আমার যৌবনের কয়েকটি স্মরণীয় বছর কেটেছে কুষ্টিয়ায়। সেখানকার মাটি, সেখানকার মানুষ, সেখানকার মানুষের মুখের ভাষা ও অন্তরের প্রীতি আমি কি ভুলতে পারি? এককালে ভাবতুম সরকারি কাজ থেকে অকালে অবসর নিয়ে সেইখানেই সাহিত্যসাধনার আসন পাতব। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদা সেখানে, লালন ফকিরের আস্তানা সেখানে, বাউলদের মিলনকেন্দ্র সেখানে। সুতরাং আমারও কুটির হবে সেখানে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়!...
অন্নদাশঙ্করের সারা জীবনের সাধনা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলন। হিন্দু ও এই দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির ভেতর দিয়েই অন্নদাশঙ্কর হয়েছিলেন লালনের ‘মনের মানুষ’। অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রয়াণে একজন বলেছেন, ‘বাংলার রেনেসাঁর শেষ প্রতিনিধি বিদায় নিলেন।’ হয়তো সেই সঙ্গে সম্প্রদায়-সম্প্রীতির, উদার মানবিকতার, মূর্ত মনুষ্যত্বের, পরিশীলিত রুচির, প্রগতি-চিন্তার একজন বিবেকী শিল্পীরও তিরোধান ঘটল। তার প্রিয় লালন সাঁইয়ের পদ-পঙ্ক্তি দিয়েই তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি: ‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাব না’।
সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রতি তার ছিল চিরকালের আকর্ষণ ও দুর্বলতা। এর পেছনে রয়েছে এই ভূখণ্ডে অনেক প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য ও তার পেশাজীবনের স্মৃতি। দেশভাগ তাকে গভীর আঘাত ও দুঃখ দিয়েছিল। ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর ’পরে রাগ করো’- এই ছড়ায় তার সেই বেদনার দীর্ঘশ্বাস প্রচ্ছন্ন থাকেনি। তাই পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র-রচনায় ব্রতী হয়, অন্নদাশঙ্কর তখন সক্রিয় সমর্থন, সহায়তা ও সাহস জুগিয়েছেন। লালনকে তিনি সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও মিলনের প্রতীক এবং মানবতাবাদের এক শক্তিশালী প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি আখড়াই ঘরানার শুদ্ধ সুরে লালনের গানের প্রচার চাইতেন। পশ্চিমবঙ্গেও তিনি মুক্তবুদ্ধির প্রতীক লালনকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
প্রখ্যাত বাঙালি রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘অন্নদাশঙ্করের প্রবন্ধসম্ভার বাংলাসাহিত্যের মহামূল্য সম্পদ’। অন্নদাশঙ্করের সাহিত্যচেতনা দুই মহান সাহিত্যপ্রবাহে লালিত। একটি ভারতীয় সাহিত্যের তিন হাজার বছরের ধারা, অন্যটি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পাঁচ শ বছরের জোয়ার, তার সাহিত্য সৃষ্টিতে এই দুই ধারার অনবদ্য সমন্বয় ঘটেছে। তার রচনায় একদিকে যেমন আছে সরলতা ও স্নিগ্ধতা, তেমনি অন্যদিকে আছে বিশুদ্ধ ও বৈজ্ঞানিকতা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, শিল্প ও জীবন, বিশ্বাস ও মনন এবং ভাবের সঙ্গে ভাবনা, বস্তুজিজ্ঞাসার সঙ্গে রোমান্টিক চেতনা, লোকজীবনের সঙ্গে পরিশীলিত জীবন- সব কিছু মিলিয়ে তিনি নিজে এবং তার সৃষ্টিও এক আশ্চর্য নান্দনিক সমীকরণ। জানা যায়, সাক্ষাৎপ্রার্থী বা অতিথির প্রতি আন্তরিকতা ও মনোযোগে বাধা পড়েনি কখনো। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। অন্নদাশঙ্কর রায় কবি ও কথাসাহিত্যিক, ভ্রমণকাহিনিকার, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার এবং সর্বোপরি সচেতন ও বিবেকবান চিন্তাবিদ।