-Golpo-FL-1735279657.jpg)
সবাই ওকে পরী বলে ডাকে। এই নামটা ওর কে রেখেছিল, কে জানে! লম্বাটে গড়ন আর দেখতে একটু শ্যামলা, কিন্তু মুখের আদলটা চমৎকার। বড় বড় চোখ দুটো যেন সব সময় কথা বলে চলেছে। শান্ত তাতেই মুগ্ধ। পরী যখন কারও দিকে চোখ তুলে তাকায় তখন মনে হয়, ও যেন অন্য কোনো গ্রহের মানুষ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে কারোর দিকে।
প্রায় একটা বছর ধরে এই কলেজে পড়ছে শান্তনু। এতদিনে সহপাঠীদের কাছে সে সংক্ষেপে শান্ত নামেই পরিচিত হয়ে গেছে। সবার কাছে গ্রাম থেকে আসা শান্ত একেবারেই শান্তশিষ্ট গুড বয়। নামের সঙ্গে ওর স্বভাব-চরিত্র যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, সবাই এটাই বলে।
ওর সহপাঠীদের মধ্যে মিলন, বিথী, শাহনাজ, রেবেকা, রুমি আর ওই পরী, বলা যায়, প্রায় সব সময়ই একসঙ্গে থাকে। এদের সঙ্গে কখনো কখনো যুক্ত হয় শান্ত। তবে গ্রামের ভালো ছেলে শান্তকে ওরা বেশি পাত্তা দেয় না। এটা যে শান্ত জানে না, তেমন নয়। জেনেও কখনো কখনো ওদের সঙ্গে আড্ডায় শামিল হয়। তখন সবার অজান্তেই যেন ওর মনের ভেতরে একটা সুপ্ত ইচ্ছা কাজ করে, সেটা হলো পরীকে দেখা। ওর মনের এই গোপন ইচ্ছাটা ও কাউকে জানতে বা বুঝতে দিতে চায় না।
পরীকে ওর খুব ভালো লাগে। তবে কেন এই গোপন ভালোলাগা, এই প্রশ্নের উত্তরটা সে কোথাও খুঁজে পায় না। তবে এসব ব্যাপারে মেয়েদের চোখ এড়ানো শক্ত। না হলে গতকাল ওই শাহনাজ কেন বলে উঠবে, এই যে গুড বয়, আমার কিন্তু সন্দেহ হয়, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ না তো!
হঠাৎ শাহনাজের এই কথাটা শুনে সবাই নিজেদের কথা থামিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে।
ভ্রু কুঁচকে বিথী বলে, তুই কাকে কী বলছিস রে শানু?
শাহনাজ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, আজকে আমি কিছু বলছি না, আর দু-একদিন দেখি, তার পর বলব।
এখন বলতে কি হয়! মিলন বলে ওঠে, তোরও দেখছি সব কিছুতেই রহস্য। রহস্য ছেড়ে পরিষ্কারভাবে বল তো কী বলতে চাইছিস।
বলছি তো আজকে না, আরেকদিন বলব। শাহনাজ বলে, এসব ছাড় তো, যে বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেটাই বল। পরিষ্কার জানতে চাই, আগামী শুক্রবার রেবেকাদের বাড়িতে আমাদের গেট টুগেদার প্রোগ্রামটা হচ্ছে তো? যদি হয়, তাহলে আমরা সবাই যাচ্ছি তো?
মনে হয় হচ্ছে, আর আমরা সবাই যাচ্ছি। রুমি কথাটা বলতে বলতে পরীর দিকে তাকায়, তুমি যাচ্ছ তো পরী?
পরী চট করে কোনো উত্তর দেয় না। বরং কী ভাবতে ভাবতে বড় বড় চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকায়। যেন কী উত্তর দেবে, ভেবে পাচ্ছে না।
ব্যস, হয়ে গেল! বিথি টিপ্পনি কাটে, আরে ও আর কী বলবে, ওর কত কাজ আছে না, চিন্তাভাবনা আছে, তার পরে ডিসিশন, সেটা এখন আর হচ্ছে না। তার চেয়ে বরং অন্য কথা বল, কীভাবে প্রিপারেশন নিতে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হোক।
আসলে পরীর এসব নিয়ে খুব মাথাব্যথা নেই। কারণ ও সব সময় একটু ঘরকুনো, সবাই যাকে বলে, হোমসিক। আর আছে শান্ত, যে সব সময় নিরিবিলি থেকে সবাইকে এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে।
অন্যরা যখন অনুষ্ঠানের প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত, তখন শান্ত একবার আড় চোখে তাকায় পরীর দিকে। আর ওর দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে দেখে, পরীর বড় বড় চোখ দুটো অপলক তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।
শান্ত যেন অনেকটা বিব্রত বোধ করে। বুকের ভেতর কোথায় যেন শির শির করে ওঠে। এক সময় হঠাৎ আস্তে করে বলে ওঠে, তাহলে তুমি কি ওদের সঙ্গে যাচ্ছ?
