আগামী বইমেলা নিয়ে আপনার মতামত কী?
যেকোনো আন্দোলন বা সংগ্রামের পর বইমেলা ভালো হয়। এবার বইমেলায় বেশি লোকের সমাগম হবে বলে আশা করি। কারণ, এবার আমরা নতুন সরকার পেয়েছি। ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষে একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তাই, এবারের বইমেলা অনেকটাই পরিচ্ছন্ন ও প্রাঞ্জল হবে। বিগত বইমেলায় যে অনিয়মগুলো ছিল সেগুলো এখন আর থাকবে না। এবারের বইমেলায় অবশ্যই নতুনত্ব ও পরিবর্তন আসবে।
এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি বই এবং কী ধরনের বই প্রকাশ করছেন?
প্রতিবছর বইমেলায় প্রায় ১০০-এর বেশি বই আমার প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এবার একটু কম বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে। কারণ দেশে এবার মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এতে আর্থিক অনটনের কারণে মানুষের বই কেনার প্রবণতা একটু কমতে পারে। ১৯৭১ সালের পর আমরা নতুন একটা বিপ্লব পেয়েছি, সে ক্ষেত্রে ভালো লেখক দরকার, যার শূন্যতা বোধ করছি। তাছাড়া ভালো পাঠকের খুবই অভাব। অনেক লেখক লিখছেন না, আবার অনেকেই বিভিন্ন কারণে লিখতে পারেননি। এ কারণেই এবার বইমেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা তুলনা অনুপাতে কম প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বইমেলায় অনেক লোক সমাগম হবে এবং প্রচুর বই বিক্রি হবে। সেই হিসেবে বলা যায় এবারের বইমেলা অনেক প্রাণবন্ত হবে। মানুষের বিনোদনের এখন কোনো জায়গা নেই। মানুষ বিনোদনের জন্য যাবে কোথায়? তাই মেলায় আড্ডা ও বই কিনতে অনেক মানুষ আসে। একুশের বইমেলা আমাদের আত্মা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একদম মিশে গেছে।
আপনার প্রকাশনী থেক উল্লেখযোগ্য কী কী বই প্রকাশ করছেন?
আমার প্রকাশনা থেকে অনেক উল্লেখযোগ্য লেখকের বই প্রকাশ করব এবারের বইমেলায়। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ভৌতিক কিশোর গল্প, থ্রিলার ও কবিতার বই প্রকাশ হবে। এবারের বইমেলায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের খুবই সমৃদ্ধশালী বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে। নন্দিত কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের গোয়েন্দা কাহিনি সমগ্র ‘ফুটকুমামা গোয়েন্দাসমগ্র’ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করা হবে, যা ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মহিউদ্দিন আহমেদের ‘খালেদা জিয়া’ নামে অনেক ভালো একটা বই বের হবে। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, জেলে কাটানো দিন ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ুর ওপর একটি ভালো বই প্রকাশ করা হবে। ইমদাদুল হক মিলনের ছোটদের জন্য মানসম্মত একটি বই প্রকাশ করা হবে।
মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
প্রকাশক হিসেবে আমি চাই মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে হোক। আমরা পাঠকবান্ধব বইমেলা চাই। বইমেলার অবয়ব বা ইন্টেরিয়র ডিজাইনটা এমনভাবে করা হোক যাতে একজন পাঠক বইমেলায় ঢুকলে সে সহজেই তার কাঙ্ক্ষিত স্টল বা প্যাভিলিয়ন পেয়ে যায়। পাঠককে যেন বেশি ঘুরতে না হয় এবং বই সহজেই খুঁজে বের করতে পারে। কারণ বইমেলায় অনেকে ঘুরতে আসে এবং বই দেখতে আসে, তাদের যেন কোনো বই বা স্টল খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়। পাঠক যেন সহজেই তার পছন্দের বই কিনতে পারে, সেটাই প্রকাশক হিসেবে আমার প্রত্যাশা। আসন্ন বইমেলা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে হবে বলে মনে করি। বাংলা একাডেমিতে নতুন মহাপরিচালক এসেছেন, যিনি বয়সে তরুণ এবং অনেক মেধাবী। তাছাড়া এই সরকারে সংস্কতি দেখভাল করা লোক ইতোমধ্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। আশা করি, তিনি বইমেলার দিকে বিশেষভাবে নজর দেবেন। বইমেলা কীভাবে ডিজিটালাইজড করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
আগের তুলনায় বই বিক্রি কি কম?
