সড়কের মাঝখানে সড়কদ্বীপ। অভিন্ন একটি সড়ককে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে এই দ্বীপ। ফলে একদল গাড়ি এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে। আরেক দল ওদিক থেকে এদিকে। সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে রয়েছে সড়কবাতির একটি সরু স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের চূড়ায় দুই হাত দুই দিকে মেলে আছে দুটি বাতি। সন্ধ্যা হলে শহর কর্তৃপক্ষের লোকজন সুইচ টিপে দেবে। জ্বলে উঠবে পাখির মতো ডানা মেলে থাকা বাতি দুটি। সড়কবাতির এই স্ট্যান্ডের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য যেকোনো মানুষকে স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেবে। তীব্র রোদ ও তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডটি এক স্বাধীন সত্তার গল্প বলছে। বলছে, আমি বন্ধনহীন। যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা কিনতে রাজি আছি।
সড়কবাতির এই ভাবনা দেখে আগন্তুক পাখি হাসে। উড়ে যেতে যেতে পাখি ভাবে- সড়কদ্বীপের মাঝে দাঁড়িয়ে বন্ধনের সত্য স্বীকার করেও স্বাধীনতার গৌরব করে সড়কবাতি।
সামনে যেতে যেতে সড়ক দীর্ঘ হয়। সড়কের সঙ্গে দীর্ঘ হয় সড়কবাতির দল। সড়কবাতি সঙ্গে নিয়ে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে। সাতমসজিদ রোডে বৃষ্টি নেমে আসে। সন্ধ্যার এই বৃষ্টি বেরসিক। মানুষের ঘরে ফেরার তীব্র তাগিদকে সে হেয়ালি করে। সড়কের মতোই বৃষ্টির ফলা সরু ও তীক্ষ্ণ। গাড়ির হেডলাইটে বৃষ্টির এই তীক্ষ্ণতা ঠাহর হয়।
সান্ধ্য বৃষ্টিতে রিং রোডমুখী গাড়ির বহর সড়কে আটকে যায়। পৃথক নম্বরপত্র নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষা গাড়িবহরের। অথচ একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিটি গাড়ির ভেতরে গল্প চলছে। নম্বরপত্রের মতো পৃথক গল্প। গাড়ির নম্বরপত্র দেখে গাড়ির দৌড়ের গতি, গাড়ির দম ও দাম অনুমান করা গেলেও গাড়ির ভেতরের গল্প আঁচ করা যায় না।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একেকটি গাড়ি যেন একেকটি বাবল হয়ে ভেসে আছে। বাবলগুলোর ভেতর ভিন্ন গল্প ঘুরে ফিরছে। আজ সন্ধ্যার সবগুলো গল্প রিং রোড অভিমুখী। অথচ এখনো একটি গাড়িও না পেল শাহাজাহান রোডের দেখা, না পেল তাজমহল রোড।
ঢাকা মেট্রো-গ ৪৪-১৩০-২৩।
-ফিলিস্তিনে কতকাল মার খাবে মানুষ, এভাবে কতকাল দুধের শিশুর রক্ত ঝরবে, কতকাল রাষ্ট্রহীন থাকবে তারা? হাতে থাকা পত্রিকার কপি ভাঁজ করে রেখে প্রফেসর সহকর্মীকে বলেন নীলিমা নিলোর্মি। পত্রিকার প্রথম পাতায় চার কলামে ছাপা হওয়া গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত দুই শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে গোরস্থানের দিকে ধাবমান পিতার ছবি প্রফেসর নীলিমার চোখে ভাসছে।
-ইসরায়েলের সঙ্গে পারবে না জেনেও ওরা কেন মৌচাকে ঢিল ছোড়ে। জীবনের চেয়ে রাষ্ট্র ধারণা এত তীব্র হবে কেন মানুষের? প্রফেসর রেহমান জামিল অনুযোগের সুরে বললেন।
