ঢাকা ৩০ পৌষ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ পিএম
সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে
সাদাত উল্লাহ খান

সাদাত উল্লাহ খান স্বাধীন লেখকের জীবন বেছে নেন। লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ ও সমালোচনা। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে গবেষণা পত্রিকা ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’ সম্পাদনা করছেন।

আপনার পত্রিকা ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’র ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গিয়ে কতটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন? 
পারিবারিকভাবেই অর্থের চাইতে জ্ঞানের দিকে আমাদের মোহ বেশি। আমি স্কুল বয়স থেকেই পারিবারিক পাঠাগার থেকে অনেক বই পড়েছি। তলস্টয়, দস্তয়েভস্কি ও গোর্কিসহ বিভিন্ন বই পড়েই সাহিত্যের প্রতি আমার ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। সাহিত্য আমার রক্তে-মাংসে মিশে গেছে। ‘প্রতি বুদ্ধিজীবী’ চালাতে গিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে বের করার জন্য আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। প্রয়োজনে জমি বিক্রি করে হলেও পত্রিকাটি বের করার অভয় আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আমাদের পরিবারের অনেকেই লেখক। যার কারণে সহজেই পত্রিকাটি চালাতে পারছি।   

আপনার পত্রিকাটির ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’ নাম দেওয়ার কারণ কী? 
বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বুদ্ধিজীবীরা পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরা ফুটওভার ব্রিজের মতো, মানুষ যেদিকে যায় তার থেকে তারা ১০০ গজ দূরে থাকে। সমাজের গতিবিধি তারা বোঝে না। তারা নিজেদের স্বার্থ বোঝে। অনেক বড় বড় সংকটে বুদ্ধিজীবীরা আন্দাজ করতে পারেন না। ২০২৪ সালে এমন একটি বিপ্লব হবে কোনো বুদ্ধিজীবী ধারণাই করতে পারেননি। ১৯৭১ সালেও একই ঘটনা। এজন্য ‘প্রতিবুদ্ধিজীবী’র অর্থ হলো প্রকৃত প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী। প্রতিবুদ্ধিজীবীরা অরগানিক ইনট্যালেকচুয়াল। এরা প্রথাগত বুদ্ধিজীবী নন। যারা ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত সাহসী এবং অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের ও মানুষের জন্য কথা বলেন তারাই হলেন প্রতিবুদ্ধিজীবী। এখন বুদ্ধিজীবীরা বেশির ভাগই সুবিধাবাদী। প্রতিবুদ্ধিজীবী বলতে আহমদ শরীফ, সলিমুল্লাহ খান, আহমদ ছফার মতো মানুষদের বোঝায়, যারা কখনই রাষ্ট্র বা সরকারের বিন্দুমাত্র সাহায্য গ্রহণ করেননি। কোনো বুদ্ধিজীবী যদি সরকারের সাহায্য নিয়ে থাকেন তাহলে তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যারা প্রতিবাদী চিন্তাবিদ তারাই প্রতিবুদ্ধিজীবী। 

আপনি নিজে ব্যবসায়ী হয়েও কীভাবে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠলেন?
আমরা চিন্তাকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি। মানুষের ভেতরে আলো জ্বালাতে গেলে জ্ঞান ছাড়া পারবেন না। আমি জাপান স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। মানুষকে আলোকিত করার একমাত্র উপায় বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া। আমাদের দেশে লেখাপড়া একদমই নেই। শুধু নোট বই পড়ে, পরীক্ষা দেয়, পাস করে। কোনো কবিতার বই প্রকাশকরা ছাপাতে চান না। কারণ, কবিতার বই মানুষ কিনতে চায় না। অথচ সবচেয়ে উচ্চ শিল্প হলো কবিতা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা হলো লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন সব সময় নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। 

আপনার জন্ম মহেশখালীতে, প্রকৃতির সান্নিধ্যেই বড় হয়েছেন। মহেশখালীর প্রকৃতি আপনার লেখায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? 
মহেশখালী দ্বীপের মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মহেশখালীর মানুষ এই দ্বীপের বাইরে আত্মীয়তার সম্পর্ক খুব কম করে। মহেশখালী দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হওয়ায় লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ অনেক জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম হয়েছে এই মহেশখালীতে। ভৌগোলিকভাবেই এখানে জ্ঞানী মানুষের জন্ম হয়। এই দ্বীপের মানুষ হয়ে আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। এখনো আমাদের দ্বীপের মানুষ সচিব হতে পারেনি। এমনকি সেনাবাহিনীর উচ্চ পদ বা জেনারেল হতে পারেনি। একজন বিচারপতি নেই। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ পান চাষ ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই দ্বীপে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তবে আমি আমার লেখায় মহেশখালীর জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

