ঢাকা ৩০ পৌষ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

দাও সে প্রেমের দান

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পিএম
দাও সে প্রেমের দান
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শীতকাল, ঘুম থেকে জেগে ওঠে রমা। শব্দহীন চুপচাপ ঘর থেকে বেরোয়। মা জেগে গেলে যাত্রা হবে না, বাধা আসবে। মাকে ফাঁকি দিতে ভোররাতেই রওনা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে। এখনই সঠিক সময়- ঘড়ি দেখে হিসাব করে রমা। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। অনেক রাত অব্দি ঘুম আসেনি। অন্তরের কষ্ট বুকে চেপে রাখতে হয়েছে। রমেন্দ্র কুমার দাস ওরফে রমা তার নাম। বয়স একুশ ছুঁইছুঁই। এলোমেলো লম্বা চুল। গায়ের রং ফর্সা হলেও এই কদিনে তামাটে বর্ণ ধরেছে। 

শরণার্থী ক্যাম্পের তিন দিনের অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধা মাকে ওখানে রেখে আসা ছাড়া উপায় ছিল না ওর। এটা অবশ্য পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা। 

এক সময় সংসার বলতে ছিল রমা, নববিবাহিত স্ত্রী কবরী আর তার মা। বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। কবরীকে ধরে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী। গায়ে দিয়েছে আগুন। নারী-পুরুষ-বউ-ঝি-শিশু-কিশোর সবাই পালিয়েছে। এসব ঘটনার পরদিনই সুনামগঞ্জের ভাঙ্গাডহর থেকে পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে এসে থামতে হয়েছে ওর। 

পুরো ছয়দিন রাস্তায় কেটেছে, নৌকা, পায়ে হাঁটা পথ আর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ। মায়ের ঠিকানা এখন  মৈলাম ক্যাম্প। তাকে তো ট্রেনিংয়ে যেতেই হচ্ছে। কিন্তু বউ? বউ যে তার আত্মা। বউকে ভুলে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পরও বারবার মুখখানি উঁকি মারছে চোখে। মায়াময় সেই দুটো ছলছল চোখ। মেয়েদের পোড়াপ্রাণে স্বামী শাসক হলেও তার এখন যেন উল্টোটা হচ্ছে। এই মুহূর্তে রমার মনে হয় জীবন ও যৌবনরাজ্যে কবরীর স্থান অতি উচ্চে।   
  
ঝুপড়ি শিবিরে কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখনই রওনা দেওয়ার কথা ছিল তার। শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই এখানে শীত নিবারণের একমাত্র ভরসা। দু-চারজনের থাকলেও, অধিকাংশ শরণার্থীর ঘরেই নেই শীত ঠেকানোর ব্যবস্থা। তাই দিনের বেলায় কুড়িয়ে আনা লাকড়ির পরিত্যক্ত অংশ জ্বালিয়ে কোনোরকমে শীত থেকে বাঁচার উপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর। রমার বস্ত্র বলতে পরনের একখানি লুঙ্গি আর গায়ে হাফহাতা শার্ট। প্রচণ্ড শীত, শরীর কাঁপছে; তবু ট্রেনিংয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ায় লম্বা সড়কের কিনারে। 

হঠাৎ অচেনা একটি লোক এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি রমা?’ মাথাসমেত  হাঁটুঅব্দি লম্বাকোট পরা মানুষ।  
লোকটির দিকে চোখ বুলিয়ে ‘হাঁ’ শব্দটি মুখে উচ্চারণ না করেও আস্তে মাথা নেড়ে বুঝাল, সঠিক। 
রমা আবারও তাকাল চেহারার দিকে। 
রং ফর্সা, গোল মুখ। সত্তরোর্ধ্ব লোকটি কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার।’
গায়ের চাদর আর গরমকাপড় পেয়ে প্রাণ ফিলে পেল শীতবস্ত্রহীন রমা। 

খুশি হলো। হাঁ-না প্রশ্ন করল না রমা। কথা বলতেই কি ভুলে গিয়েছিল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে- লোকটি কে? কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে। নীরবে চলে যাচ্ছে কোটপরা কুঁজো লোকটি। 

সুধারাম বলেছিল- শীতবস্ত্র পাবে। তোমাকে দিয়ে যাবে একজন। তবে কী এ-ই লোক? রমা রাস্তা ধরে সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে সুধারামের অপেক্ষা করে। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে লক্ষ্যে।    

এই মুহূর্তে চলতি পথেও রমাকে ভাবায় ওর স্ত্রী কবরী।  মন উচাটন করে, কখনো দুচোখে পানি ভরে ওঠে। বিয়ের কয়েকদিন পরই যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। অধিক উজ্জ্বল হয়েছিল গাত্রবর্ণ। টানাটানা চোখ দুটো যেন আরও পরিষ্কার, আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পরনে সাদা-নীল ফুলে আঁকা লালপেড়ে শাড়ি পরার পর চোখ সরাতে ইচ্ছে করত না রমার। সম্ভবত সৌন্দর্য এমন একটি জিনিস যা হাতে ধরা যায় না। এমনকি এখনো কনে দেখার মুহূর্তটি কোনোভাবেই চোখ থেকে সরতে চায় না। 

কবরীদের বাড়ি ছিল অতি সুন্দর। চারদিকেই কী সবুজ। সে কি ভোলা যায়!  আম, জাম, কাঁঠাল তো আছেই, এর বাইরে নাম না-জানা অসংখ্য গাছগাছালি। কী স্নিগ্ধ। চোখ জুড়িয়ে  যেত  সেই গ্রামের দৃশ্য। বাড়িতে  পৌঁছবার মুহূর্তে  রমা দেখল-  ছোট সরু রাস্তা। মাঝে মাঝে কচুরিপানাভর্তি খাল। ছোট ছোট পানাপুকুর, সরু সরু গ্রাম্য রাস্তা। 

এর পর পাত্রী দেখার বড় রকমের আয়োজন বাড়িময়। টিনের ছাউনি, কাঠের বাড়িঘর, ফুল, লতাপাতা আঁকা দরজা। বৈঠক ঘরের জানালায় নারীদের উৎসাহী, উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মুখ। পাত্রী দেখা ও আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়েছে ওখানেই।  
সারবাঁধা চেয়ার, জলচৌকি আর বেঞ্চ পাতা ঘরে। নেচে নেচে উঠছে সেসব দৃশ্য। 

চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রতিবেশী ষাটোর্ধ্ব বয়সী ছালাম মাতবর বললেন, ‘দিনের অবস্থা ভালো নয়। আকাশে মেঘ জমেছে। যা করবার তাড়াতাড়ি।’ 
রমার চেনাজানা বন্ধুবান্ধব এসেছে। বিবাহের প্রথম পর্ব এটি। জীবনের এই অধ্যায়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলের পাত্রী দেখতে এসেছেন রমার বাবা। তিনিও সায় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আকাশে কয়দিন থেকে যেন মেঘ বাসা বেঁধেছে।’

