীধর, মেয়েদের নয়, ছেলেদের তানপুরো তৈরি করে দিল কালুর বউয়ের তানপুরো ফাটানোর বিনিময়ে, তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল, সে-কালের শ্রীধর আর এ-কালের শ্রীধরের মধ্যে জাপানি বন্ধুদের প্রভাবের আগে আর পরে এতটা ফারাক ঘটবে?

‘পিঁয়াজি’র দিকে শ্রীধরের বাপ, মানে শ্রীধরের বিকাশমান লালিত্যের সে-কালের উদ্ভাষক ক্ষিরুমামার একটা বিশেষ রকমের প্রভাব ছিল। প্রতিপত্তিও ছিল। আসলে ক্ষিরুর পৈতৃক সূত্রে একটা দখল করা বাড়ি ছিল সেকালের মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায়। এখন ক্ষিরুমামার আট মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি হলেও ‘পিঁয়াজি’কে নিয়ে যখন শ্রীধর, ওয়াই কে টু-র প্রবলেম সল্ভ করতে ক্ষিরুমামার ঠাকুর্দা, মানে শ্রীধরের পরদাদা, অশ্বিনীকুমার ঘোরপাড়ুইয়ের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যেত, তখন রিপোজ নার্সিংহোমের সামনে রীতিমতো লোক জমে যেত পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবীকে দেখতে।

পিঁয়াজিবালা এখন রীতিমতো আগুনখেঁকো নেত্রী। ব্যান্ডেল চার্চপাড়ায় এককালে যিনি দাপুটে কাউন্সিলর ছিলেন, সেই মাস্টারমশাই জ্ঞানদাকে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতে হয় পিঁয়াজিবালার আগমন এবং নিষ্ক্রমণ ঘিরে। জ্ঞানদার সঙ্গে শ্রীধরের পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে, শ্রীধর নিশ্চয়ই শুধাতো- দেবীর কি সে আগমন? আর নিষ্ক্রমণই বা কীসে? 

আচ্ছা  পিঁয়াজিবালার স্কুটির পেছনে শ্রীধর কখনো সাওয়ারি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি কখনো শ্রীধর তানপুরোতে তিনটে আঙুলের, কসরতে সুরলহরি তুলে ছায়াহিন্দোল গেয়েছে?

পিঁয়াজিবালা সেদিন লোটে মাছের ছালুন রেঁধেছিল বেলডাঙার মরিচ দিয়ে। ঝালের জন্য এদিকে বেলডাঙার মরিচের বেশ নামডাক আছে। সেই নুন দিয়ে নুচি খাওয়ার কালে শ্রীধর ব্যান্ননে মরিচ দেখলে তা আর মুখেই তুলত না। দীপক সাহার দোকানে পিঁয়াজিবালা প্রথম যেদিন শ্রীধরের কোলে বসে, শ্রীধরেরই বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল, সেদিনই দীপক সাহা নিজের হাতে দুটো কাঁচা মরিচ দেওয়া ডবল ডিমের ওমলেট খাইয়েছিল ছেলেটাকে।
লোটে মাছের ছালুন দিয়ে মাখা ভাতের লোকমাটা মুখে চালান করতে করতেই শ্রীধর বলে উঠল- 

বুঝলি কুমড়ি, এই লোটে মাছে প্রচুর ফসফরাস থাকে। ফসফারাসে চোখ ভালো হয়।

পিঁয়াজিবালাকে ডাক নামে ডাকতেই ভালোবাসে শ্রীধর। তবে কালুর বৌ থেকে ক্ষিরুর আপিসের সেই লাবণ্যলতা হয়ে চিনে হাঁদুর বর্তমান ভাগনেবৌ, সবাইকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে শ্রীধর ‘হেকেটি’ বলতে ভালোবাসে। কারণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’তে নাকি লেখা আছে, রবীন্দ্রনাথ, তার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ বলে ডাকতেন।

বড় বড় জিনিস দেখে তোমার এখন চোখ বড়তেই সয়ে গেছে গো শ্রীধরদা। নতুন করে আর তোমার এখন চোখ ভালো করবার দরকার নেই। চোখের জ্যোতি তোমার কালুদা আর ভবান বৌদি, দুজনেই মেজেঘসে বেশ চকচকে করেই রেখে দিয়েছে।

পিঁয়াজিবালা নোয়াখাইল্যা হলেও সমরেশ বসুর ‘ভানুমতী’র দেশে থেকে ফরাসডাঙার ‘হ্যাঁ গো’, ‘কী গো’ বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। যদিও হাওড়ার ঘঁটি কেতা ভুলে এখন শ্রীধর হাবুডুবু খাচ্ছে কালু জানুলম্বিত ঘণ্টার তালে তালে।

