হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যে মূলত ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বস্ত্রসংকট, দেশভাগ এবং দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, সামরিকতন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে বাঙালির জাতীয় জীবনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে ঘটে যাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সব পরিবর্তনকেই তিনি তার কথাসাহিত্যের বিষয় করেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যের শিল্পমানেও নতুন মাত্রা যোগ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।…
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে ছোটগল্পকার হিসেবে বিখ্যাত হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১)। তিনি আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ রচনা করে শক্তিমান ঔপন্যাসিক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার গল্পগ্রন্থ- ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’ ইত্যাদি। তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ সাহিত্যে এক স্বতন্ত্রধারা তৈরি করতে সক্ষম হন। তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’, ‘অপ্রকাশের ভার’, ‘অতলের আঁধি’।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে দেশভাগ। এটা হতে পারে তার ব্যক্তিগত কষ্টবোধের কারণেও। কারণ, তিনি রাঢ়বঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন। তিনি এই বেদনা সারা জীবন গভীরভাবে বহন করেছেন। যা তার সাহিত্যের বড় একটা অংশ বিভিন্নভাবে এই গভীর বেদনাবোধজুড়ে আছে। সেই সময়কালে অধিকাংশ লেখকের রচনাতেই দেশভাগ বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছিল। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে দেশভাগের কষ্ট বেদনায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। দেশভাগের মাধ্যমে বাঙালির বিভাজন কোনো বাঙালিই মানতে পারেনি। হাসান আজিজুল হক সেই গভীর বেদনাবোধ থেকেই রচনা করেছেন ‘খাঁচা’সহ দেশভাগের বেদনাজারিত অসংখ্য গল্প। বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ ও বাংলাভাগ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে, যেখানে শেকড় ছিন্ন হওয়ার ক্ষতবিক্ষত আর্তিও প্রকাশ ঘটেছে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন ছিল রাজনৈতিক সীমানার পরিবর্তন এবং অন্যান্য সম্পদের বিভাজন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ-শাসনের বিলুপ্তি এবং এবং দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। এতে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফলে, বাংলা ভাগ হয়ে যায়।
পশ্চিমবাংলা, আসাম, ওড়িশাকে ভারতের সঙ্গে রাখা হয়। পূর্ববাংলাকে আলাদা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে ভারত যেমন ভাগ হয়ে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়, বাংলাও তেমনি খণ্ডিত হয়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। ভারত-বিভক্তির ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে এবং দুই দেশের মধ্যে অভূতপূর্ব স্থানান্তর ঘটে। শরণার্থীদের মধ্যে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল যে, সহধর্মবাদীদের মধ্যে নিরাপত্তা রয়েছে।
মুসলমানরা পাকিস্তানকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা মনে করেছিল। অর, হিন্দু সম্প্রদায় মনে করেছিল, ভারত তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই বিশ্বাসে ভর করে প্রায় ১৪ মিলিয়ন থেকে ১৮ মিলিয়ন মানুষ স্থানান্তরিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। দেশভাগের সময় অতিরিক্ত মৃত্যুর হার সাধারণত প্রায় ১ মিলিয়ন ছিল বলে অনুমান করা হয়। বিভাজনের সহিংস প্রকৃতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতা ও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা তাদের সম্পর্ককে আজও প্রভাবিত করে।
বাংলাভাগের কারণে পূর্ববাংলা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু বাঙালি পশ্চিম বাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছে। পশ্চিমবাংলা থেকেও অনেক মুসলমান পূর্ববাংলায় স্থান্তরিত হয়েছিল। বাংলা খণ্ডন কোনো বাঙালিই স্বাভবিকভাবে গ্রহণ করেননি। নিজের দেশ, বাপদাদার ভিটে কেউই ত্যাগ করতে চাননি। এই ত্যাগ করতে তাদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। যে যন্ত্রণা-বেদনা সারা জীবন তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
‘খাঁচা’ গল্পে মূলত ভারত-বিভাগের পর পূর্ববঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের ভারতের এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে বাড়ি বদল করার চেষ্টা, যেটাকে বিনিময়ও বলা হতো- এই ব্যাপারটি এবং এর ব্যর্থতার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পে উঠে এসেছে শেকড় ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের আর্তি, আর্থসামাজিক অবস্থা, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যময় পরিবারের করুণ চিত্র।
‘খাঁচা’ গল্পে একটি পরিবার আছে- সেখানে অম্বুজাক্ষ (ডাকনাম হীরণ), তার স্ত্রী সরোজিনী, বাবা কালীপ্রসন্ন, সন্তান সূর্য, অরুণ, বরুণ, কমল, ভ্যাবলা আছে। এদের ঘিরেই গল্পটি গড়ে উঠেছে। এদের প্রতিদিনের জীবন-জীবিকা, দেশত্যাগের মানসিক অবস্থা, সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, দারিদ্র্যের জঙ্গুলে ঘরবাড়ি, সাপের বসবাস এবং সাপকে দেবতামান্য- এসবই গল্পের মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের মুসলমান পরিবারের এ দেশে চলে আসার ব্যাপারটি। দেশভাগের পরে এটিই ঘটেছে। পূর্ববঙ্গ থেকে বহু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে গেছে, ভারত থেকে অনেক মুসলমান পরিবার পূর্ববঙ্গে চলে এসেছে। অনেকে যেতে চয়েও যায়নি। অনেকে আবার শেকড় ধরেই নিজের বাপদাদার ভিটেয় এ দেশেই থেকে গেছেন। তখনকার বাস্তবতা ছিল এরকমই। এই গল্পের মূল ব্যাপারটিও তাই।
দেশভাগ মানুষের মনে যে গভীর বেদনা ও ক্ষত তৈরি করেছিল, সেই বিষয়টিই ‘খাঁচা’ গল্পের মূল উপজীব্য। এ কথাও প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, হাসান আজিজুল হক ব্যক্তিগতভাবেও দেশভাগের শিকার। সেই বেদনা তিনিও ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছেন। ‘খাঁচা’ গল্পে তিনি সেই কষ্ট-যন্ত্রণা উগরে দিয়েছেন। তিনি অসাধারণ দক্ষতায় চরিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন। সংলাপগুলো যথোপযুক্ত হয়েছে। সেই সমাজ-সমকাল ও অর্থনৈতিক অবস্থা যথার্থভাবে তুলে ধরে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। শিল্পমানেও গল্পটি উচ্চমার্গের। বিশেষ করে ভাষার মুনশিয়ানায় তার দক্ষতা অসামান্য। দেশভাগের কষ্ট সেটা অনুভবের না হয়ে তিনি যেন চিত্রকল্পের মাধ্যমে জীবন্ত করে চোখের সামনে একখানা ছবি করে দেখিয়েছেন। দেশভাগের কষ্ট-যন্ত্রণা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, স্বপ্নভঙ্গ চোখের সামনে স্পষ্টতর- এমন চিত্র তিনি অসামান্য দক্ষতায় নির্মাণ করেছেন। যে কারণে ‘খাঁচা’ গল্পটি কালের যাত্রায় স্থায়ী চিহ্নিত শিল্পকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে, যেখানে নিহিত রয়েছে বাঙালির করুণ এক ইতিহাস, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা।