ঢাকা ৪ মাঘ ১৪৩১, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

রূপার জন্য

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪২ পিএম
রূপার জন্য
অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রূপা চলে গেছে। রূপা আমার স্ত্রী। কোথায় গেছে বলে যায়নি। একটা চিঠিও লিখে যায়নি।

ছ’বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। কোনোদিন এমনটা হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। আমিই কোথাও চলে গেছি ওকে কিছু না বলে। আবার হঠাৎ করেই একদিন ফিরে এসেছি। রূপা কোনোদিন কিছু বলেনি।

রূপাকে প্রথম দেখেছিলাম শুভদৃষ্টির সময়। তার আগে কখনো ওকে দেখার প্রয়োজন হয়নি। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও ওর নিষ্পলক চোখ দুটো দেখছিলাম। তার পর কীভাবে যেন ছয় বছর পার হয়ে গেল।

ছ’ছ-টা বসন্ত পেরিয়ে গেল রূপার সঙ্গে। অথচ আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। রূপার এ ব্যাপারেও কোনো ক্ষোভ নেই আমার বিরুদ্ধে। রূপা কখনো বলেনি, চলো একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি। আমিও বলিনি কখনো।

ঘরে রান্নার কিছু নেই, বাজারে যেতে হবে, রূপা কখনো ধমক দিয়ে আমার হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দেয়নি। বলেনি, ‘ঝটপট বাজারটা নিয়ে এসো তো। সঙ্গে একটু মাছও এনো। অনেকদিন ইলিশ খাওয়া হয় না। শুনেছি এখন দামটা একটু কমেছে।’

বরং রূপা নিজেই সবকিছু করে। বাজার-হাট সবকিছু। আমাকে কিছুই করতে হয় না।
রূপার মতন একটা মেয়ে পেয়েছি বলেই হয়তো আমি এতটা নিশ্চিন্ত! কিন্তু কোথায় যেতে পারে রূপা? রূপার তো কেউ নেই আমি ছাড়া!

ছোটবেলা ওর মা মারা গেছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। রূপার মামারাও রূপাকে তেমন ভালোবাসে না। এ ছাড়া তো রূপার আর কেউ নেই! আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ না!

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই চা নিয়ে হাজির হতো রূপা। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আসত। পাশেই ঠাকুর ঘর থেকে ধুপের গন্ধটা ভেসে আসত। আমি চোখ বুজে একবার সেই গন্ধটা নিতাম। তার পর রূপার হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিতাম। ততক্ষণে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিত রূপা। সকালের নরম রোদের আলো বারান্দা পেরিয়ে এ ঘরে ঢুকত। সেই সঙ্গে প্রচুর টাটকা অক্সিজেন। আমার গোটা শরীর সকালের মিষ্টি হওয়ায় কেঁপে উঠত। রূপা সেটা বুঝতে পারত। তাই প্রিয় নীল শালটা কখন যে আলতো করে জড়িয়ে দিত আমার গায়ে।

আমাদের বিয়ের পর প্রথমবার রূপার সঙ্গে যখন দার্জিলিং গিয়েছিলাম। তখনই রূপা পছন্দ করে আমার জন্য শালটা কিনেছিল। রূপার পছন্দের অনেককিছুই আমার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন- নীল রংটা আমার ভীষণ পছন্দের। রূপা নীল রঙের শাল কিনল। সঙ্গে একটা সোয়েটার আর মাফলার। সেটাও নীল রঙের। সব আমার জন্য। রূপা বলেছিল, ওগুলো পরলে নাকি আমাকে ভালো মানাবে। বুঝেছিলাম, রূপা আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে।

বাড়ি ফিরে এসে হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে, রূপার জন্য তো কিছুই কেনা হলো না?

রূপা এরকমই। কখনো নিজের জন্য কিছু ভাবে না। কোনোকিছু মুখ ফুটে চায়ও না। যেন আমার কাছে ওর কোনো দাবি নেই!
আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রূপা নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছি। কিন্তু চা দেওয়ার কেউ নেই। সারা রাত ঘরটা বন্ধ থাকায় বাতাসগুলো ভারী হয়ে উঠেছে। অক্সিজেনের অভাবে কেমন যেন দম আটকে আসছে। অথচ দরজাগুলো খুলে দেওয়ার কেউ নেই। এতক্ষণে বোধহয় বাইরে রোদ উঠে পড়েছে। সকালের টাটকা বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢোকার জন্য ছটফট করছে। তবু পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেওয়ার কেউ নেই। ঠাকুর ঘর থেকে আজ কোনো ধুপের গন্ধ আসছে না।
কোথায় যে গেল রূপা? এত সকালে তো না বলে কোথাও বেরোয় না ও!

বিছানা ছেড়ে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রূপা নেই। তাহলে কি ফুল তুলতে গিয়ে এত দেরি হচ্ছে?

