ঢাকা ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
English
বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শেরেবাংলা: বাঙালি জাতির অন্যতম প্রাণপুরুষ

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম
শেরেবাংলা: বাঙালি জাতির অন্যতম প্রাণপুরুষ
শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক

আবুল কাশেম ফজলুল হকের জন্ম (২৬ অক্টোবর ১৮৭৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬২) ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে। পিতা কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং মাতা সাইদুন্নেসা খাতুন। শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বাঙালি জাতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। মুসলমানদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল ইংরেজ বণিকরা। ২০০ বছরের শাসনামলে তারা মুসলমানদের দেখেছে অবজ্ঞার চোখে। এ দেশের মুসলমানরা তাই অশিক্ষা, কুসংস্কার আর জমিদার-মহাজনের নির্মম নিষ্পেষণে হয়ে পড়েছিল দিশাহারা। জাতির এই চরম দুর্দিনে তিনি দৃপ্ত পদভারে আগমন করলেন। তার আবির্ভাবে বাঙালিরা অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসার পথের সন্ধান পেল। আনাচার, নিপীড়ন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস সঞ্চয় করল। ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাবে’ মুসলমানদের জন্য একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানালেন তিনি। তারই আলোকে ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা একটা স্বতন্ত্র আবাসভূমি পেল। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বৈরিতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। শেরেবাংলার নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হলো এবং রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে। অবশেষে চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলো বাঙালিরা। আমরা পেলাম নিজস্ব ঠিকানা- বাংলাদেশ।

‘ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচয়’ নিয়ে বই লিখছি

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ পিএম
‘ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচয়’ নিয়ে বই লিখছি
ফরিদ আহমদ দুলাল

ফরিদ আহমদ দুলালের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ মে ময়মনসিংহ শহরে। নাট্যকর্মী পিতা মীর্জা মো. ফেরদৌসী, মাতা ফাতেমা আখতার খাতুন। ফরিদ আহমদ দুলালের সাংস্কৃতিক জীবন শুরু সংগীতচর্চা-নাট্যচর্চা ও কাব্যচর্চা দিয়ে। একসময় তার নাট্যচর্চা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, তার অন্য সব পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। পঞ্চাশোর্ধ মঞ্চ সফল নাটক রচনা, শতাধিক নাটকে অভিনয় এবং পঞ্চাশোর্ধ নাটক নির্দেশনা ছাড়াও তিনি শাপলা নাট্যগোষ্ঠী, জাগ্রত নাট্যগোষ্ঠী, ময়মনসিংহ থিয়েটার, নাট্যাঙ্গন নাট্যপরিবার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন মোর্চা গঠনেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। সত্তরের দশকের অন্যতম কবি ফরিদ আহমদ দুলাল কবিতাচর্চায় যেমন নিবেদিত, কবিতা বিষয়ক সাংগঠনিক কার্যক্রমে বিশেষ যত্নশীল।

ফরিদ আহমদ দুলাল এক সময় জাতীয় কবিতা পরিষদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কবিতাবাংলা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সাহিত্য সাময়িকী ‘উপল’, ‘স্বরচিত’, ‘স্বতন্ত্র’; নাট্যপত্রিকা ‘মথি’র সম্পাদক। তার গ্রন্থ তালিকায় আছে- কবিতা: অপূর্ব ডেকে যায়, লাবণ্য ছুঁয়েছি তোমাকে, জলের গহীনে রোদ, নিবিড় নিঃশ্বাস তার, করতলে রাত্রির ছোঁয়া, মুখোমুখি দুঃসময়, দীর্ঘ বিষাদ সড়ক, নিঃসঙ্গ রজনীর লাবণ্য, অমানিশার কাব্য, প্রত্যুষের বাগান রচনা পর্ব, মৈমনসিং গীতিকাভাসান, অরণ্যে অনর্থ তোলপাড়, নাইওর, নিরাপদ দূরত্বে থাকি, কৃষ্ণকলি নাম তার, মৃত্তিকাবন্দনা, যে পথে ব্যস্ততা গেছে, ইত্যাদিসহ ১৯টি। নাটক: এবং লাঠিয়াল, মানিক বাউলের পালা, তিন একাঙ্ক, তিমির বিনাশী, কোঁচ, লড়াই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি নাটক, ফুলজান-জরিবিবি এবং নাটকসমগ্র-১। গল্প: কতিপয় দ্বন্দ্ব; যুদ্ধযাত্রা এবং অন্যান্য গল্প। উপন্যাস: শৃঙ্খল এবং চন্দ্রাবতীর নূপুর; গবেষণা: বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান, প্রগতি: শিল্পী-সাহিত্যিকের ভূমিকা, নেপথ্য-নাটক, কবিতার মায়াবন: শব্দ-শিল্প-ছন্দ প্রকরণ, মনোময় ময়মনসিংহ ইত্যাদি।

শিল্প-সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন সেলিনাবানু স্বর্ণপদক (পাবনা ১৯৯৯),  সেবাসম্মান (২০০৫), গীতিকার সম্মান (২০০৬), বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সম্মাননা ২০০৬, নেতাজী সুভাষ পদক ২০০৯ (পশ্চিমবঙ্গ), মহাদিগন্ত পুরস্কার ২০০৯ (পশ্চিমবঙ্গ), নাট্যাঙ্গন পদক ২০০৯, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব পদক ২০১০, রূপসীবাংলা পুরস্কার ২০১৩ (পশ্চিমবঙ্গ) ইত্যাদি পুরস্কার ও পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০২২), অরণি কবিতা পুরস্কার (২০২০) ইত্যাদি। 