পাত্রীপক্ষের অভিভাবকমণ্ডলীর একজন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আজ্ঞে, আপনারা যদি দয়া করেন তাহলেই মঙ্গল। যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আমাদের সবকিছু  তৈরি।’

ঝাঁকবাঁধা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ঠেলে ফাঁকা করা হলো ঘরে ঢোকার জায়গা। এর পর লালশাড়ি পরিয়ে বউ বউ ধরনের সাজগোজ করে পাত্রীকে সামনে আনা হলো।

‘নাম।’
‘কবরী।’
পাত্রীর গড়ন দেখেই তৃপ্তির হাসি খেলল প্রধানসঙ্গী ছালাম মুরুব্বির মুখে। 
‘দাঁড়াতে হবে, আমাদের দাঁড়িয়ে দেখাতে হবে।’
কবরী দাঁড়াল। ছালাম মাতব্বর বললেন, ‘হাঁটাচলা দেখি।’ 
কবরী ঘরেই দুটি চক্কর দিয়ে হাঁটল।
ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য, ‘দারুণ ফিগার। এবার বসো।’
কবরী বসল। 

বরপক্ষের একজন বলল, ‘উঁহু, মুখচোখের গড়ন দেখতে হবে। কপাল-মুখ এত ঢাকাঢাকি কেন?’
অভিভাবকমণ্ডলীর দিকে তাকাল কবরী। আড়াল থেকে কেউ হাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কবরী কপাল-মুখ খুলে দেখাল।
‘দাঁত দেখাও?’  বরপক্ষের কেউ একজনের কণ্ঠ। 

‘খুব সুন্দর। অবশ্য মেয়ের বয়স কম।’ দাড়ি হাতাতে হাতাতে ছালাম মুরুব্বির মন্তব্য।
কনের অভিভাবকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে প্যান্ট পরা এক  প্রৌঢ়  উচ্চারণ করলেন, ‘সতেরো। কলেজে ভর্তি হইছিল।’

সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে অতীতে ডুবে গিয়েছিল রমা। 

বিরাটাকৃতির পাথরটির পাশেই দাঁড়ানো সে। জায়গাটি অচেনা। শনাক্ত করার একমাত্র উপায় পাথর আর কিছু কিছু পাহাড়ি গাছ। এখানেই আসার কথা মুক্তিযোদ্ধা সুধারামের। কিছু একটা ভেবে স্বগতোক্তির মতো রমা উচ্চারণ করল, এখানেই অপেক্ষা করব। 

ভোরের আলো ফুটে এখন দিন শুরু হতে যাচ্ছে। দেখা গেল, এক যুবতীর কোলে দুই বছরের শিশু। পাশে আরেকটি পাঁচ বছর বয়সের কন্যাশিশু, প্রস্রাব করছে রাস্তার ওপাশে, পিঠছেঁড়া জামা। কোলের শিশুটি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, চোখ-মুখ দেখেই অনুমান করা যায়। সড়কের পাশে বসে অপেক্ষা সুধারামের। কয়েক মিনিট পর রমা আবারও হাতঘড়ি দেখে, সাড়ে ছ’টা। 

সুধারাম এল আচমকা। যাতে শীত স্পর্শ না করতে পারে, পোশাক সেভাবেই পরা তার। ত্রিশ বছরের তরুণ। মাথা-গলায়  হলুদ-লাল রঙের মাফলার দিয়ে প্যাঁচানো। মুক্তিযুদ্ধে নাম-ঠিকানা লেখানোর সব রাস্তাঘাট মুখস্থ।  এসেই তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল, বেলা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো ৭টায় পৌঁছাতে হবে।  মৈলাম ক্যাম্পেই বাইজা গেল সাড়ে ৬টা।’ 

রমা বলল, ‘আমি যথাসময় এসেছি। কখন থেকেই অপেক্ষায় আছি!’ 

‘দেরি হয়ে গেল, মায়ের জন্যি। তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারি না। আমি ফিরে আসব বিশ্বাস নেই তার। বুঝলে রমা, মা তো? নরম মন, মায়ায় ভরা।  নারীরা মায়ের জাতি।’

‘হু’। শব্দ করে উত্তর দেয় রমা। হাঁটা শুরু করার একটু পর রমা জানতে চাইল, ‘আমরা কই যাব পয়লা’। 
‘হাঁটো জোরে জোরে, এখন কোনো কথা না।’

রমা উত্তর করে না। হাঁটতেই থাকে। রাস্তা শেষ হয় না। নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখটি আবার ভেসে ওঠে। দুই সপ্তাহ কেটেছিল কবরীর সুখ-সংসার। এর মধ্যেই কত কী। পিঠে হাত রেখে শ্বশুর বলেছিলেন, ‘বাবা, হগ্গল বাপের কাছেই তার কন্যা ভালো, উত্তম। তবে আমি বেশি কিছু বলব না, খালি বলব, তুমি ঠকবা না। যদি কখনো-সখনো আমার কবরী ভুল করেই ফেলে, ক্ষমার চোখে দ্যাখবা। মাইয়া আমার মিশুক, সহজ-সরল, হাসি-খুশির।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘কষ্ট দেব না।’ 

শ্বশুর বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাজছে বইলা কাজটা তাড়াহুড়ো করে করছি। কওন তো যায় না।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়েছিল হাঁ ভঙ্গিতে। 

‘আমার আচানক মেয়ের দিকে খারাপ মাইনষের চোখ পড়েছে।’ 
রমার জবাব ছিল, ‘আপনি ভাববেন না, ওরে সুখে রাখব। কমতি হবে না।’
‘বাবা-রে ভাবতে চাই না কিন্তু মনটা ভাবে, কান্দে। এই আর কী। তুমি আমার ভরসা।’

রমা এদিনই ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিল শ্বশুরকে। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। চোখে পুরু চশমা। ভরা বর্ষাকাল। বিদায়বেলা, নৌকায় দাঁড়িয়ে দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে দুজনেরই অনিশ্চয়তার ছায়া। নৌকা ছাড়ার আগ মুহূর্তে  অর্থাৎ বিদায়কালে রমা শ্বশুরকে শেষ কথা বলেছিল, ‘এত চিন্তা করবেন না। আমি আছি না?’ 
সুধারামের কাশির শব্দে রমা সম্বিৎ ফিরে পেল।
‘ঘন কুয়াশা পড়ছেরে রমা।’ 
সুধার এমন কণ্ঠে হাঁ-না মন্তব্য না করে রমা জানতে চাইল, ‘আর কত দূর?’ 
‘আইসা পড়ছি, ওই তো দেখা যায়।’ আশ্বস্ত করে সুধা। 

রমা সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, বুঝলও না। ডানে-বায়ে  শুধু শরণার্থী শিবিরের লম্বা সারিসারি ঘর চোখের সামনে।  
রমা জানতে চাইল, ‘এটা কত নম্বর ক্যাম্প?’
হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয় সুধারাম, ‘পাঁচ নম্বর।’ 

প্রচণ্ড শীত। রমার মনে পড়ে, এক কাপড়ে মাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সে। গরম কাপড় তো দূরের কথা, কোনো কিছুই মাকে দিয়ে আসতে পারেনি। বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। তিন দিন অনাহারে কেটেছে। ছিল, প্রতিমুহূর্তে যমদূতের আতঙ্ক।