সলিমুল্লাহ খান আপনার লেখায় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন? 
আমার ভাই সলিমুল্লাহ খান সবসময় লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেন। তিনি উপদেশ দিতেন বড় লেখক  হওয়ার জন্য। আমার জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি যতটুকু সহযোগিতা করেছেন ততটুকু আমার বাবাও করেননি। তিনি আমেরিকায় থাকতে আমি যেসব বই চেয়েছি, তিনি মাটির নিচ থেকে হলেও সেই বই আমাকে খুঁজে বের করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। 

অনুলিখন: সানজিদ সকাল

ধারাবাহিক উপন্যাস গোপনীয়

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৬ এএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
গোপনীয়
গ্রাফিকস: নাজমুল মাসুম

পর্ব- ১৮

কোনো এক বিখ্যাত কবি নাকি বলেছিলেন, এপ্রিল হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস। আর রিয়াজুল্লার কাছে সপ্তাহের নিষ্ঠুরতম দিন হলো রোববার। বিদেশে এ দিনটি সাপ্তাহিক বন্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে সপ্তাহ শুরু এ দিনে। তাই রোববার সপ্তাহ শুরু হলেও শরীর সাড়া দেয় না। ক্লান্তি জাকিয়ে বসে মনে। নেতা-কর্মীরাও আসে না খুব একটা। তবে দুই সপ্তাহ ধরে তার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে একজনের কল্যাণে। তার নাম অধরা। বাস্তবেও সে অধরা, অন্তত এখন পর্যন্ত।  
রিয়াজুল্লার ক্লান্তিক্ষণগুলো অধরা ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে চ্যাটের মাধ্যমে। বাইরের পৃথিবীতে মহান নেতার বিশাল ভারে নূব্জ রিয়াজুল্লা অধরার কাছে নিতান্তই একজন সুখে-দুঃখে ভরা সাধারণ ব্যক্তি। অধরার সঙ্গে তার জীবন, কথা, উপকথা একান্তই ব্যক্তিগত। সেখানে রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, নেই অর্থনীতি অথবা নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা।   
ইদানীং রিয়াজুল্লা ভাবছে, একদিন অন্তর্জালের দেয়াল ছিন্ন করে অধরা নামের মেয়েটি ধরা দেবে তার করকমলে, এসে বসবে ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে, শিয়রে ছড়াবে চুলের গন্ধ।  
অধরার সঙ্গে প্রথম দিনের কথা সারাক্ষণ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে রিয়াজুল্লার কানে,  
-হ্যালো।  
-কে বলছেন?  
-আমি অধরা। আপনি?  
উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল রিয়াজুল্লা। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সে। তাই নিজের নাম বলল না।
বলল-  
-আমি কে তা তো আপনি জানেন।   
-আশ্চর্য আমি আপনার নাম জানব কী করে?  
-আপনিই তো হ্যালো বললেন।  
-চ্যাট বক্সে আপনার আইডি দেখে নক করলাম। আইডি নম্বর বিডি ০০৭। নাম তো লেখা নেই!  
এইবার রিয়াজুল্লা বিপদ দেখে, ভাবে নাম বলবে। শেষে বহু চিন্তা করে বলে,   
-আমার নাম জুল্লা।  
কিন্তু নাম লেখার আগেই কম্পিউটারের স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। সরকারের পরিবর্তে লোড শেডিংকে কষে গালি দিতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ তার মনে হয় সরকার লোড শেডিং করে মানুষে মানুষে যোগাযোগে বাধা দিচ্ছে। এটি এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। পাঁড় রাজনীতিক রিয়াজুল্লা। সে এটিকে নতুন প্রজন্মকে পার্টিতে টানার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়।   
তবে ব্যক্তিগত চ্যাটের মধ্যে তার স্বভাবগত রাজনীতি চলে আসায় লজ্জা পায় রিয়াজুল্লা।  
আবার ‘অধরা’র কথা ভেবে হৃদয়ের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়েটির নাম সে জানল, কিন্তু তার নামটি মেয়েটি জানল না। আচ্ছা সে কে অথবা কোথায় তার বাড়ি! দেখতেই বা কেমন সে! সে কি তার মা আর বন্ধুদের প্রাণপন চাওয়া পাত্রীর একটি স্বার্থক জবাব হতে পারবে- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্নে রিয়াজুল্লার মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়।  
