ঢাকা ৪ মাঘ ১৪৩১, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

অরবিটাল: মহাকাশ থেকে দেখা পৃথিবীর রাজনৈতিক গল্প

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১২ পিএম
অরবিটাল: মহাকাশ থেকে দেখা পৃথিবীর রাজনৈতিক গল্প
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সামান্থা হার্ভের

কখনো কখনো কি মনে হয় না, চেনা জগৎ থেকে অন্য কোথাও চলে যাই? এই পৃথিবীর অন্য কোথাও- ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।’ লেখকরা, বিশেষ করে কবি ও কথাশিল্পীরা অনেক সময় নিজের চেনা পৃথিবী ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু সে আর কতদূর? হয়তো জনমানবহীন গোবি সাহারায় কিংবা নির্জন তাহিতি দ্বীপে। তবে এর মধ্যেও একজন ঔপন্যাসিক এই পৃথিবীতে নয়, পৃথিবী ছাড়িয়ে পরাপৃথিবীর কথা ভেবেছেন। সেই ভাবনাবীজ থেকে তিনি লিখে ফেলেছেন একটা উপন্যাস ‘অরবিটাল’। সেই উপন্যাসের সূত্রে আবার অর্জন করেছেন বুকার সাহিত্য পুরস্কার। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের পরেই এই পুরস্কারকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার মনে করা হয়। নোবেল দেওয়া হয় সাহিত্যের যেকোনো শাখায়, কিন্তু বুকার দেওয়া হয় শুধু উপন্যাসে। 

সামান্থা হার্ভের ‘অরবিটাল’ উপন্যাসটি একেবারেই ভিন্ন ধরনের উপন্যাস। শুধু ভিন্ন বলি কেন, প্রচলিত অর্থে আমরা যাকে উপন্যাস বলি, এটি তাও নয়। এই সংশয় অন্য কারও নয়, স্বয়ং ঔপন্যাসিক সামান্থার। একটা সাক্ষাৎকারেই এমনটা বলেছেন তিনি।


এই উপন্যাসটি নিয়ে যখন লিখব ভাবছিলাম, তখনই আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। আজারবাইজানের বাকুতে এই মুহূর্তে চলছে ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। যেদিন আমার এই লেখাটি বেরোবে, সেদিন, অর্থাৎ ২২ নভেম্বর সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীর মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, সেই তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর ২০০টি দেশ বাকুতে মিলিত হয়েছে। ফল যে খুব আশাপ্রদ হবে, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে, এমন নয়। প্রসঙ্গটি তুললাম এই কারণে যে, ‘অরবিটাল’ উপন্যাসে জলবায়ু বিপর্যয়ের কথা আছে। তবে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় আমাদের এই পৃথিবী, যা একই সঙ্গে সুন্দর ও বিপন্ন। উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু তাই ভূরাজনীতি। কিন্তু সরল অর্থে আমরা যাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলি, ঘটনাটি ঘটে কোনো না কোনো রাষ্ট্রে, উপন্যাসটির কাহিনি সেরকম নয়। ‘অরবিটালে’র গল্পটি ঘটছে আসলে মহাকাশে। এর চরিত্রগুলো মহাকাশযানে অবস্থান করছে। তারা সেখান থেকে পৃথিবীকে দেখছে। তাহলে ‘অরবিটাল’ কি কল্পবিজ্ঞান, সায়েন্স ফিকশন? না, তাও নয়।  

সামান্থার নিজের কথার সূত্র ধরে বলি, ‘মানবিক মনোলোকে (সাইকি) পুরাণের অভিঘাত’ নিয়ে উপন্যাসটি লেখা। পৃথিবী থেকে দেখা চলিষ্ণু আলো আর চাঁদকে অতিক্রম করা ছায়াচিত্রের মতো প্রজাপতির দেখা মিলবে এই উপন্যাসে।’ ‘প্রযুক্তি, পুরাণ ও সময়’ একীভূত হয়ে গেছে। আগেই বলেছি, এর গল্পটি মহাকাশের। তবে ‘স্টার ট্রেক’-এর কল্পবিজ্ঞান নয়, আবার কল্পবিজ্ঞানের কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে এতে। গল্পটি আরেকটু বিস্তৃতভাবে বলি।