আপনি এখন কী পড়ছেন?
পড়ার বিষয়ের কোনো অন্ত নেই; কত কিছুই না পড়তে হয়! কী পড়ছি সে তালিকা করা কঠিন, সেই কিশোর বয়স থেকে পড়ছি, সেসব পড়া আবার নতুন করে চিন্তায় এনে পড়তে হয়, প্রয়োজনে মিলিয়ে নিতে হয় বই বের করে; অনেকটা জাবর কাটার মতো। একজন পাঠক যখন পড়েন, মনের আনন্দে পড়েন, তৃপ্তির খোঁজে পড়েন; কিন্তু একজন লেখক যখন পড়েন, তখন তিনি কেবল মনের আনন্দে নয়, কখনো প্রয়োজনেও পড়েন; বিশেষ করে যখন তিনি গদ্য লেখার চেষ্টা করেন, তখন তাকে প্রয়োজনের পড়াও পড়তে হয়। ছাত্রজীবনের অত্যাবশ্যকীয় পাঠের যন্ত্রণা শেষ হলে, একজন মানুষকে না পড়লেও চলে; কিন্তু একজন লেখককে শেষ দিন পর্যন্ত পড়তেই হয়, সে পাঠে কিতাবি পড়ার বিকল্প-বৈচিত্র্যও থাকে প্রচুর। কবিতার পাশাপাশি আমাকে প্রচুর গদ্য এবং ভিন্নধারার রচনাও লিখতে হয়। সে বিবেচনায় আমাকে নিজের লেখার প্রয়োজনে নানান ধরনের বইও পড়তে হয়।

প্রায়শ নিজের আকাঙ্ক্ষার পাঠে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ থাকে না। ধরা যাক, আমি যখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পুনর্পাঠে আগ্রহী, ঠিক তখনই আমার লিখতে হচ্ছে ‘একবিংশের প্রথম দশকের বাংলা কবিতা’; আমাকে কিন্তু মানিক তুলে রেখে তরুণ কবিদের কবিতায় মনোযোগী হতে হচ্ছে। সুতরাং আমি ‘কী পড়ছি’ সে কথা আগে না বলে বলতে চাই ‘কী লিখছি’। দ্বিতীয় কথা, পড়ে পড়ে কী আর কবিতা লেখা হয়?

কবিতা তো লেখা হয়ে যায়, আর কবিতা লেখার জন্য যত না বই পড়তে হয়, তার চেয়েও বেশি পড়তে হয় জীবন-প্রকৃতি-পরিপার্শ্ব আর মানুষ; যা আমার নিত্যদিনের পাঠ। ঘর থেকে পথে বেরোলেই আমার পাঠ শুরু হয়ে যায়। প্রিয় নারীর চোখের ভাষা-হাসির ভাষা-রাগ-অভিমান সহস্রবার পড়ার পরও পুনর্বার পড়ি। পড়ায় আমার সামান্য ক্লান্তিও নেই। এবার আসি গদ্য প্রসঙ্গে, গদ্য লিখবার জন্য আমি নিত্যপাঠে রাখি ইতিহাস-পুরাণ-দর্শন আর সমাজতত্ত্ব; যা আমি একজন গদ্য-লেখকের ভিত্তি বিবেচনা করি। গদ্যের আবার দুটি ধারা, একটি তাৎক্ষণিক পাঠের বিষয়, অন্যটি দীর্ঘ প্রস্তুতির বিষয়। প্রথম ধারায় আছে, আমাকে যদি কোনো একটা বিশেষ বই নিয়ে বা ব্যক্তিকে নিয়ে লিখতে হয়, তাহলে আমার চলতি পাঠ্যসূচিতে থাকবে সেই বইটি এবং সেই ব্যক্তির বই; কিন্তু আমাকে যদি রবীন্দ্রনাথের ওপরে কিছু লিখতে হয়, মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লিখতে হয়, তখন আমার পাঠপ্রস্তুতি হবে দীর্ঘ। কতিপয় দীর্ঘস্থায়ী পাঠের কথা আমি উল্লেখ করতে চাই, যা আমি অবকাশ পেলেই পড়ি; যদিও অত্যধিক লেখার চাপে সে পাঠেও ব্যত্যয় ঘটে; যেমন ইলিয়ড, রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয় পুরাণসহ বিভিন্ন পুরাণ, জীবনানন্দ দাশ, হাদিস শরিফ, ইসলামের ইতিহাস, মহাভারত ইত্যাদি; এগুলো আমি পড়তেই থাকি।

আপনি এখন কী লিখছেন? 
অন্যান্য চাহিত লেখা এবং কবিতার বাইরে এই মুহূর্তে আমি প্রধানত দুটি বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করছি; দুটিই গবেষণামূলক রচনা; প্রথমটি ‘বাঙালির আবহমানকালের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ শিরোনামের দীর্ঘ রচনা, আর দ্বিতীয়টি ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচয়’। প্রথমটির জন্য আমার পাঠসূচিতে আছে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পুনর্পাঠ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন লেখকের গদ্য, প্রিয় কবিদের লেখা রাজনৈতিক কবিতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক যাত্রার ইতিহাস ইত্যাদি; দ্বিতীয়টির জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্নজনের রচনা এবং তাদের জীবনাচার আর সামাজিক রীতিনীতি পাঠ। দুই পাঠের চারিত্র্য এক নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন দৃষ্টিশক্তির যে অবস্থা তাতে টানা দীর্ঘপাঠ প্রায়শ অসম্ভব হয়ে পড়ে; আবার নিত্যপাঠ ছাড়া স্বপ্নপূরণের সুযোগ দেখতে পাই না। সে কারণেও কিতাবের ছোট ছোট হরফ পাঠের পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীবন পাঠের স্বস্তিকে সমন্বয় করে নিতে চাই। পাঠসূচির কথা বলতে বলব, গোগ্রাসে কবিতাপাঠ, বিশেষভাবে সমকালীন কবিদের কবিতা পড়া হয় নিয়মিত; তরুণতম কবির কবিতাও বাদ যায় না। ছাত্রদের আন্দোলন-সংগ্রাম, বিভিন্ন পেশাজীবীদের আন্দোলনও মনোযোগে পড়ি; আর পড়ি সমাজের অধপতন, মূল্যবোধ আর স্বপ্নচিন্তার ক্রম অধোগতি।

আমার লেখার প্রতিটি অনুষঙ্গকে আমি একজন লেখক হিসেবে দায় বিবেচনা করি; সঙ্গত কারণেই আমি আমার প্রতিটি লেখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চাই। বাঙালির অগ্রযাত্রার সংগ্রামে যারা বিভিন্ন সময় বুকের রক্ত দিয়েছেন; তাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর কাছে ঋণবোধ থেকেই আমি আমার লেখকজীবনের দায় স্বীকার করি প্রতিদিন; বাঙালির জীবন পাঠ করতে গিয়ে লোকবাংলার জীবন ও সংস্কৃতি অনুসন্ধন অনিবার্য হয়ে পড়ে; সে বিবেচনায় প্রায়স পাঠমগ্ন হয়ে যাই। এসব প্রিয় প্রসঙ্গে মগ্ন হতে গিয়ে হয়তো অনেক প্রসঙ্গই পাঠসীমার বাইরে থেকে যায়; বাদ পড়ে যাওয়া সেইসব প্রসঙ্গ হয়তো আপনার অথবা অন্য কারও প্রিয় প্রসঙ্গ। সঙ্গত কারণেই আপনার কাছে এবং সেই সব বন্ধুদেও কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে চাই, যাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমি ব্যর্থ হচ্ছি।

দৈনন্দিন রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে যত্নে পড়তে চাই; পড়তে চাই মুখ ও মুখোশের দ্বিচারিতা; কিন্তু কিছুতেই আমি দলান্ধ হতে চাই না। 

খবরের কাগজ সাহিত্যপাতা ‘সুবর্ণরেখা’ সমৃদ্ধ হোক- কবি হয়ে এই কামনাই রইল।

বিমল মিত্র এবং কড়ি দিয়ে কিনলাম

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ পিএম
আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ পিএম
বিমল মিত্র এবং কড়ি দিয়ে কিনলাম
বিমল মিত্র

বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় একটি ধারা আছে। সেই ধারা বহু আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ বহুল পঠিত গ্রন্থ। এটি অনুবাদগ্রন্থ হলেও ঈশ্বরচন্দ্রের নিজস্ব ভাষাশৈলীতে মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছিল। এর পরে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে এ দুটি গ্রন্থই জনপ্রিয়তার ধারার ভিত্তি শক্তভাবে স্থাপন করেছিল। এর পর আরও অনেক লেখকের উপন্যাস জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে নক্ষত্র উজ্জ্বল অগ্রগণ্য নাম। বাংলা সাহিত্যে অনেক ঔপন্যাসিকই সচেতনভাবে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির মোহে উপন্যাস রচনা করেছেন। অনেকে সফলও হয়েছেন। অনেক লেখকের উপন্যাস জনপ্রিয়তা লাভ করলেও শিল্পমূল্যে উত্তীর্ণ হতে পারেনি, গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। কালের যাত্রায় টিকতে পারেনি। আবার অনেক লেখকের উপন্যাস ব্যাপকভাবে যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। কালের যাত্রায় অমরত্ব পেয়েছে। এই জায়গাটিতে বিমল মিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম।…

বিমল মিত্রের উপন্যাস যেমন অবিশ্বাস্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, একই সঙ্গে অসামান্য শিল্পকর্মের মর্যাদাও লাভ করেছে। এটা সবার কপালে জোটে না। সবাই অর্জন করতে পারেন না। বিমল মিত্র (১৮ মার্চ ১৯১২-২ ডিসেম্বর ১৯৯১) পেরেছেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি যে হালকা বা চটুল হিসেবে দেখা হতো, তাকে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাহিত্য-শিল্পকর্মে যাদের অসামান্য অবদান রয়েছে, বিমল মিত্র নামটি সেখানে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।

তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক। কর্মজীবনে তিনি রেলে চাকরি করতেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘ছাই’। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাস তার অন্যতম গ্রন্থ। একসময় রেলের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার উপন্যাসগুলো মধ্যে রয়েছে- কড়ি দিয়ে কিনলাম, চাই, প্রিয় সাথী, একক দশক শতক, সাহেব বিবি গোলাম, বেগম মেরী বিশ্বাস, চলো কলকাতা, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ, এরই নাম সংসার, মালা দেওয়া নেওয়া, তোমরা দুজনে মিলে, গুলমোহর, আসামী হাজির ইত্যাদি।

বিমল মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। দুই খণ্ডের সুবৃহৎ উপন্যাস এটি।  উপন্যাসটির পরতে পরতে জীবনের চরম কঠিন রূঢ় বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। উপন্যাসটির মূল চরিত্র দীপঙ্কর সেন। এ ছাড়া অসংখ্য চরিত্র রয়েছে উপন্যাসটিতে। সতী, লক্ষ্মী, অঘোর ভট্টাচার্য, ছিটে, ফোঁটাসহ অসংখ্য চরিত্র গড়ে উঠেছে দেশ-কাল-সমাজ-সমকালের ভিত্তিতে। 

দিপুর বাবা মারা যান ডাকাতের হাতে। এ কারণে অভাব-অনটনের শিকার হয় তাদের সংসার। মা-সহ আশ্রয় হয় অঘোর দাদুর বাড়িতে। সেখানে মাকে রান্না ও ঘরসংসারের কাজ করতে হয়। অঘোর দাদু নিজের নাতিদের পছন্দ করত না। খেতেও দিত না। বরং তার বাড়িতে এলে লাঠি দিয়ে তাড়া করত। কিন্তু দিপুর মা অঘোর দাদুর আড়ালে তাদের খাবার দিত। তারা খেয়ে পালিয়ে যেত। অঘোর দাদু দিপুকে ভালোবাসলেও তা কখনোই বুঝতে দিত না।

দিপুর মধ্যে সবচয়ে বড় পরিবর্তন আসে সমবয়সী সতী ও লক্ষ্মী দুই বোনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে। বিশেষ করে অঘোর দাদুর বাড়িতে তারা ভাড়াটিয়া হয়ে আসার পর। হৃদয়গত চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে, যা একরকম প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এর মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। দেশের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দুর্ভিক্ষ-মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভয়াবহ এক অবস্থার শিকার হয় দেশের পরিস্থিতি। এর ভেতর দিয়েই দিপু একদিন বড় হয়ে ওঠে- দিপু হয়ে ওঠে দীপঙ্কর সেন। অর্থবিত্তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে দীপঙ্কর সেন। রেল কোম্পানির বড় সাহেব হয়ে ওঠে।  অথচ নিজের ভেতর দীপঙ্কর কেমন যেন একাই থেকে যায়। শুধু সর্বসংহার মতো সবকিছু সয়ে গেছে নীরবে। লক্ষ্মী বয়সে বড় হওয়ার কারণে তাকে ‘লক্ষ্মীদি’ ডাকত। সতীকে গভীরভাবে ভালোলাগলেও তা কখনোই বলা হয়নি। কারণ সবসময়ই নিজের নিজস্বতাকে ধারণ করে চলতে চেয়েছে দীপঙ্কর। এবং চলেছেও। নিজের নিজস্বতাকে বাঁচাতে গিয়ে তাকে হারাতে হয়েছে অনেক কিছু। নিজেকে কখনই সে প্রকাশ করেনি। দুঃখ-কষ্ট নিজের ভেতরেই গোপন করেছে। দীপঙ্কর সবসময়ই মানুষের উপকার করেছে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থেকেছে। তবুও তার কাছের মানুষগুলো সবসময়ই দূরে সরে গেছে। এই কষ্ট সে নীরবে সহ্য করেছে, ভেতরে ভেতরে সে নিতান্তই একা, নিঃসঙ্গ।

‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসে সাধারণ মানুষের যাপিতজীবন ও তাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। কেন এই যুদ্ধ, কেন এই শত্রুতা- এসব প্রশ্ন তাদের। তারা জার্মানি, ইতালি, আমেরিকা, জাপান দেখেনি। তারা বুঝতে পারে না জার্মানি কেন তাদের শত্রু, আমেরিকাই বা কেন তাদের বন্ধু। তারা তো শুধু প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ আর প্রাণঘাতী মৃত্যু দেখেছে। তারা দেখেছে কীভাবে লুণ্ঠিত হয় বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও। দীপঙ্কর মনে করে এসবের জন্য দায়ী আমেরিকার ডলার, ইংল্যান্ডের পাউন্ড, ইতালির লিরা, জার্মানির মার্ক, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জাপানের ইয়েন, আর ইন্ডিয়ার টাকা। দীপঙ্কর কখনো হতাশ না হলেও, একসময় সংসার ত্যাগী হয়ে পড়ে। তার পরও আশাটা সে ধরে রাখে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সত্যিকারের মানুষ সে পাবেই- এই আশা তার ভেতর তীব্রতর হয়ে বেঁচে থাকে। কড়ি দিয়ে পৃথিবীতে হয়তো সব কেনা যায়, কিন্তু মনুষ্যত্ব কি কেনা যায়! যায় না। সেই সত্য এই উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ কড়ি দিয়ে সবকিছু কেনা সম্ভব নয়।

ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ কয়েকটি দিক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৬ পিএম
আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৬ পিএম
ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ কয়েকটি দিক
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ করেন কান্তি চন্দ্র ঘোষ, তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছিলেন: ‘তোমার তর্জ্জমা পড়ে আমার একটা কথা বিশেষ করে মনে উঠেচে। সে হচ্ছে এই যে বাংলা কাব্যে ভাষার শক্তি এখন এত বেড়ে উঠেচে যে, অন্য ভাষার কাব্যের লীলা অংশও এ-ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। মূল কাব্যের এই রস-লীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধূর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্চে...’।

ওমর খৈয়াম পারস্যের এক বিস্ময়কর কবি। তিনি মূলত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, গ্রহ-নক্ষত্র বিশারদ, বীজগণিতের সূত্র আবিষ্কারক। তিনি তার অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন কবি হিসেবে। তার কবিতার মধ্যে সমকালীন সময় ও সমাজ, প্রিয়ার বিরহ ও মিলন, প্রকৃতি ও বসন্তের রূপ, অদৃষ্ট বা নিয়তির প্রতি শ্লেষ, ভণ্ড বা বকধার্মিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ধর্ম-শাস্ত্রবিরুদ্ধ কবিতা, সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা অন্যতম। তার রুবাইয়ের মধ্যে এমন এক দার্শনিক প্রজ্ঞা রয়েছে যা প্রগতিশীল মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তার সৃষ্টি করেছে। তার প্রশ্ন ছিল আমি কে, আমি কোথায় ছিলাম, কেন এই পৃথিবীতে এসেছি, শুধুই আসা-যাওয়া না কি তার পরে আবার কিছু আছে। কোনো কোনো দার্শনিকের মতে, জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য। উপনিষদের বাণীর সঙ্গে খৈয়ামের মতের অনেক মিল রয়েছে। আবার অমিলও রয়েছে। যে কয়দিন বাঁচ সাকি ও শরাবের মধ্যে ডুবে থাক। কারণ, একদিন সবাইকে মাটিতে মিশে যেতে হবে, এর কোনো অন্যথা হবে না। 

ইংরেজ কবি ফিটজেরল্ড সাহেবের কল্যাণে ওমর খৈয়ামের নাম সারা বিশ্বে পরিচিত। তার ‘রোবাইয়াত’ বা ‘রুবাইয়াৎ’ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তিনি জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি গ্রহতত্ত্ব ও গ্রহ-নক্ষত্র, গণিতশাস্ত্র, জড়বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন বলে জানতে পারা যায়। ওমর খৈয়ামের আরেকটি বিশেষ পরিচিতি নাস্তিক হিসেবে। কারণ তার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মমত সম্পর্কে এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। তার অধিকাংশ রুবাই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রচলিত ধর্মবিধির প্রতি তার অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা ছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীন চিন্তার পক্ষপাতী। সত্যের সন্ধানে তিনি প্রচলিত শাস্ত্র-নির্দিষ্ট পথ পরিহার করেছিলেন। সুফিদের রহস্যময় সাধন-পথেরও পরিপন্থি ছিলেন, যা তার রুবাইগুলোর মধ্যে দেখা যায়। তার রচনার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মতত্ত্বের নিগূঢ় পরিচয়ের মধ্যে প্রচলিত ধর্মমত শাস্ত্রবিদ বা যাজক পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তীব্র কটাক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি চার্বাক মতের অনুসারী, এপিকিউরিয়ান বা জড়বাদী ও দেহাত্মবাদী। অনেকেই মনে করেন তার রুবাইয়ের মধ্যে সুরা ও সাকির রূপকের মধ্যেই রয়েছে অরূপের সন্ধান। তিনি তার দেশের যুক্তিহীন অসার ধর্ম ও মিথ্যা উপাসনার ভণ্ডামি কখনো সহ্য করেননি।

রোবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন: ‘এ কবিতার জন্ম হৃদয়ে নয়, মস্তিষ্কে। ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত। তিনি সারা-জীবন চর্চা করেছিলেন শুধু বিজ্ঞানের, কাব্যের নয়। অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতিষে তিনি সেকালের সর্ব্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত ছিলেন। এই জ্ঞান-চর্চার অবসরে গুটিকয়েক চতুষ্পদী রচনা করেন, এবং সেই চতুষ্পদী কটিই তার সমগ্র কাব্যগ্রন্থ।’

ওমর খৈয়ামের কবিতা প্রথমে ইউরোপের মানুষের কাছে নতুন পথের সন্ধান দেয়। যখন খ্রিষ্টান পাদ্রিদের কথামতো সবকিছু পরিচালিত হতো। ওমর খৈয়ামের আবির্ভাব সেকালের সমাজের মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার কাব্যে সম্পূর্ণ নতুন দার্শনিক কথা। প্রায় প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু ওমর সবকিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন, এসব মিথ্যে আর মানুষের মনগড়া কল্পনা মাত্র। একথা বলার পর ওমরকে নানা রকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরীর মতে, ওমরের সব কবিতার ভিতর দিয়ে যা ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে মানুষের মনের চিরন্তন এবং সব চাইতে বড় প্রশ্ন: ‘কোথায় ছিলাম, কেনই আসা, এই কথাটা জানতে চাই/ যাত্রা পুনঃ কোন লোকেতে’? এই প্রশ্নের জবাবে ওমর খৈয়াম বলেন: ‘সব ক্ষণিকের, আসল ফাঁকি, সত্য মিথ্যা কিছুই নাই।’ ওমর যে সেকালের মুসলমান সমাজে উপেক্ষিত হয়েছিলেন, এবং একালের ইউরোপীয় সমাজে আদৃত হয়েছেন, তার কারণ এই জবাব। যারা মুসলমান ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে এ মত শুধু অগ্রাহ্য নয়- একেবারে অসহ্য; কেননা এ কথা ধর্ম মাত্রেরই মূলে কুঠারাঘাত করে। অপরপক্ষে এ বাণী মেনে নেওয়ার জন্য এ যুগের ইউরোপের মন সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ইউরোপের মন একান্ত বিজ্ঞান-চর্চার ফলে, খ্রিষ্টধর্মের ওপর তার প্রাচীন বিশ্বাস হারিয়ে বসেছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে কোনো নতুন বিশ্বাস খুঁজে পাইনি। সুতারাং, ওমরের কবিতায় বতমান ইউরোপ তার নিজের মনের ছবিই দেখতে পেয়েছিল। 

কাজী নজরুল ইসলাম ফার্সি জানতেন। তিনি ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’-এর অনেকটা ভাবানুবাদ করেছেন। তিনি ভূমিকায় লিখেছেন: ওমরকে তাঁর কাব্য পড়ে যারা Epicurean বলে অভিহিত করেন, তাঁরা পূর্ণ সত্য বলেন না। ওমর খৈয়ামের কবিতা বা রুবাইয়ের মধ্যেকার বিষয়গুলির মধ্যে এক গভীর দর্শন নিহিত রয়েছে। তাঁর অভিযোগ অদৃষ্টের প্রতি। কবি মনে করেন, এই পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ এক অসহায় জীব। তার এমন কি এমন, অপরাধ যার জন্য তাঁকে পাপ-পুণ্যের সাজা ভোগ করতে হবে। মানুষের প্রচলিত ধারণা মানুষ ইন্দ্রিয় বা রিপু দ্বারা পরিচালিত হয়ে পাপ অথবা পুণ্য করে। তাই ওমরের প্রশ্ন, গর্তে বোঝাই করে পাপ রেখে মানুষের অসহায় অবস্থার প্রতি খেলা বিধাতার এ কোন খেলা। তিনি মনে করেন মানুষের প্রতি ঈশ্বরের একরকম অবিচার। তাই ওমরের জিজ্ঞাসা :

মানব সৃজন ক’রলে দিয়ে মৃত্তিকাতে পাপের ছাপ,/ ...মানুষ তোমায় ক’রছে ক্ষমা- তুমিও দেব, ক্ষমিও তায়! 

অন্য একটি রুবাইয়ে, ভাগ্যে বা অদৃষ্টে যা আছে তা হবেই, তার বিরুদ্ধে যাওয়াটা বোকামি। কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি শরাব সাকি ত্যাগ করতে পারবেন না। নগদ যা পাওয়া যায় তার পরিবর্তে ধারে স্বর্গ কিনতে তিনি নারাজ। তার কাছে মানুষের জীবনের সার্থকতা প্রেমে। ‘সেই নিরালা পাতায়-ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,/ খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!’ তার কাছে তাই প্রিয়ার সান্নিধ্য, এক পেয়ালা সুরা, একটি কবিতার বই পেলেই তিনি স্বর্গে যেতে ইচ্ছক নন। খৈয়ামের চিন্তাধারা তাই বাস্তববাদী মানুষের একান্ত প্রিয়। ধর্মশাস্ত্র নিয়ে যারা বেশি মাতামাতি করেন তিনি তাদের নিরেট মূর্খ বলে অভিহিত করেছেন। মানুষের জীবনকে উপভোগ করার যে বার্তা তিনি তার রুবাইয়ের মধ্যে দিয়েছেন, যার মর্ম পাশ্চাত্যের মানুষ অনুধাবন করেছে। ওমরের নিকট সব ধর্মের উপাসনা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের কাছে মনে হয়, ওমরের দর্শন পৃথিবীর অগনিত মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ওমরের কাছে একটি কবিতার বই, একটুকরো রুটি, শারাব আর সাকি হলেই আর স্বর্গ প্রয়োজন নেই। ওমরের জীবন-দর্শনের মূল সুর মূলত এটি।

রূপার জন্য

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪২ পিএম
রূপার জন্য
অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রূপা চলে গেছে। রূপা আমার স্ত্রী। কোথায় গেছে বলে যায়নি। একটা চিঠিও লিখে যায়নি।

ছ’বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। কোনোদিন এমনটা হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। আমিই কোথাও চলে গেছি ওকে কিছু না বলে। আবার হঠাৎ করেই একদিন ফিরে এসেছি। রূপা কোনোদিন কিছু বলেনি।

রূপাকে প্রথম দেখেছিলাম শুভদৃষ্টির সময়। তার আগে কখনো ওকে দেখার প্রয়োজন হয়নি। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও ওর নিষ্পলক চোখ দুটো দেখছিলাম। তার পর কীভাবে যেন ছয় বছর পার হয়ে গেল।

ছ’ছ-টা বসন্ত পেরিয়ে গেল রূপার সঙ্গে। অথচ আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। রূপার এ ব্যাপারেও কোনো ক্ষোভ নেই আমার বিরুদ্ধে। রূপা কখনো বলেনি, চলো একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। আমিও বলিনি কখনো।

ঘরে রান্নার কিছু নেই, বাজারে যেতে হবে, রূপা কখনো ধমক দিয়ে আমার হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দেয়নি। বলেনি, ‘ঝটপট বাজারটা নিয়ে এসো তো। সঙ্গে একটু মাছও এনো। অনেকদিন ইলিশ খাওয়া হয় না। শুনেছি এখন দামটা একটু কমেছে।’

বরং রূপা নিজেই সবকিছু করে। বাজার-হাট সবকিছু। আমাকে কিছুই করতে হয় না।
রূপার মতন একটা মেয়ে পেয়েছি বলেই হয়তো আমি এতটা নিশ্চিন্ত! কিন্তু কোথায় যেতে পারে রূপা? রূপার তো কেউ নেই আমি ছাড়া!

ছোটবেলা ওর মা মারা গেছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। রূপার মামারাও রূপাকে তেমন ভালোবাসে না। এ ছাড়া তো রূপার আর কেউ নেই! আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ না!

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই চা নিয়ে হাজির হতো রূপা। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আসত। পাশেই ঠাকুর ঘর থেকে ধুপের গন্ধটা ভেসে আসত। আমি চোখ বুজে একবার সেই গন্ধটা নিতাম। তার পর রূপার হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিতাম। ততক্ষণে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিত রূপা। সকালের নরম রোদের আলো বারান্দা পেরিয়ে এ ঘরে ঢুকত। সেই সঙ্গে প্রচুর টাটকা অক্সিজেন। আমার গোটা শরীর সকালের মিষ্টি হওয়ায় কেঁপে উঠত। রূপা সেটা বুঝতে পারত। তাই প্রিয় নীল শালটা কখন যে আলতো করে জড়িয়ে দিত আমার গায়ে।

আমাদের বিয়ের পর প্রথমবার রূপার সঙ্গে যখন দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তখনই রূপা পছন্দ করে আমার জন্য শালটা কিনেছিল। রূপার পছন্দের অনেককিছুই আমার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন- নীল রংটা আমার ভীষণ পছন্দের। রূপা নীল রঙের শাল কিনল। সঙ্গে একটা সোয়েটার আর মাফলার। সেটাও নীল রঙের। সব আমার জন্য। রূপা বলেছিল, ওগুলো পরলে নাকি আমাকে ভালো মানাবে। বুঝেছিলাম, রূপা আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে।

বাড়ি ফিরে এসে হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে, রূপার জন্য তো কিছুই কেনা হলো না?

রূপা এরকমই। কখনো নিজের জন্য কিছু ভাবে না। কোনোকিছু মুখ ফুটে চায়ও না। যেন আমার কাছে ওর কোনো দাবি নেই!
আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রূপা নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছি। কিন্তু চা দেওয়ার কেউ নেই। সারা রাত ঘরটা বন্ধ থাকায় বাতাসগুলো ভারী হয়ে উঠেছে। অক্সিজেনের অভাবে কেমন যেন দম আটকে আসছে। অথচ দরজাগুলো খুলে দেওয়ার কেউ নেই। এতক্ষণে বোধহয় বাইরে রোদ উঠে পড়েছে। সকালের টাটকা বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢোকার জন্য ছটফট করছে। তবু পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেওয়ার কেউ নেই। ঠাকুর ঘর থেকে আজ কোনো ধুপের গন্ধ আসছে না।
কোথায় যে গেল রূপা? এত সকালে তো না বলে কোথাও বেরোয় না ও!

বিছানা ছেড়ে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রূপা নেই। তাহলে কি ফুল তুলতে গিয়ে এত দেরি হচ্ছে?

পর্দা সরিয়ে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিলাম। এই প্রথম আমি একা নিজের হাতে জানালাগুলো খুললাম। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে এসে ঢুকল। সকালের মিষ্টি বাতাস গোটা শরীরে দোলা দিয়ে গেল। সেই সঙ্গে অল্প অল্প শীত অনুভবও হলো। গায়ে কিছু একটা জড়ানো দরকার। কিন্তু আমার নীল শালটা কোথায়? সেটাও তো রূপা জানে। আমি তো ওসব নিয়ে ভাবিনা কখনো!

সেই সময়ই মাথাটা ধরে এল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার অভ্যেস বরাবরের। কিন্তু আজ রূপা নেই। তাই চা খাওয়াও হয়নি। মাথাটা যেন জাঁকিয়ে কামড়ে ধরছে।

একবার ভাবলাম বাইরে দোকান থেকে গিয়ে চা খেয়ে আসি। কিন্তু রূপার কথা মনে পড়ল আবার। দোকানের চা একদম পছন্দ করে না রূপা। জানলে রাগ করবে ভীষণ। যদিও রূপাকে কখনো রেগে যেতে দেখিনি আমি। রূপা আমার সঙ্গে কখনো রেগে কথা বলেনি কোনোদিন!

এই প্রথম রান্নাঘরে ঢুকলাম আমি। রূপার সবকিছুই সাজানো-গোছানো। চায়ের কেটলি, চিনি, চা-পাতা সব হাতের কাছেই রাখা ছিল। রূপাই হয়তো সব রেখে গেছে গুছিয়ে। আমি গ্যাস জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিলাম। দোকানে বসে বেশ কয়েকবার রতনকে চা বানাতে দেখেছি।

এককাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে বেলা বাড়ছে। সেই সঙ্গে রোদের তাপও চড়া হচ্ছে ক্রমশ। এতো দেরি করছে কেন রূপা?

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে নাক-মুখ থেকে জল বের করে ফেললাম। চিনি হয়নি, লিকারটাও বেশি পড়ে গেছে। প্রথমবার নিজের হাতে চা বানিয়ে খাচ্ছি। ভুল তো একটু হতেই পারে! মনকে সান্ত্বনা দিলাম। তার পর প্রায় চোখ বন্ধ করেই বাধ্য ছেলের মতো বাকিটা গিললাম।

ঘড়ি ধরে ঠিক নয়টায় স্নান সারলাম। নীল পাঞ্জাবিটা চেয়ারের ওপরেই রাখা ছিল। পরে নিলাম। এই পাঞ্জাবিটাও রূপার দেওয়া। আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে।

মনে আছে, সেদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। দেখি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে রূপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপা নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। নীল রঙের শাড়ি পরলে রূপাকে অন্যরকম দেখায়। কেমন যেন অন্য মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা। ওকে দেখে হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল, আজ তো তাড়াতাড়ি ফিরব বলে কথা দিয়েছিলাম রূপাকে। বলেছিলাম, সন্ধ্যাটা দুজনে একসঙ্গে কাটাব। বাইরে কোথাও ঘুরব-ফিরব, খাওয়া-দাওয়া করব। সব বেমালুম ভুলে বসে আছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল রূপার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, রূপা আমার কাছে বিন্দুমাত্র অভিযোগ জানাল না। জানতে চাইল না, কেন ফিরতে এতো দেরি হলো? কেন কথা দিয়েও ওকে অপেক্ষায় রাখলাম এতক্ষণ?

রূপা শুধু আমাকে নীল পাঞ্জাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ফ্রেস হয়ে পরে নাও। তার পর রান্না ঘরে ফিরে গেছিল নিজের মতো করে।

আজ সেই নীল পাঞ্জারিটা পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে একবার তাকাই। খুব কি খারাপ লাগছে? জানি না। রূপা থাকলে হয়তো বলতে পারত।

চোখ গেল টেবিলের ওপরে রাখা আমার আর রূপার ছবিটার দিকে। ওটাও সেবার দার্জিলিংয়ে তোলা। ম্যালে। রূপাই জোর করে পাশে দাঁড়িয়ে তুলেছিল। সেই প্রথম আমরা দুজনে ক্যামেরার সামনে। তার পর আর কোনো ছবি তুলিনি ওর সঙ্গে। রূপাও আবদার করেনি কখনো। আমিও না।

ঠিক দশটায় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ছুটে গেলাম বারান্দার দিকে। ভাবলাম, রূপা এসেছে নিশ্চই। দরজা খুলে দেখলাম রূপা কোথায়, অল্প বয়সী ছেলেটা দুধের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হলাম। ছেলেটি বোধহয় আরও বেশি। মনে মনে ভাবলাম, এই রোজ দুধ দিয়ে যায় এ বাড়িতে? ছেলেটি চলে যেতেই ফিরে এলাম ঘরে।

সকাল থেকে এখন এত বেলা হয়ে গেছে পেটে কিছুই পড়েনি। খিদেয় ভেতরে ভতরে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। মনে হলো, খিদে পেলে এতটা কষ্ট হয় আগে কখনো তো অনুভব করিনি! রূপা কখনো সেই সুযোগই দেয়নি। এতক্ষণে ঠিক গুণে গুণে তিনটে রুটি, সবজি, আর একটা ডিম সিদ্ধ বানিয়ে এনে দিত।

এত দেরি করছে কেন রূপা? তবে কি ফুল তুলে বাজারে গেছে? একবারে বাজারটা সেরে বাড়ি ফিরবে?

