ঢাকা ৪ মাঘ ১৪৩১, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

রিং রোড

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৫ পিএম
আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৬ পিএম
রিং রোড
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সড়কের মাঝখানে সড়কদ্বীপ। অভিন্ন একটি সড়ককে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে এই দ্বীপ। ফলে একদল গাড়ি এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে। আরেক দল ওদিক থেকে এদিকে। সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে রয়েছে সড়কবাতির একটি সরু স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের চূড়ায় দুই হাত দুই দিকে মেলে আছে দুটি বাতি। সন্ধ্যা হলে শহর কর্তৃপক্ষের লোকজন সুইচ টিপে দেবে। জ্বলে উঠবে পাখির মতো ডানা মেলে থাকা বাতি দুটি। সড়কবাতির এই স্ট্যান্ডের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য যেকোনো মানুষকে স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেবে। তীব্র রোদ ও তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডটি এক স্বাধীন সত্তার গল্প বলছে। বলছে, আমি বন্ধনহীন। যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা কিনতে রাজি আছি।

সড়কবাতির এই ভাবনা দেখে আগন্তুক পাখি হাসে। উড়ে যেতে যেতে পাখি ভাবে- সড়কদ্বীপের মাঝে দাঁড়িয়ে বন্ধনের সত্য স্বীকার করেও স্বাধীনতার গৌরব করে সড়কবাতি।

সামনে যেতে যেতে সড়ক দীর্ঘ হয়। সড়কের সঙ্গে দীর্ঘ হয় সড়কবাতির দল। সড়কবাতি সঙ্গে নিয়ে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে। সাতমসজিদ রোডে বৃষ্টি নেমে আসে। সন্ধ্যার এই বৃষ্টি বেরসিক। মানুষের ঘরে ফেরার তীব্র তাগিদকে সে হেয়ালি করে। সড়কের মতোই বৃষ্টির ফলা সরু ও তীক্ষ্ণ। গাড়ির হেডলাইটে বৃষ্টির এই তীক্ষ্ণতা ঠাহর হয়।

সান্ধ্য বৃষ্টিতে রিং রোডমুখী গাড়ির বহর সড়কে আটকে যায়। পৃথক নম্বরপত্র নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষা গাড়িবহরের। অথচ একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিটি গাড়ির ভেতরে গল্প চলছে। নম্বরপত্রের মতো পৃথক গল্প। গাড়ির নম্বরপত্র দেখে গাড়ির দৌড়ের গতি, গাড়ির দম ও দাম অনুমান করা গেলেও গাড়ির ভেতরের গল্প আঁচ করা যায় না।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একেকটি গাড়ি যেন একেকটি বাবল হয়ে ভেসে আছে। বাবলগুলোর ভেতর ভিন্ন গল্প ঘুরে ফিরছে। আজ সন্ধ্যার সবগুলো গল্প রিং রোড অভিমুখী। অথচ এখনো একটি গাড়িও না পেল শাহাজাহান রোডের দেখা, না পেল তাজমহল রোড।

ঢাকা মেট্রো-গ ৪৪-১৩০-২৩।

-ফিলিস্তিনে কতকাল মার খাবে মানুষ, এভাবে কতকাল দুধের শিশুর রক্ত ঝরবে, কতকাল রাষ্ট্রহীন থাকবে তারা? হাতে থাকা পত্রিকার কপি ভাঁজ করে রেখে প্রফেসর সহকর্মীকে বলেন নীলিমা নিলোর্মি। পত্রিকার প্রথম পাতায় চার কলামে ছাপা হওয়া গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত দুই শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে গোরস্থানের দিকে ধাবমান পিতার ছবি প্রফেসর নীলিমার চোখে ভাসছে। 

-ইসরায়েলের সঙ্গে পারবে না জেনেও ওরা কেন মৌচাকে ঢিল ছোড়ে। জীবনের চেয়ে রাষ্ট্র ধারণা এত তীব্র হবে কেন মানুষের? প্রফেসর রেহমান জামিল অনুযোগের সুরে বললেন। 

-আমি ফিলিস্তিনিদের এই লড়াইকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখি। মুসলমান বনাম ইহুদির কোনো ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নয়। প্রফেসর রেহমানের কথায় যেন কিছুটা চোট পেয়েছেন নিলোর্মি। অসন্তোষ নিয়ে জবাব দিলেন তিনি।

-শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম ও প্রধান অন্তরায়। এই দখলদারি, হানাহানি ও রক্তপাত তাদের শতবর্ষী প্রজেক্ট। কায়সার জামিল এই যুদ্ধকে বহুকাল জিইয়ে থাকা বিবাদের ধারাবাহিকতা বলতে চান। 

-দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকায় রক্তের বন্যা বইয়ে চলেছে। তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত। নিলোর্মি ফের বললেন। নিষ্ঠুর রক্তারক্তির সঙ্গে অন্য কিছু জড়িয়ে তিনি এই বর্বরতাকে হালকা করতে নারাজ। 

-যুদ্ধই তো এক মস্ত অপরাধ। এতে আবার আলাদা যুদ্ধাপরাধ কী? রেহমান জামিল শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।  

-ভিটেমাটি ছেড়েও প্রাণে রক্ষা হচ্ছে না। নিরীহ মানুষ তো কোনো অন্যায় করেনি। হানড্রেড ইয়ারস অব হিউমিলিয়েশন। হতাশার সুর আছড়ে পড়ল প্রফেসর নিলোর্মির কণ্ঠে। 

প্রফেসর রেহমান এবার বললেন, মার খেলেও ফিলিস্তিনের লড়াইটা সুন্দর। এখানে ধর্মীরা লড়ছে, ধর্মে আস্থাহীনরা লড়ছে, ডান লড়ছে, বামও লড়ছে। সবাই একসঙ্গে। স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিরা বন্দুক থেকে সাধ্যমতো গুলি ছুড়ছে, কবিতাও লিখছে। 

থেমে থেমে গাড়ি দশ-বিশ মিটার সামনে চলছে। বৃষ্টির তীব্রতা কমার লক্ষণ নেই। 

ঢাকা মেট্টো-ঘ ৪৫-০৬৭-৯৮।

পুরো পরিবার নিয়ে কলাবাগান গিয়েছিলেন কিরণ কিশোয়ার। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক। ফেরার পথে সবার জন্য বার্গার কিনে নিয়েছেন তিনি। এভাবে সপরিবারে বৃষ্টি আর বার্গার উপভোগ্য। খেতে খেতে কেশে উঠলেন তিনি। স্ত্রী শায়লা কিশোয়ার তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। এবার তাদের বড় ছেলেটিরও কাশি পেল।
 
-তোমাদের বাপ-ছেলের কী হলো? শায়লা কিশোয়ার টিপ্পনি কেটে বললেন। 

-বর্ষাকালে আমার পুরনো অ্যাজমা বেড়ে যায়। তাছাড়া বয়স বাড়ছে তো। একটু-আধটু জটিলতা শুরুর সময় এখন। 

-বয়স কি তোমার ছেলেরও বেড়েছে নাকি? কিরণ কিশোয়ারের কথায় প্রতিত্তোর করলেন স্ত্রী শায়লা। 

-বাবা, কাশি হলে আমি এক অদ্ভুত গন্ধ পাই। আই মিন, আমার কাশির স্মেল।

-কেমন স্মেল? ছেলে শমসের কিশোয়ারের এমন কথা শুনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন মা শায়লা কিশোয়ার। 

-কাশির সঙ্গে সঙ্গে আমার নাকে কাঁচা ইলিশের গন্ধ ভেসে আসে। আমি বেশ কয়েকদিন লক্ষ করেছি। শমশের কিশোয়ার নির্মোহ কণ্ঠে বলল, তার কথায় উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র নেই।

কিশোর কিশোয়ারের মুখে এমন আজব কথা শুনে স্বামীর দিকে চেয়ে শায়লা বললেন, এমন হচ্ছে কেন? 

-ডাক্তার সাহেব ভালো বলতে পারবেন। নির্ভাবনায় স্ত্রীকে উত্তর দিলেন কিরণ কিশোয়ার।

-এমন কথা তো কোনোদিন শুনিনি। তোমার কী মনে হয়? এমন হচ্ছে কেন?

-তোমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে গতবছর চাঁদপুর থেকে আধা মণ ইলিশ এনে দিয়েছিল আমার অফিসের স্টাফ ছেলেটি।

-হ্যাঁ। ইলিশ খেলে কাশি থেকে ইলিশের স্মেল আসবে কেন? ইলিশ আমরা সবাই খেয়েছি। তাছাড়া শমশের তো কাঁচা ইলিশ খায়নি।

-বিষয়টি জটিল করছ কেন? মৃদু বিরক্তির সুরে স্ত্রী শায়লাকে বললেন কিরণ। 

-তাহলে তুমি গত বছরের ইলিশের কথা তুললে কেন? শায়লা এবার আরও উৎকণ্ঠিত হলেন।

-দেখ। ছেলেটি লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের ইলিশ এনে দিয়েছিল। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষেধ। অথচ তখন একঝাঁক মা ইলিশ আমরা বাড়িতে এনেছি। মাছগুলোর পেটভর্তি ডিম ছিল। প্রকৃতির বিচার বলেও তো কিছু আছে!

স্বামীর এমন কথা শুনে শায়লা বেকুব বনে গেলেন, বললেন, তাহলে তোমার-আমার অসুবিধা হোক। ছেলের হবে কেন? 

-প্রকৃতি কাকে ব্যথা দিয়ে কী প্রতিশোধ নেবে- তা তুমি-আমি ঠিক করে দিতে পারি?

কাশির স্মেলের সঙ্গে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ভক্ষণের সম্পর্ক নির্মাণ দেখে শায়লা কিশোয়ার এবং শমসের কিশোয়ারের অবাক না হয়ে উপায় থাকল না। স্ত্রী-পুত্রকে অবাক করে দিয়ে নিজেও সম্ভবত হতভম্ব হলেন কিরণ কিশোয়ার।

অপেক্ষমাণ একদল গাড়ি বৃষ্টি থেমে গেলে রিং রোডে উঠবে। অথচ বৃষ্টি বিরতির কোনো লক্ষণ নেই। গাড়ির সঙ্গে দূরত্ব মেনে দাঁড়িয়ে আছে রিকশা, কাভার্ড ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি। মোটরসাইকেল আরোহীদের কেউ অবশ্য বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। কোনোভাবে স্পেস বের করে ছুট দিয়েছে। হুড তুলে ঊরুর ওপর পলিথিন চেপে বসে থাকা রিকশা আরোহীর আজ গল্পের সঙ্গী নেই। বারিধারায় স্তব্ধ হয়ে বিরক্তি ভাব নিয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। এদের কেউ হয়তো ভাবছেন- বাড়ি ফেরার তাগাদা না থাকলে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগত।

-বাসা কোথায় আপনার? নিজের একাকিত্ব ভাঙতে রিকশা আরোহী রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলেন। 

রিকশাচালক উত্তর দিলেন, জলঢাকা।

-হ্যাঁ। এখন তো জলে ঢেকে আছি। আমি বলছি, ঢাকায় কোথায় থাকেন? 

-বসিলা ব্রিজ এলাকায়। 

-কতদিন যাবৎ এই পেশায় আছেন? 

-দেড় বছর। 

-এর আগে কী করতেন? 

-কিছুদিন রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি।

-ছাড়লেন কেন? রিকশা আরোহীর প্রশ্ন শুনে এতক্ষণে বিরক্ত হলো রিকশাচালক। উত্তরে বললেন, কাজ করিয়ে যথাযথ পারিশ্রমিক না দেওয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো। 

-আপনি ইতিহাস পড়েছেন? 

-পড়তে হবে কেন? আমার সঙ্গে গতকাল যা ঘটেছে আজ তা ইতিহাস হবে না?
 
-পড়াশোনা করেছেন কতদূর?

-এখনো আইয়ে পাস। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর পড়েছিলাম। কম্পিউটার সায়েন্সে। খরচ জোগাতে না পেরে ছেড়ে দিছি। আমার পিঠে যে কোম্পানির নাম দেখছেন এটা আমার স্টার্টআপ। ফেইল করছে। মেলা টাকা লস দিসি। এখন রিকশা চালাই।

-ও। এটি আপনার নিজের কোম্পানির প্রমোশনাল টি-শার্ট। কীসের স্টার্টআপ এটি?

-দৈনন্দিন পণ্য ডেলিভারির। অ্যাপটি এখনো প্লে স্টোরে পাবেন। 

-কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি? অনেকে তো স্টার্টআপের ভালো আইডিয়ায় ফান্ডিং করে।

-করেছি। অনেকে আশা দিছে। বহুদিন ঘুরাইছে। 

-পরে আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি?

-কেন, ফিল্ম দেখেন নাই? ওখানে বলে যে- যোগাযোগ হলো অভ্যাস, অতি যোগাযোগ বদঅভ্যাস। 

-কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো হলো না। লেগে থাকুন, একদিন নিশ্চয়ই হবে।

-হবে হয়তো। দেখুন, আমার এই স্বপ্নটা এক টুকরা মাংসের মতো। আনমনে চিবুচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ আয়েশ করে চিবুবো। কিন্তু হঠাৎ আমার অনিচ্ছায় গলা দিয়ে নেমে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু তো টুকরাটি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। 

ঢাকা মেট্টো-গ ১৩-১২০-২৪।
 
অফিস শেষে বিকেলে বাসায় ফেরার কথা ছিল রায়হানের। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরাকে বলে এসেছেন- প্রয়োজনে বসের সঙ্গে কথা বলে অফিস থেকে খানিকটা আগে বের হবেন। রায়হান একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস গ্রাজুয়েট। একটি টেলিকম কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হিসেবে দুই বছর ধরে চাকরি করছেন। তিন বছর প্রেমের পর তাদের বিয়ে হয়। আজ বিয়ের প্রথম বার্ষিকী। এমন দিনেও ঢাকার ট্রাফিক ও বৃষ্টি সড়কে আটকে দিয়েছে রায়হানকে। বিকেলে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়েছে। এখন রাতে লা-ব্রিস্টলে বাফেট ডিনার ক্যানসেল হওয়ার পথে। গাড়িতে বসে কয়েক দফা ফোনে কথা বলে পরিস্থিতি অবহিত করে অন্তরাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন রায়হান। কিছুক্ষণ পরে রায়হানের হোয়াটসঅ্যাপে অন্তরার টেক্সট এল।