সুধাকে অনুসরণ করতে করতে বিরক্ত হয় রমা। তবু প্রকাশ করে না ক্ষোভ, কষ্ট- দুঃখ। কেউ বলে দেয়,  ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এসবের কোনোটিই নয়।  

নতুন রাস্তার অদূরে ত্রিপলের ছাউনিঘেরা ত্রাণকেন্দ্রের পাশে ধানি জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে চারজন নানাবয়সী পুরুষকে। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছে তারা। দাঁড়িয়ে-বসে থাকা নারী-শিশুরা শীতে কাঁপছে। বাঁশের বেড়া ও দুটি ত্রিপল মাটিতে পড়ে আছে। বোঝা যায়  খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সবকিছুই অনিশ্চিত। 

রমা জানতে চায়, ‘সুধাদা ওরাও মনে হয় রাইতে আসছে। তাই না?’
‘হু, খুব কষ্টে আছে বাইচ্চারা?’ মুখ ঘুরিয়ে শরাণার্থীদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুধা। 
‘আর কত দূর?’
‘অত অস্থির হইলে চলব?’ বিরক্ত কণ্ঠে সুধারামের জিজ্ঞাসা।
‘শীতে পা হিম হয়ে আছে!’ 

কয়েক মিনিটের মাথায় সুধা থেমে গেল। শরণার্থী শিবিরের মাঝখানে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের পাশে বেঞ্চ। বসে পড়ল সুধারাম। পাশের খালি জায়গাটি দেখিয়ে বলল, ‘বসো রমা। চা খাই আমরা, লোকটি এখানে আসবে।’ 

দোকানটি শরণার্থীদের মধ্য থেকেই কেউ বানিয়ে দিয়েছে এটি। চা-অলার আলাপে ধারণা পায় রমা।
চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে রমা বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাব, মুক্তিযুদ্ধ করব, মিলিটারিদের শক্তি শ্যাষ হবে, আর এইটাও সত্য- আমরা স্বাধীন হব একদিন।’
‘এর পর আমার কবরীরে কি পাব, সুধাদা?’

মাঝারি কণ্ঠে সুধা বলল, ‘রমা, তুমি কবরীরে নিয়া ভাবতেছ এখনো? কত কবরী  প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে, শরীর দিয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারিরে- এর সংখ্যা জানো? জানবা না কোনো দিন?’ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ওপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে সুধা বলল, ‘বিড়াল ইঁদুর ধরে খেলায়, কখনো নিজেই খেলে, আমাদের মা-বৈইনরে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ইঁদুর খেলা শুরু করছে,  বুঝলা?’ 

রমা বুঝতে পারে আগ্রহ ও ভীতি মিশে আছে কথাগুলোয়। সুধার চোখের দিকে তাকিয়ে রমা সন্দেহমাখা প্রশ্ন করল, ‘আমরা পারব, দাদা?’ 
‘শহরে ছিলাম, আমি তো ছাত্ররাজনীতি করেছি, মিটিং-মিছিল কম করি নাই। বহু বই পড়েছি, পৃথিবীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন? কোনো যুদ্ধের লগে মিল নাই।’ ভেঙে ভেঙে কথাগুলো বলে সুধারাম। 

‘আমরা পারব তো?’ রমা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবারও প্রশ্নের জবাব জানতে চায়। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না সুধারাম। 
রমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে বহু শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে। চা-অলা বলল, ‘ঘরে ছাউনি দিতে পারে নাই ওরা। চাটাই নাই, দড়ি নাই, আলপিন নাই।’
সকাল সাড়ে ৭টা হলেও রোদের দেখা নেই। সাদা কাপড় পরা এক বৃদ্ধা চা-দোকানির কাছে এসে জানতে চাইল, ‘পানি বসাইছ?’
সুধারাম একটু দূরে গিয়ে আরেকটি সিগারেট জ্বালাল। মাথা উঁচিয়ে আছে দূরের দিকে। কাউকে যেন সে খুঁজছে।

‘দেখা যায়?’ 
পেছন দিকে না তাকিয়ে সুধা ‘না’ ইঙ্গিতে হাত নাড়ল। 
রমা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল চায়ের দোকানি আর বৃদ্ধার কথা। এবার নিজেই কথা শুরু করে বৃদ্ধার সঙ্গে। ‘আপনারা কবে আসছেন এইখানে?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘বাইশ দিন হইল। কোনো গরম কাপড় নেই, একটা ঝুপড়িঘরে পরিবারের এগারো নারী ও শিশু নিয়া গাদাগাদি করে থাকছি। লগে পুরুষ মানুষ নাই একটাও। এইখানে, আসবার পথে তাদের ধরে নিয়ে গেছে পাঞ্জাবি মিলিটারিরা। রেজাকারেরা ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিছে। ওগোরে আমি বাংলাদেশি জানোয়ার বলি।’

শব্দটি রমার পছন্দ হলো। ‘বাংলাদেশি জানোয়ার?’
‘রেডিও দেই নাই। লুকাইয়া রাখছিলাম। পোলাডা মুক্তিযুদ্ধে গেছে।’ 

শুধু বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো আশ্বাস দিতে পারে না রমা। কী করা যায় এখন? কী-ই বা ক্ষমতা। চোখ যায় অদূরে, মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে। চিকিৎসা নিতে এসেছেন কয়েকজন নারী। দু-একজনের কোলে ফুটফুটে শিশু। তাদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। দুই মাসের একটি ছেলেশিশুর অস্বাভাবিক কান্না। চিৎকারের সঙ্গে মায়ের কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রমা অনুমান করতে পারে বাচ্চাটি অসুস্থ। মায়া জাগে। এগিয়ে যায় রমা। 

‘কী হয়েছে বাচ্চার?’

কাঁচাবয়সী এক নারী কয়েক পলক তাকান রমার দিকে। এর পর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেন, ‘পাকসেনারা স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। স্বামীর কোনো খবর জানা নাই। বাপ নাই বাচ্চাদের। বাচ্চারা সবাই অসুস্থ। কলেজে লেকচারার ছিলাম। এখন এতিমের মতো আমি।’

কোলের শিশুটি কেঁদে ওঠে। হাতে বিস্কুট জাতীয় খাবার তুলে দেন মা। নারী আবার কথা শুরু করেন, ‘কোলের বাচ্চাটা ঠাণ্ডা, জ্বর আর কাশিতে ভুগছে, চিকিৎসা নিতে আসছি। মেডিকেল ক্যাম্পে ডাক্তার নেই, আছে খালি নার্স।’ কথা শেষ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নারী অন্যদিকে মুখ ফেরান।

শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের শব্দ পাশের মেডিকেল ক্যাম্পে। হঠাৎ রমার চোখ থেমে গেল মেডিকেল ক্যাম্পের প্রবেশপথের দিকে। একটি মেয়েমুখ তার দিকে চেয়ে আছে, বিস্ময়ে ভরা চোখ। অসুস্থ হলেও হঠাৎ যেন দেহের সব শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা ওর। রমা এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। চোখজোড়া  যেন পরিচিত। যে চোখজোড়া দেখে রমা আকর্ষিত হয়েছিল। তবে কী কবরীর চোখ? একদার প্রিয় স্ত্রী কবরী এখানে এলো কীভাবে? ওর এমন দশা কেন? অসংখ্য প্রশ্ন, জবাব নেই। আরও কাছাকাছি হয় রমা। চিনতে ভুল হয় না।

‘তুমি কি কবরী, না?’

