মৃত্তিকা আমাকে সকাল ঠিক ১০টায় এখানে থাকতে বলেছে। এখানে বলতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। নদের পাড়ে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। বেলা গড়ায়নি দেখে দর্শনার্থীদের ভিড় এখনো তেমন জমে ওঠেনি। পাড়ে বেশ কিছু শ্যালোনৌকা যাত্রীর অপেক্ষায় অলস সময় পার করছে। এজন্য যাত্রী ভেড়াতে কোনো হাঁক-ডাক নেই। এর মানে যাত্রী তোলার কোনো প্রতিযোগিতাও নেই।
মৃত্তিকা এমন একটি মেয়ে, যার সারা দিন যায় প্রাণচাঞ্চল্যে। ধনীর ঘরের বখে যাওয়া মেয়ে নয় ও। সমাজবাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা বজায় রেখে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে সে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ওর সীমাহীন। জানতে চায়, বুঝতে চায়। এলাকাবাসী হলেও ব্রহ্মপুত্র সম্পর্কে ওর জানার আগ্রহ নতুন করে বেড়ে গেছে। আমাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র অবলোকন করবে, জানবে, বুঝবে।
একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। একটি মেয়ে অটোরিকশা থেকে নামার পর তাকে আর মেয়ে বলা যাবে না। কারণ, মোহনীয় আর রমণীয় রূপে যাকে দেখছি, সে আসলে নীলাম্বরী মৃত্তিকা। নীল শাড়ির সঙ্গে শরীরের প্রত্যেকটি পোশাক কম্বিনেশন করে পরেছে। এক কথায় যা অপূর্ব।
আমি তার হাত ধরে একটি শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকায় গিয়ে বসলাম।
আমি মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ তুমি নীলাম্বরী সাজে এলে কেন?
প্রসারিত হাসি দিয়ে মৃত্তিকা বলল, ‘এখন শরৎকাল। আর শরৎকালের আকাশ এমনি থাকে। তুমি কি মনে করো ঋতুর প্রকৃতির সঙ্গে আমি মানিয়ে চলব না?
‘রুচিবোধ তোমার বরাবরই ভালো। শরতের মেঘাকাশে তোমার নীলাম্বরী রং আরও ঝিলিক দিয়ে উঠবে।’
‘আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে নাকি আজকের কার্যক্রম শুরু করবে।’
‘তুমি তো ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে এসেছ!’
‘হ্যাঁ এলাম, কিন্তু রোদ তো খুব চড়া। একটা ছাউনিনৌকা হলে ভালো হতো না?’
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘তাহলে কি ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা বা পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে পারবে।’
মৃত্তিকা বলে, ‘এলাম তো সে জন্যই।’
‘তুমি আজকে একটা পারফেক্ট সাজ করেছ।’
‘কী সেটা?’
‘এখন তো শরৎকাল, ঠিক না।’
‘হ্যাঁ, তাতে কী?’
‘তুমি নিজেকে দিয়ে শরৎকালের প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছ, এটা কি তুমি জেনে-বুঝে করোনি?’
‘বুঝলাম না তোমার কথা।’
‘শরতের প্রকৃতি এখন ডানা মেলে আছে আর তুমি আজ পরে এসেছ সবুজ নীলপেড়ে শুভ্র-সাদা শাড়ি! তাহলে এটা কেন করলে, বলবে?