একটা আন্তর্জাতিক মহাকাশযান, যার পোশাকি নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ (আইএসএস)। এই স্পেসে মহাকাশচারীর সংখ্যা ছয়। তাদের চারজন পুরুষ, দুজন নারী। সবাই ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ। দুজন রাশিয়ার, একজন করে জাপান, ইতালি, আমেরিকা ও ব্রিটেনের। মহাকাশযানে করে তারা এক দিনের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছেন। প্রদক্ষিণের সময় এই মহাকাশচারীরা যা কিছু করছেন, যা কিছু দেখছেন, যা কিছু ঘটছে- সেসব নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির গল্প। সেই গল্পে দেখা যাচ্ছে ২৪ ঘণ্টা ধরে তারা কক্ষপথে ঘুরছেন। মহাকাশযানটি ১৬ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবীর সময় আর মহাশূন্যের সময়কে ‘অরবিটালে’ ভিন্নভাবে দেখিয়েছেন সামান্থা। এখানে প্রতি ১৯ মিনিটে একটা দিন হয়। 

দেখা যাচ্ছে, এই প্রদক্ষিণের সময় মহাকাশচারীদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ কাজ করছে। সেই সঙ্গে পরস্পরের কাছাকাছিও চলে এসেছেন তারা। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের মহাকাশচারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একধরনের যৌথ সচেতনতা বোধ তৈরি হচ্ছে। গভীর অর্থে একে বলা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির যৌথ মানবিক বোধ। একটা চরিত্রের কথায় সেই বোধটি উচ্চারিত হয়েছে এভাবে: ‘সাঁতার কাটতে পারছি না, আমরা সবাই এমনই একটা গভীর, কালো যানের যাত্রী।’ এভাবেই স্বাভাবিক বর্ণনাভঙ্গির মধ্যদিয়ে ‘অরবিটালে’র গল্পটি অগ্রসর হয়েছে। অর্থাৎ এই উপন্যাসের আখ্যানাংশ বাস্তববাদী রাজনৈতিক উপন্যাসের বর্ণনারীতিকে অবলম্বন করে লেখা, আর সেই সূত্রে উপন্যাসটিতে সামান্থার দার্শনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।

সামান্থাই জানাচ্ছেন, ‘কল্পবিজ্ঞানকে’ তিনি ‘কল্পবাস্তব’ কাহিনিতে রূপান্তরিত করেছেন। এ হচ্ছে, তার ভাষায়, ‘নতুন কাল্পনিক ক্ষেত্র’, নতুন ধরনের জ্যঁর বা সাহিত্য-প্রকরণ। তিনি এই ধরনের সাহিত্য-প্রকরণের নামকরণ করেছেন ‘সায়েন্স-প্যাস্টোরাল’। ইংরেজি এই শব্দবন্ধের বঙ্গীকরণ করে একে বলা যায় ‘বিজ্ঞানকল্প চারণভূমি’। অর্থাৎ এর কাহিনি বিজ্ঞাননির্ভর এবং পৃথিবীকেন্দ্রিক ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। একই সঙ্গে তা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক ভাবনার দ্বারা প্রাণিত রচনা। স্পেস বা মহাশূন্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে বোঝার প্রয়োজন থেকেই সামান্থা ‘অরবিটাল’ উপন্যাসটি লিখেছেন।


পৃথিবীর প্রথম উৎক্ষিপ্ত মহাকাশযান ‘স্পুটনিক ১’। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহাকাশযানটি ১৯৫৭ সালের ১ অক্টোবর কক্ষপথে পরিভ্রমণ শুরু করে। এই উৎক্ষেপণের একটা রাজনীতি ছিল। আমাদের বিশ্বের বাইরের জগতে কোন দেশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না কি সোভিয়েত ইউনিয়নের- এই নিয়ে দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে শুরু মহাকাশ-যুগের। সামান্থা এই প্রেক্ষাপটে ‘অরবিটাল’কে শুধু একটা সরল সায়েন্স ফিকশন করে তোলেননি। তার লক্ষ্য ছিল আরও গভীর। পরাশক্তির দ্বন্দ্বকেও তিনি উপন্যাসের বিষয় করেননি। তিনি হাজির করেছেন বিপরীতধর্মী বয়ান বা ডিসকোর্স। 