পর্দা সরিয়ে বারান্দার জানালাগুলো খুলে দিলাম। এই প্রথম আমি একা নিজের হাতে জানালাগুলো খুললাম। সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে এসে ঢুকল। সকালের মিষ্টি বাতাস গোটা শরীরে দোলা দিয়ে গেল। সেই সঙ্গে অল্প অল্প শীত অনুভবও হলো। গায়ে কিছু একটা জড়ানো দরকার। কিন্তু আমার নীল শালটা কোথায়? সেটাও তো রূপা জানে। আমি তো ওসব নিয়ে ভাবিনা কখনো!

সেই সময়ই মাথাটা ধরে এল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার অভ্যেস বরাবরের। কিন্তু আজ রূপা নেই। তাই চা খাওয়াও হয়নি। মাথাটা যেন জাঁকিয়ে কামড়ে ধরছে।

একবার ভাবলাম বাইরে দোকান থেকে গিয়ে চা খেয়ে আসি। কিন্তু রূপার কথা মনে পড়ল আবার। দোকানের চা একদম পছন্দ করে না রূপা। জানলে রাগ করবে ভীষণ। যদিও রূপাকে কখনো রেগে যেতে দেখিনি আমি। রূপা আমার সঙ্গে কখনো রেগে কথা বলেনি কোনোদিন!

এই প্রথম রান্নাঘরে ঢুকলাম আমি। রূপার সবকিছুই সাজানো-গোছানো। চায়ের কেটলি, চিনি, চা-পাতা সব হাতের কাছেই রাখা ছিল। রূপাই হয়তো সব রেখে গেছে গুছিয়ে। আমি গ্যাস জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিলাম। দোকানে বসে বেশ কয়েকবার রতনকে চা বানাতে দেখেছি।

এককাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে বেলা বাড়ছে। সেই সঙ্গে রোদের তাপও চড়া হচ্ছে ক্রমশ। এতো দেরি করছে কেন রূপা?

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে নাক-মুখ থেকে জল বের করে ফেললাম। চিনি হয়নি, লিকারটাও বেশি পড়ে গেছে। প্রথমবার নিজের হাতে চা বানিয়ে খাচ্ছি। ভুল তো একটু হতেই পারে! মনকে সান্ত্বনা দিলাম। তার পর প্রায় চোখ বন্ধ করেই বাধ্য ছেলের মতো বাকিটা গিললাম।

ঘড়ি ধরে ঠিক নয়টায় স্নান সারলাম। নীল পাঞ্জাবিটা চেয়ারের ওপরেই রাখা ছিল। পরে নিলাম। এই পাঞ্জাবিটাও রূপার দেওয়া। আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে।

মনে আছে, সেদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। দেখি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে রূপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপা নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। নীল রঙের শাড়ি পরলে রূপাকে অন্যরকম দেখায়। কেমন যেন অন্য মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা। ওকে দেখে হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল, আজ তো তাড়াতাড়ি ফিরব বলে কথা দিয়েছিলাম রূপাকে। বলেছিলাম, সন্ধ্যাটা দুজনে একসঙ্গে কাটাব। বাইরে কোথাও ঘুরব-ফিরব, খাওয়া-দাওয়া করব। সব বেমালুম ভুলে বসে আছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল রূপার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, রূপা আমার কাছে বিন্দুমাত্র অভিযোগ জানাল না। জানতে চাইল না, কেন ফিরতে এতো দেরি হলো? কেন কথা দিয়েও ওকে অপেক্ষায় রাখলাম এতক্ষণ?

রূপা শুধু আমাকে নীল পাঞ্জাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ফ্রেস হয়ে পরে নাও। তার পর রান্না ঘরে ফিরে গেছিল নিজের মতো করে।

আজ সেই নীল পাঞ্জারিটা পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে একবার তাকাই। খুব কি খারাপ লাগছে? জানি না। রূপা থাকলে হয়তো বলতে পারত।

চোখ গেল টেবিলের ওপরে রাখা আমার আর রূপার ছবিটার দিকে। ওটাও সেবার দার্জিলিংয়ে তোলা। ম্যালে। রূপাই জোর করে পাশে দাঁড়িয়ে তুলেছিল। সেই প্রথম আমরা দুজনে ক্যামেরার সামনে। তার পর আর কোনো ছবি তুলিনি ওর সঙ্গে। রূপাও আবদার করেনি কখনো। আমিও না।

ঠিক দশটায় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ছুটে গেলাম বারান্দার দিকে। ভাবলাম, রূপা এসেছে নিশ্চই। দরজা খুলে দেখলাম রূপা কোথায়, অল্প বয়সী ছেলেটা দুধের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হলাম। ছেলেটি বোধহয় আরও বেশি। মনে মনে ভাবলাম, এই রোজ দুধ দিয়ে যায় এ বাড়িতে? ছেলেটি চলে যেতেই ফিরে এলাম ঘরে।

সকাল থেকে এখন এত বেলা হয়ে গেছে পেটে কিছুই পড়েনি। খিদেয় ভেতরে ভতরে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। মনে হলো, খিদে পেলে এতটা কষ্ট হয় আগে কখনো তো অনুভব করিনি! রূপা কখনো সেই সুযোগই দেয়নি। এতক্ষণে ঠিক গুণে গুণে তিনটে রুটি, সবজি, আর একটা ডিম সিদ্ধ বানিয়ে এনে দিত।

এত দেরি করছে কেন রূপা? তবে কি ফুল তুলে বাজারে গেছে? একবারে বাজারটা সেরে বাড়ি ফিরবে?