রূপার কাছে কোনো ফোন নেই। তাই ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়ও নেই। এ ব্যাপারেও অবশ্য রূপার কোনো অভিযোগ নেই। রূপা কখনো মোবাইল চায়নি। আমিও কিনে দিইনি ওকে।

আচ্ছা, কোন বাজারটায় যায় রূপা? চৌমাথার রাস্তা পেরিয়ে সেই সকালের বাজারটায়? নাকি স্টেশনের ওদিকের সবজি বাজার? আজ কী বার? রূপা কি একবারে বাজার করে বিকেলের হাট সেরে তবে বাড়ি ফিরবে? কিন্তু কাল রাতেও তো রূপা তেমনটা কিছু জানায়নি। আমারও অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

একবার মনে হলো, এগিয়ে দেখি। খুঁজে আনি রূপাকে। আবার মনে হলো, কোন বাজারে খুঁজব ওকে? যদি বাজারে না গিয়ে অন্য কোনো কাজে? আর আমি খুঁজতে বেরিয়ে, এদিকে যদি রূপা ফিরে আসে। তাহলে তো ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে। আমাকে না পেয়ে তো আরও দুশ্চিন্তায় পড়বে রূপা।

এসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই কী খেয়াল, একবার ফ্রিজটা খুলে দেখলাম। রূপা হয়তো কিছু খাবার রেখে গেছে আমার জন্য। খিদেটাকে আর বাগে আনতে পারছি না। মাথাটাও ধরে আসছে। শরীরটাও কেমন জানি ছেড়ে দিচ্ছি ভেতর থেকে।

ফ্রিজ খুলে সত্যি সত্যি কিছু খাবার পেয়ে গেলাম। সত্যি রূপা সব গুছিয়ে রেখে গেছে আমার জন্য। একদম তৈরি খাবার। গোগ্রাসে সেগুলো গিললাম। খিদের আগুন নিভল। মনে মনে ভাবলাম, যাক এবেলা তো পেরিয়ে গেল। ওবেলায় না হয় কিছু একটা ব্যবস্থা হবে ঠিক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই রূপা ফিরে আসবে কাজ সেরে।

দুপুরের পর হঠাৎ করেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। চারদিক কালো করে আবহাওয়াটা হঠাৎ বেশ খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই রূপার কথা মনে পড়ল আবার। রূপা কি ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে? বৃষ্টির জল ওর একদম সহ্য হয় না। অল্পতেই ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দি। রূপা নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজবে না। ও খুব বুদ্ধিমান। হয়তো কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে। অপেক্ষা করবে। তার পর বৃষ্টি কমলে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরবে।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমার চোখ তখন সেই বৃষ্টি ছাপিয়ে বকুল গাছটার দিকে। কেমন থমকে গেলাম হঠাৎ। দুটো শালিক পাশাপাশি বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। আবার একে অপরের গায়ে ঠোঁট দিয়ে জল সরিয়ে দিচ্ছে। ওরা নিশ্চই প্রেমিক-প্রেমিকা। কত সুখ ওদের!

হঠাৎ রূপার জন্য মনটা কেমন করে উঠল। এই প্রথম খুব একা একা লাগল। মনে হলো, একা থাকতে একদম ভালো লাগছে না। এখনই এক দৌড়ে ছুটে যাই রূপার কাছে। তার পর দুজনে সারা দিন পাশাপাশি বসে বৃষ্টি দেখি। একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটি।

একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে আমার সারা শরীরে জল ছিটিয়ে দিয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম। হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগল। গা-টাও বেশ গরম গরম হয়ে আসছে। মনে হলো জ্বর আসবে।

বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলাম। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে বিছানার চাদরটাই গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ততক্ষণে শীতে আমার শরীর ভীষণ কাঁপছে। কিছুতেই যেন কাঁপুনিটাকে থামাতে পারছি না। বিছানার সঙ্গে নিজেকে জাপটে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

রূপা থাকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাকে মোটা চাদরে জড়িয়ে নিত। তাতেও কাঁপুনি না থামলে আমাকে ওর নিজের শরীর দিয়ে জড়িয়ে নিত। কাঁপুনি একটু থামলে নিশ্চয়ই ডাক্তারখানা নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত।

রূপা নেই। আমি অসহায়ের মতো বিছানায় পড়ে রইলাম। আমার জ্বর বাড়ছে। সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আমার মাথাটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। চোখটাও ঝাপসা হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

ঠিক কখন যে ঘুম থেকে উঠেছি মনে নেই। হুঁশ ফিরতেই দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার গায়ে মোটা চাদর। এখন আর জ্বর নেই। মাথাটাও বেশ হালকা লাগছে।

পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। বৃষ্টি কখন যে থেমে গেছে। মেঘ সরে বাইরে এখন রোদ ঝলমল করছে। বকুল গাছটা থেকে দুটো শালিক উড়ে গেল এই মাত্র।

তখনই রূপা এল। হাতে এককাপ চা নিয়ে। কাপটা টেবিলে রেখে আমার গা-ঘেঁষে বসল। তার পর ওর হাতটা আমার কপালে রাখল। রূপার হাতটা ভীষণ নরম। ওর নরম হাত দিয়ে আমার মাথাটা বুলিয়ে দিল।

রূপাকে কাছে পেয়ে আর জানতে চাওয়া হলো না, ‘কোথায় গিয়েছিলে? ফিরতে এত দেরি হলো কেন?’

সুবর্ণরেখা

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৯ পিএম
সুবর্ণরেখা

পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যে শুধু পুতুল। কোন অদৃশ্য হাতের সুতার টানাপোড়েনে নাচে, কাঁদে কথা বলে।... যে সীমাহীন নীড় প্রেমের স্বপ্ন দেখেছিল শশী, সে স্বপ্ন তার চুরমান হয়ে গেল কেন?... ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ এই বিপর্যস্ত জীবন্ত পুতুলদের হাসিকান্নার মর্মান্তিক অভিনয় আর তাদের প্রেরণাহীন যান্ত্রিক জীবনের ব্যর্থতার ইতিহাস। আবার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘...ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’… উজ্জ্বল নক্ষত্রের এক লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সমাজ ও সাহিত্যের মধ্যকার নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারটি কেউই অস্বীকার করতে পারে না। সমাজ পরিবর্তনের নানান সূত্র ধরে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয় সাহিত্যের রূপ ও মাধ্যম; তৈরি হয় নতুন নতুন ক্যানভাস। সময় ও সমাজের বিবর্তনের এক বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের জন্ম। বাংলা উপন্যাসের অভিযাত্রার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু উপন্যাসধর্মী রচনা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ভিত রচনা করলেও এ মাধ্যমের সৌন্দর্য সাধিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) হাত ধরে। পরবর্তীকালে এ ধারার বিকাশে মেধা-মনন ও শ্রম বিনিয়োগ করেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।...