অস্থিরতা কয়েকদিন কয়েক মাসের মতো ভারী মনে হয়। তবু রুটিন করে অফিসে আসে সে। রাজনীতি করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে ‘অধরা’ নামের অধরা মেয়েটির কাছে। আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা হবে কি!  
এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বকুলঝরা পুলিশ ফাঁড়ি লুটের ঘটনায় তার দুজন কর্মীকে ফাঁসি দিয়েছে সরকার। তার প্রতিবাদ সভা শেষে মিছিল করতে করতে অফিসে ফিরেছে রিয়াজুল্লা। 
একটু জিরিয়ে বেরোবে বাড়ির উদ্দেশে। এসময় আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি এল। আর বৃষ্টির সঙ্গে এল প্রায় ভুলতে বসা ‘অধরা’র ডাক-  
-হ্যালো কেমন আছেন!  
-আপনি?  
-হ্যাঁ আমি।  
-এতদিন কোথায় ছিলেন?  
-তেঁতুল ঝরা গ্রামে। চেনেন ওই গ্রাম?  
-না। 
একদিন আসুন। আপনাকে নিয়ে যাব। তবে সংগীতের যেমন প্রহর থাকে, ওই গ্রামে যাওয়ারও নির্দিষ্ট সময় আছে। ওখানে পৌঁছাতে হয় হব হব সন্ধ্যায় যখন দিনের আলো নরম হয়ে আসে আর বৈরাগীর পাহাড়ের আড়ালে তিনি রঙের খেলা সাজান। তার পর সন্ধ্যা সোনার মতো হলে বোয়ালভাসা নদীর তীরে বসতে হয় পাশাপাশি-ললাট লিখন থাকলে দেখা যায় দিন-রাত্রির সেই মিলন খেলা। তা শুধু অনুভবই করা যায়, মুখের কথায় বা হাতের লেখায় বলা যায় না কোনোদিন।  
-বাহ্, আপনি কি কবিতা লেখেন নাকি?  
-নাহ, আমিই কবিতা। আপনি কী করেন?  
-আমি বলি। 
-মানে?  
-মানে আমি বক্তা। ‘বক্তৃতা আমার পেশা, নেশা, বক্তৃতা আমার প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার।’ 
-আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার পেশা কী, মানে আপনি কী করেন।   
-বললাম তো আমি বক্তৃতা দিই।         
রিয়াজুল্লা আরেকটু হলে বলেই ফেলত, সে রাজনীতি করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনীতিই তাকে বাঁচিয়ে দিল। সে বলল-  
-আমি প্রতিবাদ করি। আর আমি মানুষকে আশাবাদী করি।  
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।  
-না বোঝার কী আছে। আপনি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেশের আকাশে স্বাধীনতাবিরোধী শুকুনিদের ডানার উল্লাস, জমিনে লুটেরা আর সন্ত্রাসীদের মুখের ব্যাদান। এ অবস্থায় একজন সুস্থ মনের মানুষ, যার মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেম আছে প্রতিবাদী না হয়ে পারে না; আমিও পারিনি।  
-আপনি রাজনীতিকের মতো কথা বলছেন।  
রিয়াজুল্লা খেয়াল করল আবার তার পরিচয় ফাঁস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু সে তো চ্যাট শুরু করেছিল রাজনীতির বাইরে তার একটি একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অন্বেষায়; যেখানে পৃথিবী থেকে দূরে কোনো এক নিরালায় একটি গৃহকোণ থাকবে, গৃহের দুয়ারে মৃদুল প্রদীপ জ্বেলে কেউ একজন দিনের শেষে অস্থির অপেক্ষা করবে; তার পর দিনের ক্লান্তিকর দুনিয়াদারি শেষে বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছালে অপেক্ষার সে মানুষটি মৃদু অনুযোগ তুলে বলবে, ‘ফিরতে অ্যাতো দেরি হলো ক্যান?’  
কিন্তু তার রাজনৈতিক সত্তা তার ব্যক্তি সত্তার ওপর এমনভাবে আছর করে আছে তা আগে কোনোদিন জানতে পারেনি সে। এখন, এই তুমুল মুহূর্তে সে উপলব্ধির সন্ধান পেয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এদিকে তার জবাব না পেয়ে স্ক্রিনের মেয়েটি বারবার বলে চলেছে  
-কী হলো? কথা বলছেন না যে!  
-হ্যালো?  
-হ্যালো...   যখন খেয়াল হলো, রিয়াজুল্লা ভাবল, কিছু লেখে, সে লিখল-   
-সরি, ফোন এসেছিল।  
কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে উঠল অধরা চ্যাটবক্স ত্যাগ করেছেন। আর তখনই রিয়াজুল্লার মনে হলো, এবারও তার নামটি বলা হলো না।