রূপার কাছে কোনো ফোন নেই। তাই ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়ও নেই। এ ব্যাপারেও অবশ্য রূপার কোনো অভিযোগ নেই। রূপা কখনো মোবাইল চায়নি। আমিও কিনে দিইনি ওকে।

আচ্ছা, কোন বাজারটায় যায় রূপা? চৌমাথার রাস্তা পেরিয়ে সেই সকালের বাজারটায়? নাকি স্টেশনের ওদিকের সবজি বাজার? আজ কী বার? রূপা কি একবারে বাজার করে বিকেলের হাট সেরে তবে বাড়ি ফিরবে? কিন্তু কাল রাতেও তো রূপা তেমনটা কিছু জানায়নি। আমারও অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

একবার মনে হলো, এগিয়ে দেখি। খুঁজে আনি রূপাকে। আবার মনে হলো, কোন বাজারে খুঁজব ওকে? যদি বাজারে না গিয়ে অন্য কোনো কাজে? আর আমি খুঁজতে বেরিয়ে, এদিকে যদি রূপা ফিরে আসে। তাহলে তো ব্যাপারটা আরও খারাপ হবে। আমাকে না পেয়ে তো আরও দুশ্চিন্তায় পড়বে রূপা।

এসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই কী খেয়াল, একবার ফ্রিজটা খুলে দেখলাম। রূপা হয়তো কিছু খাবার রেখে গেছে আমার জন্য। খিদেটাকে আর বাগে আনতে পারছি না। মাথাটাও ধরে আসছে। শরীরটাও কেমন জানি ছেড়ে দিচ্ছি ভেতর থেকে।

ফ্রিজ খুলে সত্যি সত্যি কিছু খাবার পেয়ে গেলাম। সত্যি রূপা সব গুছিয়ে রেখে গেছে আমার জন্য। একদম তৈরি খাবার। গোগ্রাসে সেগুলো গিললাম। খিদের আগুন নিভল। মনে মনে ভাবলাম, যাক এবেলা তো পেরিয়ে গেল। ওবেলায় না হয় কিছু একটা ব্যবস্থা হবে ঠিক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই রূপা ফিরে আসবে কাজ সেরে।

দুপুরের পর হঠাৎ করেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। চারদিক কালো করে আবহাওয়াটা হঠাৎ বেশ খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই রূপার কথা মনে পড়ল আবার। রূপা কি ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে? বৃষ্টির জল ওর একদম সহ্য হয় না। অল্পতেই ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দি। রূপা নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজবে না। ও খুব বুদ্ধিমান। হয়তো কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে। অপেক্ষা করবে। তার পর বৃষ্টি কমলে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরবে।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমার চোখ তখন সেই বৃষ্টি ছাপিয়ে বকুল গাছটার দিকে। কেমন থমকে গেলাম হঠাৎ। দুটো শালিক পাশাপাশি বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। আবার একে অপরের গায়ে ঠোঁট দিয়ে জল সরিয়ে দিচ্ছে। ওরা নিশ্চই প্রেমিক-প্রেমিকা। কত সুখ ওদের!

হঠাৎ রূপার জন্য মনটা কেমন করে উঠল। এই প্রথম খুব একা একা লাগল। মনে হলো, একা থাকতে একদম ভালো লাগছে না। এখনই এক দৌড়ে ছুটে যাই রূপার কাছে। তার পর দুজনে সারা দিন পাশাপাশি বসে বৃষ্টি দেখি। একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটি।

একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে আমার সারা শরীরে জল ছিটিয়ে দিয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম। হঠাৎ শরীরটা খারাপ লাগল। গা-টাও বেশ গরম গরম হয়ে আসছে। মনে হলো জ্বর আসবে।

বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলাম। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে বিছানার চাদরটাই গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ততক্ষণে শীতে আমার শরীর ভীষণ কাঁপছে। কিছুতেই যেন কাঁপুনিটাকে থামাতে পারছি না। বিছানার সঙ্গে নিজেকে জাপটে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

রূপা থাকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাকে মোটা চাদরে জড়িয়ে নিত। তাতেও কাঁপুনি না থামলে আমাকে ওর নিজের শরীর দিয়ে জড়িয়ে নিত। কাঁপুনি একটু থামলে নিশ্চয়ই ডাক্তারখানা নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত।

