পর্ব: ০৯
চারু রত্নার কথাগুলো গোগ্রাসে গিলছিল। তার ভেতরটা হঠাৎ ফাগুন বাতাসে উড়ে যাওয়া শিমুলের মতো পলকা হয়ে ওঠে। সে ভাবে, এই পৃথিবীতে তার জন্ম একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়নি। সেও এ সমাজের জন্য, এ পৃথিবীর জন্য কিছু করতে পারে, কিছু করে নিজেও অর্থে আর বিত্তে নিজের স্থান করে নিতে পারে। তার মনে এ সময় হঠাৎ প্রশ্ন জাগে, রত্না তাকে এসব বলছে কেন? এ জন্যই কি তাকে এখানে ডেকে এনেছে সে? আর সে তো এক গ্রামীণ মেয়ে, এমন শিক্ষকের মতো বক্তৃতা শিখল কোথায়?
রত্না চারুর অস্থিরতা টের পেয়ে যায়। চারু প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দেয়,
-হ্যাঁ। আমাকে তোমাকে বোঝানোর জন্যই পাঠানো হয়েছে। আর আগেই বলেছি রূপচর্চা আর কথার চর্চা এ দুটিই আমি পেশা হিসেবে নিয়েছি। আমি নিজে স্বল্পশিক্ষিত। কিন্তু আমাদের এই ঘরাণার তাহজিব আর তমদ্দুন, সাজ আর সজ্জা আমি শিখেছি আর এখন তোমাদের মতো নতুনদের শিখাই। যদি আমার পেশায় আসো ভালো, যদি সংগীত আর নৃত্যে কি পার্লারে যেতে চাও আরও বহু উস্তাদ পাবে। কি বলো তুমি?
চারু কিছু বলে না। শুধু তার আবারও মনে হয়, তার জীবনের একটি উপলক্ষ এখানেই সে খুঁজে নেবে। আবার নিজের ভেতরে কি একটি শঙ্কা কী উৎকণ্ঠা টের পায় যা কিছুতেই বলবার মতো করে গুছিয়ে আনতে পারে না।
রত্না ঠাঁয় তাকিয়ে থাকে। ভাবে মাসিমার অর্পিত দায়িত্ব সে যথাযথ পালন করেছে। চারুকে পল্লির জীবন, জীবনের ভবিষ্যৎ কৌশলে বলা হয়ে গেছে। এখন তাকে মনের মতো করে সাজাবে সে। তার পর দুজন মিলে পল্লির প্রান্তরে সন্ধ্যা-আধাঁরে হাওয়া খেতে বের হবে। তার পর তাই হবে তার ওপর যা হয়েছিল দুবছর আগে- একথা ভাবতেই রত্নার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। না, এ কিছুতেই সে হতে দেবে না। তাকে যে তার ভালো লেগে গিয়েছে! কিন্তু কি করবে, কীভাবে চারুকে রক্ষা করবে তার এখনো কোনো কিনারা করতে পারেনি সে।
পরের কাজ পরে হবে, মনকে এতটুকু সান্ত্বনা দিয়ে চারুর সাজে মন দেয় সে। বলে, চলো, তোমাকে আমার মনের মতো করে সাজাই। তুমি চাইলে সাজানোর এ বিদ্যাটাও পেশা হিসেবে নিতে পার।
চারু আবেগে মথিত হয়ে পড়ে। শুধু বলতে পারে, চলো।
সাজঘরের স্নানাগারটি বিশাল। ওপরে পানির ঝরণা, নিচে একপাশে বাথটাব আর দেয়ালের কুলুঙ্গিতে থরে থরে সাজানো অঙ্গরাগ।
চারুকে ঝরনার নিচে দাঁড় করাল রত্না। ঝুনা নামের মিহিন মসলিনে আবৃত করল তার কুমারী শরীর। পরনের কাপড়গুলো একে একে গা থেকে খসিয়ে দিল তার পর। তার পর সুক্ষ মসলিনের আড়ালে রত্নার দেখা সবচেয়ে সুন্দরীর দেহকে আবিষ্কার করল তার দুই চোখ।
ঝরনার আতপ্ত জল সেই দেহে গড়িয়ে পড়লে মসৃণ মসলিন লেপ্টে গেল চারুর দেহের কারুকার্যে। অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু রুমের জানালা গলে সেই দেহের ওপর চুম্বনে, মেহনে অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে দিল। একঠায় তাকিয়ে থাকল রত্না। তার মন বলে উঠল, সুন্দর; কিন্তু করিৎকর্মা হাত দুটি সহসা চারুর পরিচ্ছদ সজ্জায় ব্যস্ত হলো।
