
আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর... আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম...
পাড়ার মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। যারা নামাজি ব্যক্তি এক্ষুনি তাদের ঘুম ভেঙে যাবে। ফজরের নামাজ পড়তে তাদের উঠতে হবে। আর যারা নামাজি ব্যক্তি নয়, নামাজ পড়ে না, তাদের ঘুম ভাঙার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যতক্ষণ খুশি তারা ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। তাদের ইচ্ছামতো তারা ঘুম থেকে উঠবে।
কিন্তু ফাইজুল বছরে দুটো ঈদেরর নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ পড়ে না। কেউ নামাজ পড়ার কথা বললে বলে, পড়ব। কিন্তু কোনোদিন পড়ে না। তবু তার আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল!
ফাইজুলের ঘুম এই সময় প্রতিদিনই ভাঙে। কারণ, ডুমুরতলার মাঠে তার আট কাঠার একখান ভুঁই আছে। ওই ভুঁইয়ে পটোল লাগানো আছে। অত ভোরে উঠে সে ভুঁইয়ে পটোলের ফুল ছোঁয়াতে যায়। মদ্দা ফুল তুলে মাদি ফুলে ছোঁয়ায়। ফুল ছোঁয়ালে পটোলের জালি নষ্ট হয় না। সব জালি রয়ে যায়। ফলে পটোলের ফলন বাড়ে। আর ফলন বাড়লে লাভ বাড়ে। সেই লাভের আশায় ফাইজুল প্রতিদিন...
ফাইজুলের ভুঁইয়ে পটোল ভালোই হয়। প্রতি সপ্তাহে সে ছয় থেকে সাত মণ পটোল তোলে। পটোলের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য সে কম খাটে না! প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা নিয়ম করে ভিটামিন পাউডার স্প্রে করে। এতে করে পটোল খুব তাড়াতাড়ি মোটা হয়। এ ছাড়া পটোলের গাছ ঠিক রাখার জন্য সময়মতো সেচ, বিভিন্ন রকম সার, অণু খাদ্য ও কীটনাশক প্রয়োগ করে। যাতে পোকার আক্রমণ থেকে সবকিছু সুরক্ষিত থাকে। পটোলের গাছ, পটোলের ফুল ও জালি। আর ঘাস হলে ঘাস মেরে দেয়। ভুঁইয়ে একখানা দাউলি সবসময় রাখা থাকে। দাউলিখানা সে বাড়ি আনে না। পটোল গাছের ঝোপে লুকিয়ে রাখে। নিজের শরীরের চাইতেও পটোলে ও পটোলের গাছের বেশি যত্ন করে। তাহলে পটোলের ফলন বৃদ্ধি পাবে না!
সপ্তাহে ফাইজুল দুই দিন পটোল তোলে। বুধবার আর রবিবার। ওই দুই দিন ভগীরথপুরে হাট বসে। ভগীরথপুরের হাটে পটোলের দাম খুব ভালো পাওয়া যায় বলে অন্য হাট সে ধরে না। যদিও আশপাশে অনেক হাট বসে।
হাটে পটোল দু’রকমভাবে বিক্রি হয়। পাইকারি ও খুচরা। পাইকারি বেচলে খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়। পলিথিন পেতে হাটে বসতে হয় না। যারা হাটে বসে সবজি বেচে তারাই কিনে নেয়। কিন্তু লাভ কম হয়। আর খুচরা বেচলে লাভ বেশি হয়। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে হাটে বসতে হয়। তা-ও সব বিক্রি হয় না। কিছু থেকে যায়। সেগুলো হাট ঘুরানো পটোল হয়ে যায়। পরে সেগুলো আর ভালো দামে বিক্রি হয় না। সস্তা দরে বেচে দিতে হয়। যে কারণে ফাইজুল হাটে পটোল পাইকারিই বেচে। কোনোদিন খুচরা বেচে না।