-আমি ফিলিস্তিনিদের এই লড়াইকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখি। মুসলমান বনাম ইহুদির কোনো ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নয়। প্রফেসর রেহমানের কথায় যেন কিছুটা চোট পেয়েছেন নিলোর্মি। অসন্তোষ নিয়ে জবাব দিলেন তিনি।
-শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম ও প্রধান অন্তরায়। এই দখলদারি, হানাহানি ও রক্তপাত তাদের শতবর্ষী প্রজেক্ট। কায়সার জামিল এই যুদ্ধকে বহুকাল জিইয়ে থাকা বিবাদের ধারাবাহিকতা বলতে চান।
-দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকায় রক্তের বন্যা বইয়ে চলেছে। তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত। নিলোর্মি ফের বললেন। নিষ্ঠুর রক্তারক্তির সঙ্গে অন্য কিছু জড়িয়ে তিনি এই বর্বরতাকে হালকা করতে নারাজ।
-যুদ্ধই তো এক মস্ত অপরাধ। এতে আবার আলাদা যুদ্ধাপরাধ কী? রেহমান জামিল শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।
-ভিটেমাটি ছেড়েও প্রাণে রক্ষা হচ্ছে না। নিরীহ মানুষ তো কোনো অন্যায় করেনি। হানড্রেড ইয়ারস অব হিউমিলিয়েশন। হতাশার সুর আছড়ে পড়ল প্রফেসর নিলোর্মির কণ্ঠে।
প্রফেসর রেহমান এবার বললেন, মার খেলেও ফিলিস্তিনের লড়াইটা সুন্দর। এখানে ধর্মীরা লড়ছে, ধর্মে আস্থাহীনরা লড়ছে, ডান লড়ছে, বামও লড়ছে। সবাই একসঙ্গে। স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিরা বন্দুক থেকে সাধ্যমতো গুলি ছুড়ছে, কবিতাও লিখছে।
থেমে থেমে গাড়ি দশ-বিশ মিটার সামনে চলছে। বৃষ্টির তীব্রতা কমার লক্ষণ নেই।
ঢাকা মেট্টো-ঘ ৪৫-০৬৭-৯৮।
পুরো পরিবার নিয়ে কলাবাগান গিয়েছিলেন কিরণ কিশোয়ার। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক। ফেরার পথে সবার জন্য বার্গার কিনে নিয়েছেন তিনি। এভাবে সপরিবারে বৃষ্টি আর বার্গার উপভোগ্য। খেতে খেতে কেশে উঠলেন তিনি। স্ত্রী শায়লা কিশোয়ার তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। এবার তাদের বড় ছেলেটিরও কাশি পেল।
-তোমাদের বাপ-ছেলের কী হলো? শায়লা কিশোয়ার টিপ্পনি কেটে বললেন।
-বর্ষাকালে আমার পুরনো অ্যাজমা বেড়ে যায়। তাছাড়া বয়স বাড়ছে তো। একটু-আধটু জটিলতা শুরুর সময় এখন।
-বয়স কি তোমার ছেলেরও বেড়েছে নাকি? কিরণ কিশোয়ারের কথায় প্রতিত্তোর করলেন স্ত্রী শায়লা।
-বাবা, কাশি হলে আমি এক অদ্ভুত গন্ধ পাই। আই মিন, আমার কাশির স্মেল।
-কেমন স্মেল? ছেলে শমসের কিশোয়ারের এমন কথা শুনে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন মা শায়লা কিশোয়ার।
-কাশির সঙ্গে সঙ্গে আমার নাকে কাঁচা ইলিশের গন্ধ ভেসে আসে। আমি বেশ কয়েকদিন লক্ষ করেছি। শমশের কিশোয়ার নির্মোহ কণ্ঠে বলল, তার কথায় উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র নেই।
কিশোর কিশোয়ারের মুখে এমন আজব কথা শুনে স্বামীর দিকে চেয়ে শায়লা বললেন, এমন হচ্ছে কেন?
