ফরিদ আহমদ দুলালের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ মে ময়মনসিংহ শহরে। নাট্যকর্মী পিতা মীর্জা মো. ফেরদৌসী, মাতা ফাতেমা আখতার খাতুন। ফরিদ আহমদ দুলালের সাংস্কৃতিক জীবন শুরু সংগীতচর্চা-নাট্যচর্চা ও কাব্যচর্চা দিয়ে। একসময় তার নাট্যচর্চা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, তার অন্য সব পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। পঞ্চাশোর্ধ মঞ্চ সফল নাটক রচনা, শতাধিক নাটকে অভিনয় এবং পঞ্চাশোর্ধ নাটক নির্দেশনা ছাড়াও তিনি শাপলা নাট্যগোষ্ঠী, জাগ্রত নাট্যগোষ্ঠী, ময়মনসিংহ থিয়েটার, নাট্যাঙ্গন নাট্যপরিবার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন মোর্চা গঠনেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। সত্তরের দশকের অন্যতম কবি ফরিদ আহমদ দুলাল কবিতাচর্চায় যেমন নিবেদিত, কবিতা বিষয়ক সাংগঠনিক কার্যক্রমে বিশেষ যত্নশীল।
ফরিদ আহমদ দুলাল এক সময় জাতীয় কবিতা পরিষদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কবিতাবাংলা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সাহিত্য সাময়িকী ‘উপল’, ‘স্বরচিত’, ‘স্বতন্ত্র’; নাট্যপত্রিকা ‘মথি’র সম্পাদক। তার গ্রন্থ তালিকায় আছে- কবিতা: অপূর্ব ডেকে যায়, লাবণ্য ছুঁয়েছি তোমাকে, জলের গহীনে রোদ, নিবিড় নিঃশ্বাস তার, করতলে রাত্রির ছোঁয়া, মুখোমুখি দুঃসময়, দীর্ঘ বিষাদ সড়ক, নিঃসঙ্গ রজনীর লাবণ্য, অমানিশার কাব্য, প্রত্যুষের বাগান রচনা পর্ব, মৈমনসিং গীতিকাভাসান, অরণ্যে অনর্থ তোলপাড়, নাইওর, নিরাপদ দূরত্বে থাকি, কৃষ্ণকলি নাম তার, মৃত্তিকাবন্দনা, যে পথে ব্যস্ততা গেছে, ইত্যাদিসহ ১৯টি। নাটক: এবং লাঠিয়াল, মানিক বাউলের পালা, তিন একাঙ্ক, তিমির বিনাশী, কোঁচ, লড়াই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি নাটক, ফুলজান-জরিবিবি এবং নাটকসমগ্র-১। গল্প: কতিপয় দ্বন্দ্ব; যুদ্ধযাত্রা এবং অন্যান্য গল্প। উপন্যাস: শৃঙ্খল এবং চন্দ্রাবতীর নূপুর; গবেষণা: বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান, প্রগতি: শিল্পী-সাহিত্যিকের ভূমিকা, নেপথ্য-নাটক, কবিতার মায়াবন: শব্দ-শিল্প-ছন্দ প্রকরণ, মনোময় ময়মনসিংহ ইত্যাদি।
শিল্প-সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন সেলিনাবানু স্বর্ণপদক (পাবনা ১৯৯৯), সেবাসম্মান (২০০৫), গীতিকার সম্মান (২০০৬), বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সম্মাননা ২০০৬, নেতাজী সুভাষ পদক ২০০৯ (পশ্চিমবঙ্গ), মহাদিগন্ত পুরস্কার ২০০৯ (পশ্চিমবঙ্গ), নাট্যাঙ্গন পদক ২০০৯, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব পদক ২০১০, রূপসীবাংলা পুরস্কার ২০১৩ (পশ্চিমবঙ্গ) ইত্যাদি পুরস্কার ও পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০২২), অরণি কবিতা পুরস্কার (২০২০) ইত্যাদি।
আপনি এখন কী পড়ছেন?