পর্ব-১০
শানবাঁধানো পুকুরঘাটে চেয়ার পেতে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। জরুল্লার কাজে খুশি হলেন মা। রিয়াজুল্লা এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার মন যেন অন্য কোথাও!  
দুই হবু বেয়াই বেয়াইনের সঙ্গে মায়ের পরিচয় হলো। ভদ্রলোক স্থানীয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক। রিয়াজুল্লার মায়ের সঙ্গে মিল হওয়ায় দুই পক্ষই খুশি। দুই অধ্যাপক সাহিত্য নিয়ে ইতং বিতং কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। একজন বিষ্ণুদের কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই রেগে গেলেন। দুই উল্লা এসবের মর্মার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে  
থাকল।  
এসময় চা-নাশতা পরিবেশন হওয়ায় বাঁচোয়া।  
হরেক রকমের বৈকালিক নাশতায় ভরে উঠল শানবাঁধানো পুকুরপাড়। টেবিলে টেবিলে ঘিয়ে প্রজ্বলিত প্রদীপ শিখা। বোঝা গেল, বাবা বাংলার অধ্যাপক হলেও, কনের মা সাংসারিক বিষয়ে সাংঘাতিক সচেতন। মেয়ের কনে-দেখা বলে কথা!  
রিয়াজুল্লার মায়ের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এসবে পটে যাওয়ার পাত্রী আমি নই; তা ছাড়া আমি নিশ্চিত এসব নাশতার অর্ধেকও মেয়েটি বানায়নি।  
কিন্তু মেয়ের মা পাক্কা গৃহিণী। হবু বেয়াইনের মনোভাব বুঝে তিনি আগেই বলে ফেললেন,  
-মিথ্যা বলব না, এসব নাশতার অধিকাংশ বাইরের, তবে গুরুত্বপূর্ণ আইটেমগুলো আমার মেয়েই বানিয়েছে। মা আমার সাক্ষাৎ গৃহলক্ষ্মী। 
মনে মনে গজরান রিয়াজুল্লার মা, এ যে দেখছি ঘসেটি বেগম; তার মেয়ে কেমন হয় আল্লা মালুম।   
কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললেন,  
-বাহ্, খুবই ভালো। তা আপনার গৃহলক্ষ্মী মেয়েটিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। গৃহশাস্ত্র সম্পর্কে তার সঙ্গে একটু আলাপ করতাম।  
মেয়ের মা আহত হোন মনে, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। তবে এসময় সন্ধ্যার পরিবেশ আলো করে মেয়েটি হাজির হলে সবাই নড়েচড়ে বসে। রিয়াজুল্লার মায়ের গলা দিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি বের হয়ে আসে,  
-বাহ্, আমাদের মা তো দেখি আসলেই গৃহলক্ষ্মী!  
তবে পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সংযত করে নেন। এ মেয়েকে আগে তিনি সব উপায়ে পরীক্ষা নেবেন; তার পর মন্তব্য করা যাবে।  
একটু দূরে বসে রিয়াজুল্লা বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যা হওয়া দেখছিল।       
বন্ধু বলল, দেখ, ভালো করে দেখ। 
রিয়াজুল্লা- দেখেছি। ও ঘর হতে বের হওয়ার সময়ই দেখে ফেলেছি।        
-কী দেখলে?  
-উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, ওজন ৪৫ কেজি, কালো চুল কোমর ছাপিয়ে নেমেছে।  
-আর কিছু দেখলে?  
- আর দেখলাম কথা বলা দুটি চোখ, দুটি চঞ্চল পা, আর তনুমধ্যা শরীরে কালীদাসের উপন্যাসের রমণীদের মতো কদলী উরু।  
-বাহ্, তুমি কি কবি নাকি রাজনীতিক?  
-আমি রাজনীতিক বলেই মানুষকে দেখার, চেনার এই চোখ আছে। পরীক্ষণের ব্যাপারটা মা-কে করতে দাও, চলো আমরা দূর থেকে দেখি।  
এদিকে মায়ের নির্দেশে মেয়ে হবু শাশুড়িকে কদমবুচি করে নাশতা পরিবেশন শুরু করেছে। পরীক্ষার হলে কঠোর পরীক্ষকের মতো রিয়াজুল্লার মা মেয়েটির প্রতিটি নড়ন চড়ন, তার কথা, এমনকি বারে বারে মাথা থেকে নেমে আসা মখমলের ওড়নাটি পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে  চলেছেন। এক সময় তিনি বলেই ফেললেন-
-তা বেয়াইন আপনি আপনার মেয়েকে শাস্ত্রে বর্ণিত চার রমণীর কোনটিতে ফেলবেন।
-মাফ করবেন, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।  
-না বোঝার কী আছে, আপনি কি শাস্ত্রে বর্ণীত হস্তিনী, সিংহিনী, শংখিনী, পদ্মিনী এ চার প্রকার মেয়ের ব্যাপারে জানেন না?  
-বেয়াইন আমি মেয়েকে শিখিয়েছি শালীনতা, লেহাজ, আর ঘরকন্না। আপনার বেয়াই শিখিয়েছেন তাহজিব আর তমুদ্দুন। কিন্তু এরকম শাস্ত্রবর্ণিত রমণীভেদ আমার জানা নেই।  
-ঠিক আছে। আমিই দেখছি। ক্লান্ত দিবাকর মলিনমুখে অস্তাচলে বসেছেন। তার শেষ রশ্মিটুকু পৃথিবীর পাতায় পাতায় অনিঃশেষ মায়ায় লেপ্টে আছে। তারই এক টুকুরো কিরণ পৃথিবীর বুকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি মেয়েটির শাড়ির আঁচলে ‘লুটাইয়া পড়িতেছিল’। 
রিয়াজুল্লার মা মেয়েকে কাছে ডাকলেন।         
-জি মা!  
-সুরা ফাতেহা একটু পড়ে শোনাও মা।
-আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।........ওয়ালাদ্ব্যোল্লিন।  
-আমিন। ভালো, তবে কোরআন পড়ার সময় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে শুরু করতে হয়। এটি কোরআনের আদব। বেয়াইনকে বলছি, যারা পদ্মিনী তারা শুধু জীবনাচারে নয়, ধর্মাচারেও আদব মেনে চলে।  
মা বা মেয়ে কেউ কিছু বলে না। নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে চারদিক। দিনান্তের ম্লান আলো দিয়ে দিগন্তের পাহাড়গুলোর চূড়ায় রঙের খেলা সাজিয়েছেন তিনি। সেই আলোর খেলা মেয়েটির অলক চিকুরে লেগে মোহনীয় হয়ে উঠেছে। বোধ করি, তা দেখেই পিতা বলে উঠলেন-  
আচ্ছা বেয়াইন, আগে কিছু মুখে দেন। তার পর কথা বলুন। 
কিন্তু যার উদ্দেশে এ কথা বলা সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি একদৃষ্টে মেয়ের মাথার দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন,  
-মা, তোমার চুলের কবরী খুলে দাও তো দেখি। 