-ডাক্তার সাহেব ভালো বলতে পারবেন। নির্ভাবনায় স্ত্রীকে উত্তর দিলেন কিরণ কিশোয়ার।
-এমন কথা তো কোনোদিন শুনিনি। তোমার কী মনে হয়? এমন হচ্ছে কেন?
-তোমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে গতবছর চাঁদপুর থেকে আধা মণ ইলিশ এনে দিয়েছিল আমার অফিসের স্টাফ ছেলেটি।
-হ্যাঁ। ইলিশ খেলে কাশি থেকে ইলিশের স্মেল আসবে কেন? ইলিশ আমরা সবাই খেয়েছি। তাছাড়া শমশের তো কাঁচা ইলিশ খায়নি।
-বিষয়টি জটিল করছ কেন? মৃদু বিরক্তির সুরে স্ত্রী শায়লাকে বললেন কিরণ।
-তাহলে তুমি গত বছরের ইলিশের কথা তুললে কেন? শায়লা এবার আরও উৎকণ্ঠিত হলেন।
-দেখ। ছেলেটি লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের ইলিশ এনে দিয়েছিল। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষেধ। অথচ তখন একঝাঁক মা ইলিশ আমরা বাড়িতে এনেছি। মাছগুলোর পেটভর্তি ডিম ছিল। প্রকৃতির বিচার বলেও তো কিছু আছে!
স্বামীর এমন কথা শুনে শায়লা বেকুব বনে গেলেন, বললেন, তাহলে তোমার-আমার অসুবিধা হোক। ছেলের হবে কেন?
-প্রকৃতি কাকে ব্যথা দিয়ে কী প্রতিশোধ নেবে- তা তুমি-আমি ঠিক করে দিতে পারি?
কাশির স্মেলের সঙ্গে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ভক্ষণের সম্পর্ক নির্মাণ দেখে শায়লা কিশোয়ার এবং শমসের কিশোয়ারের অবাক না হয়ে উপায় থাকল না। স্ত্রী-পুত্রকে অবাক করে দিয়ে নিজেও সম্ভবত হতভম্ব হলেন কিরণ কিশোয়ার।
অপেক্ষমাণ একদল গাড়ি বৃষ্টি থেমে গেলে রিং রোডে উঠবে। অথচ বৃষ্টি বিরতির কোনো লক্ষণ নেই। গাড়ির সঙ্গে দূরত্ব মেনে দাঁড়িয়ে আছে রিকশা, কাভার্ড ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি। মোটরসাইকেল আরোহীদের কেউ অবশ্য বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। কোনোভাবে স্পেস বের করে ছুট দিয়েছে। হুড তুলে ঊরুর ওপর পলিথিন চেপে বসে থাকা রিকশা আরোহীর আজ গল্পের সঙ্গী নেই। বারিধারায় স্তব্ধ হয়ে বিরক্তি ভাব নিয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। এদের কেউ হয়তো ভাবছেন- বাড়ি ফেরার তাগাদা না থাকলে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগত।
-বাসা কোথায় আপনার? নিজের একাকিত্ব ভাঙতে রিকশা আরোহী রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলেন।
রিকশাচালক উত্তর দিলেন, জলঢাকা।
-হ্যাঁ। এখন তো জলে ঢেকে আছি। আমি বলছি, ঢাকায় কোথায় থাকেন?
-বসিলা ব্রিজ এলাকায়।
-কতদিন যাবৎ এই পেশায় আছেন?
-দেড় বছর।
-এর আগে কী করতেন?
-কিছুদিন রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি।
-ছাড়লেন কেন? রিকশা আরোহীর প্রশ্ন শুনে এতক্ষণে বিরক্ত হলো রিকশাচালক। উত্তরে বললেন, কাজ করিয়ে যথাযথ পারিশ্রমিক না দেওয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো।
-আপনি ইতিহাস পড়েছেন?
