
পর্ব-১৯
মেয়ে একটু ইতস্তত করল। মাথার ওড়না পড়ে গেলে আবার আদবের বরখেলাপ হয় কিনা। কিন্তু হবু শাশুড়ির হুকুম বলে কথা। অনায়াস হাতে খোপা উন্মোচন করল সে। কোমর ছাপিয়ে নামল এলোচুল।
রিয়াজুল্লার মা বললেন, বাহ্ ভালো তো, একটু সামনে আসো মা, তোমার সিঁথিটা দেখি। দেখে মনে হলো তিনি স্বস্তি পেলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।
-কপালকুণ্ডলা নামে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত এক উপন্যাস আছে। কপালকুণ্ডলা শব্দের অর্থ জানো?
-জি না।
-জানবে কোত্থেকে! আজকাল কি পরিবারে শাস্ত্র শিক্ষা হয়? যাই হোক, যে মেয়ের সিঁথির গিঁট পেছনে না হয়ে কপালের ওপর হয়, তাকে বলে কপালকুণ্ডলা, সে হয় স্বামীহন্তারক। শাস্ত্রে তাদেরই শংখিনী বলে, বুঝলা মা।
-জি।
-তবে তুমি তা নও। তোমার গিঁট সিঁথির পেছনে। এবার তোমার শেষ পরীক্ষা। পা একটু জলে ভিজিয়ে হেঁটে যাও; পায়ের ছাপটুকু দেখি একবার।
কথামতো শানবাঁধানো পুকুরঘাটে রাতুল পা দুটি ভেজায় মেয়েটি। তার পদস্পর্শে নিস্তরঙ্গ পুস্করিণীর জল মৃদু দোলায় তরঙ্গিয়া ওঠে। মেয়ের অধ্যাপক পিতার মন হব হব সন্ধ্যায় শানবাঁধানো পুকুরের জলের চূড়ায় চূড়ায় অস্তগামী সূর্যের বিম্বিত আলোয় আটকে থাকে। কিন্তু রিয়াজুল্লার মায়ের চোখ পুকুরের ঘাটে পড়া মেয়ের পায়ের ছাপে নিবদ্ধ।
-না, পায়ের পাতার ছাপ পুরোটাই পড়েছে। হস্তিনী মেয়েদের মতো পা কোকড়ানো নয়।
ডুবন্ত সূর্যের পশ্চাৎপটে স্বর্গের অপসরীর মতো ভেসে থাকা মেয়েটি হবু শাশুড়ির কথা বুঝে উঠতে পারে না। থমকে দাঁড়ায় সে। পৃথিবীর নীচতার বিপরীতে অপার্থিব সৌন্দর্যে বিভোল মেয়েটিকে শেষবারের মতো আলিঙ্গন করে সূর্য ‘ডুবিয়া যায়’। সূর্যশেষ গোধূলিতে আচ্ছন্ন হয় চরাচর।
১১
চারু বোধ করি এ কথার জন্যই অপেক্ষা করছিল। পল্লির দাওয়ায় বসে সে রাতের আকাশের দিকে একঠায় তাকিয়ে ছিল। এমন সময় ক্লিং শব্দ হলো।
-হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।
- আপনাকে অতি আনন্দিত মনে হচ্ছে আজ।
-হ্যাঁ আনন্দের ব্যাপার একটা ঘটেছে বটে।
-যদি বলা যায় আমাকে বলতে পারেন।
-বলব বলেই তো আপনাকে নক করলাম।
-বলুন তাহলে।
-এ ধরনের জিনিস অনুভব করা যায়। বলা বা লেখা যায় না।
-তাহলে কী করবেন বলুন।
-ব্যাপারটা হলো, জিনিসটাকে আপনারা যাই বলুন আমি তার মধ্যে পতিত হয়েছি।
-ভয়ানক ব্যাপার। আপনি কি কোনো নদী, সাগর, দিঘি, কূপ, কিংবা ভূতলে পতিত হয়েছেন।
-না ম্যাডাম, আমি প্রেমে পড়েছি।
-তাই বলুন, তো মেয়েটির নাম বা পরিচয় বলা যাবে।
-আমি তো বলিনি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছি।
-হায় আল্লাহ! তাহলে কী কোনো ছেলে...