পরী দু-চার সেকেন্ড চুপ করে থেকে আবছা কণ্ঠে বলে, জানি না। এখনো কিছু ঠিক করিনি। তুমি যাচ্ছ তো?
পরীর এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না শান্ত, চুপ করে থাকে। একটু পরে কিছু একটা বলতে গিয়ে কী ভেবে থেমে যায়। তাকায় অন্যদের দিকে।
ওরা সবাই তখন একটু দূরে দেয়ালের পাশের বড় টেবিলটা ঘিরে বসে কে কখন আসবে, কী খাওয়া-দাওয়া হবে, তাতে কত খরচ হতে পারে, সেসবের বাজেট তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একেক জন একেক রকম কথা বলছে, মতামত দিচ্ছে, তাই ওদের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখছে না।
এমন সময় একটা ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ে গেলে সবাই পরের ক্লাসে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
শাহনাজ বলে, ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমাদের আবার বসতে হবে। তখন সবকিছু ফাইনাল হবে। টাকা-পয়সা কত কী লাগবে, সেটাও বোঝার ব্যাপার আছে, কালেকশনের ব্যাপার আছে, আর দেরি করা যাবে না।
কথা বলতে বলতে শাহনাজ উঠে দাঁড়ায়। ওর সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায়। এখন বাংলার ক্লাস হবে দোতলায়।
একসঙ্গে হলেও একেবারে শেষের দিকে শান্ত বেরিয়ে আসে, তার পরে পরী।
শান্ত রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে একটু থামে।
এর মধ্যে অন্যরা সবাই সিঁড়িতে উঠে গেছে। শান্তকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে পরীও দাঁড়ায়, কী হলো, ক্লাসে যাবে না?
যাব তো, শান্ত বলে, ঘরের ভেতরে বসে তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়নি। জানো তো, আসলে, আমার অতো হইচই ভালো লাগে না। তাই… বলতে বলতে একটু থেমে আবার বলে, যাকগে, এসব কথা এখন থাক, ক্লাস শেষ হয়ে গেলে কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এসব নিয়ে না হয় আলোচনা করা যাবে, অবশ্য যদি তোমার কোনো আপত্তি বা বাড়ি যাওয়ার তাড়া না থাকে।
শান্তর কথা শুনে মৃদু হেসে পরী বলে, না, ঠিক আছে। তবে তুমি কি একটু কষ্ট করে লাইব্রেরির দিকে আসবে, একটা বই ফেরত দিয়ে আসতে হবে। ভাবছিলাম, এখন দেব, কিন্তু ওদের সঙ্গে এখানে থাকার জন্য আর দেওয়া হলো না।
মাথা দোলায় শান্ত, বলে, ওইটুকু কষ্ট না হয় করাই গেল। ঠিক আছে, আমি আসব। এখন চলো।
শাহনাজরা ততক্ষণে ওপরে উঠে গেছে। ক্লাসে যাওয়ার জন্য ওরাও দুজনে সিঁড়িতে উঠে আসে।
ক্লাস শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে শাহনাজদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সরাসরি লাইব্রেরিতে চলে আসে পরী।
এদিকে শান্ত ক্লাস শেষে এক বন্ধুর সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। তার পর এদিক-সেদিক একটু ঘুরে ফিরে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায়।
ছুটির পরে ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যে যার পথে বেরিয়ে যাচ্ছে কলেজ থেকে। বিকেলের ছায়া ঘন হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাস।
শান্ত লাইব্রেরিতে ঢুকে একটা খালি টেবিল দেখে বসে দূরে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে একটু খুঁজতেই দেখতে পায় পরীকে। পরী তখন কাউন্টারের সামনে আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়ে বই জমা দিচ্ছে। কাজ শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই কিছুটা দূরে টেবিলে বসা শান্তকে দেখে ধীর পায়ে কাছে চলে আসে।
পরী সামনে এসে দাঁড়াতেই শান্তও উঠে দাঁড়ায়, এখানে কি একটু বসবে নাকি এখনই বাইরে চলে যাবে?