বই বিক্রি কম নয়, বরং বিক্রি আরও অনেক বেড়েছে। পাঠক তার পছন্দের বই অবশ্যই কিনছে। হয়তো পাঠকের রুচি বা পছন্দমতো বই আমরা দিতে পারি না। পাঠক কমে যায়নি, আরও বেড়েছে। বর্তমানে বই অনলাইন বা ডিজিটালে পাওয়া গেলেও মানুষ প্রিন্ট বই কেনার জন্য ছুটে বেড়ায়। তবে পাঠককে আমরা ভালোমানের বা গুণের বই দিতে পারছি না, এটা আমাদের জন্য ব্যর্থতা। প্রকাশকরা ভালো বই প্রকাশ করতে চায়, কিন্তু সেই মানের লেখা পাচ্ছে না। আমাদের উদ্দেশ্য পাঠকের সামনে ভালো বই পোঁছে দেওয়া।
আপনি কি বর্তমানে মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন?
এই বিষয়ে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, বর্তমানে মানসম্মত বইয়ের বড়ই অভাব। যারা লেখক যাদের কাছ থেকে পাঠকের চাহিদা মোতাবেক পাণ্ডুলিপি পাই না। লেখকরা নিজেরাও লিখছেন না, বিভিন্ন কারণে লেখার তেমন সুযোগ পাচ্ছেন না। নতুন অনেক লেখক এসেছেন যারা অনেকেই ভালো লিখছেন। আবার অনেকেই খুবই নিম্নমানের লেখা লিখছেন। এই ধরনের পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ না হলেই ভালো। ভালো লেখক হতে হলে আগে ভালো পড়াশোনা করতে হবে। এখনকার প্রজন্ম যারা লিখছেন, তারা একদমই পড়াশোনা করতে চান না। লেখক হতে হলে প্রচুর বই পড়তে হবে, সে ক্ষেত্রে শুধু বাংলা বই পড়লে হবে না, বিশ্বসাহিত্য বা লেখা পড়তে হবে। বই পড়লে জ্ঞান আহরিত হয়। তার পর ভালো লেখা বের হবে। এখনো আমাদের দেশে অনেক বড় বড় লেখক আছেন যারা অনেক পড়াশোনা করেন।
বইমেলায় কী ধরনের বই বেশি বিক্রি হয়?
সারা পথিবীতেই উপন্যাস বেশি বিক্রি হয়। কারণ পাঠকদের উপন্যাসের প্রতি চাহিদা বেশি থাকে। তার পর গোয়েন্দা, থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন জাতীয় বইগুলোর বেশি চাহিদা থাকে। এ বিষয়ের ওপর আমাদের দেশে ভালো লেখক আছে। কবিতার বই বাজারে একটু কাটতি কম থাকে। তবে কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের প্রাণ। কবিতা লেখা সহজ মনে হলেও আসলে তা নয়, কবিতা লেখা অনেক কঠিন কাজ। আমি কবি আল মাহমুদকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি কি বছরে ১২টি কবিতা লিখতে পারেন না’। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা কি এত সহজ কাজ? অনেক কবিতা পড়তে হবে, আমি বাজারে একটি কাগজের ঠোঙায় লেখা দেখলেও পড়ি’। আমার প্রকাশনী থেকে সবচেয়ে বেশি কবিতার বই প্রকাশ করেছি।
কবিতার বই মানুষ কেন কিনতে চায় না বুঝি না। অথচ, একটা কবিতা একটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে। দেশে যত আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ হয়েছে সব জায়গাতেই কবিতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কবিতা জাতিকে সবসময় সাহস সঞ্চার করে থাকে। ২০২৪-এর বিপ্লবেও কবিতা ও গ্রাফিতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং জাতিকে নতুন কিছু এনে দিতে পেরেছে।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রকাশক: অনন্যা