-আজকের দিনেও কথা রাখতে পারলে না। সঙ্গে হৃদয় ভাঙা ইমোজি। 

-ভুল বুঝ না প্লিজ। রোডে ডেডলকড হয়ে আছি। এমন হওয়ার কথা ছিল না। যত দ্রুত সম্ভব আমি ফিরছি। 

হাত জোড় ইমোজির সঙ্গে রায়হানের টেক্সট অন্তরার অভিমান কমাতে পারেনি, তা স্পষ্ট হলো অন্তরার ফিরতি মেসেজে। অন্তরা লিখল, তার পর মন ভেঙে গেলে কাচের টুকরোর মতন পাশাপাশি সাজিয়ে দেখি- ফের যদি জোড়া লাগে।  

তুমুল অপরাধবোধ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঘিরে ফেলল রায়হানকে। বাইরে তখনো বৃষ্টি।

একগুচ্ছ গল্প রিং রোডে উঠে ফের পূর্বের স্থানে ফেরে। রোদ-বৃষ্টিতে রোজ ঘুরপাক খায় অবিরাম।

মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া
কিংবদন্তির ভাগীরথী

শিরোনামে যাকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছি, তিনি এ বিষয়ে, মানে কথাসাহিত্যে আর পাঁচজনের মতো নন, বরং বেশ ব্যতিক্রমী এক মেধা। বিগত চার দশকে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত সৃষ্টিশীল প্রকাশসহ, গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে একের পর এক যে অবদান রেখে চলেছেন। 

ভাষার অধিকার নিয়ে জাতির আন্দোলনে যেমন নারী তার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তেমনি দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালে নারীর ওপর নির্যাতন, শেষে চরম আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নারীদের এক অসামান্য উদাহরণ হয়ে থাকবে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা আরেক নারী চরিত্র, ভাগীরথী। কিংবদন্তির ভাগীরথী সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্ট উপন্যাস। 

রাতের অন্ধকারে রাজাকার সুলতান মাহমুদের সহায়তায় পাকিস্তানি পিশাচ সৈন্যরা পিরোজপুর শহরের বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের নারীদের কী এক অজানা বিকৃত চিন্তায় বেশি করে টার্গেট করা হয়। ভাগীরথী তেমনি এক অল্প বয়েসী, পাঁচ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তান, লালশ্যামের মা। ঘনশ্যাম তার স্বামী একজন মুচি। ক্যাপ্টেন আলী মোহাম্মদ হাত বাড়ায় ভাগীরথীর দিকে। ভাগীরথীর চওড়া কাঁধের ওপর আলী মোহাম্মদ কঠোর হাত রাখে। ঘাড় ফিরে দেখে ভাগীরথী নিজের কাঁধটা দখল হয়ে গেছে (পৃ: ১৫, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। এতক্ষণ নির্জীব ঘনশ্যাম দৌড়ে এসে সুলতান মাহমুদের দুই পা জড়িয়ে ধরে- সুলতান দাদা, আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান। আপনেগো সব জোতা মুই সেলাই কইরা দিমু। আপনেগো সব জোতা কালি কইরা দিমু। আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান (পৃ: ১৫-১৬, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। কিন্তু রাজাকার সুলতান মাহমুদ আর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তো একথা শোনার মানুষ নয়। পিরোজপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পে মেজর ইসকান্দার হায়াৎ খানের যৌন লালসার শিকার আরও অগুনিত নারীর পরিণতি হয় ভাগীরথীরও পরিণতি। 

একদিন সুযোগ আসে। ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগের হৃদয় গলিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় ভাগীরথী। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। বরং স্বামী ও প্রতিবেশীরা তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ভাগীরথী আবিষ্কার করে, সে আর কোনোদিন তার পুরনো স্বাভাবিক সংসারে ফিরে যেতে পারবে না।

ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় একদল মুক্তিসেনার সঙ্গে। তাদের সমবেদনা ভাগীরথীকে অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করার কাজে। নিজের জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে ভাগীরথী যে তথ্য দেয়, মুক্তিসেনারা তাতে কয়েকটি সফল অপারেশন করতে পারে। এতে পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগসহ পঞ্চাশজন সৈন্য নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। 

উপন্যাস কিংবদন্তির ভাগীরথী জাদুকরী কথাসাহিত্যিক, অথবা বলা যায় কথাসাহিত্যের জাদুকর রঙের তুলিতে নয়, শব্দচিত্র দিয়ে নির্মাণ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। বাজারে চলছে বইটির চতুর্থ মুদ্রণ। 

লেখক: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, কথাশিল্পী, কবি, অনুবাদক 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে
মাজহারুল ইসলাম

কেমন হতে পারে এবারের মেলা? 