পড়ার বিষয়ের কোনো অন্ত নেই; কত কিছুই না পড়তে হয়! কী পড়ছি সে তালিকা করা কঠিন, সেই কিশোর বয়স থেকে পড়ছি, সেসব পড়া আবার নতুন করে চিন্তায় এনে পড়তে হয়, প্রয়োজনে মিলিয়ে নিতে হয় বই বের করে; অনেকটা জাবর কাটার মতো। একজন পাঠক যখন পড়েন, মনের আনন্দে পড়েন, তৃপ্তির খোঁজে পড়েন; কিন্তু একজন লেখক যখন পড়েন, তখন তিনি কেবল মনের আনন্দে নয়, কখনো প্রয়োজনেও পড়েন; বিশেষ করে যখন তিনি গদ্য লেখার চেষ্টা করেন, তখন তাকে প্রয়োজনের পড়াও পড়তে হয়। ছাত্রজীবনের অত্যাবশ্যকীয় পাঠের যন্ত্রণা শেষ হলে, একজন মানুষকে না পড়লেও চলে; কিন্তু একজন লেখককে শেষ দিন পর্যন্ত পড়তেই হয়, সে পাঠে কিতাবি পড়ার বিকল্প-বৈচিত্র্যও থাকে প্রচুর। কবিতার পাশাপাশি আমাকে প্রচুর গদ্য এবং ভিন্নধারার রচনাও লিখতে হয়। সে বিবেচনায় আমাকে নিজের লেখার প্রয়োজনে নানান ধরনের বইও পড়তে হয়।
প্রায়শ নিজের আকাঙ্ক্ষার পাঠে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ থাকে না। ধরা যাক, আমি যখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পুনর্পাঠে আগ্রহী, ঠিক তখনই আমার লিখতে হচ্ছে ‘একবিংশের প্রথম দশকের বাংলা কবিতা’; আমাকে কিন্তু মানিক তুলে রেখে তরুণ কবিদের কবিতায় মনোযোগী হতে হচ্ছে। সুতরাং আমি ‘কী পড়ছি’ সে কথা আগে না বলে বলতে চাই ‘কী লিখছি’। দ্বিতীয় কথা, পড়ে পড়ে কী আর কবিতা লেখা হয়?
কবিতা তো লেখা হয়ে যায়, আর কবিতা লেখার জন্য যত না বই পড়তে হয়, তার চেয়েও বেশি পড়তে হয় জীবন-প্রকৃতি-পরিপার্শ্ব আর মানুষ; যা আমার নিত্যদিনের পাঠ। ঘর থেকে পথে বেরোলেই আমার পাঠ শুরু হয়ে যায়। প্রিয় নারীর চোখের ভাষা-হাসির ভাষা-রাগ-অভিমান সহস্রবার পড়ার পরও পুনর্বার পড়ি। পড়ায় আমার সামান্য ক্লান্তিও নেই। এবার আসি গদ্য প্রসঙ্গে, গদ্য লিখবার জন্য আমি নিত্যপাঠে রাখি ইতিহাস-পুরাণ-দর্শন আর সমাজতত্ত্ব; যা আমি একজন গদ্য-লেখকের ভিত্তি বিবেচনা করি। গদ্যের আবার দুটি ধারা, একটি তাৎক্ষণিক পাঠের বিষয়, অন্যটি দীর্ঘ প্রস্তুতির বিষয়। প্রথম ধারায় আছে, আমাকে যদি কোনো একটা বিশেষ বই নিয়ে বা ব্যক্তিকে নিয়ে লিখতে হয়, তাহলে আমার চলতি পাঠ্যসূচিতে থাকবে সেই বইটি এবং সেই ব্যক্তির বই; কিন্তু আমাকে যদি রবীন্দ্রনাথের ওপরে কিছু লিখতে হয়, মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লিখতে হয়, তখন আমার পাঠপ্রস্তুতি হবে দীর্ঘ। কতিপয় দীর্ঘস্থায়ী পাঠের কথা আমি উল্লেখ করতে চাই, যা আমি অবকাশ পেলেই পড়ি; যদিও অত্যধিক লেখার চাপে সে পাঠেও ব্যত্যয় ঘটে; যেমন ইলিয়ড, রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয় পুরাণসহ বিভিন্ন পুরাণ, জীবনানন্দ দাশ, হাদিস শরিফ, ইসলামের ইতিহাস, মহাভারত ইত্যাদি; এগুলো আমি পড়তেই থাকি।
আপনি এখন কী লিখছেন?