রমার এ প্রশ্নের জবাব নেই নারী মুখটিতে। মায়াময় মুখচোখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। মনে হয় এ যেন শতজনমের পরিচিত কেউ। 
রোগীর ওপর চোখ রেখে মধ্যবয়স্কা নার্স জবাব দেন, ‘পাকিস্তানি মিলিটারা এ নারীর ওপর এতটাই অত্যাচার করেছে যে, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।’ 

‘মানে?’ 

‘মানে, লিখতে পারে, বলতে পারে না। লিখে জানাল ওর নাম কবরী। বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের দিরাই।
রমাকে খুঁজতে খুঁজতে সুধারাম মেডিকেল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসে।  চোখাচোখি হতেই রমাকে তাড়া দিয়ে সুধারাম বলে, ‘সময় হয়ে গেছে। আমাদের লোক এসে গেছে, আসো তুমি।’

‘কোথায়?’ রমার জিজ্ঞাসা।
‘কেন? যুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে।’
‘আমার কবরীকে রেখে? স্ত্রীকে রেখে?’ রমার প্রশ্ন।

কোনোদিকেই  ভ্রুক্ষেপ নেই সুধারামের। একমাত্র জবাব তার,  ‘হাজার হাজার, লাখ লাখ কবরীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে রক্ষা করতে হবে। মাটিকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব, রমা!’

‘না, আমি যাব না, সুধাদা।’

উচ্চকণ্ঠে সুধারামের জবাব, ‘ছাবালের মতো কথা বলবা না। দেরি করা যাবে না।’ রমার প্রাণে বেজে ওঠে রবীন্দ্র সংগীতের সেই দুটি চরণ- নেব সকল বিশ্ব দাও সে প্রবল প্রাণ, করব আমায় নিঃস্ব দাও সে প্রেমের দান’।

ধারাবাহিক উপন্যাস গোপনীয়

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৬ এএম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
গোপনীয়
গ্রাফিকস: নাজমুল মাসুম

পর্ব- ১৮

কোনো এক বিখ্যাত কবি নাকি বলেছিলেন, এপ্রিল হলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস। আর রিয়াজুল্লার কাছে সপ্তাহের নিষ্ঠুরতম দিন হলো রোববার। বিদেশে এ দিনটি সাপ্তাহিক বন্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে সপ্তাহ শুরু এ দিনে। তাই রোববার সপ্তাহ শুরু হলেও শরীর সাড়া দেয় না। ক্লান্তি জাকিয়ে বসে মনে। নেতা-কর্মীরাও আসে না খুব একটা। তবে দুই সপ্তাহ ধরে তার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে একজনের কল্যাণে। তার নাম অধরা। বাস্তবেও সে অধরা, অন্তত এখন পর্যন্ত।  
রিয়াজুল্লার ক্লান্তিক্ষণগুলো অধরা ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে চ্যাটের মাধ্যমে। বাইরের পৃথিবীতে মহান নেতার বিশাল ভারে নূব্জ রিয়াজুল্লা অধরার কাছে নিতান্তই একজন সুখে-দুঃখে ভরা সাধারণ ব্যক্তি। অধরার সঙ্গে তার জীবন, কথা, উপকথা একান্তই ব্যক্তিগত। সেখানে রাজনীতি নেই, সমাজনীতি নেই, নেই অর্থনীতি অথবা নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা।   
ইদানীং রিয়াজুল্লা ভাবছে, একদিন অন্তর্জালের দেয়াল ছিন্ন করে অধরা নামের মেয়েটি ধরা দেবে তার করকমলে, এসে বসবে ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে, শিয়রে ছড়াবে চুলের গন্ধ।  
অধরার সঙ্গে প্রথম দিনের কথা সারাক্ষণ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে রিয়াজুল্লার কানে,  
-হ্যালো।  
-কে বলছেন?  
-আমি অধরা। আপনি?  
উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল রিয়াজুল্লা। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সে। তাই নিজের নাম বলল না।
বলল-  
-আমি কে তা তো আপনি জানেন।   
-আশ্চর্য আমি আপনার নাম জানব কী করে?  
-আপনিই তো হ্যালো বললেন।  
-চ্যাট বক্সে আপনার আইডি দেখে নক করলাম। আইডি নম্বর বিডি ০০৭। নাম তো লেখা নেই!  
এইবার রিয়াজুল্লা বিপদ দেখে, ভাবে নাম বলবে। শেষে বহু চিন্তা করে বলে,   
-আমার নাম জুল্লা।  
কিন্তু নাম লেখার আগেই কম্পিউটারের স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। সরকারের পরিবর্তে লোড শেডিংকে কষে গালি দিতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ তার মনে হয় সরকার লোড শেডিং করে মানুষে মানুষে যোগাযোগে বাধা দিচ্ছে। এটি এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। পাঁড় রাজনীতিক রিয়াজুল্লা। সে এটিকে নতুন প্রজন্মকে পার্টিতে টানার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়।   
তবে ব্যক্তিগত চ্যাটের মধ্যে তার স্বভাবগত রাজনীতি চলে আসায় লজ্জা পায় রিয়াজুল্লা।  
আবার ‘অধরা’র কথা ভেবে হৃদয়ের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়েটির নাম সে জানল, কিন্তু তার নামটি মেয়েটি জানল না। আচ্ছা সে কে অথবা কোথায় তার বাড়ি! দেখতেই বা কেমন সে! সে কি তার মা আর বন্ধুদের প্রাণপন চাওয়া পাত্রীর একটি স্বার্থক জবাব হতে পারবে- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্নে রিয়াজুল্লার মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়।  
অস্থিরতা কয়েকদিন কয়েক মাসের মতো ভারী মনে হয়। তবু রুটিন করে অফিসে আসে সে। রাজনীতি করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে ‘অধরা’ নামের অধরা মেয়েটির কাছে। আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা হবে কি!  
এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বকুলঝরা পুলিশ ফাঁড়ি লুটের ঘটনায় তার দুজন কর্মীকে ফাঁসি দিয়েছে সরকার। তার প্রতিবাদ সভা শেষে মিছিল করতে করতে অফিসে ফিরেছে রিয়াজুল্লা। 
একটু জিরিয়ে বেরোবে বাড়ির উদ্দেশে। এসময় আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি এল। আর বৃষ্টির সঙ্গে এল প্রায় ভুলতে বসা ‘অধরা’র ডাক-  
-হ্যালো কেমন আছেন!  
-আপনি?  
-হ্যাঁ আমি।  
-এতদিন কোথায় ছিলেন?  
-তেঁতুল ঝরা গ্রামে। চেনেন ওই গ্রাম?  
-না। 
একদিন আসুন। আপনাকে নিয়ে যাব। তবে সংগীতের যেমন প্রহর থাকে, ওই গ্রামে যাওয়ারও নির্দিষ্ট সময় আছে। ওখানে পৌঁছাতে হয় হব হব সন্ধ্যায় যখন দিনের আলো নরম হয়ে আসে আর বৈরাগীর পাহাড়ের আড়ালে তিনি রঙের খেলা সাজান। তার পর সন্ধ্যা সোনার মতো হলে বোয়ালভাসা নদীর তীরে বসতে হয় পাশাপাশি-ললাট লিখন থাকলে দেখা যায় দিন-রাত্রির সেই মিলন খেলা। তা শুধু অনুভবই করা যায়, মুখের কথায় বা হাতের লেখায় বলা যায় না কোনোদিন।  
-বাহ্, আপনি কি কবিতা লেখেন নাকি?  
-নাহ, আমিই কবিতা। আপনি কী করেন?  
-আমি বলি। 
-মানে?  
-মানে আমি বক্তা। ‘বক্তৃতা আমার পেশা, নেশা, বক্তৃতা আমার প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার।’ 
-আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার পেশা কী, মানে আপনি কী করেন।   
-বললাম তো আমি বক্তৃতা দিই।         
রিয়াজুল্লা আরেকটু হলে বলেই ফেলত, সে রাজনীতি করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনীতিই তাকে বাঁচিয়ে দিল। সে বলল-  
-আমি প্রতিবাদ করি। আর আমি মানুষকে আশাবাদী করি।  
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।  
-না বোঝার কী আছে। আপনি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেশের আকাশে স্বাধীনতাবিরোধী শুকুনিদের ডানার উল্লাস, জমিনে লুটেরা আর সন্ত্রাসীদের মুখের ব্যাদান। এ অবস্থায় একজন সুস্থ মনের মানুষ, যার মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেম আছে প্রতিবাদী না হয়ে পারে না; আমিও পারিনি।  
-আপনি রাজনীতিকের মতো কথা বলছেন।  
রিয়াজুল্লা খেয়াল করল আবার তার পরিচয় ফাঁস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু সে তো চ্যাট শুরু করেছিল রাজনীতির বাইরে তার একটি একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অন্বেষায়; যেখানে পৃথিবী থেকে দূরে কোনো এক নিরালায় একটি গৃহকোণ থাকবে, গৃহের দুয়ারে মৃদুল প্রদীপ জ্বেলে কেউ একজন দিনের শেষে অস্থির অপেক্ষা করবে; তার পর দিনের ক্লান্তিকর দুনিয়াদারি শেষে বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছালে অপেক্ষার সে মানুষটি মৃদু অনুযোগ তুলে বলবে, ‘ফিরতে অ্যাতো দেরি হলো ক্যান?’  
কিন্তু তার রাজনৈতিক সত্তা তার ব্যক্তি সত্তার ওপর এমনভাবে আছর করে আছে তা আগে কোনোদিন জানতে পারেনি সে। এখন, এই তুমুল মুহূর্তে সে উপলব্ধির সন্ধান পেয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এদিকে তার জবাব না পেয়ে স্ক্রিনের মেয়েটি বারবার বলে চলেছে  
-কী হলো? কথা বলছেন না যে!  
-হ্যালো?  
-হ্যালো...   যখন খেয়াল হলো, রিয়াজুল্লা ভাবল, কিছু লেখে, সে লিখল-   
-সরি, ফোন এসেছিল।  
কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে উঠল অধরা চ্যাটবক্স ত্যাগ করেছেন। আর তখনই রিয়াজুল্লার মনে হলো, এবারও তার নামটি বলা হলো না।


