কখনো কখনো কি মনে হয় না, চেনা জগৎ থেকে অন্য কোথাও চলে যাই? এই পৃথিবীর অন্য কোথাও- ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।’ লেখকরা, বিশেষ করে কবি ও কথাশিল্পীরা অনেক সময় নিজের চেনা পৃথিবী ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু সে আর কতদূর? হয়তো জনমানবহীন গোবি সাহারায় কিংবা নির্জন তাহিতি দ্বীপে। তবে এর মধ্যেও একজন ঔপন্যাসিক এই পৃথিবীতে নয়, পৃথিবী ছাড়িয়ে পরাপৃথিবীর কথা ভেবেছেন। সেই ভাবনাবীজ থেকে তিনি লিখে ফেলেছেন একটা উপন্যাস ‘অরবিটাল’। সেই উপন্যাসের সূত্রে আবার অর্জন করেছেন বুকার সাহিত্য পুরস্কার। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের পরেই এই পুরস্কারকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার মনে করা হয়। নোবেল দেওয়া হয় সাহিত্যের যেকোনো শাখায়, কিন্তু বুকার দেওয়া হয় শুধু উপন্যাসে।
সামান্থা হার্ভের ‘অরবিটাল’ উপন্যাসটি একেবারেই ভিন্ন ধরনের উপন্যাস। শুধু ভিন্ন বলি কেন, প্রচলিত অর্থে আমরা যাকে উপন্যাস বলি, এটি তাও নয়। এই সংশয় অন্য কারও নয়, স্বয়ং ঔপন্যাসিক সামান্থার। একটা সাক্ষাৎকারেই এমনটা বলেছেন তিনি।
২
এই উপন্যাসটি নিয়ে যখন লিখব ভাবছিলাম, তখনই আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। আজারবাইজানের বাকুতে এই মুহূর্তে চলছে ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। যেদিন আমার এই লেখাটি বেরোবে, সেদিন, অর্থাৎ ২২ নভেম্বর সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীর মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, সেই তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর ২০০টি দেশ বাকুতে মিলিত হয়েছে। ফল যে খুব আশাপ্রদ হবে, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে, এমন নয়। প্রসঙ্গটি তুললাম এই কারণে যে, ‘অরবিটাল’ উপন্যাসে জলবায়ু বিপর্যয়ের কথা আছে। তবে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় আমাদের এই পৃথিবী, যা একই সঙ্গে সুন্দর ও বিপন্ন। উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু তাই ভূরাজনীতি। কিন্তু সরল অর্থে আমরা যাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলি, ঘটনাটি ঘটে কোনো না কোনো রাষ্ট্রে, উপন্যাসটির কাহিনি সেরকম নয়। ‘অরবিটালে’র গল্পটি ঘটছে আসলে মহাকাশে। এর চরিত্রগুলো মহাকাশযানে অবস্থান করছে। তারা সেখান থেকে পৃথিবীকে দেখছে। তাহলে ‘অরবিটাল’ কি কল্পবিজ্ঞান, সায়েন্স ফিকশন? না, তাও নয়।
সামান্থার নিজের কথার সূত্র ধরে বলি, ‘মানবিক মনোলোকে (সাইকি) পুরাণের অভিঘাত’ নিয়ে উপন্যাসটি লেখা। পৃথিবী থেকে দেখা চলিষ্ণু আলো আর চাঁদকে অতিক্রম করা ছায়াচিত্রের মতো প্রজাপতির দেখা মিলবে এই উপন্যাসে।’ ‘প্রযুক্তি, পুরাণ ও সময়’ একীভূত হয়ে গেছে। আগেই বলেছি, এর গল্পটি মহাকাশের। তবে ‘স্টার ট্রেক’-এর কল্পবিজ্ঞান নয়, আবার কল্পবিজ্ঞানের কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে এতে। গল্পটি আরেকটু বিস্তৃতভাবে বলি।
একটা আন্তর্জাতিক মহাকাশযান, যার পোশাকি নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ (আইএসএস)। এই স্পেসে মহাকাশচারীর সংখ্যা ছয়। তাদের চারজন পুরুষ, দুজন নারী। সবাই ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ। দুজন রাশিয়ার, একজন করে জাপান, ইতালি, আমেরিকা ও ব্রিটেনের। মহাকাশযানে করে তারা এক দিনের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছেন। প্রদক্ষিণের সময় এই মহাকাশচারীরা যা কিছু করছেন, যা কিছু দেখছেন, যা কিছু ঘটছে- সেসব নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির গল্প। সেই গল্পে দেখা যাচ্ছে ২৪ ঘণ্টা ধরে তারা কক্ষপথে ঘুরছেন। মহাকাশযানটি ১৬ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবীর সময় আর মহাশূন্যের সময়কে ‘অরবিটালে’ ভিন্নভাবে দেখিয়েছেন সামান্থা। এখানে প্রতি ১৯ মিনিটে একটা দিন হয়।