কামিনি বুকের ওপর সোনার রঙের কাঁচুলি পরিয়ে দিল রত্না; তার পর মাথার চুলে দিল টরসেল, পরনে পরাল চুড়িদার পাজামার ওপর লাস্যময়ী ঘাঘরা। হাতে-পায়ে অলক্ত রঙে রঙিন করতে করতে উত্তর ভারতীয় এক ক্লাসিক্যাল রাগ গুনগুন করে গেল রত্না। চারু তার কিছুই বুঝল না, কিন্তু তার মনে হলো এমন সাজের সময় এমন গান না হলে সমস্ত সাজসজ্জা বুঝি-বা অপূর্ণ থাকত।
পরিধান পর্ব অসমাপ্ত রেখে রত্না চারুর পায়ে গুরবাক নামের নূপুর, হাতে রতনচুড় আর কানে বেরেলি বাজার থেকে আনা ঝুমকো পরিয়ে দিল। সবশেষে শরীরজুড়ে থাকল কারচুপি নামের নয়নাভিরাম পোশাক আর মুখে অতি সূক্ষ্ম নেকাব- আবরোঁয়া।
স্মিত হেসে চারুকে বলল, তোমার আবরোঁয়া তোলো সজনী, দেখে আমার নয়ন সার্থক করি। চারু কিছুই করল না, বা বলল না। কিন্তু আসন্ন সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে নিজের হাতে সাজানো এই আনমল রতন দর্শনে রত্নার চোখ-মন-হৃদয় এক অজানিত পুলকে ‘কেমন করিয়া উঠিল’।
বাইরের পৃথিবীতে ততক্ষণে সূর্যশেষ গোধূলী ছড়িয়েছে। চারুকে নিয়ে রত্না প্রান্তরের নির্জনতায় বেরিয়ে এল। চারুর চলার পথে নূপুরের নিক্কন ব্যতিত আশপাশের সব শব্দ নিভে গেছে। সদ্য পরিচিতা দুই বন্ধু যেন-বা কত কত দিনের পুরনো সইয়ের মতো হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগল। প্রান্তরের লিলুয়া বাতস দুই কাঞ্চন কামিনীর অঙ্গ ঘিরে খেলতে লাগল অনুক্ষণ।
এমন সময়, এমন সম্মোহন মন্ত্রমুগ্ধ সময়ে রত্না পাশের গাছের আড়ালে একজনের অস্তিত্ব অনুভব করে। একটি ছায়া সরে গেল হঠাৎ। হঠাৎ রত্নাকে জড়িয়ে ধরে চারু, বলে, ওখানে কেউ একজন আছে। রত্না মুখে কিছুই বলে না, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আমি কিছুতেই তা হতে দেব না, আমার ওপর যা হয়েছিল দু-বছর আগে তা আজ কিছুতেই না।
কিন্তু বরাবরের মতো ‘কীভাবে এ কিছুতেই হতে দেবে না’ -এ ষোড়শবর্ষীয়া মেয়েটি সন্ধ্যা-অন্ধকারে তখনো ভেবে উঠতে পারছিল না।
দুজন আহিস্থা আহিস্থা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অদূরে নয়নহারা নদী কলরবে বয়ে চলেছে। ওপরে সন্ধ্যাতারা জেগে উঠেছে। আপনার মনে আপনি বিভোল চারু নিজের সৌন্দর্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। চপলা হরিণীর মতো চঞ্চল পায়ে পথ চলছিল সে। পথ চলতে গিয়ে রত্নার পরিয়ে দেওয়া তার নূপুরের নিক্কন ঝিল্লিমন্দ্রিত সন্ধ্যায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। চারু ভাবল, পৃথিবীটা এত সুন্দর এতদিন কেন জানা ছিল না!
কিন্তু রত্নার ছোট্ট মস্তিষ্কের ভাবনাজুড়ে চিন্তার কিলবিল, কীভাবে সে এমন মোহন সুন্দরকে রক্ষা করবে ঘৃণিত অসুন্দরের কবল থেকে, কীভাবে!
-আজ চান্নি পসর রাইত।
চারুর কথায় রত্নার চিন্তা ভেঙে চুর হয়।
-কী বললে?
-বলছি, আজ চান্নি পসর রাইতে দেখো কেমন চন্দ্রিমা উঠেছে আকাশে।
-আমি দেখছি ভূমিতে ওঠা চন্দ্রিমাকে।
কিছু বুঝতে না পেরে অবাক তাকিয়ে থাকে চারু। আকাশে ওঠা রুপার থালার মতো চাঁদখানি বেদনার্ত আলো বিলিয়ে যায়। সেই চাঁদের জোছনায় একটি মানব ছায়ার নড়াচড়া লক্ষ্য করে রত্না। তার পর হঠাৎ চারুর হাত ধরে ত্রস্তে সামনে এগিয়ে যায়।
-তুমি। তুমিই হচ্ছ পৃথিবীর জমিতে ওঠা চন্দ্র। তুমি কি জানো, তুমি চাঁদের চেয়ে সুন্দর!