পর্ব-১০
শানবাঁধানো পুকুরঘাটে চেয়ার পেতে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। জরুল্লার কাজে খুশি হলেন মা। রিয়াজুল্লা এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার মন যেন অন্য কোথাও!  
দুই হবু বেয়াই বেয়াইনের সঙ্গে মায়ের পরিচয় হলো। ভদ্রলোক স্থানীয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক। রিয়াজুল্লার মায়ের সঙ্গে মিল হওয়ায় দুই পক্ষই খুশি। দুই অধ্যাপক সাহিত্য নিয়ে ইতং বিতং কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। একজন বিষ্ণুদের কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই রেগে গেলেন। দুই উল্লা এসবের মর্মার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে  
থাকল।  
এসময় চা-নাশতা পরিবেশন হওয়ায় বাঁচোয়া।  
হরেক রকমের বৈকালিক নাশতায় ভরে উঠল শানবাঁধানো পুকুরপাড়। টেবিলে টেবিলে ঘিয়ে প্রজ্বলিত প্রদীপ শিখা। বোঝা গেল, বাবা বাংলার অধ্যাপক হলেও, কনের মা সাংসারিক বিষয়ে সাংঘাতিক সচেতন। মেয়ের কনে-দেখা বলে কথা!  
রিয়াজুল্লার মায়ের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এসবে পটে যাওয়ার পাত্রী আমি নই; তা ছাড়া আমি নিশ্চিত এসব নাশতার অর্ধেকও মেয়েটি বানায়নি।  
কিন্তু মেয়ের মা পাক্কা গৃহিণী। হবু বেয়াইনের মনোভাব বুঝে তিনি আগেই বলে ফেললেন,  
-মিথ্যা বলব না, এসব নাশতার অধিকাংশ বাইরের, তবে গুরুত্বপূর্ণ আইটেমগুলো আমার মেয়েই বানিয়েছে। মা আমার সাক্ষাৎ গৃহলক্ষ্মী। 
মনে মনে গজরান রিয়াজুল্লার মা, এ যে দেখছি ঘসেটি বেগম; তার মেয়ে কেমন হয় আল্লা মালুম।   
কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললেন,  
-বাহ্, খুবই ভালো। তা আপনার গৃহলক্ষ্মী মেয়েটিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। গৃহশাস্ত্র সম্পর্কে তার সঙ্গে একটু আলাপ করতাম।  
মেয়ের মা আহত হোন মনে, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। তবে এসময় সন্ধ্যার পরিবেশ আলো করে মেয়েটি হাজির হলে সবাই নড়েচড়ে বসে। রিয়াজুল্লার মায়ের গলা দিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি বের হয়ে আসে,  
-বাহ্, আমাদের মা তো দেখি আসলেই গৃহলক্ষ্মী!  
তবে পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সংযত করে নেন। এ মেয়েকে আগে তিনি সব উপায়ে পরীক্ষা নেবেন; তার পর মন্তব্য করা যাবে।  
একটু দূরে বসে রিয়াজুল্লা বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যা হওয়া দেখছিল।       
বন্ধু বলল, দেখ, ভালো করে দেখ। 
রিয়াজুল্লা- দেখেছি। ও ঘর হতে বের হওয়ার সময়ই দেখে ফেলেছি।        
-কী দেখলে?  
-উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, ওজন ৪৫ কেজি, কালো চুল কোমর ছাপিয়ে নেমেছে।  
-আর কিছু দেখলে?  
- আর দেখলাম কথা বলা দুটি চোখ, দুটি চঞ্চল পা, আর তনুমধ্যা শরীরে কালীদাসের উপন্যাসের রমণীদের মতো কদলী উরু।  
-বাহ্, তুমি কি কবি নাকি রাজনীতিক?  
-আমি রাজনীতিক বলেই মানুষকে দেখার, চেনার এই চোখ আছে। পরীক্ষণের ব্যাপারটা মা-কে করতে দাও, চলো আমরা দূর থেকে দেখি।  
এদিকে মায়ের নির্দেশে মেয়ে হবু শাশুড়িকে কদমবুচি করে নাশতা পরিবেশন শুরু করেছে। পরীক্ষার হলে কঠোর পরীক্ষকের মতো রিয়াজুল্লার মা মেয়েটির প্রতিটি নড়ন চড়ন, তার কথা, এমনকি বারে বারে মাথা থেকে নেমে আসা মখমলের ওড়নাটি পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে  চলেছেন। এক সময় তিনি বলেই ফেললেন-
-তা বেয়াইন আপনি আপনার মেয়েকে শাস্ত্রে বর্ণিত চার রমণীর কোনটিতে ফেলবেন।
-মাফ করবেন, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।  
-না বোঝার কী আছে, আপনি কি শাস্ত্রে বর্ণীত হস্তিনী, সিংহিনী, শংখিনী, পদ্মিনী এ চার প্রকার মেয়ের ব্যাপারে জানেন না?  
-বেয়াইন আমি মেয়েকে শিখিয়েছি শালীনতা, লেহাজ, আর ঘরকন্না। আপনার বেয়াই শিখিয়েছেন তাহজিব আর তমুদ্দুন। কিন্তু এরকম শাস্ত্রবর্ণিত রমণীভেদ আমার জানা নেই।  
-ঠিক আছে। আমিই দেখছি। ক্লান্ত দিবাকর মলিনমুখে অস্তাচলে বসেছেন। তার শেষ রশ্মিটুকু পৃথিবীর পাতায় পাতায় অনিঃশেষ মায়ায় লেপ্টে আছে। তারই এক টুকুরো কিরণ পৃথিবীর বুকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি মেয়েটির শাড়ির আঁচলে ‘লুটাইয়া পড়িতেছিল’। 
রিয়াজুল্লার মা মেয়েকে কাছে ডাকলেন।         
-জি মা!  
-সুরা ফাতেহা একটু পড়ে শোনাও মা।
-আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।........ওয়ালাদ্ব্যোল্লিন।  
-আমিন। ভালো, তবে কোরআন পড়ার সময় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে শুরু করতে হয়। এটি কোরআনের আদব। বেয়াইনকে বলছি, যারা পদ্মিনী তারা শুধু জীবনাচারে নয়, ধর্মাচারেও আদব মেনে চলে।  
মা বা মেয়ে কেউ কিছু বলে না। নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে চারদিক। দিনান্তের ম্লান আলো দিয়ে দিগন্তের পাহাড়গুলোর চূড়ায় রঙের খেলা সাজিয়েছেন তিনি। সেই আলোর খেলা মেয়েটির অলক চিকুরে লেগে মোহনীয় হয়ে উঠেছে। বোধ করি, তা দেখেই পিতা বলে উঠলেন-  
আচ্ছা বেয়াইন, আগে কিছু মুখে দেন। তার পর কথা বলুন। 
কিন্তু যার উদ্দেশে এ কথা বলা সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি একদৃষ্টে মেয়ের মাথার দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন,  
-মা, তোমার চুলের কবরী খুলে দাও তো দেখি। 

