যুক্তি, আবেগ, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, স্বদেশিকতা, মানবিকতা ও বৈশ্বিক চেতনায় সমৃদ্ধ মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম, যা আমৃত্যু চর্চিত সাধনার শিল্পিত ফসল। তার এ শিল্পমানসগঠন ও জীবনবোধের স্বরূপ সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা, সমকালীন আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রিক, আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং বিশ্ব শিল্প-সাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্য। এর মধ্যেই মুনীর চৌধুরী বেড়ে ওঠেন, নিজেকে গড়ে তোলেন এবং নির্মাণ করেন প্রদীপ্ত সাহিত্যসম্ভার।...
বাংলাদেশের সাহিত্যের উৎকর্ষসাধনে মুনীর চৌধুরী সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম শিল্পফসল ও কালোত্তীর্ণ। মুনীর চৌধুরী শুধু একটি নাম নয়, ইতিহাস। অসাধারণ এবং অসম্ভব রকমের এক প্রতিভার নাম মুনীর চৌধুরী। তার প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল আদর্শবাদিতা, নিষ্ঠা, সফল নাট্যপ্রতিভা ও সমাজচেতনার সমৃদ্ধি। দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে তিনি নিহত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহত শহিদদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তার চেতনায় সর্বদা লালিত হয়েছে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনাপ্রবাহসহ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সংগ্রামী চেতনা। তিনি ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন, ছিলেন মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল।
ভাষাবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুরো নাম আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ শহরে তার জন্ম। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলায়। পিতা খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মাতা আফিয়া বেগম। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ১৯৬২ সালে নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার। তিনি ১৯৫৩ সালে কারাবন্দি অবস্থায় প্রথম ‘কবর’ নাটক রচনা করেন। যা ১৯৬৬ সালে পূর্ববাংলার প্রথম প্রতিবাদী নাটক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তার মৌলিক নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (১৯৬২), ‘চিঠি’ (১৯৬৬), ‘রাজার জন্মদিন’ (১৯৪৬), ‘মানুষ’ (১৯৪৭), ‘পলাশী ব্যারাক’ (১৯৪৮), ‘ফিটকলাম’ (১৯৪৮), ‘আপনি কে?’ (১৯৪৮), ‘নষ্ট ছেলে’ (১৯৫০) ইত্যাদি। নাট্যাচার্য রামেন্দু মজুমদার মুনীর চৌধুরীর অনুবাদ রূপান্তরমূলক রচনাগুলো প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুনীর চৌধুরী আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটি অবিস্মরণীয় প্রতিভা। আমাদের দেশে আধুনিক নাটকের তিনিই জনক।’
মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন বিশিষ্ট্য নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার স্মৃতিচারণামূলক লেখায় লিখেছেন: ‘‘মুনীর চৌধুরী আমার বড় ভাই। তিনি আমার থেকে ১৫ বছরের বড়। আমাদের ১৪ ভাইবোনের মধ্যে আমি ১১তম, মুনীর চৌধুরী দ্বিতীয় ছিলেন। তিনি খুবই স্নেহপ্রবণ একজন মানুষ ছিলেন। তার প্রচণ্ড রসবোধ ছিল। মুনীর চৌধুরীর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল, তিনি সব সময় বইয়ের মতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন।
মুনীর চৌধুরী খুব ভালো নাটক লিখতেন এবং সেটি আমাদের ভাইবোনদের পড়ে শোনাতেন। তার রসবোধের একটি গল্প সবাই জানেন। তিনি প্রায় ১২-১৩টি আটার রুটি একবারে খেয়ে ফেলতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াতে যেতেন সে সময় আমার মা বসে বসে রুটি বেলতেন এবং তা ভেজে মুনীর চৌধুরীকে খেতে দিতেন। মায়ের হাতে এলার্জি হয়েছে এবং আমার মা আমার বড় বোন কণাকে বলেছেন, আজকে তুমি মুনীরকে একটু খাবার বানিয়ে দিও। কনা আপা তিনটি রুটি বেলে দেওয়ার পরে মুনীর চৌধুরী বললেন, আর খাব না। যাইরে! কনা আপা জিজ্ঞেস করলেন, কেন, মুনীর ভাই?