ছয় মহাকাশচারী পৃথিবী থেকে ২৫০ মাইল ঊর্ধ্বে প্রতিঘণ্টায় ১৭৫০০ মাইল বেগে কক্ষপথে ঘুরছেন। নানা দেশের মানুষ তারা। মহাকাশ স্টেশনের ভেতর থেকে আমাদের পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছেন। পৃথিবীর ভূমি, প্রকৃতি, জনবসতির বিন্যাস, নগরের গঠন, আবহাওয়া- তাদের গবেষণার অংশ হয়ে উঠছে। কত বৈচিত্র্য, বৈভব আর বৈষম্যের দ্বারা গঠিত আমাদের পৃথিবী। একই সঙ্গে যেমন সুন্দর, তেমনি বীভৎস। পৃথিবীকে এভাবে দেখাটা একান্তই ঔপন্যাসিক সামান্থা হার্ভের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। উপন্যাসটিতে তাই পাওয়া যায় তার দার্শনিক ভাবনা ও চিন্তার গভীর ভাবার্পণের শৈল্পিক প্রকাশ। এর ভাষাও হয়ে উঠেছে কখনো কাব্যিক, কখনো বাস্তবতার প্রতিভাস। 

মাত্র ১৪৪ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা উপন্যাস। কিন্তু এতে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে শুরু করে যুদ্ধ-সংঘাত, মানবিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বিষয়টি গভীর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে ৪৯ বছর বয়সী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সামান্থা হার্ভের। 

বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে এর আগে এ ধরনের কোনো উপন্যাস বুকার পুরস্কার পায়নি। এমনকি এটি বিশ্ব-উপন্যাসের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অভূতপূর্ব একটি উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত হবে। পুরস্কারের আগেই বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে সামান্থা হার্ভেকে আন্তরিক অভিনন্দন।

মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া
কিংবদন্তির ভাগীরথী

শিরোনামে যাকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছি, তিনি এ বিষয়ে, মানে কথাসাহিত্যে আর পাঁচজনের মতো নন, বরং বেশ ব্যতিক্রমী এক মেধা। বিগত চার দশকে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত সৃষ্টিশীল প্রকাশসহ, গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে একের পর এক যে অবদান রেখে চলেছেন। 

ভাষার অধিকার নিয়ে জাতির আন্দোলনে যেমন নারী তার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তেমনি দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালে নারীর ওপর নির্যাতন, শেষে চরম আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নারীদের এক অসামান্য উদাহরণ হয়ে থাকবে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা আরেক নারী চরিত্র, ভাগীরথী। কিংবদন্তির ভাগীরথী সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্ট উপন্যাস। 

রাতের অন্ধকারে রাজাকার সুলতান মাহমুদের সহায়তায় পাকিস্তানি পিশাচ সৈন্যরা পিরোজপুর শহরের বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের নারীদের কী এক অজানা বিকৃত চিন্তায় বেশি করে টার্গেট করা হয়। ভাগীরথী তেমনি এক অল্প বয়েসী, পাঁচ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তান, লালশ্যামের মা। ঘনশ্যাম তার স্বামী একজন মুচি। ক্যাপ্টেন আলী মোহাম্মদ হাত বাড়ায় ভাগীরথীর দিকে। ভাগীরথীর চওড়া কাঁধের ওপর আলী মোহাম্মদ কঠোর হাত রাখে। ঘাড় ফিরে দেখে ভাগীরথী নিজের কাঁধটা দখল হয়ে গেছে (পৃ: ১৫, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। এতক্ষণ নির্জীব ঘনশ্যাম দৌড়ে এসে সুলতান মাহমুদের দুই পা জড়িয়ে ধরে- সুলতান দাদা, আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান। আপনেগো সব জোতা মুই সেলাই কইরা দিমু। আপনেগো সব জোতা কালি কইরা দিমু। আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান (পৃ: ১৫-১৬, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। কিন্তু রাজাকার সুলতান মাহমুদ আর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তো একথা শোনার মানুষ নয়। পিরোজপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পে মেজর ইসকান্দার হায়াৎ খানের যৌন লালসার শিকার আরও অগুনিত নারীর পরিণতি হয় ভাগীরথীরও পরিণতি। 