এবারের বইমেলা ভালো হবে। পাঠক বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রতিদিন মেলায় আসবেন। পছন্দের লেখকের বই কিনবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। এই মেলার জন্য সারা বছর তারা অপেক্ষায় থাকেন। সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করবেন, সেলফি তুলবেন। সর্বোপরি পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবার অংশগ্রহণে একটি বইবান্ধব মেলা হবে। 

এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি বই প্রকাশ করছেন? 
এবার অন্যপ্রকাশ থেকে প্রায় অর্ধ শত বই প্রকাশিত হবে। 

উল্লেখযোগ্য বই কী কী? 

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে আল মাহমুদের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’, ‘সেরা পাঁচ উপন্যাস’, ড. মোহাম্মদ হাননানের ইতিহাসগ্রন্থ ‘ভাষার সংগ্রাম ১৯১৭-১৯৯৯ [হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সংগ্রামের ঐতিহাসিক আলেখ্য], এম আবুল কাসেমের ব্যতিক্রমী গবেষণাগ্রন্থ ‘চা-অর্থনীতি’, এম আবদুল আলীমের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ ছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের জনপ্রিয় ছোটকাকু সিরিজের ৪০টি বইয়ের সংকলন ‘ছোটকাকু চল্লিশ’। ৮০০ পৃষ্ঠার এই বইটি নিছকই একটি সংকলন নয়, এর আকারে যেমন অভিনবত্ব থাকবে, তেমনি প্রোডাকশনটি হবে ভিন্নমাত্রার। সব মিলে একটা সংগ্রহে রাখার মতো প্রকাশনা হবে এটি।

মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি? 

মেলাপ্রাঙ্গণ হবে এমন, যেন ক্রেতা-পাঠক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, সহজে চলাফেরা করতে পারেন। মেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন তা পাঠক ও প্রকাশকবান্ধব হয়। কেউ যেন কোনো সমস্যা বোধ না করেন। ধুলার সমস্যা দীর্ঘদিনের, একই সঙ্গে আলোর স্বল্পতা। আশা করি, এই বিষয় দুটি গুরুত্বের সঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটি সমাধানের চেষ্টা করবে। 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন কি? 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব নতুন কিছু নয়। এই সংকট আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। দুঃখজনক সত্য হলো, ন্যূনতম মানহীন কিছু পাণ্ডুলিপিও বই আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা আসলে সামগ্রিক দুর্বলতারই অংশ। অনেক ক্ষেত্রে  আমরা এগিয়েছি, এটা যেমন সত্য, তেমনি নতুন লেখক সৃষ্টিতে কিংবা মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে আমাদের এখনো অনেক কিছু করা বাকি। সাহিত্যের চর্চা, এর পঠনপাঠন বাড়ানো গেলে, সংস্কৃতিমনস্কতার উন্নতি হলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।

মেলায় কী ধরনের বই বেশি বেচা হয়? 

গল্প-উপন্যাস, থ্রিলার, ভ্রমণকাহিনি। ইদানীং ননফিকশনাল বইও বেশ বেচা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মউন্নয়নমূলক বইয়েরও চাহিদা রয়েছে।

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

মাজহারুল ইসলাম 
প্রধান নির্বাহী, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

ফেরার পথ নেই

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
ফেরার পথ নেই
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

এই শহরে আগেও অনেকবার এসেছে জারা। এখানে প্রায়ই বড় বড় আয়োজনের বিয়ে, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর জমকালো অনুষ্ঠান থাকে। আবার দীর্ঘদিন লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায় থাকার পর দেশে ফেরা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গেট-টুগেদার আয়োজন করে কেউ কেউ। এবারও তেমন একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে নিজের টিম নিয়ে এসেছে জারা। এ ধরনের অনুষ্ঠানে খানাপিনার সঙ্গে ডিজে পার্টি, মিউজিক্যাল নাইটের আয়োজন থাকে। বেশ কয়েক মাস আগেই শিডিউল ঠিক করা ছিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে গোলাপগঞ্জে লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে জমকালো গেট-টুগেদার অনুষ্ঠান। শহরের বাইরে হলেও জায়গাটা অনেক উন্নত। এবার প্রোগ্রাম করতে এলেও ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে জারা। এক ধরনের অস্বস্তি বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে। প্লেনে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। ক্লান্তির প্রশ্নই ওঠে না। তার পরও নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।

ঢাকায় থাকতেই জারা জেনেছে, উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টিতে মাদক আর বিষাক্ত ভেজাল মদ খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের আটক করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় সংসদে সবাই একমত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। শাহবাগ, টিএসসি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। ফলে এ ইস্যুটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশজুড়ে মাদককারবারি, চোরাচালানি, সরবরাহকারীদের ধরতে শক্ত অভিযান চলছে। কেউ ছাড়া পাচ্ছে না। আটক করে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে কয়েকটি ক্রসফায়ারের ঘটনা এসব কাজে জড়িতদের মনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে সে রাতের ডিজে পার্টি আয়োজনের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে থাকা সবার নাম পুলিশ ও সিআইডি এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তালিকা ধরে তাদের খোঁজ চলছে। ঢাকা ছেড়ে অন্য শহরে কিংবা গ্রামে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে। সেই তালিকার প্রথমদিকেই ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক বিখ্যাত ডিজে গার্ল জারা শাহরিন খানের নামটি রয়েছে। 

প্রভাবশালী কয়েকজন হোমরাচোমরা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যের কারণে সে নানাভাবে বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা-প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এতদিন। বেশ কয়েকবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেও সেই হোমরাচোমরাদের বদান্যতায় উদ্ধার পেয়েছে জারা। কিন্তু এবার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনাটিতে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তালিকা থেকে তার নামটি যেকোনোভাবে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পর কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পারেনি। সবাই একটাই কথা বলেছে, এ কেসটি অন্য সব কেস থেকে আলাদা। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে চাপ রয়েছে- অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবে পার পেয়ে না যেতে পারে। সবাইকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেকোনো মূল্যে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কারও জন্য তদবির, সুপারিশ করার একদম সুযোগ নেই। তেমন পরিস্থিতিতে কখন যে কী ঘটে যায়- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। 

বুকের মধ্যে অনেক অস্বস্তি চেপে বসেছে। কিছুতেই সেটাকে সরাতে পারছে না। সারাক্ষণ একটা ভয়, আতঙ্কভাব তাড়া করে ফিরছে তাকে। গত কয়েক দিন ধরে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে ছিল সে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও দুচোখে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ একটু তন্দ্রাভাব এলেও পরক্ষণেই তা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ রকম একটি অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ খুঁজছিল জারা। 

আরও কয়েক মাস আগেই সিলেটে একটি প্রোগ্রামের কথাবার্তা ফাইন্যাল হয়েছিল। প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দিতে পারত সে। কিন্তু একটুখানি প্রশান্তির আশায় ঢাকার বাইরে দূরে কোথাও চলে যেতে মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এ কারণেই প্লেনে চড়ে সোজা সিলেট চলে এসেছে। এখানে যাদের বাড়িতে প্রোগ্রাম, তারাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তাদের নিজস্ব গাড়িতে হোটেলে এনেছে। দামি বিলাসবহুল লাক্সারি স্যুটে জারার

থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। 
নিজেকে আরও রিফ্রেশ করতে বাথটাবে হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ শরীরটা ডুবিয়ে রেখেছে। এতে কিছুটা কাজ হয়েছে। হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শরীরটা ডুবিয়ে রাখার পর কিছুটা প্রশান্তিবোধ করায় আয়োজকদের ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলেছে জারা। আজ রাতে যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে সেখানে গিয়ে সবকিছু দেখতে চায় সে।

ছবির মতো চমৎকার সুন্দর বিলেতি ডিজাইনের একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়িটি থামে। এই বাড়িতেই আজ অনুষ্ঠান। দীর্ঘদিন লন্ডন, কানাডায় থাকা কয়েকটি পরিবার দেশে বেড়াতে এসেছে। দেশে এসে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছে। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গানবাজনা, ডিজে পার্টির ব্যবস্থা করেছেন তারা। 

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে তৈরি করা স্টেজের দিকে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় জারার। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা একজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে না ফেললে মাটিতে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটত নিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে কিছুটা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়। তাহলে কি এখানে তার জন্য কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে? যার আগাম সংকেত হলো হঠাৎ এই হোঁচট খাওয়া! সাধারণভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেলে অনেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করে মনে মনে। কুসংস্কার হলেও তেমন বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলা থেকে এ রকম কিছু ঘটলে কাছাকাছি মা থাকলে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, মায়ের দোয়া সঙ্গে থাকলে কোনো বালা-মুসিবত, বিপদাপদ কাছে আসতে পারবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত কদিন ধরে এক ধরনের অস্থিরতা তাড়া করে ফিরছে তাকে। এক ধরনের অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময় কাটছে।