-পড়তে হবে কেন? আমার সঙ্গে গতকাল যা ঘটেছে আজ তা ইতিহাস হবে না?
-পড়াশোনা করেছেন কতদূর?
-এখনো আইয়ে পাস। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর পড়েছিলাম। কম্পিউটার সায়েন্সে। খরচ জোগাতে না পেরে ছেড়ে দিছি। আমার পিঠে যে কোম্পানির নাম দেখছেন এটা আমার স্টার্টআপ। ফেইল করছে। মেলা টাকা লস দিসি। এখন রিকশা চালাই।
-ও। এটি আপনার নিজের কোম্পানির প্রমোশনাল টি-শার্ট। কীসের স্টার্টআপ এটি?
-দৈনন্দিন পণ্য ডেলিভারির। অ্যাপটি এখনো প্লে স্টোরে পাবেন।
-কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি? অনেকে তো স্টার্টআপের ভালো আইডিয়ায় ফান্ডিং করে।
-করেছি। অনেকে আশা দিছে। বহুদিন ঘুরাইছে।
-পরে আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি?
-কেন, ফিল্ম দেখেন নাই? ওখানে বলে যে- যোগাযোগ হলো অভ্যাস, অতি যোগাযোগ বদঅভ্যাস।
-কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো হলো না। লেগে থাকুন, একদিন নিশ্চয়ই হবে।
-হবে হয়তো। দেখুন, আমার এই স্বপ্নটা এক টুকরা মাংসের মতো। আনমনে চিবুচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ আয়েশ করে চিবুবো। কিন্তু হঠাৎ আমার অনিচ্ছায় গলা দিয়ে নেমে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু তো টুকরাটি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।
ঢাকা মেট্টো-গ ১৩-১২০-২৪।
অফিস শেষে বিকেলে বাসায় ফেরার কথা ছিল রায়হানের। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরাকে বলে এসেছেন- প্রয়োজনে বসের সঙ্গে কথা বলে অফিস থেকে খানিকটা আগে বের হবেন। রায়হান একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস গ্রাজুয়েট। একটি টেলিকম কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হিসেবে দুই বছর ধরে চাকরি করছেন। তিন বছর প্রেমের পর তাদের বিয়ে হয়। আজ বিয়ের প্রথম বার্ষিকী। এমন দিনেও ঢাকার ট্রাফিক ও বৃষ্টি সড়কে আটকে দিয়েছে রায়হানকে। বিকেলে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়েছে। এখন রাতে লা-ব্রিস্টলে বাফেট ডিনার ক্যানসেল হওয়ার পথে। গাড়িতে বসে কয়েক দফা ফোনে কথা বলে পরিস্থিতি অবহিত করে অন্তরাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন রায়হান। কিছুক্ষণ পরে রায়হানের হোয়াটসঅ্যাপে অন্তরার টেক্সট এল।
-আজকের দিনেও কথা রাখতে পারলে না। সঙ্গে হৃদয় ভাঙা ইমোজি।
-ভুল বুঝ না প্লিজ। রোডে ডেডলকড হয়ে আছি। এমন হওয়ার কথা ছিল না। যত দ্রুত সম্ভব আমি ফিরছি।
হাত জোড় ইমোজির সঙ্গে রায়হানের টেক্সট অন্তরার অভিমান কমাতে পারেনি, তা স্পষ্ট হলো অন্তরার ফিরতি মেসেজে। অন্তরা লিখল, তার পর মন ভেঙে গেলে কাচের টুকরোর মতন পাশাপাশি সাজিয়ে দেখি- ফের যদি জোড়া লাগে।
তুমুল অপরাধবোধ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঘিরে ফেলল রায়হানকে। বাইরে তখনো বৃষ্টি।
একগুচ্ছ গল্প রিং রোডে উঠে ফের পূর্বের স্থানে ফেরে। রোদ-বৃষ্টিতে রোজ ঘুরপাক খায় অবিরাম।