একদিন সুযোগ আসে। ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগের হৃদয় গলিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় ভাগীরথী। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। বরং স্বামী ও প্রতিবেশীরা তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ভাগীরথী আবিষ্কার করে, সে আর কোনোদিন তার পুরনো স্বাভাবিক সংসারে ফিরে যেতে পারবে না।

ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় একদল মুক্তিসেনার সঙ্গে। তাদের সমবেদনা ভাগীরথীকে অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করার কাজে। নিজের জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে ভাগীরথী যে তথ্য দেয়, মুক্তিসেনারা তাতে কয়েকটি সফল অপারেশন করতে পারে। এতে পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগসহ পঞ্চাশজন সৈন্য নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। 

উপন্যাস কিংবদন্তির ভাগীরথী জাদুকরী কথাসাহিত্যিক, অথবা বলা যায় কথাসাহিত্যের জাদুকর রঙের তুলিতে নয়, শব্দচিত্র দিয়ে নির্মাণ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। বাজারে চলছে বইটির চতুর্থ মুদ্রণ। 

লেখক: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, কথাশিল্পী, কবি, অনুবাদক 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে
মাজহারুল ইসলাম

কেমন হতে পারে এবারের মেলা? 

এবারের বইমেলা ভালো হবে। পাঠক বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রতিদিন মেলায় আসবেন। পছন্দের লেখকের বই কিনবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। এই মেলার জন্য সারা বছর তারা অপেক্ষায় থাকেন। সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করবেন, সেলফি তুলবেন। সর্বোপরি পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবার অংশগ্রহণে একটি বইবান্ধব মেলা হবে। 

এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি বই প্রকাশ করছেন? 
এবার অন্যপ্রকাশ থেকে প্রায় অর্ধ শত বই প্রকাশিত হবে। 

উল্লেখযোগ্য বই কী কী? 

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে আল মাহমুদের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’, ‘সেরা পাঁচ উপন্যাস’, ড. মোহাম্মদ হাননানের ইতিহাসগ্রন্থ ‘ভাষার সংগ্রাম ১৯১৭-১৯৯৯ [হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সংগ্রামের ঐতিহাসিক আলেখ্য], এম আবুল কাসেমের ব্যতিক্রমী গবেষণাগ্রন্থ ‘চা-অর্থনীতি’, এম আবদুল আলীমের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ ছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের জনপ্রিয় ছোটকাকু সিরিজের ৪০টি বইয়ের সংকলন ‘ছোটকাকু চল্লিশ’। ৮০০ পৃষ্ঠার এই বইটি নিছকই একটি সংকলন নয়, এর আকারে যেমন অভিনবত্ব থাকবে, তেমনি প্রোডাকশনটি হবে ভিন্নমাত্রার। সব মিলে একটা সংগ্রহে রাখার মতো প্রকাশনা হবে এটি।

মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি? 

মেলাপ্রাঙ্গণ হবে এমন, যেন ক্রেতা-পাঠক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, সহজে চলাফেরা করতে পারেন। মেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন তা পাঠক ও প্রকাশকবান্ধব হয়। কেউ যেন কোনো সমস্যা বোধ না করেন। ধুলার সমস্যা দীর্ঘদিনের, একই সঙ্গে আলোর স্বল্পতা। আশা করি, এই বিষয় দুটি গুরুত্বের সঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটি সমাধানের চেষ্টা করবে। 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন কি? 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব নতুন কিছু নয়। এই সংকট আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। দুঃখজনক সত্য হলো, ন্যূনতম মানহীন কিছু পাণ্ডুলিপিও বই আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা আসলে সামগ্রিক দুর্বলতারই অংশ। অনেক ক্ষেত্রে  আমরা এগিয়েছি, এটা যেমন সত্য, তেমনি নতুন লেখক সৃষ্টিতে কিংবা মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে আমাদের এখনো অনেক কিছু করা বাকি। সাহিত্যের চর্চা, এর পঠনপাঠন বাড়ানো গেলে, সংস্কৃতিমনস্কতার উন্নতি হলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।

মেলায় কী ধরনের বই বেশি বেচা হয়? 

