এই প্রণয়! চলো, আর্টস ক্যাফেটেরিয়ায় বসি! রাবার ব্যান্ড খুলে ছড়ানো চুলগুলো বুকের সামনে এনে রাখে ঘর্মাক্ত মিতা। সহপাঠী প্রণয়কে কাছে ডাকল। অনার্স তৃতীয় বর্ষে অর্থনীতি বিষয়ে পড়ছে ওরা।
গ্রীষ্মের দাবদাহের দুপুর। কলা ভবনের গাছগুলো যেন নড়ছে না! ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ থমাস রবার্ট ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি তত্ত্বের ওপর রাজিয়া ম্যাডাম লেকচার দিচ্ছেন কদিন ধরে। ইনকোর্স পরীক্ষার জন্য নোট করতে হবে। তাই লাইব্রেরি ওয়ার্ক প্রয়োজন মিতার! এ জন্য প্রণয়ের সহযোগিতারও দরকার। আজকে তিনটে ক্লাস। সকালে ও কিছুক্ষণ আগে দুটো হয়ে গেছে। বাকিটা ২টা ১৫ মিনিটে। বাকি ক্লাসটার ফাঁকা সময়ে মিতার জোর অনুরোধ। পীড়াপীড়িতে প্রণয়ও ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকে।
সৌম্য ছেলে প্রণয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মেধাবী ছাত্র। ক্লাস শেষে সোজা হলে ফিরবে। ক্লাসমেট মিতাদের বাসা ইস্কাটনে। গল্পবাজ মিতা। ক্লাস শেষে ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুম, বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, রোকেয়া হল এবং সূর্যসেন হলে ও পদধূলি দেবেই। ক্লাস না থাকলেও ক্যাম্পাসে ওর আসা চাই। আড্ডা না হলে ওর যেন জীবন চলে না! ক্যাম্পাস থেকে মিতার বাসায় ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়!
ও যত ওকে এড়িয়ে যেতে চায় প্রণয়ের প্রতি মিতার আগ্রহ তত বাড়ে। ক্যাফেটেরিয়ায় একটা টেবিলে সামনাসামনি ওরা বসল। টোকেন দিল ক্যান্টিন বয় সুরুজের হাতে।
-চারটা সমুচা আর দুটা চা নিয়ে আয় তো পিচ্চি? খাবারের অর্ডার দিল মিতা। দুই বছর আগে থেকেই প্রণয়ের পিছু নিয়েছে। ওর পরিবার সম্পর্কে মিতার জানার আগ্রহ বেশ। বিষয়টি প্রণয় এড়িয়ে যাওয়ায় ওর কৌতূহল বেড়ে যায়! মনে মনে মিতা আজ প্রতিজ্ঞা করেছে প্রণয়ের ভাইবোন কজন তা জেনেই ছাড়বে। পড়ার বিষয় ছাড়া প্রণয় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। মিতার পারিবারিক বিষয়ে ও কখনো জানতে চাইনি। ওর এতগুলো ভাইবোন! কীভাবে বলবে কথাটা! সংখ্যাটি বলায় প্রণয়ের বেশি অনাগ্রহ। নাছোড়বান্দা মিতা।
সমুচা মুখে কামড় দিতে দিতে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করল-
-তোমরা কয় ভাইবোন এখনো বললে না প্রণয়! তোমার সঙ্গে এত কথা হয়। তুমি বিষয়টি এড়িয়ে যাও কেন?
-বিষয়টি থাক না! মিহি গলায় প্রণয়ের উত্তর।
ছয় বোন ও চার ভাইয়ের কথা এতদিন সংকোচে বলা হয়নি। ছয় সংখ্যাটি আস্তে এবং চার অক্ষরটি সশব্দে বলে প্রণয়। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নেয় সে।
-মাত্র!
মিতার শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক কচ্ছপের মতো মাথা বের করে প্রণয়। বেশ দ্রুতভাবে বলল-
-তোমার! তোমার!
-আমরা ১৩ বোন এক ভাই।
আলাপ সেরে ওরা কলা ভবনের দিকে রওনা দেয়।
বাকি ক্লাস শেষে লাইব্রেরি ওয়ার্ক। তা সেরে বিকেলে রোকেয়া হলে ঢুকল মিতা। ও অ্যাটাচড এ হলে। প্রশাসনিক কাজে এখানে আসতে হয়। তাছাড়া ক্লাসমেট পাঁচজন এ নিবাসের আবাসিক ছাত্রী। এর মধ্যে লুবনা ও শিবানীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা মিতার বেশি। দুজন একেই কক্ষে থাকে।
লুবনার মাধ্যমে প্রণয়ের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরুর দুই মাস পর মিতার প্রথম কথা হয়। প্রথম পরিচয়ের কথা মিতার মনে পড়ে গেল। স্পষ্ট মনে আছে ওর। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। শীত পড়তে শুরু করেছে সবেমাত্র। সকালে ক্লাস ছিল। বান্ধবী লুবনা আধুনিক তাত্ত্বিক একটি চ্যাম্পটার প্রণয়ের কাছে ভালোভাবে জেনেছিল! সে কারণে ওর প্রতি লুবনা কৃতজ্ঞ ছিল। সেটা মিতাও জানে। সেদিন দুটি ক্লাস ছিল ওদের। ওইদিন প্রণয় ভুলে সেমিনার রুমে ওর নোট খাতা রেখে যায়! লুবনার কাছে বিষয়টি খারাপ লাগে। মিতাকে লুবনা বলল- চল ওর হলে খাতাটা পৌঁছে দিয়ে আসি।
-তুই উনার রুম নম্বর জানিস?