-আরে না। আমি বলছি মানুষের জীবনে রাজনীতি, ব্যবসা, চাকরিই সব নয়, মানুষের জীবনে একজন সঙ্গীরও দরকার। সেই অনুভবে আজ আমি সমাহিত। আমি জানি না, যাকে দেখে, যার উপলক্ষে এ অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করেছে সেই কি আমার পরিণতি না অন্য কেউ। তবে আমি নিশ্চিত জানি কেউ আমার জীবনসঙ্গী হতে চলেছে।
-জানতাম আপনি মানুষের অধিকারের কথা বলেন, রাজনীতির কথা বলেন, কিন্তু আজ কোন জাদুবলে এমন কাব্যিক প্রেমিক হলেন জানি না।
-জানবেন, এখন ঠিকই জানবেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক একমাত্র একজন রাজনীতিবিদই হতে পারেন।
-আপনার কথা প্রবাদ বাক্যের মতো শোনাচ্ছে।
-আজকে কেউ মানুক আর না মানুক একদিন এ কথা প্রবাদে পরিণত হবে।
-পরের কথা পরের জন্য রাখি, এখন কি সেই মেয়ের সম্পর্কে একটু জানতে পারি?
-একটু কেন পুরোটাই জানুন। তখন ছিল আসি আসি সন্ধ্যা। এক নিভৃত নিলয়ের টলোমল সরোবরে রাতুল পা দুখানি ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার আকুল দেহে সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিটুকু ব্যাকুল হয়ে জড়িয়ে ছিল আর সে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তাকালাম আমিও। জানি এমন করে তাকিয়ে দিন-মাস-বর্ষ শতাব্দী পার করে দেওয়া যায়। কিন্তু আমি চাই সেই মায়াবী তনুটি বাস্তব অবাস্তবের দেয়াল ভেঙে শরীর বৃত্তীয় কাঠামোয় পরিপূর্ণ হবে একদিন। অঞ্চল ছাড়িয়ে এসে বসবে ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে। বলবে, বলো প্রিয়, বলো প্রিয়তম।...
-বাহ্, আপনি দেখছি সত্যি অন্তর থেকে প্রেমিক হয়ে উঠেছেন।
-একটু আগেই তো বললাম, শুধু প্রেমিক নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রেমিক। তবে সমস্যা আছে একটা।
-কী সমস্যা আবার?
-অমন প্রেম ধারণ করতে পারে সেই পাত্রীটি কে?
-কে আবার? আমি।
-হুম। হতে পারেন, আপনিই হতে পারেন। কারণ আপনার সঙ্গে কথা হয় শুধু, দেখা হয় না। তাই আপনাকে সাজাতে পারি হৃদয়ের সব দিয়ে; তার পর যেদিন দেখা হবে, তখন আপনি যাই হোন না কেন, দেখব সেই সাজানো দেবীকে, দেখব সেই মনের রানি অদৃশ্যের আড়াল ভেঙে পাশে এসে বসেছে। শিয়রে ছড়াইছে চুলের গন্ধ।
-মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।
-মনে হতে পারে। তবে মানুষ দৃঢ়ভাবে যা বিশ্বাস করে তাই দেখে। তাই তো দশজনের চোখে ঘোর কৃষ্ণা নারীও প্রেমিকের কাছে স্বর্গের অপ্সরীর মতো প্রতিভাত হয়। এটাই সত্যদর্শন; এটাই প্রেম।
এর পর কি কথা হয়েছিল চারু মনে করতে পারে না। শুধু মনে আছে, এতদিন সমাজের সব উঁচুতলার মানুষকে সে ‘পতিত’ বলত, আজ তার উপলব্ধি হলো, তাদের কেউ কেউ সত্যিকারের মানুষও হতে পারে বৈ কি!