রূপা নেই। আমি অসহায়ের মতো বিছানায় পড়ে রইলাম। আমার জ্বর বাড়ছে। সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আমার মাথাটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। চোখটাও ঝাপসা হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

ঠিক কখন যে ঘুম থেকে উঠেছি মনে নেই। হুঁশ ফিরতেই দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার গায়ে মোটা চাদর। এখন আর জ্বর নেই। মাথাটাও বেশ হালকা লাগছে।

পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। বৃষ্টি কখন যে থেমে গেছে। মেঘ সরে বাইরে এখন রোদ ঝলমল করছে। বকুল গাছটা থেকে দুটো শালিক উড়ে গেল এই মাত্র।

তখনই রূপা এল। হাতে এককাপ চা নিয়ে। কাপটা টেবিলে রেখে আমার গা-ঘেঁষে বসল। তার পর ওর হাতটা আমার কপালে রাখল। রূপার হাতটা ভীষণ নরম। ওর নরম হাত দিয়ে আমার মাথাটা বুলিয়ে দিল।

রূপাকে কাছে পেয়ে আর জানতে চাওয়া হলো না, ‘কোথায় গিয়েছিলে? ফিরতে এত দেরি হলো কেন?’

মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
মনি হায়দারের ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া
কিংবদন্তির ভাগীরথী

শিরোনামে যাকে কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছি, তিনি এ বিষয়ে, মানে কথাসাহিত্যে আর পাঁচজনের মতো নন, বরং বেশ ব্যতিক্রমী এক মেধা। বিগত চার দশকে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত সৃষ্টিশীল প্রকাশসহ, গল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে একের পর এক যে অবদান রেখে চলেছেন। 

ভাষার অধিকার নিয়ে জাতির আন্দোলনে যেমন নারী তার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তেমনি দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১ সালে নারীর ওপর নির্যাতন, শেষে চরম আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নারীদের এক অসামান্য উদাহরণ হয়ে থাকবে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের কলমের আঁচড়ে ফুটে ওঠা আরেক নারী চরিত্র, ভাগীরথী। কিংবদন্তির ভাগীরথী সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্ট উপন্যাস। 

রাতের অন্ধকারে রাজাকার সুলতান মাহমুদের সহায়তায় পাকিস্তানি পিশাচ সৈন্যরা পিরোজপুর শহরের বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের নারীদের কী এক অজানা বিকৃত চিন্তায় বেশি করে টার্গেট করা হয়। ভাগীরথী তেমনি এক অল্প বয়েসী, পাঁচ বছর বয়সের এক পুত্রসন্তান, লালশ্যামের মা। ঘনশ্যাম তার স্বামী একজন মুচি। ক্যাপ্টেন আলী মোহাম্মদ হাত বাড়ায় ভাগীরথীর দিকে। ভাগীরথীর চওড়া কাঁধের ওপর আলী মোহাম্মদ কঠোর হাত রাখে। ঘাড় ফিরে দেখে ভাগীরথী নিজের কাঁধটা দখল হয়ে গেছে (পৃ: ১৫, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। এতক্ষণ নির্জীব ঘনশ্যাম দৌড়ে এসে সুলতান মাহমুদের দুই পা জড়িয়ে ধরে- সুলতান দাদা, আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান। আপনেগো সব জোতা মুই সেলাই কইরা দিমু। আপনেগো সব জোতা কালি কইরা দিমু। আমার বৌরে ছাইড়া দ্যান (পৃ: ১৫-১৬, কিংবদন্তির ভাগীরথী)। কিন্তু রাজাকার সুলতান মাহমুদ আর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তো একথা শোনার মানুষ নয়। পিরোজপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পে মেজর ইসকান্দার হায়াৎ খানের যৌন লালসার শিকার আরও অগুনিত নারীর পরিণতি হয় ভাগীরথীরও পরিণতি। 

একদিন সুযোগ আসে। ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগের হৃদয় গলিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় ভাগীরথী। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। বরং স্বামী ও প্রতিবেশীরা তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ভাগীরথী আবিষ্কার করে, সে আর কোনোদিন তার পুরনো স্বাভাবিক সংসারে ফিরে যেতে পারবে না।

ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় একদল মুক্তিসেনার সঙ্গে। তাদের সমবেদনা ভাগীরথীকে অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের মুক্তির জন্য পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ করার কাজে। নিজের জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে ভাগীরথী যে তথ্য দেয়, মুক্তিসেনারা তাতে কয়েকটি সফল অপারেশন করতে পারে। এতে পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন দিলদার হোসেন বেগসহ পঞ্চাশজন সৈন্য নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। 

উপন্যাস কিংবদন্তির ভাগীরথী জাদুকরী কথাসাহিত্যিক, অথবা বলা যায় কথাসাহিত্যের জাদুকর রঙের তুলিতে নয়, শব্দচিত্র দিয়ে নির্মাণ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। বাজারে চলছে বইটির চতুর্থ মুদ্রণ। 

লেখক: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, কথাশিল্পী, কবি, অনুবাদক 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে এখনই কিছু করতে হবে
মাজহারুল ইসলাম

কেমন হতে পারে এবারের মেলা? 