আজ রুটি বানানো কি খুব খারাপ হয়েছে? মুনীর ভাই জবাবে বললেন, না খুব মজবুত হয়েছে। মানে খুব শক্ত হয়েছে। এই কথা বলে মুনীর ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। একবার মুনীর ভাই অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাছিলেন। খুলতে দেরি হয়েছে দেখে আমি গিয়ে খুললাম। তখন মুনীর ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এত বিলম্ব হলো কেন? উত্তরে আমি বলেছিলাম, ভক্ষণ করিতে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তোরা আবার কী ভক্ষণ করিস? ভক্ষণ করেন রাজা-বাদশারা। তোরা তো গিলিস! তিনি যখন ক্লাস নিতেন তখন ক্লাসের ছাত্ররা ছাড়াও অন্য ক্লাসের ছাত্ররা এসে পেছন দিকে বসে তার লেকচার শুনত।
আমি যে নাটকে এসেছি, সে উদ্দীপনা মুনীর ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া। মুনীর চৌধুরী নাটক খুব পছন্দ করতেন। আমাদের পরিবারটি প্রচণ্ড রক্ষণশীল পরিবার ছিল। আমি, বলা যায় অনেকটা যুদ্ধ করেই নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার প্রথম নাটক ‘ডাক্তার আব্দুল্লাহর কারখানা’। শওকত ওসমানের নাটক। সেই নাটকের জন্য মুনীর ভাই একদিন আমাকে বললেন, তুই আমার নাটকে অভিনয় করে দে। আমি তখন কলেজে পড়ি। আমি মুনীর ভাইকে বললাম, আমি কীভাবে পারব? কখনো নাটক করিনি। মুনীর চৌধুরী বলল, তুই এটা পারবি। কারণ এটা একটা রোবটের চরিত্র। রোবটের চরিত্র মানে এটা একটা যন্ত্রমানবী। তোকে কিছু করতে হবে না। শুধু সংলাপ মুখস্থ বলবি। ঠাস ঠাস করে কথা বলবি। আমি বললাম, সে তো বুঝলাম। কিন্তু আব্বা তো আমাকে করতে দিবে না। মুনীর ভাই বললেন, সেই দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আমার ভাই শহিদ মুনীর চৌধুরীকে আমরা হারিয়েছি। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর তাকে ধরে নিয়ে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। কবির চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীসহ এ রকম কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আমরা করেছিলাম। যখন আমার কানে খবরটি পৌঁছায় যে, মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেছে, ভাই তো! আমি অস্থির হয়ে উঠি। এদিকে খবর আসছে দেশ স্বাধীন হয়ে আসছে!
সেই মুহূর্তটি আমি বর্ণনা করতে পারি না। মুনীর ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে, আরও অনেককেই ধরে নিয়ে গেছে। আমি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। মুনীর চৌধুরীকে কেন নিয়ে গেলেন? আমার স্বামী আমাকে বললেন তাকে, তাদের মতো মানুষকেই তো নিয়ে যাবে, একটি দেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের তো নিতে হবেই।
মুনীর চৌধুরীর কাছে অনেকেই আসতেন। তিনি বাসায় এমনিতে বলে রেখেছিলেন যে, কেউ যদি বলে যে, স্যার আছেন? তাহলে দরজা খুলে দেবে। কিন্তু যারা সেদিন এসেছিল ওরা ছিল আলবদর। স্যার আছেন? আমার বড় বোন দরজা খুলে দিয়েছিলেন। মুনীর ভাই তখনো শার্ট পরেননি। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা ছিলেন। দরজা খুলে দেওয়ার পরই তার পিঠে বন্দুক রাখা হলো। তিনি তখন বললেন, আমি জামা পরে আসি। তিনি জামা পরে এলেন। চোখ বন্ধ করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা যেভাবে মাত্র ৯ মাসে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু একটি দেশ পাওয়া যত কষ্টকর, তা রক্ষা করা আরও বেশি কষ্টকর। এই দেশটিকে আমাদের পরিচর্যা করা উচিত। আমরা তা করতে পারি। আমরা যদি দেশটিকে ভালো না বাসি, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে না পারি, আসলে সেরকম কিছুই আমরা করতে পারিনি। ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাট, নির্যাতন, সবই চলছে। আমারা যদি নিজেদের মনকে পরিশুদ্ধ না করি, তাহলে এ দুঃখ আর কখনো ঘুচবে না। আমার বড় ভাই মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলব, তার পরিচয় দিতে আমি যেমন গৌরব অনুভব করি, তেমনই আমার চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে!’’
অসাম্প্রদায়িক মানুষ মুনীর চৌধুরীর জন্মদিনে রইল গভীর শ্রদ্ধা।