আমার এ কথায় মৃত্তিকা খুব প্রসারিত হাসি হেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নৌকায় দুলুনি দিতে থাকে। এতে বোঝা গেল, ব্রহ্মপুত্র নদের কাশবন আর ওর পোশাক ও মনন শরৎপ্রকৃতির কম্বিনেশন ফুটিয়ে তুলতেই নিজেকে সাজিয়ে এনেছে; যা বেশ অপূর্ব। শরৎকালীন শুভ্রতার প্রতীক বলা যায়। প্রকৃতিকে অনেক সতেজ মনে হয়। আমাদের মধ্যে কথা হয় শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকা হলেও ইঞ্জিন চালু থাকবে না। মাঝি বৈঠা চালিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে নাও বাইবে। এতে করে আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। নৌকা ধীরে ধীরে চলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা গুনগুনিয়ে গান ধরে, ‘আমারও পরান যাহা চায় তুমি তাই গো’, ওর গলায় মেলোডি আছে! অল্প-স্বল্প চর্চা করে। এটা বোঝাই যায়।
আমাদের নিয়ে বেয়ে যাওয়া শ্যালোনৌকাটি হঠাৎ-ই থেমে যায়। ব্যাপার কী? সামনেই খেয়াঘাট, প্রচুর নৌকা ঘাটে ভেড়ানো, যার দরুণ ওরা জ্যামে পড়ে যায়। আমরা জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার পাড়ে। ভিড়ের মধ্যে পারাপার করতে গেলে যাত্রী এবং মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে একটা বাড়তি টেনশন থাকে; যার দরুণ হুড়োহুড়িতে অঘটন ঘটে। একটা শিশু শ্যালোনৌকা থেকে পড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। আমি মৃত্তিকাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটাও প্রকৃতির একটা স্বাভাবিকতা। ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে গিয়ে মৃত্তিকার জন্য এটা বাড়তি জানা হলো।
বাঁ-পাশে কাশবন আর রবিশস্যের খেতের সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এক নিসর্গ উপাদান এতে বিরাজ করছে। মৃত্তিকা হঠাৎ করে চঞ্চলা হয়ে উঠল। মাঝিকে বলল, নৌকা থামাতে। নামতে গিয়ে নদের পাড়ের পানিতে নেমে পড়ে। মৃত্তিকার শরীর হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যায়। এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার! কাশবনে ঢুকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে শুরু করল। আমি ওর কাছে যেতেই মৃত্তিকা আমারও কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। এর পর আমার হাতে ওর মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি কাশবনে লুটোপুটি খাব, তুমি এটা ভিডিও করো।
আমি তাকে বললাম, ‘তুমি এমনটি করতে চাচ্ছ কেন?
মৃত্তিকা আমাকে বোঝায়, নদীর পাড়ের কাশবনটা শরৎকালেই ধরা দেয়। তখন কাশবনের পাশে সবুজের সমারোহ থাকলে আর আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ালে আকাশ-প্রকৃতির সঙ্গে মাটি-প্রকৃতির ভীষণ একটা লুকোচুরি খেলা হয়।
‘বাহ! তুমি তো বেশ দর্শনতত্ত্বে কথা বললে, তোমার কথার বহিঃপ্রকাশ আগে তো এমনটি দেখিনি!’
‘আমার বান্ধবী বর্ষা আর আমি সুযোগ পেলেই এসব নিয়ে ডিসকাস করি। এই যেমন ধরো, আমি আজ নীলপেড়ে শুভ্র সাদা শাড়ির সঙ্গে কীসের কম্বিনেশন করলাম, শরৎপ্রকৃতিকে সাদর-সম্ভাষণ জানানোর জন্য না? তুমি এটাই মনে করতে পার।’
আমি তাকে বোঝালাম যে, ‘নদনদী তীরবর্তী এলাকাতেই সাধারণত শরৎকালে কাশবনের প্রভাব থাকে বেশি; আর দেখ, আমাদের এখানে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই কূলেই কাশবন আর সবুজ প্রকৃতির সমারোহ থাকে।’
মৃত্তিকা কাশবনের একটি ফুলের তোড়া ডান হাতে নিয়ে পতাকা নাড়ানোর মতো দোলাতে দোলাতে কাশবনজুড়ে দৌড়াতে থাকে। মনে হচ্ছে শিশুকালে চলে গেছে মৃত্তিকা! খুনসুটি, দুষ্টুমি যতটুকু পারা যায় যেন নিজের সঙ্গেই করছে। শেষ বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কিছুটা জমে গেছে বলা যায়, কাশবনের পাশেই রবিশস্যের খেত এখনো সবুজাভ থাকলেও বেড়ে উঠছে। মৃদু বাতাসে তা দুলে দুলে উঠছে। মৃত্তিকা আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে নেয়। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দুজনের সেলফি তোলে। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সঙ্গে মৃত্তিকা নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। শরৎকালের আবহের সঙ্গে পোশাকের আবহ ধরে রাখবে বলেই সে আজ প্ল্যান করে বেরিয়েছে।
আমরা আবার শ্যালোনৌকায় চড়ে বসলাম। হঠাৎ মৃত্তিকা আসল প্রশ্ন করে বসে, ‘একটা ব্যাপার তুমি খেয়াল করে দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘কোন ব্যাপারটা?’
‘এই সিজনে ব্রহ্মপুত্র নদে কমবেশি পানি ঠিকই আছে কিন্তু পাড়ে কোথাও সরু আর কোথাও প্রশস্ত, এটার কারণ কী?’
