হুমায়ূন আহমেদ। নাম একটি, সত্তা তার অনেক। শিক্ষক, কথাশিল্পী, কবি, গীতিকার, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, পর্যটক, ম্যাজিশিয়ান, বৃক্ষপ্রেমী, লোকঐতিহ্যের প্রবল অনুরাগী। কী নন তিনি? একের মধ্যে অনেক। তুখোড় আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। আড্ডা জমাতে তার জুড়ি ছিল না। যেকোনো আড্ডায় অতি অবশ্যই মধ্যমণি থাকতেন। লেখালেখির মতোই আনন্দঘন, সুস্বাদু উপভোগ্য ছিল তার রসালো কথাবার্তা, নাট্যিক উপস্থাপনা গুণ। ব্যঙ্গনৈপুণ্য, কৌতুকপরয়াণতা ছিল দারুণ উপভোগের বিষয়। লোকজনকে হাসানোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন ওস্তাদ।…
১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের শুভ জন্মদিন। খবরের কাগজ-এর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। মৃত্যু আমেরিকায়, ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। আক্রান্ত হয়েছিলেন কোলন ক্যানসারে। তার স্বপ্ন ছিল, মাতৃভূমিতে বিশ্বমানের একটি ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার। দুর্ভাগ্য, আজও সেটা পূরণ হয়নি। হতে পারত নিশ্চয়ই। মাত্র ৬৪ বছরের আয়ুষ্কালে তার রচিত গ্রন্থাবলি তিন শতাধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই স্বেচ্ছা অবসর নেন। নিয়ে ব্যাপৃত হন পূর্ণকালীন লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে।
ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন খুব। দেশে এবং বিদেশে। দলবেঁধে হইহল্লা করে ঘুরতেন। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষটি সেন্টমার্টিনে বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেই সময়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাতায়াত আজকালের মতো এতটা সহজগম্য ছিল না। সেখানেও সব সময় যেতেন দলবল নিয়ে। নিজের বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘সমুদ্র বিলাস’। তার এলিফ্যান্ট রোডের ফ্ল্যাটে দেখেছি অনেকগুলো লাইফ বোট জমিয়ে রাখা। ভ্রমণের সময় যেগুলো বেশ দরকার হয়। বঙ্গোপসাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সময় সমুদ্র উত্তাল থাকলে তা মোকাবিলা করার জন্য লাগে এই লাইফ বোট।
তিনি ছিলেন আশ্চর্য লেখক। তার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, তা ছিল কিংবদন্তির মতো। বাংলা একাডেমিতে একুশের বইমেলায় তার অটোগ্রাফসহ বই কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত। ভিড়ের চাপ সামলানোর জন্য মেলা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে পুলিশের সাহায্য নিতে হতো। এমন অভিনব দৃশ্য দেখা গেছে বছরের পর বছর। তার পাঠকপ্রিয়তা এখনো পর্যন্ত অতুলনীয়।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা শিশু-কিশোর গ্রন্থাবলির সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয়। সে তালিকাটির দিকে একটু চোখ বুলানো যাক। প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- তোমাদের জন্য ভালোবাসা, সূর্যের দিন, পুতুল, বোতল ভূত, ভূত ভূতং ভূতৌ, আমার ছেলেবেলা, নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ, পিপলী বেগম, এ কী কাণ্ড, তারা তিনজন, বোকাভূত, পরীর মেয়ে মেঘবতী, চেরাগের দৈত্য এবং বাবলু, তোমাদের জন্য রূপকথা, কানী ডাইনী, ছোটদের জন্য এক ব্যাগ হুমায়ূন, বোকা রাজার সোনার সিংহাসন, টগর এন্ড জেরী, ব্যাঙ কন্যা এলেং, কাক ও কাঠগোলাম, তিনি ও সে, নীল হাতি, হিমু মামা, মজার ভূত, ছেলেটা, কুহু রানী, মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ, হলুদ পরী, বনের রাজা, ভূতমন্ত্র, রাক্ষস খোক্কস এবং ভোক্কস।