এবারের বইমেলা ভালো হবে। পাঠক বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে প্রতিদিন মেলায় আসবেন। পছন্দের লেখকের বই কিনবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। এই মেলার জন্য সারা বছর তারা অপেক্ষায় থাকেন। সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করবেন, সেলফি তুলবেন। সর্বোপরি পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবার অংশগ্রহণে একটি বইবান্ধব মেলা হবে। 

এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশনী থেকে কয়টি বই প্রকাশ করছেন? 
এবার অন্যপ্রকাশ থেকে প্রায় অর্ধ শত বই প্রকাশিত হবে। 

উল্লেখযোগ্য বই কী কী? 

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে আল মাহমুদের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’, ‘সেরা পাঁচ উপন্যাস’, ড. মোহাম্মদ হাননানের ইতিহাসগ্রন্থ ‘ভাষার সংগ্রাম ১৯১৭-১৯৯৯ [হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সংগ্রামের ঐতিহাসিক আলেখ্য], এম আবুল কাসেমের ব্যতিক্রমী গবেষণাগ্রন্থ ‘চা-অর্থনীতি’, এম আবদুল আলীমের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এ ছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের জনপ্রিয় ছোটকাকু সিরিজের ৪০টি বইয়ের সংকলন ‘ছোটকাকু চল্লিশ’। ৮০০ পৃষ্ঠার এই বইটি নিছকই একটি সংকলন নয়, এর আকারে যেমন অভিনবত্ব থাকবে, তেমনি প্রোডাকশনটি হবে ভিন্নমাত্রার। সব মিলে একটা সংগ্রহে রাখার মতো প্রকাশনা হবে এটি।

মেলাপ্রাঙ্গণ বা অবয়ব নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি? 

মেলাপ্রাঙ্গণ হবে এমন, যেন ক্রেতা-পাঠক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, সহজে চলাফেরা করতে পারেন। মেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন তা পাঠক ও প্রকাশকবান্ধব হয়। কেউ যেন কোনো সমস্যা বোধ না করেন। ধুলার সমস্যা দীর্ঘদিনের, একই সঙ্গে আলোর স্বল্পতা। আশা করি, এই বিষয় দুটি গুরুত্বের সঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটি সমাধানের চেষ্টা করবে। 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব বোধ করছেন কি? 

মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব নতুন কিছু নয়। এই সংকট আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। দুঃখজনক সত্য হলো, ন্যূনতম মানহীন কিছু পাণ্ডুলিপিও বই আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা আসলে সামগ্রিক দুর্বলতারই অংশ। অনেক ক্ষেত্রে  আমরা এগিয়েছি, এটা যেমন সত্য, তেমনি নতুন লেখক সৃষ্টিতে কিংবা মানসম্মত পাণ্ডুলিপির সংকট কাটাতে আমাদের এখনো অনেক কিছু করা বাকি। সাহিত্যের চর্চা, এর পঠনপাঠন বাড়ানো গেলে, সংস্কৃতিমনস্কতার উন্নতি হলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।

মেলায় কী ধরনের বই বেশি বেচা হয়? 

গল্প-উপন্যাস, থ্রিলার, ভ্রমণকাহিনি। ইদানীং ননফিকশনাল বইও বেশ বেচা হচ্ছে। এ ছাড়া আত্মউন্নয়নমূলক বইয়েরও চাহিদা রয়েছে।

ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার: সানজিদুল ইসলাম সকাল

মাজহারুল ইসলাম 
প্রধান নির্বাহী, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

ফেরার পথ নেই

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
ফেরার পথ নেই
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

এই শহরে আগেও অনেকবার এসেছে জারা। এখানে প্রায়ই বড় বড় আয়োজনের বিয়ে, গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর জমকালো অনুষ্ঠান থাকে। আবার দীর্ঘদিন লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায় থাকার পর দেশে ফেরা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গেট-টুগেদার আয়োজন করে কেউ কেউ। এবারও তেমন একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে নিজের টিম নিয়ে এসেছে জারা। এ ধরনের অনুষ্ঠানে খানাপিনার সঙ্গে ডিজে পার্টি, মিউজিক্যাল নাইটের আয়োজন থাকে। বেশ কয়েক মাস আগেই শিডিউল ঠিক করা ছিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে গোলাপগঞ্জে লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে জমকালো গেট-টুগেদার অনুষ্ঠান। শহরের বাইরে হলেও জায়গাটা অনেক উন্নত। এবার প্রোগ্রাম করতে এলেও ভেতরে ভেতরে অনেক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে জারা। এক ধরনের অস্বস্তি বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে। প্লেনে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। ক্লান্তির প্রশ্নই ওঠে না। তার পরও নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।