চলবে… 

রঙচঙে

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৬ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
রঙচঙে
আঁকা: খবরের কাগজ

সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি,
খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি সাদা হয়ে আসছে,
পাকন ধরেছে কয়েক গাছি চুলে। 
রঙচঙ মেখে আর ক’টা দিন না হয়
লুকালে আড়ালে,
জীবনের যে রঙ হারিয়েছে, 
তা ফিরবে আর কোন ভোরে? 

মোমের মতো গলে যাচ্ছে সময়,
চামড়া কুঁচকে গিলে খেল বয়স, 
বলিরেখাদের উল্লাস।  
ফাউন্ডেশনের শেড কিংবা সেটিং স্প্রে
আবারও স্বপ্ন দেখায়, 
যে সূর্য মধ্য গগণ পেরিয়ে গেছে, 
আস্তাচলেই তার নিয়তি, কে বোঝাবে?

অবিমিশ্রিত চিন্তার দেয়াল

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
অবিমিশ্রিত চিন্তার দেয়াল
আঁকা: খবরের কাগজ

চিন্তার দেয়ালজুড়ে বাসা বেঁধেছে অচিন আশ্রম
প্রত্যহ জলকেলি করতে করতে সে দৃশ্য আঁকে
                    আমি তার দিকে চেয়ে থাকি
                                ভগ্ন হৃদয় থেকে
কার যেন অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে
সে কি মা নাকি প্রেয়সী-       নিদারুণ বিরান প্রহরে
                                 ভাসছে কারও মুখ
আমার অবিশ্রিত চিন্তার দেয়ালজুড়ে তার পদচারণ
এসো ভিন শতাব্দী থেকে       আত্মার কোমলতা ছেড়ে
বিলিন হও আমার মস্তিষ্কের নিউরণে
                        চারদিকে মুখোশ মিছিল
পা গুলো এগিয়ে যাচ্ছে        কেবলই এগিয়ে যাচ্ছে-

এ কেমন দিন

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
এ কেমন দিন
আঁকা: খবরের কাগজ

চুলার ভিতর থেকে সরাসরি উঠে এসে পাকানো আগুন 
আমাকে হঠাৎ বলে: 
কেন তুমি এমন শীতল, এত চুপচাপ? 
বরং এখন চলো খোলা মাঠে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিই! 
হ্যাঁ, ঠিক কথাই তো- আমি আগুনকে সাথে নিয়ে  
বের হয়ে পড়ি- ব্যস্ত পথে দেখি, 
লোভী মানুষেরা কী নিপুণভাবে
শার্টের পকেটে লুকিয়ে রেখেছে হিংসা, ঘৃণা আর ক্রোধ!
এর কোনো মানে হয়? 
কারও আচরণে নেই গভীর মমতা,  
ফুটপাতে ধুলায় গড়াচ্ছে আহত বাসনা 
আর মনুষ্যত্ব প্রতিটি বাড়ির স্টোর রুমে বসে ঝিমুচ্ছে একাকী!