শ্রীধর মাঝেমধ্যে বেশ উদাস হয়ে যায় জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ কষতে গিয়ে। ছেলেটা খুব যে একটা হিসেবি, তা বলা যায় না। অন্ততপক্ষে এলাকার নেতা দুই তরফের দুই নেতা- মলয় ভট্টাচার্য আর শমিত ঘোষ, যারা দুবেলা যাদবপুর থেকে ঠেঙিয়ে নৈহাটি আসা শ্রীধরকে তাদের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখে, তারা কখনো ছেলেটাকে তেমন একটা হিসেবি বলে না।

আসলে বলে না, নাকি বলতে চায় না- এটা নিয়ে আবার সুনীতিদাদের ঠেকে বেশ তক্কবিতক্ক আছে। ওই যে সুনীতিদের সঙ্গে ঠেক মারা রেলের রিটায়ার্ড বুকিং ক্লার্ক তপুবাবু, রাত্রিক নাট্যসংস্থায় চা, জল বয়ে এনে নিজেকে নাট্যকর্মী বলে দাবি করে শহরের বুকে নাট্যোৎসব হলে ঠিক টুক করে মন্ত্রীর পাশের সিটটা দখল করে নেয়, সেই তপুবাবু, নিজের চাকরি জীবনে যেভাবে হাতের ভাঁজে একটা পাত্তি পকেটস্থ করতেন, ঠিক সেই স্টাইলে শ্রীধরকে রোজ একটা করে গোল্ড ফ্লেক সিগারেট দেয়।

কালু সম্ভবত মহাদেবের চা-খানায় এককালে সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে দুপুর আড়াইটের সময় শ্রীধরকে একা একা আড্ডা মারতে দেখে বাড়ি গিয়ে ভবানীকে ব্যাপারটা বলে ফেলে। আসলে সেদিন কালুরই ব্যাংকিংয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছিল। সবিতা। কালুর ছোটভাইয়ের বৌ, হাজার পাঁচেক টাকা চেয়েছিল। পেনশনভোগী কালু মাসের যত তারিখই হোক না কেন, সবিতা টাকা চাইলে কখনো না করতে পারে না। হাসির ছলে ভেসে যাওয়া দিনের কথা মনে করে হৃদয়ের দয়ার ঘটটা কালুর ছলছলিয়ে ওঠে ছোটভাইয়ের অসহায় বৌটার জন্য। 

নিজে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল সেদিন কালু টাকাটা পাঠাতে সবিতাকে। কিছুতেই অনলাইন ট্রানজাকশন হচ্ছে না। আবার বাড়িতে বসে বেশি সময় ধরে চেষ্টা করলে পাছে ভবানী জানতে চায়, মোবাইলে অতক্ষণ ধরে কী করছ খুটখুট করে? 

তাই পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে নেমে নেদু সান্যালের বাড়িটা পেরোতেই কালুর মনে পড়ে গেল, এই রে, শ্রীধর তো আবার বলবে; আরে কালুদা, আবার ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে এসেছেন? পুজোর তো এখন অনেক দেরি!

কালু অনেক বলবার চেষ্টা করেছে শ্রীধরকে বোঝাতে, ঘণ্টা যত নড়বে, হাওয়া তত বইবে, আলো আরও খেলবে। বলব বলব করেও অবশ্য কথাগুলো শ্রীধরকে বলে উঠতে পারেনি কালু। না বলবার কারণ হলো, পাছে শ্রীধর জেনে যায় অনুর জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব!

মহাদেবের দোকানে কালুর সমস্যা সল্ভ করে শ্রীধর, কিন্তু যেহেতু সে নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, খুব একটা পাত্তা দেয় না কালুকে। শ্রীধরের এই পাত্তা না দেওয়াটা বেশ একটু বেশি পরিমাণেই আঁতে লাগে কালুর। মটকা গরম হয়ে গেলেও মুখে কিছু না বলে মহাদেবের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে আবার সুরো ভটচায্যির গলি পেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মনে তখন কালুর একটাই তৃপ্তি, শ্রীধর খুব একা পাত্তা দিক আর না দিক, ওর দৌলতে সবিতাকে পাঁচ হাজার টাকা শেষ পর্যন্ত পাঠানো গেছে।

আজ সকালে যখন মলয় ভটচায্যি বললেন, শ্রীধরকে নিয়ে অক্ষয়কুমারী দেবী রোডের আশপাশে ঘুরতে দেখেছেন, একদম উল্টো রাজনৈতিক শিবিরের শমিত যখন এককথায় সমর্থন করল মলয়ের সেই কথা, শ্রীধর অবশ্য তখনো দাঁতের ডাক্তার রণজিৎ সরকারের বাড়িতে সে গেছিল, এই যুক্তিতেই একদম এঁটুলির মতো এঁটে রইল।

আসলে মিথ্যে কথাটা শ্রীধরের ঠিক আসে না। মিথ্যে বললেই কেমন যেন ওর মুখটা ভ্যাদাই মাছের মতো বোকা বোকা হয়ে যায়। আর তেমনটা হলেই, ডাল মে যে থোরা থোরা কালা- সেটা মালুম করে নিতে কারও খুব একটা অসুবিধা হয় না।

সাত সকালে আজ হেকেটি ফোন করেছে শ্রীধরকে। ট্রেনটা তখনো শিয়ালদা সাউথ সেকশনে ঢোকেইনি। এই সময়ে শ্রীধর সাধারণত ফোন-টোন ধরে না। সবাই জানে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরুর আগেই স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নৈহাটিতে মহাদেবের চায়ের দোকানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের কেয়ার না করে আড্ডা দিতে চলে আসে শ্রীধর। আবার বিকেলে, পাঁচটা বাইশের নৈহাটি লোকাল ধরে যাদবপুরে শেষ ক্লাসটা নিয়ে, ইউনিভার্সিটির ঘরগুলোর সব তালা ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে নাকি সেটা টেনেটুনে দেখে, বাপ্পার দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে, শঙ্কুরবাড়ি পাশ কটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে সে পৌঁছায়।

সুরঞ্জন দাশ নাকি শ্রীধরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; তা কত ইস্তক এ কাজ কোরচেন? 

শ্রীধর জবাব দিয়েছিল; একুনে সেই ত্রিগুণা সেনের আমল থেকে।

তার পর থেকে নাকি আর কেউ যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ঘিরে শ্রীধরকে কোনো কথা শুধোতে সাহস করেনি।

তাই এমন অসময়ে কালুদার বৌ ফোন করাতে যুগপৎ বিরক্ত আর বিস্মিত হলো শ্রীধর। তবে ছেলেটার সব থেকে বড়ো একটা গুণ হলো, রেগে গেলেও ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু ধরা যায় না, আনন্দেও নয়। তাই তো কালুর বৌ একদিন নিজের পরম তৃপ্তির পর শ্রীধরকে বেশ ন্যাকা ন্যাকা সুরেই শুধিয়েছিল; আর ইউ ওকে শ্রীধর? 

কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা কালুর ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে সাইকেলের তালা খুলে সটান মহাদেবের চায়ের দোকানের পাশে মাছের আড়তের বড় বেদিটার ওপর বসে পড়ে জোরে হাঁক দিয়েছিল, সোমনাথ একটা ছোট চা।

ভবানীর গলার স্বরটা আজ আদৌ রসেবশে নেই। বেশ একটু কর্কশই। শ্রীধর একটু জোর করলে যেমন চেঁচিয়ে উঠতে অভ্যস্ত কালুর বৌ, অনেকটা তেমন। অবশ্য শ্রীধরের ধারণা, হেকেটির এই চেঁচানিটা একটু আর্টিফিসিয়াল। লোক দেখানো। আসলে নদী যখন তীরে এসে আছড়ে পড়ে, জলের ইচ্ছে না থাকলেও জলে জলে কোলাকুলিতে যেমন নদীর পাড়ে ঢেউয়ের আছড়ে পরবার একটা আওয়াজ হয়, কালুর বৌয়ের সময় বিশেষের আওয়াজটাকে অমনটাই মনে হয় শ্রীধরের। তাই ফোনের ও-প্রান্ত থেকে যখন একটু খ্যাঁককুটে গলাতেই প্রশ্ন এল- ক্লাসে? 

নিজেকে একটু সেফসাইডে রেখেই ব্যাট করতে নামল শ্রীধর। কারণ, ওর তখন মন বলছে, বলটা গুগলিই হবে। আর গুগলি বলে ভালো ব্যাট করতে কোনোদিনই শ্রীধর পারে না। এককালে ছক্কা হাঁকানো শ্রীধর, সেই পিঁয়াজিবালার শ্রীধর, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়েই ফোনের ও-প্রান্তের দিকে উত্তর পাঠাল- হ্যাঁ, বলুন বৌদি।

দুই তরফেই খানিকটা নিস্তবদ্ধতা। শ্রীধর ভাবছে, সময় সম্বন্ধে তো হেকেটির অসাধারণ মাত্রাজ্ঞান। এই সময়ে তো খুব বড় কিছু দরকার না হলে, কেবল আমড়াগাছি করতে এই সময়ে হেকেটি ফোন করে না।

হ্যাঁ বৌদি, কালুদা ঠিক আছে তো? 

ও প্রান্ত থেকে একটাই উত্তর, টুকুদির ছেলের বৌয়ের প্রেগ কালার টেস্টের রিপোর্ট আমার হাতে।

ঝপ করে ফোনটা কেটে দিল শ্রীধর।