দিন গেল দিন যাপনের দায় মেটাতে। দিনান্তে পল্লিপ্রান্তরের দিগন্তে রঙের খেলা ‘দেখাইয়া’ সূর্য অস্ত গেল। ঝিল্লিমন্দ্রিত হলো দিকে দিকে। তার পর সন্ধ্যা সোনার মতো হলো চারুপল্লিতে ভিড়তে লাগল যারা ভিড় করে তারা।
কিন্তু পরের দিন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে গেল। চারু দিনের ক্লান্তি নিয়ে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শুয়েছিল। তার চোখ ঘরের দেয়ালে আটকানো ফ্ল্যাট স্ক্রিনের টিভিতে, সেখানে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ছবিতে সন্ধ্যা-অন্ধ গৃহের কোণে নাটালি পোর্টম্যানের সঙ্গে মিলা কিউনিস সমকামী প্রেমে আচ্ছন্ন।
দুজন চুম্বনে, মেহনে যখন অন্য জগতে, তখন বহুল পরিচিত কোনো পুরুষের সুগন্ধ চারুকে বর্তমান জগতে এনে ফেলল।
-এও কি সম্ভব?
স্বগতোক্তি করে চারু। চারুর ইন্দ্রিয় ভুলেই গিয়েছিল এ সুগন্ধের আস্বাদন। দিন তো কম হলো না। সে তাহলে আবার এসেছে! এতদিন পর!
সহসা তার পদধ্বনি শুনতে পেল চারু। হালকা দূরাগত আলতো পায়ের শব্দ। ক্রমাগত সেই শব্দ দরজার সামনে এসে জোড়াল হলো। থেমে গেল। থেমে গেল ব্ল্যাক সোয়ানের গোঙানি; আর তখনই দরজার কড়া নড়ে উঠল।
চারু উঠল, গায়ের কাপড় গোছাল, তার পর উঁকি দিল দরজার ছিদ্র দিয়ে।
বলল, কে...
-আমি।
-আমি কে?
-আমার গলা বোঝো না?
-পরিচিত গলা মনে হচ্ছে। কিন্তু সময়ের ধূলা পড়ে স্মরণশক্তি কাবু হয়ে গেছে।
-বেশ কাব্যপ্রতিভা জন্ম নিয়েছে দেখছি। আমি সজীব।
-আর আমি চারু।
-জানি। ওয়ান অ্যান্ড অনলি চারু। চারু দরজা এতটুকু খুলল কি খুলল না, সজীব আলগোছে ঢুকে পড়ল ঘরে, যেন বা কোনো ফেরারি আসামি পুলিশের তাড়া খেয়ে নিজের কোনো গোপন আস্থানায় চকিতে ঢুকে পড়েছে।
চারু বলল, এতদিন পর কী মনে করে এলে?
-ভুলিনি আমার আসার কথা, সবকিছু গুছিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।
সজীবকে তাকিয়ায় বসিয়ে চারু ঔহীরে সজ্জিত বয়াম থেকে একে একে অনেক নাশতা পরিবেশন করল; কাচের সোরাহিতে ঢালল মদিরা। কিন্তু সজীব না বলাতে ঢালল লাল রঙের রুহ আফজা।
সজীব একটু থিতু হয়ে এলে চারু তার হরিণীর মতো চোখ দুটি নিবদ্ধ করল সজীবের বহুল কাঙ্খিত মুখের ওপর। চৈত্রের দুপুরে বয়ে যাওয়া লিলুয়া বাতাসের মতো এক ঝলক লালিমার অস্তিত্ব দেখল চারু। মনে হলো নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে সজীবের।
চারু এতদিনে পূর্ণরাগের এসব লক্ষণ রপ্ত করে ফেলেছিল। সে বলল-
-খেলবে?
-চলো বাইরে যাই।
চারু কিছুই বলল না।
পূর্বরাগে জজর্র সজীবকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল। তার সঙ্গে সজীবের সব কিছু তো ঘরের বাইরেই হয়েছে।
কিন্তু ঘরের বাইরে অন্য এক সজীবকে দেখল চারু। সে বলল, সমাজের ভন্ডরা যারা তোমার এক রাতের প্রেমিক সাজে এবার আর পার পাবে না। তাদের ধরার জাল গুটিয়ে আনতেই দেরিটুকু হলো। তার পর আমি আর তুমি এই ভন্ড পৃথিবীর নষ্ট মানুষদের ডিঙিয়ে হেঁটে যাব অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে।
চারু কিছুই বুঝতে পারল না। সজীব নোটের মতো একটি খাতা বের করে চারুকে দিল। বলল,
-সমস্ত পরিকল্পনা এখানে লিপিবদ্ধ করেছি। কষ্ট করে পড়ে নেবে। দুই সপ্তাহ চলবে তোমার আর আমার প্রস্তুতি। তার পর আগামী কোজাগগি পূর্ণিমার রাতে হবে খেলা। ঠিক এক বছর আগে এমন এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তুমি আমাকে এ পল্লি উদ্ধারের ডাক দিয়েছিলে। মনে পড়ে?
চারুর সব কিছু মনে পড়ে গেল। যক্ষের ধনের মতো নোটখাতাটি আঁকড়ে থাকল। সজীব বলল, এখানে যা আছে তাকে সে অনুযায়ী প্রস্তুত হতে হবে। দিকে দিকে খদ্যোতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সন্ধ্যারাত্রি।
১২
গতকালের রাতটি ছিল অদ্ভুত উন্মাদনায় ঠাসা। রিয়াজুল্লাকে এমন প্রেমকাতর, এমন কবোষ্ণ প্রেমিকের ধরনে কোনোদিন দেখেনি চারু।
সন্ধ্যায় একে একে পার্টির কর্মীরা যখন চলে যায়, অনেকক্ষণ কাজে বা অকাজে বসে থাকে রিয়াজুল্লা। চারুর প্রহর ফুরোয় না। কখনো রিয়াজুল্লা তার কক্ষে আসে, কখনো আসে না; এমন করেই চলছিল এতদিন।
কিন্তু, বহুদিনের মুখস্থ পথে গতকাল হাঁটেনি রিয়াজুল্লা। অফিস খালি হয়েছে কি হয়নি... চারুর কক্ষে ঢোকে সে। তখন কেবল সন্ধ্যা ঘনাইছে বনে বনে। তারই আঁধারটুকু জানালা দিয়ে গলে প্রেমময় করে তুলছিল চারুকে। একলা রুমে চারু জানালা পথে প্রান্তরের শিরীষ গাছের দিকে তাকিয়েছিল। সেদিকে দিন শেষের ক্লান্ত পাখিরা বৃক্ষতল মুখর করে তুলেছে। এমন সময় পেছন দিক থেকে চারুর চোখ টিপে ধরল রিয়াজুল্লা। বলল,
-বলো তো, আমি কে?
চারু জানে, রিয়াজুল্লা আগে কোনোদিন এরকম করেনি। আজ কী উদ্দেশে তার এমনতরো কর্ম ভেবে উঠতে পারছে না সে। তবে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম বলে কথা। চারু বলল,
-আপনি আবার কে? আমার বস।
-ঠিকই বলেছ।
-আপনার গায়ের গন্ধ আমার পরিচিত। ঠিক না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
-হ্যাঁ, আজ আমিও অন্য এক গন্ধ অনুভব করছি। এ বোধ হয় নতুন প্রেমের।
আর কথা বাড়ায়নি কেউ। দুজন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করল নিজেদের। দুজন যখন অফিস ত্যাগ করে ততক্ষণে শহ জুড়ে সূর্যশেষ গোধূলী ছড়িয়েছে। পথে যেতে যেতে চারু বলল, কী এমন হলো আজ। কিন্তু উত্তর খুঁজে পেল না।
কিন্তু সদা অনুসন্ধিৎসু চারুর মন তাকে ঘুমাতে দিল না রাত্রে। শেষ রাতে যখন শুধু নক্ষত্ররা জেগে আছে আকাশে, চারু খেয়াল করল তার মোবাইলে চ্যাটবক্সে রিং হচ্ছে-
-অনেক রাত জেগে আছেন, আপনি।
চারু- হ্যাঁ; অনেক রাত।
-আমিও জেগে আছি আজ।
-কেন আজ জেগে আছেন বলুন তো।
চলবে...