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ফাইজুল মাঠে গেল। মাঠে যাওয়ার সময় ভোরের আঁধার খানিকটা থাকলেও মাঠে যাওয়ার পর সব আঁধার একটু একটু করে কেটে গেল। ফাইজুল তখন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ভিটামিন পাউডারের প্যাকেট, স্প্রে মেশিন আর জলের জারটা ভুঁইয়ের ভেতর একটা জায়গায় রেখে পটোলের ফুল ছোঁয়াতে লাগল। প্রথমে মদ্দা গাছ থেকে কিছু মদ্দা ফুল তুলে মাদি ফুলে ছোঁয়াল। একে বলে মিলন ঘটানো। কাজটা সে সারি ধরে করল। তাতে একটাও ফুল বাদ পড়ল না। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে কাজটা হয়ে গেলে ফাইজুল ভিটামিন পাউডারের প্যাকেট থেকে পঞ্চাশ গ্রাম মতো পাউডার হাতের তালুতে ঢেলে জলের জারের ভেতর ভরে মুখে ছিপি এঁটে দিয়ে বারকয়েক ঝাঁকিয়ে জলের সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে স্প্রে করল। পরে বাড়ি এসে কলে মুখ-হাত ধুয়ে একথালা পান্তা ভাত খেয়ে থামে হেলান দিয়ে বসল। বসে একটা বিড়ি ধরাল। বিড়িটা শেষ হলে ফাইজুলের ঘরনি সুফিয়া বিবি বলল- ঘরের ত্যাল ফুরিয়্যা গেছে। লোকের বাড়ি ত্যাল ধার করে চলছে। তিন-চার শিশি ত্যাল ধার হয়ে গ্যালো। আর কত ধার করব? এখুন তুমি মিলে ঘানি লিয়্যা যাও! যাইয়্যা বসে থেক্যা ভাঙিয়্যা আনো! কাল রাইয়ে রোদ দিয়ে বস্তায় ভরে মুক বেঁধে থুয়েচি।
ফাইজুল আর বসল না। মাঠে কাজ করা পরনের পুরনো লুঙ্গিটা আর গায়ের জামাটা খুলে, তুলে রাখা নতুন লুঙ্গি-জামা পরে সাইকেলের পেছনে ঘানি বেঁধে নিয়ে ডোমকলে বসাক ঘানি মিলে ভাঙাতে চলল। আশপাশে অনেক ঘানি মিল থাকলেও ফাইজুল এখানেই ঘানি ভাঙায়। কারণ, তেল বেশি হয়। কম হয় না। অন্য মিলে তেল বেশি হবে কি হবে না, তা ভেবে ভাঙায় না। যদিও বসাক ঘানি মিল তার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। ওই দূরটা ফাইজুল কিছু মনে করে না।
যাই হোক। ফাইজুল মিলে এসে দেখল, মিলে বেশ ভিড় আছে। মিলের ভেতরে ঘানির লাইন। লাইনে ঘানি রেখে সবাই বাইরে রকে বসে অপেক্ষা করছে। কখন তাদের ঘানি ভাঙানো হবে! ফাইজুল তা দেখে ভড়কে গেল! তাহলে কি আজ তার ঘানি ভাঙানো হবে না! যে লোক ঘানি ভাঙাচ্ছে সে তখন তার কাছে গিয়ে চুপিচুপি বলল- কাকা, আমারডা একচিন আগে দ্যাওয়া যাতক না! দিলে খুব ভালো হতক। আমি আপনাধের মিলে বারাবর ঘানি ভাঙাতে আসি। আমার বাড়ি থেক্যা আপনাধের মিল দূর হয় তা-ও আসি। তাহিলে একচিন আগে না দিলে এতদূর আসব?
-বুঝছি। কিন্তু লাইনে ঘানি রেখে সবাই বাইরে বসে রয়েছে তো। জানতে পেরে গেলে ঝামেলা করবে।
-তা-ও একচিন আগে দ্যাওয়ার চেষ্টা করেন না!
-ঠিক আছে, দেখছি। আপনি ঘানি রেখে কিছুক্ষণ বাইরে বসুন! বারবার ভেতরে আসবেন না।
ফাইজুল ঘানি রেখে বাইরে বসল। কিন্তু সে রকে বসল না। রকে বসার জায়গা নেই। জায়গা না পেয়ে সে কাছের একটা চায়ের দোকানে বসল। বড় চায়ের দোকান। বসার অনেক জায়গা। পাঁচটা-ছ’টা বেঞ্চ। ফলে দোকানে আগে থেকেই কিছু লোক বসে রয়েছে। ফাইজুল তাদের সবাইকে চিনতে না পারলেও একজনকে চিনতে পারল। চোখে চশমা আর পরনে কাঁচা হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছেন যিনি। ফাইজুলদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের তিনি প্রধান শিক্ষক। নাম মদন মোহন ব্যানার্জি।
ফাইজুল চিনতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করল- ক্যামুন আছেন মাস্টার মশাই?