পরী একটু ইতস্তত করে আস্তে বলে, একটু পরেই তো লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে। তার চাইতে আমরা বরং বাইরেই চলে যাই। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
ঠিক আছে। টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা হাতে তুলে নেয় শান্ত, চলো।
দুজনে ধীরে ধীরে অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কলেজ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।
শান্তর বুকের ভিতর কেমন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পরী তার এত কাছে কাছে হাঁটছে, এটা যেন সে কল্পনাই করতে পারছে না। পথের দুই পাশে এত গাছপালা, তার মাঝে ঘরে ফেরা অচেনা পাখির কিচিরমিচির আজকে যেন একেবারেই অন্যরকম লাগছে। সবকিছু এত ভালো লাগছে, এমন আর কোনোদিন লাগেনি।
পরীকে সে আজ কী বলবে, কিছুতেই যেন ভেবে উঠতে পারছে না। অথচ কতদিন মনে হয়েছে, পরীকে একবার কাছে পেলে মনের ভেতরে গোপন কথাগুলো বলে দিয়ে একেবারে হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু এখন এমন কেন হচ্ছে? কেন সব কথা গুলিয়ে যাচ্ছে মনের ভেতরেই। মুখ ফুটে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সবকিছু এমনভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
কী ব্যাপার, একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলে যে, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মৃদু হেসে বলে ওঠে পরী, কী যেন বলবে বলছিলে।
বলছিলাম, শান্ত তাকায় পরীর মুখের দিকে, আসলে আমার কেন যেন ওদের ওই হইহুল্লোড় একেবারেই ভালো লাগে না। তাই আমি হয়তো তোদের ওখানে যাচ্ছি না।
তুমি তো যাচ্ছ?
জানি না, এখনো কিছু ঠিক নেই। যেতেও পারি, নাও যেতে পারি। অন্য রকম কণ্ঠে বলে ওঠে পরী, কিন্তু তোমার যেতে আপত্তি কোথায়? তুমি ওদের সঙ্গে হইহুল্লোড় না করলেই হয়, নিরিবিলি বসে থাকবে।
এটা কি হলো! তুমি আমার কথাটা তোমার মতো করে বলে দিলে। কিন্তু নিজের কথাটা তো কিছুই বললে না। এদিকে না, ওদিকেও না। আসলে কী বলতে চাইছ বলো তো, কিছুই তো বোঝা গেল না। পরীর দিকে তাকায় শান্ত।
পরী তাকিয়ে আছে। সেই অবাক করা দুই চোখে যেন হাসির ঝিলিক। ওর দুই চোখের এই ভাষাটা একেবারেই বুঝতে পারে না শান্ত। তাই আর কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে।
কী হলো? থমকে দাঁড়ায় পরী, এই সোজা কথাটা বুঝতে পারছ না, আশ্চর্য তো!
আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, চোখ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে শান্ত।
সে তো আমি জানি, হাসতে হাসতে পরী বলতে থাকে, তুমি একটু বোকা আছ, তাই না।
সোজা কথাটা বুঝতে পার না, বলতেও পার না।
মানে, কোন কথাটা? অবাক হয় শান্ত।
সরাসরি শান্তর দিকে তাকিয়ে পরী বলে, সেই কথাটা, যে কথাটা তুমি মনে মনে বল, অথচ কারও সামনে কখনো মুখ ফুটে বলতে পার না।
এবার যেন অথই জলে পড়ে যায় শান্ত, মনে মনে ভাবে, তাহলে কি ওর মনের কথাটা সত্যিই টের পেয়ে গেছে পরী! মেয়েরা কি অন্তর্যামী, চোখের ভাষায় আরেকজনের মনের কথা ঠিক বুঝে নিতে পারে?
পরী আবার বলে, ওই যে বাঁ-দিকে, আঙুল তুলে ইশারা করে ছোট্ট পার্কটা দেখায়। ওখানে দেখছ না বিকেল বেলায় অনেকগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলাধুলা করছে, তুমি না অনেকটা ওদের মতো।
তাই নাকি! তাহলে তো ভালোই, হেসে ফেলে শান্ত, যাক শোনো, চলো পার্কটার ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। অসুবিধা নেই তো।
ওই পার্কে? ঠিক আছে, চলো। তবে বেশিক্ষণ কিন্তু বসব না। আর কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে পার্কের ভেতরে এসে একটা বেঞ্চের ওপর বসে। একটু দূরেই ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। অপলক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে পরী। বিকেলবেলা চারদিকে মন কেমন করা শেষ সূর্যের লালচে আলো ছড়িয়ে আছে। আশপাশের গাছে গাছে ঘরফেরা পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে, বাচ্চাদের খাওয়াবার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।
এদিকে উদাস চোখে শান্ত তাকিয়ে আছে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকা লাল সূর্যটার দিকে। এর আগে এমন দৃশ্য ও কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ পরে অভাবিত এক নিবিড় মগ্নতার মধ্যে পরীর দিকে তাকায় শান্ত। আস্তে করে ডাক দেয়, পরী।
মুখ ঘুরিয়ে পরী তার সেই ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে চোখ তুলে তাকায় শান্তর দিকে।
তোমার হাতটা একবার একটু ধরতে দেবে?
অবাক হয়ে পরী বলে, কেন? দুই চোখে তার সেই রহস্যময় দুষ্টুমির ঝিলিক। তার পর একটু থেমে কী ভেবে একখানা হাত বাড়িয়ে দেয় শান্তর দিকে। বলে, একবার ধরেই তো আবার ছেড়ে দেবে, তাই তো।
না। পরীর বাড়ানো হাতখানা শক্ত করে ধরে এবার আশ্চর্য কণ্ঠে বলে ওঠে শান্ত, না, আর কখনো ছাড়ব না।