অন্যান্য চাহিত লেখা এবং কবিতার বাইরে এই মুহূর্তে আমি প্রধানত দুটি বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করছি; দুটিই গবেষণামূলক রচনা; প্রথমটি ‘বাঙালির আবহমানকালের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ শিরোনামের দীর্ঘ রচনা, আর দ্বিতীয়টি ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচয়’। প্রথমটির জন্য আমার পাঠসূচিতে আছে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পুনর্পাঠ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন লেখকের গদ্য, প্রিয় কবিদের লেখা রাজনৈতিক কবিতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক যাত্রার ইতিহাস ইত্যাদি; দ্বিতীয়টির জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্নজনের রচনা এবং তাদের জীবনাচার আর সামাজিক রীতিনীতি পাঠ। দুই পাঠের চারিত্র্য এক নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন দৃষ্টিশক্তির যে অবস্থা তাতে টানা দীর্ঘপাঠ প্রায়শ অসম্ভব হয়ে পড়ে; আবার নিত্যপাঠ ছাড়া স্বপ্নপূরণের সুযোগ দেখতে পাই না। সে কারণেও কিতাবের ছোট ছোট হরফ পাঠের পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীবন পাঠের স্বস্তিকে সমন্বয় করে নিতে চাই। পাঠসূচির কথা বলতে বলব, গোগ্রাসে কবিতাপাঠ, বিশেষভাবে সমকালীন কবিদের কবিতা পড়া হয় নিয়মিত; তরুণতম কবির কবিতাও বাদ যায় না। ছাত্রদের আন্দোলন-সংগ্রাম, বিভিন্ন পেশাজীবীদের আন্দোলনও মনোযোগে পড়ি; আর পড়ি সমাজের অধপতন, মূল্যবোধ আর স্বপ্নচিন্তার ক্রম অধোগতি।
আমার লেখার প্রতিটি অনুষঙ্গকে আমি একজন লেখক হিসেবে দায় বিবেচনা করি; সঙ্গত কারণেই আমি আমার প্রতিটি লেখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চাই। বাঙালির অগ্রযাত্রার সংগ্রামে যারা বিভিন্ন সময় বুকের রক্ত দিয়েছেন; তাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর কাছে ঋণবোধ থেকেই আমি আমার লেখকজীবনের দায় স্বীকার করি প্রতিদিন; বাঙালির জীবন পাঠ করতে গিয়ে লোকবাংলার জীবন ও সংস্কৃতি অনুসন্ধন অনিবার্য হয়ে পড়ে; সে বিবেচনায় প্রায়স পাঠমগ্ন হয়ে যাই। এসব প্রিয় প্রসঙ্গে মগ্ন হতে গিয়ে হয়তো অনেক প্রসঙ্গই পাঠসীমার বাইরে থেকে যায়; বাদ পড়ে যাওয়া সেইসব প্রসঙ্গ হয়তো আপনার অথবা অন্য কারও প্রিয় প্রসঙ্গ। সঙ্গত কারণেই আপনার কাছে এবং সেই সব বন্ধুদেও কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে চাই, যাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমি ব্যর্থ হচ্ছি।
দৈনন্দিন রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে যত্নে পড়তে চাই; পড়তে চাই মুখ ও মুখোশের দ্বিচারিতা; কিন্তু কিছুতেই আমি দলান্ধ হতে চাই না।
খবরের কাগজ সাহিত্যপাতা ‘সুবর্ণরেখা’ সমৃদ্ধ হোক- কবি হয়ে এই কামনাই রইল।