-ভালো আছি। কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।
-আমার বাড়ি... আপনি আমাদের গিরামের পিরাইমারি ইশকুলের পোধান শিক্ষক। আপনি আমার বাড়ির পাশ দিয়ে
পোতিদিন ইশকুলে যান।
-ও, আচ্ছা আচ্ছা। বলে তিনি ফাইজুলকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি ভালো আছেন?
-হ্যাঁ।
-এখানে কোনো দরকারে এসেছেন বুঝি!
-হ্যাঁ।
-কী দরকারে এসেছেন?
-ঘানি ভাঙাতে এস্যাচি। বাড়িতে ত্যাল নাই।
-এক্ষুনি এলেন বুঝি!
-হ্যাঁ।
-ঘানি তাহলে ভাঙানো হয়নি?
-না।
-একটা চা খান তাহলে?
-চা খাব না। বাড়ি থেক্যা ভাত খেয়্যা আসনু। আপনি কী করছেন?
-বসে আছি, গল্প করছি।
-আজ ইশকুল যাননি?
-আজ স্কুল ছুটি আছে।
সামনের রাস্তা দিয়ে তখন একটা পাগল হেঁটে যাচ্ছে। পাগলটার হাঁটা আর পাঁচ-দশটা মানুষের মতো সাধারণ হাঁটা নয়। কেমন ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা। হাঁটার মধ্যে একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে। পাগলটার দুই ঘাড়ে দুটো বস্তা ঝোলানো। পাগলটাকে চায়ের দোকানের সবাই দেখলেও কেউ ডাকল না। তিনি ডাকলেন-
-এই, শোন!
পাগলটা কাছে গেল- বলো!
-বস!
পাগলটা ঘাড়ের বস্তা রেখে কাছে বসল। বস্তার ভেতর কী ভরা আছে কে জানে? হয়তো কোনো ছেঁড়া চিলমিলি অথবা ছেঁড়া কোনো কাগজ ভরা আছে। পাগলের কাছে এসব ছাড়া কী থাকবে? বসার পর তিনি পাগলটাকে জলখাবার খাওয়ালেন। দুটো বিস্কুট, একটা চা। খাওয়ানোর পর একটা সিগারেট দিলেন। এরপর তিনি একটা পান খাওয়ার কথা বললে পাগলটা দুই দিকে মাথা নাড়ল।
-তাহলে একটা গান শোনা! অনেক দিন তোর কোনো গান শুনিনি। শুধু আমি নই, এখানে যারা আছে সবাই তোর গান শুনবে। শোনা!
পাগলটা গান শুরু করল-
বঁড়শি ফেলেছি গোঁসাই জলে
খাস বা না খাস ঠোক দিয়ে যা ঠোকায় নেব তুলে।
বঁড়শি ফেলেছি গোঁসাই জলে।।
কী অসাধারণ গানের গলা! গলায় যেন জাদু আছে। সবাই তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে আর একখানা গান শোনাতে বলল। কিন্তু পাগলটা একখানার বেশি গান গাইল না। বস্তা নিয়ে উঠে গেল।
পাগলটা উঠে যাওয়ার পর তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন-
পাগলটাকে আপনারা কেউ চেনেন? চেনেন না। পাগলটা হলো আমার বন্ধু; আমার ক্লাসমেট; বহরমপুর কেএন কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। ক্লাসের মধ্যে ও ছিল টপ স্টুডেন্ট। আর কী ফিগার! যেমন ফিগার তেমন গানের গলা। গোটা কলেজকে ও একাই মাতিয়ে রাখত। বাড়ি করিমপুর। নাম জ্যোতির্ময় দত্ত। কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলে। কিন্তু কীভাবে যে এরকম হলো! সবই হলো ভগবানের খেলা! যাই হোক, এ রকম পাগল দেখলে আপনারা কেউ অবজ্ঞা করবেন না। পিছু লাগবেন না। পারলে কাছে ডেকে কিছু খেতে দেবেন।
পাগলরা কিছু খেতে পেলে সন্তুষ্ট হয়। কারণ, তারা খেতে পায় না। খেতে না পেয়ে পেয়ে কঙ্কালসার শরীর নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ঠোঙা কুড়িয়ে চেটে খায়। পাগলরা অসহায়। অসহায় মানুষকে ভালোবাসলে ঈশ্বর তাকে ভালোবাসেন। পাগলরা ঈশ্বরের প্রিয় মানুষ।