গল্প-উপন্যাস, থ্রিলার, ভ্রমণকাহিনি। ইদানীং ননফিকশনাল বইও বেশ বেচা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মউন্নয়নমূলক বইয়েরও চাহিদা রয়েছে।

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

মাজহারুল ইসলাম 
প্রধান নির্বাহী, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

ফেরার পথ নেই

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
ফেরার পথ নেই
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

এই শহরে আগেও অনেকবার এসেছে জারা। এখানে প্রায়ই বড় বড় আয়োজনের বিয়ে, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর জমকালো অনুষ্ঠান থাকে। আবার দীর্ঘদিন লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায় থাকার পর দেশে ফেরা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গেট-টুগেদার আয়োজন করে কেউ কেউ। এবারও তেমন একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে নিজের টিম নিয়ে এসেছে জারা। এ ধরনের অনুষ্ঠানে খানাপিনার সঙ্গে ডিজে পার্টি, মিউজিক্যাল নাইটের আয়োজন থাকে। বেশ কয়েক মাস আগেই শিডিউল ঠিক করা ছিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে গোলাপগঞ্জে লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে জমকালো গেট-টুগেদার অনুষ্ঠান। শহরের বাইরে হলেও জায়গাটা অনেক উন্নত। এবার প্রোগ্রাম করতে এলেও ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে জারা। এক ধরনের অস্বস্তি বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে। প্লেনে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। ক্লান্তির প্রশ্নই ওঠে না। তার পরও নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।

ঢাকায় থাকতেই জারা জেনেছে, উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টিতে মাদক আর বিষাক্ত ভেজাল মদ খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের আটক করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় সংসদে সবাই একমত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। শাহবাগ, টিএসসি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। ফলে এ ইস্যুটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশজুড়ে মাদককারবারি, চোরাচালানি, সরবরাহকারীদের ধরতে শক্ত অভিযান চলছে। কেউ ছাড়া পাচ্ছে না। আটক করে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে কয়েকটি ক্রসফায়ারের ঘটনা এসব কাজে জড়িতদের মনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে সে রাতের ডিজে পার্টি আয়োজনের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে থাকা সবার নাম পুলিশ ও সিআইডি এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তালিকা ধরে তাদের খোঁজ চলছে। ঢাকা ছেড়ে অন্য শহরে কিংবা গ্রামে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে। সেই তালিকার প্রথমদিকেই ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক বিখ্যাত ডিজে গার্ল জারা শাহরিন খানের নামটি রয়েছে। 

প্রভাবশালী কয়েকজন হোমরাচোমরা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যের কারণে সে নানাভাবে বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা-প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এতদিন। বেশ কয়েকবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেও সেই হোমরাচোমরাদের বদান্যতায় উদ্ধার পেয়েছে জারা। কিন্তু এবার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনাটিতে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তালিকা থেকে তার নামটি যেকোনোভাবে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পর কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পারেনি। সবাই একটাই কথা বলেছে, এ কেসটি অন্য সব কেস থেকে আলাদা। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে চাপ রয়েছে- অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবে পার পেয়ে না যেতে পারে। সবাইকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেকোনো মূল্যে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কারও জন্য তদবির, সুপারিশ করার একদম সুযোগ নেই। তেমন পরিস্থিতিতে কখন যে কী ঘটে যায়- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। 

বুকের মধ্যে অনেক অস্বস্তি চেপে বসেছে। কিছুতেই সেটাকে সরাতে পারছে না। সারাক্ষণ একটা ভয়, আতঙ্কভাব তাড়া করে ফিরছে তাকে। গত কয়েক দিন ধরে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে ছিল সে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও দুচোখে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ একটু তন্দ্রাভাব এলেও পরক্ষণেই তা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ রকম একটি অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ খুঁজছিল জারা। 