স্টেজে উঠে চারপাশে তাকাতেই জারা দেখতে পায়, বাড়ির সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে। এ রকম গাড়ি তো আজ অনেক আসছে এ বাড়িতে। অতিথিরা যে যার মতো গাড়ি নিয়ে আসছেন। কিন্তু সাদা মাইক্রোবাস থেকে নামতে থাকা মানুষগুলো সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরা হলেও তাদের কয়েক জনের গায়ে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট দেখে ভয়ে, আশঙ্কায় তার সারা শরীরে হালকা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। দেখেই বোঝা যায়, এই লোকগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গাড়ি থেকে নেমে তারা এ বাড়ির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে- এতদূর থেকে শোনা না গেলেও এ বাড়ির মানুষজন লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্টেজের দিকে হাতের ইশারা করছে, দেখতে পায় সে। তাদের কথোপকথনের ধরন দেখে এখানে থাকা কারও কথা আলোচনা করছে বোঝা যায়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকগুলোর হাতে অস্ত্র দেখা যায়। তারা সবাই এদিকেই এগিয়ে আসছে দৃঢ় পদক্ষেপে। 

ব্যাপারটা এত দ্রুত এভাবে ঘটবে ভাবতে পারেনি জারা। এ রকম একটা মুহূর্ত আসবে তার জীবনে, যেখানে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ নেই। এতদিন নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে এলেও আজকের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আগে কখনো। এ অবস্থায় যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সে।


জারাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে আরও এক ঘণ্টা আগে। 
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে সেই কবে। রাস্তাজুড়ে রাতের অন্ধকার জেঁকে বসেছে। সেই অন্ধকার ভেদ করে হেডলাইটের তীব্র আলো ছড়িয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটছে গাড়িটা। গাড়িতে তার দুপাশে দুজন শক্তসমর্থ গড়নের নারী। তাদের পরনেও প্যান্টশার্ট। দেখেই বোঝা যায়, তারাও একই বাহিনীর সদস্য। এখন কোনো নারীকে আটক করতে গেলে সেই অভিযানে নারী সদস্য রাখা হয়। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা নিয়ম হয়ে গেছে এখন। একসময় এমনটা ছিল না।

ঢাকার উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনায় জারা শাহরিন খানকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। আরও আগে থেকেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। জারাকে আটকের ব্যাপারে শুরু থেকে তৎপর ছিল পুলিশ। তবে এতদিন তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি প্রভাবশালী মহল নানাভাবে চেষ্টা করে গেছে, যাতে সে আটক না হয়। কিন্তু দেশজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতেই অনেকটা চাপে পড়ে পিছু হটে এসেছে সেই প্রভাবশালী মহলটি।

গাড়িতে জারা ছাড়াও আরও কয়েকজন যাত্রী থাকলেও তারা কেউ তেমন কথা বলছে না। এক ধরনের অসহ্যকর নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে এখানে। এসি গাড়ির সব জানালা বন্ধ রয়েছে। বাইরে কোনো শব্দ আসছে না। আশপাশে ছুটে চলা অন্যান্য গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির হর্নের ক্ষীণ শব্দ কানে এলেও সেটা জেঁকে বসা নীরবতাকে যেন দূর করতে পারছে না।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে এসেছিল জারা। লেখাপড়া শেষে নিজেকে যোগ্য করে তোলার পর ভালো একটি চাকরিতে ঢোকার স্বপ্ন ছিল; যা তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা দেবে। সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে চলার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা জারাকে সেই অবস্থা থেকে যোজন যোজন দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মফস্বল শহর থেকে আসা মেধাবী, স্বপ্নবাজ, ভালো মেয়েটি মোহনা থেকে জারায় পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা তাকে স্বপ্ন দেখা সেই পথ থেকে সরিয়ে ভিন্ন আরেক জগতে নিয়ে এসেছে। যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে দুঃস্বপ্ন। ভোগ-বিলাস, আনন্দ, অর্থবিত্তের বাসনা, লোভ-লালসা ইত্যাদি কেবল মরীচিকার মতো চারদিকে ছুটে বেড়ায়, মোহজাল সৃষ্টি করে। যার পেছনে ছুটতে গিয়ে পদে পদে অবক্ষয়, বিকৃতি, বীভৎস লালসার শিকার হতে হয়, নিজের বিবেক, মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। গত কয়েকটি বছর সেই অন্ধকার একটি জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কুৎসিত একটি পৃথিবীকে দেখে দেখে নিজের প্রতি চরম ঘেন্না ধরে গেছে। তার অপরাধ আর পাপের বোঝা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে। যা বইতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। 

ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছে, কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে ডিবির লোকগুলো বলেছে। এটা তো স্রেফ একটি কেস। এ রকম আরও বহু ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার প্রমাণ পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে রয়েছে। যা এতদিন নানা উপায়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি কেসে ধরা পড়লে বাকিগুলো এমনিতেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ রকম একটি পরিণতির অপেক্ষায় ছিল সে এতদিন। যদিও এ রকম কিছু তার কাম্য ছিল না। এই পৃথিবীতে কাম্য না হলেও, না চাইলেও অনেক কিছু ঘটে যায়। নানাভাবে চেষ্টা করলেও যা ঠেকানো সম্ভব হয় না। 