বলুন না এ কেমন দিন এল? 
হেঁটে হেঁটে স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে 
স্বচ্ছ জলাশয় পার হই, পাশে খোলা প্রান্তরের 
মাঝখানে পৌঁছে ভীষণ চমকে উঠি, চোখে পড়ে-
সবুজ গাছের পাতা ছুঁয়ে বাতাস নীরবে ছড়াচ্ছে আদর,   
অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হই- ঘোর কেটে গেলে 
শুরু করি খেলা, দুই ঠোঁট বেয়ে 
উঠে আসা শব্দগুলো সযত্নে জাগিয়ে তুলি
আর বুকে জমে থাকা সব কষ্ট ওমে পরিণত করি।

সৃষ্টির বিচিত্র এ-খেলায় নেশা পেয়ে বসে,  
এক এক করে সেই সব ওম মননের সুতোয় জড়িয়ে
আগুনের নিখুঁত দলায় রূপ দিই, তার পর 
রোদে যত্নসহ মেলে ধরি! 
বলা তো যায় না, এই অস্ত্র প্রয়োজন হতে পারে যে-কোনো সময়!

মৃত্তিকা ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিল

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২০ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২১ পিএম
মৃত্তিকা ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিল
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

মৃত্তিকা আমাকে সকাল ঠিক ১০টায় এখানে থাকতে বলেছে। এখানে বলতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। নদের পাড়ে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। বেলা গড়ায়নি দেখে দর্শনার্থীদের ভিড় এখনো তেমন জমে ওঠেনি। পাড়ে বেশ কিছু শ্যালোনৌকা যাত্রীর অপেক্ষায় অলস সময় পার করছে। এজন্য যাত্রী ভেড়াতে কোনো হাঁক-ডাক নেই। এর মানে যাত্রী তোলার কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। 

মৃত্তিকা এমন একটি মেয়ে, যার সারা দিন যায় প্রাণচাঞ্চল্যে। ধনীর ঘরের বখে যাওয়া মেয়ে নয় ও। সমাজবাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা বজায় রেখে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে সে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ওর সীমাহীন। জানতে চায়, বুঝতে চায়। এলাকাবাসী হলেও ব্রহ্মপুত্র সম্পর্কে ওর জানার আগ্রহ নতুন করে বেড়ে গেছে। আমাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র অবলোকন করবে, জানবে, বুঝবে। 

একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। একটি মেয়ে অটোরিকশা থেকে নামার পর তাকে আর মেয়ে বলা যাবে না। কারণ, মোহনীয় আর রমণীয় রূপে যাকে দেখছি, সে আসলে নীলাম্বরী মৃত্তিকা। নীল শাড়ির সঙ্গে শরীরের প্রত্যেকটি পোশাক কম্বিনেশন করে পরেছে। এক কথায় যা অপূর্ব। 

আমি তার হাত ধরে একটি শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকায় গিয়ে বসলাম। 
আমি মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ তুমি নীলাম্বরী সাজে এলে কেন?
প্রসারিত হাসি দিয়ে মৃত্তিকা বলল, ‘এখন শরৎকাল। আর শরৎকালের আকাশ এমনি থাকে। তুমি কি মনে করো ঋতুর প্রকৃতির সঙ্গে আমি মানিয়ে চলব না?

‘রুচিবোধ তোমার বরাবরই ভালো। শরতের মেঘাকাশে তোমার নীলাম্বরী রং আরও ঝিলিক দিয়ে উঠবে।’ 
‘আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে নাকি আজকের কার্যক্রম শুরু করবে।’
‘তুমি তো ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে এসেছ!’ 
‘হ্যাঁ এলাম, কিন্তু রোদ তো খুব চড়া। একটা ছাউনিনৌকা হলে ভালো হতো না?’
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘তাহলে কি ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা বা পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে পারবে।’ 
মৃত্তিকা বলে, ‘এলাম তো সে জন্যই।’
‘তুমি আজকে একটা পারফেক্ট সাজ করেছ।’
‘কী সেটা?’
‘এখন তো শরৎকাল, ঠিক না।’
‘হ্যাঁ, তাতে কী?’
‘তুমি নিজেকে দিয়ে শরৎকালের প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছ, এটা কি তুমি জেনে-বুঝে করোনি?’
‘বুঝলাম না তোমার কথা।’
‘শরতের প্রকৃতি এখন ডানা মেলে আছে আর তুমি আজ পরে এসেছ সবুজ নীলপেড়ে শুভ্র-সাদা শাড়ি! তাহলে এটা কেন করলে, বলবে?