চলবে… 

রঙচঙে

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৬ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
রঙচঙে
আঁকা: খবরের কাগজ

সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি,
খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি সাদা হয়ে আসছে,
পাকন ধরেছে কয়েক গাছি চুলে। 
রঙচঙ মেখে আর ক’টা দিন না হয়
লুকালে আড়ালে,
জীবনের যে রঙ হারিয়েছে, 
তা ফিরবে আর কোন ভোরে? 

মোমের মতো গলে যাচ্ছে সময়,
চামড়া কুঁচকে গিলে খেল বয়স, 
বলিরেখাদের উল্লাস।  
ফাউন্ডেশনের শেড কিংবা সেটিং স্প্রে
আবারও স্বপ্ন দেখায়, 
যে সূর্য মধ্য গগণ পেরিয়ে গেছে, 
আস্তাচলেই তার নিয়তি, কে বোঝাবে?

অবিমিশ্রিত চিন্তার দেয়াল

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
অবিমিশ্রিত চিন্তার দেয়াল
আঁকা: খবরের কাগজ

চিন্তার দেয়ালজুড়ে বাসা বেঁধেছে অচিন আশ্রম
প্রত্যহ জলকেলি করতে করতে সে দৃশ্য আঁকে
                    আমি তার দিকে চেয়ে থাকি
                                ভগ্ন হৃদয় থেকে
কার যেন অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে
সে কি মা নাকি প্রেয়সী-       নিদারুণ বিরান প্রহরে
                                 ভাসছে কারও মুখ
আমার অবিশ্রিত চিন্তার দেয়ালজুড়ে তার পদচারণ
এসো ভিন শতাব্দী থেকে       আত্মার কোমলতা ছেড়ে
বিলিন হও আমার মস্তিষ্কের নিউরণে
                        চারদিকে মুখোশ মিছিল
পা গুলো এগিয়ে যাচ্ছে        কেবলই এগিয়ে যাচ্ছে-

এ কেমন দিন

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
এ কেমন দিন
আঁকা: খবরের কাগজ

চুলার ভিতর থেকে সরাসরি উঠে এসে পাকানো আগুন 
আমাকে হঠাৎ বলে: 
কেন তুমি এমন শীতল, এত চুপচাপ? 
বরং এখন চলো খোলা মাঠে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিই! 
হ্যাঁ, ঠিক কথাই তো- আমি আগুনকে সাথে নিয়ে  
বের হয়ে পড়ি- ব্যস্ত পথে দেখি, 
লোভী মানুষেরা কী নিপুণভাবে
শার্টের পকেটে লুকিয়ে রেখেছে হিংসা, ঘৃণা আর ক্রোধ!
এর কোনো মানে হয়? 
কারও আচরণে নেই গভীর মমতা,  
ফুটপাতে ধুলায় গড়াচ্ছে আহত বাসনা 
আর মনুষ্যত্ব প্রতিটি বাড়ির স্টোর রুমে বসে ঝিমুচ্ছে একাকী!