‘আদিকাল থেকেই তো নদীর ভাঙা-গড়া! মানুষ দুই পাশ দখল করে আবাসন গড়ে তুলেছে আবার বালু উত্তোলন করতে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করায় ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথের বিঘ্ন ঘটেছে।’
‘বহু পুরনো নদ তো ব্রহ্মপুত্র। চারদিক তাকালে বোঝা যায় দুই পাড়ে প্রচুর ভাঙা-গড়ার খেলা হয়েছে।’
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘আমরা এখানকার মানুষ, যদ্দূর জানি, অনেক আগে ব্রহ্মপুত্র নদ এখানে ছিল না। ছিল ময়মনসিংহ শহরের গাঙিনার পাড়ে। কালের গর্ভে পরে নদ ধীরে ধীরে বর্তমান জায়গায় চলে এসেছে।’
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে, ‘তোমার তথ্যের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ দেখা যাচ্ছে।’
আমি তাকে বোঝালাম,‘ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী শহরে আমাদের বসবাস, তাহলে তোমার-আমার কিংবা সবারই এসব জানা থাকা দরকার না?’
মৃত্তিকা বলে, ‘জানার পরিধি তো ব্যাপক! আমরা কেউ বেশি জানি আবার কারও জানাশোনা কম! অভিজ্ঞতা সবার এক রকম নয়। যেমন ধরো, আমি যদি আজ তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের আদিগন্তের খোঁজখবর নিতে না আসতাম, তাহলে আমিও তো অন্ধকারে রয়ে যেতাম!’
একটু দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় বেশ কিছু অসমাপ্ত স্থাপনা দেখা গেল। হেলেপড়া টিনের চাল, ভাঙা কাঠের খুঁটি ইত্যাদি। মৃত্তিকার চোখ এসব এড়ায়নি।
আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘ওই পাড়ে ভাঙাচোরা এসব কী?’
আমিও তার কৌতূহল মেটাতে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলাম, বললাম, ‘কিছুদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের আওতা বাড়াতে জমি অ্যাকোয়ারের বিজ্ঞপ্তি ছেড়েছিল।
‘জমি অ্যাকোয়ার হয়ে গেছে?’
‘না, চরাঞ্চলের লোকেরা আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং-মিছিলে নিজেদের সরব রাখে।’
‘তাদের আন্দোলন কি সফলতা পেয়েছিল?’
‘এটার কোনো সিদ্ধান্তই এখনো হয়নি। এখন আন্দোলন কিংবা জমি অ্যাকোয়ার সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- এ ব্যাপারে এখন কোনো পক্ষেরই যেন কোনো মাথাব্যথা নেই?’
‘আমাদের দেশে তো এখন এরকমই হচ্ছে যে, কোনো আন্দোলন প্রথমে সংগঠিত হলেও পরে তা পর্যায়ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
‘তোমার কথা ঠিকই আছে। কোনো পক্ষের আপসকামিতা থাকলে এরকমই ঘটে।’
পড়ন্ত বিকেল এখন। আমাদের নৌকার স্পিড এখন অনেকটাই কম। আসলে কমিয়ে রাখা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাশের আসন্ন সন্ধ্যা অবলোকন করার জন্যই। সামনে নদের পানিতে বিশাল এক ছায়া পড়েছে। বাঁ-পাশে বৃহৎ অট্টালিকার পাওয়ার হাউস। এখানে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার থেকে একটা অংশ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার কাজে লাগে, বাকিটা রপ্তানি হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় এ ধরনের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এটা ধরে নেওয়া যায়।
সকাল থেকে পাখিদের মতো কলরবে মাতা মৃত্তিকা ক্লান্ত শরীর নিয়ে নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়েছে। সারা দিনের ক্লান্তি ওর শরীরকে অবসন্ন করে ফেলেছে। চঞ্চলা হরিণীকে এখন নেতিয়ে পরা বাঘিনীর মতো মনে হচ্ছে। সারা দিনের ধকল অনেক গেলেও দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার ব্রহ্মপুত্র নদের রূপবৈচিত্র্য এবং এর গতিপ্রকৃতি দুই চোখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখার জন্য এ এক পরম সৌভাগ্য বলেই মনে করে মৃত্তিকা। ওর শান্তশিষ্ট রূপ সেটাই বলে দিচ্ছে।