ঢাকা ২ ফাল্গুন ১৪৩১, শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১

কারবালার সমাজতত্ত্ব

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৩ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
কারবালার সমাজতত্ত্ব
কারবালা উপাখ্যান

‘‘প্রিয় পাঠক, ‘কারবালা উপাখ্যান’ একটি ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাস, ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে এই কাহিনি। এতে তথ্যগত ভুল যাতে না থাকে সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করার চেষ্টা করেছি (মোস্তফা কামাল, কারবালা উপাখ্যান, ভূমিকা)।’’ তবে একথা ঠিক যে, সাহিত্য অবশ্যই ইতিহাসের উপাদান। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সুতরাং, সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাসের ছায়া ও প্রতিফলন দেখা যায়। আমরা তাই বলতে পারি, মোস্তফা কামাল রচিত ‘কারবালা উপাখ্যান’ ইসলামের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতার একটা চিত্র ও ক্ষমতার নির্মমতার বাস্তবতা।

‘মহানবীর (স.) পরলোকগমনের পর তাঁর রেখে যাওয়া পবিত্র কোরআন, আহলে বাইয়াত এবং খেলাফতপ্রাপ্ত চার খলিফা নানাভাবে অসম্মানিত ও অপমানিত হন। একে একে তিন খলিফাকে হত্যা করা হয়। অতঃপর নির্মমতার শিকার হলেন হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দুই নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন’ (মোস্তফা কামাল, কারবালা উপাখ্যান, ভূমিকা)। ‘কারবালা উপাখ্যান’ উপন্যাসের সমাজতত্ত্ব হলো ‘রাজনীতি ও ক্ষমতার খেলায়’ ধর্ম, খলিফা এবং এমনকি স্বয়ং নবি করিম হজরত মুহাম্মদ (স.)-ও এক ধরনের গৌণ বিষয়।

হজরত মুয়াবিয়া (৬০২-৬৮০) ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর একজন বিশিষ্ট সাহাবি, ওহি লেখক এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও আত্মীয়। শুধু তাই নয়, হজরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন হজরত মুয়াবিয়ার ভগ্নিপতি। সেই বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের সব শিক্ষা, মর্মকথা, আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা লণ্ডভণ্ড করে, খেলাফতের রীতিনীতি ধ্বংস করে রাজতন্ত্র কায়েম করেন। ইসলাম ধর্মের আদর্শ, মর্যাদা, খেলাফতের বিধান, খলিফাদের পরিচ্ছন্ন জীবনধারা এবং নবিবংশের সম্মান সবকিছুই ধ্বংস করে, পদদলিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পারিবারিক রাজতন্ত্র কায়েম করে নিজ পুত্র, উচ্চ মদ্যপ ও পিশাচ ইয়াজিদকে ক্ষমতার শীর্ষপদ ‘খলিফা’ পদে মনোনীত করেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, ইয়াজিদ ছিলেন নষ্ট চরিত্রের একজন নিষ্ঠুর ক্ষমতালোভী ব্যক্তি। তার মতো নিম্নমানের একজন ব্যক্তি সম্মানিত খলিফা মনোনীত হওয়া, সত্যিকার অর্থেই ইসলাম ধর্মকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর সুমহান আদর্শ ও মর্যাদাকে পদদলিত করেছে।

লেখক মোস্তফা কামাল অনেক তথ্য ও ইতিহাসের আলোকে গতিশীল ভাষায় ‘কারবালা উপাখ্যান’ বর্ণনা করেছেন। ইতিহাসের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং চমৎকার উপস্থাপনায় ইতিহাসকে সাহিত্যের রূপ দান করেছেন। ঐতিহাসিক উপাদানের আলোকে উপন্যাস রচনা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে মোস্তফা কামাল ‘কারবালা উপাখ্যান’ বয়ানে অত্যন্ত সফল বলা যায়। কারণ যেকোনো মনোযোগী ও ঐতিহাসিক জ্ঞানসম্পন্ন পাঠক কোনো ধরনের ছন্দপতন ছাড়াই সমান্তরাল গতিতে ‘কারবালা উপাখ্যান’ পাঠ করতে করতে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। এই বইটির বড় ধরনের সাফল্য হলো পাঠকের প্রথাগত ধর্মীয় ধারণায় নতুন চেতনার জন্ম দেওয়া। কোনো পুস্তক যদি পাঠকের মনে নতুন ভাবনা ও পথের দিশা দিতে না পারে সেই পুস্তককে সফল বলা যাবে না। 

কারবালা উপাখ্যানের সমাজতত্ত্ব প্রশ্ন কি এমন জ্ঞানশীল পাঠকের মনে উদিত হতে পারে। এই বইটিতে লেখক ঘটনা বা কাহিনির বিবরণ দিয়েছেন, সমাজতত্ত্বের জবাব দেননি। সমাজতত্ত্বের প্রশ্ন সৃষ্টি করেছেন। তাই সমালোচকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- হজরত হাসান একাধিক বিয়ে করেছেন। সেই বউদের একজনের হাতে বিষ মাখানো খেজুর খেয়ে প্রাণ হারান। নেপথ্যে ছিলেন ইয়াজিদ। আবার হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর অপর নাতি হজরত হোসেন প্রাণ হারান শিমারের হাতে ইয়াজিদের নির্দেশে। এখন সারা দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই মর্মান্তিক ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন আর জানতে চান যে, এমন কেন হলো?

‘কারবালা উপাখ্যান’ পাঠ শেষে পাঠকের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়- হায়! এমন নিষ্ঠুর ঘটনা কেন ঘটল?

খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফার মধ্যে তিন খলিফাকে নির্মমভাবে হত্যা এবং নবিজির প্রিয় দুই নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করে শিরশ্ছেদ করা, কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এখনো দুনিয়ায় কাঁদায়।

এই উপন্যাস পাঠ করে কোনো পাঠকের মনে যদি এসব প্রশ্ন দেখা না দেয়, তাহলে  বলতে হবে-  এমন পাঠক এই উপন্যাসের মর্মে ও সমাজতত্ত্বে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই আলোকে বলা যায়, লেখক মোস্তফা কামাল সফল। এমন একটি চমৎকার উপন্যাসের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেত যদি মুদ্রণ প্রমাদ না থাকত। বাংলাদেশে প্রকাশনার সমস্যা সম্পাদনায় অযত্ন ও অবহেলা। এই উপন্যাস ও লেখকের সাফল্য কামনা করছি।

মোস্তফা কামাল, কারবালা উপাখ্যান, সময় প্রকাশন,  ঢাকা, ২০২৪, প্রচ্ছদ: মেধা রোশনান সারওয়ার, 
মূল্য: ৪৬০টাকা।

 

বইমেলা দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচিত ২৪ বই

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম
আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৩ পিএম
দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচিত ২৪ বই

প্রতিটি বই একটি পৃথিবী। বই হলো বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। আর বইমেলা হলো জ্ঞানের উৎসব। এই উৎসবে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে শব্দ তৈরিতে, আর লিখিত শব্দগুলো একটি সেতুতে পরিণত হয়। যা আমাদের সাহিত্যযাত্রার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করে। আমাদের জনগণের চেতনা সংরক্ষণ, উদযাপন এবং বিশ্বের সঙ্গে সেতু তৈরি করে বইয়ের পাতা।

‘গরম’ জলবায়ু ও গরম রাজনীতি
ফরিদা আখতার
শ্রেণি: প্রকৃতি, জলবায়ু ও পরিবেশ 
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৮৪; মূল্য: ৫০০ টাকা

গরম জলবায়ু ও গরম রাজনীতি কথার কথা নয়। পৃথিবী ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। জলবায়ু নিয়ে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে রাজনীতি হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে বিশ্বের মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। গরম তো আরও বাড়বেই। প্রতি বছর জাতিসংঘ আয়োজিত কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হাজার হাজার পরিবেশকর্মী এবং সরকারের প্রতিনিধিরা সেখানে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুই অর্জন করা যাচ্ছে না। দেশের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর বিষয় নিয়ে সবাই ভুগলেও মাত্র একটি মন্ত্রণালয় এই বিষয়সংক্রান্ত কার্যকলাপে জড়িত হচ্ছে। তাতে সবার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যেমন- নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, ভূমি সবকিছুই জড়িত অথচ তারা জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় নেই। এই বইতে জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়েই নানা কথা।...

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী 
এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি
মতিউর রহমান
শ্রেণি: সমাজসেবক ও সংস্কারক 
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৯৬; মূল্য: ৬০০ টাকা

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে লন্ডনে শ্রমিক আন্দোলন ও সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে প্রচার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এক বাঙালি বিপ্লবী। তার পর প্যারিস, বার্লিন, জেনেভা, মস্কো প্রভৃতি ইউরোপীয় শহর ঘুরে খুঁজে ফেরেন ভারতের মুক্তির দিশা। আরও দুই বিপ্লবীর সঙ্গে মিলে ‘ভারত ও বিশ্ববিপ্লব’ থিসিস লিখে পাঠান রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের কাছে। বিয়ে করেন এক ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ও মডেলকে, যার পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন প্রখ্যাত ইতালীয় শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানি। সবশেষে স্থায়ী হন মস্কোয়। গ্রহণ করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং সোভিয়েত নাগরিকত্ব। পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) নানামুখী কাজের সঙ্গে জড়িত হন।... ভারতের স্বাধীনতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা এই বাঙালি বিপ্লবী আর কোনো দিন ফিরতে পারেননি মাতৃভূমিতে।

পেশাওয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প
কৃষণ চন্দর, জ্যোতির্ময় নন্দী (অনুবাদক)
শ্রেণি: অনুবাদ গল্প
প্রকাশনী: বাতিঘর, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৪৪; মূল্য: ৪০০ টাকা

কৃষণ চন্দরকে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, সারা বিশ্বের সেরা কথাশিল্পীদের কাতারে ফেলা যায়। তার সাহিত্য পাঠ করা মানে স্বপ্নীল রোম্যান্টিকতা ও রক্তাক্ত বাস্তবতার এক আশ্চর্য পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। বইয়ের গল্পগুলো পাঠককে সেই আশ্চর্য পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তার রচনায় ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ, বিশেষ করে পাঞ্জাব-বিভক্তির যন্ত্রণা সবচেয়ে গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। তার রচনাবলির একটি বড় অংশ ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভারতবাসীর অংশগ্রহণ, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে।...

গদ্যসংগ্রহ
শহীদ কাদরী
মুহিত হাসান (সম্পাদিত)
শ্রেণি: প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গবেষণা সমগ্র/সংকলন
প্রকাশনী: কবি, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬৮; মূল্য: ৪০০ টাকা

শহীদ কাদরী কবি হিসেবে পাঠকদের কাছে রীতিমতো কিংবদন্তি হলেও তার গদ্যকার-সত্তা সম্বন্ধে অনেকেই অবগত নন। বিষয়ের বৈচিত্র্য, বিশ্লেষণের ধার ও ভাষার স্বাতন্ত্র্যের নিরিখে কাদরীর গদ্য তার কবিতার মতোই বিশিষ্ট, ঋদ্ধ। যেন মনন-সৃজনের বিরল নিখুঁত যুগলবন্দি। ‘গদ্যসংগ্রহ’-এ অপ্রাপ্যতার আড়াল থেকে প্রথমবারের মতো একত্রিত হলো শহীদ কাদরীর প্রায় অর্ধশত দুর্লভ গদ্যরচনা। এই সংকলন আক্ষরিক অর্থেই এক উজ্জ্বল উদ্ধার।...

তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
মহিউদ্দিন আহমদ
শ্রেণি: রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৩২; মূল্য: ৫৮০ টাকা

১৯৪০-এর দশকে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ঢাকার একজন ছাত্র সংগঠক। ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীন হন সাধারণ সম্পাদক। তিনি বরাবরই থেকে গেছেন মুজিবের ছায়ায়। থেকে গেছেন নেপথ্যে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। তাজউদ্দীন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়াদিল্লি যান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। ওই সময় তিনি যদি এই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। দেশ মুক্ত হওয়ার পর তিনি সরকার ও দলের মধ্যে ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের নায়ক ছিলেন তাজউদ্দীন।...

রক্তে লেখা বিপ্লব
ওয়াসি আহমেদ (সম্পাদিত)
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: বলাকা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৭২০; মূল্য: ১৫০০ টাকা

এই সংকলনটি প্রয়োজনীয়, কারণ আমাদের স্মৃতি বিশ্বাসঘাতক। দৈনন্দিন জীবন আমাদের ওপর অবিরাম এবং নির্দয়ভাবে অধিকার খাটায়। ইতিহাসকে বিলাসিতায় পর্যবসিত করতে চায়। কিন্তু অতীতের অস্তিত্ব অস্বীকার করে যে বর্তমান, সে বর্তমান বেজন্মা। দৈনন্দিন সমস্যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আজ আমরা যে বাজার এবং বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ পাচ্ছি, তা পেয়েছি তরুণ রক্তের বিনিময়ে। আমাদের যাদের জীবন বা অঙ্গ আন্দোলনে হারাতে হয়নি, তাদের জন্য আন্দোলনকে এখনই দূরের অতীত মনে হতে পারে। আধুনিক জীবনের ব্যতিব্যস্ততায় কয়েক মাসকে কয়েক বছর মনে হতেই পারে। এ জন্যই সংকলনটি প্রয়োজনীয়। এখানের লেখাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে কেন সমগ্ৰ বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে একস্বরে স্লোগান দিচ্ছিল। কেন রাস্তা ছিল তাজা রক্তে মাখামাখি, কেন প্রতি ঘরে প্রতিটি মানুষের শ্বাসরোধ করছিল তথ্যের অমানিশা এবং চাপা উৎকণ্ঠা, কেন সারা দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে চলেছিল রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা
সরদার আবদুর রহমান
শ্রেণি: বাংলাদেশের রাজনীতি
প্রকাশনী: ঐতিহ্য, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৩২০; মূল্য: ৭০০ টাকা

একটি দেশের গণতন্ত্র কতটা বিকশিত ও দৃঢ়মূল হতে পারছে সেটি প্রধানত তার নির্বাচনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ও স্বচ্ছতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তার বিকাশে ও স্থিতিশীলতায় নির্বাচনিব্যবস্থার সর্বাধিক অবদান থাকার কথা ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার হীন বাসনায় কী জাতীয় নির্বাচন আর কী স্থানীয়- সব ব্যবস্থাকেই প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়। শীর্ষ থেকে শিকড় পর্যন্ত এক নির্বিচার পীড়নযজ্ঞ চলে মানুষের ভোটাধিকারের ওপর। স্বাধীনভাবে প্রার্থী হতে না পারা এবং মুক্তমনে ভোট দিতে না পারার, বেদনায় জর্জরিত হতে থাকে নাগরিক মন।...

সময় বহিয়া গেল
আনোয়ারা সৈয়দ হক
শ্রেণি: ঐতিহাসিক উপন্যাস
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬৮; মূল্য: ৪৫০ টাকা
পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বাঙালি ডাক্তার সানজিদা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যথারীতি কর্মস্থলে যায়, রোগী দেখে। তার সহকর্মীরা একে একে গোপনে যুদ্ধে চলে যায়, কিন্তু সে কোথাও যেতে পারে না। এক রাতে জরুরি রোগী দেখার কথা বলে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে নারকীয় বিভীষিকা। সানজিদা ডাক্তারি পাস করে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগ দেয়। স্বামী, বাচ্চা ও মাকে নিয়ে তার সংসার। প্রশিক্ষণ নিতে রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে সে জানতে পারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা, একই দেশের অংশ হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা।... সানজিদা প্রমাদ গোনে: এ কোথায় আনা হলো তাকে! কী অপেক্ষা করছে তার নিজের জন্য?

বাংলা বাঙালি বাংলাদেশ
মজিবর রহমান
শ্রেণি: ইতিহাস- প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
প্রকাশনী: বিভাস, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৭৬; মূল্য: ৩০০ টাকা

মজিবর রহমান ‘বাংলা বাঙালি বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন: অনেকদিন থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম বাংলাদেশের জন্মকথা আরও পেছন থেকে শুরু করে পরিবেশন করার। আমরা যে বাঙালি জাতিসত্তার কথা বলি তার উদ্ভব কীভাবে, যে ভাষায় আমরা কথা বলি সেটি সুসংহত হলো কেমন করে, যে সমাজ-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা তার বিবর্তনের ধারা কীরূপ, যে জনপদটি আজকের বাংলাদেশ নামে খ্যাত তার ভূ-প্রাকৃতিক ধরন কেমন ছিল- ক্ষুদ্র পরিসরে সেসব জানান দিতে। বলা প্রাসঙ্গিক যে এমন বিশালত্বকে সংকীর্ণ অবয়ব দিয়ে সন্নিবন্ধ করার মতো মেখা ও বিশেষায়িত জ্ঞান আমার নেই। তার পরও এ কাজে হাত দেওয়ার স্পর্ধা পোষণ করি নিজের শেকড়সন্ধানী প্রবণতা ও সাধারণ্যের কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি লক্ষ্যে।...

বাংলাদেশের সংবিধান ইতিহাসের পুনর্পাঠ
কাজী জাহেদ ইকবাল
শ্রেণি: সংবিধান ও সংবিধান প্রসঙ্গ
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৩১২; মূল্য: ৬০০ টাকা

বাংলাদেশের সংবিধান নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। যুদ্ধে সফল হয়ে আপন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাওয়ার পর সেই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ নেয়। এর নেপথ্যে আছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। খুঁজলে যার শেকড় মিলবে প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত শাসননীতিতে। তার পর মধ্যযুগ, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তানি জামানার শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে তবেই বাংলাদেশের সাংবিধানিক সত্তা নিজস্বতা অর্জন করেছিল। বাংলাদেশ তার প্রথম পৃথক মৌলিক সাংবিধানিক পদক্ষেপ নেয় স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে। স্বাধীনতা অর্জনের পর সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ইতিহাসের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়। নানা কারণে গত ৫০ বছরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুরা
ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম
শ্রেণি: বিদেশিদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৪৮৪; মূল্য: ১৮০০ টাকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট সদস্য, কূটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলের নেতা, লেখক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্ণধার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রমুখ স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি পক্ষাবলম্বন করেছেন, সমর্থন দিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন; উপরন্তু গণহত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের মানুষের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন- তাদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে। এ ছাড়া গণহত্যা, নির্যাতন, দমন, নিপীড়ন ও শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে যেসব বিদেশি বন্ধু সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন- তাদের ভূমিকাও আলোচিত হয়েছে।

ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক
হাসান ফেরদৌস
শ্রেণি: মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও দর্শন
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬০; মূল্য: ৪২০ টাকা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি বিরাট রাজনৈতিক ঘটনা। সে ঘটনার তাৎপর্য আবিষ্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই যুদ্ধের ঘটনাস্থল যদিও বাংলাদেশে, তবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল নানা বিদেশি শক্তি, বিশেষত সেই সময়ের দুই প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। জড়িত ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক ব্যক্তিও। কেউ আমাদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন, কেউ ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। এই গ্রন্থে যেমন আমাদের পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রিচার্ড নিক্সন ও তার সহযোগী হেনরি কিসিঞ্জারের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে, তেমনি পরিচয় হয় প্রায় অপরিচিত মার্কিন নৌসেনা চার্লস র‌্যাডফোর্ড ও সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের সঙ্গে। আরও রয়েছে বিজয়ের প্রাক্কালে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীবাহিনীর অবতরণের নাটকীয় ঘটনার পুনর্নির্মাণ এবং ১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় প্রকাশ্যে ‘তওবা’ উচ্চারণের স্বল্পপরিচিত ঘটনা। 

চেতনায় নজরুল
আবদুল লতিফ
শ্রেণি: সাহিত্য ও সাহিত্যিকবিষয়ক প্রবন্ধ
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৯৬; মূল্য: ৩০০ টাকা

লেখালেখির জগতে আবদুল লতিফের বহুমুখী বিচরণ। তিনি গল্প, কবিতা, রম্যরচনা আর ভ্রমণকাহিনির পাশাপাশি মনীষীদের জীবনকাহিনি লিখে থাকেন। গত বছর তার লেখা বই সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসিত হওয়ার পর নজরুল জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে তিনি লিখেছেন চেতনায় নজরুল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের নানা দিক নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তার অন্য সব বইয়ের মতো এই বইটিও পাঠকনন্দিত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।...

কবি ও একজন নর্তকী
মোস্তফা কামাল
শ্রেণি: উপন্যাস
প্রকাশনী: অনন্যা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৮৬; মূল্য: ২৫০ টাকা

রাতের আঁধারে এক সুন্দরী নারী ঢোকে মাহমুদুল হকের বাড়িতে। তিনি একজন চিরকুমার কবি। মুখাবয়বে বয়সের ছাপ। কিন্তু সুন্দরী নারী দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। সুন্দরীকে পেয়ে কবির আবেগ-ভালোবাসা যেন উথলে ওঠে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে অন্যত্র। মেয়েটি কবির বাড়িতে এসেই মানসিক ভারসাম্য হারায়। ভুলে যায় সে নিজের নাম-পরিচয়। এতে মহাবিপাকে পড়েন কবি। তার পরও এক মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই মেয়েটির গর্ভে আসে নতুন অতিথি। কিন্তু হায়! সেই সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই আত্মহননের পথ বেছে নেয় মেয়েটি। কিন্তু কেন? কী ঘটেছিল তার জীবনে?

কুষ্টিয়ার জমিদার
ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন ও ড. সারিয়া সুলতানা
শ্রেণি: আঞ্চলিক ইতিহাস
প্রকাশনী: কণ্ঠধ্বনি, কুষ্টিয়া
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৯২; মূল্য: ৬০০ টাকা

মুঘল সাম্রাজ্যের সময় জোতদার, জমিদাররা আভিজাত্যের প্রতীক ছিল এবং শাসক শ্রেণি গঠন করত। বাঙালি সমাজের রূপান্তর ঘটেছিল বিদেশি স্বার্থে। একশ্রেণির হিন্দু-মুসলমান বাঙালি, শাসকের অনুগত হয়ে বিত্ত সঞ্চয় করে আভিজাত্যের তকমা লাগিয়ে সমাজ-প্রভু হয়ে ওঠে। বিত্তের গদিতে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে তারা রাজা, রায়বাহাদুর খেতাবে বিভূষিত হতে থাকে। বেশির ভাগ বাঙালি সহায়সম্পদ হারিয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল। জমিদাররা ইংরেজ শাসনের ভিত পাকাপোক্ত করেছিল- তাদের স্বার্থেই দরিদ্র গ্রামবাসীকে ব্যস্তুচ্যুত করেছিল, দারিদ্র্যের শেষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছিল। এই গ্রামবাসীর পনেরো আনাই ছিল কৃষক। হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে যে জমিদার গোষ্ঠীর সৃষ্টি, তাদের নিষ্ঠুরতার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার অন্যতম হলো দুর্ভিক্ষ। বিদেশি বণিক যখন এ দেশে প্রভু হয়ে বসে, তখন তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক স্বার্থে পরিচালিত করে। সেজন্য তাদের প্রয়োজন হয়েছিল জমিদারশ্রেণির মতো এক গোষ্ঠীর।...

পানি সংকট প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
সৈয়দা বদরুন নেসা
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: বলাকা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৮৪; মূল্য: ৬৫০ টাকা

‘পানি সংকট প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’- শুধু একটি বই নয়, সময়ের আহ্বানে লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল। যা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা। বইটিতে বাংলাদেশের পানি সংকটের বহুমুখী দিক তুলে ধরা এ এর কার্যকর সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা আছে।

কাটামুণ্ডু রহস্য
মোস্তফা কামাল
শ্রেণি: থ্রিলার
প্রকাশনী: সময়, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৯৬; মূল্য: ২২০ টাকা

জয়নালের মনের মধ্যে ভয় আর শঙ্কা। রিকশায় চটের বস্তা দেখে সে চমকে ওঠে। বস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে আবার ফিরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বস্তা খোলার জন্য এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে বস্তা খোলে। বস্তার ভেতরের দিকে নজর পড়তেই লাফিয়ে ওঠে জয়নাল! বস্তা ফেলে দূরে সরে যায়। ভয়ে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আচমকা বলে ওঠে, ও আল্লাহ! এ কী সর্বনাইশ্যা কাণ্ড! এই রক্তাক্ত কাটামুণ্ডু কার! জয়নাল মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এই কাটা মাথা সে কী করবে! কোথায় নিয়ে ফেলবে! এটা গ্যারেজে রাখা নিরাপদ না। পুলিশ টের পেলে আর রক্ষা নেই। জয়নালকে তো জেলে যেতেই হবে; সঙ্গে গ্যারেজ মালিককেও! কাটামুণ্ডু ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়নাল! কিন্তু সেখানেও ঘটে বিপত্তি! চারদিক থেকে কেবল বিপদের হাতছানি! 
কাটামুণ্ডু রহস্য এক রোমহর্ষক কাহিনি।

বখতিয়ারের বানরগুলি 
নাসরীন জাহান
শ্রেণি: সমকালীন গল্প
প্রকাশনী: বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৭২; মূল্য: ২৪০ টাকা

দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে নাসরীন জাহানের নতুন গল্পের বই বেরোল। নাসরীন নিজের গল্পের মাধ্যমকে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করেন। ‘সিগনেচার লেখা’ বলা যায়, এমন বেশকিছু গল্প আছে তার যা আলোচিত হয়, দেশে, দেশের বাইরে। জাদুবাস্তবতার ফর্মে তৈরি আগের গল্পগুলো নিষ্পেষিত জীবনের। এই বইয়ের গল্পগুলো সেসব গল্প থেকে আলাদা। বেশির ভাগ গল্প আকারে ছোট। সহজাত জীবন এবং বোধের ছন্দে লিখে গেছেন তিনি। তার নিজের একটা তৈরি গদ্যভাষা আছে। সেই ভাষা ডিঙিয়ে এবার জমিয়ে গল্প লেখার কথা ভেবেছেন তিনি। যা ধরে রাখে, শেষ অব্দি।...

নিঃসঙ্গ নটী
দীপু মাহমুদ
শ্রেণি: ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস
প্রকাশনী: সময় প্রকাশন
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৪৪; মূল্য: ৩৪০.০০ টাকা

অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর নামে থিয়েটারের নাম হওয়ার কথা ছিল বিনোদিনী থিয়েটার। তা হয়নি। থিয়েটারের নাম হয়েছে স্টার থিয়েটার। প্রশ্ন করেছেন নটী বিনোদিনী, কীসের ক্ষোভ ছিল আমার ওপর? নাকি ভয়! একজন নারী, সে আবার বারনারী, দখল করে নিচ্ছে কলকাতার থিয়েটার সাম্রাজ্য। যা আপনারা কয়েকজন পুরুষ আপনাদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে জ্ঞান করেন!... সত্য ঘটনা নিয়ে বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে লেখা সাহস আর সংগ্রামের পরম বাস্তবতার অজানা কাহিনি নিঃসঙ্গ নটী। প্রেম, স্পর্ধা, হাহাকার, প্রতারিত হওয়া আর মানুষের মর্যাদার পক্ষে লড়ে যাওয়ার একজন নারীর না-বলা বিস্ময়কর উপাখ্যান।

প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর
শাহনাজ মুন্নী
শ্রেণি: সমকালীন গল্প
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২০৮; মূল্য: ৪০০ টাকা

নির্লিপ্ত বর্ণনায় হরেক চরিত্রের সাবলীল চলাফেরা শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পের বৈশিষ্ট্য। ছোটো ছোটো সংলাপ, কথা বলা কি না-বলা, অথচ যেন অনেক কিছু বলা! বয়ানের দক্ষতায় অলীক কাহিনি যখন চোখের সামনে ঘোর বাস্তব হয়ে ওঠে, তখন পাঠক প্রত্যাশিত আবেশে গা না-ভাসিয়ে পারেন না। চিরাচরিত জীবন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বিষয়-দুইয়ের মেলবন্ধন যেন শাহ্নাজ মুন্নী গল্প। আর গল্প যে কেবল কাহিনি নয়, মানানসই শব্দ-বাক্যেরও সমাহার, তা মুন্নীর গল্প পড়লেই জানা যায়। কাব্যিক চলনে দৃশ্যের পর দৃশ্য যেন একেকটি গল্পই নয় কেবল, একেকটি ক্যানভাস! 


 
মোগল শাহজাদিদের কান্না
খাজা হাসান নিজামী, আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু (অনুবাদক)
শ্রেণি: ঐতিহাসিক উপন্যাস
প্রকাশনী: ঐতিহ্য, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৪০; মূল্য: ১৮০ টাকা
ব্রিটিশরা সাগর পাড়ি দিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতের দক্ষিণ অংশে পৌঁছায় এবং মোগল সম্রাট ও শাহজাদাদের কাছে ধরনা দেয় বাণিজ্যসুবিধা লাভের আশায়। ভারতবর্ষে বিরাজমান তখনকার নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি ইংরেজদের উদ্দেশ্য সাধনের অনুকূলে ছিল। বণিক থেকে ক্রমান্বয়ে ভারতের শাসক হিসেবে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায় মোগল সম্রাটের প্রতি ব্রিটিশের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষে মোগল শাসনের শেষ নিশানাটুকুও বিলীন হয়ে যায়। মোগল রাজপরিবারের অনেক সদস্য ইংরেজদের নিগ্রহ এড়াতে পরিচয় লুকিয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। মোগল পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহিলাদের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে করুণ।

 

তিতাসের বুনো হাঁস 
মাসউদ আহমাদ
শ্রেণি: জীবনীভিত্তিক উপন্যাস
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৭৬; মূল্য: ৪৭০ টাকা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাটে মালো পরিবারে জন্মেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। ভদ্রলোকেরা ‘গাবরপাড়া’ বলে তাচ্ছিল্য করতেন। শৈশবেই মা-বাবাকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েন। ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় পাড়ি দেন। ত্রিপুরা পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি; ক্রমশ নবশক্তি, মোহাম্মদী, কৃষক ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় কাজ করেন। আচমকা যক্ষ্মারোগ ধরা পড়লে কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েও তিনি পালিয়ে যান; লেখার কাজ ও মালো সম্প্রদায়ের মানুষের টানে। কেমন ছিল তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই আর মানসরাজ্য? সময়ের জলছাপে তার নামটি মুছে গেলেও তিতাস একটি নদীর নাম স্বমহিমায় ভাস্বর। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহই ছিল জীবনের আরাধনা। তিতাসের বুনো হাঁস উপন্যাসে মন কেমন করা সেই গল্পই ধরা পড়েছে।

দি হোয়াইট বুক
হান ক্যাং
আসাদুল লতিফ (অনুবাদক)
শ্রেণি: অনুবাদ উপন্যাস 
প্রকাশনী: অন্যধারা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৬৪; মূল্য: ১৪০ টাকা

জীবন, মৃত্যু আর শোক নিয়ে ভাবনা জাগানো হান ক্যাং-এর কাব্যিক ধ্যানের উপন্যাস ‘দি হোয়াইট বুক’। তুষার, লবণ, শিশুর প্রথম আচ্ছাদন কিংবা সাদা ফুলের শুভ্রতা নিয়ে গড়ে উঠেছে এর একেকটি আখ্যান। এই চিহ্নগুলোর ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে কাছের মানুষ হারানোর গল্প, হোক সেটা লেখকের একান্ত কিংবা অন্য কারও। অনেকটা দূর থেকে দেখা স্মৃতি, আত্মপরিচয় আর অস্তিত্বের অনিত্যতার ভাবনাগুলো গদ্য আর চিত্রকল্পের মিশেলে এই বইয়ে চিত্রিত হয়েছে এক গভীর আত্মদর্শনে।... স্মৃতি আর বিষাদে ছেয়ে থাকা আপাত খাপছাড়া এই লেখাগুলো সংবেদী পাঠকের ইতিহাস আর রাজনীতির ভাবনায়ও আলোড়ন জোগাবে।

একটি বিষণ্ন রাইফেল
রায়হান রাইন
শ্রেণি: থ্রিলার
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৪৮; মূল্য: ৫৫০ টাকা

এক জোছনারাতে অপহরণকারীরা শাফায়েত কবিরকে ফেলে রেখে যায় পাহাড়ি রাস্তার ধারে। জেরা করার সময় একজন বলেছিল, ‘খেয়াল কইরেন শাফায়েত সাহেব, একটা গরু কীভাবে বাঁচে।’ কিন্তু শাফায়েত গরুর মতো বাঁচতে চায়নি। সে কারণে নজরদারি শুরু হয়ে যায়। একের পর এক অচেনা আগন্তুক আসতে শুরু করে তার বাসায়। তারা শাফায়েতকে এক ভয়ংকর খেলায় নামতে বাধ্য করে এবং একজন বলে, ‘এই খেলায় আপনি আউট হয়ে যাবেন- আউট মানে ডেথ।’ মায়ের প্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, শাফায়েতের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনিও কি শাফায়েতকে অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন?... রাষ্ট্রখেলা শাফায়েতকে সবকিছু থেকে উৎখাত করে, এমনকি নিজের পরিচয় ও ‘দেহ’ থেকেও। তনুজা শারমিনের চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে শাফায়েত তার সেই বদলে যাওয়া ‘প্রতিকৃতি’ দেখতে পায়।...

গ্রন্থনা: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন

দিগন্তে ফুলের আগুন একজন শহীদুল্লা কায়সার

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম
দিগন্তে ফুলের আগুন একজন শহীদুল্লা কায়সার
শহীদুল্লা কায়সার

মৃত্যুর শেষ মৃত্যুই। মৃত্যুর শেষ জীবন, সে কদাচিৎ। কেননা জীবনের জন্য মৃত্যুটা দুর্লভ। কিন্তু রাতের পর দিন, প্রকৃতির অমোঘ ধর্ম...

সাংবাদিকতা তার পেশা। বামপন্থি রাজনীতিতে ছিলেন সক্রিয়। তবে, তার সাহিত্যিক খ্যাতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বোধি পাঠকের হৃদয়-মণিকোঠায়। সারেং বৌ, সংশপ্তকের মতো কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্ঠা শহীদুল্লা কায়সারের জন্ম ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬। বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেন। দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তার ক্ষুরধার কলম সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিল। কারাজীবনের দুঃসহ দিনগুলোতে তিনি রচনা করেন রাজবন্দির রোজনামচা। তিনি আমাদের গৌরবদীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের একজন শহিদ বুদ্ধিজীবী। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। আর মাত্র এক দিন পর পরাধীন বাঙালির বিজয়ের দিন। এদিন সন্ধ্যায় কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর কজন সদস্য কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ঢাকায় ২৯ কায়েত টুলির বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার পর তিনি আর ফেরেননি। শহীদুল্লা কায়সারের অমর সাহিত্যকর্মের মধ্যে আমরা খুঁজে পাব এই মহান জীবনশিল্পীকে। পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৮৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৮)।

ধারাবাহিক উপন্যাস মোহিনী

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
মোহিনী
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সপ্তম পর্ব

ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজ খানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ধৈর্য ধরুন। নিশ্চয়ই একটা কিছু হবে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার স্ত্রীর অবশ হয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরাগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা হচ্ছে। তার মস্তিষ্কের সঙ্গে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখতে চিকিৎসক দল বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনাকে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আপনারা একেবারে অন্তিম মুহূর্তে রোগীকে নিয়ে এসেছেন। এ ধরনের রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপরও আস্থা রাখতে হয়। আমি নিজে যদিও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি না। তার পরও বলছি, নীলিমার যদি হায়াত থাকে তাহলে সে বাঁচবে। আর সে যদি বেঁচে যায় তাহলে বলতে হবে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে সে ফিরে এসেছে।

শাহবাজ খান আর কোনো কথা বলতে পারেন না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যে স্ত্রীকে সব সময় তিনি হেলাফেলা করেছেন সে যে তার জীবনে কতভাবে মিশে আছে তা আজ টের পাচ্ছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে, নীলিমার মৃত্যু হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সময় তার ফুপুর জীবনেও এমন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল। তিনি সেই অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। 

শাহবাজ খানের ফুপু শাওলী খানেরও বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল। তার ফুপা সানোয়ার হোসেন বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীর মধ্যে তার নাম ছিল। সানোয়ার হোসেন মধ্য বয়সে এসে এক সুন্দরী টিভি অভিনেত্রীর প্রেমে পড়ে যান। সে কী প্রেম! পরকীয়া প্রেম বুঝি এক ভয়ানক নেশা! এই নেশায় যাকে একবার পায় তাকে আর ফেরানো যায় না! টিভি অভিনেত্রী খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক নারী। সে সানোয়ার হোসেনকে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এ কারণেই হয়তো একেবারে জোকের মতো সানোয়ার হোসেনকে সে আঁকড়ে ধরে। 

অবৈধ সম্পর্ক থেকে সানোয়ার হোসেনকে ফেরানোর জন্য তার ফুপু হেন কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সানোয়ার হোসেনকে ফেরানো গেল না। তারা বিয়ে করতে রাজি হলো না। তারই বা রহস্য কী, তাও তারা কেউ বুঝতে পারলেন না। 

সানোয়ার হোসেন রাতদিন সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গেই কাটাতেন। তাকে নিয়ে বিদেশে যেতেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করতেন। ব্যবসায় তার কোনো মনোযোগ ছিল না। দিনে দিনে তার ব্যবসা মন্দাবস্থা শুরু হলো। সানোয়ার হোসেনকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক হলো। তাকে ফেরানোর জন্য শাহবাজ খানের বাবাও অনেক চেষ্টাচরিত করলেন। কিছুতেই কিছু হলো না। স্বামীর ওপর শাওলী খানের রাগ-ক্ষোভ-অভিমান চরম পর্যায়ে পৌঁছে। অবশেষে তিনি বিষপান করলেন। 

শাওলী খানকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরেই নিয়ে আসা হয়েছিল। টানা সাতান্ন দিন মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা করা হয় তার। কয়েক কোটি টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। সানোয়ার হোসেনের এখন অসহায় অবস্থা। বৈরম খানের দয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। অথচ বৈরম খানও সানোয়ার হোসেনের হাত ধরে ব্যবসা শুরু করছিলেন। 

শাহবাজ খান হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিনি আর কিছুই মনে করতে চান না। কিন্তু সেই ভয়ংকর স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে।   

শাহবাজ খান হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে এসে হাজির হন। আইসিইউর সামনে এসে পা রাখতেই ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনো কথা না বলে তিনি তার কাঁধে হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি ডাক্তার। তাই তাকে অনেক কিছুই সামাল দিতে হয়। অনেক আবেগ সংবরণ করতে হয়। অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা চোখের সামনে দেখতে হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন। সে বাণী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে হয়। 

ডাক্তার চ্যাঙ জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। তিনি অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করেছেন। কেউ ভালো হয়েছেন। আবার কেউ চলে গেছেন ওপারে। সবাই যে ভালো হবে তার তো কোনো গ্যারান্টি কোনো ডাক্তার দিতে পারেন না। ডাক্তার চেষ্টা করতে পারেন মাত্র। কিন্তু নীলিমার চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। রোগীকে বাঁচাতে হবে, এটাই ছিল তার ব্রত। শেষ পর্যন্ত পারলেন না। এই না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনি নিজেই নীলিমার মৃত্যু মানতে পারছেন না। তার স্বামী কী করে মানবেন! 

ডাক্তার চ্যাঙ কীভাবে শাহবাজকে খবরটা দেবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। বড়ই সংকোচ বোধ করছেন তিনি। কিন্তু তার পরও তাকে খবরটা দিতে হবে। কীভাবে শুরু করবেন তা নিয়ে ভাবেন। সময় নেন।

ডাক্তারের অবস্থা দেখে শাহবাজ আঁচ করতে পারেন, তার জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। তিনি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। আর ডাক্তার কী বলবেন তা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। এর মধ্যেই ডাক্তার চ্যাঙ নরম গলায় বললেন, শাহবাজ আমি কীভাবে কথাটা বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি নিজেই তো দেখেছেন! আমরা আটজন ডাক্তার কীভাবে চেষ্টা করেছি। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, রাত নেই দিন নেই। 

শাহবাজ খান কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন। তিনি ডাক্তারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার চ্যাঙ আবারও শাহবাজের কাঁধে হাত রাখেন। তার পর বলেন, শাহবাজ মনটাকে শক্ত করুন। আমি আগেই বলেছি, যেকোনো খবরের জন্য আপনার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। আমি আশা করছি, আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শেষপর্যন্ত আমরা আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না। 

শাহবাজ খান এসব কী শুনছেন! তিনি তো এই সংবাদ শোনার জন্য আসেননি। তিনি একটা সুসংবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেন এই সংবাদ দিচ্ছেন ডাক্তার! না না! এটা হতে পারে না! নীলিমা মরতে পারে না! নীলিমা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না! কিছুতেই না! কিছুতেই না!

শাহবাজ খান আচমকা নীলিমা বলে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তার পর পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। 

চলবে...

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-

পর্ব-১

পর্ব-২

পর্ব-৩

পর্ব-৪

পর্ব-৫

পর্ব-৬

রফিক আজাদের কবিতা: দ্রষ্টার তীর্যক ক্ষোভ

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
রফিক আজাদের কবিতা: দ্রষ্টার তীর্যক ক্ষোভ
রফিক আজাদ

ষাটের দশক ছিল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তা দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করি না কেন। ছেচল্লিশের মন্বন্তর পেরিয়ে, দেশভাগ হয়ে পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রেক্ষিতে দানা বেঁধে ওঠা স্বাধিকার আন্দোলন তখন বিকাশ লাভ করছে। গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রাণিধাকারের স্বপ্ন। অন্যদিকে এই অঞ্চলের বাইরে কী ঘটছে? ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হয়েছে, সাদা-কালোর বিভেদ চরম আকার ধারণ করেছে, তৃতীয় বিশ্বে পুঁজিবাদের ধাক্কা লাগা শুরু হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের নীরব প্রতিযোগিতা পুঞ্জীভূত হচ্ছে, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হয়েছে, ব্রিটিশদের একের পর এক উপনিবেশ গুটিয়ে আনার পরে নতুন শাসনব্যবস্থার প্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারের আবহমান কাঠামো, কমিউনিস্ট-শাসিত দেশগুলোতে একের পর এক অদ্ভুতরকম আইন পাস হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ওইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ। সবগুলো ঘটনার কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও উপনিবেশ (নব্য, পরোক্ষ ও বিশেষায়িত )-এর নিয়ন্ত্রণ। 

কেন্দ্রীভূত এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ- অস্বীকার। বিশ্বব্যাপী তরুণদের প্রধান লক্ষ্যণও ছিল তাই। প্রথমে অস্বীকার, এর পর প্রতিবাদ। বিট জেনারেশন, অ্যাংরি জেনারেশন, হাংরি জেনারেশন- এরকম নানা নামে ডাকলেও তাদের কেন্দ্রে ছিল ওই বীজ- অস্বীকার করো। তার পর করো প্রতিবাদ। তার পর প্রাপ্য বুঝিয়ে নাও। তার পর নিয়ন্ত্রণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠা করো সাম্য ও মানবিক মর্যাদা।

কবি রফিক আজাদ ঠিক ওই সময়ের সন্তান। বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের যে লক্ষ্যণ ও বৈশিষ্ট্য ওই সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল- বাংলা ভাষার কবি রফিক আজাদের মধ্যে সেসবের পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি ছিল। না হলে কীভাবে তিনি বলতে পারেন ‘এটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই- আমি/ ধ্বংস ও শন্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না/... ভিতর-মহল জেঁকে বসে আছে লাল বর্ণমালা’।

ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে বিশাল দূরত্ব তিনি মানেন না। এই না-মানার মধ্যে রয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যদিও তা সহজ নয়। কারণ ‘দেয়ালে দেয়ালে অনীবার্য অন্ধকার’। সেই অন্ধকারের স্বরূপ উন্মোচন করে করেই-না এগোতে হয়। কিন্তু তার ভেতরে তো বীভৎস্য সত্যের আচ্ছাদন! সেখানে মানুষের মৌলিক উপলব্ধির গভীর জগৎ। সেই গভীর জগতের ভেতরে যে সত্য সেই সত্য একসময় তাকে বলতে বাধ্য করে, ‘আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।/ ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবো।’ প্রচলিত মুক্তির গভীরে তিনি চোখ ফেলেছেন। ভৌগলিক স্বাধীনতার পর প্রকৃত মুক্তি যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা তাই-ই তিনি ইঙ্গিত করেন। ইঙ্গিত করেন বীভৎস্য রূপে।

তবে বীভৎস্য রূপের ভেতরে যে রাগ ও ক্ষোভ বিদ্যমান তাই-ই তার সামগ্রিক রূপ নয়। বাহ্যিক ও প্রকাশ্য এই রূপের অভ্যন্তরে রয়েছে জীবনকে উল্টে-পাল্টে দেখার নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষা তাকে দিয়েছে এক জীবনে বহু জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা- ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগভ্রান্ত পথিক’। এই ‘দিগভ্রান্ত পথিক’ আদতে এক শিল্পপথ-প্রাপ্ত কবি। কখনো কখনো তিনি শিশু। কখনো বালক- ‘বালক ভুল করে নেমেছে/ ভুল জলে/ বালক পড়েছে ভুল বই/ পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই’। জীবন নিয়ে নিরীক্ষা করলেই-না কবি ‘বালক’ হয়ে ‘ভুল জলে’ নেমে পড়তে পারেন। হিসেবি আমরা, স্বার্থপর আমরা ক’জন ওই ‘ভুল জলে’ নেমে পড়ার সাহস দেখাতে পারি?

পারি না। পারি না বলেই আমরা সাধারণ। পারেন বলেই তিনি রফিক আজাদ। তাই তো তিনিই বলতে পারেন, ‘একটি চুমুর বিনিময়ে একটি কবিতা উৎসর্গ হবে।’ শুধু কি তাই? ভালোবাসা পেলে শুধরে নেবেন তিনি ‘জীবনের ভুলগুলি।’ ‘ব্যকরণ’ না-পড়া, ‘মূল বই’ না-পড়া বালক যদি ‘জীবনের ভুলগুলি’ শুধরে নেন তাহলেই কি বন্ধ হয়ে যাবে ‘সময়ের উদরে অনীবার্য বসবাস?’

না, যাবে না। তবুও চুনিয়া তার কাছে আর্কেডিয়া, ‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে/ নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।/ চুনিয়া বিশ্বাস করে: শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে/ পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’

এই তো আশার কথা। সবকিছু অস্বীকার করা তরুণ যখন প্রতিবাদের পর, পরিবর্তনের পর, জীবনের বহুপথ হেঁটে এসে আশার কথা বলেন তখনই তো তার শিল্পযাত্রা সফল হয়ে ওঠে। দৃশ্য থেকে কবি যখন অভিজ্ঞতা তুলে এনে দ্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখন জগতের সবগুলো ফুল হেসে ওঠে। সেই হাসির ঝলকে যে সুবাস ছড়ায় তাই-ই তো কবির দেওয়া শ্রেষ্ঠ অর্ঘ।

আমাদের আত্মপরিচয়ের সিঁড়িগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সিঁড়িগুলো নেমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। সিঁড়ি ভেঙে রক্ত গলে গলে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাংলার পবিত্র মাটি। তবুও আমাদের হৃদয় জাগছে না। কারণ ভুল মোহর চেপে ধরে রেখেছে প্রকৃত বেদি। ‘ভুল বই’ পড়া কোনো এক রফিক আজাদ আত্মগত সততা নিয়ে যখন বলে ওঠেন, ‘নিপাট বাঙালি কবি/ আমি একবিংশ শতাব্দীর’ তখন ভাবতে ভালো লাগে ষাটের প্রতিবাদী তারুণ্য নিয়ে যিনি দৃশ্য ধারণ করেছিলেন, তিনি পতনের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে নেমে সাধারণ হয়ে যাননি। শিল্পকে ধারণ করে ‘ভুল ব্যাকরণের’ শুদ্ধ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনি যে শেষ পর্যন্ত কবিই ছিলেন।

একজন মানবিক কবি আল মাহমুদ

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৬ পিএম
একজন মানবিক কবি আল মাহমুদ
কবি আল মাহমুদ

‘পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত,
তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাসবায়ু।’
নিজের সম্পর্কে মন্তব্যে কবি বলেছিলেন, ‘…তবুও বলব কবিতা লিখে এ দেশে যতটুকু ভালোবাসা আদায় করা যায়, আমার ভাগ্যে তা জুটেছে। অখ্যাতিও কম জোটেনি। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে- অপূর্ণতাটা কোথায়? না, দেখতে পাই না।’…

কবি আল মাহমুদের কেমন ছিল শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের শুরুটা? মোল্লাবাড়িতে জন্ম ও ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। এরপর রঙিন শৈশবের ভেতর ঢুকে পড়ল ছোট্ট মফস্বল শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিতাসপাড়ে গরুর রাখালের পেছনে ছুটতে ছুটতে করুলিয়ার সেতু, লালমোহন পাঠাগার কিংবা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে কলকাতা যাত্রা- এভাবে বেড়ে উঠেছেন আল মাহমুদ। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল আর ভাষার জাদুতে মনোগ্রাহী করে তুলেছেন লেখনীর মাধ্যমে। এভাবেই তৈরি হয়েছে তার কবিজীবনের পটভূমি।

শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম আল মাহমুদ। তার কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই ভূমিপুত্র কবি একাধারে সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। মৃত্তিকার ঘ্রাণ, মননের সৌরভসিক্ত তার কবিতাকুঞ্জ। লোকজীবনের নানা শাখা তিনি অঙ্কন করেছেন শৈল্পিক দৃষ্টিতে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী। জন্ম ১১ জুলাই ১৯৩৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পিতা মীর আবদুর রব ও মাতা রওশন আরা মীর।

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ছাত্রজীবনেই লেখালেখি শুরু। ১৯৫৪ সাল থেকে ঢাকা ও কলকাতার সাময়িকীগুলোতে তার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ’৬০-এর দশকজুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। 

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি। 

আল মাহমুদ তার এক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘একটা বয়সে উপনীত হয়ে সব কবিরই সাধ জাগে নিজের কবিতার একটি সংকলন হাতে নিয়ে দেখতে। আমারও এ লোভ ছিল। শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি। আবার একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। বয়স ও স্মৃতিশক্তির কারণে এখন আর তা সম্ভব নয়। জীবনসায়াহ্নে এসে বুঝতে পেরেছি আর দশটি অপূর্ণ ইচ্ছার মতো এ ইচ্ছাটিও অপূর্ণই রয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি।…’

১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩)। এই কাব্যগ্রন্থই সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। সবচেয়ে বেশি আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩)। কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’ (১৯৯৩)। হয়েছেন বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও কথাসাহিত্যিক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ- সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০-এর অধিক। অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সাহিত্য পুরস্কার। মৃত্যু ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।