আরও কয়েক মাস আগেই সিলেটে একটি প্রোগ্রামের কথাবার্তা ফাইন্যাল হয়েছিল। প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দিতে পারত সে। কিন্তু একটুখানি প্রশান্তির আশায় ঢাকার বাইরে দূরে কোথাও চলে যেতে মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এ কারণেই প্লেনে চড়ে সোজা সিলেট চলে এসেছে। এখানে যাদের বাড়িতে প্রোগ্রাম, তারাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তাদের নিজস্ব গাড়িতে হোটেলে এনেছে। দামি বিলাসবহুল লাক্সারি স্যুটে জারার

থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। 
নিজেকে আরও রিফ্রেশ করতে বাথটাবে হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ শরীরটা ডুবিয়ে রেখেছে। এতে কিছুটা কাজ হয়েছে। হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শরীরটা ডুবিয়ে রাখার পর কিছুটা প্রশান্তিবোধ করায় আয়োজকদের ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলেছে জারা। আজ রাতে যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে সেখানে গিয়ে সবকিছু দেখতে চায় সে।

ছবির মতো চমৎকার সুন্দর বিলেতি ডিজাইনের একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়িটি থামে। এই বাড়িতেই আজ অনুষ্ঠান। দীর্ঘদিন লন্ডন, কানাডায় থাকা কয়েকটি পরিবার দেশে বেড়াতে এসেছে। দেশে এসে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছে। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গানবাজনা, ডিজে পার্টির ব্যবস্থা করেছেন তারা। 

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে তৈরি করা স্টেজের দিকে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় জারার। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা একজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে না ফেললে মাটিতে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটত নিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে কিছুটা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়। তাহলে কি এখানে তার জন্য কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে? যার আগাম সংকেত হলো হঠাৎ এই হোঁচট খাওয়া! সাধারণভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেলে অনেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করে মনে মনে। কুসংস্কার হলেও তেমন বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলা থেকে এ রকম কিছু ঘটলে কাছাকাছি মা থাকলে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, মায়ের দোয়া সঙ্গে থাকলে কোনো বালা-মুসিবত, বিপদাপদ কাছে আসতে পারবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত কদিন ধরে এক ধরনের অস্থিরতা তাড়া করে ফিরছে তাকে। এক ধরনের অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময় কাটছে।

স্টেজে উঠে চারপাশে তাকাতেই জারা দেখতে পায়, বাড়ির সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে। এ রকম গাড়ি তো আজ অনেক আসছে এ বাড়িতে। অতিথিরা যে যার মতো গাড়ি নিয়ে আসছেন। কিন্তু সাদা মাইক্রোবাস থেকে নামতে থাকা মানুষগুলো সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরা হলেও তাদের কয়েক জনের গায়ে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট দেখে ভয়ে, আশঙ্কায় তার সারা শরীরে হালকা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। দেখেই বোঝা যায়, এই লোকগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গাড়ি থেকে নেমে তারা এ বাড়ির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে- এতদূর থেকে শোনা না গেলেও এ বাড়ির মানুষজন লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্টেজের দিকে হাতের ইশারা করছে, দেখতে পায় সে। তাদের কথোপকথনের ধরন দেখে এখানে থাকা কারও কথা আলোচনা করছে বোঝা যায়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকগুলোর হাতে অস্ত্র দেখা যায়। তারা সবাই এদিকেই এগিয়ে আসছে দৃঢ় পদক্ষেপে। 

ব্যাপারটা এত দ্রুত এভাবে ঘটবে ভাবতে পারেনি জারা। এ রকম একটা মুহূর্ত আসবে তার জীবনে, যেখানে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ নেই। এতদিন নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে এলেও আজকের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আগে কখনো। এ অবস্থায় যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সে।


জারাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে আরও এক ঘণ্টা আগে। 
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে সেই কবে। রাস্তাজুড়ে রাতের অন্ধকার জেঁকে বসেছে। সেই অন্ধকার ভেদ করে হেডলাইটের তীব্র আলো ছড়িয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটছে গাড়িটা। গাড়িতে তার দুপাশে দুজন শক্তসমর্থ গড়নের নারী। তাদের পরনেও প্যান্টশার্ট। দেখেই বোঝা যায়, তারাও একই বাহিনীর সদস্য। এখন কোনো নারীকে আটক করতে গেলে সেই অভিযানে নারী সদস্য রাখা হয়। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা নিয়ম হয়ে গেছে এখন। একসময় এমনটা ছিল না।

ঢাকার উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনায় জারা শাহরিন খানকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। আরও আগে থেকেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। জারাকে আটকের ব্যাপারে শুরু থেকে তৎপর ছিল পুলিশ। তবে এতদিন তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি প্রভাবশালী মহল নানাভাবে চেষ্টা করে গেছে, যাতে সে আটক না হয়। কিন্তু দেশজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতেই অনেকটা চাপে পড়ে পিছু হটে এসেছে সেই প্রভাবশালী মহলটি।

গাড়িতে জারা ছাড়াও আরও কয়েকজন যাত্রী থাকলেও তারা কেউ তেমন কথা বলছে না। এক ধরনের অসহ্যকর নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে এখানে। এসি গাড়ির সব জানালা বন্ধ রয়েছে। বাইরে কোনো শব্দ আসছে না। আশপাশে ছুটে চলা অন্যান্য গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির হর্নের ক্ষীণ শব্দ কানে এলেও সেটা জেঁকে বসা নীরবতাকে যেন দূর করতে পারছে না।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে এসেছিল জারা। লেখাপড়া শেষে নিজেকে যোগ্য করে তোলার পর ভালো একটি চাকরিতে ঢোকার স্বপ্ন ছিল; যা তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা দেবে। সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে চলার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা জারাকে সেই অবস্থা থেকে যোজন যোজন দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মফস্বল শহর থেকে আসা মেধাবী, স্বপ্নবাজ, ভালো মেয়েটি মোহনা থেকে জারায় পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা তাকে স্বপ্ন দেখা সেই পথ থেকে সরিয়ে ভিন্ন আরেক জগতে নিয়ে এসেছে। যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে দুঃস্বপ্ন। ভোগ-বিলাস, আনন্দ, অর্থবিত্তের বাসনা, লোভ-লালসা ইত্যাদি কেবল মরীচিকার মতো চারদিকে ছুটে বেড়ায়, মোহজাল সৃষ্টি করে। যার পেছনে ছুটতে গিয়ে পদে পদে অবক্ষয়, বিকৃতি, বীভৎস লালসার শিকার হতে হয়, নিজের বিবেক, মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। গত কয়েকটি বছর সেই অন্ধকার একটি জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কুৎসিত একটি পৃথিবীকে দেখে দেখে নিজের প্রতি চরম ঘেন্না ধরে গেছে। তার অপরাধ আর পাপের বোঝা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে। যা বইতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। 

ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছে, কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে ডিবির লোকগুলো বলেছে। এটা তো স্রেফ একটি কেস। এ রকম আরও বহু ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার প্রমাণ পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে রয়েছে। যা এতদিন নানা উপায়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি কেসে ধরা পড়লে বাকিগুলো এমনিতেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ রকম একটি পরিণতির অপেক্ষায় ছিল সে এতদিন। যদিও এ রকম কিছু তার কাম্য ছিল না। এই পৃথিবীতে কাম্য না হলেও, না চাইলেও অনেক কিছু ঘটে যায়। নানাভাবে চেষ্টা করলেও যা ঠেকানো সম্ভব হয় না। 

জারা নিজের পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে কেমন যেন দার্শনিক হয়ে ওঠে। এমন একটি পরিস্থিতিতেও তার হাসি পায় ভীষণ। মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গাড়িতে থাকা ডিবির নারী-পুরুষগুলো কী মনে করে, ভেবে নিজের হাসিটা চেপে রাখে। আগামীকালের দৈনিক পত্রিকায় তাকে আটক করার ছবি ও রিপোর্ট ছাপা হবে। টিভি চ্যানেলের, অনলাইন পোর্টালের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে অপরাধী হিসেবে। তার পর তা টিভি পর্দায়, ইউটিউবে দেখানো হবে। আজকাল সাধারণত এমনই হয়। তার বেলাতেও তাই হবে। এ আর নতুন কী? 

রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর, সবুজ বনবনানী, ধান খেত, নদী, খাল-বিল পেছনে ফেলে জারাকে বহনকারী সাদা মাইক্রোবাসটি তীব্র গতিতে ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কতক্ষণে ঢাকা শহরের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে নিরাপদে পৌঁছবে, তেমন ভাবনা মধ্যবয়সী গাড়িচালকের। পথে কোনোরকম দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয়- তাই খুবই সাবধানী হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে মানুষটা। সবদিক সতর্ক হয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে তাকে। 

এতদিন ঢাকা শহরটাকে এক মায়ার শহর ভেবে এসেছে জারা। এখানে যারা পা রাখে, তারা কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে যায়। একসময় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই মোহে জড়িয়ে পড়ে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়। মায়ানগরীর সেই মোহ ধ্বংসের মুখে নিয়ে দাঁড় করানোর আগে উপলব্ধি হলেও তখন আবার শিকড়ে ফেরার তীব্র ইচ্ছে জাগে। ইচ্ছে কিংবা সাধ জাগলেও আর ফেরার উপায় বা সুযোগ থাকে না সে সময়। সেই নরকেই পুড়ে মরতে হয়। শেষ পরিণতিকে মেনে নিতে হয় বাধ্য হয়েই।

নতুন ধানের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
নতুন ধানের ঘ্রাণ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ভাবনার ভিতর একমুঠু ভাত
মগ্নরাতে কৃষকের হাহাকার।

রাত্রি ডোবে কালোর গভীরে
বিঘা বিঘা জমিতে সোনালি ধান।

ক্ষুধার্ত শরীর ঘামে জবজব 
মাঠে কৃষক হৃদয়ে প্রতিবাদ। 

একজোড়া পায়ে কী অসীম শক্তি
বুকজুড়ে নতুন ধানের ঘ্রাণ। 

লাঙল কাঁধে কৃষক হাঁটে 
ধানি জমিজুড়ে ভাটিয়ালি গান।

ওহ্‌ হৃদয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
ওহ্‌ হৃদয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ঝড়ের স্মৃতিতে অবাঞ্ছিত প্রাঙ্গণে
বিষাদের কফিন খুলে সঙ্গোপনে 
বিগতবেলার যে ঘ্রাণ নিচ্ছ 
তাতে বিষাক্ত কীট, বিক্ষত পরাগরেণু
ঝরে যাচ্ছে গোলাপ পাপড়ি।

আহত পাখির পালকে বিরচিত সৌধে
পরাজিত মুহূর্তরা স্তরে স্তরে,
নদীর ভালোবাসা ছেড়ে পতিত মাছ
তীব্র তৃষ্ণায়, তবু জলের দ্রাঘিমায়
সমাপ্তি টেনে আশ্রয় নেয় মধ্যাহ্নে। 
 
এতটা কার্বন অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে
রুগ্নদিন শেষে অন্ধকারে নোঙর ফেলে
বুকের উত্তাপে পুড়ছে আত্মহনন নেশায়।


ওহ্‌ হৃদয়! কেন খরাক্রান্ত নগর ঘুরে
তৃষ্ণা পুষে রাখো বুকের করিডোরে।

দখলি দিগন্তে রক্তজবার পাণ্ডুলিপি
ক্ষরণের গোধূলি চুয়ে পড়ে পড়ন্ত সূর্যে।
অনিদ্রার নিশানা উড়িয়ে
দীর্ঘ করা রাতে যখন নক্ষত্র কাঁদে 
বেদনা আছড়ে পড়ে আঙিনাজুড়ে। 

ওহ্ হৃদয়! কেন ধূমায়িত হয়ে থাকো
অনেক শূন্যতার আকাশ হয়ে।