বলুন না এ কেমন দিন এল? 
হেঁটে হেঁটে স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে 
স্বচ্ছ জলাশয় পার হই, পাশে খোলা প্রান্তরের 
মাঝখানে পৌঁছে ভীষণ চমকে উঠি, চোখে পড়ে-
সবুজ গাছের পাতা ছুঁয়ে বাতাস নীরবে ছড়াচ্ছে আদর,   
অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হই- ঘোর কেটে গেলে 
শুরু করি খেলা, দুই ঠোঁট বেয়ে 
উঠে আসা শব্দগুলো সযত্নে জাগিয়ে তুলি
আর বুকে জমে থাকা সব কষ্ট ওমে পরিণত করি।

সৃষ্টির বিচিত্র এ-খেলায় নেশা পেয়ে বসে,  
এক এক করে সেই সব ওম মননের সুতোয় জড়িয়ে
আগুনের নিখুঁত দলায় রূপ দিই, তার পর 
রোদে যত্নসহ মেলে ধরি! 
বলা তো যায় না, এই অস্ত্র প্রয়োজন হতে পারে যে-কোনো সময়!

মৃত্তিকা ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিল

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২০ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২১ পিএম
মৃত্তিকা ব্রহ্মপুত্রের কাছে এসেছিল
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

মৃত্তিকা আমাকে সকাল ঠিক ১০টায় এখানে থাকতে বলেছে। এখানে বলতে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। নদের পাড়ে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। বেলা গড়ায়নি দেখে দর্শনার্থীদের ভিড় এখনো তেমন জমে ওঠেনি। পাড়ে বেশ কিছু শ্যালোনৌকা যাত্রীর অপেক্ষায় অলস সময় পার করছে। এজন্য যাত্রী ভেড়াতে কোনো হাঁক-ডাক নেই। এর মানে যাত্রী তোলার কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। 

মৃত্তিকা এমন একটি মেয়ে, যার সারা দিন যায় প্রাণচাঞ্চল্যে। ধনীর ঘরের বখে যাওয়া মেয়ে নয় ও। সমাজবাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা বজায় রেখে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে সে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ওর সীমাহীন। জানতে চায়, বুঝতে চায়। এলাকাবাসী হলেও ব্রহ্মপুত্র সম্পর্কে ওর জানার আগ্রহ নতুন করে বেড়ে গেছে। আমাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র অবলোকন করবে, জানবে, বুঝবে। 

একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। একটি মেয়ে অটোরিকশা থেকে নামার পর তাকে আর মেয়ে বলা যাবে না। কারণ, মোহনীয় আর রমণীয় রূপে যাকে দেখছি, সে আসলে নীলাম্বরী মৃত্তিকা। নীল শাড়ির সঙ্গে শরীরের প্রত্যেকটি পোশাক কম্বিনেশন করে পরেছে। এক কথায় যা অপূর্ব। 

আমি তার হাত ধরে একটি শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকায় গিয়ে বসলাম। 
আমি মৃত্তিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ তুমি নীলাম্বরী সাজে এলে কেন?
প্রসারিত হাসি দিয়ে মৃত্তিকা বলল, ‘এখন শরৎকাল। আর শরৎকালের আকাশ এমনি থাকে। তুমি কি মনে করো ঋতুর প্রকৃতির সঙ্গে আমি মানিয়ে চলব না?

‘রুচিবোধ তোমার বরাবরই ভালো। শরতের মেঘাকাশে তোমার নীলাম্বরী রং আরও ঝিলিক দিয়ে উঠবে।’ 
‘আমাকে নিয়ে গবেষণা করবে নাকি আজকের কার্যক্রম শুরু করবে।’
‘তুমি তো ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে এসেছ!’ 
‘হ্যাঁ এলাম, কিন্তু রোদ তো খুব চড়া। একটা ছাউনিনৌকা হলে ভালো হতো না?’
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘তাহলে কি ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা বা পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে পারবে।’ 
মৃত্তিকা বলে, ‘এলাম তো সে জন্যই।’
‘তুমি আজকে একটা পারফেক্ট সাজ করেছ।’
‘কী সেটা?’
‘এখন তো শরৎকাল, ঠিক না।’
‘হ্যাঁ, তাতে কী?’
‘তুমি নিজেকে দিয়ে শরৎকালের প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছ, এটা কি তুমি জেনে-বুঝে করোনি?’
‘বুঝলাম না তোমার কথা।’
‘শরতের প্রকৃতি এখন ডানা মেলে আছে আর তুমি আজ পরে এসেছ সবুজ নীলপেড়ে শুভ্র-সাদা শাড়ি! তাহলে এটা কেন করলে, বলবে?

আমার এ কথায় মৃত্তিকা খুব প্রসারিত হাসি হেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নৌকায় দুলুনি দিতে থাকে। এতে বোঝা গেল, ব্রহ্মপুত্র নদের কাশবন আর ওর পোশাক ও মনন শরৎপ্রকৃতির কম্বিনেশন ফুটিয়ে তুলতেই নিজেকে সাজিয়ে এনেছে; যা বেশ অপূর্ব। শরৎকালীন শুভ্রতার প্রতীক বলা যায়। প্রকৃতিকে অনেক সতেজ মনে হয়। আমাদের মধ্যে কথা হয় শ্যালোইঞ্জিনচালিত নৌকা হলেও ইঞ্জিন চালু থাকবে না। মাঝি বৈঠা চালিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে নাও বাইবে। এতে করে আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। নৌকা ধীরে ধীরে চলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্তিকা গুনগুনিয়ে গান ধরে, ‘আমারও পরান যাহা চায় তুমি তাই গো’, ওর গলায় মেলোডি আছে! অল্প-স্বল্প চর্চা করে। এটা বোঝাই যায়। 

আমাদের নিয়ে বেয়ে যাওয়া শ্যালোনৌকাটি হঠাৎ-ই থেমে যায়। ব্যাপার কী? সামনেই খেয়াঘাট, প্রচুর নৌকা ঘাটে ভেড়ানো, যার দরুণ ওরা জ্যামে পড়ে যায়। আমরা জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার পাড়ে। ভিড়ের মধ্যে পারাপার করতে গেলে যাত্রী এবং মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে একটা বাড়তি টেনশন থাকে; যার দরুণ হুড়োহুড়িতে অঘটন ঘটে। একটা শিশু শ্যালোনৌকা থেকে পড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। আমি মৃত্তিকাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটাও প্রকৃতির একটা স্বাভাবিকতা। ব্রহ্মপুত্র নদের পারিপার্শ্বিকতা অবলোকন করতে গিয়ে মৃত্তিকার জন্য এটা বাড়তি জানা হলো। 

বাঁ-পাশে কাশবন আর রবিশস্যের খেতের সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এক নিসর্গ উপাদান এতে বিরাজ করছে। মৃত্তিকা হঠাৎ করে চঞ্চলা হয়ে উঠল। মাঝিকে বলল, নৌকা থামাতে। নামতে গিয়ে নদের পাড়ের পানিতে নেমে পড়ে। মৃত্তিকার শরীর হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যায়। এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার! কাশবনে ঢুকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে শুরু করল। আমি ওর কাছে যেতেই মৃত্তিকা আমারও কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। এর পর আমার হাতে ওর মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি কাশবনে লুটোপুটি খাব, তুমি এটা ভিডিও করো। 

আমি তাকে বললাম, ‘তুমি এমনটি করতে চাচ্ছ কেন? 