দেখা যাচ্ছে, এই প্রদক্ষিণের সময় মহাকাশচারীদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ কাজ করছে। সেই সঙ্গে পরস্পরের কাছাকাছিও চলে এসেছেন তারা। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের মহাকাশচারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একধরনের যৌথ সচেতনতা বোধ তৈরি হচ্ছে। গভীর অর্থে একে বলা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির যৌথ মানবিক বোধ। একটা চরিত্রের কথায় সেই বোধটি উচ্চারিত হয়েছে এভাবে: ‘সাঁতার কাটতে পারছি না, আমরা সবাই এমনই একটা গভীর, কালো যানের যাত্রী।’ এভাবেই স্বাভাবিক বর্ণনাভঙ্গির মধ্যদিয়ে ‘অরবিটালে’র গল্পটি অগ্রসর হয়েছে। অর্থাৎ এই উপন্যাসের আখ্যানাংশ বাস্তববাদী রাজনৈতিক উপন্যাসের বর্ণনারীতিকে অবলম্বন করে লেখা, আর সেই সূত্রে উপন্যাসটিতে সামান্থার দার্শনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।
সামান্থাই জানাচ্ছেন, ‘কল্পবিজ্ঞানকে’ তিনি ‘কল্পবাস্তব’ কাহিনিতে রূপান্তরিত করেছেন। এ হচ্ছে, তার ভাষায়, ‘নতুন কাল্পনিক ক্ষেত্র’, নতুন ধরনের জ্যঁর বা সাহিত্য-প্রকরণ। তিনি এই ধরনের সাহিত্য-প্রকরণের নামকরণ করেছেন ‘সায়েন্স-প্যাস্টোরাল’। ইংরেজি এই শব্দবন্ধের বঙ্গীকরণ করে একে বলা যায় ‘বিজ্ঞানকল্প চারণভূমি’। অর্থাৎ এর কাহিনি বিজ্ঞাননির্ভর এবং পৃথিবীকেন্দ্রিক ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। একই সঙ্গে তা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক ভাবনার দ্বারা প্রাণিত রচনা। স্পেস বা মহাশূন্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে বোঝার প্রয়োজন থেকেই সামান্থা ‘অরবিটাল’ উপন্যাসটি লিখেছেন।
৩
পৃথিবীর প্রথম উৎক্ষিপ্ত মহাকাশযান ‘স্পুটনিক ১’। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহাকাশযানটি ১৯৫৭ সালের ১ অক্টোবর কক্ষপথে পরিভ্রমণ শুরু করে। এই উৎক্ষেপণের একটা রাজনীতি ছিল। আমাদের বিশ্বের বাইরের জগতে কোন দেশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না কি সোভিয়েত ইউনিয়নের- এই নিয়ে দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে শুরু মহাকাশ-যুগের। সামান্থা এই প্রেক্ষাপটে ‘অরবিটাল’কে শুধু একটা সরল সায়েন্স ফিকশন করে তোলেননি। তার লক্ষ্য ছিল আরও গভীর। পরাশক্তির দ্বন্দ্বকেও তিনি উপন্যাসের বিষয় করেননি। তিনি হাজির করেছেন বিপরীতধর্মী বয়ান বা ডিসকোর্স।
ছয় মহাকাশচারী পৃথিবী থেকে ২৫০ মাইল ঊর্ধ্বে প্রতিঘণ্টায় ১৭৫০০ মাইল বেগে কক্ষপথে ঘুরছেন। নানা দেশের মানুষ তারা। মহাকাশ স্টেশনের ভেতর থেকে আমাদের পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছেন। পৃথিবীর ভূমি, প্রকৃতি, জনবসতির বিন্যাস, নগরের গঠন, আবহাওয়া- তাদের গবেষণার অংশ হয়ে উঠছে। কত বৈচিত্র্য, বৈভব আর বৈষম্যের দ্বারা গঠিত আমাদের পৃথিবী। একই সঙ্গে যেমন সুন্দর, তেমনি বীভৎস। পৃথিবীকে এভাবে দেখাটা একান্তই ঔপন্যাসিক সামান্থা হার্ভের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। উপন্যাসটিতে তাই পাওয়া যায় তার দার্শনিক ভাবনা ও চিন্তার গভীর ভাবার্পণের শৈল্পিক প্রকাশ। এর ভাষাও হয়ে উঠেছে কখনো কাব্যিক, কখনো বাস্তবতার প্রতিভাস।
মাত্র ১৪৪ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা উপন্যাস। কিন্তু এতে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে শুরু করে যুদ্ধ-সংঘাত, মানবিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বিষয়টি গভীর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে ৪৯ বছর বয়সী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সামান্থা হার্ভের।
বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে এর আগে এ ধরনের কোনো উপন্যাস বুকার পুরস্কার পায়নি। এমনকি এটি বিশ্ব-উপন্যাসের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অভূতপূর্ব একটি উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত হবে। পুরস্কারের আগেই বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে সামান্থা হার্ভেকে আন্তরিক অভিনন্দন।