ঢাকায় থাকতেই জারা জেনেছে, উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টিতে মাদক আর বিষাক্ত ভেজাল মদ খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের আটক করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাতীয় সংসদে সবাই একমত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। শাহবাগ, টিএসসি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। ফলে এ ইস্যুটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশজুড়ে মাদককারবারি, চোরাচালানি, সরবরাহকারীদের ধরতে শক্ত অভিযান চলছে। কেউ ছাড়া পাচ্ছে না। আটক করে জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে কয়েকটি ক্রসফায়ারের ঘটনা এসব কাজে জড়িতদের মনে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে সে রাতের ডিজে পার্টি আয়োজনের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে থাকা সবার নাম পুলিশ ও সিআইডি এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তালিকা ধরে তাদের খোঁজ চলছে। ঢাকা ছেড়ে অন্য শহরে কিংবা গ্রামে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে। সেই তালিকার প্রথমদিকেই ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক বিখ্যাত ডিজে গার্ল জারা শাহরিন খানের নামটি রয়েছে। 

প্রভাবশালী কয়েকজন হোমরাচোমরা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যের কারণে সে নানাভাবে বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা-প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এতদিন। বেশ কয়েকবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেও সেই হোমরাচোমরাদের বদান্যতায় উদ্ধার পেয়েছে জারা। কিন্তু এবার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনাটিতে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তালিকা থেকে তার নামটি যেকোনোভাবে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানানোর পর কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পারেনি। সবাই একটাই কথা বলেছে, এ কেসটি অন্য সব কেস থেকে আলাদা। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে চাপ রয়েছে- অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবে পার পেয়ে না যেতে পারে। সবাইকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেকোনো মূল্যে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কারও জন্য তদবির, সুপারিশ করার একদম সুযোগ নেই। তেমন পরিস্থিতিতে কখন যে কী ঘটে যায়- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। 

বুকের মধ্যে অনেক অস্বস্তি চেপে বসেছে। কিছুতেই সেটাকে সরাতে পারছে না। সারাক্ষণ একটা ভয়, আতঙ্কভাব তাড়া করে ফিরছে তাকে। গত কয়েক দিন ধরে এক ধরনের ট্রমার মধ্যে ছিল সে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও দুচোখে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ একটু তন্দ্রাভাব এলেও পরক্ষণেই তা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ রকম একটি অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ খুঁজছিল জারা। 

আরও কয়েক মাস আগেই সিলেটে একটি প্রোগ্রামের কথাবার্তা ফাইন্যাল হয়েছিল। প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দিতে পারত সে। কিন্তু একটুখানি প্রশান্তির আশায় ঢাকার বাইরে দূরে কোথাও চলে যেতে মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এ কারণেই প্লেনে চড়ে সোজা সিলেট চলে এসেছে। এখানে যাদের বাড়িতে প্রোগ্রাম, তারাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তাদের নিজস্ব গাড়িতে হোটেলে এনেছে। দামি বিলাসবহুল লাক্সারি স্যুটে জারার

থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। 
নিজেকে আরও রিফ্রেশ করতে বাথটাবে হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ শরীরটা ডুবিয়ে রেখেছে। এতে কিছুটা কাজ হয়েছে। হালকা গরম-ঠাণ্ডা পানিতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শরীরটা ডুবিয়ে রাখার পর কিছুটা প্রশান্তিবোধ করায় আয়োজকদের ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলেছে জারা। আজ রাতে যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হবে সেখানে গিয়ে সবকিছু দেখতে চায় সে।

ছবির মতো চমৎকার সুন্দর বিলেতি ডিজাইনের একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়িটি থামে। এই বাড়িতেই আজ অনুষ্ঠান। দীর্ঘদিন লন্ডন, কানাডায় থাকা কয়েকটি পরিবার দেশে বেড়াতে এসেছে। দেশে এসে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে একটি গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছে। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গানবাজনা, ডিজে পার্টির ব্যবস্থা করেছেন তারা। 

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে তৈরি করা স্টেজের দিকে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় জারার। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা একজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে না ফেললে মাটিতে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটত নিশ্চিত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে কিছুটা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়। তাহলে কি এখানে তার জন্য কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে? যার আগাম সংকেত হলো হঠাৎ এই হোঁচট খাওয়া! সাধারণভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেলে অনেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করে মনে মনে। কুসংস্কার হলেও তেমন বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলা থেকে এ রকম কিছু ঘটলে কাছাকাছি মা থাকলে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, মায়ের দোয়া সঙ্গে থাকলে কোনো বালা-মুসিবত, বিপদাপদ কাছে আসতে পারবে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত কদিন ধরে এক ধরনের অস্থিরতা তাড়া করে ফিরছে তাকে। এক ধরনের অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময় কাটছে।