জারা নিজের পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে কেমন যেন দার্শনিক হয়ে ওঠে। এমন একটি পরিস্থিতিতেও তার হাসি পায় ভীষণ। মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গাড়িতে থাকা ডিবির নারী-পুরুষগুলো কী মনে করে, ভেবে নিজের হাসিটা চেপে রাখে। আগামীকালের দৈনিক পত্রিকায় তাকে আটক করার ছবি ও রিপোর্ট ছাপা হবে। টিভি চ্যানেলের, অনলাইন পোর্টালের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে অপরাধী হিসেবে। তার পর তা টিভি পর্দায়, ইউটিউবে দেখানো হবে। আজকাল সাধারণত এমনই হয়। তার বেলাতেও তাই হবে। এ আর নতুন কী? 

রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর, সবুজ বনবনানী, ধান খেত, নদী, খাল-বিল পেছনে ফেলে জারাকে বহনকারী সাদা মাইক্রোবাসটি তীব্র গতিতে ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কতক্ষণে ঢাকা শহরের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে নিরাপদে পৌঁছবে, তেমন ভাবনা মধ্যবয়সী গাড়িচালকের। পথে কোনোরকম দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয়- তাই খুবই সাবধানী হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে মানুষটা। সবদিক সতর্ক হয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে তাকে। 

এতদিন ঢাকা শহরটাকে এক মায়ার শহর ভেবে এসেছে জারা। এখানে যারা পা রাখে, তারা কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে যায়। একসময় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই মোহে জড়িয়ে পড়ে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়। মায়ানগরীর সেই মোহ ধ্বংসের মুখে নিয়ে দাঁড় করানোর আগে উপলব্ধি হলেও তখন আবার শিকড়ে ফেরার তীব্র ইচ্ছে জাগে। ইচ্ছে কিংবা সাধ জাগলেও আর ফেরার উপায় বা সুযোগ থাকে না সে সময়। সেই নরকেই পুড়ে মরতে হয়। শেষ পরিণতিকে মেনে নিতে হয় বাধ্য হয়েই।

নতুন ধানের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
নতুন ধানের ঘ্রাণ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ভাবনার ভিতর একমুঠু ভাত
মগ্নরাতে কৃষকের হাহাকার।

রাত্রি ডোবে কালোর গভীরে
বিঘা বিঘা জমিতে সোনালি ধান।

ক্ষুধার্ত শরীর ঘামে জবজব 
মাঠে কৃষক হৃদয়ে প্রতিবাদ। 

একজোড়া পায়ে কী অসীম শক্তি
বুকজুড়ে নতুন ধানের ঘ্রাণ। 

লাঙল কাঁধে কৃষক হাঁটে 
ধানি জমিজুড়ে ভাটিয়ালি গান।

ওহ্‌ হৃদয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
ওহ্‌ হৃদয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ঝড়ের স্মৃতিতে অবাঞ্ছিত প্রাঙ্গণে
বিষাদের কফিন খুলে সঙ্গোপনে 
বিগতবেলার যে ঘ্রাণ নিচ্ছ 
তাতে বিষাক্ত কীট, বিক্ষত পরাগরেণু
ঝরে যাচ্ছে গোলাপ পাপড়ি।

আহত পাখির পালকে বিরচিত সৌধে
পরাজিত মুহূর্তরা স্তরে স্তরে,
নদীর ভালোবাসা ছেড়ে পতিত মাছ
তীব্র তৃষ্ণায়, তবু জলের দ্রাঘিমায়
সমাপ্তি টেনে আশ্রয় নেয় মধ্যাহ্নে। 
 
এতটা কার্বন অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে
রুগ্নদিন শেষে অন্ধকারে নোঙর ফেলে
বুকের উত্তাপে পুড়ছে আত্মহনন নেশায়।


ওহ্‌ হৃদয়! কেন খরাক্রান্ত নগর ঘুরে
তৃষ্ণা পুষে রাখো বুকের করিডোরে।

দখলি দিগন্তে রক্তজবার পাণ্ডুলিপি
ক্ষরণের গোধূলি চুয়ে পড়ে পড়ন্ত সূর্যে।
অনিদ্রার নিশানা উড়িয়ে
দীর্ঘ করা রাতে যখন নক্ষত্র কাঁদে 
বেদনা আছড়ে পড়ে আঙিনাজুড়ে। 

ওহ্ হৃদয়! কেন ধূমায়িত হয়ে থাকো
অনেক শূন্যতার আকাশ হয়ে।