আমার এ কথায় মৃত্তিকা খুব প্রসারিত হাসি হেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নৌকায় দুলুনি দিতে থাকে। এতে বোঝা গেল, ব্রহ্মপুত্র নদের কাশবন আর ওর পোশাক ও মনন শরৎপ্রকৃতির কম্বিনেশন ফুটিয়ে তুলতেই নিজেকে সাজিয়ে এনেছে; যা বেশ অপূর্ব। শরৎকালীন শুভ্রতার প্রতীক বলা যায়। প্রকৃতিকে অনেক সতেজ মনে হয়। আমাদের মধ্যে কথা হয় শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকা হলেও ইঞ্জিন চালু থাকবে না। মাঝি বৈঠা চালিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে নাও বাইবে। এতে করে আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। নৌকা ধীরে ধীরে চলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা গুনগুনিয়ে গান ধরে, ‘আমারও পরান যাহা চায় তুমি তাই গো’, ওর গলায় মেলোডি আছে! অল্প-স্বল্প চর্চা করে। এটা বোঝাই যায়। 

আমাদের নিয়ে বেয়ে যাওয়া শ্যালোনৌকাটি হঠাৎ-ই থেমে যায়। ব্যাপার কী? সামনেই খেয়াঘাট, প্রচুর নৌকা ঘাটে ভেড়ানো, যার দরুণ ওরা জ্যামে পড়ে যায়। আমরা জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার পাড়ে। ভিড়ের মধ্যে পারাপার করতে গেলে যাত্রী এবং মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে একটা বাড়তি টেনশন থাকে; যার দরুণ হুড়োহুড়িতে অঘটন ঘটে। একটা শিশু শ্যালোনৌকা থেকে পড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। আমি মৃত্তিকাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটাও প্রকৃতির একটা স্বাভাবিকতা। ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে গিয়ে মৃত্তিকার জন্য এটা বাড়তি জানা হলো। 

বাঁ-পাশে কাশবন আর রবিশস্যের খেতের সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এক নিসর্গ উপাদান এতে বিরাজ করছে। মৃত্তিকা হঠাৎ করে চঞ্চলা হয়ে উঠল। মাঝিকে বলল, নৌকা থামাতে। নামতে গিয়ে নদের পাড়ের পানিতে নেমে পড়ে। মৃত্তিকার শরীর হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যায়। এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার! কাশবনে ঢুকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে শুরু করল। আমি ওর কাছে যেতেই মৃত্তিকা আমারও কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। এর পর আমার হাতে ওর মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি কাশবনে লুটোপুটি খাব, তুমি এটা ভিডিও করো। 

আমি তাকে বললাম, ‘তুমি এমনটি করতে চাচ্ছ কেন? 

মৃত্তিকা আমাকে বোঝায়, নদীর পাড়ের কাশবনটা শরৎকালেই ধরা দেয়। তখন কাশবনের পাশে সবুজের সমারোহ থাকলে আর আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ালে আকাশ-প্রকৃতির সঙ্গে মাটি-প্রকৃতির ভীষণ একটা লুকোচুরি খেলা হয়। 
‘বাহ! তুমি তো বেশ দর্শনতত্ত্বে কথা বললে, তোমার কথার বহিঃপ্রকাশ আগে তো এমনটি দেখিনি!’ 
‘আমার বান্ধবী বর্ষা আর আমি সুযোগ পেলেই এসব নিয়ে ডিসকাস করি। এই যেমন ধরো, আমি আজ নীলপেড়ে শুভ্র সাদা শাড়ির সঙ্গে কীসের কম্বিনেশন করলাম, শরৎপ্রকৃতিকে সাদর-সম্ভাষণ জানানোর জন্য না? তুমি এটাই মনে করতে পার।’ 
আমি তাকে বোঝালাম যে, ‘নদনদী তীরবর্তী এলাকাতেই সাধারণত শরৎকালে কাশবনের প্রভাব থাকে বেশি; আর দেখ, আমাদের এখানে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই কূলেই কাশবন আর সবুজ প্রকৃতির সমারোহ থাকে।’

মৃত্তিকা কাশবনের একটি ফুলের তোড়া ডান হাতে নিয়ে পতাকা নাড়ানোর মতো দোলাতে দোলাতে কাশবনজুড়ে দৌড়াতে থাকে। মনে হচ্ছে শিশুকালে চলে গেছে মৃত্তিকা! খুনসুটি, দুষ্টুমি যতটুকু পারা যায় যেন নিজের সঙ্গেই করছে। শেষ বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কিছুটা জমে গেছে বলা যায়, কাশবনের পাশেই রবিশস্যের খেত এখনো সবুজাভ থাকলেও বেড়ে উঠছে। মৃদু বাতাসে তা দুলে দুলে উঠছে। মৃত্তিকা আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে নেয়। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দুজনের সেলফি তোলে। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সঙ্গে মৃত্তিকা নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। শরৎকালের আবহের সঙ্গে পোশাকের আবহ ধরে রাখবে বলেই সে আজ প্ল্যান করে বেরিয়েছে। 

আমরা আবার শ্যালোনৌকায় চড়ে বসলাম। হঠাৎ মৃত্তিকা আসল প্রশ্ন করে বসে, ‘একটা ব্যাপার তুমি খেয়াল করে দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘কোন ব্যাপারটা?’