মৃত্তিকা আমাকে বোঝায়, নদীর পাড়ের কাশবনটা শরৎকালেই ধরা দেয়। তখন কাশবনের পাশে সবুজের সমারোহ থাকলে আর আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ালে আকাশ-প্রকৃতির সঙ্গে মাটি-প্রকৃতির ভীষণ একটা লুকোচুরি খেলা হয়। 
‘বাহ! তুমি তো বেশ দর্শনতত্ত্বে কথা বললে, তোমার কথার বহিঃপ্রকাশ আগে তো এমনটি দেখিনি!’ 
‘আমার বান্ধবী বর্ষা আর আমি সুযোগ পেলেই এসব নিয়ে ডিসকাস করি। এই যেমন ধরো, আমি আজ নীলপেড়ে শুভ্র সাদা শাড়ির সঙ্গে কীসের কম্বিনেশন করলাম, শরৎপ্রকৃতিকে সাদর-সম্ভাষণ জানানোর জন্য না? তুমি এটাই মনে করতে পার।’ 
আমি তাকে বোঝালাম যে, ‘নদনদী তীরবর্তী এলাকাতেই সাধারণত শরৎকালে কাশবনের প্রভাব থাকে বেশি; আর দেখ, আমাদের এখানে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই কূলেই কাশবন আর সবুজ প্রকৃতির সমারোহ থাকে।’

মৃত্তিকা কাশবনের একটি ফুলের তোড়া ডান হাতে নিয়ে পতাকা নাড়ানোর মতো দোলাতে দোলাতে কাশবনজুড়ে দৌড়াতে থাকে। মনে হচ্ছে শিশুকালে চলে গেছে মৃত্তিকা! খুনসুটি, দুষ্টুমি যতটুকু পারা যায় যেন নিজের সঙ্গেই করছে। শেষ বর্ষায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কিছুটা জমে গেছে বলা যায়, কাশবনের পাশেই রবিশস্যের খেত এখনো সবুজাভ থাকলেও বেড়ে উঠছে। মৃদু বাতাসে তা দুলে দুলে উঠছে। মৃত্তিকা আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে নেয়। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দুজনের সেলফি তোলে। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সঙ্গে মৃত্তিকা নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। শরৎকালের আবহের সঙ্গে পোশাকের আবহ ধরে রাখবে বলেই সে আজ প্ল্যান করে বেরিয়েছে। 

আমরা আবার শ্যালোনৌকায় চড়ে বসলাম। হঠাৎ মৃত্তিকা আসল প্রশ্ন করে বসে, ‘একটা ব্যাপার তুমি খেয়াল করে দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘কোন ব্যাপারটা?’

‘এই সিজনে ব্রহ্মপুত্র নদে কমবেশি পানি ঠিকই আছে কিন্তু পাড়ে কোথাও সরু আর কোথাও প্রশস্ত, এটার কারণ কী?’
‘আদিকাল থেকেই তো নদীর ভাঙা-গড়া! মানুষ দুই পাশ দখল করে আবাসন গড়ে তুলেছে আবার বালু উত্তোলন করতে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করায় ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথের বিঘ্ন ঘটেছে।’

‘বহু পুরনো নদ তো ব্রহ্মপুত্র। চারদিক তাকালে বোঝা যায় দুই পাড়ে প্রচুর ভাঙা-গড়ার খেলা হয়েছে।’ 
আমি মৃত্তিকাকে বললাম, ‘আমরা এখানকার মানুষ, যদ্দূর জানি, অনেক আগে ব্রহ্মপুত্র নদ এখানে ছিল না। ছিল ময়মনসিংহ শহরের গাঙিনার পাড়ে। কালের গর্ভে পরে নদ ধীরে ধীরে বর্তমান জায়গায় চলে এসেছে।’
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে, ‘তোমার তথ্যের ভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ দেখা যাচ্ছে।’

আমি তাকে বোঝালাম,‘ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী শহরে আমাদের বসবাস, তাহলে তোমার-আমার কিংবা সবারই এসব জানা থাকা দরকার না?’
মৃত্তিকা বলে, ‘জানার পরিধি তো ব্যাপক! আমরা কেউ বেশি জানি আবার কারও জানাশোনা কম! অভিজ্ঞতা সবার এক রকম নয়। যেমন ধরো, আমি যদি আজ তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের আদিগন্তের খোঁজখবর নিতে না আসতাম, তাহলে আমিও তো অন্ধকারে রয়ে যেতাম!’
একটু দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় বেশ কিছু অসমাপ্ত স্থাপনা দেখা গেল। হেলেপড়া টিনের চাল, ভাঙা কাঠের খুঁটি ইত্যাদি। মৃত্তিকার চোখ এসব এড়ায়নি। 

আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘ওই পাড়ে ভাঙাচোরা এসব কী?’
আমিও তার কৌতূহল মেটাতে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলাম, বললাম, ‘কিছুদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের আওতা বাড়াতে জমি অ্যাকোয়ারের বিজ্ঞপ্তি ছেড়েছিল। 
‘জমি অ্যাকোয়ার হয়ে গেছে?’
‘না, চরাঞ্চলের লোকেরা আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং-মিছিলে নিজেদের সরব রাখে।’ 
‘তাদের আন্দোলন কি সফলতা পেয়েছিল?’
‘এটার কোনো সিদ্ধান্তই এখনো হয়নি। এখন আন্দোলন কিংবা জমি অ্যাকোয়ার সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- এ ব্যাপারে এখন কোনো পক্ষেরই যেন কোনো মাথাব্যথা নেই?’
‘আমাদের দেশে তো এখন এরকমই হচ্ছে যে, কোনো আন্দোলন প্রথমে সংগঠিত হলেও পরে তা পর্যায়ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ে। 
‘তোমার কথা ঠিকই আছে। কোনো পক্ষের আপসকামিতা থাকলে এরকমই ঘটে।’ 

পড়ন্ত বিকেল এখন। আমাদের নৌকার স্পিড এখন অনেকটাই কম। আসলে কমিয়ে রাখা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাশের আসন্ন সন্ধ্যা অবলোকন করার জন্যই। সামনে নদের পানিতে বিশাল এক ছায়া পড়েছে। বাঁ-পাশে বৃহৎ অট্টালিকার পাওয়ার হাউস। এখানে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার থেকে একটা অংশ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার কাজে লাগে, বাকিটা রপ্তানি হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় এ ধরনের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এটা ধরে নেওয়া যায়। 

সকাল থেকে পাখিদের মতো কলরবে মাতা মৃত্তিকা ক্লান্ত শরীর নিয়ে নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়েছে। সারা দিনের ক্লান্তি ওর শরীরকে অবসন্ন করে ফেলেছে। চঞ্চলা হরিণীকে এখন নেতিয়ে পরা বাঘিনীর মতো মনে হচ্ছে। সারা দিনের ধকল অনেক গেলেও দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার ব্রহ্মপুত্র নদের রূপবৈচিত্র্য এবং এর গতিপ্রকৃতি দুই চোখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখার জন্য এ এক পরম সৌভাগ্য বলেই মনে করে মৃত্তিকা। ওর শান্তশিষ্ট রূপ সেটাই বলে দিচ্ছে।