-সূর্যসেন হল। কক্ষ নম্বর ৩৪৮
সে সময় হলেই ছিল প্রণয়। দুটি টিউশনি করে। সে জন্য আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছিল রুম থেকে বের হওয়ার। অতিথি লুবনার খবর পেয়ে গেস্ট রুমে নেমে আসে সে।
-প্রণয়, ওকে তো চেনো? ওর নাম মাহমুদা শারমীন মিতা! বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে মিতাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লুবনা! মাথা নেড়ে স্বাগত জানিয়ে মৃদুস্বরে প্রণয় বলে- আচ্ছা।
হলের গেস্ট রুমে কিছুক্ষণ সময় কাটায় ওরা! মিতার পছন্দের রং গোলাপি। সাক্ষাতের প্রথম দিন প্রণয় গোলাপি রঙের গেঞ্জি পরেছিল! ভালো ছাত্র, নিরহংকারী এবং ব্যক্তিত্ববান ছেলে হিসেবে প্রথম দিনেই শাকিল আখতার প্রণয়কে মিতার ভালো লেগে যায়। এর পর থেকে মিতা কারণে-অকারণে প্রণয়ের সান্নিধ্য পেতে চেয়েছে। আজও ক্যাফেটেরিয়ায় ওকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে করছিল। বান্ধবীর হয়ে শিবানী প্রণয়ের কাছে ওকে এড়িয়ে চলার ব্যাপারটা জেনেছে!
প্রণয়ের অনেক ভাইবোন। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে বিবর্ণ প্রণয়ের মধ্যে অতিরিক্ত সংখ্যাভীতি কাজ করে! যেচে কথা বলা ওর স্বভাব নয়। এ ব্যাপারে লজ্জাবোধ কাজ করে ওর মধ্যে। প্রণয় পরিবারের প্রায় সবাই বৃত্তি ও টিউশনি করে পড়ালেখা করে। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু ভাববার সময় নেই তার। প্রণয়ের দর্শন হলো প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য জীবনের মূল গন্তব্য। তা অর্জিত হলে সময়মতো সব নৈকট্য লাভ করে। সময়ের প্রয়োজনে সব সম্পন্ন হয়। ‘টাইম উইল টেল দ্য রিয়েলিটি।’ জীবন সম্পর্কে প্রণয়ের এই উপলব্ধি শিবানীকে চিন্তামগ্ন করেছিল সেদিন! শিবানী মিতাকে প্রণয়ের কথাগুলো বলেছে। মিতা তা শুনে তো অবাক!
নানা ভাবনা নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে এল মিতা। ওকে লুবনা এগিয়ে দিল টিএসসির ডাস কর্নার অবধি। এ সময় দুজনের আলোচনায় স্থান পেল প্রণয় প্রসঙ্গ। মিতাই তুলল আজকের ক্যাফেটেরিয়ায় ওদের আলোচনার বিষয়টি।
-জানিস লুবনা আমাদের মতো ওদেরও ভাইবোন বেশি! তবে আমরা সংখ্যায় চারজন বেশি!
লুবনা হেসে উঠে বলে
-তাহলে প্রণয়ের সঙ্গে তো মিলেই গেল?
-আরে না! ওর সঙ্গে সব মিল কী আর হয়? তবে আমাদের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় ওরা অনেক এগিয়ে। প্রায় সবাই ওরা মেধাবী। সেও চৌকস।
-একটা জায়গায় তোদের বৈপরীত্য আছে!
-কী সেটা?