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম ১৯০৪ সালের ১৫ মার্চ ব্রিটিশ ভারতে বর্তমান ওড়িশার ঢেঙ্কানলে। বাবা ছিলেন ঢেঙ্কানল রাজস্টেটের কর্মী নিমাইচরণ রায় এবং মা হেমনলিনী। ছোটবেলায় ঢেঙ্কানলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯২১ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এর পর সংবাদপত্রের সম্পাদনা শিখতে কলকাতা বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের কাছে যান। তিনি শর্টহ্যান্ড, টাইপরাইটিং এবং প্রুফরিডিংও শেখেন। কিন্তু এই কাজ তার ভালো লাগেনি। এর পর তিনি কটকের রাভেনশ কলেজ থেকে ১৯২৩ সালে আইএ পরীক্ষা দেন এবং ১৯২৫ সালে বিএ পরীক্ষাতেও তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯২৭ সালে এমএ পড়াকালীন আইসিএস পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয়বার পূর্ববর্তী রেকর্ড ভেঙে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এ গৌরব লাভ করেন। সেই বছরেই তিনি সরকারি খরচে আইসিএস হতে ইংল্যান্ড যান। সেখানে তিনি দুই বছর ছিলেন। এই সময়ে তার ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি ‘পথে প্রবাসে’ বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়।
অন্নদাশঙ্কর ১৯৩৫-৩৬ সালে কুষ্টিয়ার মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। কুষ্টিয়া তখন নদীয়া জেলার একটি অংশ। তার যৌবনের কর্মক্ষেত্র কুষ্টিয়ার প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ও দুর্বলতার কথা নানাভাবে নানান লেখায় প্রকাশ করেছেন। ‘কুষ্টিয়ার বাউলসাধক’-এর পরিচায়িকায় তিনি বলেছিলেন, ‘কুষ্টিয়ায় আমার যৌবনের কয়েকটি স্মরণীয় বছর কেটেছে। সেখানকার মাটি, সেখানকার মানুষ, সেখানকার মানুষের মুখের ভাষা ও অন্তরের প্রীতি আমি কি ভুলতে পারি? এককালে ভাবতুম সরকারি কাজ থেকে অকালে অবসর নিয়ে সেইখানেই সাহিত্যসাধনার আসন পাতব। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদা সেখানে, লালন ফকিরের আস্তানা সেখানে, বাউলদের মিলনকেন্দ্র সেখানে। সুতরাং আমারও কুটির হবে সেখানে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়!’ ১৯৪০ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি কাজে নিযুক্ত থেকে ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিচার বিভাগের সেক্রেটারি হন। ১৯৫১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তখন থেকে সাহিত্য সাধনার জন্য শান্তিনিকেতনে বাস। সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন প্রথম সভাপতি এবং আমৃত্যু এই পদে ব্রতী ছিলেন। তার অপর সাধনা হয় দুই বাংলার সেতুবন্ধন। আজ থেকে ২৫ বছর আগে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘জীবন যৌবন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “গান্ধীজি বলতেন, ‘আমার জীবনই আমার বাণী।’ আমি বলি, আমার বাণীই আমার জীবন। আমার বাণীর মধ্যেই আমার জীবন নিহিত। সাতচল্লিশ বছর বয়সে এই জীবনস্মৃতির দাঁড়ি টেনেছি। গান্ধীজিও দাঁড়ি টেনেছিলেন সেই রকম বয়সে। রবীন্দ্রনাথ আরও পূর্বে।...”
ঐতিহ্যচেতনায় তিনি একদিকে যেমন বিশুদ্ধ বাঙালি, অপরদিকে সংস্কৃতির অন্বেষণে বিশ্বপথিক। অহিংস-পন্থায় তার অটল বিশ্বাস, মানবতার তিনি একান্ত পূজারি, সৌন্দর্যপ্রেমের নিত্য-অন্বেষক, মৃৎসংস্কৃতির মমতায় সিক্ত, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি রচনায় নিষ্ঠ সাধক। তাঁর জীবনচেতনা ও সাহিত্যসাধনায় তলস্তয়-রবীন্দ্রনাথ যেমন, তেমনই গান্ধী-লালনও প্রেরণা হয়েছেন। সব্যসাচী বাঙালি লেখক তিনি। সৃষ্টিধর্মী ও মননশীল- উভয় ধারার রচনাতেই তার অনায়াস সিদ্ধি। তিনি গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রেখেছেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক।
সাহিত্যকর্মের জন্য অন্নদাশঙ্কর রায় বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদক পুরস্কারে ভূষিত করে। তাকে দেশিকোত্তম সম্মান প্রদান করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডিলিট) উপাধি প্রদান করে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬২), আনন্দ পুরস্কার (দুবার-১৯৮৩ ও ১৯৯৪), বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৫), রবীন্দ্র পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার, বাংলাদেশের জেবুন্নিসা পুরস্কার। সাহিত্যের এই মহাপুরুষ মৃত্যুবরণ করেন ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর।