
জীবনানন্দ দাশ নামের মানুষটি কেবল কবি নন, তিনি এক আশ্চর্য সম্মোহন। একটি গোধূলি। মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে হৃদয়ের অলৌকিক উপশম। কেননা, তিনি অনুভূতির এমন এক স্তরে পৌঁছে কবিতাচর্চা করে গেছেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সৃজনশীলতার সেই আরশিনগর স্পর্শ করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। মানুষের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের যে ছন্দ ও অভীপ্সা, স্বপ্ন-বাসনা, সেখানে ভীষণরকম উদাসীন ও অসফল ছিলেন; কিন্তু শিল্পচর্চায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত হিসেবী, সতর্ক ও লক্ষ্যভেদী।
আমাদের মানসরাজ্য এবং অনুভবের সব তন্ত্রী খুলে খুলে যায়, তার কবিতা পাঠ করলে। কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি এক দুর্মর-জীবনতৃষ্ণা জাগিয়ে দেওয়া মায়াময় অনুভূতির প্রবাহ তৈরি করেন। এদিক থেকে তিনি এক নিঃসঙ্গ শিল্পনাবিক; যিনি কবিতার ভেতর দিয়ে এক অপরূপ ও প্রাতিস্বিক সৃজনভুবন তৈরি করে গেছেন, যার আকর্ষণ বারবার পাঠেও ফুরোয় না।
সে কারণে কবিতাভুবনের নতুন অভিযাত্রীরা তার কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অজান্তেই সেঁটে যান, প্রভাবযন্ত্রণায় নিজের পথ ভুলে যান। নতুন কবিরা তার কবিতায় মগ্ন হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যান, কবিতার ভেতর দিয়ে যেন জীবনানন্দর ভাবনা ও শিল্পকুশলতা অনুবাদ করে চলেন। গল্প-উপন্যাসেও তিনি একইভাবে নতুন পথের সন্ধান করেছেন। কিন্তু দুঃখ এই, প্রকাশের পর পাঠকের কী অভিমত, তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।
আমাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ আর জীবন-সংসার নিয়ে যা কিছু স্বপ্ন, ভাবনা ও অভিপ্রায় তার মনোরম প্রকাশ ঘটেছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক বা পরে, অনেকেই কবিতাচর্চা করে গেছেন, কিন্তু জীবনানন্দর কবিতায় মনের মাধুরী মেশানো ভঙ্গি ও শিল্পকুশলতা যেভাবে প্রতিভাত হয়েছে, এর তুল্যমূল্য কম। তার কবিতাপাঠ নতুন অনুভবের জন্ম দেয়, ঘোর তৈরি করে; সেই ঘোর থেকে সহজেই বেরোনো যায় না।
হেমন্ত ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম ঋতু। হেমন্তের এক রাতেই তিনি জীবনের ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। ২২ অক্টোবর সেই বিরহছোঁয়ানো দিন, যেদিন তিনি তার সব শিল্পপ্রচেষ্টার কিছু শেষ করে, কিছু অসমাপ্ত এবং বেশির ভাগই অপ্রকাশিত রেখে নির্ভার চোখ বুজেছেন। কিন্তু তার প্রয়ানের এত বছর পর, যে মানুষটি বেঁচে থাকতে উল্লেখ করার মতো একটা জীবন পাননি; সবখানেই খামতি ও বেদনার গল্পজুড়ে ছিল দগদগে ঘায়ের মতো; ভালো কোনো চাকরি পাননি, বউ ভালোবাসেনি, নিজের বাড়িতেও থাকতেন বহিরাগতের মতো, কিছুটা নাম হওয়ার পরেও তার লেখা ফেরত আসত; সেই মানুষটি প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করতেন, সামাজিক প্রভাব আর সাহিত্যিক দাপট আলগা হয়ে এলে কে শ্রেষ্ঠ তা সময়ই বলবে। একদিন তার লেখার যথার্থ সমাদর হবে, বাজারে খুব বিকোবে তার লেখাপত্র; সেদিন হয়তো তিনি থাকবেন না।
সেই সময়ের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাসচিব হুমায়ুন কবিরকে একটি চিঠি লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সেই চিঠিতে এর আভাস পাওয়া যায়:
‘...আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না, আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু-যা শেষ বিচারে কোনো একটা জিনিসের-মতন-জিনিস; কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’
কবির সাহেবেকে লেখা তার চিঠির মর্মকথা কী নিদারুণ সত্য হয়ে ফলেছে, তার শত্রুও আজ তা জেনে গেছে।
জীবদ্দশায় তিনি অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য ও অসংলগ্ন বলে চিহ্নিত ছিলেন, আর প্রায়-অস্বীকৃত বা কেবল ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ছিলেন উন্মোচিত; মৃত্যু-পরবর্তীতে তিনিই পাঠক-সমালোচকদের কাছে হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে প্রিয়। কবিতায় তিনি একটানা মায়াবী-আচ্ছন্ন করা সুর গেঁথে দিয়েছেন, গল্প-উপন্যাসেও জীবনের বহু স্তর-অনুভূতি-বিবেচনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বর্তমান জীবনের কথাই লিখছেন তিনি; আমাদের সমসাময়িক জীবন ও শিল্পভাবনার রূপকার জীবনানন্দ দাশ। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সৃজনপ্রবাহ থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তার এক একটা জন্ম ও মৃত্যুদিন আসে, আর তিনি যেন নতুন করে জেগে ওঠেন, স্বমহিমায়।
মৃত্যুর পর, অনেক কবি ও শিল্পী হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস, গল্পকার জগদীশ গুপ্ত প্রমুখ বেঁচে থাকতেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। অনেকে মৃত্যুর পরে নতুন করে জেগেও ওঠেন। জীবনানন্দ মৃত্যুর পরই নতুন জীবন পেয়েছেন তার সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে। তার সৃষ্টিজগৎ ঘিরে নিয়ত কৌতূহল ও চর্চা বাড়ছে, বিরতিহীন, একই সঙ্গে ব্যক্তি জীবনানন্দকে নিয়ে তো বটেই।
আমি একটু গল্প ও উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি। জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সময় নিয়ে দীর্ঘ উপন্যাস লেখার এক ভ্রমণে পথ থেকে পথে হেঁটে গেছি বহুদিন। উপন্যাস লেখার কাজ শেষ হয়ে গেছে সেই কবেই। একসময় জীবনানন্দ-চর্চার একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা প্রকাশে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, স্বপ্রণোদনায়। এমন একটি পত্রিকা, যেখানে জীবনানন্দ-সম্পর্কিত কবিতা-গল্প-ভাবনা-স্কেচ-তথ্য-সংবাদ-আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হতে পারে। সুধীজন আদৃত সেই পত্রিকা এখন আর বেরোয় না। জীবনানন্দ-সাম্রাজ্যে এখন আর নেই আমি, থাকি না। কিন্তু টের পাই, জীবনানন্দ দাশের ভুবনে একবার অবগাহন করলে সারা জীবনেও তার মায়া ও সম্মোহন থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়।
ফাল্গুন মাসে জন্মেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রকৃতিতে ফাল্গুনের আগমনী গান বেজে উঠেছে। এই সুযোগে বাংলা ভাষার অসামান্য এই কবিকে হৃদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। শুভ জন্মদিন, প্রিয় কবি ও চিন্তক জীবনানন্দ দাশ।