কেন এত পাঠকপ্রিয় হতে পেরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ? কী সেই রহস্য? আসলে রহস্য তেমন কিছু না। অত্যন্ত মেধাবী মানুষ ছিলেন তিনি। তার ভাষা ছিল খুব সহজ, সাবলীল। অসাধারণ এক গল্প বলিয়ে ছিলেন তিনি। মানুষের মনের ভিতরের নিভৃত কথাটি তিনি নিপুণ, নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতে পারতেন। সেই গল্প যেমন নাটকীয়, তেমনি রহস্যমণ্ডিত। কিশোরদের জন্য যেসব লেখালেখি করেছেন, তার মধ্যে আমরা যেমন বিজ্ঞানমনস্কতার দেখা পাই, তেমনি পাই ফ্যান্টাসি, রূপকথার ব্লেন্ডিংও। শিশু মনস্তত্ত্ব তিনি ভালো বুঝতেন, অননুকরণীয় মুনশিয়ানায় তা হাজির করতেন পাঠকসমীপে।
কৌতুক তার লেখার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। গদ্য তার সুললিত, নদীর স্রোতের মতো স্বচ্ছন্দে বয়ে চলে। তরতর করে এগিয়ে যায় কাহিনি, বাঁক নেয় কল্পনার বাইরে, পড়া শেষ না করে ওঠা পর্যন্ত পাঠকের স্বস্তি বিরতি নেই। সুতরাং কিশোরসাহিত্য শুধু শিশু-কিশোরদেরই টানে না, বড়দের জন্যও তা উপভোগ্য হয়ে ওঠে অনায়াসে। এ দেশের সায়েন্স ফিকশন লিখিয়ে যারা অগ্রণী ও পথিকৃৎ, তিনি তাদের অন্যতম।
উনিশ শ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহিদ বাবাকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের মর্মস্পর্শী একটা লেখা রয়েছে। সেটা এখানে উদ্ধৃত করি।
লেখাটির শিরোনাম ‘আমার বাবার জুতা’।
“আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তাঁর পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত, কারণ আমাদের প্রায়ই তাঁর জুতা কালি করতে হতো। কাজটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। জুতার কালির গন্ধটা খুব মজা লাগত। আবার ব্রাশ ঘষতে ঘষতে জুতা যখন ঝকঝকে হয়ে উঠত, তখন দেখতে ভালো লাগত। সবচেয়ে বড় কথা, ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে।’ এই বাক্যটি শুনতেও বড় ভালো লাগত।
১৯৭১ সালের ৫ মে আমার বাবা তাঁর লাল জুতা পরে বরিশালের গোয়ারেখো গ্রাম থেকে বের হলেন। সেদিন জুতা জোড়া কালি করে দিল আমার ছোট বোন। বাবা যথারীতি বললেন, ‘আরে বাপ রে এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছিস দেখি।’ সেই তাঁর জুতা পরে শেষ বের হয়ে যাওয়া।
সন্ধ্যার সময় খবর এল, বলেশ্বর নদের তীরে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মানুষকে যে এত সহজে মেরে ফেলা যায়, তা আমার মা তখনো জানতেন না। তিনি খবরটা বিশ্বাস করলেন না। তিনি আমাদের ডেকে বললেন, তোরা এই লোকগুলোর কথা বিশ্বাস করিস না। তোর বাবা সারা জীবনে কোনো পাপ করেনি। এ রকম মৃত্যু তাঁর হতে পারে না। তোর বাবা অবশ্যই বেঁচে আছেন। যেখানেই থাকুন তিনি যেন সুস্থ থাকেন, এই দোয়া কর। আমি জানি তোর বাবার সঙ্গে তোদের আবার দেখা হবে, অবশ্যই হবে।
একজনের বিশ্বাস অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা সবাই মায়ের কথা বিশ্বাস করলাম। এর মধ্যে মা এক রাতে স্বপ্নেও দেখলেন, মিলিটারিরা বাবাকে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে সেখানের এক জেলে আটকে রেখেছে। বাবা স্বপ্নে মাকে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলেই এরা আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই কদিন একটু কষ্ট করে থাকো।’
মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছুই খেতে পারতেন না। এই স্বপ্নের পর আবার অল্পস্বল্প খেতে শুরু করলেন। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম স্বাধীনতার দিনটির জন্য। আমরাও মায়ের মতোই ধরে নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন হলেই বাবাকে পাওয়া যাবে। মায়ের প্রতি আমাদের এই অবিচল বিশ্বাসের কারণও আছে। আমার মা কখনোই তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনো ভুল আশ্বাস দেননি।
আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে আছি। মে মাস প্রায় শেষ হতে চলছে। ঘোর বর্ষা। দিনের পর দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন অদ্ভুত একটা খবর পাওয়া গেল। এক লোক নাকি বলেশ্বর নদ দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা লাশ তুলে কবর দিয়েছে। তার ধারণা, এটা পিরোজপুরের পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদের লাশ। সে লাশটা কবর দিয়েছে, তবে প্রমাণের জন্য লাশের পা থেকে জুতা জোড়া খুলে রেখেছে। এই জুতা জোড়া সে আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার মা বললেন, অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কারও জুতা। তবু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আমাকে জুতা আনতে শহরে পাঠালেন। আমাকে পাঠানোর কারণ হলো, আমার মায়ের ধারণা, আমি খুব ভাগ্যবান ছেলে। আমি কখনো অমঙ্গলের খবর আনব না।
মিলিটারিতে তখন পিরোজপুর গিজগিজ করছে। এ অবস্থায় কোনো যুবক ছেলের শহরে ঢোকা মানে জীবন হাতে নিয়ে ঢোকা। তার ওপর শুনেছি, মিলিটারিরা আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমি শহরে গেলাম লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি মাথায় দিয়ে। যেন কেউ চিনতে না পারে। ওই লোককে খুঁজে বের করলাম। আমাকে জুতা জোড়া দেওয়া হলো। হ্যাঁ, আমার বাবারই জুতা। ভুল হওয়ার কোনোই কারণ নেই। জুতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। আমার মা জুতা দেখলেন, তিনিও বুঝলেন এটা কার জুতা, তার পরও বিশ্বাস করলেন না। এক রকম জুতা তো কত মানুষেরই থাকতে পারে। তিনি আমাদের বললেন, জুতা দেখে তোরা মন খারাপ করিস না। এটা মোটেই কোনো জোরালো প্রমাণ না। জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে এক কোনায় রেখে দেওয়া হলো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর মা ঢাকা থেকে পিরোজপুর গেলেন। নদীর পাড়ে যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচে গলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর তিনি স্বীকার করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই।
তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন, আমাদের যে এত দিন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি অসুস্থ। সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। মা আমার ছোট ভাইকে বললেন, তাকে যেন বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা হয়।
সন্ধ্যাবেলা মা কাগজের মোড়ক থেকে জুতা জোড়া বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে পরিষ্কার করলেন। লাল কালি কিনে এনে জুতা কালি করা হলো। আমরা দেখলাম, তাঁর বিছানায় বালিশের পাশে জুতা জোড়া রাখা হয়েছে। সেই রাতে তিনি বাবার জুতা জোড়া জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুতে গেলেন।
আজকের এই মহা-আনন্দের দিনে আমি আপনাদের আমার একটি ব্যক্তিগত কষ্টের গল্প বললাম। আমার এই কষ্ট যেন আপনাদের আনন্দকে কোনোভাবেই ছোট না করে। আজকের দিনে কষ্টের কোনো স্থান নেই। আমার বাবা এই দেশকে ভালোবেসেছিলেন। আমিও বাসি। অবশ্যই আমার ছেলেমেয়েরাও বাসবে। আজকের দিনে এই ভালোবাসাই সত্য, আর সব মিথ্যা।
প্রতিবছর বিজয় দিবস আসে, আমি নিজের হাতে বাসায় একটা পতাকা টানাই। পতাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগে। আমার কী সৌভাগ্য, স্বাধীন দেশের পতাকা নিজের হাতে ওড়াচ্ছি।
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।”