স্টেজে উঠে চারপাশে তাকাতেই জারা দেখতে পায়, বাড়ির সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে। এ রকম গাড়ি তো আজ অনেক আসছে এ বাড়িতে। অতিথিরা যে যার মতো গাড়ি নিয়ে আসছেন। কিন্তু সাদা মাইক্রোবাস থেকে নামতে থাকা মানুষগুলো সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরা হলেও তাদের কয়েক জনের গায়ে বিশেষ ধরনের জ্যাকেট দেখে ভয়ে, আশঙ্কায় তার সারা শরীরে হালকা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। দেখেই বোঝা যায়, এই লোকগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। গাড়ি থেকে নেমে তারা এ বাড়ির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে- এতদূর থেকে শোনা না গেলেও এ বাড়ির মানুষজন লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্টেজের দিকে হাতের ইশারা করছে, দেখতে পায় সে। তাদের কথোপকথনের ধরন দেখে এখানে থাকা কারও কথা আলোচনা করছে বোঝা যায়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকগুলোর হাতে অস্ত্র দেখা যায়। তারা সবাই এদিকেই এগিয়ে আসছে দৃঢ় পদক্ষেপে। 

ব্যাপারটা এত দ্রুত এভাবে ঘটবে ভাবতে পারেনি জারা। এ রকম একটা মুহূর্ত আসবে তার জীবনে, যেখানে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ নেই। এতদিন নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে এলেও আজকের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আগে কখনো। এ অবস্থায় যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সে।


জারাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে আরও এক ঘণ্টা আগে। 
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে সেই কবে। রাস্তাজুড়ে রাতের অন্ধকার জেঁকে বসেছে। সেই অন্ধকার ভেদ করে হেডলাইটের তীব্র আলো ছড়িয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটছে গাড়িটা। গাড়িতে তার দুপাশে দুজন শক্তসমর্থ গড়নের নারী। তাদের পরনেও প্যান্টশার্ট। দেখেই বোঝা যায়, তারাও একই বাহিনীর সদস্য। এখন কোনো নারীকে আটক করতে গেলে সেই অভিযানে নারী সদস্য রাখা হয়। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা নিয়ম হয়ে গেছে এখন। একসময় এমনটা ছিল না।

ঢাকার উত্তরার ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টের ঘটনায় জারা শাহরিন খানকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। আরও আগে থেকেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। জারাকে আটকের ব্যাপারে শুরু থেকে তৎপর ছিল পুলিশ। তবে এতদিন তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি প্রভাবশালী মহল নানাভাবে চেষ্টা করে গেছে, যাতে সে আটক না হয়। কিন্তু দেশজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতেই অনেকটা চাপে পড়ে পিছু হটে এসেছে সেই প্রভাবশালী মহলটি।

গাড়িতে জারা ছাড়াও আরও কয়েকজন যাত্রী থাকলেও তারা কেউ তেমন কথা বলছে না। এক ধরনের অসহ্যকর নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে এখানে। এসি গাড়ির সব জানালা বন্ধ রয়েছে। বাইরে কোনো শব্দ আসছে না। আশপাশে ছুটে চলা অন্যান্য গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির হর্নের ক্ষীণ শব্দ কানে এলেও সেটা জেঁকে বসা নীরবতাকে যেন দূর করতে পারছে না।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে এসেছিল জারা। লেখাপড়া শেষে নিজেকে যোগ্য করে তোলার পর ভালো একটি চাকরিতে ঢোকার স্বপ্ন ছিল; যা তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা দেবে। সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে চলার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবতা জারাকে সেই অবস্থা থেকে যোজন যোজন দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মফস্বল শহর থেকে আসা মেধাবী, স্বপ্নবাজ, ভালো মেয়েটি মোহনা থেকে জারায় পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা তাকে স্বপ্ন দেখা সেই পথ থেকে সরিয়ে ভিন্ন আরেক জগতে নিয়ে এসেছে। যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে দুঃস্বপ্ন। ভোগ-বিলাস, আনন্দ, অর্থবিত্তের বাসনা, লোভ-লালসা ইত্যাদি কেবল মরীচিকার মতো চারদিকে ছুটে বেড়ায়, মোহজাল সৃষ্টি করে। যার পেছনে ছুটতে গিয়ে পদে পদে অবক্ষয়, বিকৃতি, বীভৎস লালসার শিকার হতে হয়, নিজের বিবেক, মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। গত কয়েকটি বছর সেই অন্ধকার একটি জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কুৎসিত একটি পৃথিবীকে দেখে দেখে নিজের প্রতি চরম ঘেন্না ধরে গেছে। তার অপরাধ আর পাপের বোঝা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে। যা বইতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। 