রাজিয়া আপা জনসংখ্যা তত্ত্বের ক্লাসে যা পড়াচ্ছেন তাতে দেখছি দুই পরিবারেই নেই। রীতিমতো জনবিস্ফোরণ! ম্যাডাম বলেন, দেশ উন্নয়নে জনরোধের বিকল্প নেই।
প্রগলভা মিতা। সপ্রতিভ হয়ে বলল-
-ম্যালথাস তো তাই বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সরকারিভাবে এখন জোরদার হয়েছে। আমাদের মা-বাবাদের আমলে কনট্রাসেপ্টির অত ব্যবহার ছিল না! বলা চলে, সমাজ ও সংসারে এন্টারটেইনমেন্ট ছিল সীমিত! সংসারে অভাব ছিল। কষ্টার্জিত উপার্জন। দাম্পত্য জীবনে বিনোদন মানেই স্বামী-স্ত্রীর গোপন ভালোবাসা! জিহ্বা বের করে দাঁতে দাঁত চেপে ডান হাত মাথায় রাখে লুবনা। কাঁপানো ঠোঁটে অট্টহাসিতে গড়াগড়ি যায় সে।
-থাম থাম! ও আল্লারে! আর বলিস না! একটু থেমে আবার বলল-
-সে কারণেই লজ্জায় চুপসে থাকে প্রণয়! সংসারে অধিক সদস্য সংখ্যাভীতি ওর মধ্যে কাজ করে!
-কই আমার তো তা নেই!
-তুইও তো প্রথম প্রথম বিষয়টা এড়িয়ে যেতি!
ক্লাসে প্রণয়কে নিয়ে রাজিয়া আপার রসিকতা করার দৃশ্যটার কথা মনে এল মিতার। জন্মরহস্যের প্রসঙ্গটি এল ম্যাডামের লেকচারে সেদিন। লাজুক প্রণয় অন্যমনস্ক ছিল। রাজিয়া ম্যাডাম তা খেয়াল করলেন। প্রণয়কে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলেন। ম্যাডামের প্রশ্ন প্রণয়কে।
-এই ছেলে বুঝেছ? প্রাণীদের জন্মরহস্য জানো?
-না ম্যাডাম! প্রণয়ের এমন উত্তরে ক্লাসে উপস্থিত অনেকেই বিস্মিত হয়ে যায়! আপা ধমকের সুরে প্রণয়ের উদ্দেশে বললেন, আজকে বিয়ে করিয়ে দাও না কালই সে বাবা হয়ে যাবে!
তখন তো ঠিকই বুঝবে বাবা সন্তান উৎপাদন প্রণালি। রাজিয়া ম্যাডামের এমন উত্তরে ক্লাসে হাসির রোল পড়ে। বেশ লজ্জা পেয়ে যায় প্রণয়। বিষয়টি মিতাকে বেশ ভাবায় অনেকদিন। এত বড়ো ছেলে কিছুই জানে না! আসলেই প্রণয় একজন চরিত্রবান তরুণ।
বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ থেকে আসরের আজান শোনা যাচ্ছে। লুবনা ও মিতা দুজনেই ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকে। রিকশা ডেকে সিটে বসে মিতা। লুবনা রুমে গিয়ে নামাজ পড়বে। তাই দেরি না করে বিদায় দিল মিতাকে। তাড়াহুড়ায় বলল-
-সাবধানে যাস মিতা! আমি গেলাম।
রিকশার হুট টেনে তুলল মিতা। সিগন্যালের লাল বাতির কারণে শাহবাগ মোড়ে এসে রিকশাটি থামে।
মনে করল ক্যাফেটেরিয়ায় নোট দেখানোর ছলে প্রণয়ের হাত স্পর্শের মুহূর্তটুকু। কী নিবিড় শিহরণ। সুখের দোলা! কি নিরামিশরে বাবা! অসংবেদনশীল! একটুও প্রণয় অনুভূতি নেই। মগবাজারে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের এক ছাত্রীকে পড়ায় প্রণয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন সন্ধ্যায়। সেটা মিতা জেনেছে ওর কাছ থেকে। প্রণয়ের ছাত্রী পড়ানোকে ভালো চোখে দেখে না মিতা। প্রণয়কে একদিন বলেছেও।
‘ছেলে পড়ানো যায় না বুঝি?’ বহুদিন ভেবেছে ভার্সিটি থেকে রিকশায় চড়ে বাড়ি ফেরায় পথে প্রণয়কে সঙ্গে নিয়ে আসবে। অনুরোধও করেছে কদিন ওকে। কিন্তু প্রণয় তা আমলেই নেয়নি। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ছেলে সে। প্রায় সময়ই প্রণয় টিউশনিতে পদব্রজে মগবাজার যায়। আজ ভাবল, রিকশায় দুজন থাকলে মন্দ হতো না। আনন্দে কেটে যেত সময়টা। ওর শরীরের ছোঁয়া পেত, পুলকবোধ হতো! ওর অপ্রকাশিত কথা বলার সুযোগও পেত। হাতের প্রণয় মিলত হয়তো! কিন্তু আজও তা অসম্পন্ন থেকে গেল! অদৃশ্যমান মিতার প্রণয়! এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ে মিতা। কখন যে ইস্কাটনে ওদের বাসার সামনে রিকশাটা দাঁড়াল খেয়াল করেনি সে। রিকশাওয়ালা মিতার দিকে তাকায়।
-আপা ভাড়া দ্যান?
অঝোরে ঘাম নিঃসৃত হওয়া রিকশাওয়ালার ডাকে মিতা অবশেষে সম্বিত ফিরে পায়।