চারু কিছু বলে না, সে আগেও রত্নার মুখে এমন কথা শুনেছে। হঠাৎ এক বৃষ্টিবিস্নাত শ্রাবণ সন্ধ্যার কথা তার মনে পড়ে। মনে পড়ে, সেদিন নিস্তব্ধ আকাশের নিচে যৌবনের প্রথম প্রস্ফুটনে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিল সে। যৌবনের প্রথম সে আবিষ্কারের আস্বাদ কোনো মেয়ে কি ভুলতে পারে? পেরেছে কোথাও! কিন্তু আজ এতদিন পরে দ্বিতীয় কারও কাছে তার সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনে সন্ধ্যা অন্ধকারের মধ্যেও তার চোখে-মুখে রঙের বান ডেকে যায়।
-বলেছে তোমাকে! চাঁদ তো চাঁদই। আমি চারু। দুজনের নামের শুরুতে চ আকার আছে বটে, আর কোনো মিল আছে কি?
এখন নদীর একবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। রত্নার মনে হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় ধরে যায়। এই সেই এলাকা যেখানে আজ থেকে দু-বছর আগে এমন এক সন্ধ্যা অন্ধকারে তার ওপর আক্রমণ নেমে এসেছিল এ সময়। এদিকে এতক্ষণ আড়ালে আড়ালে হাঁটতে থাকা মানুষের ছায়াটি প্রলম্বিত হয়ে তাদের গায়ে এসে পড়ে। অনতিদূরে সেই মানবরূপী পশুকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে দুজন।
-আপু পালাও।
-না।
আক্রমনোদ্যত পশুটি হঠাৎ থমকে যায়, পিছিয়ে যায়। পিছিয়ে যেতে যেতে দেখে, রত্নার পেলব অধর দুটি চারুর ঠোটে নেমে এসেছে।
পশ্চাদপসারণরত জানোয়ারের চোখমুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হতে থাকে। আর মুখ দিয়ে বের হয় জঘন্য এক গালি-
-লেসবিয়ান!
এক দিন পর সমস্ত কিছু অন্যরকম হয়ে গেল।
সকাল, চারু টানা বারান্দার দাওয়ায় বসে উদাস তাকিয়ে ছিল। কিন্তু ভরা বর্ষায় কে না জানে বাংলার সকালগুলো বিকেল কী সন্ধ্যার মতো, তেমনি মরা বিকেলের এক চিলতে মরা আলো উঠানের রক্ত গোলাপের ফাঁক দিয়ে চারুর পায়ে এসে লুটিয়ে পড়েছিল। চারুর অবসন্ন মন একবার গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোয় আবার আসন্ন সন্ধ্যায় বোয়ালভাসা নদীর ফেলে আসা তীরে বিচরণ করতে লাগল। ছোটোবেলার সেই দিনগুলো!
এমন সময় তিনি এলেন। মাসি। চারু পরে জেনেছিল, তার নাম মামনি চৌধূরী। কিন্তু মাসি নামের আড়ালে তার আসল নাম কবে হারিয়ে গেছে তিনি নিজেও জানতেন না। সেই মাসি এসে বসলেন চারুর পাশে, অবসন্ন আলোর আঁচলের ওপর।
-এখন কেমন আছ, চারু?
চারু কী বলবে, কী বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। তার পর কী ভেবে বললো, ভালো।
-ভালো তো থাকতেই হবে। তুমি ভালো না থাকলে আমরা এখানে থেকে লাভ কী।
গতকালের ঘটনা, ঘটনার পরম্পরা বিদ্যুচ্চমকের মতো চারুর মনে পড়ে যাচ্ছিল। নয়নহারা নদীর তীর থেকে দুই বন্ধুতে কীভাবে ফিরে এসেছিল চারু মনে করতে পারল না কিছুতেই। শুধু জানে, দুজনে জান নিয়ে, ইজ্জত নিয়ে কোনোমতে ফিরে এসেছিল। আরও জানে, রত্না তাকে জোর করে চুমু খাওয়ায় সে লোকটি মনে করেছিল তারা সমকামী; ঘৃণায়, ক্ষোভে ফিরে গিয়েছিল সে। নইলে এতক্ষণে সম্ভ্রমহারা অন্য দশটি মেয়ের একজনে পরিণত হতো চারু!
চলবে...