ব্লু শাইন রেস্টুরেন্টে ডিজে পার্টির আয়োজক হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছে, কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে ডিবির লোকগুলো বলেছে। এটা তো স্রেফ একটি কেস। এ রকম আরও বহু ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার প্রমাণ পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে রয়েছে। যা এতদিন নানা উপায়ে পাথরচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি কেসে ধরা পড়লে বাকিগুলো এমনিতেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। এ রকম একটি পরিণতির অপেক্ষায় ছিল সে এতদিন। যদিও এ রকম কিছু তার কাম্য ছিল না। এই পৃথিবীতে কাম্য না হলেও, না চাইলেও অনেক কিছু ঘটে যায়। নানাভাবে চেষ্টা করলেও যা ঠেকানো সম্ভব হয় না। 

জারা নিজের পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে কেমন যেন দার্শনিক হয়ে ওঠে। এমন একটি পরিস্থিতিতেও তার হাসি পায় ভীষণ। মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গাড়িতে থাকা ডিবির নারী-পুরুষগুলো কী মনে করে, ভেবে নিজের হাসিটা চেপে রাখে। আগামীকালের দৈনিক পত্রিকায় তাকে আটক করার ছবি ও রিপোর্ট ছাপা হবে। টিভি চ্যানেলের, অনলাইন পোর্টালের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে অপরাধী হিসেবে। তার পর তা টিভি পর্দায়, ইউটিউবে দেখানো হবে। আজকাল সাধারণত এমনই হয়। তার বেলাতেও তাই হবে। এ আর নতুন কী? 

রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর, সবুজ বনবনানী, ধান খেত, নদী, খাল-বিল পেছনে ফেলে জারাকে বহনকারী সাদা মাইক্রোবাসটি তীব্র গতিতে ছুটছে গন্তব্যের দিকে। কতক্ষণে ঢাকা শহরের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে নিরাপদে পৌঁছবে, তেমন ভাবনা মধ্যবয়সী গাড়িচালকের। পথে কোনোরকম দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয়- তাই খুবই সাবধানী হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে মানুষটা। সবদিক সতর্ক হয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে তাকে। 

এতদিন ঢাকা শহরটাকে এক মায়ার শহর ভেবে এসেছে জারা। এখানে যারা পা রাখে, তারা কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে যায়। একসময় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই মোহে জড়িয়ে পড়ে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়। মায়ানগরীর সেই মোহ ধ্বংসের মুখে নিয়ে দাঁড় করানোর আগে উপলব্ধি হলেও তখন আবার শিকড়ে ফেরার তীব্র ইচ্ছে জাগে। ইচ্ছে কিংবা সাধ জাগলেও আর ফেরার উপায় বা সুযোগ থাকে না সে সময়। সেই নরকেই পুড়ে মরতে হয়। শেষ পরিণতিকে মেনে নিতে হয় বাধ্য হয়েই।

নতুন ধানের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
নতুন ধানের ঘ্রাণ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ভাবনার ভিতর একমুঠু ভাত
মগ্নরাতে কৃষকের হাহাকার।

রাত্রি ডোবে কালোর গভীরে
বিঘা বিঘা জমিতে সোনালি ধান।

ক্ষুধার্ত শরীর ঘামে জবজব 
মাঠে কৃষক হৃদয়ে প্রতিবাদ। 

একজোড়া পায়ে কী অসীম শক্তি
বুকজুড়ে নতুন ধানের ঘ্রাণ। 

লাঙল কাঁধে কৃষক হাঁটে 
ধানি জমিজুড়ে ভাটিয়ালি গান।

ওহ্‌ হৃদয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম
ওহ্‌ হৃদয়
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ঝড়ের স্মৃতিতে অবাঞ্ছিত প্রাঙ্গণে
বিষাদের কফিন খুলে সঙ্গোপনে 
বিগতবেলার যে ঘ্রাণ নিচ্ছ 
তাতে বিষাক্ত কীট, বিক্ষত পরাগরেণু
ঝরে যাচ্ছে গোলাপ পাপড়ি।

আহত পাখির পালকে বিরচিত সৌধে
পরাজিত মুহূর্তরা স্তরে স্তরে,
নদীর ভালোবাসা ছেড়ে পতিত মাছ
তীব্র তৃষ্ণায়, তবু জলের দ্রাঘিমায়
সমাপ্তি টেনে আশ্রয় নেয় মধ্যাহ্নে। 
 
এতটা কার্বন অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে
রুগ্নদিন শেষে অন্ধকারে নোঙর ফেলে
বুকের উত্তাপে পুড়ছে আত্মহনন নেশায়।


ওহ্‌ হৃদয়! কেন খরাক্রান্ত নগর ঘুরে
তৃষ্ণা পুষে রাখো বুকের করিডোরে।

দখলি দিগন্তে রক্তজবার পাণ্ডুলিপি
ক্ষরণের গোধূলি চুয়ে পড়ে পড়ন্ত সূর্যে।
অনিদ্রার নিশানা উড়িয়ে
দীর্ঘ করা রাতে যখন নক্ষত্র কাঁদে 
বেদনা আছড়ে পড়ে আঙিনাজুড়ে। 

ওহ্ হৃদয়! কেন ধূমায়িত হয়ে থাকো
অনেক শূন্যতার আকাশ হয়ে।