‘এই সিজনে ব্রহ্মপুত্র নদে কমবেশি পানি ঠিকই আছে কিন্তু পাড়ে কোথাও সরু আর কোথাও প্রশস্ত, এটার কারণ কী?’
‘আদিকাল থেকেই তো নদীর ভাঙা-গড়া! মানুষ দুই পাশ দখল করে আবাসন গড়ে তুলেছে আবার বালু উত্তোলন করতে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করায় ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথের বিঘ্ন ঘটেছে।’

‘বহু পুরনো নদ তো ব্রহ্মপুত্র। চারদিক তাকালে বোঝা যায় দুই পাড়ে প্রচুর ভাঙা-গড়ার খেলা হয়েছে।’ 
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘আমরা এখানকার মানুষ, যদ্দূর জানি, অনেক আগে ব্রহ্মপুত্র নদ এখানে ছিল না। ছিল ময়মনসিংহ শহরের গাঙিনার পাড়ে। কালের গর্ভে পরে নদ ধীরে ধীরে বর্তমান জায়গায় চলে এসেছে।’
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে, ‘তোমার তথ্যের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ দেখা যাচ্ছে।’

আমি তাকে বোঝালাম,‘ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী শহরে আমাদের বসবাস, তাহলে তোমার-আমার কিংবা সবারই এসব জানা থাকা দরকার না?’
মৃত্তিকা বলে, ‘জানার পরিধি তো ব্যাপক! আমরা কেউ বেশি জানি আবার কারও জানাশোনা কম! অভিজ্ঞতা সবার এক রকম নয়। যেমন ধরো, আমি যদি আজ তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের আদিগন্তের খোঁজখবর নিতে না আসতাম, তাহলে আমিও তো অন্ধকারে রয়ে যেতাম!’
একটু দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় বেশ কিছু অসমাপ্ত স্থাপনা দেখা গেল। হেলেপড়া টিনের চাল, ভাঙা কাঠের খুঁটি ইত্যাদি। মৃত্তিকার চোখ এসব এড়ায়নি। 

আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘ওই পাড়ে ভাঙাচোরা এসব কী?’
আমিও তার কৌতূহল মেটাতে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলাম, বললাম, ‘কিছুদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের আওতা বাড়াতে জমি অ্যাকোয়ারের বিজ্ঞপ্তি ছেড়েছিল। 
‘জমি অ্যাকোয়ার হয়ে গেছে?’
‘না, চরাঞ্চলের লোকেরা আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং-মিছিলে নিজেদের সরব রাখে।’ 
‘তাদের আন্দোলন কি সফলতা পেয়েছিল?’
‘এটার কোনো সিদ্ধান্তই এখনো হয়নি। এখন আন্দোলন কিংবা জমি অ্যাকোয়ার সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- এ ব্যাপারে এখন কোনো পক্ষেরই যেন কোনো মাথাব্যথা নেই?’
‘আমাদের দেশে তো এখন এরকমই হচ্ছে যে, কোনো আন্দোলন প্রথমে সংগঠিত হলেও পরে তা পর্যায়ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ে। 
‘তোমার কথা ঠিকই আছে। কোনো পক্ষের আপসকামিতা থাকলে এরকমই ঘটে।’ 

পড়ন্ত বিকেল এখন। আমাদের নৌকার স্পিড এখন অনেকটাই কম। আসলে কমিয়ে রাখা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাশের আসন্ন সন্ধ্যা অবলোকন করার জন্যই। সামনে নদের পানিতে বিশাল এক ছায়া পড়েছে। বাঁ-পাশে বৃহৎ অট্টালিকার পাওয়ার হাউস। এখানে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার থেকে একটা অংশ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার কাজে লাগে, বাকিটা রপ্তানি হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় এ ধরনের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এটা ধরে নেওয়া যায়। 

সকাল থেকে পাখিদের মতো কলরবে মাতা মৃত্তিকা ক্লান্ত শরীর নিয়ে নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়েছে। সারা দিনের ক্লান্তি ওর শরীরকে অবসন্ন করে ফেলেছে। চঞ্চলা হরিণীকে এখন নেতিয়ে পরা বাঘিনীর মতো মনে হচ্ছে। সারা দিনের ধকল অনেক গেলেও দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার ব্রহ্মপুত্র নদের রূপবৈচিত্র্য এবং এর গতিপ্রকৃতি দুই চোখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখার জন্য এ এক পরম সৌভাগ্য বলেই মনে করে মৃত্তিকা। ওর শান্তশিষ্ট রূপ সেটাই বলে দিচ্ছে।